• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৫ | জানুয়ারি ২০২২ | গল্প
    Share
  • শব্দ : উস্রি দে



    ক ঠক ঠক। ওই শুরু হল। সারাদিন সংসারে হাড় ভাঙা খাটুনির পর রাতে যে একটু শান্তিতে ঘুমোবে মানুষ, তার জো নেই! রাত বারোটার পর, চোখটা সবে লেগেছে, মাথার ওপরের ওই শব্দে তন্দ্রাটা চটকে যেতেই মেজাজ গরম হয়ে গেলো অসীমার। আশ্চর্য! মানুষের কি একটুও কান্ডজ্ঞান থাকতে নেই! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবুও মরণ নেই! নাঃ, এভাবে অপরের মৃত্যু কামনার জন্য বেচারি অসীমাকে খুব একটা দোষ বোধহয় দেওয়া যায় না। এই পুরোন বাড়ির শরীকী বিভাজনে দোতলার দুটো ঘর, রান্নাঘর আর এক ফালি বারান্দা যে পেয়েছে থাকার জন্যে, এই কত না! বড় ভাসুর পুরো নিচটা নিয়ে আছেন। ছোট ভাই তরুণ, অসীমার বর, দোতলাটা পেল একটাই শর্তে, মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে পুরোপুরি।

    তা সে অনেকদিন আগের কথা। বুল্টু তখন সবে হয়েছে। দুটো ঘরে দিব্যি মানিয়ে গুছিয়ে চলে যাচ্ছিল। উপরন্তু, একটু বড় হতেই বুল্টু ঠাম্মার সাথে পাশের ঘরে ঘুমোত গল্প শুনতে শুনতে। এতে অসীমা ও তরুণের দাম্পত্যও একটু আড়াল পেয়েছিল। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে পালটায় চালচিত্র। বয়স বাড়ে, সবারই। বয়োজ্যেষ্ঠা ক্রমে বৃদ্ধা হলেন। ইতিমধ্যে অসীমার সংসারে আর একজনের আবির্ভাব। তা টুম্পার ও তো দেখতে দেখতে ক্লাস নাইন হল। স্বল্প পরিসরে স্থান অকুলান। ফলস্বরূপ, খুঁটিনাটি নিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক বচসা। বৃদ্ধা কে নিয়েই সমস্যার সূত্রপাত। কেননা, পরিবারে তিনিই যে এখন অতিরিক্ত!

    অবশেষে, মাথা খাটিয়ে একটা পথ বের করা গেল। তরুণের যদিও বেশ কিছুটা ধার দেনা হল অফিসে, তবু মোটামুটি একটা সমাধানে তো পৌঁছন গেল। দোতলার ছাদের চিলেকোঠাটিকে কিছুটা সংস্কার করিয়ে, সাথে লাগোয়া একটা বাথরুমের ব্যবস্থা করে ফেলল তরুণ। মায়ের দুটো পা ই প্রায় অচল, বাতে। তাই বাথরুমে কমোড ও বসিয়ে দিল। মায়ের এই স্থানান্তরণে ওদের কিছুটা স্থান সংকুলান হল ঠিকই, কিন্তু অসীমার পরিশ্রম এতে বাড়ল বই কমল না। দোতলার ছাদে উঠে দুবেলা খাবার দিয়ে আসা, ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া – কাজ কি একটা! অসীমারও তো বয়স হচ্ছে! বেশ কিছুদিন যাবৎ অফিস ফেরত প্রায় প্রতিদিন অসীমার মুখে তার কষ্টের রোজনামচা শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছিল তরুণ। দাদার কাছ থেকে তো কোনরকম সাহায্য পাওয়ার আশাই নেই। অফিসের হালদার দার কাছে ওর সমস্যার কথা একদিন খুলে বলতে, হালদারদাই খোঁজ দিলেন একজনের। বয়স্ক মহিলা, ছেলেরা দেখে না, ওনাদের পাড়াতেই মুদির দোকানের চাতালে রাত কাটায়। শুনেই তরুণ উৎসাহিত বোধ করল। অফিস ছুটির পর হালদার দার সাথে ওদের পাড়ায় গিয়ে একেবারে হারুর মা কে বাড়িতে নিয়ে এল। ভদ্রমহিলা খুবই সাদাসিধে গোছের। কাজকর্মেও বেশ ভালো। এই বাজারে সীমিত আয়ে খাওয়াপরার লোক রাখার বিলাসিতা হয়তো তরুণকে মানায় না, তবু একে রাখতে একরকম বাধ্যই ছিল তরুণ। কেননা মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বটা হারুর মায়ের ওপরই ছেড়ে দেওয়া গিয়েছিল পুরোপুরি। হারুর মা কে পেয়ে মাও খুব খুশি। এই বয়সে যা হয়, একজন কথা বলার লোকেরও তো প্রয়োজন। অসীমাও অতিরিক্ত চাপ থেকে অনেকটা হাল্কা হতে পারল।

    পঁচাশি পেরিয়ে গেছে বুড়ির। রাতের খাওয়া বলতে একটু দুধ রুটি। সাড়ে ন’টার মধ্যেই সেরে ফেলে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো, টিভি দেখা, এসব শেষ হলে, রাতের খাওয়াদাওয়া চুকিয়ে রান্নাঘরের কাজ সেরে বিছানায় গা এলাতে এলাতে অসীমার রোজই প্রায় বারোটার কাছাকাছি। ততক্ষণে বুড়ির একঘুম হয়ে যায়। বুড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে যায় লাঠি ঠকঠক করতে করতে। হারুর মা পাশ থেকে ধরে থাকে। কষ্ট হলেও কিছুতেই রাতে বিছানায় শুয়ে বেডপ্যান নেবে না বুড়ি। ভীষণ জেদি! এদিকে অসীমার ঘরের ঠিক ওপরেই বুড়ির ঘর। ফলে অত রাতে ওই ঠকঠক আওয়াজটা তীব্র হয়ে কানে বাজে। প্রতি রাতে চোখ লাগতে না লাগতেই শুরু হয় শব্দটা – অসহ্য বোধ হয় অসীমার! প্রথমদিকে কয়েকবার শাশুড়িকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ওই সময় ওইভাবে লাঠির আওয়াজ হলে নিচের ঘরে সেটা খুব জোরে কানে গিয়ে লাগে। তাই রাতের ওই সময়টুকুর জন্য শুধু যদি বেডপ্যানটা ব্যবহার করেন, হারুর মা তো আছেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! উনি ওনার মতই চলবেন! আর ঠিক এই কারণেই মঝে মাঝে অসীমা অভিসম্পাত করে শাশুড়িকে মনে মনে, মৃত্যুকামনা করে ওনার – হ্যাঁ হ্যাঁ, মরলেই হাড় জুড়োয়। বিছানায় ওর পাশে শুয়ে তরুণ কিন্তু দিব্যি ঘুমিয়ে কাদা। ওকে কিছু বলতে গেলেই অসীমাকে শুনতে হয় – ‘কি করা যাবে! কানে তুলো দিয়ে ঘুমোও’, বলতে বলতে পাশ ফেরে।

    সেদিন সন্ধ্যেয় ছেলেমেয়েদের জন্য ডিম পরোটা বানাচ্ছিল অসীমা। হারুর মা সাহায্য করছিল রান্নাঘরে। সেই সময় ছাদে ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজে দুজনেই সচকিত হয়ে উঠল। হারুর মা তাড়াতাড়ি ওপরে ছুটল দেখতে কী হয়েছে। সর্বনাশ! বুড়ি পড়ে আছে ছাদে, গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে মাথা ফেটে, পাশে একটা ছোট বাক্স – লোহার! কী চাইছিল বুড়ি, বাক্সতেই বা কী আছে, এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে সবাই মিলে ধরাধরি করে খাটে শুইয়ে দেওয়া হল বুড়িকে। জ্ঞান ছিল না বুড়ির। অ্যামবিউলেন্স ডেকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বুড়িকে। কিন্তু জ্ঞান আর ফেরেনি। আই. সি. ইউ তে দুদিন রাখার পরে ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছিলেন আর কিছুই করার নেই।

    শেষ কবে শাশুড়ির সঙ্গে হেসে দুটো কথা বলেছিল অসীমা, মনে পড়ে না। বুড়ি কিন্তু ডাকত অসীমাকে, নাতি নাতনিদের কাছে পেতে চাইত। সময়ের বড় অভাব যে, তাই সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ওঠা হয় নি। মায়ের দেহটা চুল্লিতে ঢোকানোর পর বাইরে চাতালে বসে তরুণ ভাবছিল সে নিজে কবে মায়ের কাছে গিয়ে দু’দন্ড বসেছে ইদানিংকালে। ‘আচ্ছা, বয়স তো হচ্ছে আমারও, বৃদ্ধাবস্থায় আমারও কি …’। নাঃ, আর ভাবতে পারে না। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে ভেতরটা নাড়িয়ে দিয়ে গেল তরুণের। দু’ ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল শুকনো গাল বেয়ে।

    কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর বাড়িটা আজ একদম খালি হয়ে গেছে। এই ক’দিন যা ঝড় গেছে! বড় জা তো নড়তেই পারে না। ভাসুরও তথৈবচ। তাই সবকিছু সামলাতে হয়েছে তরুণ আর অসীমাকেই। ননদরাও একে একে বিদায় নিয়েছে। এই ক’দিন এত ব্যস্ততার মধ্যে আর অন্যকিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। আজ একটু হাল্কা হওয়াতে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া চুকিয়ে শুয়ে পড়তে চাইছিল অসীমা। হারুর মা দোতলার বারান্দার এক কোণে ঠাঁই নিয়েছে। ওপরে থাকার সাহস তার আর নেই। এবার একদিন ওপরের ঘর দোর সব পরিস্কার করিয়ে (অবশ্য কাজের সময় অনেকটাই করা হয়েছে), বুল্টুর যাবতীয় জিনিষপত্র ওখানে সরিয়ে দিতে হবে। বুল্টু তো বলেই রেখেছে, ওই ঘরটায় সেইই থাকবে। ভালই হল। স্থানাভাবের সমস্যা কিছুটা মিটল। টুম্পাটাও একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকতে পারবে। ঘরের আলো নিভিয়ে অনেকদিন পর শান্তিতে পাশ ফিরল অসীমা। চোখটা লেগেও এসেছিল, আচমকা ঘুমটা ভেঙে গেল। একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে অসীমার, এপাশ ওপাশ করছে, ঘুম আসছে না কিছুতেই। কিছুক্ষণ বাদে উঠে বসে পাশের টেবিল থেকে জলের বোতলটা নিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খেলো, তারপর আবার মাথা রাখল বালিশে। উহু, ঘুম আসছে না। কী যেন নেই! কীসের যেন অভাব! ঘুমন্ত তরুণকে ঠেলা দিল অসীমা। ‘কী হল?’ ঘুম জড়ানো বিরক্ত গলায় তরুণ।

    ‘ঘুম আসছে না!’

    ‘কেন, এখন আবার কি?’

    ‘কী নিঃস্তব্ধ চারদিক! কোন শব্দ নেই যে!’



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)