বিশাখা কিচেন প্ল্যাটফর্মের সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে কড়াইতে খুন্তি নাড়ছিল। এক ঝলক দেখে মনে হল উচ্ছে ভাজছে। আমাদের কিচেনটা বেশ বড়, খোলামেলা... ঢুকেই বাঁ-দিকে ডবল-ডোর রেফ্রিজারেটর, দেওয়ালের গায়ে ক্রকারি-ক্যাবিনেট, গ্যাস আভেনের ওপর শঙ্কুর আকৃতির চিমনি। আমি ঠান্ডা জলের বোতল বার করার জন্য রেফ্রিজারেটরের দরজা খুললাম। শব্দ পেয়ে বিশাখা ঘাড় ঘোরাল, আমায় দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ল, “এর মধ্যে ফিরে এলে?”
আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “মানে? কী বলছ শিখি? গেলাম কখন যে ফিরে আসব?”
বিশাখা ঝেঁঝে উঠল, “ন্যাকামি কোরো না। এই তো একটু আগেই ‘গোপালের দোকানে চা খেতে যাচ্ছি’ বলে রাগ দেখিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, “চা খেতে? কেন?”
বিশাখা গজগজ করছিল, “কেন আবার? করে দিইনি বলে… আবদার বলিহারি! রাজ্যের কাজ পড়ে আছে, এখন কি আমার চা বানানোর সময়! একটু তো বুঝবে…”
আমাদের বাড়িটা একতলা। ছাদের একধারে প্যারাপেট ওয়ালের গা ঘেঁষে গোটাকতক টব, হাস্নুহানা, বেলি, জুঁই… বিশাখাই নার্সারি থেকে কিনে এনে লাগিয়েছে। ছুটির দিনে সকালবেলা জলখাবার খেয়ে গাছগুলোর পরিচর্যা করতে ছাদে উঠেছিলাম। এত গরম, ঘেমেনেয়ে একসা হয়ে গিয়েছিলাম। গলাটা শুকিয়ে ঝাঁ-ঝাঁ করছিল। এক ঢোঁক জল খাওয়ার জন্য নিচে নেমে এসে এখন এই বিপত্তি। বিশাখাকে বোঝানো মুশকিল আমি ঘুণাক্ষরে ওর কাছে চায়ের জন্য বায়না করিনি। গোপালের দোকানে চা খেতেও যাইনি। আমার চপ্পল পায়ে গলিয়ে যে বেরিয়ে গেছে সে আমি নই, অন্য কেউ। জানতাম গুণময় ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ, তাই বলে...
গতকাল সন্ধেবেলা যখন অফিস থেকে ফিরছি গুণময় ছায়ার মত পিছু নিয়েছিল। একসময় ওর সঙ্গে স্যান্ডো গেঞ্জি ভাগাভাগি করে পরেছি। আমি ওর গায়ের গন্ধ চিনি। থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, “গুনো, ভাল হবে না বলছি। সামনে আয়।”
গুণময় বাধ্য ছেলের মত সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এক গাল হেসে বলেছিল, “জানতাম তোকে ধোঁকা দিতে পারব না।”
আমি হাসিনি। ব্যাটা যখনই আসে কিছু না কিছু ঝামেলা পাকায়। ভুরু কুঁচকে বলেছিলাম, “কী ব্যাপার? এবার কী মনে করে?”
গুণময় বলেছিল, “বলছি, বলছি, বাড়িতে নিয়ে চল তো আগে। সাত দিন চান করিনি। ফ্রেশ হয়ে সব বলব।”
আমি বলেছিলাম, “যা বলার এখানেই বল।”
গুণময় বলেছিল, “ভয় পাচ্ছিস? একবার বাড়িতে ঢুকলে আর বেরোব না?”
আমি হাত নেড়েছিলাম, “না, সেজন্যে নয়। বিশাখার শরীর বিশেষ ভাল যাচ্ছে না।”
গুণময়ের মুখ গম্ভীর হয়েছিল, চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে বিশাখার?”
আমি বলেছিলাম, “তেমন সিরিয়াস কিছু নয়। মেয়েদের পঞ্চাশ পেরোলে যা হয়, খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে দিনদিন, রাতে ঘুম হয় না... তাছাড়া মাইগ্রেনের সমস্যাটা আছেই, তুই তো জানিসই।”
গুণময় বলেছিল, “মনোজ, শোন, চাপ নিস না একদম। বিশাখা জানতেই পারবে না, আমি তোর সঙ্গে আছি।”
আমি বলেছিলাম, “মানে?”
“আজকাল বুঝলি, শরীরটাকে গুঁড়োগুঁড়ো করে কী করে পাঁচ ভূতে মিশে যেতে হয় বেশ শিখে গেছি,” গুণময় রহস্যময় হেসে বলেছিল, “এসব উচ্চমার্গের সাধনা, তুই বুঝবি না।”
গুণময়ের শুরুটা অবশ্য ছদ্মবেশ দিয়েই। ক্লাস এইটে ‘যেমন-খুশি-সাজো’ প্রতিযোগিতায় গুণময় রামকৃষ্ণ সেজেছিল। দাড়ি-টাড়ি লাগিয়ে অবিকল যুগপুরুষ। দাঁতের ফাঁকের শূন্যস্থানটুকু পর্যন্ত নিক্তি মেপে বানানো, এক সুতোর এদিক-ওদিক নেই। মনে আছে, সেদিন মা-মাসিমারা খোলা মাঠে রোদ্দুরের মধ্যে লাইন লাগিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল। বরেণের ঠাকুমা পাক্কা এগারো টাকা প্রণামী ধরে দিয়েছিলেন।
বাড়িতে ঢুকে দেখলাম বিশাখা মন দিয়ে বাংলা সিরিয়াল দেখছে। আমাদের দিকে ভাল করে নজর করল না। করলেও গুণময়কে দেখতে পেত কি না সন্দেহ। সে আমার পিঠের সঙ্গে মিশে, সেঁটে, পায়ে পা মিলিয়ে ভিতরে ঢুকে এল। গুণময়ের পিসির বাড়ি ছিল আমাদের পাড়ায়। তার বাবা-মা থাকতেন পুরুলিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সে টাউনে পিসির বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করত। আমাদের বাড়িতে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। এ বাড়ির অন্ধিসন্ধি তার চেনা। মা বলত, আমার দুই ছেলে মনো আর গুনো। মা আর নেই, তিন বছর হল চলে গেছে। চট করে মায়ের ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল গুনো।
গত রাতে খাওয়ার পর বাড়ির সামনে গেট খুলে বেরিয়ে ভুলোকে ডেকে যখন এঁটোকাঁটা বেড়ে দিচ্ছি, দেখি গুণময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বললাম, “কী রে, খিদে পেয়েছে?”
গুণময় উদাস হয়ে বলল, “ধ্যুর! তখন বললাম না, আজ আমি ভূত। ভূতেদের আবার খিদে-তেষ্টা কীসের?”
আমি বললাম, “রাত্তিরে যখন মেক-আপ খুলে মানুষ হবি, তখন যদি খিদে পায়, ফ্রিজ খুলে জ্যাম-পাঁউরুটি খেয়ে নিস।”
গুণময় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “রাত্তিরে আমার অন্য কাজ আছে।”
আমি বললাম, “তোর মতলবটা কী বল তো?”
গুণময়ের চোখ একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল। সে নিরীহ গলায় বলল, “কিছু না। একটা মুখোস আঁকব। অর্ধেক এঁকে ফেলে রেখেছি, শেষ করা আর হয়ে উঠছে না।”
গুণময়ের বাবা বলাইচন্দ্র সূত্রধর ছৌ নাচের মুখোস তৈরি করত। সেই মুখোস বানানোর অনেক হ্যাপা। মাটির ছাঁচের ওপর ছাই লাগিয়ে আট-দশ পরত কাগজ চেপকাও রে, বারবার রোদে ফেলে শুকাও রে... তার ওপর আবার মাটি লাগাও, আবার শুকোও। তারপর ছাঁচ খুলে মুখোসের ওপর কাপড় সেঁটে, পালিশ-টালিশ করে মুখ আঁকো।
গ্রাম থেকে ফেরার সময় বাতিল মুখোসগুলো গুণময় সঙ্গে করে নিয়ে আসত। তারপর তার ওপর নিজে-নিজেই রং বুলোত। কোনও দিন সন্ধেবেলা ফুটবল খেলা হয়ে গেলে, গোলপোস্টের নিচে যে জায়গাটায় পায়ে-পায়ে ঘাস উঠে টাক বেরিয়ে যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে সে মুখে মুখোস চড়াত। গুণময়ের মুখে একবার মুখোস উঠলে তাকে আর সেই সব ভীমপরাক্রম পৌরাণিক চরিত্রদের থেকে আলাদা করা যেত না। গুণময়দের পাশের গ্রামে কে এক মাহাতো-কাকা ছিল, তার কাছে ছৌ নাচ শিখেছিল গুণময়, বাপকে লুকিয়ে। গুণময় পড়াশুনো ছাড়া অন্য দিকে মন দিক তার বাপ মোটেই চাইত না। কিন্তু ভবিতব্যকে কে বদলাতে পারে? পড়ে আসা আলোয় আমরা অবাক হয়ে দেখতাম জটায়ু-বধ পালা। কখনও সে অরুণ-তনয় দৈবপক্ষী জটায়ু, আবার কখনও তস্কর চূড়ামণি দশানন রাবণ, লম্ফঝম্ফ দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে যেত।
আমায় চুপ করে থাকতে দেখে গুণময় বলল, “ভয় পেলি নাকি?”
আমি বললাম, “তোকে বিশ্বাস নেই। আগের বার যা ফ্যাসাদে ফেলেছিলি!”
গুণময় বলল, “কী করব, লুকোনোর দরকার পড়লে তোদের বাড়ির কথাই আগে মনে পড়ে যে।”
বছর পাঁচেক আগেও পুলিশের তাড়া খেয়ে সে নিশুতি রাতে আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিল। মাস খানেক ছিল সেবার। কখনও নিজের মুখে বলেনি যদিও, আমার ধারণা গুণময় কোনও গুপ্ত সংগঠনের সদস্য। জিজ্ঞেস করলে হেসে পাশ কাটিয়ে যেত। এমন নয় সারাদিন বাড়িতে বসে থাকত। গা ঢাকা দিয়ে এদিক-সেদিক যেত, সবার অগোচরে ফিরে আসত। একটা ডুপ্লিকেট চাবি রাখা থাকত ওর কাছে। যদিও তাকে সর্বক্ষণ চোখে দেখা যেত না। কিন্তু সে যে আছে পরিষ্কার টের পাওয়া যেত। বিশাখা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। একটা মানুষ আছে আবার নেই। কতদিন সহ্য করা যায়? আমাকে কথা শোনাত, “লোকটার কোনও আক্কেল-বিবেচনা নেই। এই ভাবে কেউ অনন্তকাল অন্যের বাসায় পড়ে থাকে নাকি? বন্ধুর উপার্জনের অন্ন ধ্বংস করতে লজ্জা করে না?”
গুণময় চলে যাওয়ার পরে অবশ্য বিশাখার একটু মন খারাপ হয়েছিল। না বলে-কয়ে চলে গেলে কার ভাল লাগে? একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখেছিলাম, ডাইনিং টেবিলের ওপর একটা মুখোসের পাশে রিঙে লাগানো ডুপ্লিকেট চাবিটা পড়ে আছে। সাধারণত কোনও পরিচিত মুখের আদলে একটা মুখোস তৈরি হয়। কিন্তু অনেক পর্যবেক্ষণ করেও মুখোসের মানুষটা যে কে, আমরা চিনতে পারিনি। একটা অতি সাধারণ মেহনতি মুখ, গালের চামড়া শিথিল হয়ে এসেছে, কপালে ভাঁজ, চোখের কোণে পাখির পা। বিশাখা মুখোসটা ভাঁড়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছিল যাতে চট করে অতিথি-অভ্যাগতদের চোখে না পড়ে। আমি গুণময়কে বললাম, “তোর এত লুকোনোর দরকার পড়ে কেন?”
গুণময় ঠোঁট উলটে বলল, “তোদের এই পচা-গলা সমাজটা আমাদের মত সাধু-সন্তদের সহ্য করতে পারে না, তাই। তবে আজকাল আর অসুবিধে হয় না, বুঝলি! জুতসই একটা মুখোস লাগিয়ে নিলেই ব্যস, হাজার খুঁজলেও কেউ আর পাত্তা পাবে না।”
আমি অনুসন্ধিৎসু হয়েছিলাম, “এবার কার মুখ আঁকছিস?”
মাঝ রাত্তিরের গলি কাঁপিয়ে গুণময় হেসে উঠেছিল। সেই হাসিতে উল্লাসের সঙ্গে খানিকটা বিদ্রুপও মিশে ছিল মনে হয়। নাকি অনুকম্পা? ভুলো ভয় পেয়ে খাবার ছেড়ে দু’-পা পিছু হটে গিয়েছিল। তখনও বুঝিনি গুণময় আমার মুখের আদলে মুখোস আঁকছে। আর পরের দিন সেই মুখোস পরে বিশাখাকে বোকা বানাবে। ছেলেটা যে আস্ত শয়তান সেই নিয়ে আদৌ কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু সেই শয়তানির দায়-ভার যে আমাকে নিতে হতে পারে কোনওদিন ভাবিনি। বিশাখার কাছে সাফাই দিয়ে লাভ নেই। মনে মনে ভাবলাম, গুনো মহারাজ, আজ বাড়ি ফেরো, তোমায় কী করে শায়েস্তা করতে হয় আমি জানি।
২
রাত্তিরে বিশাখা ঘুমিয়ে পড়লে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে, পা টিপে টিপে মায়ের ঘরে ঢুকলাম। গুণময় যেন আমার অপেক্ষাতেই বসে ছিল। ঘরে ঢুকতেই বলল, “কী রে, এত দেরি হল?”
রাগে আমার মাথা জ্বলছিল, বললাম, “তুই ভেবেছিস কী? যা প্রাণ চায় করবি আর আমি মুখ বুজে মেনে নেব?”
গুণময়ের মুখ দেখে মনে হল ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, বলল, “আহা, চটছিস কেন? কী হয়েছে বলবি তো?”
আমি গসগস করে বললাম, “তুই কোন আক্কেলে তোর ওই অখদ্যে মুখোসে আমার মুখ এঁকেছিস? আবার জিজ্ঞেস করছিস কী হয়েছে?”
গুণময় বলল, “ওহ, ধরে ফেলেছিস? এঁকেছি তো কী হয়েছে? তুই শালা কোন লাটের বাঁট যে আগে পারমিশন নিয়ে তারপর তোর থোবড়া আঁকতে হবে? বেশ করেছি এঁকেছি। যাহ, যা পারিস কর গিয়ে।”
আমি বললাম, “গুনো, ভাল চাস তো এই মুহূর্তে মুখোসখানা আমার হাতে দে। নইলে কান ধরে বাড়ি থেকে বার করে দেব।”
“বাড়িটা কি তোর একার?” গুণময় ঠোঁট বেঁকাল। দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “একবার ওই ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে দেখ না।”
দেখলাম মায়ের ছবিটায় একটা মালা চড়িয়েছে গুণময়। বললাম, “বাজে কথা রাখ। আজ সকালে তোর জন্য বিশাখার কাছে ঝাড় খেয়েছি। তুই ওই মুখোস পরে একদম বিশাখার কাছ ঘেঁষবি না, এই বলে দিলাম।”
গুণময় খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসল, বলল “এবার বুঝলাম, তোর আসল ব্যথা কোথায়?”
আমি বললাম, “আস্তে, বিশাখা ঘুমোচ্ছে। তোর ধান্ধাটা কী বলতো? আচমকা আমাকে নিয়ে পড়লি কেন?”
গুণময় বলল, “না-হলে তোদের পার্টি অফিসে এন্ট্রি পেতাম কী করে? তাও তো পৌরপিতা শ্রীযুক্ত বিধান চন্দ্র সান্যালের সঙ্গে দেখা হল না। মালটা মহা হারামী। বৌকে পার্টি অফিস যাচ্ছি বলে বেরিয়ে নাকি হামেশাই ব্যারাকপুরে গিয়ে বসে থাকে। শুনলাম সেখানে অন্য একটা মেয়েমানুষ পেলে রেখেছে। খবরটা আগে জানলে...”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে? তুই আমি সেজে বিধানদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলি? কেন? বিধানদার সঙ্গে তোর কী কাজ?”
গুণময় বলল, “তুই জানিস, লোকটা কী করেছে? মাস মার্ডার। জমি দখল করার জন্য মজদুরদের একটা বস্তি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। রাত্তিরবেলা মানুষগুলো অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। মেয়ে-মদ্দ মিলিয়ে মোট তেইশ জন পুড়ে মরেছিল, তার মধ্যে সাতটা দুধের বাচ্চা।”
আমি বললাম, “গঙ্গার ধারে ইটখোলার পাশে যেখানে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংটা উঠছে তুই সেই জায়গাটার কথা বলছিস তো? যে দিন ওই বস্তিটা পুড়েছিল সেদিন বিধানদা টাউনেই ছিল না। জামশেদপুরে মেয়ের বাড়ি গিয়েছিল।”
গুণময় আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “অনেক খবরই রাখিস দেখছি। তাহলে এটাও নিশ্চয়ই জানিস যে জানোয়ারের দল দর্মার বেড়া দেওয়া ঘরগুলোয় আগুন লাগিয়েছিল তারা সবাই তোর বিধানদারই পোষা গুণ্ডা, নিমাই, কালু, মথুর, সাধন... পুরো লিস্টটা আমার মোবাইলে সেভ করা আছে। দেখবি?”
আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম, “তুই কী চাস গুনো?”
“মৃত্যু,” বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় গুণময় বলল, “শাস্তি ওদের পেতেই হবে মনোজ। আমি কাউকে ছাড়ব না। সব হিসেব গুনেগেঁথে চুকিয়ে দিয়ে তবে আমি যাব।”
আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল। বলে কী ছেলেটা? আমার মুখ আঁকা মুখোস পরে মানুষ খুন করতে চায়। বললাম, “আমাকে ফাঁসাতে চাস? আমি কী দোষ করেছি?”
গুণময় ম্লান হাসল, “তুই এই শয়তানগুলোকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাস না?”
আমি অধৈর্য গলায় বললাম, “চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? খুন-জখম আমার জন্য নয়, রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘোরে।”
গুণময় বলল, “সে সব আমার ওপর ছেড়ে দে, আমি বুঝে নেব।”
আমি বললাম, “তুই তো মুখোস খুলে রেখে কেটে পড়বি, পুলিশ এসে আমায় ধরবে। জেলে যাব আমি। যাবজ্জীবন, এমনকি ফাঁসি হওয়াও আশ্চর্য নয়।”
গুণময় যেন একটু আশ্চর্য হল, বলল, “ও, তুই ভাবছিস আমি ওই মুখোসটা পরে বিধান সান্যালকে খুন করে ফেরার হব, আর তুই কলে পড়বি?”
আমি বললাম, “এই তো সেদিন টিভিতে একটা সিনেমা দেখাচ্ছিল, প্রস্থেটিক লাগিয়ে একজন মানসিক রোগী একের পর এক খুন করছে, আর পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে অন্য কেউ।”
গুণময় ন্যাকা সেজে বলল, “হে, হে... আইডিয়াটা মন্দ দিসনি, মনো।”
আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম, “বিশাখার কী হবে ভেবে দেখেছিস?”
গুণময় বলল, “ভাবিস না। দরকার হলে বিশাখার দেখভাল করার দায়িত্ব আমি নেব।”
বিশাখার প্রতি যে গুণময়ের যে একটা হালকা দুর্বলতা আছে, সে সংশয় আমার অনেক দিনের। গুণময় এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছে না তো? আমি জিজ্ঞেস করলাম, “দেখভাল মানে? মুখোস পরে না মুখোস খুলে?”
গুণময় লম্বা করে হাই তুলল, “তুই যাতে কম্ফর্টেবল।”
আমি খোলা জানলার বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বিষাদকাতর গলায় বললাম, “সে কি আর আমি দেখতে আসব রে?”
গুণময় আমায় সান্ত্বনা দিল, “এত ভেঙে পড়ছিস কেন? এমনও তো হতে পারে খুনি কে পুলিশ জানতেই পারল না। এতদিন যখন ওরা আমায় ছুঁতে পারেনি, এখনও যে হদিস করতে পারবে তার গ্যারান্টি কী?”
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম গুণময় আমার দিকে আড়চোখে দেখছে। লক্ষ করছে আমি ওর কথায় আশ্বস্ত হলাম কিনা। আমার কেমন সন্দেহ হল, গুণময় ইচ্ছে করেই ঘটনাস্থলে এমন কিছু প্রমাণ ছেড়ে আসবে যাতে আমার সন্ধান পাওয়া যায়। হয়তো গিয়ে কাছাকাছি কোনও সি সি টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবে বা সিকিউরিটির সঙ্গে ঝগড়া বাঁধাবে, তারপর বিধানদাকে খুন করে কেটে পড়বে। হঠাৎ মনে হল, আমি যদি এখনই গিয়ে গুণময়ের ছকটা পুলিশকে জানিয়ে দিই, তাহলে কেমন হয়! সেক্ষেত্রে ভগবান না করুন, বিধানদার কিছু হয়ে গেলে পুলিশ আমায় ব্যস্ত করবে না। এমনকি বিধানদার অপঘাতে মৃত্যুটাও হয়তো এড়ানো যাবে। কেউ যতই দোষী হোক না কেন, আমি ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট সমর্থন করি না। তাছাড়া গুণময় যেটা করতে চাইছে সেটা সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কী? সবাই যদি হাতে আইন তুলে নেয় দেশে অরাজকতার শেষ থাকবে না।
“তুই কি পুলিশের কাছে যাবি ভাবছিস?” আমি চমকে উঠলাম, ব্যাটা কি হাত গুনতে জানে? গুণময় হাসল, “এখনও ছেলেমানুষই রয়ে গেলি। তোর কি মনে হয় পুলিশ তোর একটা কথাও বিশ্বাস করবে?”
আমি হাত ওলটালাম, “অগত্যা…”
গুণময় বলল, “তুই তো দেখছি আচ্ছা গাঁড়োল। ডেকে ডেকে বাঁশ নিতে চাইছিস। এখন যদি পুলিশের কাছে যাস, বিধান সান্যাল খুন হওয়ার পর সব থেকে প্রথমে ওরা তোকেই ইন্টারোগেট করবে।”
গুণময় মিথ্যে বলছে না। একজন লোক অন্যের মুখোস পরে মানুষ খুন করতে যাচ্ছে, তাকে কেউ চিনতে পারছে না – এ সব সিনেমা-টিনেমাতেই হয়, বাস্তবে বাঁধাঘাটে নেমে গঙ্গাজল ছুঁয়ে বললেও কেউ মানবে না। তারা তো আর গুণময়কে চেনে না বা গুণময়ের মুখোস নির্মাণের দক্ষতার সঙ্গে পরিচিত নয়।
গুণময়কে থামাতে না পারলে আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তো হবেই, গোটা টাউনে হুলুস্থুল বেঁধে যাবে। আমি বললাম, “দেখ গুনো, আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। ঝামেলায় জড়াতে চাই না। কাল সকালেই আমি বিশাখাকে নিয়ে পুরি বা বেনারস চলে যাচ্ছি। তারপর তোর যা প্রাণ চায় কর।”
“ভাবছিস টাউন ছেড়ে চলে গেলেই অ্যালিবাই পেয়ে যাবি? পুলিশ তোকে এত সহজে ছেড়ে দেবে মনে করেছিস?” গুণময় হাতের উলটো পিঠ দিয়ে হাই চাপা দিয়ে বলল, “তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি কোনও ট্রেনে রিজার্ভেশনও পাবি না।”
গুণময়ের জাল কেটে বার হবার কোনও উপায় না পেয়ে আমার মাথার মধ্যে নিষ্ফলা রাগটা আবার ফিরে আসছিল। বললাম, “ঠিক আছে। আমার কথা যখন শুনবিই না, আমিও দেখছি কী করা যায়। সাধন-নিমাইদের কথা বলছিলি না... গোপালের চায়ের দোকানে রোজ সকালে ওরা চা খেতে আসে। কাল ওদের গিয়ে আমি সব কথা জানাব। তারপর ওরা যা ভাল বুঝবে...”
কথার মাঝখানেই হাত ঝেড়ে আমায় নস্যাত করে দিয়ে গুণময় বলল, “মনো, অনেক বোর করেছিস, এবার শুতে যা। আমার বেধড়ক ঘুম পাচ্ছে।”
চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। গুণময়কে মায়ের ছবির নিচে ছেড়ে আমি উঠে এলাম।
৩
সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হল। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে মনে হল এমন তো নয় যে গুণময় পাতি ঢপ দিচ্ছে। পার্টি অফিসে গিয়ে সরজমিনে খোঁজখবর করা দরকার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই লোকজন এসে পড়েছে। বিধানদার আসার কথা থাকলে একটু বেশি জমায়েত হয়। না-হলে দু’-চারটে ছেলে-ছোকরা জুটে চা-সিগারেট খায়, গুলতানি করে। কাউকে না কাউকে পেয়ে যাবই। বাসি পাজামার ওপর পাঞ্জাবি গলিয়ে বাজারের থলেটা নিয়ে বেরোলাম, ফেরার সময় সব্জি বাজারও ঘুরে আসব। আমাদের গলিটা থেকে বেরিয়ে মোড় ঘুরেই পার্টি অফিস। সামনে এসে হতাশ হয়ে দেখলাম দেখলাম দরজায় তালা ঝুলছে। পাশেই গোপালের চায়ের গুমটি, গোপাল আমায় দেখে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল। গুমটির সামনে রাখা আম কাঠের বেঞ্চটা হাতের গামছা দিয়ে ঝেড়ে গদগদ হয়ে বলল, “মনোজদা, বসুন। লেবু চা বানিয়ে দিই? অল্প বীটনুন দিয়ে?”
ক্বচিৎ কদাচিৎ গোপালের দোকানে চা খাই। আজ এত খাতির কেন কে জানে? পার্টি অফিসের বন্ধ দরজা দেখিয়ে গোপালকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, আজ এখনও কেউ আসেনি?”
গোপাল বলল, “গতকাল আপনি কালু আর সাধনকে যা ধ্যাঁতানি দিলেন, ক’দিন ওরা আর এমুখো হবে ভেবেছেন? ওহ্, এমন রামক্যালানি ওরা বাপের জন্মে খায়নি। সাধনকে তো শুনলাম হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল, মাথায় তিনটে স্টিচ পড়েছে।”
আমি সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, “বলিস কী?”
গোপাল বলল, “মনোজদা, আপনি ভেতরে ভেতরে যে এই রকম চণ্ডাল রাগ পুষে রেখেছেন কোনওদিন বুঝতে পারিনি। আপনাকে পায়ে হাত দিয়ে পেন্নাম করতে ইচ্ছে হচ্ছে। বিধানদার আস্কারা পেয়ে ছেলেগুলো একেবারে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল।”
গুণময় তার মানে অলরেডি অ্যাকশনে নেমে পড়েছে। আমি গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “বিধানদা জানে?”
গোপাল বলল, “জানে নিশ্চয়ই। তবে জেনে আর কী করবে? তার কি এখন মরার সময় আছে? আজ বিকেলে হাসপাতাল মাঠে জনসভা আছে। মন্ত্রী-টন্ত্রী আসবে, সেই নিয়ে সে সাংঘাতিক ব্যস্ত।”
আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে গোপাল চা আনতে গেল। আমি বসে বসে ভাবছিলাম, বিধানদাকে যদি টপকাতে হয় ভিড়-ভাড়, চিৎকার-চেঁচামেচি, বিশৃঙ্খলা অতি আদর্শ পরিবেশ। গুণময় কি এমন সুবর্ণ সুযোগ ছেড়ে দেবে? গোপাল কাচের গ্লাসে চা এনে দিল। এক চুমুক দিয়ে দেখলাম লিকার বেশি হয়ে গেছে, লেবুর রসেও তিতকুটে ভাব যায়নি। অর্ধেক খেয়ে নামিয়ে রাখলাম। গোপালকে চায়ের দাম দিতে গেলে সে কানে হাত ছুঁইয়ে বলল, “কী যে বলেন দাদা! আপনার কাছ থেকে চায়ের দাম নিলে আমার পাপ লাগবে না?”
পাপ পুণ্যের বিচার কে করে? গোপাল জানে না, আমি নেহাত স্বার্থপরের মত কোনওমতে নিজের পিঠ বাঁচানোর কথা ভাবছি। মজদুরদের বস্তি জ্বালানো অপরাধীরা শাস্তি পেল কি পেল না তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমার ঘরে আগুন না লাগলেই হল। এখন মনে হচ্ছে গুণময় সেটা করার জন্যই উঠে পড়ে লেগেছে। মুখোস পরেই হোক, কিংবা মুখোস ছাড়া, আমার অবর্তমানে বিশাখা কি গুণময়কে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেবে? গুণময় বিশাখার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকবে, এক বিছানায় শোবে... তার গায়ে হাত দেবে, তাকে ভালবাসবে, ভাবলেই আমার বুকের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমি গোপালের চায়ের দোকান ছেড়ে পা বাড়ালাম। বাজার করার সময় পড়ে আছে, আপাতত গুণময়কে নিরস্ত করা দরকার। যেন তেন প্রকারেণ তাকে আটকাতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
বাড়িতে ঢুকেই বিশাখার সামনে পড়ে গেলাম। সে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল। খালি থলে দেখে তার মুখ ভার হল, বলল, “বাজারে যাবে না-ই যখন, ঢং করে থলে হাতে করে বেরিয়েছিলে কেন?”
আমি বললাম, “পেটটা ব্যথা করে উঠল…”
বিশাখা বলল, “পেটের আর কি দোষ? ক’দিন ধরে দেখছি যা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলছ, একাই দু’-জনের খোরাক সাবাড় করে দিচ্ছ।”
তার মানে বিশাখা এখনও গুণময়ের উপস্থিতি খেয়াল করেনি। ভাবছে আমিই... ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম গুণময় মায়ের ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে, আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছে। আমায় দেখে ফিচেল হেসে বলল, “কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে দে তো। সকালে দাস্ত সাফ হয়নি।”
আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, “একটু দাঁড়া, দিচ্ছি…”
পা টিপে টিপে শোওয়ার ঘরে ঢুকলাম। বেডসাইড টেবিলের ওপর একটা প্লাস্টিকের বাক্সোয় বিশাখার রোজকার ওষুধ থাকে। ঘেঁটেঘুঁটে সেখান থেকে ঘুমের ওষুধের পাতাটা খুঁজে, পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে আবার নিঃশব্দে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। নিজের বাড়িতে এই ভাবে চোরের মত চলাফেরা করতে হবে কোনোদিন ভাবিনি। কিচেনে ঢুকে চায়ের জল বসিয়ে ওষুধের পাতা ছাড়িয়ে যে কটা বড়ি অবশিষ্ট ছিল ঢেলে দিলাম। তারপর চায়ের পাতা। ফুটুক, খুব ফুটুক জল! এবার বাবা গুণময়! ঘুঘু দেখেছ, ফাঁদ দেখনি। আপাতত চা খেয়ে, পড়ে পড়ে ঘুমোও। ওদিকে বিধানদা সভা-টভা সেরে নিক। আমিও মায়ের ঘর হাঁটকে দেখি, আমার চাঁদমুখ আঁকা মুখোসখানা তুই কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস।
গুণময়ের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে বেরিয়ে আসতে না আসতেই বিশাখা ডাকল। কাছে যেতে বলল, “একখানা চেয়ার এনে আমার পাশে বসো।”
আমি বললাম, “রোদ উঠে গেছে, তাত আসছে, ভিতরে গিয়ে বসলে হত না?”
বিশাখা আমার দিকে কঠিন চোখে তাকাল। আমি বাধ্য ছেলের মত ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে তার পাশে বসলাম, বললাম, “বলো, কী বলবে?”
বিশাখা ঠান্ডা গলায় বলল, “গুণময় আবার এসেছে, তাই না?”
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়। আমি আমতা আমতা করে বললাম, “না, মানে...”
বিশাখা বলল, “আমার কাছে লুকিও না।”
কোনদিনই বা তার কাছে কিছু লুকোতে পেরেছি। মাথা নিচু করে বললাম, “হ্যাঁ।”
বিশাখা জিজ্ঞেস করল, “এত অস্থির হয়ে আছ কেন? নিশ্চয়ই কিছু গোলমাল হয়েছে?”
আমি আর পারলাম না। বিশাখার হাত দুটো ধরে বললাম, “আমাকে বাঁচাও, শিখি। তোমাকে ছেড়ে থাকতে হলে আমি মরে যাব।”
বিশাখা হাত ছাড়িয়ে নিল না। বলল, “কী হয়েছে, বিশদে বলো আমায়।”
বিশাখাকে সব কথা বললাম। এমনকি চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে গুণময়ের হাতে তুলে দিয়ে এসেছি, সে কথাটাও বাদ দিলাম না। সব শুনে-টুনে বিশাখা উঠে দাঁড়াল। আমার হাতে টান দিয়ে বলল, “এসো আমার সঙ্গে। দেখি তোমার গুনোর কত ক্ষমতা।”
মায়ের ঘরে ঢুকতে হল না। তার আগেই ডাইনিং টেবিলের ওপর মুখোসটা দেখতে পেলাম আমরা। চায়ের কাপের পাশে। কাপটা কানায় কানায় ভর্তি। গুণময় তাতে ঠোঁট ছোঁয়ায়নি। নিশ্চয়ই আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনছিল। তারপর যথারীতি পিছনের দরজা খুলে পালিয়ে গেছে। মুখোসের নিচে এক চিলতে কাগজ চাপা দেওয়া ছিল। বিশাখা দেখার আগেই আমি সেটা হাতের মুঠোর মধ্যে লুকিয়ে ফেললাম। বিশাখা কাছে এসে মুখোসটা দেখে বলল, “কী আশ্চর্য! অবিকল তুমি!”
এক হাতের মুঠোয় গুণময়ের ফেলে যাওয়া কাগজ। আমি অন্য হাতে মুখোসটা তুলে নিরীক্ষণ করে দেখলাম, গুণময় বানিয়েছে ভাল। মুখোস না মুখ বোঝা যাচ্ছে না। বললাম, “কিন্তু ব্যাটা মুখোসটা ছেড়ে গেল কেন?”
বিশাখা বলল, “ধরা পড়ে গেছে তাই। বুঝতে পেরেছে পুলিশকে ফাঁকি দিলেও আমার সঙ্গে কোনোরকম জারিজুরি চলবে না।”
মাথাটা হালকা লাগছিল। বিশাখাকে বললাম, “গেছে, আপদ গেছে। এক কাজ করো, তুমি পরোটা আর হিং-পাঁচফোড়ন দিয়ে আলুর চচ্চড়ি বানাও। খেয়ে-দেয়ে বেলার দিকে বাজার যাব।”
বিশাখা ভাঁড়ার ঘরে ঢুকল। আমি মুঠো খুলে দেখলাম, চিলতে কাগজটায় গুনো লিখে রেখে গেছে, ‘তুই কী বোকা রে মনো! মুখোস আঁটলেই কি আর গুনো থেকে মনো হওয়া যায়? তাও আবার ছৌ নাচের! হে, হে...’
মরেছে, তার মানে মুখোস-টুখোস নয়। গোপাল তবে কাকে দেখল? বিশাখা কাকে আমি ভেবে ভুল করল? রাত্তিরে বিশাখার সঙ্গে বিছানায়... নেমকহারাম গুনো কি তবে শুধু মুখ নয়, এই ক’দিন আমার পুরো শরীরটাকেই দখল করে বসেছিল? আমি তবে কোন জাহান্নমে গিয়েছিলাম? আমার অস্থির লাগছিল। মনটাকে অন্যদিকে নেওয়ার জন্য আমি টিভি চালালাম। দেখলাম, খবরের চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ আসছে, আজ সকালে পৌরপ্রধান বিধান চন্দ্র সান্যাল নিজ বাসভবনের সামনে ছুরিকাহত। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী আততায়ী একজন সাধারণ মজদুর গোত্রের মানুষ। অন্তত দূর থেকে দেখে তাই মনে হয়েছে। খুনি পলাতক। খুনের পর অলৌকিক ভাবে সে হাওয়ায় মিশে যায়। সাধারণত এই সব ছুটকো-ছাটকা খুন-জখম খবর-ওয়ালাদের নজরে আসে না। আকছার ঘটছে, কত আর রিপোর্ট করা যায়। তবে সামনের বিধানসভা নির্বাচনে বিধানদার টিকিট পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল। তাই হয়তো...
বিশাখা ভাঁড়ার ঘর থেকে চেঁচিয়ে বলল, “ও মা, দেওয়াল থেকে মুখোসটা কে খুলে নিল?”
আমি উঠে গিয়ে দেখলাম গুণময় আগের বার যে মুখোসটা ছেড়ে গিয়েছিল, সাধারণ এক মজদুরের মুখ... বিশাখা যেটা ভাঁড়ার ঘরের শোভা বর্ধন করার জন্য দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিল, সেটা বেমালুম গায়েব। মুখোসের নিচে চাপা পড়ে থাকা দেওয়ালের অপেক্ষাকৃত ফরসা জায়গাটুকু আমাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাংচাচ্ছে।
বিশাখা বলল, “যাহ, অত সুন্দর জিনিসটা তোমার বন্ধু চোট করে দিল।”
কেমন মনে হল, ওই হারিয়ে যাওয়া মুখোসটার বর্তমান ঠিকানা আমি জানি। অবশ্য বিশাখার কাছে কথাটা ভাঙলাম না। বললাম, “ওখানে অন্য মুখোসটা টাঙিয়ে দিলেই হবে।”
বিশাখা বলল, “নাহ, এমনিতেই তোমার মুখ দেখতে দেখতে আমার বিঘ্নি ধরে গেছে। তার ওপর রাতদিন যদি মুখোসটা চোখের সামনে ঝোলে... তার চে’ বরং ওটাকে আমি পুড়িয়েই ফেলব।”
মুখোসটা আমার হাতে ধরা ছিল। বিশাখা সেটা জোর করে কেড়ে নিল।