রাজার ছিল দুই ছেলে। বড় রাজপুত্র পিতার মতই যোগ্য ও সৎ ছিলেন। তিনি রাজাকে শাসনকার্যে সাহায্য করতেন এবং প্রজাদের খবরাখবর রাখতেন। প্রজারাও তাঁকে খুব ভালবাসত৷ ছোট রাজপুত্র ভিন্ন প্রকৃতির ছিলেন, শিকার, জুয়াখেলা ও নানারকম অসৎসঙ্গে তাঁর সময় কাটত। স্বভাবতই রাজা বড় ছেলেকেই বেশি পছন্দ করতেন, সকলেই জানত ভবিষ্যতে তিনিই একদিন রাজ্যের দায়িত্বভার হাতে নেবেন।
কালের নিয়মে রাজা বৃদ্ধ হয়ে একদিন মারা গেলেন। প্রাথমিক শোকপালনের পর গোটা রাজ্য যখন বড় রাজপুত্রের রাজ্যাভিষেকের জন্য তৈরী হচ্ছে, তখনই ঘটল দুর্বিপাক। ছোট রাজকুমার চক্রান্ত করে সেনাবাহিনীর একাংশকে হাত করে দাদাকে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন এবং নিজে রাজা হয়ে বসলেন। প্রজাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল কিন্তু একসময় থিতিয়েও গেল।
নতুন রাজা রাজ্যভার হাতে নিয়েও আগের মতই আরামে-বিলাসে দিন কাটাতে লাগলেন। রাজকার্যে মন নেই। প্রশাসন শিথিল হল। দেশের ভিতরে ও বাহিরে অস্থিরতা দেখা দিল। রাজার ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি নিজের শখ-আহ্লাদ নিয়ে মেতে রইলেন।
ইদানীং রাজার নতুন শখ হয়েছে দেশ-বিদেশ থেকে দুর্লভ রত্ন সংগ্রহ করা। এ শখ কিছুটা আগেও ছিল কিন্তু এখন রাজকোষ প্রায় খুলে দিয়েছেন। রাজার বিশেষ আসক্তি হীরেতে৷ খবর পেয়ে দূর দূর দেশ থেকে বণিকেরা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া সব হীরকখণ্ড রাজদরবারে নিয়ে আসে। রাজাও বিপুল অর্থ দিয়ে সেগুলি কিনে নেন। তাঁর বাসনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হীরেগুলি একমাত্র তাঁরই সংগ্রহে থাকবে।
এভাবেই একদিন এক বণিক নিয়ে এল উজ্জ্বল ও অপরূপ একটি হীরকখণ্ড। দেখে রাজা অভিভূত। এত বড় হীরে তাঁর সংগ্রহেও নেই। তিনি মহামন্ত্রীকে ইঙ্গিত করলেন। মন্ত্রী প্রশ্ন করলেন, "হে বণিক, এই হীরকখণ্ডের মূল্য কত?"
বণিক উওর দিল, "একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা।"
সভায় গুঞ্জন উঠল। রাজারও ভ্রূ কুঞ্চিত হল। তিনি জলদগম্ভীর স্বরে বললেন, “এই মূল্য কি অত্যধিক নয়?”
বণিক মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “অপরাধ মার্জনা করবেন মহারাজ, এই হীরকখণ্ডটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা সুন্দর। তাই এর মূল্য কিঞ্চিৎ অধিক।”
রাজার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি মহামন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন বণিককে একলক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করবার জন্য৷ মন্ত্রী প্রমাদ গণলেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় করলে রাজকোষ প্রায় শূন্য হয়ে যাবে৷ কিন্তু সেকথা প্রকাশ্য সভায় রাজাকে বলা যায় না।
এইসময় সভাকক্ষের প্রবেশদ্বার থেকে কেউ বলে উঠল, “তিষ্ঠ রাজন!”
সকলে তাকিয়ে দেখল, জটাজুটধারী পীতাম্বরপরিহিত এক সন্ন্যাসী। রাজার দেবদ্বিজে ভক্তি আছে, তাই রাজসভায় সাধু-সন্তদের অবারিত দ্বার। কেউ বাধা দিল না। সন্ন্যাসী ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে আবার বললেন, “তিষ্ঠ রাজন। এই হীরকখণ্ড বিশ্বের সর্ববৃহৎ নয়।”
বণিক প্রমাদ গণল। রাজা বিনীত স্বরে বললেন, “হে মুনিবর, আপনি কি বলতে পারেন তা হলে সেই হীরকখণ্ড কোথায় আছে?”
সন্ন্যাসী সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললেন, “সেই হীরকখণ্ড সাধারণ নয়। অত্যুজ্জ্বল নীলাভ তার দ্যুতি। আর তার কেন্দ্রে রয়েছে অগ্নিশিখার তুল্য এক বর্ণচ্ছটা।”
রাজা উৎসুক হয়ে বললেন, “হে সন্ন্যাসীশ্রেষ্ঠ, এই অপরূপ হীরকখণ্ড কার অধিকারে রয়েছে?”
সন্ন্যাসী সভায় দাঁড়িয়েই চোখ বন্ধ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি সুউচ্চ এক পর্বতশৃঙ্গে এক মন্দিরের মধ্যে একটি স্ফটিকের বেদীতে রাখা আছে এই হীরকটি। তাকে পাহারা দিচ্ছে এক কালনাগিনী।”
রাজা আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সন্ন্যাসী আর কোনও কথা না বলে ধীর পদক্ষেপে সভাগৃহ থেকে প্রস্থান করলেন। রাজা মহামন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মহামন্ত্রী, সেই হীরে আমার চাই।”
মন্ত্রীর ব্যবস্থাপনায় রাজার গুপ্তচরেরা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। বিশেষ করে পার্বত্য এলাকায়। কিন্তু মাসাধিককাল অনুসন্ধান করেও সন্ন্যাসীর বর্ণনা অনুযায়ী হীরের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। রাজা ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছেন। তাঁর আদেশে গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে ঢাক পিটিয়ে ঘোষণা করা হল যে এই হীরের খোঁজ দিতে পারবে তাকে দশ সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দেওয়া হবে।
কিছুদিন পরে রাজসভায় এল এক ভবঘুরে। শীর্ণ চেহারা, মলিন বেশ। হীরের খোঁজ এনেছে শুনে দ্বাররক্ষীরা তাকে আসতে দিয়েছে।
সে রাজা ও মহামন্ত্রীকে প্রণাম করে বলল, “মহারাজ, আমি যাযাবর। দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াই। গত বৎসর ঘুরতে ঘুরতে আমি রাজধানী থেকে প্রায় পাঁচশো ক্রোশ উত্তরে এক বিশাল পর্বতের সানুদেশে ছোট একটি গ্রামে গিয়ে পড়েছিলাম। সেখানে গ্রামবৃদ্ধদের কাছে শুনেছিলাম সেই পর্বতের শীর্ষে এক মন্দিরে অপরূপ এক রত্ন রাখা আছে এবং এক নাগিনী তার রক্ষা করে। গ্রামবাসীরা সাহস করে কেউ সেখানে যাবার চেষ্টা করে না।”
রাজা বললেন, “বেশ। আমি শীঘ্রই সৈন্যদল পাঠাব। তোমাকে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তোমার কথা সত্যি হলে তুমি ঘোষণামত পুরস্কার পাবে৷”
দুদিন পরেই স্বয়ং সেনাপতির নেতৃত্বে একশো জন বাছাই করা সৈন্য ভবঘুরেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল। দীর্ঘ বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে প্রায় এক মাস পরে তারা সেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছল। গ্রামবাসীরা তাদের দেখে ও তাদের আসার উদ্দেশ্য শুনে ভীত ও বিরক্ত হল কিন্তু রাজার আদেশের উপর কথা চলে না। বাধ্য হয়েই তারা রাতের জন্য সৈন্যদের আশ্রয় ও খাদ্য দিল। পরের দিন সকালেই কয়েকজন সৈন্য এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য ইত্যাদি নিয়ে সেনাপতি পর্বতারোহণ শুরু করলেন। সুউচ্চ সেই পর্বতের শীর্ষে উঠতে তাদের কয়েক দিন লাগল। শীর্ষে উঠে তাঁরা দেখলেন সত্যিই এক প্রাচীন মন্দির রয়েছে। সেনাপতি সন্তর্পণে উন্মুক্ত অসি হাতে মন্দিরে প্রবেশ করে দেখলেন কক্ষের কেন্দ্রে এক স্ফটিকের বেদী আর তার উপরে উদ্যত ফণা নিয়ে বসে আছে কালনাগিনী। তার ফণার তলায় বেদীতে রাখা আছে অত্যুজ্জ্বল বৃহদাকার নীলাভ এক হীরকখণ্ড। তার কেন্দ্রে জ্বলছে যেন এক আগুনের শিখা।
সেনাপতি বুঝলেন এই সেই সন্ন্যাসী-কথিত হীরকখণ্ড। তিনি ইতিকর্তব্য ঠিক করে ধীর পায়ে তরবারি হাতে এগিয়ে গেলেন। তারপর বিদ্যুৎবেগে নাগিনীর মস্তক লক্ষ্য করে তরবারি চালালেন। নাগিনীর মস্তক ছিন্ন হয়ে ধূলায় লুটিয়ে পড়ল। আর কিমাশ্চর্যম, নাগিনীর স্থানে আবির্ভূত হলেন পরমাসুন্দরী এক কন্যা। তিনি করজোড়ে সেনাপতিকে প্রণাম করে বললেন, “হে বীরশ্রেষ্ঠ, আপনার জন্য আজ আমার শাপমুক্তি ঘটল। আমার প্রণতি গ্রহণ করুন।”
সেনাপতি যারপরনাই বিস্মিত হয়ে বললেন, “আপনি কে সুন্দরী? কার শাপে আপনি নাগিনী হয়ে ছিলেন? কিভাবেই বা আজ আপনার শাপমুক্তি ঘটল?”
সুন্দরী কন্যাটি জানালেন আজ থেকে বহুযুগ আগে এই পর্বতে এক সমৃদ্ধ রাজ্য ছিল। তিনি ছিলেন সেই রাজ্যেরই রাজকুমারী। তাঁর পিতা এক দেবতার বরে এই হীরকখণ্ড লাভ করে প্রিয়তমা কন্যাকে দান করেছিলেন। কিন্তু এক গন্ধর্ব এই হীরকখণ্ডের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমারীর কাছে এটি প্রার্থনা করেন। রাজকুমারী অসম্মত হওয়ায় গন্ধর্ব রুষ্ট হয়ে শাপ দেন রাজকুমারী অনন্তকাল এক নাগিনী হয়ে এই হীরকখণ্ডকে রক্ষা করবেন। রাজা অনেক কাকুতিমিনতি করায় তিনি বলেন কোন বীরপুরুষ যদি তরবারির এক আঘাতে নাগিনীর মুণ্ডচ্ছেদ করতে পারেন তাহলে রাজকুমারী পুনরায় স্বমূর্তি ফিরে পাবেন। সেই রাজ্য ও রাজবংশ কবেই কালের গর্ভে মিলিয়ে গেছে কিন্তু রাজকুমারী এতদিন ধরে নাগিনী হয়ে হীরকখণ্ডকে রক্ষা করছিলেন।
সেনাপতি চমৎকৃত হয়ে বললেন, ধন্য আপনার কাহিনী হে রাজকুমারী। কিন্তু এখন অনুমতি দিন মহারাজের ইচ্ছানুযায়ী এই হীরকখণ্ড আমি নিয়ে যাই।
রাজকুমারী বললেন, “এই হীরকখণ্ড নিতে হলে আমার দুইটি শর্ত আছে। এক, এই হীরকটি আমার। হীরকটি যিনি নেবেন, তাঁকে আমাকেও গ্রহণ করতে হবে।”
সেনাপতি মৃদু হেসে বললেন, “মনে হয় না এই শর্তে আমাদের মহারাজের কোন আপত্তি হবে। আর আপনার দ্বিতীয় শর্ত?”
রাজকুমারী গম্ভীর হয়ে বললেন, “এই হীরকখণ্ডের সঙ্গে একটি শাপও জড়িয়ে আছে। যিনি একে পাবেন, তাঁকে সেই শাপকেও স্বীকার করতে হবে। যেমন আমার স্বর্গত পিতা আমাকে হারিয়েছিলেন। আমি নিজেও বহু যুগ নাগিনীরূপে কাটিয়েছি।”
সেনাপতি এবার দ্বিধায় পড়লেন। কিন্তু তিনি সৈনিক, রাজাদেশ পালন তার কর্তব্য। তাই দ্বিধা কাটিয়ে বললেন, “তথাস্তু দেবী।“
এবার রাজকুমারীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “চিন্তা করবেন না, হে বীর সৈনিক। আমার মন বলছে এই হীরকখণ্ড আপনাদের রাজ্যের মঙ্গলই করবে৷”
রাজকুমারী এগিয়ে এসে বেদী থেকে হীরকখণ্ডটি তুলে নিয়ে বললেন, “চলুন, আমি প্রস্তুত।”
এর কিছুদিন পরের কথা। সেনাপতি রাজকন্যা ও সৈন্যদের নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করেছেন। দূতের মুখে আগেই খবর পাঠানো হয়েছিল, নগরবাসীরা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে পুষ্পবৃষ্টি করছেন। হীরকখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত শাপের কথা মনে করে সেনাপতির মুখমণ্ডল চিন্তাগ্রস্ত। রাজকন্যার মুখে কিন্তু মৃদু হাসি লেগে রয়েছে।
রাজকন্যাকে নিয়ে সেনাপতি সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। রাজা সিংহাসনে উপবিষ্ট, তাঁর মুখ আনন্দোজ্জল। সেনাপতির ইঙ্গিতে রাজকন্যা এগিয়ে গিয়ে রাজাকে করজোড়ে প্রণাম করলেন, তারপর কটিতে রাখা পেটিকা থেকে হীরকখণ্ড বার করে সসম্ভ্রমে রাজার হাতে তুলে দিলেন।
রাজার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। তিনি হীরকখণ্ডটি ভালো করে দেখবেন বলে চোখের সামনে তুলে ধরলেন।
কিন্তু হঠাৎ তাঁর মুখ যন্ত্রণায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল। ডান হাত দিয়ে বক্ষদেশ স্পর্শ করে তিনি ধীরে ধীরে সিংহাসনেই ঢলে পড়লেন। তাঁর হাত থেকে হীরকখণ্ডটি সভাকক্ষের মাটিতে পড়ে গেল।
সভাগৃহে হুলস্থুল পড়ে গেল। রাজবৈদ্য ছুটে এলেন। কিন্তু প্রাণপণ চেষ্টা করেও তিনি রাজাকে বাঁচাতে পারলেন না। সভাগৃহে কান্নার রব উঠল।
মহামন্ত্রী, সেনাপতি ও রাজপুরোহিত দ্রুত মন্ত্রণাকক্ষে মিলিত হলেন। তাঁদের নির্দেশে বড় রাজপুত্রকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে সসম্মানে সভাকক্ষে নিয়ে আসা হল। রাজপুরোহিত নিজের হাতে তাঁর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে ও মন্ত্রোচ্চারণ করে তাঁকে নতুন রাজা ঘোষণা করলেন।
পুরনো রাজার সৎকার ও পারলৌকিক কাজ ইত্যাদি মিটে যাবার পরই নতুন রাজা এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে রাজকুমারীকে বিবাহ করলেন। তারপর রাজ্যশাসনে মন দিলেন। রাজকোষে অর্থাভাব, তাই হীরে ও অন্যান্য রত্ন সব বিক্রি করে সেই অর্থ প্রজাদের কল্যাণের জন্য ব্যয় করলেন। ধীরে ধীরে দেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরে এল।
শুধু রাজকুমারীর হীরেটি তিনি রেখে দিলেন। রাজ্যের সুখ ও সমৃদ্ধির প্রতীক স্বরূপ এই হীরকখণ্ডটি রাজসিংহাসনের পাশে এক স্বর্ণাধারে উজ্জ্বল দ্যুতিতে শোভা পেতে লাগল৷