• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১ | জুন ১৯৯৭ | উপন্যাস
    Share
  • লোকে বলে অলৌকিক : ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত




    || ||

    সাহাবাবুর ক্লাসে একদিন

    শিবুরা বহুদিন পর্যন্ত জানতে পারেনি সাহাবাবুর স্বরূপটা কি! অন্য শিক্ষকদের মতই ঠিক সময়ে স্কুলে আসতেন এবং অ্যাসেম্বলীতে দাড়িয়ে জর্দা চিবোতেন চুপচাপ। তাঁর স্বভাব খুব কড়া ছিলো না বলে ছেলেমেয়েরা পছন্দই করতো। চেহারা খুব ভালো ছিলো; অরণ্যদেবের গায়ে একটু মেদ জমেছে মনে হতে পারে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, মাথার চুল কুচকুচে কালো। সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরেও আসতেন মাঝে মাঝে। ক্লাসে ঢুকে অন্যমনস্ক থাকার পর বলছিলেন একদিন--

    --অলৌকিক কাকে বলে জানো?

    সেদিন সবাই চুপ। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা সর্বাণী--যে সব প্রশ্নের উত্তরে হাতটা তুলে দেয়

    -- সেও অভ্যাসবশত ডান হাতটা তুলতে গিয়েই হঠাৎ সতর্ক হয়ে নামিয়ে নিয়েছিল। এদিক ওদিক চাইছিল। এমন সময়ে লাস্ট বেঞ্চের পদা এরকম সুযোগ যেতে দেবে না বলেই রকেটের মত একটা হাত তুলে দিয়েছিল।

    তুমি জানো পদাঙ্ক? অলৌকিক কাকে বলে জানো তুমি? বলবে? সাগ্রহে বলছিলেন সাহাবাবু।

    পদা খানিকটা সময়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর দাঁত চুলকে, ঘাড় চুলকে, ঠোঁট চেটে বলেছিল – আত্মা স্যার। যেন ভেবে ভেবে উত্তর দিতে হচ্ছে বা কোন কারণে সে দোনামনায় এইরকম ভাব করে সে বলেছিল – আত্মাই হল অলৌকিক।

    শুনে ক্লাসে মৃদু হাসির গুঞ্জন। কিন্তু সাহাবাবু আরো অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে সিরিয়াসলি বলেছিলেন-- কোন আত্মা? জীবাত্মা না পরমাত্মা? ঠিক কার কথা বলছ তুমি খুলে বলবে একটু?

    তখন পদাও সাহস পেয়ে বলেছিল-- সব আত্মা স্যার। শনিবার রাতে এই বিল্ডিং-এ জিভ বের করে যারা ঘোরে তাদের কথাই ধরুন না। তারা কি নিজেরাই জানে তারা কি ধরনের আত্মা? ক্লাস এইটের কালুকে রাতে জবরদস্তি বায়োলজি ল্যাবে বন্ধ করে তার বডিতে ঢোকার চেষ্টা করেনি? অবশ্য কালুর নিজের আত্মাটাই এতবড়, আর জায়গা হল না।

    কালুর ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা সবাই জানত। পরদিন সকালে তাকে ল্যাবের টুলের নীচ থেকে জমাদার ঝাঁট দিয়ে বের করে। পরে প্রিন্সিপালের ঘরে বসে জবানবন্দীতে কালু রতন জানা আর সুখরাম চাপরাশিকেই অভিযুক্ত করেছিল। রতন জানা’কে শিবুরা কেউ দেখে নি। কিন্তু তার গল্পও সবাই জানত। বছর বারো আগে স্কুল থেকে যেবার পুরী বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো রতন জানা তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। পুরীর সমুদ্রেই ডুবে মারা যায়। সেই থেকেই স্কুলের ছাত্র আর শিক্ষকদের উপর সে রাগ করে এইখানেই থেকে গেছে শোনা যায়। জনশ্রুতি এও যে তার নামে ফুটবল ট্রফি চালু করা হলে সে শান্ত হবার বদলে উলটে আরও রেগে গিয়ে প্রিন্সিপালের ঘরের সাজানো শীল্ড আর কাপগুলো সব আছড়ে ভেঙে দিয়েছিলো। ভাইস প্রিন্সিপাল তারাদাস বাবুকে নাকি লিখে জানিয়েছিল তাঁর মেয়ের বিয়েতে খেতে আসবে। কি খেতে আসবে সেটা রহস্য করে লেখেনি। ‘খেতে’ শব্দটা তারাদাস বাবুর স্টাইল নকল করেই দুবার আণ্ডারলাইন করা ছিল শুধু। রতন জানার মতি গতি বোঝা অসম্ভব এরপর থেকে তাকে আর ঘাঁটানো হয় না।

    অভিযুক্ত সুখরাম এই স্কুলে দীর্ঘকাল চাপরাশির কাজে বহাল ছিল। বেশিদিন আগের কথা নয়, কোনো কারণে সে ওই বায়োলজি ল্যাবেই এক বোতল ক্লোরোফর্ম খুলে পাশে বিছানা করে শুয়েছিল। সকালবেলা দরজা খুলে প্রথমে তার এবং অব্যবহিত পরে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকা আধডজন ডাইসেকশনের ইঁদুরের লাশ আবিষ্কার করা হয়। শিবুরা সেই প্রথম ইস্কুলে পুলিশি তদন্ত হতে দেখেছিল।

    পদা এইসব কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াতে ক্লাসের সকলেই বিলক্ষণ আনমনা হয়ে যায়। সেদিন আকাশ বেশ মেঘলা হয়ে ছিল। ক্লাসেও কেমন অন্ধকার। সাহাবাবু নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ছিলেন না। বোর্ডে একটা অংক বোঝাতে গিয়ে পারলেন না। সর্বাণী আর প্রজ্ঞা

    অন্যদিনের চেয়ে অনেক চুপ। একটা কিছুর উপস্থিতি অনুভব করছিল শিবুরা। গদাধর, মানে গদাই, একসময় শিবুকে বললো-- আচ্ছা ভাব, আমাদের সবার আত্মাগুলো যদি একসঙ্গে বডি ছেড়ে বেরিয়ে আসে ?

    ফিসফিস করে বললেও সবাই তা শুনতে পেয়ে শিউরে ওঠে। মনে হয় তিরিশটা ছেলেমেয়ে তো নয় আসলে তিরিশটা শরীর--আর ততগুলোই অনিবার্য আত্মা। তার মোট ষাট এই কথা ভাবতেই ঝপ করে আরও গাঢ় অন্ধকার। সাহাবাবু বোর্ডের সামনে দাড়িয়ে কি লিখলেন দেখা গেল না। বাইরে গড়গড় করে বারবার বাজ ভেঙ্গে পড়ার শব্দ। আর প্রজ্ঞা পিছন ফিরে শিবুদের নীচু গলায় বলল – কিন্তু প্রমাণ ছাড়া...।

    সে দিনটার কথা বিশেষ ভাবে মনে আছে শিবুর। তাদের, মানে ক্লাস সিক্সের, ঘরটা ছিল সিঁড়ির পাশেই। অন্য ক্লাসরুমের চেয়ে একটু বড়। দরজাটা ছিল কোনে, প্রজ্ঞাদের মুখোমুখি। সেই দরজায় টক্ তো করে টোকা। সকলে দেখে নতুন চাপরাশি শান্তি একটা স্লিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো মুখ করে। সাহাবাবু গিয়ে স্লিপটা নিলেন। পড়তে পড়তেই বললেন--তোমরা বস আমি আসছি।

    সাহাবাবু ধুতির খুঁট ধরে বেরিয়ে গেলেই ক্লাসে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। সর্বাণী পিছন দিকে ফিরে হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল – আত্মা না ছাই! অলৌকিক মানে যা লৌকিক নয় – অপার্থিব কিছু।

    গদাই প্রজ্ঞাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল – আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি আমার শরীরের ভিতর একটা অপার্থিব কিছু বাসা করে আছে। তুই সেরকম ফীল করছিস না?

    এই বাঙময় বিরতির মধ্যে শিবু লক্ষ্য করে যে সাদা চক দিয়ে বোর্ডে অস্পষ্ট ভাবে সাহাবাবু কিছু লিখে আর মুছবার সময় পান নি। ডেস্ক থেকে উঠে সে বোর্ডের কাছে গিয়ে দেখতে পায় সাহাবাবুর হাতের সুঠাম রেখায় লেখা অপার্থিব সমীকরণদ্বয়।





    সুখরাম + ক্লোরোফর্ম = আত্মা

    অলৌকিক – ক্লোরোফর্ম = সুখরাম

    শিবুকে বোর্ডের সামনে হাঁ করে দাঁড়াতে দেখে সেদিন আস্তে আস্তে একজন দুজন করে তার পাশে দাঁড়াতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা যায় যে পুরো ক্লাস সেদিনের অংক থেকে সাহাবাবুর স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করছে। সেই প্রথম সাহাবাবুকে নিয়ে যৌথ চিন্তাভাবনার শুরু।

    -- মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে একেবারে। বলেছিল সর্বাণী।

    পদা সর্বাণী মারবে বলে গাঁট্টা তুলেও কি ভেবে থেমে গিয়েছিল। হঠাৎ একটুকরো চক কুড়িয়ে নিয়ে সে দুটো ইকোয়েশন যোগ করে লিখেছিল –

    সুখরাম + অলৌকিক = আত্মা + সুখরাম

    আত্মা = অলৌকিক

    অর্থাৎ পদার প্রতিপাদ্যই এরকমভাবে সাহাবাবুর অংকের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে। পদা যে অংক পারে সেটা দেখে অনেকে থ। কিন্তু পদার কোনও উল্লাস বোধ হয় নি। সেও কেমন একটু নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল সাহাবাবুর এইসব কাণ্ড দেখে। একমাত্র গদাই তখনো বাচাল। সে প্রজ্ঞাকে বোঝাচ্ছিল – টের পাস না, শরীরের ভেতরে ঘোরাফেরা করছে? কখনো বুকে এসে লাবডুব, কখনো পেটে গিয়ে কুঁইকুঁই, কখনো মনে হচ্ছে ঢেঁকুর হয়ে বেরিয়েই চলে আসবে?

    প্রজ্ঞা বলল – সাহাবাবু কি সত্যিকারের অংক ছেড়ে এখন এইসব পড়াবেন?

    তখন একমাত্র শিবুই বুঝতে পারে যে সুখরামের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সাহাবাবু এখনো ভাবেন । যেমন ভাবেন ইউক্লিডের সুত্র নিয়ে। কোনো কোনো জিনিস পুরোনো হয়েও পুরোনো না, ভাবলেই নতুন কিছু বেরিয়ে আসে। এসবও তো সাহাবাবুরই চলিত উক্তি।

    সাহাবাবু সেদিন আর ক্লাস নিতে আসেননি। ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। পিছনের জানলা দিয়ে ছাঁট আসায় ক্লাসের ভিতরে ভিজে ধূলো আর বৃষ্টির গন্ধ। গদাই খুব ফিসফিস করে শিবু আর সিংগিকে বলেছিল – রতন জানার আত্মা পুরী থেকে দিল্লী অবধি এল কি করে?

    আজ থেকে বারো বছর আগে সাহাবাবু নতুন শিক্ষক। পুরীতে বেড়াতে যাওয়া দলটিতে তিনি ছিলেন। ছিলেন ভাইস প্রিন্সিপাল তারাদাসবাবু। গদাই বলেছিল--মিডিয়াম কাকে বলে জানিস? বাবা কিছুদিন আগে বললো সাহাবাবু নাকি ভালো মিডিয়াম হতে পারেন।

    প্রজ্ঞা আর সর্বাণী ওমনি বোঁ করে ঘুরে ওদের দিকেই মুখ করে বসেছে। গদাইও আমতা আমতা করে চুপ করে গিয়ে আর কোনো খবর দেয় না। বেলা গড়িয়ে অন্ধকার থেকে অন্ধকার।

    এরকমই হয়। মিথ্যে আশার মিথ্যুক এক একটা দিন।






    বিপন্ন বিজ্ঞান


    প্রজ্ঞারা থাকে শিবুদের পাড়াতে। শিমলিপুরে। দিল্লীতে প্রবাসী বাঙালিদের পুরনো পাড়া । গদাধরও সেখানেই।

    প্রজ্ঞার বাবা ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। পাড়ার একমাত্র বাংলা বইয়ের লাইব্রেরিটা তাঁর । সন্ধ্যে ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সবার জন্যে খুলে দেওয়া হয়। একজন লোক বসে থাকে বইগুলো দিয়ে গ্রাহকের নাম খাতায় টুকে রাখার জন্যে। প্রতি মাসে দুটাকা চাঁদা দিয়ে মেম্বারও হতে হয়। বৃহস্পতিবার লাইব্রেরী বন্ধ থাকে। সেদিন সন্ধ্যে ছটা থেকে লাইব্রেরী ঘরেই প্রফেসর বাগচীর প্রতিষ্ঠিত ‘বিপন্ন বিজ্ঞান’ নামক ক্লাবের সান্ধ্য বৈঠক আয়োজিত হয়।

    গদাধরের বাবা শম্ভুবাবু সম্প্রতি এই ক্লাবের সন্ধান পেয়ে সোৎসাহে যোগ দিয়েছেন । এছাড়া আছেন রিটায়ার্ড ফরেনসিক সায়েন্টিস্ট ডাঃ বিক্রম সেন, সিভিল সার্জেন ডাঃ মাধব নন্দী, কেরানী সিঁধু বাঁড়ুজ্জে, উকিল অপুর্বকৃষ্ণ দাস, প্রফেসর বাগচীর সহকর্মী প্রফেসর রায় ও প্রফেসর গাঙ্গুলী ইত্যাদি।

    প্রতি সপ্তাহে ‘বিপন্ন বিজ্ঞান’ ক্লাবের কোন সদস্য, বা কোন অতিথি সদস্য একাটি এমন অভিনব, আশ্চর্যজনক বা হেঁয়ালিপূর্ণ ঘটনার বর্ণনা করেন যার আপাতদৃষ্টিতে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এরপর বাকী সময়টুকুতে সমস্ত সদস্যরা মিলে ঘটনাটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তৈরি করেন – অথবা স্বীকার করেন যে সেরকম কোনো ব্যাখ্যা সত্যিই নেই। মতের অমিল হলে ভোট নেওয়া হয়। সান্ধ্য অধিবেশনের প্রথম অংশে শুধু চা আর চানাচুর সেবন কারার নিয়ম – যা বুদ্ধি খুলতে সাহায্যকারী। রহস্যের জট খুলে যাওয়ার পরে কাটলেট, ঘুগনি, মিষ্টান্ন ইত্যাদিও পরিবেশন হয়।

    স্ত্রীলোকদের জন্য ক্লাবটির দ্বার প্রথম থেকেই খোলা। কিন্তু প্রথম অধিবেশনের পর থেকে সদস্যদের স্ত্রীরাই ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। ফলে এখনকার অধিবেশনগুলি স্ত্রীভূমিকাবর্জিত। এর জন্যে অবশ্য কোন সদস্যরই দুঃখ আছে বলে মনে হয় না।

    সেদিন সন্ধ্যায় শিবু আর গদাধর প্রজ্ঞাদের বাড়িতে এসে লাইব্রেরি ঘরে আগে থাকতেই ঢুকে বসেছিল। তিনটে ঘর নিয়ে লাইব্রেরি। বড় ঘরটাতে পড়াশোনা করার জন্য গোল টেবিল ঘিরে আট দশটা চেয়ার পাতা আছে। সেখানেই ‘বিপন্ন বিজ্ঞান’-এর বৈঠক হয়। বড় ঘরের দুদিকে দুটো ছোট ঘর। একটা এনসাইক্লোপিডিয়াতে ভর্তি আর অন্যটাতে প্রধানত ছোটদের বই। প্রজ্ঞা বাড়ি ছিল না বলে শিবু আর গদাই এই ঘরটাতেই বসে ছিল । ছোট ঘর থেকে বেরোবার আলাদা দরজা নেই। বড় ঘর ক্রস করে যেতে হয়। গদাইয়ের ইচ্ছে ছিল না বাবার মুখোমুখি হবার। ক্লাবের অধিবেশন শুরু হয়ে যাবার পর শিবু আর গদাই তাই বেরোবার সুযোগ পায় নি।

    গদাই আর শিবু হাত চেপে ধরে নিচু গলায় বলেছিল – বসে থাক। মনে হয় বাবা কিছু একটা করবে।

    গদাই হয়ত কিছুটা জানতো কি হবে। অন্যদিন সন্ধ্যেবেলা গদাইয়ের বাবা শম্ভুবাবু গদাইকে হোমওয়ার্ক করতে বলে লুঙ্গি পরে নিজের পড়ার ঘরে দরজা দিয়ে পড়াশোনা করতে চলে যান। যতক্ষণ না বমি পেয়ে যায় ততক্ষণ একনাগাড়ে নিজের হোমওয়ার্ক করে যান নাকি । তারই ফাঁকে হুংকার দিয়ে দু--একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেন আর কি।

    শিবু মজা করবে বলে গদাই--কে জিগ্যেস করেছিল – হাত উঠবে নাকি রে?

    শম্ভুবাবুর হাত সহজে উঠে যায় – সে নিয়ে একটু দুর্নাম আছে। কিন্তু শিবুর কথা শুনে গদাই এমন মুষড়ে পড়ে যে শিবু আর কিছু বলতে সাহস পায় না। ভাবে নির্ঘাৎ গদাইয়ের বাবা অন্য অনেকের বিরুদ্ধে কোনো একটা কারণে রেগে আছেন। গদাই জানে সত্যি কিছু ঘটলে প্রজ্ঞা তাকে ছাড়বে না।

    সেদিন ‘বিপন্ন বিজ্ঞান’-এর বক্তা ছিলেন শম্ভু চৌধুরীই। পাটভাঙা কোঁচানো ধুতি পরে এসেছিলেন সেজেগুজে দোহারা মানুষটা। চোখ ঈষৎ লাল। লাইব্রেরী ঘরে ঢুকতেই মিষ্টি পানের সুগন্ধ আর তিতকুটে একটা অন্যকিছুর গন্ধও পেয়েছিল শিবুরা। প্রফেসর বাগচী অপূর্ববাবুর দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলেছিলেন – আজকেও মেরে এসেছেন। কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে অপূর্ববাবু আরো চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন – এবার কাকে মারলেন?

    অবশ্য শম্ভুবাবু যখন তাঁর গল্প শুরু করেন তখন সবাই মোটামুটি চুপই ছিল। পাশের ঘর থেকে উৎকর্ণ গদাই আর শিবু শুনতে পায় শম্ভুবাবু পকেট হাৎড়ে পানের ছোট্ট ডিবেটা বের করে টেবিলের ওপর ঠক করে নামিয়ে রাখলেন। কাঁচের গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে একচুমুক জল দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলেন। বললেন – পটভূমিকাটা আগে বলা দরকার – তাই তো ?

    ‘বিপন্ন বিজ্ঞানে’র বৈঠকে কি হয় এ নিয়ে শিবুর ভাসা ভাসা ধারণা থাকলেও – এর আগে কোন অধিবেশনে এরকম আড়ি পেতে থাকার সুযোগ হয়নি। ভিতরের খবর কিছু জানা ছিল না। ফলে শম্ভুবাবুর গল্প শুরু হবার পরেও ঠিক ঠাহর করতে পারে নি শ্রোতাদের মন কোন দিকে এগোচ্ছে। বা বোঝে নি কেন ডাঃ সেন একটা খাতা কলম নিয়ে বসে নিখুঁত নোট নিয়ে যাচ্ছিলেন ও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছিলেন। এসবের কারণ পুরো অধিবেশন শেষ হয়ে যাবার কোনো এক সময়ে আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করে। তখন মনে হয়েছিল – সাহাবাবুর ইকোয়েশনের সাথে বিপন্ন বিজ্ঞানের এই যুগে, সবার সামগ্রিক জীবনযাত্রার একটা নিবিড় যোগ আছে।

    এরপর একদিন সাহস করে সাহাবাবুকে করিডরে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল – স্যার আপনি ‘বিপন্ন বিজ্ঞান’-এর কথা জানেন?

    সাহাবাবুও চাবুকের মত সোজা হয়ে শিবুকে পাল্টা প্রশ্ন করে হতবাক করে দিয়েছিলেন । --কে তোমাকে পাঠিয়েছে শিবনাথ? কার হয়ে কাজ করছো আজকাল?

    শিবু প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলেছিল – কেউ নয় তো?

    সাহাবাবু মাথা নাড়াতে নাড়াতে চলে গিয়েছিলেন।--তোমাকে কি বিশ্বাস করা যায় শিবনাথ ? কিছু মনে কোরো না – কিন্তু আর কিছু বলা উচিত নয় আমার।

    সাহাবাবু ওরকম জেনেই শিবু আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু এসবের সঙ্গে সাহাবাবুর ইকোয়েশনের যোগসূত্রের ব্যাপারে তার আগের ধারণা আরো বলবান হয়েছিল।






    শম্ভুবাবুর গল্পঃ বালক রাক্ষস হল কি করে?


    যাইহোক, বিপন্ন বিজ্ঞানের যে নিয়মটা শম্ভুবাবুর মত দুর্দান্ত লোককেও মানতে হত সেটা শিবু-- গদাই না জেনেই ঠিকঠাক পালন করেছিল। নিয়মটা এই যে – কাহিনী যখন বলা হচ্ছে তখন শ্রোতারা কেউ কথা বলবেন না। স্বগতোক্তি বা একলাইনের ছোট্ট টু দ্য পয়েন্ট প্রশ্ন গল্পের অর্থ পরিষ্কার করার খাতিরে শুধু করা যেতে পারে। শম্ভুবাবুর গল্প তার পটভূমিকাবিস্তার ও বিদগ্ধ শ্রোতাদের অনুসন্ধানী প্রশ্নের উঁচুনিচু জমি পার করে সেদিন মোটামুটিভাবে এইভাবে এগিয়েছিল।

    (জল খেয়ে শম্ভুবাবু বললেন --)

    দেখুন গল্পটা মানুষের মধ্যেই বিরাজমান পৈশাচিক ক্ষমতা নিয়ে। কেউ এর দার্শনিক ব্যাখ্যাও দিতে পারেন। আমি শুধু সত্যিকারের ঘটনাটার বিবরণ দিয়ে বোঝাবুঝির ভার আপনাদের হাতে ছেড়ে দেবো।

    ঘটনাটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু পরের। অসহযোগ আন্দোলন তখনো শুরু হয়নি কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর খ্যাতি দিনদিন বাড়ছে।

    কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে চলে আসার ফলে এই যুগে বহু বাঙালী সরকারী চাকুরে দিল্লী প্রবাসী হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন তখন ইতিহাস। ইংরেজরা ভারত জুড়ে দাপিয়ে

    শাসন করছে। কিন্তু শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চাপা আক্রোশ ক্রমশ প্রত্যক্ষ বিক্ষোভ হয়ে বেরিয়ে আসবো আসবো করছে।

    কলকাতার বাবুরাও গোরাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছেন কেউ কেউ (আবার কেউ কেউ-- এই আমাদের মতই ক্লাব ট্‌লাব নিয়েই আছেন)।

    যেদিনকার কথা বলছি সেদিনও গড়ের মাঠে একটা কিছু গণ্ডগোল হওয়াতে কিছু বাঙালী ছেলেকে পুলিশ ঠেঙিয়েছে। চারিদিকে হাওয়া গরম।

    (এইখানে ডাঃ সেন, যিনি খুঁতখুঁতে ও মেথডিকাল লোক বলে কুখ্যাত, একটা আঙুল তুলে বললেন – এক্‌জ্যাক্ট তারিখটা পাওয়া যাবে? যার জবাবে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে শম্ভু বাবু বললেন – দূর মশাই! এক্‌জ্যাক্ট ডেট কি ধুয়ে খাবেন? ঘটনাটা খবরের কাগজে বেরিয়েছিল। দরকার হয় কাটিং আনিয়ে দেবো। অপূর্বকৃষ্ণ বাবু যখন তাড়াতাড়ি বললেন -- যেমন চলছে চলুক। অতঃপর শম্ভুবাবুও বলে চললেন --)<প/> কলকাতা টু দিল্লী স্টীম ইঞ্জিনের ট্রেন। তারই একটা কল্পনা করুন। ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় বসে একটি বাঙালী পরিবার দিল্লী রওনা হচ্ছে। বেড়াতে যাওয়া নয় – চিরকালের মত দেশ ছেড়ে প্রবাসে যাওয়া। সঙ্গে লাগেজ যাচ্ছে প্রচুর – দিল্লীতে তখন জনসংখ্যা খুব কম (এখানে প্রফেসর বাগচী দুবার মাথা নাড়লেন)। দোকান বাজার নেই বললেই চলে। প্রবাসী বাঙালিদের অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হত।

    পরিবারটিতে আছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে চাকুরিরত এক ভদ্রলোক। বয়স ত্রিশেক হবে । নাম ধরা যাক ধনঞ্জয়বাবু। পরনের সাদা জামা, খাকি হাফ প্যান্ট আর শোলার টুপি দেখলেই বোঝা যায় যে সাহেবী পোষাকে ও আদবকায়দায় তিনি অভ্যস্ত। চুল মিলিটারির লোকেদের মত ছোট করে ছাঁটা। নাকের ওপর পুরু বাটারফ্লাই গোঁফ। তাঁর স্ত্রী অবশ্য সাধারণ বাঙালী গৃহবধূর পোষাকই পরেছেন। কিন্তু শাড়ির সঙ্গে পুরোহাতা জ্যাকেট এবং পায়ে চটি দেখে সাহেবী প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়।

    (অপূর্ব বাবু চোখ বুজে বললেন – ভালো হচ্ছে। দৃশ্যটা কল্পনা করতে পারছি ।)

    গল্পের মুখ্য চরিত্র এঁদের ছেলেটি – যার বয়স ছার কি পাঁচ। এই বালকের মধ্যেই কিছুক্ষণ পরে পৈশাচিক ক্ষমতা আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে খুব শান্ত। ভালো করে দেখলে ম্রিয়মাণই বলতে হবে। হাত পা রোগা, কৃকলাসের মত চেহারা। বালকের বাবা--মা দুজনেরই বিশ্বাস যে এ ছেলে বেশিদিন বাঁচবে না। পরের কথা ভাবলে অবশ্য বলতে হয় – হাউ আয়রনিকাল!

    যাই হোক গার্ড দ্বিতীয় হুইসেল্‌ দেবার পর আত্মীয় পরিজনরা নেমে যাচ্ছে। এই কামরার আরেকটি মাত্র কুপে লোক ছিল – দুই সাহেব যাত্রী। তারা অনেকক্ষণ ধরেই ধনঞ্জয় বাবুদের ওপর নজর রেখেছিল। কটমট করেই চেয়েছিল আসলে। এই পরিবারের কাউকেই কি কারণে তাদের একেবারে পছন্দ হয়নি।

    ধনঞ্জয় বাবু আর তাঁর স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরে তাঁদের গুরুমশাইয়ের প্রতীক্ষা করছিলেন। সেকেন্ড হুইসেলের পর হঠাৎ তাঁকে দৌড়তে দৌড়তে আসতে দেখা গেলো। সাদা দাড়ি গোঁফ দেখলে মনে হয় বছর ষাট পঁয়ষট্টি বয়েস হবে – যদিও অনেকের বিশ্বাস আসল বয়েস পেতে গেলে তার সাথে আরো কয়েক’শ বছর যোগ করতে হয়। গুরুদেব এসেই জিভ কেটে বললেন – শুভম ভূয়াৎ--এঃ হে বড় দেরি করে ফেলেছি।

    এই কথা বলার কারণ কটমট করে চেয়ে থাকা সাহেবদের একজন কামরার দরজা বন্ধ করে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন যে তারা কামরার লোক ওঠা পছন্দ করছে না তা বোঝা দায়। ধনঞ্জয়বাবুর দোহারা চেহারা। তিনি উঠে দাঁড়াতে সাহেব সরে গেল বটে কিন্তু বিড় বিড় করে মুখ খারাপ করতে ছাড়লো না – যার মধ্যে শুধু ডার্টি কথাটা শোনা গেল।

    গুরুদেব কামরায় উঠে সবে প্রণামটুকু নিয়েছেন এমন সময় থার্ড হুইসেলও পড়ে গিয়েছে। ধনঞ্জয়বাবুর স্ত্রী বললেন – গুরুদেব, এই মূর্খ, আধমরা ছেলেটাকে কিছু তেজ দিয়ে যান। নইলে বিদেশ--বিভূঁয়ে গিয়ে একদিনও বাঁচবে না।

    গুরুদেব বললেন--বাঁদরামি ছাড়া রোগ কি?

    ধনঞ্জয় বাবুর স্ত্রী বললেন – হতভাগার কিচ্ছু রোচে না মুখে, তাই এরকম চেহারা।

    গুরুদেব বললেন – এর ভালো দাওয়াই আছে আমার কাছে – এই বলে ঝোলা ঘেঁটে একটা নীল রঙের মন্ত্রপূত জবা ফুল বের করে বললেন – এর নাম আকাশ কুসুম। শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমায় মেঘের ভিতর ফোটে। দ্যাখো কেমন বিদ্যুতের মত আলো বেরোচ্ছে গা থেকে! এর একটা পাপড়ি মধু দিয়ে মেড়ে খেলেই... এইটুকু মাত্র বলেছেন এমন সময় ট্রেনটা একটা ঝাঁকুনি মেরেছে আর ওদিক থেকে অন্য সাহেবটা – আউট্‌ আউট্‌ বলে তেড়ে এসে ইচ্ছে করেই গুরুদেবের পা দিয়েছে মাড়িয়ে।

    ধনঞ্জয়বাবুও এই জবরদস্তি দেখে দাঁত কিড়মিড় করে লাফিয়ে উঠেছেন। নাকের ওপর বাটারফ্লাই গোঁফ ফুলে এমন অবস্থা একটা মারামারি হয়েই যেত। (এইখানে প্রফেসর বাগচী এমন ভাবে সিধুবাবুর দিকে চাইলেন যার অর্থ শম্ভু বাবুর গল্পে মারামারি থাকবে না এমন হয় ?)

    কিন্তু সরকারি চাকুরে – সাহেবের গায়ে হাত তুললে তার কি হবে তা সবাই যানে। গুরুদেবই বাঁচাবার জন্য দুহাত তুলে বললেন – বিবাদেন অলম্‌। মা নিষাদ প্রতিষ্টাং ত্বমগম -- বুড়োর পা মাড়িয়ে কেউ কোনদিন বড়লোক হয় না, প্রতিষ্ঠাও পায় না। যার ভাগ্যে যা আছে তা তো হবেই। আমিই বরং নেমে যাই।

    একদিক থেকে ভালোই হল, কারণ গুরুদেব খোঁড়াতে খোঁড়াতে যতক্ষণে নেমেছেন ততক্ষণে ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। ধনঞ্জয়বাবুর স্ত্রী জানলার কাছে মুখ বাড়িয়ে বললেন – গুরুদেব ফুলতা...।

    তাড়াতাড়ি ছুটে গুরুদেব ফুলটা জানলার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন – অভিপ্রায় একটা পাপড়ি ছিঁড়ে দেবেন। এমন সময় – নিয়তি আর কাকে বলে – চার বছরের সেই পিশাচে পাওয়া

    ম্রিয়মাণ ছেলের হঠাৎ কি হয়েছে – সে ছোঁ মেরে পুরো ফুলটাই গুরুদেবের হাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিয়েছে!

    গুরুদেব হাঁ হাঁ করে বললেন – ওরে থাম থাম গুরুপাক হয়ে যাবে!

    কিন্তু যা হবার হয়ে গিয়েছে। ট্রেনও প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে। ভোঁ আওয়াজে গুরুদেবের সব কথা চাপা পড়ে যায়।

    (এতদুর বলে শম্ভুবাবু একটু দম নিতে থেমেছেন। সেই অবসরে বিপন্ন বিজ্ঞানের সদস্যরা উঠে প্লেটে চানাচুর ভর্তি করে নেন। অপূর্ববাবু বললেন – ভালোই চলছে, কিন্তু রহস্যটা এখন জানা হল না। শম্ভুবাবু জলে চুমুক দিয়ে বললেন – এলো বলে।)

    ট্রেন চলছে। দেখা গেল কামরার মাত্র দুটো কূপেই লোক আছে। অন্য কূপের সহযাত্রী সাহেবরা আলাপ তো করলোই না, উপরন্তু সারাক্ষণ দরজা দিয়ে বসে রইলো কি জানি কেন রাগ করে। ধনঞ্জয় বাবুরাও আর যেচে কথা বললেন না। দীর্ঘ দুদিনের পথ। ভালোয় ভালোয় কাটাতে হবে।

    দুপুরের খাবারের সময়ই গুরুদেবের মন্ত্রপূত ফুলের আশ্চর্য মাহাত্ম্য প্রকাশ পেল। পাঁচ বছরের খোকাকে যা দেওয়া হচ্ছে সে তাই চোখ বুজে খেয়ে ফেলছে। এক সময়ে একটা ছোট কাপড়ের থলিও তুলে নিয়ে নিমেষের মধ্যে তা গিলে অদৃশ্য করে দিলে। ধনঞ্জয় বাবু চিন্তিত হয়ে বললেন – এ তো সর্বভূক হয়ে গেল মনে হচ্ছে! বিকেলে দেখা গেল ধনঞ্জয় বাবুর একপাটি চটি হাওয়া। ছেলের মুখ দেখে বোঝা গেল না সে চটি নিয়ে কি করছে। তক্কে তক্কে থেকে ধনঞ্জয় বাবু কিছুক্ষণ পরে তার মুখ থেকে একটা অর্ধেক চিবিয়ে ফেলা চশমার খাপ উদ্ধার করতে সমর্থ হলেন। ধনঞ্জয় বাবু ঠিক করলেন যে ছেলেকে চোখে

    চোখে রাখতে হবে। স্ত্রী কে বললেন – খাদ্য অখাদ্য যা আছে সব লোহার তোরঙ্গটাতে তুলে ফেলো।

    সন্ধ্যেবেলাটা এইভাবেই কাটলো। বাচ্চা ছেলের তাড়াতাড়ি ঘুম পায় এই রক্ষে। রাত্রে আবার সে দিস্তে খানেক লুচি সাবাড় করে সে বাবা-- মা’কে অবাক করে দিয়ে শুতে গেল। সে ঘুমোলে ধনঞ্জয় বাবু স্ত্রীকে বললেন – এ কী রাক্ষুসে স্বভাব হয়ে গেল গো খোকার /

    ধনঞ্জয় বাবুর স্ত্রী কিন্তু ছেলের দোষ দেখতে পেলেন না। উল্টে স্বামীকেই বকে দিলেন নিজের ছেলেকে রাক্ষস বলার জন্য।

    স্ত্রীও ঘুমোতে গেলে ধনঞ্জয় বাবু একা চুপচাপ জেগে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। অন্ধকারে তাঁর মনে হল ছেলেটা বাঘের মত বিরাট হাঁ করে হাই তুলছে এক একটা। নানা রকম ভালোমন্দ চিন্তা করতে করতে ধনঞ্জয় বাবুর যখন ঘুম এল তখন গভীর রাত।

    ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধনঞ্জয় বাবু স্বপ্ন দেখলেন যে তাঁর খোকা দিল্লীতে বড়লাটের বাড়ির থামগুলো খুলে খুলে যাচ্ছে। আর লর্ড কর্নওয়ালিস তাঁদের চায়ের নেমত্নন্নে ডেকে সাবধান করে দিচ্ছেন – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্যকে কেউ গিলে শেষ করতে পারে না মাই ডিয়ার বাবু। খোকাকে বলুন একটু বেছে খেতে। লজ্জিত হয়ে ধনঞ্জয় বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারছেন না।

    ট্রেনের ঝাঁকুনিতে যখন ঘুম ভাঙল ধনঞ্জয়বাবুর তখন সবে ভোর হয়েছে। আবছা একটু সাদা কালো এসে ঢুকেছে কূপে। ধনঞ্জয় বাবু দেখলেন তাঁর স্ত্রী ঘুমোচ্ছেন পাশ ফিরে। খোকার কোনো পাত্তা নেই। ধনঞ্জয় বাবু চাপা গলায় ডাকলেন – খোকা? একটু দুরের অন্য কূপ থেকে অস্ফুট সাড়া এল – খাচ্ছি। অসীম সাহসী ও দুর্দান্ত বলে বিখ্যাত ধনঞ্জয় বাবুর একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। তিনি বিড় বিড় করে বললেন – কি খাচ্ছিস ?

    (শম্ভু বাবু আমার থেমেছেন দম নেবার জন্য। কিন্তু সভাস্থ কেউ আর প্রশ্ন করছে না । প্রফেসর বাগচীও চুপ।) স্ত্রীকে না জানিয়ে আলতো পায়ে অন্য কূপের কাছে গেলেন ধনঞ্জয় বাবু। দরজা বন্ধ, কেউ কোথাও নেই। বাকি কূপগুলো যথারীতি ফাঁকা। ধনঞ্জয় বাবু সাহেব্দের কুপের দরজায় টোকা দিয়ে বললেন – এক্সকিউজ মি, মে আই কাম ইন? ভিতর থেকে তাঁর পাঁচ বছরের খোকার গলা এল – বাবা খাবে? আর দ্বিরুক্তি না করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে ধনঞ্জয় বাবু দেখলেন কূপে আর কেউ নেই। মাঝখানে মেঝেতে তাঁর খোকা একটা সাদা রুমাল গিলবার জন্যে বিশাল হাঁ করেছে।

    ধনঞ্জয় বাবু বললেন – সায়েবরা কই?

    খোকা জবাবে ঢেঁউ ঢেঁউ বলে দুটো ছোট ঢেঁকুর তুললো।

    ধনঞ্জয় বাবু কপালে করাঘাত করে বললেন – সর্বনাশ! তারপর একমুহূর্ত দেরী না করে সমস্ত কামরাটা তন্য তন্য করে খুঁজলেন। কেউ কোত্থাও নেই। কামরার দরজাগুলো সব ভিতর থেকে বন্ধ। অর্থাৎ সায়েবরা কোথাও নেমেও যান নি।

    ধনঞ্জয় বাবুর হুড়োহুড়ি আর থেকে থেকে কপাল চাপড়ানোর আওয়াজে তাঁর স্ত্রী জেগে উঠে চোখ কচলে বললেন – কি ব্যাপার, খেপে গেলে নাকি? ধনঞ্জয় বাবু বললেন – তাও হতে পারে। ভালো করে ভেবে দ্যাখো – রাতে তুমি উঠেছিলে? স্ত্রী বললেন-- ভাবা ভাবির কি আছে – উঠিনি। ধনঞ্জয় বাবু বললেন – হয়তো ভুলে গেছো – অনেকে তো ঘুমের মধ্যে হাঁটে। ভেবে বলো – রাতে উঠে কামরার কোন দরজা খোলা দেখে ছিটকিনি দিয়েছিলে? স্ত্রী বললেন – পাগল নাকি? মড়ার মত ঘুম আমার। কি হয়েছে বলবে তো ?

    ধনঞ্জয় বাবু ভেঙে পড়ে বললেন – খোকা বোধহয় সায়েবদুটোকে...

    কথাটা আর শেষ করতে পারলেন না ধনঞ্জয় বাবু। কিন্তু খোকা ইতিমধ্যে একটা টাই চিবোতে চিবোতে মা বাবার কাছে চলে এসেছে। সে নিজেই একটা ঢেঁকুর তুলে বললো – খেলুম।

    শম্ভুবাবু উপস্থিত ক্লাব মেম্বারদের উদ্দেশ্য করে বললেন-- এরপর যা হল তাতে ধনঞ্জয় বাবুর অনমনীয় মনোবলই প্রকাশ পায়। প্রথমেই সাহেবদের কূপে গিয়ে ইতস্তত লাল--মাখা দুটো খবরের কাগজ, একটা মোজা, একটা তামাকের খালি প্যাকেট ও একটা রেলের টাইম টেবিল কুড়িয়ে ঘরটাকে একেবারে খালি করে দিয়ে এলেন। একবার ভাবলেন সব জানলা গলিয়ে ফেলে দেবেন। তারপর গোয়েন্দাদের লম্বা হাতের কথা ভেবে সেসব নিজের পাঁচ বছরের খোকার সামনে রেখে বললেন – শালা এবার এগুলোও খা।

    বলাই বাহুল্য খোকা বাপের অনুরোধ রাখতে কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেরি করে নি। ধনঞ্জয় বাবু আশ্চর্য হয়ে দেখলেন আগের পাটির সাথে সমান্তরাল ভাবে খোকার রাতারাতি দুটো ক্যানাইন দাঁত গজিয়েছে। দেখলেন যে পাঁচ বছরের ছেলে যা খাচ্ছে তাই তৎক্ষণাৎ হজমও হয়ে যাচ্ছে – তাই খিদেও মিটছে না তার।

    পরের ষ্টেশন আসার আগেই কামরার একটা দরজা ভিতর থেকে খুলে রাখলেন ধনঞ্জয় বাবু। দুপুরের পর কানপুরে ট্রেন থামলে উর্দিপরা দুজন পুলিশ ও এক সাহেব অফিসার উঠে এল কামরায়। ধনঞ্জয় বাবুর বুক ধড়াস ধড়াস করছে। পুলিশরা অন্য কূপগুলো খুঁজে কাউকে না পেয়ে ধনঞ্জয় বাবুকে বললো – দুজন সাহেব ছিল এই কম্পার্টমেন্টে। কোথায় তারা? শুনে খোকা আবার সংক্ষিপ্ত ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে মায়ের হাতে ঠাসঠাস করে চড় খেল। ধনঞ্জয় বাবু হরিণের মত নিরীহ মুখ করে বললেন – রাতে তো ছিলো? সকাল থেকে দেখছি না। কেন, কূপে নেই তারা?

    তখন পুলিশরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বললো – পাখি পালিয়েছে। ধনঞ্জয় বাবুর পরিচয় পত্র দেখে একটা একটা ছোট্ট জবানবন্দী নিয়ে নেমে গেল তারা।

    দিল্লীতে গিয়ে ধনঞ্জয় বাবু শুনলেন কলকাতার একটি বড় মার্চেন্ট কোম্পানিতে পুকুর চুরির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে দুই ডিরেক্টর দিল্লীতে অফিসে জবাবদিহি করার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। তারপর থেকে তাঁরা বেপাত্তা। তাঁরা পালাতে পারেন এই আশঙ্কা করে কানপুরে তাঁদের কাস্টডিতে নেবার জন্যে লোক পাঠানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গিয়েছে। দুই ডিরেক্টারকে খুঁজতে পুলিশ ও মিলিতারি দুইই লাগানো হয়েছে। সারা ভারত জুড়ে হুলিয়া।

    ধনঞ্জয় বাবু সব শুনে বললেন-- হুম্‌। ইতিমধ্যে তাঁর অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে ছেলে গোটা তিনেক বুশশার্ট আর একটা কৃষ্ণনগরের মূর্তি সাবড়ে দিয়েছে। ধনঞ্জয় বাবু আর দেরি না করে কলকাতায় তাঁর করে গুরুদেবকে বললেন-- কাম সুন। খোকা সিরিয়াস।

    সাতদিনের মাথায় দিল্লীতে যজমানের বাড়িতে গুরুদেব মুখ চুন করে এসে হাজির। দরজা জানলা বন্ধ করে ধনঞ্জয় বাবু পুরো ঘটনা বললেন গুরুদেবকে। বললেন-- আজ্ঞা করুন তবে গুরুদেব, এবার বিদায় করি। গুরুদেব বললেন – কাকে? ধনঞ্জয় বাবু বললেন--এই নরভোজী ছেলেকে ঘরে রাখা কি আর উচিৎ হবে? কবে না বুড়ো বাপ--মা--কেই... ? গুরুদেব জিভ কেটে বললেন – শুভম্‌ ভূয়াৎ, শুভম্‌ ভূয়াৎ। খারাপ কথা ভাবছো কেন?

    তারপর আমতা আমতা করে বললেন – যা হবার তা হয়েই গেছে। অনুশোচনা করে লাভ নেই। তাড়াহুড়োর মাথায় আমারই হাত ফস্কে গিয়েছিল। অন্যায় কিছু হলে আমারই হয়েছে সন্দেহ নেই। এ ছেলে নির্দোষ।

    ধনঞ্জয় বাবু হাত জোড় করে বললেন – কিন্তু প্রভু আমরা সংসারী লোক। ভয়ে রাতে ঘুমোতে পারি না। আসা ইস্তক পাড়ার একটি ডানপিটে মূলতানী গরু গায়েব হয়ে গিয়েছে । লোকে আমাদেরই সন্দেহ করে।

    গুরুদেব স্মিত হেসে বললেন – ওভারডোজ হয়ে গিয়েছে। মাত্রার হেরফের। সেটা ঠিক করে দেওয়া যাবে। এই বলে খোকাকে নিজের কোলে বসিয়ে চোয়ালে টক্‌ টক্‌ করে গোটা দশেক টোকা মারতেই নতুন গজানো ক্যানাইন দাঁতের একটা ঠক্‌ করে পড়ে গেল। অন্যটা রেখে গুরুদেব বললেন-- এবার ঠিক হয়েছে।

    ধনঞ্জয় বাবু বললেন--আপনাকে ছাড়ছি না। একমাস দেখি কোন প্রগ্নসিস হচ্ছে কিনা। এর মধ্যে পুর্জা সিংএর দ্বিতীয় গরুটা যদি হারায় তাহলে আমি সস্ত্রীক কাশীবাসী হবো।

    শম্ভু চৌধুরী বললেন – চরিত্রদের কেউ কেউ এখনো জীবিত। গুরুদেবের মহাপ্রয়াণ ঘটে ভারত যেদিন স্বাধীন হয় তার একদিন আগে। তাঁর বুদ্ধিতেই ধনঞ্জয় বাবু গয়ায় গিয়ে প্রতিবছর দুই সাহেবের আত্মার সদ্গতি কামনা করে পিন্ডদান করে আসতেন। ধনঞ্জয় বাবুর খোকা বড় হয়ে ব্রিটিশ সরকারের ফৌজে বড় অফিসার হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু ব্রিটিশ সোলজারের প্রাণরক্ষা করে। খাদ্যে কোনদিন তার অরুচি হয় নি। অখাদ্য সে চিরজীবন বর্জন করে চলেছে। এখানেই গল্পের ইতি। এবার আপনারাই বলুন এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি?






    শিমলিপুর


    শম্ভু চৌধুরীর গল্পটা শুনে গদাই একটু আপ্লুত হয়ে পড়েছিল নিশ্চয়ই। শিবুর কাঁধে আলতো করে সে হাত রেখে বললো-- বাবার নরম দিকটা দ্যাখ। ফাইন আর্টসে... শিবু মাথা নাড়িয়ে সায় দিতে বাধ্য হয়। গল্পের মতো ঘটনা। শিমলিপুরে গত পাঁচ ছ বছরের যে ইতিহাস যে স্মরণে আছে তাতে সিধুবাবুকে ডাকাত সন্দেহ করে গ্রেফতার ও প্রহারের বিখ্যাত ঘটনাটি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন কিছুই ঘটে নি। সম্প্রতি গদাইয়ের বাড়িতে একটা হাস্যকর ব্যাপার হয়েছে অবশ্য। গদাইএর পোষা অ্যালসেশিয়ান অর্থবর নামে পরপর তিনটে উড়ো চিঠি এসেছে। প্রথম চিঠিটা এসেছিল অর্থবর জন্মদিনের দিন।

    গোলাপী গ্রিটিং কার্ডে লেখাঃ ‘অভিনন্দন অর্থব! তোমায় শেষ জন্মদিন মোবারক হোক’। দ্বিতীয়টা আসে এক সপ্তাহ বাদে, হলুদ খামে। লেখাঃ অর্থব তুমি একটা মোটা মাংসের থলে। আমার হল শুরু, তোমার হল সারা’।

    প্রথম চিঠিটা পেয়ে গদাই কিছু বুঝতে পারে নি। দ্বিতীয়টা পাবার পর চিন্তিত হয়ে শম্ভুবাবুর সাথে রাতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করেছিল। শম্ভুবাবু অবশ্য চিঠিটা পড়ে হাসতে হাসতে পেটে ব্যাথা করে ফেলেছিলেন। তাতে গদাই কিছুটা স্বস্তি পায়। তার দিন দশেক পরে তৃতীয় চিঠি। পোস্টকার্ডে। লেখা ছিল – ‘অর্থব ঈশ্বরের সাথে মিলিত হবার জন্য প্রস্তুত হও। আমেন’। তৃতীয় চিঠিটার পর প্রায় মাসখানেক নিরুপদ্রবে কেটে গেছে। গদাই ছাড়া আর সবাই ভুলতেও বসেছে ঘটনাটা। গদাই শুধু অথর্বের ফাইলে চিঠি তিনটে রেখে দিয়েছে মন্তব্য সহ। কোনদিন যদি সে পৃথিবীতে না থাকে এবং অথর্ব হস্তান্তরিত হয় তাহলে নতুন মনিব এই ফাইল পাবে। শিবুকে দেখিয়ে রেখেছিল গদাই। শেষ চিঠিটা পাবার মন্তব্যের পাতায় ভিনসেন্ট ডি’মেলোর নাম সন্দেহের তালিকায় লাল কালি দিয়ে লেখা হয়েছিল। পাশে চৌকো বাক্সে সাবধানবাণী-- ‘এর প্রদত্ত খাবার পরীক্ষা না করিয়া অথর্বকে খাওয়াইবেন না’।

    উল্লেখযোগ্য অথর্বের অন্য তিন ভাই (যাদের নাম যথাক্রমে ঋক, সাম ও যজু) অদ্ভূতভাবে একের পর এক অপঘাতে মারা গিয়েছে বলে শোনা যায়। জন্মের পরেই চারভাই পৃথিবীর চারিদিকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। চকোত্তিদের চারটে নতুন কুকুর পালার ইচ্ছে ছিল না-- তাই তাদের বিদেশবাসী তিন মেয়েকে ভালো তিনটে বেছে দিয়েছিল তাঁরা। অথর্ব অপেক্ষাকৃত স্থূল ও আলসে বলে বিদেশ যেতে পারে নি। এ হাত সে হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত গদাইয়ের বাড়ি এসে টিকে যায়। এসব বছর চারেক আগেকার ঘটনা। শিবু গদাইরা তখন বেশ ছোট। যাই হোক, তারপর নমাস--ছমাস পরেই চক্কোতিরা মেয়েদের কাছ থেকে ঋক--সাম--যজুর হ্রিদয়বিদারক মৃত্যুর খবর পেতো। একজন ট্রাক চাপা পড়ে, একজন সমুদ্রে ডুবে এবং তৃতীয়জন সম্ভবত কোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে গিয়ে তড়িতাহত হয়ে মারা যায়। অপঘাতে মরাটা পারিবারিক অভিশাপ হয়ে ঠেকলেও তখনো পর্যন্ত অথর্বর উড়ো চিঠি পাওয়ার সাথে তার তিন ভাইয়ের মৃত্যুর কোন যোগ খুঁজে পাওয়া যায় নি।

    গদাই অবশ্য অথর্বকে চোখে চোখেই রাখে। সেদিনও প্রজ্ঞাদের বাড়িতে অথর্বকে নিয়েই যাওয়া হয়েছিল। প্রজ্ঞার দিদি প্রমার কুকুরে অ্যালার্জি বলে বাড়িতে ঢোকানো সম্ভব হয় নি। গেটের ভিতর বাগানে জল দেবার কলের সাথে তাঁকে বেঁধে রাখা হয়।

    শিমলিপুরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শিবু আর গদাইয়ের দু--চারবার আলোচনা হয়েছে। দেখা গিয়েছে যে তাদের জন্মের আগেও শিমলিপুর মোটামুটি এরকমই ছিল। শিবু--গদাইয়ের বদলে তমালদা--হারিতদারা রাস্তাঘাটে ঘুরতো। প্রজ্ঞা যে নাচের স্কুলটাতে যায় সেখানে যেত তার দিদি। আর প্রফেসর বাগচী তখনও প্রফেসর হয়ে ওঠেননি বলে তাঁর বাড়িতে কোন আসর হত না – হত প্রফেসর বিশ্বাসের বাড়িত-- যিনি এখন রিটায়ার করে বুড়োদের একটা নতুন দল খুলেছেন যারা সারাদিনই আড্ডা দেয় এমং সন্ধ্যে হলেই মাফলার জড়িয়ে একনাগাড়ে কাশে। বছর পনেরো পর প্রফেসর বাগচী বা শম্ভুবাবুদেরও যে এই দশা হবে তাতে সন্দেহ নেই। গদাই বলে – বাবার পড়ার ঘরটা বেশ সাউন্ডপ্রুফ। ওখানেই কাশির আড্ডা বসবে দেখিস। তখন শিবু গদাইরা শিবুবাবু, গদাইবাবু নামে পরিচিত হবে এইটুকুমাত্র। ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বট্‌ল। গদাই বলে--বাবার মত তখন আমাকে লোকে বলবে ভাড়াটে গুন্ডা, প্রজ্ঞাকে বলেবে ছিটছিটে বাগচী। নতুন কি আর হবে বল?

    কথাটা শিবুকে খুব প্রভাবিত করেছিল। সাহাবাবু যেদিন ক্লাসে মর্ডান অ্যালজেব্রা পড়াতে পড়াতে বললেন – এসব অঙ্ক আমরা ছোটবেলায় করি নি হে, দিনকাল বড্ড পালটে যাচ্ছে। --তখন ছটা গোল্লার ভেন ডায়াগ্রামে চোখ বসে যাওয়া শিবু নিরাশ হয়ে বলেছিল – যাই বলুন সার, সবই তো শেষে গিয়ে যোগ, বিয়োগ, গুণ আর ভাগ। সেটা শুনে পাকা সর্বাণী আরো সিনেকের মত মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল – তাই বা কেন, শেষে গিয়ে সবই শুধু যোগ – ভেবে দ্যাখ। সাহাবাবু তখন শিবুদের দিকে সপ্রশংসভাবে চেয়ে বলেছিলেন – গভীরভাবে ভাবছো আজকাল – সেটাই তো নতুন। আরো ডীপে নেমে গেলে দেখবে যোগও নেই। শুধু তুলনা। কোনটা গুরু, কোনটা লঘু আর কোনটা সমান। সেখান থেকেই সমস্ত ম্যাথেমেটিক্স।

    শিবুর মতই ক্লাসে দুচারজন – ভিনসেন্ট, পদা, সিংহ, মাইতি, গদাই – সবাই একসাথে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলেছিল – সবার সমান স্যার, সবই সমান।

    এছাড়া আরেকটা অভাবনীয় জায়গা শিমলিপুরের স্থাবর প্রকৃতির চরম সমালোচনা শুনেছিল শিবু। সেটাও সম্প্রতি ঘটনা একটা হাস্যকর ঘটনার মধ্যেই পড়বে।

    সন্ধ্যেবেলা গদাই আর শিবুর উদ্দেশ্যহীন হাঁটাহাঁটির মধ্যে কোন উত্তেজনার সম্ভাবনা থাকে না। অথর্ব খুব ঢিলেঢালা কুকুর। সে-ই সবচেয়ে আগে হাঁপিয়ে বাড়ি চলে যেতে পারলে বাঁচে। সেদিনও গদাইয়ের পিছু পিছু অনিচ্ছের সঙ্গে হাঁটছিল। অন্ধকারের মধ্যে তখন গলির ভিতর কালো কফিন পরা ফকিরের অধম-- বিতিকিচ্ছিরি দেখতে একটা লোক প্রবেশ করে এবং অথর্বকে দেখে বাড়াবাড়ি রকম ভয়ে ফুটপাথের ধার ঘেঁষে ছুটতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য অথর্ব এসব ধাষ্টামোকে কোনোদিন প্রশ্রয় দেয় না। সে আগের মতই নির্বিকার ভাবে চলছে, সামান্য ভুক্‌ শব্দটা না করে। কিন্তু চক্কোত্তিদের টমসন বলে গাধাড়ে কুকুরটা কালো কাফুনকে ছুটতে দেখে রেলিং টপকে বিশাল চিৎকার করে তার পিছু নেয়।

    তখন টমসনকে কান ধরে ঘরে আনার কাজটা পড়ে শিবু গদাইয়েরই ঘাড়ে। তারা ধর ধর বলে কালো কাফুনের বুকে চেপে বসা টমসনকে বকলস ধরে টেনে আলাদা করে। অথর্ব থাকাতে সুবিধে, সে ভীষণ বড় আর ভারী বলে চক্কোত্তিদের অন্য কুকুরগুলো তাকে একটু সমীহ করে। ওদিকে কালো কাফুন পরা রোগা লোকটা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে শিমলিপুরকে শাপশাপান্ত করে যায়।

    অনেক কষ্টে শিবু--গদাই তাকে শান্ত করে বুঝিয়েছিল যে কুকুরগুলো একেবারেই ভয়ংকর কিছু নয়। অথর্ব তো বিশেষ রকম ধীর ও দীর্ঘসূত্রী। মানুষ তাড়াবার মত পরিশ্রমের কাজ সে করবে কেন ভাবো?

    লোকটা আঙুল তুলে শাসিয়ে বলে – নিজের কুকুর ট্যাঁকে রাখো না কেন তোমরা? ছোটলোক নাকি? এই রাস্তা দিয়ে রোজ শর্টকাট করবো এবার। ভয় করবো কেন? কাল থেকে অস্ত্রও রাখব সঙ্গে। কেটে উচ্ছেদ করে দেবো এই কুকুরের বংশ।

    তারপর থেকে লোকটাকে প্রায়ই দেখেছে শিবু গদাইরা। অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সুট করে পাড়াটা পেরিয়ে যায়। গোল গোল চোখ করে সব বাড়িতে নজরও রাখে। একটা হাত পকেটে, সেখানে কিছু অস্ত্র আছে অনুমান করা যায়। শিবু গদাইকে দেখে সে একদিন হেঁসে দাঁড়িয়েও পড়েছিল।

    --ধন্যবাদ ইয়ার, তোমরাই বাঁচালে সেদিন।

    শিবু গদাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ভেবেছিল – এতদিনে বুঝেছে ব্যাটা।

    সেদিন লোকটার অন্য একটা গুণের কথা জানা গিয়েছিল। আকাশ থেকে একটা সিগারেট পেড়ে ফেলার পর আচমকা গদাইয়ের কানের পিছন থেকে একটা দেশলাইয়ের কাঠিও বের করে এনেছিল সে। সেটা জ্বালাতে জ্বালাতে জিজ্ঞেস করেছিল – কটা বাজে হে ঘড়িতে?

    শিবু গদাইয়ের কাছে ঘড়ি ছিল না। শিবু আন্দাজে বলেছিল-- সাতটা।

    লোকটা মুখ বিকৃত করে বলেছিল – শিমলিপুরে যখনই আসি সন্ধ্যে সাতটা। কুকুর নিয়ে ছেলেরা ঘুরছে। (প্রজ্ঞাদের বাড়ির ছাদে তার দিদিকে দেখিয়ে ) ওই মেয়েটা চুল খুলে বেহায়ার মত ঘুরছে ছাদে। কাশি, কাশি চাদ্দিকে বুড়োদের কাশি। নতুন কিছু হচ্ছে না কেন? ভালো কিছু?

    তারপর লোকটা উর্দূতে বলে – হ্যায়রত হ্যায় কে হ্যায়রত নহী চেহরে পে কহী। দস্তক কি ইজাজত কো খাড়া হ্যায় তুফান। শিমলিপুরের দরজায় কোনো ঝড় এসে দাঁড়িয়েছে। আশ্চর্য হলে? এই নাও ভালো সময় চালিয়ে দিলাম তোমাদের। এই বলে নিজের হাতের ঘড়িটা সেট করে দম দিয়ে চালিয়ে দিয়েছিল লোকটা।

    শিবু গদাই এই অযাচিত উপহার নিয়ে কি করবে ভেবে না পেয়ে বোধহয় বলেছিল – ধন্যবাদ। উপকৃত হলাম।

    সুট করে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে তখন লোকটা আবার চেতাবনি দিয়ে গিয়েছিল।-- সাবধান, কুকুরটাকে আগলাও। নইলে ব্যাটা নির্ঘাৎ মরবে।

    গদাই শিবুরা ভেবে পায়নি হাসবে না কাঁদবে। শেষ পর্যন্ত হাসতে হাসতে বাড়ি। অর্থবটা কি সত্যি মরেই যাবে? ভেবেছিল দুজন।

    অর্থবের মুখ দেখে অবশ্য মনে হয়নি যে উড়োচিঠি, ভবিষ্যৎবাণী বা কোনোকিছু নিয়েই তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা আছে।

    প্রফেসর বাগচীর লাইব্রেরীতে বসে এসব কথা কিছু কিছু মনে পড়েছিল শিবু গদাইয়ের। তখন সবে শম্ভুবাবুর গল্প সমাধা হয়েছে। প্রশ্নোত্তর বা জেরার সময় শুরু হবে। বিপন্ন বিজ্ঞানের আখড়ায় বসে শিবু অনুভব করে শিমলিপুরের সে চারিত্রিক অ--চলমানতা। বাইরে ঝড় এসে দরজায় টোকা দিলেও প্রফেসর বাগচীরা বলবেন – এখন নয়। জরুরী মীটিং চলছে।

    প্রথম প্রশ্নটা এসেছিল ডাঃ সেনের কাছ থেকে। চিরকালই তাঁর কাছ থেকে আসে। তিনি দুই আঙুলে পেন্সিলটা তুলে বলেছিলেন – সাহেবদের কুপে রক্তের দাগ...?

    শম্ভু বাবু রেডি ছিলেন মনে হল, কারণ প্রশ্ন শেষ হবার আগেই তিনি বললেন-- ছিল কিনা সঠিক জানি না। তবে না থাকারই কথা। নইলে পুলিশরা আগেই তা দেখত।

    ডাঃ সেন বললেন – বিনা রক্তপাতে মানুষ খাওয়া সম্ভব?

    সিধুবাবু এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। তিনি সোৎসাহে বললেন-- অজগর যেভাবে খায় সেভাবে খেলে?

    ডাঃ সেন বললেন – পাঁচ বছরের ছেলে তা করবে?

    ডাঃ নন্দী চোখ কপালে তুলে বললেন – অলৌকিক ক্ষমতা ছাড়া সম্ভব নয় কিছুতেই।

    প্রফেসর বাগচী আর থাকতে না পেরে টেবিলে চাপড় মেরে বললেন – অলৌকিক না হাতি! বাই ডিকেন্স বোঝাই যাচ্ছে যে লোকদুটো সবার চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছে। তাড়াতাড়িতে কিছু জিনিস ফেলে যায়, যা ওই বিদ্‌ঘুটে ছেলে অ্যালেজেডলি গিলে খায়।

    অপূর্ববাবু তাঁর সরু গলায় বললেন – আপনি দুটো জিনিস ভুলে যাচ্ছেন – একঃ কামরার সব দরজা ভেতর থেকে লক ছিল। দুইঃ ছেলেটার রাতারাতি ক্যানাইন টুথ গজালো।

    ডাঃ নন্দী সায় দিয়ে বললেন – তিনঃ মূলতানি গরু!

    প্রফেসর রায় বললেন – কোনোটারই তো প্রমাণ নেই। পুরো জিনিসতাই তো মনগড়া হতে পারে ।

    শম্ভুবাবু উরুতে চাপড় মেরে বললেন--কার মনগড়া? আমি গুল দিচ্ছি বলছেন?

    সিধুবাবু জিভ কেটে বললেন-- ছি ছি ছি!

    শম্ভুবাবু বললেন – দেখুন প্যারাসাইকোলজি নিয়ে পনেরো বছর চর্চা করছি। হাজার হাজার প্যারানর্মাল বা পারলৌকিক ঘটনা আছে যার সাক্ষ্য প্রমাণ সব চোখের সামনে থাকলেও কিছু লোক চোখ বুজে বলবে – প্রমাণ নেই। আমি যে ঘটনাটা আপনাদের বললাম তার চরিত্রগুলি আমার খুব চেনা ও বিশ্বাসযোগ্য। ধনঞ্জয় বাবু আর কেউ নন আমার ঠাকুর্দা। সেই পাঁচ বছরের ছেলেটা বড় হয়ে কুইন্‌স্‌ ইন্ডিয়ান আর্মির ব্রিগেডিয়ার হয়। নাম ব্রজমাধব চৌধুরি-- আমার বাবা। এখনও বেঁচে আছেন, দার্জিলিংএ বাড়ি। আস্ত কাঁঠাল ভেঙে খান এই বয়সেও।

    --আর তাঁর সেই অতিরিক্ত ক্যানাইন দাঁত এখনও আছে। শুধু তাঁর নয়, আমারও আছে। এই বলে শম্ভুবাবু হাঁ করে দেখালেন তাঁর বাড়িতে গজদন্ত।--ওভারডোজের এফেক্টই হবে, দাঁতটা হেরেডিটারি হয়ে গেছে। যদিও আমারটা অনেক ছোট, তাই বাবার মত তেজ পাই নি। এগুলোও কি প্রমাণ নয়?

    প্রফেসর বাগচী বললেন-- আপনার বাবা সাহেব খেয়েছেন বলে দাবী করেন?

    শম্ভুবাবু বললেন – গুরুদেবের কৃপায় ওই পৈশাচিক ঘটনার কিছুই বাবার মনে নেই।

    প্রফেসর বাগচী বললেন – তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পুরো ব্যাপারটাই সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্সের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

    সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্সের কথাটা ওঠা মাত্র ঘরে একটা হৈ চৈ হট্টগোল পড়ে যায়। এর মধ্যে অপূর্বকৃষ্ণ বাবু একটা ছোট চামচ কাপে ঠুনঠুন করে ঠুকে শান্তি আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ওদিকে শম্ভুবাবু গলা তুলে বলেন-- শম্ভু চৌধুরির বিরুদ্ধে সাক্ষী দেবে কে ?

    গোলমাল কতক্ষণ চলত বলা মুশকীল। দেখা যায় অপূর্ববাবু, ডাঃ নন্দী ও সিধুবাবু ঘটনাটিকে অপেক্ষাকৃত অলৌকিক বলে মেনে নিতে রাজী আছেন। অন্যদিকে প্রফেসর বাগচী, প্রফেসর রায় ও ডাঃ সেন একাবারেই গররাজী। শম্ভুবাবুর গল্প বলে তাঁর ভোটাধিকার নেই-- কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন যে হাতাহাতির অধিকার সকলেরই আছে।

    নিঃসন্দেহে সেতাই শুরু হয়ে যেত। কিন্তু বড়ঘরের দরজাটা খুলে প্রবেশ করলেন মিসেস বাগচী। সঙ্গে একজন গৃহভৃত্য ও ট্রে ভর্তি ঘুগনির বাটি। শোরগোলের অপেক্ষাকৃত ছিলেন বোধহয়। তিনি ঢুকতেই সব চুপ। সিধুবাবু তাড়াতাড়ি সীট ছেড়ে উঠে পড়লেন। প্রফেসর বাগচী শুধু মিনমিন করে বললেন-- ম্যাগনেট, ম্যাগনেট।

    মিসেস বাগচী বললেন-- ডিস্টার্ব করলাম নাকি? পরে আসবো?

    সিধুবাবু তাড়াতাড়ি বললেন-- মোটেই না। শুভস্য শীঘ্রম্‌--আমাদের আলোচনাও শেষ। ভোট হবে এবার।

    প্রফেসর বাগচী বললেন – গাঙ্গুলিবাবু আসেন নি-- ছজনের মধ্যে আর কি ভোট হবে? টাই হয়ে যাছে তো!

    শম্ভুবাবু বললেন – মিসেস বাগচী তাহলে টাইব্রেকার ভোট--টা দিন।

    এরপর চা ও ঘুগনি সেবনের সাথে সাথে অপূর্বকৃষ্ণবাবু উকিলী কায়দায় নাটকীয়ভাবে গল্পটা সংক্ষেপে বিবৃত করলেন। সব শোনার পর মিসেস বাগচী শম্ভুবাবুর দাঁত দেখতে উঠলেন একবার।

    প্রফেসর বাগচী বললেন – ম্যাগনেট হে ম্যাগনেট! চুম্বকের খেলা। বাইরে থেকে চুম্বক ব্যবহার করে কামরার ভিতরে ছিটকিনি লাগানো হয়েছে।

    অপূর্বকৃষ্ণবাবু বললেন-- কিন্তু কেন? তাতে লাভ?

    প্রফেসর বাগচী বললেন – ধরুন সাহেবদের ধারনা হয়েছে যে ধনঞ্জয় বাবু আসলে পুলিশের গোয়েন্দা। তাঁর চোখে ধূলো দিয়ে ওদের পালাতে হবে। ছিটকিনিটা বন্ধ করে যেতে পারলে ধনঞ্জয়বাবু ভাববেন ওরা কূপের মধ্যেই আছে। ফলে পালাবার পর পুরো রাত এবং তারপর অন্তত একটা দিন পাওয়া যেতে পারে গা ঢাকা দেবার জন্য। ধনঞ্জয়বাবুর ছেলে অন্য কূপে না ঢুকলে কানপুরের আগে তিনি জানতেই পারতেন না যে সাহেবরা কামরায় নেই।

    প্রফেসর বাগচীর কথা শেষ হতে না হতেই আগের চেয়েও বেশী হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। অপূর্ববাবু পেন্সিল তুলে বললেন – আমি ভোট পাল্টাতে চাই। শম্ভুবাবু দুই ভারী হাতের থাবড়ায় টেবিল কাপিয়ে বললেন – অ্যাবসার্ড। কোম্পানির ডিরেক্টাররা ম্যাগনেট হাতে ঘোরে? প্রফেসর বাগচী বললেন – ম্যাগনেট না থাকলে সুতো দিয়ে করাও সম্ভব। দেখবেন ? মিসেস বাগচী চেঁচিয়ে উঠে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন – তুমি যত নষ্টের গোড়া! প্রফেসর বাগচী বললেন – প্রমাণ ছাড়া মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শম্ভুবাবু তখন সবার উপর গলা তুলে বললেন – এটা সারকামস্টানিশিয়াল এভিডেন্স নয়?

    বাক্‌বিতণ্ডার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে শিবু আর গদাই পা টিপে টিপে বড় ঘরের এক পাশ দিয়ে বাইরে চলে এসেছিল।

    বাইরে তখনও প্রজ্ঞাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। গেট থেকে অথর্বকে খুলে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে এসেছিল রাস্তায়। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটানো যায় একটু। কালো কাফুন পরা কোন ফক্র মার্কা লোক দেখা যাচ্ছিল না। শিবু গদাইকে হাঁ করতে বলেছিল। গদাই অত্যন্ত লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল সে তার উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া গজদন্তটা জিভ দিয়ে বারবার ঠেলছে। দূর রবীন্দ্র কলোনির সার বাঁধা ইউক্যালিপ্টাস গাছ থেকে সর্‌ সর্‌ করে হাওয়া এসে ক্রমশ ভিজিয়ে দিচ্ছিল তাদের।

    পরে গদাই এইসব বৃত্তান্ত টুকে রাখার জন্য ডায়েরির নতুন অধ্যায় খুলেছিল। পুলিশি তদন্তের সুত্র ধরে কীভাবে শিমলিপুর তার পুরোনো বাসিন্দাকে ফিরে পেয়েছিল সেই গল্প নিয়ে এই অধ্যায়। বহুদিন বাদে সেই অধ্যায়ের শেষে গদাই লিখেছিল – অলৌকিক বলে যদি সত্যি কিছু এতে থাকে তাহলে লৌকিক ঘটনারই অসম্ভাব্য যোগাযোগ, যা মাত্র একুশ দিনের মধ্যে সবার কাছে খুলে দিয়েছিল শিমলিপুরের মুখোশ। গদাই লিখেছিল – যে অনেকগুলি ঘটনার নুড়ি যখন একই পথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে হাঁটতে থাকে তখন তাকে বলে ঘটনার পাহাড়ে ধস। সবচেয়ে অলৌকিক হল এই যে আমরা প্রত্যেকে একই বিরাট বাস্তবকে দেখি এত আলাদা ভাবে যে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল সেতাই ম্লান হয়ে যায় আরো যা যা ঘটেনি বা ঘটতে পারত সেই সম্ভাবনার তুলনায়। শিমলিপুরের ইতিহাসের এই তিন সপ্তাহের অন্তত দুটো আলাদা বিবরণ গদাই নিজেই লিখেছিল দু--বছরের ব্যবধানে। তাদের ভিন্নতা দেখে সে বুঝেছিল যে এই ইতিহাসের যতজন পাঠক প্রায় ততজনই হয়ত হবে লেখক। বুঝেছিল যে প্রতিটি পাঠকের কর্তব্য বিশ্বাসের ছাঁকনিতে শিমলিপুরের ততটুকুই তুলে নেওয়া যা সে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সর্বান্তকরণে অভ্রান্ত বলে জানে এবং যেখানে ফিরে যাওয়া তার অসম্পূর্ণ ইচ্ছের মধ্যে একটা বলে মেনে নেওয়া যায়।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)