• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • ডুপ : চিন্ময় বসু



    ‘হোয়াই ব্যাড থিংস হ্যাপেন টু গুড পিপল‘ নামে একটা ইংরাজি বই এক বন্ধু আমায় দুঃসময়ে উপহার দিয়েছিল। নামের বাংলা অর্থ 'ভালো মানুষের খারাপ কেন হয়'। এক ইহুদী পুরোহিতের লেখা, লেখকের নাম হেরল্ড কুস্নার। ওঁর বড় আদরের ছেলেটা বেড়ে উঠতে থাকে, কিন্তু ছেলের চেহারার পরিবর্তন খুশির বদলে, চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় ধীরে ধীরে।

    বছর তিন-চার বয়স থেকেই নজরে পড়ে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে, অনেক প্রার্থনার পরে রোগটার বিষয়ে জানতে পারেন। এই রোগের নাম প্রিজরিয়া! জানতে পারেন ওঁর ছেলের দেহের ভেতরে যে ঘড়ি আছে, তা অনেক দ্রুত গতিতে চলছে। জগতে সবার শরীরের বয়স যখন একটা বছর কেটেছে, পুরোহিতের ছেলের দেহের বয়স পাঁচ বছর বেড়ে গেছে। দশ বছর বয়সে তার শরীরের বয়স বাবার থেকেও বেশি, চোদ্দ বছর বয়সে লোলচর্ম বৃদ্ধ! চোখের সামনে চোদ্দটি বছর ধরে ছেলেকে শৈশব থেকে, যৌবন পেরিয়ে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছাতে দেখলেন। আর তার পরে এক দিন, সন্তানের চোদ্দ বছরের বৃদ্ধ শরীরটা ওঁর চোখের সামনে পঞ্চভূতে লীন হয়ে গেল। মর্মান্তিক দুঃখে, আজীবন ভগবানে উদ্দিষ্ট জীবনে কেন এমন হলো, তার উত্তর খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন। দুঃখী মানুষদের সেই দুঃখ বহন করার শক্তি দিতেই লিখেছিলেন বইটা।

    *

    আমাদের ডুপের গল্পও যেন সেই পুরোহিতের পুত্রের জীবনের কাহিনী, প্রিজরিয়ার কাহিনী। ঘরে এল, ছোট্ট ঘি রঙের বড় বড় লোমে ঢাকা, একটা যেন উলের বল। বয়স দু’ মাস। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো। নেচে, কুঁদে, আনন্দ করে, রাগ করে, দুঃখ করে, চেঁচামেচি করে দিনগুলোকে আমাদের অবিমিশ্রিত আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে রেখেছিলো। বেশ কিছু বছর পরে প্রথম একদিন যখন মনে হলো যে, ও যেন আগের মত অত দৌড়োদৌড়ি, আনন্দ, হইচই করছে না, ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বলছে, ‘আমি আর পারবো না’, মনটা খারাপ হয়েছিল। বুঝিয়েছিলাম নিজেকে, জীবনের কিছু নিয়মকে তো মানতে হবেই। ছোট্ট শিশু থেকে চোখের সামনে বৃদ্ধ হতে দেখলাম। সতেরো বছর দিয়েছিলো সঙ্গ আমাদের। সেই স্মৃতির বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে আছে সব ঘরে, বিভিন্ন দেওয়ালে, লেখার টেবিলে; সব জায়গাতেই আমাদের ডুপু আমাদের সাথেই জড়িয়ে, ছড়িয়ে আছে।

    ত্রিশ বছর আগে, মধ্যবিত্ত পরিবারে কুকুর পালনের তেমন চল ছিল না। পোষার কুকুর মানেই বিদেশী কুকুর, রাস্তায় ঘোরা দেশি কুকুর নয়। বিদেশী কুকুরেরা দেখতে সুন্দর হয়, দামও বেশি। যত বড়লোক, তত দামি কুকুর। নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে কমই কুকুর পুষতে দেখা যেত, তবে সে কুকুরেরা সাধারণত যাদের আমরা বলি ‘দেশি’। পাড়ার কালু বা ভুলুরাও চায়ের দোকানের মালিক বা রাস্তায় নানা খেলা দেখিয়ে জীবিকা উপার্জন করা মানুষের আদরের পোষ্য হয়ে আনন্দে দিন কাটিয়েছে। বিত্তসম্পন্ন বাড়ির কুকুরদের থেকে সম্ভবত বেশি সুখেই। ওরা যে আদর ভালোবাসা পেয়েছে, তা নিখাদ মনের। তাদের জাতের নামের ও দামের সাথে জড়িয়ে থাকা মালিকের আত্মশ্লাঘাময় পরিচর্যায় নয়।

    দিল্লিতে অফিসার কলোনিতে দেখা গেছে, কিছু দামি কুকুর উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়ায়। মালিক বদলি হয়ে চলে যাওয়ার সময়, এরোপ্লেনে কুকুর নেয়ার ঝামেলা বা ভাড়ার জন্য খরচ করার অনীহার কারণে, বেচারা পোষ্যের স্থান হয় রাস্তায়। বুঝে পায় না অবোধ প্রাণী, কেন এমন হলো? ওর জীবনের ধারা এভাবে বদলে গেল কেন! যাদের বিছানায় গড়াগড়ি খেত, যারা আদর করত, খেতে দিত ... সবাই কোথায় চলে গেল হঠাৎ একদিন, ওকে ফেলে রেখে! রাস্তায় রোদে-ঘোরা, জলে-ভেজা, এক-আধ দিন পুরো পেট না-ভরা স্বাধীন কুকুরেরা প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করলেও, এক সময় ওদের নিয়ে নেয়, নিজেদের দলের সভ্য করে। অনেক সময় মানুষের থেকে হয়তো বেশিই থাকে রাস্তার কুকুরের মনুষ্যত্ব।

    আবার খুবই অসুস্থ পোষ্যকে গাড়িতে নিয়ে অনেক দূরে ছেড়ে আসার কাহিনীও শুনেছি। আজকাল তা মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে। গঙ্গাসাগর মেলায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা তো সব বছরই খবরের কাগজে পড়তে পাওয়া যায়। ইদানীং নতুন খবর হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য এনে বয়স্ক অসুস্থ মানুষদের ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে বাড়ির লোক। জগৎটা তো এমন ছিল না। বাবা-মা, দাদু-দিদিমা-ঠাকুমা, জেঠিমা-মাসিমা-কাকিমাদের কোলে পিঠে মানুষ হয়ে বৃদ্ধাবস্থায় তাদের ছেড়ে যাওয়ার প্রথা তো কখনো ছিল না। প্রযুক্তি, অর্থ, বিদ্যার সম্প্রসারণের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই নতুন মানসিকতাও বেড়ে উঠেছে। বৃদ্ধাবস্থায় বেঁচে থাকার বাধ্যবাধকতাতে গড়ে উঠেছে চারদিকে বৃদ্ধাশ্রম।

    ছোটবেলা থেকেই ভুবনেশ্বরে, কারো বাড়িতে কথা বলা ময়নার 'জয় গুরু' ডাক শুনে বা ছোট্ট সাইজের খরগোস অথবা বিড়াল ছানা দেখে রেশমির আবদার, ওরও চাই একটা কিছু। দেড়-দু' বছর পর পরই বদলি, নিজেদের জিনিসপত্র নিয়েই হয়রান, তার উপর আবার আরেকটা প্রাণীর দেখাশোনা! তাই আমরা দু'জনে দুর্বল হইনি। কিন্তু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে যখন পড়ে মেয়ে, তখন আর আবদার উপেক্ষা করতে পারল না তার মা। বলল আমায়, "কিনতে দাও। এত বলছে, দুঃখ থেকে যাবে।”

    এর পর আর কন বাবা না বলতে পারে! সব নিষ্পত্তির আসল উৎস কোথায়, ছেলে মেয়েরা ভালোই জানে। তাই ঠিক জায়গায় গিয়ে হত্যে দেয়। টাকাটা দিতে রাজি হলাম, জোগাড় করার দায়িত্ব ভাই-বোনের।

    রবিবারের খবর কাগজের শ্রেণীভুক্ত বিজ্ঞাপন নিয়ে কিছু দিন ধরে ভাই-বোনের গবেষণা চোখে পড়লো। হঠাৎ এক সকালে দেখলাম, মেঝেতে খবরের কাগজ ছড়িয়ে নিয়ে বসে লাল কালিতে দাগ দিচ্ছে। শুনলাম আকঙ্ক্ষিত জায়গা পাওয়া গেছে, মুম্বাইয়ের বান্দ্রাতে। তিন হাজার টাকা দিলাম। দামি কুকুরের দাম আরও অনেক বেশি হয় শুনেছি। মেয়ে বললো, “যদি আরো বেশি চায়?”

    “বলবি এর মধ্যেই যা হবে, দিতে।”

    জানতাম, ওদের কুকুর ছানা চাই, দামি কুকুর ছানা নয়। কম দামেও তো কুকুর ছানাই পাওয়া যাবে।

    মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে বাড়িতে টেলিফোন। রীতার সঙ্গে ফোনে আলোচনার টুকরো যা কানে এল, বুঝলাম দু'জনে খুঁজে বার করেছে কুকুর ছানা বিক্রির জায়গা।

    বিক্রেতার বাড়িতে পৌঁছে, ঘরের চারদিকে খুঁজে যাচ্ছে দু’জনে, কুকুর কোথায়? হঠাৎ ভদ্রলোক বাথরুমের দরজা খুলে দিলেন, সাত-আটটা বিভিন্ন জাতের কুকুর ছানা বেরিয়ে এল দৌড়োদৌড়ি করে। তার মধ্যে একটা বাচ্চা নতুন লোক দেখে সোজা ভাই-বোনের পায়ের কাছে। অন্যরা তখন ছাড়া পাওয়ার আনন্দে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা ঘর। ভাই-বোন তখন ঘুরে ঘুরে সব ছানাদেরই দেখছে। কিন্তু রেশমি যেখানেই যায় সে নাকি ওর পেছনেই ঘুরছে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই যেন ন্যাওটা হয়ে গেছে। ঘি রঙের বড় বড় লোমে ঢাকা উলের বলের মত সেই ছানার মুখের কিছু অংশে যেন কালো ছাপ। ছোট বোন পাগল ওটাকে নেওয়ার জন্য। সেই কুকুর ছানারও নাকি ভাই বোনকে বেশ খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু দাদার সন্দেহ ওই কালো দাগ নিয়েই, মা'র ভালো লাগবে তো? তাই মা'র কাছে ফোন, সবুজ সংকেত চাই।

    বাড়িতে এল রাজর্ষির দেওয়া নাম নিয়ে - ডুপ। ছোট্ট প্রাণী, যেন খরগোশ শিশু। প্রজাতির নাম লাসা এপসো। তিব্বতের রাজধানী লাসাতে আদি বাড়ি। পরিপূর্ণ যৌবনে ওজন সাত আট কিলোগ্রাম মাত্র। বিভিন্ন প্রজাতির কুকুরের চরিত্র বর্ণনায় এদের বলা হয় 'সেন্টিনেল' অর্থাৎ পাহারাদার। তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মঠ ও মন্দির পাহারা দেওয়ার প্রজাতি। খুবই হাস্যকর লাগতো, ওইটুকু ডুপ লাসাতে থাকলে পাহারাদার হতো!!

    ডুপের ব্যবহার ও চরিত্র নিয়ে ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করেছে, বই কিনে, ইন্টারনেট ঘেঁটে। আমাদের বোঝানো হলো, ওরা নিজেরাই নিজেদের প্রভু, অন্যকে প্রভু বলে মানে না, আদর ভালোবাসা দিলে কথাবার্তা শুনতে পারে, তবে তা ওদের ইচ্ছের উপরে। বিভিন্ন লিখিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, গবেষকের মত আমি আর দুই সন্তান খুঁজে যেতাম ওর মধ্যে, কখনো মনে হতো সম্পূর্ণ মিলে গেছে, কখনো আবার খুব হতাশ হয়েছি।

    বছর খানেকের মধ্যেই স্পষ্ট হলো যে, ও রীতার কথা মানে, ওর পায়ের কাছে গা লাগিয়ে শোয়। আমাকে অপছন্দ করে না, তবে শক্তিশালী দেশের সাথে ছোট দেশরা যেমন নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও সম্মান বাঁচিয়ে বন্ধুত্ব রাখার চেষ্টা করে, তেমন একটা ব্যবহার। প্রতিদ্বন্দ্বী বাড়িতে এক জনই, রাজর্ষি। বাইরে থেকে বাড়ি এলে বিছানার কাছে এয়ারকন্ডিশনারের সামনে কে আগে পৌঁছে শোবে, বিছানায় পছন্দের জায়গাটা নিয়ে, খাবার নিয়ে, গাড়িতে কে আগে চড়বে তা নিয়েও প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে।

    একজনকে সমীহ করত, রেশমি। ওর কোলে বসে ঘন্টা খানেক চোখ বুজে আদর খাবে, আবার যখন বাথরুমে ঢুকিয়ে দিত, কেঁদে আর্তনাদ করতে করতে চান করবে, এক ধমক দিলেই চুপ। যখনই কোনও সুস্বাদু খাবার বাড়িতে এসেছে, রেশমির কোলে বসে ওরই হাত থেকে খাবে। এমনকি অনেক বছর পরে যখন রেশমির বাচ্চা দু'টোর বয়স ২ ও ৬ আর ডুপের ১৬, মানুষের হিসেবে আশিরও বেশি, তখনো কলকাতায় বাপের বাড়িতে, মাটিতে বসে একই বড় প্লেট থেকে আলাদা সব চামচ দিয়ে ছেলে-মেয়েকে খাবার খাইয়ে, ডুপকে ও খাওয়াতো ডুপের চামচ দিয়ে। লাইন দিয়ে তিনটে শিশু যেন বসে খাচ্ছে মা-র কাছে। ঘরে এখনো ওই ছবি দেখতে দেখতে হাসি, চোখ ভিজে যায়।

    প্রথম তিনটে দিন বেচারা বেশ অত্যাচারিত হয়েছে আমাদের নির্বুদ্ধিতায়। ছোট্ট শিশু ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি, এক তলা থেকে তিন তলা, এমনকি ছাদ পর্যন্ত। আর রেখে যায় বিভিন্ন কোনায় অন্বেষণের সাক্ষী হিসেবে ওর মল ও মূত্র। মনে হলো, এই জন্যই কুকুরের গলায় চেন লাগাতে হয়। ছোট্ট তুলোর বলের মত ছানাটার গলায় পড়লো চেন। অনেক সময় লম্বা চেনের এক প্রান্ত কোথাও বাঁধা থাকতো আর ডুপ মেঝেতে চেনের ঘর্ষণের আওয়াজ করতে করতে সেটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। অনেকটা লোহার বেড়ি দিয়ে বাঁধা, খুনের আসামীদের মত। বেশ কিছুদিন পর যখন চেতনা এসেছে, নিজেরাই লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছি, কি করে অমন করতে পেরেছিলাম!

    সেদিন গ্রীষ্মের গরমে ঘরে এয়ারকন্ডিশনার চলেছে রাতে। পশুপাখিদের ঠান্ডা বা গরম লাগতে পারে, এ ভাবনা কখনো আসেনি। প্রকৃতির নিয়মে পালক বা লোমই ওদের আগলে রাখে, এমন একটা ধারণা ছিল। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মকে তুলোধোনা করে, হিমশীতল তিব্বতের প্রাণীকে যখন মুম্বাইয়ে জন্ম নিয়ে বড় হতে হয়, তার শরীরের জন্মগত পাওয়া বর্মও অকেজো হয়ে পড়ে, সে ধারণা হয়নি। আমাদের এয়ারকন্ডিশনরটা কোনো ব্র্যান্ডের নয়, এসেম্বল করা, জানলায়। তার তাপমাত্রা কমানো বাড়ানো যায় না। আমরা কম্বল গায়ে দিয়ে ঘুমিয়েছি আর বেচারা ডুপ টির টির করে কেঁপেছে। যখন আর্তনাদ করতে শুরু করে, রীতার ঘুম ভাঙে, আমিও উঠে পড়ি। দেখি লম্বা ঘরে, দূরে, কোনায়, টেবিলের তলায় থর থর করে কাঁপছে ডুপ। চৈতন্যের উদয় হলো, মুম্বাইয়ে জন্মগ্রহণ করে তিব্বতের লাসা এপসো্র ঠান্ডা জয় করার মত লাসা এপসোত্ব আর নেই।

    ছোট্ট কুকুর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়। এসে মাঝে মাঝেই পায়ের গন্ধ শোঁকে, আর ওর ঠান্ডা নাকের ছোঁয়ায় আমাদের অনভ্যস্ত শরীর কেঁপে ওঠে। রীতা ‘ওমাগো’ করে চেয়ারের ওপরে পা তুলে নেয়, আমি 'যা, যা' করতে থাকি। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন আনন্দের উপকরণ আবিষ্কারের আনন্দ। ছেলে-মেয়ের পুনায় মন বসে না, উন্মুখ হয়ে থাকে, কখন সপ্তাহ শেষ হবে। অল্প কয়েক দিনেই ডুপ পাড়ায় বেশ নাম করে ফেলেছিল। পাড়া বলতে ক্যাম্পাস কথাটাই বেশি প্রযোজ্য। দশটা গায়ে গায়ে লেগে বাংলো লাইন দিয়ে। বম্বের ভাষায় তাদের বলা হয় "রো হাউস" আর দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বাকি অংশে অনেক ফ্ল্যাট। আমাদের দুই নম্বর বাংলো। এক নম্বর বাংলো সিনেমা জগতের একসময়ের সুপারষ্টার রাজেশ খান্না তাঁর অল্পবয়সী প্রেয়সী, অভিনেত্রী টিনা মুনিমকে উপহার দেন। বাংলোর মালিকানা তখন রিলায়েন্স কোম্পানিতে হস্তান্তর হয়ে কোম্পানির একজন বড় ম্যানেজার থাকতো।

    তা এহেন এক পাড়ায় ডুপ যখন বেড়াতে বেরোতো, বিকেলে ফ্ল্যাট ও বাংলোতে যত বাচ্চা আছে সব ভিড় করতো আমাদের বাড়ির সামনে। একেক দিন বাড়ির বাইরে থেকে শিশু কণ্ঠে কাতর আবেদন শোনা যেত "আন্টি, ডুপ ভাইয়াকো থোড়া বাহার ভেজো না, হাম খেলেঙ্গে।" সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ডুপকে বাইরে পাঠানো হতো। চেনা বাচ্চাদের সাথে দেখা হতে দুই তরফেই সে কি উল্লাস।

    সেদিন অঘটন ঘটেছিল। রেশমি এসেছে পুনে থেকে। বিকেলে ডুপকে নিয়ে বেরিয়েছে, সব বাচ্চারা ঘিরে ধরেছে। ডুপের এত জনপ্রিয়তাতে প্রথমে খুব খুশি হয়ে ওঠে রেশমি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে বাচ্চারা যখন ডুপকে বেশি আদর করছিল, ডুপের প্রশ্রয়ে, রেশমির পছন্দ হয়নি। ডুপকে নিয়ে বাড়ি ফিরবে ঠিক করেছে। কিন্তু অপমান করেছিল ডুপ। সবার সামনে ও বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, ও তখন বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো বেশি পছন্দ করছে। ডুপের ব্যবহারে নাকি এটাই প্রমাণ হয়েছে, ও রেশমিকে তেমন ভালোবাসে না, বাচ্চাদের বেশি পছন্দ। বাড়ি ফিরে ডুপের ব্যবহারের কথা বলতে বলতে রেশমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল।

    আরেকদিন মনে আছে আমাকে আর রীতাকে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় দেখে একটা বাচ্চা আমাদের দেখিয়ে, আরেকজনকে বলেছিল, "ইয়ে লোক ডুপ ভাইয়াকা ঘরমে রহতে হায়।" অর্থাৎ, এরা ডুপ ভাইয়ের বাড়িতে থাকে।

    ছেলে-মেয়ে নাম করলে, বাবা মায়ের যেমন গর্ব হয়, আমাদের তেমনি মনে হয়েছিল। বেশ মজাও লেগেছিল।

    আমার ধারণা, ডুপকে ওর ‘ব্যক্তি’ত্বর জন্যই খাতির করতো বাচ্চা থেকে বুড়ো পর্যন্ত সবাই। লক্ষণ নামে একজন বেশ বর্ষীয়ান মারাঠী রাঁধুনি ছিল বাড়িতে। অফিসের দেয়া সাদা রঙের জামা ও প্যান্ট পরত। লক্ষণের চেহারাটা বড় সৌম্যকান্তি। এতটাই যে, এক-আধ জন নতুন মানুষ, ও দরজা খুলে দিতে আমার বাবা ভেবে, প্রণাম করে ফেলেছে ভীষণ লজ্জিত লক্ষণকে। সেই লক্ষণ ডুপকে শুইয়ে সারা শরীর মালিশ করে দিত। আর ওই বাচ্চা কুকুর পরমানন্দে ম্যাসাজ করাতো। একদিন আর পারিনি সামলাতে, বলেই ফেলেছি, "কি হলো লক্ষণ, তুমি আমাদের ছেড়ে ওর সেবাতেই তো লেগে থাকো… "

    হাত দু'টো কপালে তুলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে বলেছিল, “ওতো, নারায়ণস্বামী। তাঁর সেবা করছি।"

    ‘নারায়ণস্বামী’ আরাম নিতে নিতে চোখ খুলে আমায় দেখে নিল।

    ২০০৪; মুম্বাই থেকে হায়দ্রাবাদ বদলি হই। নতুন জায়গায় নতুন বাড়ি, একসাথে সবাই যেতেই ভালো লাগবে। আমার মা ও আমরা দু'জন, দুই ভাই-বোনও আমাদের সাথে যাবে। ডুপ সাথে থাকবে, তবে প্লেনে তো ওকে প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে যেতে দেবে না; ওর জন্য একটা খাঁচা বানাতে হবে, তার মধ্যে বসে অন্যান্য লাগেজের সঙ্গে ডুপও যাবে। ঘন্টা দু'য়েক সময় তো মাত্র। এইসব আলোচনা যখন চলছে, কিছুই নিষ্পত্তি হয় নি, মেয়ে বলে উঠলো, "না ও পারবে না ওইভাবে যেতে। আমি ডুপকে নিয়ে ট্রেনে যাবো, তোমরা প্লেনে চলে যাও। এমনভাবে টিকিট কাটো, যেন কাছাকাছি সময় পৌঁছোই।" তা শুনে আমার মাও বলেছিলেন, "আমিও ওদের সঙ্গে ট্রেনেই যাবো।"

    তখন ডুপের দুই বছর বয়স। এর পর পনেরো বছর আর ডুপের যাওয়া নিয়ে আলোচনা হয়নি। ডুপকে নিয়ে গেলে সবাই ট্রেনেই গিয়েছি। আর ট্রেনে ডুপ যেতে পারে এয়ারকন্ডিশন ফার্স্ট ক্লাসেই, আমাদের সাথে কম্পার্টমেন্টে। মুম্বাই থেকে হায়দ্রাবাদ, আর সেখান থেকে ভুবনেশ্বর ফেরার সময়, এ. সি ফার্স্ট ক্লাস-যুক্ত ট্রেন না থাকায় হায়দ্রাবাদ থেকে গাড়িতে বিজয়ওয়াড়া ও সেখান থেকে ট্রেন। দিল্লি, বম্বে, ভুবনেশ্বর থেকে কলকাতা, দিল্লি, আসানসোল, কটক -- যেখানেই গিয়েছি, ডুপকে নিয়ে ট্রেনেই।

    রেল কোম্পানির নিয়মানুসারে ওই একটা শ্রেণীতেই ডুপ আমাদের সাথে যাবে, যদি অন্য যাত্রীরা আপত্তি না করেন। কেউ করেনি কখনও, একজন ছাড়া; এক বয়স্ক ভদ্রলোক, অবসরপ্রাপ্ত রেলের বড় চাকুরে, রেলওয়ে বোর্ডের ভূতপূর্ব মেম্বার। রীতা বলেছিল, যদি একবারও আপনার দিকে যায়, আওয়াজ করে বা বিরক্ত করে, আমরা অন্য বন্দোবস্ত করবো। দিল্লিতে নামার সময় সেই ভদ্রলোক রীতার দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি হেসেছিলেন।

    প্রচুর তীর্থক্ষেত্র ও নামি সব মন্দির ডুপের ঘোরা। মন্দিরের ভেতরে অবশ্য প্রবেশ নিষেধ, কিন্তু গাড়ি যত কাছে যাওয়া যায়, গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছে। আমরা ভেতর থেকে এসে পুজোর সিঁদুর বা বিভূতি মাথায় দিয়েছি, প্রসাদ খেয়েছে। সিরিডি সাঁইবাবার মন্দির, দক্ষিণেশ্বর ও বেলুড় মঠ, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের লিঙ্গরাজ মন্দির, কটকের চণ্ডী মন্দির, পাহাড়ের ওপরে বিজয়ওয়াড়াতে কনকদুর্গা মন্দির, পুনাতে চতুসিঙ্গি, নাসিকে ত্র্যম্বকেশ্বরে কুম্ভ মেলা, তা আবার আমার ও রীতার মায়ের সাথে। আরো কত তীর্থ।

    ওর অদ্ভুত ব্যবহারও দেখেছি। একবার নয়, বার বার। রাজর্ষি ও রেশমি যখন বাড়ি আসতো পুনে থেকে – ডুপের বাঁধন ছাড়া আনন্দ দেখার মতো। দু-তিন দিন থেকে দাদর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে পুনে যাওয়ার বাস ধরবে বলে গাড়িতে গিয়ে বসত, আমরা দু'জনে বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকতাম, "আয় ডুপ, ওরা যাচ্ছে।" শুনতো, কিন্তু আসতো না। একতলার বসার ঘরের আরেক প্রান্তে, লনের দিকের দরজা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো। ওদের চলে যাওয়া দেখতে ডুপ আসবে না সদর দরজায়।

    ওর সতেরো বছরের জীবনে একবার দেখেছি ইংরেজি সিনেমার ওয়ারউল্ফের মত আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে যেতে "উউউউউউ, উউউউউউ।" আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছি -- কাঁদছে? রেশমির বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার দু’ দিন পরে এটা করেছিল, তার আগে বা পরে কোনও দিনও অমনি করে ডাকেনি বা কাঁদেনি। কেন ছোট্ট ডুপ দরজায় বসে, আকাশের দিকে মুখ তুলে, অমন কেঁদেছিল সেদিন? কি বলতে চেয়ে ছিল ও? কি বুঝেছিল ও তা আজও জানি না!

    আমাদের অজান্তেই জীবনের মানচিত্র বদলাচ্ছিল। ভাই-বোনের পড়াশুনা শেষ হলো, রেশমির বিয়ে হলো। ধৃতি, আমার নাতনি আসার কিছুদিনের মধ্যে, রাজর্ষির আইবুড়ো অপবাদও ঘুচলো। নতুন প্রজন্মকে জায়গা করে দিতে আমার মা চলে গেলেন, আমাদের দু'জনের দেহও প্রস্তুত হতে শুরু করল নতুনদের জন্য একসময়ে জায়গা খালি করে দিতে। কিন্তু ডুপের যেন তাড়া পড়ে গিয়েছিল। রাজর্ষির বিয়ে হলো, ডুপ দিল্লি থেকে কলকাতায় এসে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বরযাত্রী গেল। এরপর যখন আমার নাতি, ছোট্ট রাজবীর এসে হাজির হলো দুবাই থেকে দিদির হাত ধরে, ডুপ তখন বয়সের ভারে বড়ই ক্লান্ত।

    শেষের দিন অত তাড়াতাড়ি আসবে বুঝতে পারিনি। কলকাতায় বাবা-মা'র ছোট্ট ফ্ল্যাটটাতে শেষ জীবনের বাসা বেঁধেছিলাম আমরা তিন সিনিয়র সিটিজেন বছর তিনেক হলো। ডুপের সতেরো বছর চলছে। ডাক্তারের কথায়, মানুষের সাথে তুলনায় একশ পাঁচ, আমরা পঁচাশির বেশি মানিনি।

    কয়েকটা দিন ডুপ অসুস্থ ছিল। ডাক্তারবাবু স্যালাইন দিতে দিতে বলছিলেন, মনটাকে শক্ত করুন, ওর বয়সও তো হয়েছে। সকালেও নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যালাইন নিয়ে বেশ চাঙ্গা হয়ে ফেরে। রীতা খবরের কাগজ পড়ছে, আমি ল্যাপটপে কিছু কাজ করছি। ডুপ শুয়ে আছে ওর জায়গায়। হঠাৎ দেখি রীতা ডাকছে "ডুপ ডুপ"। কাছে গিয়ে দেখলাম হাত দিয়ে নাকের সামনে, না, নিঃশ্বাস পড়ছে না। স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে শুনলাম কোনও শব্দই নেই শরীর থেকে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে ঘুমন্ত ডুপের শরীরে পরিচিত স্পন্দন শেষ হয়ে গেছে। সেই চিরন্তন শেষ মুহূর্ত এসে গেছে!

    বেশি দূরে নয়, বাড়ি থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে, একটা সুন্দর নিভৃত, নিরালা জায়গাতে, মনোরম পরিবেশে মাটির নিচে আমাদের ডুপ চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে। একা নয়, ওরই মত আরও ডুপদের মাঝখানে। পাশে গিয়ে দাঁড়ালে মনে হয়, যেন একটা খুশির তরঙ্গ ভেসে আসছে কোথা থেকে।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)