• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • অক্সিজেন : সুস্মিতা ঘোষ

    “কে কাঁদছে, না? একটা কান্নার শব্দ পাচ্ছি মনে হচ্ছে!” একটুক্ষণ কান পেতে থেকে পলাশ জিজ্ঞাসা করল পাশে দাঁড়ান শিমুলকে।

    “ও তো বকুলের গলা… কিন্তু বকুল এখন কাঁদছে কেন? আজ সকালেই তো দেখলাম ও কত হাসিখুশি ছিল, মাথা নেড়ে নেড়ে কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে গল্প করছিল…”

    পাশে দাঁড়ান জারুল এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এখন বিষণ্ণ চোখে চেয়ে বলল, “তোমরা কি খবরটা পাওনি এখনও? বিকেলে বাতাস যখন কানে কানে খবরটা দিয়ে গেল সবাইকে, তোমরা মনে হয় সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঝিমুচ্ছিলে; তাই টের পাওনি।”

    এবার পলাশ আর শিমুল পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে শুরু করল। কী খবর যা সবাই জানে, শুধু তারা জানে না? কী খবর যার জন্য বকুল এই ভরসন্ধ্যেবেলা কাঁদছে? খুব ভয়ে ভয়ে শিমুল জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে জারুল ভাই? কোনো খারাপ খবর কি?”

    একটু থেমে বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে বলল জারুল, “হ্যাঁ, ভীষণ খারাপ খবর। আমাদের এই রাস্তাটা যেটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে দৃষ্টির অন্তরালে, সেটা রাজ্য সড়ক যোজনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, শুধু তাই নয় তালিকার একদম প্রথম দিকে এর নাম আছে। এটা এখন চওড়া কালো পিচের পাকা মসৃণ রাস্তা হবে।”

    “এটা তো খুবই ভালো খবর! এতে দুঃখ পাওয়ার কী আছে?” একটু অবাকই হল পলাশ।

    সঙ্গে যোগ করল শিমুল, “ঠিক… রাস্তাটা নতুন করে আবার তৈরি হলে কত সুন্দর লাগবে দেখতে, আশপাশের গ্রামের মানুষদেরও কত সুবিধে হবে যাতায়াতের।”

    “শুধু রাস্তাটা নতুন হলে তো কোনো অসুবিধা ছিল না, রাস্তা চওড়াও হবে। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য বৃদ্ধিতে এই রাস্তাই হবে অন্যতম প্রধান সহায়ক…,” জারুল বলল খুব ধীরে ধীরে।

    এবার যেন শিমুল একটু ভয় পেল, একটা আশঙ্কার বাষ্প ঘনীভূত হয়ে উঠল তার মনে, “তার মানে? চওড়া হবে কেমন করে? অত জায়গা কই?”

    পলাশ বিষয়টি এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। এসব জটিল ব্যাপার সহজে তার বোধগম্য হয় না। সে জারুলকে ধরে পড়ল, “একটু সহজ করে বোঝাও না, কী বলতে চাইছ তোমরা? পাকা রাস্তা হলে বা চওড়া রাস্তা হলে কী সমস্যা?”

    জারুল এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, কান্নায় ভেঙে পড়ল। শিমুলের মুখ থমথমে হয়ে উঠল, সে অনেকটাই বুঝতে পারছে পরিস্থিতি। পলাশ বিষয়টি ঠিকমত বুঝে উঠতে না পারলেও একটি অজানা আশঙ্কায় তার বুকও কেঁপে উঠল। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে একটু সংযত করে জারুল বলল, “রাস্তা পাকা হওয়াতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু রাস্তা চওড়া করতে গেলে যে আমাদের আর এখানে থাকা চলবে না…”

    বিস্ময়ে অধীর হয়ে পলাশ বলল, “আমাদের আর থাকা চলবে না মানে? এখানে না থাকলে আমরা যাব কোথায়? আর যাবই বা কীভাবে? আমরা তো আর হাঁটতে পারি না!”

    “হ্যাঁ, সেইজন্যই সরকারি তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আমাদের কেটে ফেলা হবে…,” বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল এবার জারুল।

    শোনামাত্র পলাশ হু-হু করে কেঁদে উঠল। তাকে দেখে শিমুলেরও চোখের জল আর বাঁধ মানল না। পাশে দাঁড়ান কৃষ্ণচূড়া, তার পাশের ইউক্যালিপটাস, তারও পাশের কুলগাছটাও এবার কাঁদতে শুরু করে দিল। বিকেলে খবরটা পাওয়ার পর থেকেই সবাই ভয়ে দুঃখে আতঙ্কে যেন শ্বাসরুদ্ধ করে ছিল, এখন অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বুকচাপা কান্না বাইরে বেরিয়ে আসতে শুরু করল বাঁধভাঙা প্লাবণের মত।

    জারুলের পাশে দাঁড়ান আমগাছটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, “এবছরই আমার ক’টা নতুন চারা হয়েছে, বাছারা বুক ভরে শ্বাস নেওয়ারও সুযোগ পাবে না, তার আগেই এই পৃথিবী ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে!”

    কিছু দূরে দাঁড়ান সর্বক্ষণ ঝিমুতে থাকা বুড়ো বট দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলে বলল, “নিজের জন্য আমার দুঃখ নেই, বুড়ো হয়েছি, আজ নয় কাল চলেই যেতে হতো। কিন্তু আমার শাখা-প্রশাখায় বাসা বেঁধে থাকা এত পাখি, কাঠবিড়ালি, কীট-পতঙ্গ— এদের কী হবে? আমার ছায়ায় বিশ্রাম নিতে আসা সেই পথিক বা রোদে খেটে হা-ক্লান্ত সেই চাষীর কী হবে? আমার অভাবে ওরা তোদের কাছে আশ্রয় পেত… তোরাও না থাকলে ওরা যাবে কোথায়? সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়বে যে…”

    প্রায় কুড়ি-একুশ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা। জারুল, বকুল, পলাশ, শিমুল, কুল, কৃষ্ণচূড়া— সকলের আশঙ্কাকে সত্যি করে দিয়ে একদিন সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেল রাস্তা পাকা করার, রাস্তা চওড়া করার আর রাস্তার দু'ধারে দাঁড়ান গাছগুলোকে কেটে ফেলার। পরিবেশকর্মীদের সব বাধাকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটা সময় কেটেও ফেলা হল সব গাছ, যদিও সরকারি তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল রাস্তার কাজ শেষ হলেই আবার দু'ধারে নতুন চারাগাছ লাগিয়ে দেওয়া হবে; কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি পালন করার তাগিদ আর পরে তেমনভাবে দেখা গেল না। বিশ্ব পরিবেশ দিবস বা অন্যান্য কোনো কোনো বিশেষ দিনে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু চারাগাছ লাগান হলেও সে চারাগাছ মাথা তুলে দাঁড়াল, না গরু-ছাগল তাকে মুড়িয়ে খেল— সে খবর অবশ্য আর কেউ রাখল না…

    বিপুল সামন্ত রাজ্য প্রশাসনের এক পদস্থ আধিকারিক। অতিমারি শুরু হতেই কাজের চাপ বহুগুণ বৃদ্ধি পেল, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অসহায় মানুষের কাছে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে বিভিন্ন এলাকা তাকে চষে বেড়াতে হয়। প্রথম কয়েক মাস ঠিকই চলছিল, হঠাৎ একদিন বিকেলে সে বাড়ি ফিরল গায়ে জ্বর নিয়ে। স্ত্রী সুদীপ্তা দু’বছরের মেয়ে ঊর্মিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গেছে। বাড়িতে সত্তরোর্ধ্ব বাবা-মা, তাই সে প্রথমেই নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিল; স্ত্রীকে ফিরে আসতে নিষেধ করল, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। চার-পাঁচ দিন পর প্রথমে মা বিনতা দেবী এবং তার পর বাবা সুধাময়বাবু করোনায় আক্রান্ত হলেন। প্রথম কয়েকদিন জ্বর, সর্দি-কাশির মতো কিছু সাধারণ উপসর্গ থাকলেও, সমস্যা তেমন গুরুতর ছিল না। অনলাইনে ডাঃ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে তাঁর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ আনিয়ে তারা প্রত্যেকেই খাচ্ছিল, সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শমত নজরও রাখছিল শরীরের অক্সিজেনের মাত্রা ঠিকঠাক আছে কি না? সমস্যা শুরু হল সুধাময়বাবুর করোনা হওয়ার অষ্টম দিন থেকে হঠাৎ তাঁর শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়াতে। ডাঃ চৌধুরী পরামর্শ দিলেন দেরি না করে হাসপাতালে ভরতি করে দিতে। সঙ্গে সঙ্গে বিপুল অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করল হাসপাতালে। কিন্তু ওদিক থেকে উত্তর এল, “হাসপাতালের সবকটি অ্যাম্বুলেন্সই বাইরে আছে, ফিরলে তবে পাওয়া যাবে।”

    “কখন পাওয়া যাবে?” বিপুলের উৎকণ্ঠিত জিজ্ঞাসা।

    ও প্রান্তের স্বর জানাল, “তা তো ঠিক বলতে পারছি না, পরে খোঁজ নেবেন,” কেটে গেল ফোন।

    এদিকে পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করল, সুধাময়বাবুর শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। দিশেহারা বিপুল সাহায্যের জন্য ফোন করতে শুরু করল সমস্ত চেনা-পরিচিত, বন্ধু-বান্ধবের কাছে।

    “আশিস, তোর কোনো চেনা অ্যাম্বুলেন্স আছে বা চেনা কোনো সংস্থা, যারা সাহায্য করতে পারবে…”

    “কেন? কার কী হয়েছে?”

    “বারো-তেরো দিন আগে প্রথমে আমার এবং আজ আট দিন হল বাবা-মায়েরও করোনা হয়েছে। এই ক’দিন কোনো সমস্যা ছিল না বলে বাড়িতেই ছিলাম সবাই, কিন্তু আজ সকাল থেকে বাবার খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, কোনো অ্যাম্বুলেন্স পাচ্ছি না হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য,” বিপুলের বাষ্পরুদ্ধ গলা।

    “আমার তো কোনো চেনা অ্যাম্বুলেন্স নেই, তবে তুই চিন্তা করিস না; আমি দেখছি কী করা যায়।” আশ্বাস দিয়ে বলল আশিস।

    চেনা-পরিচিত মহলে ক্রমাগত খোঁজখবর করে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহযোগিতায় দুপুরের পর অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল, একই সঙ্গে খোঁজ চলতে লাগল কোথায় শয্যা ফাঁকা আছে। এদিকে অক্সিজেনের অভাবে সুধাময়বাবু জল থেকে তোলা মাছের মতো খাবি খেতে শুরু করেছেন ততক্ষণে, একটা সময় তিনি চেতনা হারালেন। সন্ধ্যের পর অবশেষে বেলেঘাটা আই.ডি.-তে বাবাকে ভরতি করতে বিপুল সক্ষম হল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল আই.সি.ইউ.-তে। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু সকলের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে পরদিন দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ তিনি ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। স্তম্ভিত হয়ে গেল বিপুল! দুর্বল শরীরে বাইরে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নাকে গিলে নিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য হল সে; ততক্ষণে যে মা বিনতাদেবীকে নিয়েও শুরু হয়ে গেছে যমে-মানুষে লড়াই। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এলেন তিনি, বিপুলও ততদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে অনেকটা। কিন্তু এই পারিবারিক বিপর্যয় গভীর রেখাপাত করল তার মনে।

    ভালো লাগছিল না কলকাতা, মায়ের বিষণ্ণ উদাসী মুখখানিতেও যেন দূরে কোথাও চলে যাওয়ার আকুতি ছিল। তাই পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে প্রথম সুযোগটি পেতেই সে বদলি নিয়ে চলে এল উত্তরবঙ্গের এক প্রান্তিক শহর বালুরঘাটে, সঙ্গে নিয়ে এল মা, স্ত্রী ও কন্যাকে। এই শান্ত নিরিবিলি শহরটিতে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে ডি.এফ.ও. হিসেবে সুধাময়বাবুর পোস্টিং ছিল। নতুন জায়গায় নতুন উদ্যোমে সে আবার কাজে ডুব দিল।

    একদিন বিকেলে অফিসের কাজ শেষে সে গঙ্গারামপুর থেকে বালুরঘাটে ফিরছিল, গাড়ির জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে আশপাশের অনেক এলাকা সে ঘুরেছে, সে-সময়ের দেখা রাস্তা-ঘাটের থেকে কত বদলে গেছে সব! শুধু বালুরঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত জাতীয় সড়ক নয়, দু-দেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য পতিরাম থেকে খাঁপুর-ত্রিমোহনী হয়ে মসৃণ চওড়া পিচ ঢালা নতুন রাস্তা গিয়ে মিশেছে হিলি বর্ডার পর্যন্ত। তবে তখন রাস্তার দু’পাশে অনেক পুরোনো বড়ো বড়ো গাছ ছিল, এখন সেসব আর নেই। বিক্ষিপ্ত কিছু গাছ পরে লাগান হলেও, তাতে অভাব পূরণ হয়নি। বাবার মুখে শুনেছিল, রাস্তা চওড়া করতে প্রচুর গাছ সেসময় কেটে ফেলা হয়েছিল।

    সুধাময়বাবু বাড়ি ফিরে প্রায় দুঃখ করতেন, “সরকারি চাকরি করি, হাত-পা বাঁধা, এত বড়ো বড়ো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে; আমি কিচ্ছুটি করতে পারছি না…”

    “তুমি কেন দুঃখ পাচ্ছ? তোমার তো কোনো দোষ নেই… তোমার সাধ্য থাকলে নিশ্চয়ই এসব গাছ কাটতে দিতে না?” বিনতাদেবী সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতেন।

    “কী করব? নিজের চোখেই আমি অপরাধী হয়ে যাচ্ছি… এত অসহায় আমার নিজেকে কখনও লাগেনি। আর সবচেয়ে দুঃখের বিষয় কী, জানো? ওদের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষরটাও আমাকেই করতে হচ্ছে…,” বলতে বলতে কতদিন বাবাকে নীরব হয়ে যেতে দেখেছে বিপুল।

    বাবা তাকে মাঝে মাঝে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন, গাছপালা পাখিদের চেনাতেন। বলতেন, “গাছের চেয়ে বড়ো বন্ধু আর হয় না! চোখ বুজে কান পেতে থাকো, দেখো শুনতে পাবে ওদের কথা।”

    “কই আমি তো কিছু শুনতে পাচ্ছি না?”

    বিপুলের প্রশ্নের জবাবে সুধাময়বাবু বলতেন, “চেষ্টা করো, একদিন ঠিক পারবে…”

    চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর একটু থিতু হতেই সুধাময়বাবু বাড়ির ছাদে টবে অনেক গাছ লাগিয়ে ছিলেন, কিন্তু এত বড়ো বড়ো গাছ কেটে ফেলার আফশোস তাঁর কখনও যায়নি। এখন সেগুলো কী অবস্থায় আছে কে জানে? মালি কাকু প্রতিদিন সময় করে জল দিচ্ছে তো!— বিভিন্ন চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে, পুরোনো কথাগুলো ছবির মতো ভেসে উঠছিল চোখের সামনে, একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাড়ি ফিরতেই ঊর্মি তার আধো আধো বুলি, নিষ্পাপ হাসি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে, যা তাকে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে নিয়ে আসে বাস্তবের মাটিতে, বারি সিঞ্চন করে তার বিক্ষিপ্ত মনে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ছিল অবসন্ন, মনও যেন ছুটি চাইছিল; তাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ে, ঘুমিয়েও পড়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই। হঠাৎ ভোররাতে বুকে একটা চাপ অনুভব করে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, মুখ দিয়ে টেনে নিতে চেষ্টা করে একটু অক্সিজেন; কিন্তু না, সে পারছে না, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। যখন সে নিশ্চিত মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করছে, সেসময় কোনো একটা কিছুর ধাক্কায় তার চেতনা ফিরে আসে। দেখে সুদীপ্তা তাকে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকছে আর ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইছে, “কী হয়েছে?”

    সংবিৎ ফিরে পেয়ে বিপুল বুঝতে পারল স্বপ্ন দেখছিল সে, সত্যি সত্যিই শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়নি। ঘামে জামাটা ভিজে গেছে, খুব গরমও লাগছে। ঘড়িতে তখন তিনটে দশ, উৎকণ্ঠিত স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। আবছা অন্ধকারে বাইরে চেয়ে মনে পড়ল কাল রাতে সে ঘুমিয়ে পড়ার পর জারুল, বকুল, পলাশ, শিমুল, কুল, কৃষ্ণচূড়ারা সার বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে।

    “আমরা যে শেষ হয়ে যাচ্ছি, বাঁচাবে না আমাদের?” কাতর মিনতি করেছিল শিমুল।

    বিষণ্ণ চোখ তুলে বকুল বলেছিল, “আমাদের চোখের জল কী তোমার চোখে পড়ে না? শুনতে পাও না আমাদের কান্না?”

    “আমার কাছে যারা আশ্রয় পেয়েছিল, তারা যে নিরাশ্রয় হয়ে গেল,” বুড়ো বটের হতাশা মেশানো আকুতি।

    জারুল তার কান্নাভেজা গলায় বলেছিল, চারিদিকে দেখতে পাচ্ছ তো অক্সিজেনের অভাবে কীভাবে মানুষ মরছে, যেদিন প্রকৃতিতে সত্যিই আর অক্সিজেন থাকবে না, সেদিন কী হবে একবার ভেবে দেখেছ?”

    “কিচ্ছু করবে না আমাদের জন্য? তাহলে আমরা সবাই চলে যাচ্ছি তোমাদের পৃথিবী ছেড়ে…,” কথাকটি উচ্চারণ করেই পলাশ পেছন ফিরে চলতে শুরু করেছিল আর তাকে অনুসরণ করে যেতে উদ্যত হয়েছিল বাকিরাও। তখনই সে বুকে ওই চাপটা অনুভব করে, যেন সারা পৃথিবী থেকে সমস্ত অক্সিজেন কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে শুষে নিয়েছে; কোথাও আর একফোঁটাও অবশিষ্ট নেই…

    শুধু যাওয়ার আগে কৃষ্ণচূড়া একবার পেছন ফিরে তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল সুতীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ, “তোমার সন্তানকে কী এমন একটা পৃথিবী উপহার দিতে চাও?”

    বিপুলের চোখের সামনে ভেসে উঠল বাবার মুখটা, একটু অক্সিজেনের জন্য কী কাতর আকুতিই না ছিল সেই মুখে! না, এমন অবস্থায় সে তার ঊর্মিকে দেখতে পারবে না, দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার একমাত্র সন্তানের জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেনের ব্যবস্থা সে অবশ্যই করবে, করবেই… শত শত সন্তানেরা বেঁচে থাকবে, বুক ভরে শ্বাস নেবে এই পৃথিবীতে। হঠাৎ পিঠে একটি আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল তার কান্নার আওয়াজ পেয়ে ততক্ষণে সুদীপ্তা উঠে এসেছে বিছানা থেকে, চোখে জিজ্ঞাসা, “কী হয়েছে?” জলভরা চোখে স্ত্রীর দু’হাত জড়িয়ে ধরে এবার সে বলল তার পরিকল্পনার কথা, দু’দিন পর ঊর্মির জন্মদিন… একজন বাবা হিসেবে সেরা উপহারটির বন্দোবস্ত এবার সে করতে চায়, সব শুনে সুদীপ্তা সানন্দে সম্মতি জানাল শুধু নয়, পাশে থাকার আশ্বাসও দিল। হাতে হাত জড়িয়ে দু’জনে ঘুরে তাকাল বিছানার দিকে, ভোরের প্রথম আলো ততক্ষণে এসে খেলা করতে শুরু করেছে সেখানে শুয়ে ঘুমন্ত ঊর্মির সরল নিস্পাপ মুখে…

    সব জেনে বিনতাদেবী ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। সারাটা জীবন মানুষটা অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছেন, এতে তাঁর আত্মা প্রকৃতই শান্তি পাবে,” দু’ফোঁটা জল ঝরে পড়ল তার চোখ থেকে।

    “আমি জানি মা… নিজের অসহায়তায় লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে, চূড়ান্ত হতাশায় ছটফট করতে আমিও দেখেছি বাবাকে,” দু’হাতে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল বিপুল।

    জন্মদিনের দিন সকালে একশোটা চারাগাছ কিনে এনে সে মা, স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চলে এল সেই রাস্তার পাশে, যেখানে একসময় কেটে ফেলা হয়েছিল জারুল, বকুল, পলাশ, শিমুল, কুল, কৃষ্ণচূড়াদের; মেয়ের হাত ছুঁইয়ে একে একে তাদের পুঁতে দিল রাস্তার দু’ধারে— মনে মনে শপথ নিল, “শেষ হয়ে যেতে দেব না তোমাদের, দু’হাতে আগলে রাখব ঠিক আমার ঊর্মির মত। আমার সাধ্যের মধ্যে সচল রাখব এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, যতদিন না এই পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়ে ওঠে আগত-অনাগত সকল সন্তানদের জন্য…”



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments