১
এখনও যেন তারা-ঝলকানো আকাশটায় চোখদুটো অভ্যস্ত হতে পারেনি। তিন সপ্তাহ আগে অবধি সকাল-সন্ধ্যায় কুয়াশার আবছায়া প্রলেপ এসে মুড়ে দিত আপাদমস্তক। হঠাৎ করে কী যে খেয়াল হল ঋতুচক্রের! এখন ভোরের হাওয়া থেকে শিশিরের আর্দ্রতা মুছে যাচ্ছে দ্রুত, সূর্যের গনগনে আঁচ গলিয়ে দিচ্ছে সব ধূসর রহস্য। এবছর বসন্ত যেন বড় তাড়াতাড়ি এসে পড়েছে — কার ছায়াসঙ্গী হয়ে, কে জানে!
“টাইগার টাইগার, বার্নিং ব্রাইট...”
ফেব্রুয়ারির অমাবস্যার অখণ্ড নিস্তব্ধতা চুরমার করে দেওয়া এই আবৃত্তি শুনে চমকে উঠল অবিরাম। কখন যেন ভরত এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। ছাদের রেলিং-এ হেলান দেওয়া দীর্ঘ অবয়বটা অন্ধকারের সাথে একাত্ম হয়ে আছে। শুধু ঠোঁটের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেটের প্রত্যেক টানের সঙ্গে কয়েক মুহূর্তের জন্য দৃশ্যমান হয়ে উঠছে তার মুখ।
২
অনেক দিন পর আবার ভরতের সঙ্গে দেখা। চেন্নাইয়ের কলেজ-জীবনের পর যোগাযোগ ধরে রাখার তেমন সু্যোগ হয়নি। উদ্ভিদবিদ্যাচর্চায় একদা সতীর্থ দুই যুবকের পথ অনেকখানিই আলাদা হয়ে গিয়েছে এখন। কলেজে পড়তে পড়তে সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল অবিরাম। ছাত্র হিসেবে অসামান্য মেধাবী ছিল সে — মাত্র এক বারের চেষ্টাতেই যখন একেবারে সামনের সারিতে উত্তীর্ণ হল, তখন আত্মীয়-পরিজনের কেউই তেমন বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। অবিলম্বেই বনদপ্তর আধিকারিকের প্রশিক্ষণ নিতে দু-বছরের জন্য দেরাদুনে পাড়ি দিয়েছিল সে। এদিকে ভরত চেন্নাইতেই থেকে গেল। এম.এসসি. পরীক্ষা দিয়ে ইস্তক বিভিন্ন প্রদেশের বনসম্পর্কিত সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করে চলেছে — আসাম থেকে কর্ণাটক, কোনো জায়গাই বাদ পড়েনি। তার কাজের বিবৃতির কথা সংবাদপত্রেও ছাপা হচ্ছে আজকাল।
এতদিনে অবিরামের নিজস্ব অভিজ্ঞতাও কিছু কম হল না। কত দুর্গম অরণ্যকিনারে বাসা বেঁধে তাকে চিনতে হয়েছে সেখানকার পরিবেশ এবং জীবজগৎকে, শিখতে হয়েছে তাদের ভারসাম্য রক্ষার উপায়। তবে আজকাল মনে হয়, সেইসব বিস্তীর্ণ বনভূমির থেকে যেন ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে সে — আমলাতন্ত্রের বিরাট চাকার একটি ক্ষুদ্র দাঁত হয়ে ঘুরে চলেছে নিরন্তর। এখনও পরিদর্শনের কারণে নানা ঘাটে ঘুরতে হয় বটে, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় অফিসঘরের টেবিলের পিছনে, ফাইলের পর্বতারোহণ করে। তাই হয়তো ভরতের অ্যাডভেঞ্চারের খবর পড়তে পড়তে মনের কোনায় ঈর্ষার সূক্ষ্ম হুল অনুভব করত অবিরাম। মনে হত, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জীবন তাকে ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে তার সহপাঠী ভারতবর্ষের পরিবেশবিদ্যামণ্ডলীর এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে উঠছে।
মাসখানেক আগে ব্যক্তিগত ই-মেলের ইনবক্স খুলে চমকে উঠেছিল অবিরাম। মেলের তালিকার সবার উপরে অপেক্ষা করে আছে ভরতের বার্তা। কতদিন পর যোগাযোগ হল ফের? অবিরাম হিসেব করে দেখল, তা বছর সাতেক তো বটেই। মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে মেলটা খুলল।
ছোট্ট চিঠি — তবে তার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। অবিরাম যে মাস ছয়েক আগে পাটনায় বদলি হয়ে এসেছে, ভরত সেকথা জানে। নিজের গবেষণার কাজ নিয়ে সেও কিছুদিনের জন্য এদিকে আসছে। তার অবশ্য পাটনায় বেশিদিন থাকা হবে না — নালন্দার আশেপাশের এলাকায় ফিল্ডওয়ার্ক করতেই সময় কেটে যাবে। অবিরাম যদি খুব ব্যস্ত না থাকে, তাহলে যেন ভরতের সঙ্গে সময়-সুযোগমত যোগাযোগ করে।
কী বিষয়ে গবেষণা করতে আসছে ভরত? ওদিকটায় বলার মতো তেমন কোনো বন-জঙ্গল নেই। অথচ ভরতের কাজকর্ম সবই সংরক্ষিত এলাকাগুলোকে ঘিরে। ক’দিন আগেই কোন একটা জার্নালে যেন তার একটা গবেষণাপত্র পেয়েছিল অবিরাম। গুগ্ল সার্চ করে দেখল, ঠিকই মনে আছে। নাগারহোল টাইগার রিসার্ভে ‘ল্যান্টানা ক্যামারা’ নামক এক আগাছার প্রকোপ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছে ভরত। বিগত দশকে দেশের নানা প্রান্তে ‘ল্যান্টানা ক্যামারা’-র আধিপত্য বিস্তার ভারতীয় বনদপ্তরকে যথেষ্ট ভাবিয়ে তুলেছে। প্রায় দুই শতাব্দী আগে ইংরেজদের হাত ধরে উদয় হয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকার ভূমিজ এই উদ্ভিদ। সেই থেকে বনভূমি ও চাষের ক্ষেতে তার আক্রমণ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। নাগারহোল-এর ব্যাপার আগেও শুনেছে অবিরাম। আগাছার উগ্র বাড় বনভূমির ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে দ্রুত। স্থানীয় গাছপালা ক্রমশই মারা পড়ছে, মাটি বিষিয়ে উঠছে, দাবানলে তছনছ হয়ে যাচ্ছে অরণ্য। ল্যান্টানা ক্যামারার গ্রাস থেকে বিহারও নিস্তার পায়নি। আর বলতে হবে না; ওই আগাছার টিকি ধাওয়া করেই ভরত এখানে আসছে নির্ঘাত।
নালন্দা জেলার এক ছোট্ট মফস্বল শহরকে প্রায় মালার মতো ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একটি জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়। একসময় সেই জঙ্গলের ব্যাপ্তি ছিল বিরাট। এখন পাহাড়ের উপরেও সবুজের আবরণ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। এমনকী, নিরাপদ আস্তানা বাঁধতে না পেরে উগ্রপন্থীদের দলগুলিও পাততাড়ি গুটিয়ে জঙ্গল ছেড়ে গেছে বছর চল্লিশেক আগে। এদিকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় পবিত্র বুদ্ধভূমি নালন্দার ভোল পালটে দেওয়ার অসামান্য সব আইডিয়ার দোকান খুলে দিয়ে অধঃস্তন দলীয় সদস্য, বিধায়ক, এবং সরকারি বিভাগের কর্মচারীদের জব্দ করে ফেলেছেন। সম্প্রতি সেই আইডিয়ার তালিকায় আরেকটি সংযোজন হয়েছে — মফস্বলের লাগোয়া পাহাড়ের ওই জঙ্গলটাকে বেড়াজালে বেঁধে তৈরি হবে ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। জঙ্গল সংরক্ষণ হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও ফিরবে, সেই সঙ্গে এই নবযৌবনপ্রাপ্ত বনাঞ্চলের শোভা দেখতে আসা পর্যটকদের টিকিটবাবদ বাড়তি দু’পয়সার আমদানিও হবে।
অগত্যা অবিরামকেও সরেজমিনে জঙ্গল পরিদর্শনে বেরিয়ে পড়তে হবে। বিশাল এক কর্মকাণ্ড অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। আগাছার প্রকোপ সঠিকভাবে নির্ণয় করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়াও সেই কর্মসূচীর মধ্যেই পড়ে। চিন্তার জাল ফুঁড়ে বেরিয়ে কী-বোর্ডে মন দিল সে। পাহাড়ের পশ্চিম ভাগে একটা ছোট টিলার উপর ব্রিটিশ আমলের যে ফরেস্ট বাংলো আছে, সেখানেই ভরতকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখবে।
৩
ফরেস্ট বাংলোর সাহেব ডোরবেল যখন গমগম করে বেজে উঠল, তখনও বাইরে ধূসর অন্ধকার। দরজা খুলতেই দেখল, সামনে দাঁড়িয়ে সেই তালঢ্যাঙা দড়িপাকানো চেহারা, হাতে গোল্ড-ফ্লেক, পরনে ছেঁড়া জিন্স আর পার্কা, কাঁধে রুকস্যাক, গালে দাড়ি। অবিরামের মুখের উপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে তার মার্কামারা বিচ্ছু হাসিটা হাসল ভরত।
“হাই! লং টাইম।”
“এত সকালে যে? ক’টার ফ্লাইট ধরেছিলি?”
“হোয়াট ফ্লাইট? কলকাতা থেকে বাসে এসেছি ওভারনাইট। কন্ডাক্টর দিব্যি লোক। বিহার শরীফে লিট্টি-চোখা খাওয়াল।”
অবিরাম চোখ ওলটাল। টিপিকাল ভরত আর কাকে বলে!
প্রাতরাশ সারতে সারতে আড্ডা চলছিল। তার মাঝেই ভরত ফস করে একটা প্রশ্ন করে বসল।
“এখানে তাহলে স্যাঙ্চুয়ারি তৈরি হচ্ছে?”
এই রে! ছেলেটা যে তার পেট থেকে সরকারী তথ্য উদ্ধারের আশাতেও এসে থাকতে পারে, সে সম্ভাবনা তো মাথায় আসেনি! অবিরাম একটু সাবধানীভাবে বলল, “হুঁ। সবে তো কাজ শুরু হল।”
“জঙ্গলটা খুব পুরনো, না?”
“পুরনো? প্রাচীন বল্। আর্কিওলজিকাল সার্ভের লোকেরা তো হরদম পাহাড়ের উপর খোঁড়াখুঁড়ি করে বিম্বিসারের আমলের সব রেলিক্স বার করছে। তাছাড়া পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে জঙ্গলের ভিতর একটা ব্যাঘ্র-মন্দির আছে।”
“তাই নাকি?” ভরত নড়েচড়ে বসে, “কবেকার?”
“কেউ জানে না। ওইদিকটায় কারুর যাতায়াতও নেই তেমন। শুধু পাহাড়ের তলায় একটা ছোট গ্রাম আছে, ওরা হয়তো মাঝেমধ্যে পুজো-টুজো দেয়, সঠিক বলতে পারব না।”
“ইন্টারেস্টিং! তা, ওয়াইল্ডলাইফ কীরকম জঙ্গলে?”
“ওই, যা থাকে। শেয়াল, হরিণ, শুয়োর, খরগোস। পাখি আছে বেশ কয়েকরকম। তা, তোর রিসার্চ কীসের এখানে? ল্যান্টানা?”
ভরত ফিক করে হাসল।
“বাঃ, আমার উপর হোমওয়ার্ক করেছিস দেখছি! হুঁ, ল্যান্টানাই বটে। এখানকার চাষজমির অবস্থা তো ভাল নয় শুনেছি।”
“হ্যাঁ, তা তো নয়ই। কিন্তু নালন্দা কেন?”
“কারণ এদিকের তেমন ডেটা পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া, এই জঙ্গলটা নিয়ে একটা কিউরিওসিটি তো ছিলই। লোকালরা আগাছার ব্যাপারটা কীভাবে হ্যান্ডল করে সেটা —”
“জঙ্গলের আগাছা লোকালরা হ্যান্ডল করবে কী করে? দ্য ফরেস্ট ইজ আউট অফ বাউন্ডস। ওখানে ঢোকার অনুমতি নেই।”
“বলিস কী? কেউই ঢোকে না?”
“আরে এটা আর কতটুকু এরিয়া? ওখানে তো লুকিয়ে ঢোকা যায় না। গার্ডরা দেখলেই তাড়া করে যায়।”
“আই সী ...”
অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল ভরত। দৃষ্টিতে কেমন যেন এক অভিব্যক্তি ... বিষন্নতা কি? অবিরাম একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ভাবছিস?”
“আগুন ...” আনমনাভাবেই ধোঁয়া ছাড়ল ভরত, “গত বছর এই সময়ই আগুন লেগেছিল।”
“কোথায়?”
“টাইগার রিসার্ভে।”
“নাগারহোল? কই, খবরে তো তেমন কিছু —”
“নট নাগারহোল, বাট ক্লোজ-বাই। সেখানেও ল্যান্টানার ওভারগ্রোথ হয়েছিল। রিসার্ভের একজন গাইড ছিলেন লোকাল কম্যুনিটির সদস্য। জঙ্গলটাকে হাতের পাতার মতো চিনতেন।”
“তখন তুইও ছিলি নাকি সেখানে?”
“আমি? না। আমি তখন আসামে ছিলাম।”
খানিকক্ষণ চুপ করে রইল ভরত। তারপর আত্মগতভাবে বলল, “আয়রনিকাল। যতদিন ওঁদের কম্যুনিটি জঙ্গলের ভিতরে নির্বিঘ্নে চাষ করতে পারতেন, ততদিন সেখানে ল্যান্টানার অত উৎপাত ছিল না। শিফটিং কাল্টিভেশান করবার দরুন কয়েক বছর অন্তর ফরেস্ট-ফ্লোরে আগুন ধরিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করতে হত। সেই কন্ট্রোল্ড বার্নিং ল্যান্টানাকেও নিয়ন্ত্রণে রাখত। কিন্তু আমি যখন যাই, সরকার ততদিনে জঙ্গলে চাষ করা ব্যান করে দিয়েছে। সারা বন এমনভাবে আগাছায় ভরে গিয়েছে, যে আগুন ধরাতে গেলে গোটা বনই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। আরও বড় আয়রনি, এই উগ্রভাবে বেড়ে ওঠা ল্যান্টানার জঙ্গল এখন আর সেভাবে আগুনে কাবু হয় না। শুধু বনকে বন সাফ হয়ে যায়, জন্তু-জানোয়ার মারা পড়ে। ... সেই যে গাইড, তিনিও তো সেরকম এক দাবানলেই চলে গেলেন। শেষ দেখাটাও হল না।”
ভরত থামল। অবিরাম কী বলবে ভেবে পেল না। এই গল্পের পিছনের ইঙ্গিতটা অস্পষ্ট নয়। সরকারী আমলা হবার সুবাদে তাকে মাঝে মধ্যেই নানান লোকের বক্রোক্তির সামনে পড়তে হয়। ক্লাসরুমে আঁতেল শিক্ষকের প্রভাবেই হোক, কি এক শ্রেণীর হিন্দি ছবির প্রতি আকর্ষণের কারণেই হোক, দেশের লোক ধরেই নিয়েছে যে জঙ্গলের প্রান্তের মানুষেরা হচ্ছেন সব একবিংশ শতাব্দীর রবিনহুড, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের ধড়িবাজ কর্মীদের বিরুদ্ধে নৈতিক লড়াইয়ে প্রাণাহুতি দিয়ে চলেছেন।
সংবাদমাধ্যমের পক্ষপাত এবং বিনোদনের বিকৃত প্রতিফলনের কথা বাদ দিলেও, মনে রাখতে হয়, সাধারণ মানুষ পৃথিবীটাকে সাদা-কালো রঙেই দেখেন। তবে ভরতের মতো একজন পরিণতমনস্ক বিজ্ঞানীর কাছ থেকে এমন একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আশা করেনি অবিরাম। জঙ্গলের মধ্যে আগাছার মৌরুসিপাট্টা, ঘন ঘন দাবানল, এককালের দুর্ভেদ্য অরণ্যপ্রাচীরের রাতারাতি ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া — এ সবকিছুর দায় কি শুধুই অবিরামের মতো বনদপ্তরকর্মীদের? প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপনের সমস্ত আঙ্গিক বুঝি বন সংরক্ষণের অনুকূল? এত বছর ফীল্ডে কাজ করছে ভরত; সে কি জানে না, যে লোকাল ইকোলজিকাল প্র্যাক্টিস মানেই তা ইতিবাচক নয়, কারণ বাস্তুতন্ত্রের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জালের সরলীকরণ বাস্তবে হয় না?
সে গলা খাঁকরে বলল, “ইট্স রিয়লি স্যাড। তবে এখানে তো কোনো ইনডিজিনাস কম্যুনিটি নেই যাদের জঙ্গলের প্রতি নাড়ীর টান আছে। দেখছিসই তো, ক্যানোপির কী দুরবস্থা। তার ওপর, একসময়ে নকশালরা জঙ্গলটাকে নিজেদের ঘাঁটি বানিয়ে ফেলে চোরাকারবারিদের সঙ্গে প্রায় জয়েন্ট পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছিল — সেও প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর হবে। তাদের অত্যাচারের পর যা সামান্য কিছু অবশিষ্ট, তাও দুয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে সব সময়। আমি লোকালদের দোষ দিচ্ছি না — ফ্রি রিসোর্স থাকলে গরীব লোকেরা তো এক্সপ্লয়েট করতে চাইবেই। কিন্তু, সত্যি বলতে, সরকার যে ওদের জন্য একেবারে কিছুই করছে না, তা তো নয়। এই রিমোট জায়গাতেও গ্যাস কানেকশান, ইলেকট্রিসিটি, স্যানিটেশান ...”
বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলল অবিরাম। ভরতের মুখ দেখে মনে হচ্ছে না যে তার কানে আদৌ কোনো কথা ঢুকেছে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তার চটকা ভাঙল। হাতের সিগারেটটা ছাইদানে ঠুসে দিয়ে বিশাল এক আড়মোড়া ভেঙে স্তিমিত হাসল সে। তারপর টেবিলে দুটো টোকা মেরে বলল, “তাহলে তো ওইদিকটা একবার ঢুঁ মারতে হয়। তোর কাজ নেই তো এখন?”
৪
গ্রামের নাম মার্কসবাদীনগর। ফরেস্ট বাংলো থেকে বেরিয়ে পশ্চিমদিকে নাক-বরাবর ঘন্টাখানেক হেঁটে পৌঁছাতে হয়। তাদের বাংলোর মতো এই গ্রামটাও পাহাড়ের পাদদেশে থমকে আছে। গ্রামের ধারের ঢালু ঘাসজমি হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেছে গাছের সারির ভিতরে।
অবিরামের টাঙ্গা নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। ভরত অবশ্য হাঁটার পক্ষপাতী, তাই শেষ অবধি পয়দলেই বেরিয়ে পড়েছে ওরা। আসবার সময় রাস্তার পাশের ঢালটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে এসেছে ভরত, মাঝে মাঝে খচাখচ ছবি তুলছে। অবশ্য ছবি তোলবার মতো তেমন কিছুই নেই। চারিদিক রুক্ষ শুষ্ক খটখটে। মরা ঘাসের গোছা ভেদ করে বেরিয়ে পড়েছে পাথুরে মাটি। বর্ষার আগে অবধি আর ঢাকা পড়বে না।
গ্রামের ধারে প্রথম ঝুপড়িটার কাছে যখন এসে পৌঁছাল, তখন আকাশে পাণ্ডুরবর্ণ সূর্য দেখা দিয়েছে। ঝুপড়ির পাশে দ্বাররক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া একটা সজনে গাছ। ভিতরে লোক আছে বলে মনে হল না।
“সকালে কাউকে পাওয়া মুশকিল, কাজে বেরোয় সব,” একটা হাই চেপে বলল অবিরাম। এই গ্রামে সে আগে আসেনি, তাই কারুর তাকে চিনে ফেলবার সম্ভাবনা নেই। তবু, সারাটা পথ একটা চাপা অস্বস্তিতে ভুগেছে। ভরত অবশ্য নির্বিকার। খানিকক্ষণ দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলল, “মন্দিরটা কোথায়?”
“ওটা তো জঙ্গলের ভিতরে। এই রাস্তাটা দিয়ে খানিক গেলেই বাঁ-দিকে দেখবি একটা পায়ে-হাঁটা পথ ওপরে চলে গেছে ... কিন্তু তুই গ্রাম দেখবি না?”
“দেখব’খন, ফেরার পথে। এখন চল্, ব্যাঘ্র-দর্শন সেরে আসি।”
এই বলে সটান হাঁটা লাগাল ভরত। এতক্ষণে একটু আরাম পেল অবিরাম।
চড়াই পথ ভেঙে জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে প্রায় ঘন্টা খানেক লাগল। বন বললে সত্যিই যেন অত্যুক্তি করা হয়। এপারে দাঁড়িয়েই অন্য পারের গাছের সারি আবছাভাবে চোখে পড়ে। উপরে তাকালে দেখা যায় ঘোলাটে আকাশ। খানিক দূর যেতেই একটা টিনের শেড চোখে পড়ল। এবং কেউ কিছু বলার আগেই তার ভিতর থেকে একজন মধ্যবয়সী ক্ষয়াটে চেহারার লোক একেবারে মারমুখি হয়ে বেরিয়ে এল। প্রচণ্ড এক গর্জন ছাড়তে গিয়েও, লোকটা বোধহয় তাদের বেশভূষা লক্ষ্য করেই সেটা গিলে ফেলল। সন্দিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনারা?”
অবিরাম আড়চোখে দেখল, ভরত মুচকি হাসছে। লোকটার সরকারী উর্দি থেকে ফরেস্ট গার্ড বলে চিনে নিতে কষ্ট হয় না। বনরক্ষী হয়ে নালন্দা ফরেস্ট ডিভিশানের ডি.এফ.ও-র দিকে তেড়ে আসার মধ্যেকার ব্যঙ্গটা তাকে এড়িয়ে যায়নি। অবিরাম বিরসমুখে পকেট থেকে পরিচয়-কার্ড বার করে লোকটার হাতে গুঁজে দিল। অকারণে কর্তৃত্ব ফলানো তার স্বভাববিরুদ্ধ। তবে আজকে বনরক্ষীর ক্রমশ গোলাকৃত হয়ে ওঠা চোখদুটো দেখে বেশ একটা তৃপ্তির ভাব হল। লোকটা মহাসম্ভ্রমে কার্ড ফেরত দিয়ে কাঁচুমাচুভাবে বলল, “স্যার, যদি জানতাম আপনি আসছেন … আসলে আজ সকাল থেকে এমন এক একটা কেস —”
“হুঁ, বুঝেছি,” একটা হাত তুলে গার্ডের উদ্গত ভাবাবেগের বন্যা থামিয়ে দিল অবিরাম।
“আমার পোশাক দেখেই বুঝতে পারছ, এখানে আমি অফিশিয়ালি আসিনি। আমার এই বন্ধুটি একজন নামজাদা ইকোলজিস্ট, কয়েকদিন জঙ্গলটা সার্ভে করবেন। আপাতত শের-মন্দিরটা দেখতে চাইছেন।”
“বেশ তো, আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন না! শের-মন্দির আরও পশ্চিমে পড়বে, একটু ভিতরের দিকে। কিন্তু স্যার, ওটা তো একেবারে পোড়ো জায়গা। মূর্তি লেপেপুঁছে প্রায় নেই হয়ে গেছে বলা চলে।”
ভরত তখনও কৌতুকের চোখে তাকিয়েছিল লোকটার দিকে। এবারে হাত তুলে এক নমস্কার ঠুকে বলল, “আপনার নামটা?”
“রঘুবীর, স্যার। রঘুবীর পাণ্ডে।”
“বেশ বেশ। রঘুজী, আমার আসল কাজটা হচ্ছে জঙ্গলে কি ধরনের আগাছা আছে তার খোঁজ করা। বেশ কয়েক বার আসব এখানে। তখন আপনার হেল্প লাগবে কিন্তু।”
“হেঁ হেঁ — সেকথা আর বলতে! যখন যেমন মনে হবে, ডেকে নেবেন। আসুন, আসুন, এই দিকে …”
বলতে না বলতেই অবিরাম দেখল, ভরত দিব্যি লোকটার সঙ্গে পরম দোস্তি পাতিয়ে ফেলে, দু-খানা সিগারেট ঘুষ দিয়ে, তার পেটের যাবতীয় কথা টেনে বার করবার গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পন্ন করে ফেলেছে। তাকে ফেলে রেখে হেলতে-দুলতে মন্দিরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল দুজনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্ধুর পিছু ধরল অবিরাম।
এইদিকটায় এখনও জঙ্গল বেশ ঘন। তবে মন্দিরের চেহারা আদতে কীরকম ছিল এখন আর জানবার উপায় নেই। তাদের সামনে একটা ভগ্নপ্রায় ঘরের কাঠামোমাত্র দাঁড়িয়ে। ভিতরে হাঁটু অবধি আগাছা। চুড়োটা ভেঙে অদূরেই পড়ে রয়েছে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জায়গাটা দেখছিল ভরত।
“কি রে? ইকোলজি ছেড়ে এবারে আর্কিওলজি ধরবি নাকি?” হালকা মেজাজে কথাটা বলেই অবিরাম দেখে, ভরতের কপালে ভ্রুকুটি। কয়েক মুহূর্ত একই ভাবে তাকিয়ে থেকে অবশেষে মুখ নামিয়ে বলল, “স্ট্রেঞ্জ!”
অবিরাম তাজ্জব হয়ে বলল, “কেন? এর মধ্যে স্ট্রেঞ্জ আবার কী দেখলি?”
খানিকক্ষণ চুপচাপ ঘাড় চুলকে ভরত বলে, “আই অ্যাম নট অ্যান এক্সপার্ট, অবভিয়াসলি, কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে মন্দিরটা টিবেটান স্টাইলে বানানো।”
“তাতে এত আশ্চর্য হবার কী আছে? নালন্দাতে তো চারিদিকেই এরকম —”
“আরে ধূর! সে কি আর আমি জানি না? কিন্তু, এত প্রাচীন টিবেটান মন্দির অন্য কোথাও দেখেছিস কি? মহাবোধি টেম্পল থেকে শুরু করে নালন্দা বিহারের স্ট্রকচার, সবই ভারতীয় ধারার।”
অবিরাম আর একবার ভাল করে ঠাহর করে মন্দিরটাকে। ভরত ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেলেছে। এবারে রঘুবীরকে জিজ্ঞেস করল, “মন্দিরটা কবেকার, কে বানিয়েছিলেন, কিছু জানা যায় না?”
“কী করে জানা যাবে স্যার! এসব কি আর এক-দেড়শো বছরের কথা? লোকে তো বলে এ হল সেই পদ্মসম্ভবের আমলের এক মন্দির।”
দুজনে চোখ কপালে তুলে বলল, “সেকি!”
রঘুবীর সবজান্তা গলায় বলল, “পদ্মসম্ভব নিজে প্রাচীন নালন্দা বিহারের ছাত্র ছিলেন তা জানেন তো? শান্তরক্ষিত নামে তাঁরই এক অগ্রজ তিব্বতের তৎকালীন রাজার আমন্ত্রণ পেয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে গিয়েছিলেন। এদিকে তিব্বতে তখন ভূত-প্রেত-অপদেবতা একেবারে কিলবিল করছে — তাদের বাগে না আনতে পারলে লোকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নেবে কী করে? কিন্তু অপদেবতা শায়েস্তা করতে তান্ত্রিক দরকার, ওটা শান্তরক্ষিতের কর্ম নয়। পদ্মসম্ভব হলেন প্রেতসিদ্ধ, জীবজগতের উপর তাঁর অসামান্য নিয়ন্ত্রণ; তিনিই পারেন তিব্বতে বৌদ্ধধর্মকে স্থায়ী করতে। তাই শান্তরক্ষিত ওঁকেই ডেকে পাঠাবার পরামর্শ দিলেন। আর তারপর তো পদ্মসম্ভব তিব্বত গিয়ে তাঁর কেরামতি দেখিয়ে সবাইকে থ’ করে দিলেন।”
একটু দম নিতে থামল রঘুবীর। অবিরাম এবারে প্রশ্নটা না করে পারল না, “কিন্তু তিব্বতের কেরামতির সঙ্গে এই মন্দিরের যোগটা কোথায়?”
“যোগ নেই স্যার। তিব্বত এপিসোডটা ইন্টারলিউড। কিন্তু তারপর একবার ভুটানে —”
“আবার ভুটান!”
“আহা, শুনুনই না! একবার ভুটানের পাহাড়ে একটা দৈত্যর উপদ্রব শুরু হয়েছিল। খবর পেয়েই পদ্মসম্ভব তিব্বত ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিন্তু দৈত্যটা পাহাড়ের এমন এক দুর্গম কোণে লুকিয়ে আছে, সেখানে গিয়ে পৌঁছানোই একটা মারাত্মক কাজ। তা পদ্মসম্ভব কীভাবে সেখানে গেলেন বলুন তো?” রঘুবীর একবার দুজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে নাটকীয়ভাবে জিজ্ঞেস করল। দুজনেই অবশ্য হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। দৃশ্যটা খানিকক্ষণ উপভোগ করে রঘুবীর ঘোষণা করল, “উড়ুক্কু বাঘ!”
অবিরাম খাবি খেয়ে বলল, “কীঃ?”
রঘুবীর খিকখিক করে হেসে বলল, “আজ্ঞে, ঠিকই শুনেছেন। বিশাল ডানাওয়ালা এক বাঘিনীর পিঠে চড়ে পাহাড়ের গুহায় ঢুকে দৈত্যকে একেবারে মেরে পাট করে ছেড়ে দিলেন।”
“তারপর?”
“তারপরেই হল আসল কথা। বাহনের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন পদ্মসম্ভব। এখানকার লোকে বলে, ভুটানের সেই লড়াইয়ের পর তিনি নাকি আবার এসেছিলেন নালন্দা বিহারে। সেই সময়েই পাহাড়ের উপর এই মন্দির তৈরি করিয়ে তাঁর বাহনের আদলের এক মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন সেখানে। মানুষ এবং বনের প্রাণী, মন্দিরের এই বাঘ সবাইকেই অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে।”
এরকম মাথামুণ্ডুহীন গল্প বাপের জন্মে কোনোদিন শুনেছে কি না মনে করতে পারল না অবিরাম। ভরত ভুরু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তার মানে দিস শ্রাইন ওয়াজ বিল্ট ইন দি এইট্থ সেঞ্চুরি?”
অবিরাম মাথা চাপড়ে বলল, “সাতসকালে কীসব উন্মাদের পাল্লায় পড়তে হল রে বাবা! নে, মূর্তি-টুর্তি কী দেখবি চটপট দেখে, এক্ষুনি লোকটাকে বিদায় কর। যত্তসব গাঁজাখুরি গল্প।”
“এত বেরসিক কেন তুই?” বলে মন্দিরের ধ্বসে-পড়া প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায় ভরত। ভাগ্য ভাল, যা দেখার বাইরে দাঁড়িয়েই মোটামুটি দেখে নেওয়া যায়। প্রায় বুক-সমান ঘাস, লতা, আর আগাছার সমুদ্রের উপর দিয়ে গলা বাড়াল অবিরাম। এবং সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল, ভরতের অনুমান মিথ্যে নয়। মূর্তিটার বৈশিষ্ট্য তেমন কিছু বাকি নেই। শুধু তার সুবিশাল হাঁ করা মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা জিভটা অক্ষত। সেই জিভ ড্রাগনের মতোই সরু আর লকলকে। বাঘটার মাথার আকৃতিও যেন অনেকটা নেকড়ের মতো। এর সাথে ভারতীয় বাঘের মিল নেই।
ভরত খানিক স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল মূর্তির দিকে — ছবি তুলবার চেষ্টা করল না। তারপর রঘুবীরকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে বোধহয় কেউ পুজো দেয় না?”
রঘুবীর একেবারে হাঁ-হাঁ করে উঠে বলল, “বলেন কী স্যার? জঙ্গলের ত্রিসীমানায় কারুর টিকির ডগাটুকু দেখলেই তাড়া করে যাই। এই তো আজ সকালেই —” বলেই যেন একটা হেঁচকি তুলে থেমে গেল। এবারে অবিরামের অবাক হওয়ার পালা।
“কী হল? আজ সকালে কী?”
খানিকক্ষণ ইতস্তত করে রঘুবীর অবশেষে চাপা স্বরে বলল, “ওই গ্রামের লোকগুলো সুবিধের নয় স্যার। একদল ছোঁড়া সব সময় খরগোস ধরবার জন্য ওত পেতে থাকে। জঙ্গলের অন্য প্রান্তে যে বাজারটা, ওখানে গ্রামের অনেকের চায়ের দোকান আছে; ওরা সুযোগ পেলেই বনে আগুন লাগিয়ে দেয়, যাতে গাছগুলো মরে যায় আর ওরা সেই কাঠ নিয়ে এসে জ্বালানি করতে পারে।”
“ওদিকটায় কারা গার্ড দেয়?”
“নিখিল আর পবন, স্যার। অনেক বার বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি আমরা। কম গিয়েছি ওদের গ্রামে? কথা কানেই তোলে না। ওদের সবার ধারণা জঙ্গলটা হল ওদের পরদাদার সম্পত্তি!”
বাকি পথটুকু তেমন কোনো কথা হল না। ভরত আগাছা খুঁজতেই ব্যস্ত ছিল। এদিকেও ল্যান্টানার অস্তিত্ব রয়েছে, যদিও তেমন জাঁকিয়ে বসেনি এখনও।
৫
ফিরতি পথে যে ভরত আবার মার্কসবাদীনগরে ঢুকবে, তা ভাবেনি অবিরাম। গ্রামের মাঝবরাবর বড় গলিটা ধরে খানিক দূর এগিয়েই একটা কুঁড়ে ঘরের দাওয়ার উপর এক অশীতিপর বৃদ্ধকে বসে ঝিমোতে দেখল তারা। ভরত ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে মখমলের মতো নরম গলায় ডাকল, “চাচা!”
বৃদ্ধ চটকা ভেঙে চোখ সরু করে তাকিয়ে বললেন, “কে?”
“আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছিলাম — ফেরার পথে ঢুকে পড়েছি। ভারি চমৎকার গ্রাম আপনাদের!”
বৃদ্ধ তাঁর ঘোলাটে ছানি-পড়া চোখে অপলক তাকিয়ে রইলেন ভরতের দিকে। তারপর খ্যাসখ্যাসে গলায় বলে উঠলেন, “জঙ্গল? জঙ্গল আবার কোথায়?”
ভরত একটু হকচকিয়ে গিয়ে আমতা-আমতা করল, “জ-জঙ্গল মানে —”
“জঙ্গল ছিল আমার ছোটবেলায়,” বৃদ্ধ ভরতের কথা গ্রাহ্য না করে বলে চললেন, “সে কী জঙ্গল! ভালু তো ছিলই, শের-ও ছিল দু-একটা। অমাবস্যায় আমরা শের-মন্দিরে পূজা দিতে যেতাম, যাতে জান্বরগুলো গাঁয়ের পানে না আসে। দাদাজীর মুখে শুনতাম, ওঁর জমানায় জঙ্গল আরও অনেক ঘন, অনেক জ্য়াদা খতরনাক ছিল। আমরা যখন জন্মেছি, ততদিনে গোরা সরকার অর্ধেক জঙ্গল শেষ করে এনেছে বটে, কিন্তু তখনও লোকের মনে অরণ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল।”
একটানা এতগুলো কথা বলে থেমে গেলেন বৃদ্ধ, হয়তো হাঁপ ধরে গিয়েছিল তাঁর। ভরত চাপা উত্তেজনায় বলে উঠল, “তারপর?”
এবারে বৃদ্ধের দৃষ্টিতে অবজ্ঞার রেশ ফুটে উঠল।
“তারপর আবার কী? মরে যাওয়ার পর চিকিৎসা করলে কি লাভ হয় কিছু? সরকার মাইনে দিয়ে লাশ পাহারা দেওয়ার লোক পুষছে — আর আমরা, যারা এখনও জিন্দা আছি, তাদের চিতায় পাঠাবার জুগাড় করছে! এভাবে আর কতদিন চলবে, সাহাব্?”
অবিরামের ভিতরটা কেঁপে উঠল। ওই জরাজীর্ণ দেহটার ভিতরে এত তেজ! ভরত বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বলল, “কাকে মেরেছে ওরা?”
অম্লরসাক্ত হাসি হেসে বৃদ্ধ বললেন, “এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যাও পুবদিকে, বড় সজনে গাছতলায়।”
অর্থাৎ আসবার পথেই যে বাড়িটা গ্রামের সীমান্তে একলা দাঁড়িয়েছিল। এখন কিন্তু সেখানে গিজগিজ করছে লোক। ভরত হঠাৎ গুম মেরে গিয়েছে। অবশ্য বুড়োর কথা শুনে অবিরামের মনেও মেঘ ঘনিয়ে এসেছিল। কিন্তু ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছে, সেটা জানবার কৌতূহলও বড় কম নয়।
বাড়িটার দোরগোড়া ঘিরে জটলা তৈরি হয়েছে। দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে আছে একটি মেয়ে। জনাপাঁচেক মহিলা তার শুশ্রুষায় ব্যস্ত। মেয়েটার ময়লা কাপড় জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে গিয়েছে। হাতে-পায়ে ছড়ে যাওয়ার লম্বা-লম্বা দাগ। তবে সবচেয়ে গুরুতর তার মাথার চোট। কপালের ডান দিকের রগ ঘেঁষে বিঘতখানেক লম্বা একটা ক্ষত। জায়গাটা বিশ্রীভাবে ফুলে গিয়ে ডান চোখটাকে প্রায় বুজিয়ে দিয়েছে। রক্ত বন্ধ হয়েছে বটে, কিন্তু দেখে মনে হয় শেষ অবধি সেলাই করতে হাসপাতালে যেতে হবে। আশ্চর্য, এরকম শারীরিক বিপর্যয় সত্ত্বেও মেয়েটার মধ্যে মুহ্যমান হয়ে পড়বার কোনো লক্ষণ নেই! বরং আহত বাঘিনীর মতোই থেকে থেকে ফুঁসে উঠছে।
ভরত ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়ানো একজন প্রৌঢ় লোকের কাছ থেকে খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। অবিরাম কান পেতে শুনল, লোকটি আক্ষেপের স্বরে বলছে, “কত বুঝিয়েছি ফরেস্ট গার্ডের সঙ্গে পাঙ্গা না নিতে, সুনেগী তব্ না! আমরা গরীব আদ্মী, মাঝেসাঝে জ্বালানি কাঠকুটো কুড়াতে যাই জঙ্গলে — টহলদার দেখলে তাড়া করে, লক্ড়ির আঁটি বাঁধবার রসি কেটে দেয়, আমরাও পালিয়ে আসি। লেকিন এই ছোরী গেছে টহলদারের সঙ্গে হাতাপায়ী করতে! সেও মেরেছে তার মাথায় বন্দুকের বাড়ি, আর মেয়েটা পাহাড় থেকে গড়াতে গড়াতে পড়েছে নীচে। তাতেও সবত্ শেখেনি! এদিকে আমরা তো ভয়ে মরছি, ওই গার্ড ছোরা কোনও শিকায়ত না করে দেয়!”
ভরত নিঃশ্বাস ফেলে লোকটার কাঁধে হাত রাখে একবার। তারপর অবিরামের আস্তিনে টান দিয়ে বলে, “লেট্স গো।”
ভিড় ঠেলে বেরোতে বেরোতে নারীকণ্ঠের চিৎকার কানে এল। আহত মেয়েটাই চেঁচাচ্ছে।
“জঙ্গল কী বেটী কো জঙ্গল সে নিকালোগে? হম ভী দেখেঙ্গে!”
৬
রাত গভীর হয়েছে। বিছানায় অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শেষে বিরক্ত হয়ে ছাদে উঠে এসেছিল অবিরাম। ভরতের ঘর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল সে — কিন্তু কখন যেন তার পিছু পিছু উঠে এসে এখন উইলিয়াম ব্লেক আওড়াচ্ছে! অবিরামের মাথাটা আরও গরম হয়ে উঠল। ভরত কি মজা দেখছে নাকি? তার বন্ধুর অধস্তন কর্মীদের হাতে এলাকার মানুষদের হেনস্থা হতে হচ্ছে, তার জন্যে কি ভিতরে ভিতরে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে? মার্কসবাদীনগরের সেই বৃদ্ধের গরলাক্ত বাক্যবাণ, আহত মেয়েটার অভিশাপ, সমস্তটাই তার মর্মে বিঁধে আছে। এর মাঝে দেখিয়ে দেখিয়ে মরাল হাই-গ্রাউন্ডটা না নিলে বুঝি ভরতের চলছিল না!
“তোর ঘুম আসেনি?”
“দেখতেই তো পাচ্ছিস,” তীর্যকভাবে বলে অবিরাম।
কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানে ভরত। তারপর বলে, “অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়েছিলাম। ঘুম এল না। তাই ছাদে একটু পায়চারি করছিলাম। ফিরতেই যাচ্ছিলাম, এমন সময় সিঁড়িতে তোর পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম।”
অবিরাম এবারে অবাক হল। তার নিজের না হয় জেগে থাকার বিস্তর কারণ আছে, কিন্তু ভরতের কেন ঘুম আসবে না? প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, তবু চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ভরত নিজেই আনমনে বলতে শুরু করে, “এই কবিতাটা খুব বলত আকিলা। ‘টাইগার টাইগার, বার্নিং ব্রাইট, ইন দ্য ফরেস্ট অফ দ্য নাইট ...’”
“আকিলা ... সে আবার কে?”
“সকালে বললাম না? টাইগার রিসার্ভের সেই গাইড — আমাদের রিসার্চ টিমকে সব ঘুরিয়ে দেখাত। সে-ই আকিলা।”
বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় অবিরাম। ভরতের গলায় এ কোন সুর! এই আবেগের আর্দ্রতা, বিষাদের ভার, এ কীসের ইঙ্গিত! যেন এক যুগ পরে একটা ব্যথিত হাসির রেশ কানে আসে। ভরত বলে, “মানুষের অদ্ভুত কিছু ব্লাইন্ডনেস থাকে, তাই না? এডুকেশান ইজ সাপোজড টু এনলাইটেন আস। কিন্তু শিক্ষার কারণেও এমন কিছু অন্ধত্ব জন্মায় আমাদের মনে ভিতর ... আর সেগুলো এমন অপূরণীয় ক্ষতি করে দিয়ে যায় ...”
অবিরাম আর না পেরে বলে ওঠে, “এসব কী আবোল-তাবোল বকছিস তুই?”
ভরত যেন তার কথা শুনতেই পেল না। ঘোরলাগা স্বরে স্বগতোক্তির মতোই বলতে লাগল তার গল্পঃ
“বিল্লগিরি পাহাড়ের এক উপজাতীর মেয়ে ছিল আকিলা। ওই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বনের গভীরে বড় হয়ে উঠেছিল। তবে স্কুল-কলেজেও পড়েছিল সে, প্রথাগতভাবে পরীক্ষা দিয়েই রিসার্ভে গাইডের কাজ পেয়েছিল। সারা দেশ ঘুরে কত লোককেই তো দেখলাম। কিন্তু ওর মতো নির্ভীক, ব্যতিক্রমী, আর আত্মবিশ্বাসী মানুষের দেখা আজও পেলাম না।
“ওর কম্যুনিটির প্রায় সকলেই অবশ্য প্রবল সাহসী আর বিচক্ষণ। বাঘ যাদের প্রতিবেশী, তাদের কি আর ভিতু হলে চলে! সরকার যখন ওখানকার ফরেস্টল্যান্ডকে প্রোটেক্টেড এরিয়া বলে ঘোষণা করল, তখন আকিলাদের গোষ্ঠীর উপরেই সবচেয়ে মারাত্মক আঘাতটা গিয়ে পড়েছিল। জঙ্গল থেকে তাদের উৎখাত করবার বিরাট এক ক্যাম্পেন চলল বছর খানেক ধরে। ওঁরা কিন্তু দলবদ্ধ হয়ে খুব মেথডিক্যালি তাঁদের ফরেস্ট রাইটস ক্লেম করে আদালতে গেলেন, এবং তাঁদেরই জিত হল। আকিলার তখন আর কত বয়স! কুড়ি-বাইশ হবে? কিন্তু অধিকারের এই লড়াইয়ে সে ছিল প্রথম সারির একজন সৈনিক।
“তার কম্যুনিটির বাকিদের মতোই আকিলাও তাদের নিজস্ব পরিবেশজ্ঞানের ভাণ্ডার আহরণ করে বড়ো হয়েছিল। জীবজন্তুর পায়ের ছাপ আর গন্ধ ডিকোড করতে জানত কোনোরকম টেকনোলজি ছাড়াই। জঙ্গলের সমস্ত গাছপালা-লতাগুল্মের স্পিশিজ ছিল তার নখদর্পণে। উপরন্তু, কলেজে জুওলজি পড়বার দরুন শহুরে পরিবেশবিদদের সাথে সমস্তরকম বৈজ্ঞানিক আদানপ্রদানে ছিল সাবলীল।
“আকিলার সঙ্গে আমার আলাপ হয় চার বছর আগে। আমি তখন সবেমাত্র ল্যান্টানাচর্চা আরম্ভ করেছি। প্রথম দর্শনেই তার জ্ঞানের পরিধি বিস্মিত করেছিল আমায়, তার রূপ, গুণ, এবং সহজ সহৃদয়তায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সে হয়তো আমাকে দেখে তেমন প্রভাবিত হয়নি, কিন্তু তার পর দীর্ঘ সময় একসঙ্গে কাজ করতে করতে ... যা হয় আর কি। উই বিকেম রিয়লি ক্লোজ। এমনকী, একসময়ে ভাবলাম, আকিলাকে আমি বিয়েই করব।
“এখন স্বীকার করতে বাধা নেই, আমার ইমোশানের সঙ্গে একধরনের আত্মম্ভরিতাও মিশে ছিল। আমি শহরে বড় হওয়া উঁচু জাতের, উঁচু বংশের ছেলে। আকিলার যতই গুণ থাকুক, সে তো গ্র্যাজুয়েশানের বেশি এগোতে পারেনি — আর আমি তখন একটা নামী প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় পোস্ট-ডক্টরাল স্কলার। আমার মতো একজন পুরুষকে যে আকিলা প্রত্যাখ্যান করতে পারে, এ কথা আমি কল্পনাতেও স্থান দিতে পারিনি। অথচ, দেওয়া উচিত ছিল। আকিলা যেমন মুক্তমনা ছিল, তেমনই ছিল দৃঢ়চেতা। তার সব কাজের মধ্যে দায়িত্ব এবং সততার এমন স্পষ্ট চিহ্ন থাকত, যে উর্ধ্বতন সহকর্মীরাও তাকে সমীহ করতেন। অনেক সময় যখন তার কাছে অনাবশ্যক বিদ্যে জাহির করতাম, তখন আকিলা হাসতে হাসতে আমার হাতে মৃদু চাপড় মেরে বলত, ‘স্টপ ম্যান্স্প্লেনিং, ভরত!’
“এরকম স্নেহময় শাসনের কদর করতাম না। বরং তার এই উন্মুক্ত, স্বাধীন সত্ত্বার প্রতি একটু বিরক্তিই বোধ হত। কিন্তু আপাতভাবে, আমাদের বহু অমিলের মধ্যে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মনান্তরের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা হল ধর্মাচরণের প্রতি আমাদের বিপরীত মনোভাব।
“তুই তো জানিস, আমি বরাবরই ঘোর নাস্তিক। তাই বলে অন্যের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করাও আমার স্বভাব নয়। কিন্তু তখন যে হঠাৎ কী দুর্বুদ্ধি হয়েছিল! আকিলাদের কম্যুনিটির লোকজন নানা দেবদেবীর পুজো করতেন — জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় তাঁদের দেবস্থান ছিল। আকিলা সব আচার-অনুষ্ঠান নির্বিবাদে পালন করত। আর ওঁদের যে ব্যাঘ্র-দেবতা — হুলিভেরাপ্পা — তাঁর প্রতি তো আকিলার অবিচল ভক্তি! এ আমার অসহ্য বোধ হত। আবার একই সঙ্গে এক বিচিত্র সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতাম। মনে হত, যতই হোক, ট্রাইবাল মেয়ে — হাজার পড়াশোনা করেও এইসব তুকতাক মন্ত্রতন্ত্রের কুসংস্কার মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। এই নিয়ে ছুতোয়-নাতায় তর্ক বাধিয়ে দিতাম। আকিলা যেন আমার মতলব বুঝেই সযত্নে ওইসব বিষয় এড়িয়ে যেতে শুরু করল। তাতে আমি আরও তেলেবেগুনে জ্বলতে লাগলাম। শেষে একদিন আকিলা থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তোমার সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমি তো আমার মনের বিশ্বাস তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতেও চাইছি না, তর্ক করে তোমার মন বদলানোর চেষ্টাও করছি না। তাহলে তোমার বিরক্তির কারণটা কী?’
“আমি গোঁজ হয়ে বললাম, ‘তোমার এই বিশ্বাস ভিত্তিহীন। ইল্লজিকাল।”
একথা শুনে আকিলা হেসে বলল, “ইল্লজিকাল তো অবশ্যই! বিশ্বাসের তো কোনো লজিক থাকে না! যদি যুক্তি আর এভিডেন্স দিয়ে আমরা বিশ্বাসকে প্রমাণ করতে পারতাম, তাহলে তো সেটা বিশ্বাস থাকত না — সত্য হয়ে যেত! তবে আমার বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই, এ কথা মানব না। বহু শতাব্দী ধরে ভয়ংকর-সুন্দর এক প্রাণীর সঙ্গে সহাবস্থান করে বেঁচে আছে যে গোষ্ঠী, তাদের বিশ্বাস ভিত্তিহীন হয় কী করে? এই বিশ্বাস এসেছে অভিজ্ঞতা থেকে, এই বিশ্বাস আমাদের সংযমী এবং সতর্ক হতে শিখিয়েছে। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই হল আমাদের বেঁচে থাকার শক্তির উৎস।”
“এবারে আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, ‘শ্রদ্ধা এক জিনিস, আর কুসংস্কার অন্য জিনিস। তোমাদের এইসব বুজরুকির উদ্দেশ্য একটাই। লোককে ভয় দেখিয়ে তাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা।’”
থেমে যায় ভরত। যেন অতদিন আগে বলা সেই কথাগুলো আটকাতেই মুখের উপর ডান হাতটা চাপা দেয়। অবশেষে একটা বুকভাঙা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আমি কথাগুলো বলে ফেলেই বুঝেছিলাম, ভুল করেছি। কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গেছে। আকিলার চোখদুটো হঠাৎ যেন দপ্ করে জ্বলে উঠল। তারপর সে খুব শান্তভাবে বলল, ‘ইর্রেভারেন্স ইজ নেসেসারি সামটাইমস, ভরত। বাট ডিসরেসপেক্ট ইজ আনফরগিভেবল।’
“আকিলার সঙ্গে সেই ছিল আমার শেষ দেখা। নিজে দোষ করে নিজেই মেজাজ দেখিয়ে আসাম চলে গেলাম, এমনই আমার ইগো। ভাবলাম, আমি ফিরতে ফিরতে নিশ্চয়ই ওর গুমোর ভাঙবে। কিন্তু তার ঠিক এক সপ্তাহ পরেই ভয়ংকর দাবানল লাগল জঙ্গলে। ফরেস্ট গার্ডরা প্রায় সকলেই তাদের রেসকিউ মিশান শেষ করে নিরাপদে বেরোতে পেরেছিল। কিন্তু আকিলা একটা হরিণকে বাঁচিয়ে আনতে গিয়ে অবলীলায় নিজের প্রাণ দিয়ে দিল। বিশ্বাসের জোর না থাকলে এত সাহস হয় কী করে?”
শেষ প্রশ্নটা যে তাকে করা হয়নি, তা অবিরাম জানে। তবু কিছু একটা বলতে চায় সে, তার বহুদিনের পুরনো সুহৃদের এই অসহ্য বোঝার ভার খানিকক্ষণের জন্যে হলেও ভাগ করে নিতে চায়। কথা খুঁজে পায় না অবশ্য। রাত বেড়েই চলেছে। মনের বিষাদই বোধহয় অবশেষে তন্দ্রার রেশ এনে দিয়েছে তার চোখে। কিন্তু ঠিক তখনই ভরতের চাপা আর্তনাদে এক নিমেষে খানখান হয়ে গেল সেই আমেজ।
“ওঃ মাই গড!”
এক ঝটকায় পিছনে ফিরল অবিরাম। তার চোখের সামনে অন্ধকারের বুক চিরে একটা কমলা রেখা ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে ও কীসের আলো? অবিরামের বুকে হাতুড়ি পড়ল। আগুন! এই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে, শিশিরের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই দাবানলের সূত্রপাত? কিন্তু ... ওইদিকে তো আগাছার সেরকম বাড়াবাড়ি দেখেনি আজকে! প্রামের লোকেরা রাগের মাথায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে হয়তো ... যদিও তা পরম নির্বুদ্ধিতার কাজ, কারণ জঙ্গলের কোল-ঘেঁষা ওই গ্রামের লোকেদেরও তাতে বিপদ হয়ে যেতে পারে ... কিন্তু এখন এসব ভাববার সময় নেই। সে যখন নিজে এখানে উপস্থিত, তখন যা কিছু স্টেপ নেওয়ার তাকেই নিতে হবে। ব্যস্তভাবে সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়েও থমকে যায় অবিরাম।
আগুনটা সরলরেখায় এগিয়ে চলেছিল পাহাড়ের গা বেয়ে। কিন্তু দিকচক্রবালের সমান্তরাল সেই রেখাটা মাঝখানে এক জায়গায় হঠাৎ ওরকম লকলকিয়ে উঠেছে কেন? এত দূর থেকে দেখতে গিয়েই তো চোখ ঝলসে যাচ্ছে প্রায়। তাহলে জঙ্গলের ভিতরে আগুনের শিখা কত উঁচুতে পৌঁছে গেছে? দেখতে দেখতে আগুন একসময় যেন আকাশটাকেই ছুঁয়ে ফেলল! ভয় এবং বিস্ময়ে বিমূঢ় অবিরাম টের পায়, ভরতের কম্পিত আঙুলগুলো প্রাণপণে চেপে ধরেছে তার হাত। সেও কি তাহলে এই ভয়ংকর দৃশ্যের তাৎপর্য বুঝতে পেরেছে?
অবশ্যই পেরেছে। মানেটা দুজনের সামনেই মূর্ত হয়ে ফুটে উঠছে। আকাশচুম্বী লেলিহান আগুন জমাট বেঁধে ক্রমে এক পরিচিত আকার ধারণ করছে। পীতাভ শিখার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে কালো অন্ধকারের ডোরা ডোরা দাগ; অবয়বের দু’পাশ জুড়ে আগুন যেন বিশাল দুটো ডানার মতোই বিস্তারিত। শেষ মাঘের রাত্রি বিদীর্ণ করে গর্জন করে উঠল সেই বহ্নি-দানব — চরাচর প্লাবিত হয়ে ডুবে গেল তার ভাস্বর শরীরের ছটায়।