• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • গোয়েন্দাকাহিনি পাঠ : আগাথা ক্রিস্টির ‘The Murder of Roger Ackroyd’ : অনামিকা দাস

    আগাথা ক্রিস্টির লেখা হারকিউল পোয়ারো-কেন্দ্রিক মোট ঊনচল্লিশটি গ্রন্থের মধ্যে ‘The Murder of Roger Ackroyd’ কাহিনিকে এই প্রবন্ধে নির্বাচনের অন্যতম কারণ, কাহিনির কথক। এই কাহিনির গঠনশৈলী, তদানীন্তন কালে, গোয়েন্দাকাহিনি লেখার প্রচলিত নিয়মকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাই সমালোচকরা মূলত নানা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই কাহিনি বিচার করেছেন, এমনকি সেইসময় ক্রিস্টি-ভক্ত বেশ কিছু মানুষও ক্রিস্টির লেখনীর প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন। সেই সমালোচনার বিপরীতে ক্রিস্টির মনোভঙ্গি ঠিক কী ছিল, তিনি এই কাহিনিতে কেন এবং কতদূর গোয়েন্দাকাহিনি লেখার প্রচলিত নিয়ম ভাঙতে চেয়েছিলেন---এই প্রবন্ধ, সেই উত্তর সন্ধানের পাশাপাশি, পোয়ারোকে কাল্পনিক চরিত্রের ঘেরাটোপের বাইরে একজন জীবন্ত চরিত্র হিসেবে উপস্থাপনে প্রচেষ্ট। তাই, এই প্রবন্ধে, ‘The Murder of Roger Ackroyd’ কাহিনির ঘটনাকাল নির্ণয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পোয়ারো তাঁর গোয়েন্দাজীবনে ঠিক কোন্‌ সময় এই কেসের সমাধান করেছিলেন, আজ অবধি তা নির্ণীত হয়নি---অথচ, পোয়ারো-ভক্ত মাত্রেরই সেই কৌতূহল স্বাভাবিক। যথাতথ যুক্তির বাঁধনে সেই কৌতূহল এখানে নিরসন করা হয়েছে। এই প্রবন্ধে ক্রমান্বয়ে সজ্জিত হয়েছে কাহিনির গঠনশৈলী, কাহিনিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতীকের ব্যঞ্জনা, ‘The Murder of Roger Ackroyd’ পাঠশেষে পাঠকের-চিন্তনকে-উশ্‌কে-দেওয়া নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন, কাহিনিতে কথকের ভূমিকা, এবং কাহিনিটি মূলত কোন্‌ কোন্‌ থিমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত---সেই প্রসঙ্গ। আর, একেবারে শেষে রইল এই কাহিনির প্রচ্ছদ সংক্রান্ত আলোচনা।
    ১৯২৬। প্রকাশিত হল আগাথা ক্রিস্টির ‘The Murder of Roger Ackroyd’। আগাথার জনপ্রিয়তা হল তুঙ্গস্পর্শী। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ হাজার বই বিক্রি হয়ে গেল। ‘Daily Sketch’ লিখল, ‘the best thriller ever.’

    কিন্তু এর উল্টো প্রতিক্রিয়াও ঘটল। ‘News Chronicle’ এই বই সম্পর্কে জানাল, ‘tasteless and unfortunate let-down by a writer we had grown to admire.’ ‘The Times’ পত্রিকায় একজন ক্রিস্টি-ভক্ত পাঠক চিঠি লিখলেন, “…he announced that, having been a great admirer of Agatha Christie, he was so shocked by the denouement of Roger Ackroyd that he proposed ‘in the future not to buy any more of her books’.” এমনকি, ক্রিস্টির সমসাময়িক বিভিন্ন গোয়েন্দা ঔপন্যাসিকও মনে করলেন, ‘she had not played fair.’

    কেন এই প্রতিক্রিয়া?

    ‘The Adventure of the Blanched Soldier’ গল্পে, ওয়াটসনের অনুপস্থিতিতে নিজেই কলম ধরেছিলেন শার্লক হোমস। হারকিউল পোয়ারোর কাহিনিকার হেস্টিংস। কিন্তু ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এ হেস্টিংসের অভাবে কথকের ভূমিকা পালন করছেন এমন একজন, কাহিনির শেষে গিয়ে জানা যাবে, তিনি-ই আসল খুনি --- ডঃ শেপার্ড। কাহিনির অন্তিমে কথককেই খুনির ভূমিকায় আবিষ্কারের সেই অ-পূর্ব বিস্ময়কে ধারণ করতে না পেরেই এই কাহিনির পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় নানা নেতিবাচক মন্তব্য উঠে এসেছিল। যদিও, লর্ড পিটার উইমসির স্রষ্টা ডরোথি এল সেয়ার্স ক্রিস্টির সমর্থনে বলেছিলেন, ‘it’s the reader’s business to suspect everybody.’

    বিশ শতকের গোড়ায় ডিটেকটিভ কাহিনি লেখার বেশ কিছু নিয়ম বলেছিলেন এস.এস.ভ্যান ডাইন এবং রোনাল্ড নক্স। সেগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৮, ১৯২৯-এ। আগাথা ক্রিস্টির ‘The Murder of Roger Ackroyd’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাচ্ছে জুন, ১৯২৬-এ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই নিয়মগুলো তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এটুকু জানা ছিল যে, সাধারণত রহস্য কাহিনি বা গোয়েন্দা কাহিনিতে কথক হবেন এমন একজন, যাকে পাঠক বিশ্বাস করবেন এবং কাহিনির ক্রম-অগ্রসরণে যার সঙ্গে একধরনের তাদাত্ম্য অনুভব করবেন পাঠক।

    কিন্তু কথক-ই কাহিনির শেষে খুনি প্রতিপন্ন হবেন --- এটা সমালোচকদের কাছে অকল্পনীয় ছিল, অন্তত, আগাথা ক্রিস্টি যেসময় লিখছেন। ফলে, এই কাহিনিতে আগাথা প্রথম ধ্রুপদী ডিটেকটিভ কাহিনি লেখার নিয়মভঙ্গ করলেন। অবশ্য নিয়ম ভাঙতে বেশ পছন্দই করতেন ক্রিস্টি, যেকারণে, পোয়ারো-কেন্দ্রিক শেষ আখ্যানে পৌঁছে আমরা বজ্রাহত হয়ে দেখি, পোয়ারো-ই খুনি!

    ১৯৬৬তে Francis Wyndhamকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগাথা বলেছিলেন, ‘I have a certain amount of rules. No false words must be uttered by me. To write “Mrs Armstrong walked home wondering who had committed the murder” would be unfair if she had done it herself. But it’s not unfair to leave things out. In Roger Ackroyd … there’s [a] lack of explanation there, but no false statement. Whoever my villain is, it has to be someone I feel could do the murder.’

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’কে আগাথা তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করতেন কিনা, তা জানা যায় না বটে; কিন্তু তাঁর প্রিয় তিন-চারটি বইয়ের মধ্যে সাধারণত এই বইটির কথা উল্লেখ করতেন ক্রিস্টি।

    ১. কাহিনির ঘটনাকাল :

    আগাথা ক্রিস্টি কবে ‘The Murder of Roger Ackroyd’ লিখেছেন, কোন্‌ পত্রিকায় তা প্রকাশ পেয়েছিল --- এখনও পর্যন্ত সেসবের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, এই গল্পের পাণ্ডুলিপি, লিখনকাল ও পত্রিকাপাঠ ছাড়াই কাহিনির ঘটনাকাল নির্ণয় করতে হবে।

    গল্পের প্রকাশকাল অবশ্য আমরা জানি। আগেই বলেছি, আগাথা ক্রিস্টির ‘The Murder of Roger Ackroyd’ প্রকাশিত হচ্ছে ১৯২৬-এ। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, ১৯২৬-এর জুন মাসে। কিন্তু কাহিনির ঘটনাকাল? ঠিক কবে ঘটছে এই কাহিনি?

    গল্পের শুরুতেই আমরা দেখি মিসেস ফেরার্স মারা যাচ্ছেন, পরে জানা যাবে, তিনি আসলে আত্মঘাতী হচ্ছেন, কোনো এক ১৬ সেপ্টেম্বর। দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। তার ঠিক পরের দিন খুন হচ্ছেন রজার অ্যাক্রয়েড --- অর্থাৎ ১৭ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার।

    এখন প্রশ্ন হল, কোন্‌ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর? কোনোভাবে কি সেই সালকে নির্দিষ্ট করা যায়? এমন এক সাল, যে-বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল শুক্রবার?

    আগেই বলেছি, কাহিনির প্রকাশকাল ১৯২৬। ১৯২৬-এর ক্যালেন্ডারে আমরা দেখছি, সেই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল শুক্রবার। তাহলে কি কাহিনির ঘটনাকাল আর প্রকাশকাল এক? ১৯২৬-এই কি ঘটছে এই কাহিনি?

    না। কেন নয়? কারণ, ১৯২৬-এর জুন-এ এই কাহিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাচ্ছে। আর, যেহেতু ‘The Murder of Roger Ackroyd’ কোনো কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি নয়, ফলে, কাহিনির ঘটনাকাল, কোনোভাবেই জুন, ১৯২৬-এর পরবর্তী হতে পারে না। কাহিনি প্রকাশ পেল ১৯২৬-এর জুন মাসে, আর কাহিনি ঘটছে ১৯২৬-এর ১৭ সেপ্টেম্বরে --- এটা ঘটা কি সম্ভব? না। তাহলে কী দাঁড়াল? এই কাহিনির ঘটনাকাল কোনোভাবেই ১৯২৬ নয়। তাহলে কবে?

    ১৯২৫-এর ক্যালেন্ডারে দেখা যাচ্ছে, ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার১০। ১৯২৪-এ বুধবার ১১। ১৯২৩-এ সোমবার ১২, ১৯২২-এ রোববার ১৩, ১৯২১-এ শনিবার ১৪। অর্থাৎ, যেহেতু ১৯২৫ থেকে ১৯২১ অবধি কোনো সালেই ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছিল না, সেহেতু, কাহিনির সম্ভাব্য ঘটনাকাল হিসেবে আমরা ১৯২১ থেকে ১৯২৫ --- এই পাঁচ বছরকে বাদ দিতে পারি।

    এবার আসা যাক ১৯২০-র ক্যালেন্ডারে।

    সেই বছর দেখা যাচ্ছে, ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল শুক্রবার।১৫ তাহলে কি ১৯২০-কেই এই কাহিনির ঘটনাকাল হিসেবে নির্দিষ্ট করব? মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ১৯২০-র আগেও তো কোনো বছরে ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার হতে পারে! তাহলে সেই বছরগুলোকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হবে না কেন? তাছাড়া, আমাদের এই অনুসন্ধান ঠিক কোন্‌ বছর অবধি চলবে? সোজা কথায়, কাহিনির ঘটনাকাল অনুসন্ধানের সর্বনিম্ন সীমা কোনটা?

    ১৯২০-তে পোয়ারো-কেন্দ্রিক আগাথা ক্রিস্টির প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ পাচ্ছে --- ‘The Mysterious Affairs at Styles’। এই কাহিনির সঙ্গে যারা পরিচিত আছেন, তাঁরা জানেন যে, এই কাহিনির ঘটনাকাল সুস্পষ্টভাবে কাহিনিতেই উল্লিখিত। আর সেটা হল ১৯১৭। ‘The Mysterious Affairs at Styles’-এই হেস্টিংসের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটছে পোয়ারোর। ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে দুজনের।

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এ আমরা দেখি পোয়ারো বেশ কয়েকবার হেস্টিংসের নামোল্লেখ করছে, তার কাহিনির কথক হিসেবে হেস্টিংসের অভাব অনুভব করছে সে। কাজেই, এই কাহিনি কিছুতেই ১৯১৭ পূর্ববর্তী হতেই পারে না।

    তাহলে আমরা বলতে পারি, এই কাহিনির ঘটনাকালের নিম্নসীমা ১৯১৭। ঊর্ধসীমা ১৯২০। ১৯২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর যে শুক্রবার ছিল, সেটা আমরা আগেই জেনেছি। এবার দেখতে হবে ১৯১৭ থেকে ১৯১৯-এর মধ্যে কোনো বছরে ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছিল কিনা। চলুন দেখে নেওয়া যাক।

    ১৯১৯-এর ক্যালেন্ডার বলছে, ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল বুধবার।১৬ ১৯১৮-য় সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গলবার।১৭ আর ১৯১৭-য় যেদিন ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, সেটা হল সোমবার।১৮ অর্থাৎ, ১৯১৭ থেকে ১৯১৯-এর মধ্যে কোনো বছরেই, ১৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ছিল না।

    কাজেই, এখন ‘The Murder of Roger Ackroyd’ -এর ঘটনাকাল নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারি এই কাহিনির ঘটনাকাল ১৯২০।

    ২. কাহিনির গঠনশৈলী :

    এবার আমরা মূল কাহিনিতে প্রবেশ করব। বিভিন্ন অনুষঙ্গে আমরা দেখার চেষ্টা করব এই ডিটেকটিভ কাহিনির গঠন --- যে-কাহিনির ঘটনাস্থল ইংল্যান্ডের এক কাল্পনিক গ্রাম। গ্রামের নাম কিং অ্যাবো।

    সাতাশটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই কাহিনিতে নানা স্তর আছে। কাহিনির কেন্দ্রে আছে একটা খুন। কিন্তু তাকে ঘিরেই আছে টাকা চুরির ঘটনা ও ব্ল্যাকমেলিং। কাহিনির ক্রম-অগ্রসরণের সঙ্গে সঙ্গে এই স্তরগুলো উন্মোচিত হয় পাঠকের কাছে।

    শেপার্ড লিখেছিলেন, ‘Now there has been a rearrangement of the kaleidoscope. From a mild discussion of probable wedding presents, we had been jerked into the midst of tragedy.’

    আমরাও ক্যালাইডোস্কোপকে বিভিন্ন আঙ্গিকে রেখে, আসুন, এই কাহিনির গঠনশৈলীর দিকে এগিয়ে যাই।

    একেবারে প্রথম অধ্যায়েই আমরা বুঝে যাই, এই কাহিনির কথক হেস্টিংস নয় --- ডঃ শেপার্ড। শেপার্ড যখন কাহিনির প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেই লেখেন, ‘my instinct told me that there were stirring times ahead’, তখন গোয়েন্দা কাহিনিতে, মূল আখ্যানের গভীরে, ফল্গু স্রোতের মতো বয়ে চলা টেনশন, যেটা কিনা এই সংরূপের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তাকে বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না পাঠকের।

    কাহিনির একেবারে শুরুতেই ডঃ শেপার্ড এবং ক্যারোলিনের কথোপকথন খুব গুরুত্বপূর্ণ। আখ্যানের সেন্ট্রাল থিম-কে ধারণ করে আছে সেটা। সেটা কী? না, কোনো তদন্তের কাঁচামাল হিসেবে আক্সঁড়া তথ্যের গুরুত্ব এবং সেই তথ্যকে নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণের ক্ষমতা।

    ক্যারোলিনকে খানিকটা ‘কমিক রিলিফের’ মতো এই কাহিনিতে উপস্থিত করা হলেও, ক্যারোলিন জানেন, তথ্য ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী। তিনি তাই বলেন, “People ought to know things. I consider it my duty to tell them.” ক্যারোলিন যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেটা ডঃ শেপার্ডের কাছে একদিকে হাস্যকর মনে হলেও, ক্যারোলিনের এই কর্মপদ্ধতির, প্রশংসা না করেও পারেন না তিনি। তাই ক্যারোলিন যখন বলেন, স্বামীকে বিষ প্রয়োগে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়েছেন মিসেস ফেরার্স, তখন ক্যারোলিনের এই ‘তত্ত্ব’কে সামনাসামনি “nonsense” বললেও মনে মনে সেটাই বিশ্বাস করেন ডঃ শেপার্ড। ক্যারোলিনের সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পদ্ধতিকে তিনি “inspired guesswork” বলে তথ্য এবং সত্য --- এই দুইয়ের পার্থক্যকে তুলে ধরেন।

    তথ্য আর সত্য এক নয়। সত্যকে খুঁজে পেতে গেলে, নির্ভুলভাবে তথ্য সংগ্রহের পর তার প্রকৃত ইন্টারপ্রিটেশন দরকার।

    এর পরেই ক্যারোলিনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন ডঃ শেপার্ড। যদিও এখানে তাঁকে ‘সিস্টার’ বলেন ডঃ, পরে জানা যায়, ক্যারোলিন আসলে শেপার্ডের দিদি --- তাঁর চেয়ে আট বছরের বড়। এই ক্যারোলিন কাহিনির অন্যতম মুখ্য চরিত্র। কেন?

    ডঃ লিখছেন, ‘Caroline can do any amount of finding out by sitting placidly at home. I don’t know how she manages it, but there it is.’ পুনশ্চ, ‘... there is no need for Caroline to go out to get information. She sits at home and it comes to her.’

    আমরা জানি, আর্মচেয়ার ডিটেকশনের ক্ষেত্রে, গোয়েন্দা প্রায় কোথাও না গিয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন এবং রহস্যের সমাধান করে ফেলেন। ক্যারোলিনের মধ্যে কি আমরা তারই আভাস পাই?

    কেন এই অনুমান? কারণ, ক্যারোলিন এই কাহিনিতে নিজস্ব স্বজ্ঞা বা ইনট্যুইশন প্রয়োগের পাশাপাশি নানা তথ্য সংগ্রহ করে যেসমস্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছন, পরবর্তীকালে আমরা দেখি, সেগুলো প্রায় সবগুলোই ঠিক। যেমন, ---

    এক. মিসেস ফেরার্স তাঁর স্বামী মিঃ ফেরার্সকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন।

    দুই. মিসেস ফেরার্স আসলে আত্মঘাতী হয়েছেন।

    তিন. আত্মহত্যার আগে মিসেস ফেরার্স নিশ্চয়ই কোনো ‘কনফেশন লেটার’ বা স্বীকারোক্তিমূলক চিঠি লিখেছিলেন।

    চার. ক্যারোলিন ডঃ শেপার্ডকে বলেন, “What on earth are you doing out there, James? Why don’t you come and get your breakfast?” ডঃ উত্তর দেন, “Just coming, my dear ... I’ve been hanging up my overcoat” শোনামাত্র ক্যারোলিনের মন্তব্য, “You could have hung up half a dozen overcoats in this time.” --- কথক শেপার্ড এরপর লিখছেন, ‘She was quite right. I could have.’

    ভাইয়ের মনের ভেতর কী চলছে, তার হদিশ না পেলেও, ভাই-যে কোনো কারণে অস্থির ও অন্যমনস্ক, তা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না ক্যারোলিনের। পরে দেখব আমরা, ডঃ সেইসময় চিন্তিত ছিলেন এই নিয়ে যে, ক্যারোলিনের কথা অনুযায়ী মিসেস ফেরার্স, নিজের আত্মহত্যার কারণ হিসেবে, সত্যিই যদি কোনো স্বীকারোক্তিমূলক চিঠি লিখে থাকেন, তাহলে তো ডাক্তারের ব্ল্যাকমেলার পরিচয় সকলে জেনে যাবে !

    পাঁচ. ক্যারোলিনের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা : মিসেস ফেরার্স যে মানসিকভাবে ভালো নেই, এবং সেই ভালো না-থাকা যে তাঁর চেহারায় ছাপ ফেলেছে, সেই পর্যবেক্ষণ এড়ায় না ক্যারোলিনের চোখ। ডঃ শেপার্ডকে তিনি বলছেন, ‘Even you must have noticed how different she has been looking lately. It’s been coming on for the last six months. She’s looked positively hag-ridden. And you have just admitted that she hasn’t been able to sleep.”

    ছয়. ক্যারোলিন জানেন, র‍্যাল্ফ প্যাটন গ্রামে ফিরে ‘থ্রি বোর’-এ আশ্রয় নিয়েছেন।

    সাত. ১৭ সেপ্টেম্বর, রজার অ্যাক্রয়েড খুন হওয়ার রাতে র‍্যাল্ফ প্যাটনকে কোনো এক মহিলার সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে --- এও ক্যারোলিনের অজানা নয়।

    আট. পোয়ারোর বাড়িতে যে কাকভোরে কোনো এক অতিথি এসেছেন, ক্যারোলিনের নজর এড়ায় না সেই ঘটনাও।

    ক্যারোলিনের চরিত্রের মাধ্যমে কি আগাথা ক্রিস্টি আসলে তাঁর মহিলা গোয়েন্দা মিস জেন মার্পেলের একটা আদিকল্প বা প্রোটোটাইপ তৈরি করতে চেয়েছিলেন? হ্যাঁ। ‘The Murder of Roger Ackroyd’ প্রকাশের অনেক বছর পর, “Agatha Christie said she thought it possible that Miss Marple ‘arose from the pleasure I had taken in portraying Dr Sheppard’s sister in The Murder of Roger Ackroyd. She had been my favourite character in the book --- an acidulated spinster, full of curiosity, knowing everything, hearing everything: the complete detective service in the home.’” ১৯

    এই কাহিনিতে একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ‘গসিপ’। শেপার্ড ব্যঙ্গ করে লিখেছেন যে, কিং অ্যাবোর প্রধান বিনোদন-ই হল “gossip”। এই ‘গসিপ’কে তিনি নিজে পছন্দ না করলেও, রজার অ্যাক্রয়েডকে ঘিরে গড়ে-ওঠা “halo of gossip”-এর বর্ণনা দিতে দেখি তাঁকে। মূল শহর থেকে ন’ মাইল দূরের একটা ছোট্ট গ্রাম কিং অ্যাবো, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনে, সেটাই এই কাহিনির ঘটনাস্থল। এই যে একটা বিচ্ছিন্ন আবদ্ধ ঘটনাস্থল, সেটা মূলত দুটো বিষয়কে তুলে ধরে --- এক. অপরাধী এমন একজন, যাকে সবাই চেনে। আর, দুই. যেহেতু ওই স্বল্প পরিসরে অপরাধী কোনো কিছু গোপনের চেষ্টা করে, সেটা কাহিনিতে একধরনের সাসপেন্স তৈরিতে সহায়ক হয়ে ওঠে।

    এই আখ্যানের নামকরণই যেহেতু ‘The Murder of Roger Ackroyd’, ফলে, কাহিনিতে যে রজার-ই খুন হবেন, সেটা আগে থেকেই জানার কারণে, রজারকে নিয়ে গড়ে ওঠা ওই ‘গসিপ’এর দিকে মনোযোগ গিয়ে পড়ে পাঠকের। তাই, বিষের প্রসঙ্গ, মানুষের গোপন কথোপকথন, রজারের মৃত্যুতে প্রত্যেকের-ই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা --- এগুলোকে শেপার্ড কাহিনিতে এমনভাবে বুনতে থাকেন, যাতে উপাদানগুলো যেন খুব সাধারণভাবে অবলীলায় কাহিনিতে আসছে, এমনটাই মনে হয়। সেগুলো যে বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে, পাঠক প্রথমে তা বুঝতে পারেন না। ‘গসিপ’এর অঙ্গ হিসেবেই এগুলোকে দেখতে থাকে সে। কিন্তু শেপার্ড যে-মুহূর্তে বলেন, কিং অ্যাবোর “life and soul” হলেন অ্যাক্রয়েড, তখন থেকে পাঠক বুঝতে শুরু করেন, অ্যাক্রয়েডকে নিয়ে কাহিনিতে গোপন রহস্যময় পরিকল্পনা চলছে, যেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে ট্র্যাজেডির দিকে।

    দ্বিতীয় অধ্যায় অবধি যেভাবে কাহিনির কথন এগোচ্ছিল, সেটাকে বলে যেতে পারে একধরনের dizzying narrative, যেখানে গসিপের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল প্রকৃত তথ্য। তাই এমন একজনের প্রয়োজন পড়ল, যাঁর কাজ-ই হল, তথ্য সংগ্রহ করে প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধান। তাই তৃতীয় অধ্যায় এসে আমরা পেলাম হারকিউল পোয়ারোকে।

    পোয়ারো ডঃ শেপার্ডের প্রতিবেশী, যে-শেপার্ডের দিদি ক্যারোলিন কিনা নিজস্ব পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহে অত্যন্ত উৎসাহী। এ কি নেহাতই সমাপতন যে, পোয়ারোকে এই ক্যারোলিনের-ই প্রতিবেশী হল? পোয়ারোর মতো ডিটেকটিভ, সে আগে থেকে কোনো খোঁজ খবর না নিয়ে ক্যারোলিনের পাশের বাড়িতে পাশে উঠল, এটাকে কোইন্সিডেন্স পাঠক ভাবতেই পারেন। কিন্তু পোয়ারোর চারিত্র্যধর্মের সঙ্গে যারা পরিচিত, তাঁদের মনে এই সন্দেহ হবেই যে, ক্যারোলিনের বেশি কথা বলার প্রবণতা, তথ্য সংগ্রহে তার আগ্রহ, এসবের কারণেই পোয়ারো স্বেচ্ছায় ক্যারোলিনের প্রতিবেশী হয়নি তো?

    ৩. কাহিনিতে প্রতীকের ব্যবহার :

    এবার আমাদের আলোচনার ক্যালাইডোস্কোপটাকে একটু অন্যদিকে ঘোরানো যাক। দেখে নিই কাহিনির কিছু প্রতীক।

    প্রথম প্রতীক : মা জং

    এই কাহিনিতে আমরা দেখি গোটা একটা অধ্যায় গড়ে উঠেছে একটা চিনা খেলার অনুসঙ্গে। খেলার নাম - মা জং। আমরা জানি, ক্রিস্টি কাহিনিতে এই ধরনের খেলার অনুপ্রবেশ পছন্দ করতেন। আমাদের মনে পড়ে যায়, পোয়ারোর একটা গল্পের নাম-ই, ‘Cards On the Table’। সেখানে, টেবিলে তাস খেলতেই খেলতেই খুন হয়ে যাচ্ছেন একজন।

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এ এই মা জং খেলাকে কাহিনি-বুনোটের একটা অংশ কেন করে তুললেন ক্রিস্টি? এই প্রসঙ্গে আসার আগে দেখে নেওয়া যাক, কী এই মা জং খেলা।২০ কীভাবেই-বা সেটা খেলতে হয়।

    এটা এমন একটা খেলা, যেখানে, তাসের বদলে ব্যবহার করা হয় টালি। মোট চারজন মিলে এটা খেলা হয়। মোট টালির সংখ্যা এখানে একশ চুয়াল্লিশ।

    এই টালিগুলোর নানা প্রকারভেদ আছে।২১ সিম্পল টাইলস, অনার টাইলস এবং বোনাস টাইলস। সিম্পল টাইলসে থাকে তিন ধরনের টালি --- ডটস বা সারকেল, ব্যাম্বু বা স্টিক এবং চাইনিজ ক্যারেকটার বা সিম্বল। সিম্পল টাইলসের মোট সংখ্যা একশ আট। এর পাশাপাশি থাকে আঠাশটা অনার টাইলস, যেটা দু’ভাগে বিভক্ত --- ড্রাগন আর উইন্ড। তিন রকমের ড্রাগন টাইলস হয় --- লাল, সবুজ আর সাদা। উইন্ড টাইলস আসলে বায়ু টালি আসলে দিক নির্দেশক। নর্থ, সাউথ, ইস্ট, ওয়েস্ট --- এই চারটে হল উইন্ড টাইলস। রইল বাকি বোনাস টাইলস, যেটা খেলা হয় না, সেটাও দু’রকম --- ফ্লাওয়ার এবং সিজন। ফুল এবং ঋতু। বোনাস টাইলসের মোট সংখ্যা আট।

    খেলা শুরুর আগে এই মা জং সেটের টেবিলে একশ চুয়াল্লিশটা টালিকে ভালোভাবে মেশানো হয়, এটাকেই কার্টার বলেছেন ‘washing the table’। খেলা শুরুর সময় প্রত্যেক খেলোয়াড়ের হাতে থাকে তেরোটা করে টালি। চার জনের হাতে তেরোটা করে টালি, মানে বাহান্নটা টালি থাকে। আগেই বলেছি, আটটা বোনাস টালি খেলা হয় না। তাহলে ওই বাহান্ন আর ‌আট, মানে ষাটটা টালি বাদে চুরাশিটা টালি থাকে অতিরিক্ত। এই চুরাশিটা অতিরিক্ত টালি টেবিলের মাঝখানে রাখা হয়। এই খেলাটা হল একই র‍্যাঙ্ক ও একই স্যুটে টালি মেলানোর খেলা।

    খেলা শুরু হয় এইভাবে, প্রথমে একজন ওই অতিরিক্ত টালি থেকে একটা টালি নেবে, মানে, তখন তার হাতে টালির মোট সংখ্যা দাঁড়াবে চোদ্দ। তারপর সে দেখবে ওই টালিটা তার তেরোটা টালির কোনোটার সঙ্গে মিলল কি না। যদি মিলে যায়, তাহলে সে ওই টালিটা রেখে দেবে। কিন্তু যেহেতু তার কাছে কোনোভাবেই তেরোটার বেশি টালি থাকতে পারে না, কাজেই তাকে তার না-মেলা কোনো একটা টালি ফেরত দিতে হবে, যেটা কিনা টেবিলের মাঝখানে থাকা অতিরিক্ত টালি হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ, খেলাটার মূল ব্যাপার হল, প্রথমে নতুন টালি নেওয়া এবং পছন্দ না হলে তা ফেরত দেওয়া। যে টালিটা কেউ নিল, সে দেখল, সেই টালিটা তার কাজের নয়, কোনোভাবেই কোনো টালির সঙ্গে সেটা মিলছে না, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে তার ওই সদ্য-নেওয়া টালিটা ফেরত-ও দিতে পারে। এইভাবে খেলা এগিয়ে যায়।

    খেলাটার কিছু পরিভাষা আছে। যেমন, পং, কং এবং চাও।২২

    পং কী? না, ধরা যাক, খেলতে খেলতে, বা, খেলার শুরুতেই, কারোর আছে এরকম একটা সেট আছে, যেখানে দুটো একইরকম (আইডেন্টিক্যাল টাইলস) আছে। আর একটা হলেই তার সেই সেটটা সম্পূর্ণ হবে। খেলাটা হয় ঘড়ির কাঁটার বিপরীতধর্মী চলনে। সেইভাবে খেলতে খেলতে যখন ওই খেলোয়াড়ের সময় এল, সে একটা টালি টানল এবং দেখল, এই টালিটাই সেই টালি, যেটা তার সেটটা সম্পূর্ণ করল। একই rank এবং একই suit-এ তিনটে টালি মিলে যাওয়ায়, সে তখন অন্য খেলোয়াড়দের শুনিয়ে বলবে, ‘পং’। চাও কী? না, একই suit-এর তিনটে টালি ধারাবাহিক ক্রমে থাকবে। দুই-তিন-চার। বা, ছয়-সাত-আট। আর কং কী? পং যেখানে একই rank এবং একই suit-এ তিনটে টালি, কং সেখানে একই rank এবং একই suit-এ চারটে টালি। তিনটে টালি মেলানোর তুলনায় চারটে একই rank এবং একই suit-এর টালি মেলানোটা তুলনামূলক শক্ত, তাই, স্বাভাবিকভাবেই পং-এর তুলনায় কং-এ পয়েন্ট বেশি।

    খেলায় জেতার সেটটা কী? তিনটে টালির চারটে সেট, আর একটা জোড়া সেট। মানে, তিন-তিন-তিন-তিন-দুই --- মোট চোদ্দ।২৩

    এই খেলার লক্ষ্য কী? একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে টালি মেলানো এবং যতক্ষণ না মিলছে, ততক্ষণ বারবার টালি বদল ও সেটের পুনগর্ঠন। যে খেলোয়াড় তাড়াতাড়ি ওই তিন-তিন-তিন-তিন-দুই সেটে টালি মেলাতে পারবে, খেলায় তারই জিত। এবং জিতে গেলে সে অন্যদের শুনিয়ে বলবে, ‘মা জং’। তখন আবার নতুন সেট খেলা হবে।

    এই হল খেলাটার প্রাথমিক নিয়ম। এখন, এই খেলাটা ক্রিস্টি কাহিনির অন্তর্ভুক্ত করলেন কেন? মা জং খেলায় জেতার আগে পর্যন্ত, খেলোয়াড়রা তাদের টালি অন্যদের সামনে দেখায় না, ঠিক যেরকম হয় তাসে, প্রত্যেকে বাকি খেলোয়াড়দের টালির উল্টোপিঠটাই দেখতে পায়, আর সে নিজে, বলাই বাহুল্য দেখতে পায়, নিজের টালির সোজা দিক। অর্থাৎ, খেলাটায় একটা লুকোচুরির ব্যাপার আছে। অন্যের কাছে কী টালি আছে, সেটা যেমন আমি জানতে পারছি না, তেমনি, অন্যরা কী টালি পেল, সেটাও আমার অজানা। আর, অজানা বলেই, সবসময় একটা টেনশন আর সন্দেহের মধ্যে আমায় থাকতে হচ্ছে যে, আমি বাদে বাকিরা ভালো ভালো টাইলসের সেট পেয়ে যায়নি তো?

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর সপ্তম অধ্যায়ে আমরা পোয়ারোকে বলতে শুনি, ‘Everyone concerned in them has something to hide.’ সপ্তম অধ্যায়ে পোয়ারো আবারও এর পুনরাবৃত্তি করে বলে, ‘Everyone has something to hide.’ এই যে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু লুকোচ্ছে, বা লুকোতে বাধ্য হচ্ছে, এবং সেকারণেই প্রত্যেকেই কোনো-না-কোনোভাবে হয়ে উঠছে সন্দেহভাজন, মা জং খেলার মাধ্যমে কি তাকেই প্রতীকায়িত করে তুলতে চেয়েছেন ক্রিস্টি? এই সূত্রে আমাদের হঠাৎ চোখ চলে যায়, ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর উৎসর্গপত্রে --- যেখানে তিনি এমন একজনকে এই বই উৎসর্গ করছেন ‘who likes ... suspicion falling on everyone in turn.’

    আগেই বলেছি, এই মা জং খেলায় জেতার সেট হল তিন-তিন-তিন-তিন-দুই। এইটুকু মাথায় রেখে গল্পের ষোলো নম্বর অধ্যায়ে যাওয়া যাক। সেখানে খেলতে খেলতেই এই প্রসঙ্গ ওঠে যে, গোল্ডফিশ পুকুরে ‘R’ নামাঙ্কিত যে বিয়ের আংটি পাওয়া গেছে, সেই আংটি কে কাকে দিয়েছিল। অর্থাৎ, কাহিনির কোন্‌ দুই মানুষ গোপনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন? এখানে চারটে পূর্ণ সম্ভাবনা উঠে আসে। মেজর কার্টার বলেন, র‍্যাল্ফ ও ফ্লোরার কথা। মিস গ্যানেট ইঙ্গিত করেন রজার ও মিসেস ফেরার্স জুটিকে। ক্যারোলিন দুটো সম্ভাবনার কথা বলেন – এক. রজার-মিস রাসেল এবং দুই. রেমন্ড-ফ্লোরা। একেবারে শেষে ডঃ শেপার্ড শুধু এই ইঙ্গিতটকু দেন যে, এর মধ্যে কোনোভাবে মেজর ব্লান্ট যুক্ত আছেন কিনা। কিন্তু ব্লান্ট-যে কার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন, সেই কথা অনুক্ত রাখেন ডঃ। কাজেই ডঃ শেপার্ড যে-সম্ভাবনার কথা বলেন, সেটাকে আমরা পূর্ণ না বলে, একটা আধা-সম্ভাবনা হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

    মা জং খেলার একই rank এবং একই suit-এর টালি মেলানোর নিয়মকে শিথিল করে, যদি সেটে থাকা টালির সংখ্যাকে হিসেবের মধ্যে আনি, তাহলে দেখব, সেখানে নাম্বার কম্বিনেশন হল তিন-তিন-তিন-তিন-দুই। আর, ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর ষোলো নম্বর অধ্যায়ে, একটা চরিত্র, দুজন মানুষের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনাকে তুলে ধরছে --- এই এক আর ওই দুই-এর যোগে যদি আমরা তিন-এর একটা সেট কল্পনা করি, তাহলে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় ---

    কার্টার, র‍্যাল্ফ ও ফ্লোরা মিলে তিন। মিস গ্যানেট, রজার ও মিসেস ফেরার্স মিলে তিন। ক্যারোলিন, রজার-মিস রাসেল মিলে তিন। ক্যারোলিন-ই যেহেতু দ্বিতীয় সম্ভাবনার কথা বলেছে, তাই ক্যারোলিন, রেমন্ড-ফ্লোরা মিলে তিন। আর, ডঃ শেপার্ড শুধুই মেজর ব্লান্ট-এর উল্লেখ করেছেন, তাই, শেপার্ড- ব্লান্ট মিলে ২।

    তিন-তিন-তিন-তিন-দুই --- মা জং খেলায় জয়ী হওয়ার সেটকে কি এভাবেই কাহিনিতে বুনতে চেয়েছেন আগাথা ক্রিস্টি?

    দ্বিতীয় প্রতীক : গোল্ডফিশ

    ‘গোল্ডফিশ’ মাছের নামেই আছে ‘গোল্ড’ এবং সেটা মূল্যাবান ধাতু সোনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই মনে করা হয়, গোল্ডফিশ সম্পদের একটা প্রতীক।২৪ ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর নবম অধ্যায়ের নাম ‘The Goldfish Pond’। এই পুকুরের ধারেই আমরা ফ্লোরা ও মেজর ব্লান্টকে কথা বলতে শুনি। যদিও ফ্লোরা আগেই জেনেছিল যে, রজার উইলে তাকে কুড়ি হাজার পাউন্ড দিয়ে গেছে, কিন্তু এই অধ্যায়ে আমরা দেখি, রজারকে কে খুন করেছে, সেই টানটান উত্তেজনার মধ্যেও, ফ্লোরা ওই কুড়ি হাজার পাউন্ড পাওয়ার আনন্দ সাবলীল ভঙ্গিতে প্রকাশ করছে।

    ‘Goldfish ... are thought of as a “friendly” fish. They are socially harmonious and protective of each other. It’s very rare that goldfish attack other fish or members of their own species.’২৫ ফ্লোরা এবং মেজর ব্লান্টের বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে এই অধ্যায়েই। এবং পরে দেখব, রজারের টাকা চুরির ক্ষেত্রে যাতে কোনোভাবেই ফ্লোরার নাম জড়িয়ে না যায়, তাই ফ্লোরাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন ব্লান্ট। টাকা চুরির অভিযোগের দায় স্বীকার করছেন নিজে।

    এই অধ্যায়ের প্রায় গোড়াতেই পোয়ারো বলে, ‘ ... it is not easy to hide things from Hercule Poirot. He has a knack of finding out.’ আর এই অধ্যায়েই গোল্ডফিশ পুকুর থেকে ‘R’ নামাঙ্কিত একটা বিয়ের আংটি উদ্ধার করে পোয়ারো। আমরা জানি, ওই আংটি উর্সুলাকে দিয়েছিল র‍্যাল্ফ। আংটির ভিতরে লেখা ১৩ মার্চ। র‍্যাল্ফ-উর্সুলার বিয়ের দিন। পাশ্চাত্যে ‘তেরো’ সংখ্যা অশুভ। র‍্যাল্ফ-উর্সুলার বিয়ে-যে প্রাথমিকভাবে সুখের হবে না, আনলাকি থার্টিনের মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে সেই বার্তাই কি দিতে চেয়েছিলেন ক্রিস্টি? কিন্তু ক্রিস্টি যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়, কাহিনির শেষে --- যখন পোয়ারোর সূত্রে, যাবতীয় অভিমান সরিয়ে রেখে, মিলে যায় র‍্যাল্ফ-উর্সুলা।

    এই গোল্ডফিশ পুকুর দুটো ঘটনার সাক্ষী --- সেই পুকুর একদিকে ধারণ করে আছে প্রায় ভাঙনের-মুখে-দাঁড়ানো উর্সুলা-র‍্যাল্ফের দাম্পত্য। অন্যদিকে ফ্লোরা ও ব্লান্টকে ঘিরে একটা দাম্পত্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও উস্কে দেয় এই গোল্ডফিশ পুকুর।

    গোল্ডফিশ পুকুরে একটা কিছু পড়ে আছে, এইটুকু বুঝতে পেরেছিলেন ব্লান্ট, কিন্তু সেটা যে কারো বিয়ের আংটি, সেটা বুঝতে পারেননি। ভেবেছিলেন, হয়তো কোনো সোনার ব্রোচ। ব্লান্টের কাছ থেকে একথা শোনার পর ফ্লোরা বলেছিল, ‘Perhaps it’s a crown … Like the one Melisande saw in the water.’

    Melisande কে? Maurice Maeterlinck–এর প্রতীক নাটক Pelléas and Mélisande, যেটা প্রথম অভিনীত হয় ১৮৯৩-এ, সেই নাটকের মুখ্য চরিত্র। সেই নাটকে কী দেখি আমরা? না, একটা ব্যর্থ বিয়ে থেকে বাঁচার জন্য প্রায় নিরুপায়ভাবেই Melisande বিয়ে করে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়, বলা যাতে পারে তার বাবার বয়সী এক পুরুষ Golaud কে। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে বুঝতে পারে, সে আসলে Golaud-এর ভাই Pelléas-কে ভালোবাসে।২৬

    নাটকের এই কাহিনিকে এখানে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে উপস্থাপন করেছেন ক্রিস্টি। নাটকে মেয়েটি বয়স্ক এক পুরুষকে বিয়ে করেছিল অন্য কোনো উপায় না পেয়ে। ‘The Murder of Roger Ackroyd-এ ফ্লোরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল তরুণ র‍্যাল্ফ প্যাটনকে। নাটকের মেয়েটি ভালোবেসেছিল এক তরুণকে। আর ক্রিস্টির কাহিনিতে দেখি, ফ্লোরা ভালোবাসছে বয়স্ক মেজর ব্লান্টকে।

    Melisande-এর প্রসঙ্গ ও তার তাৎপর্য ডঃ শেপার্ড কতটা বুঝেছিলেন, জানা নেই। কিন্তু এখানে উত্তম পুরুষীয় কথক ডঃ শেপার্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছেন আগাথা ক্রিস্টি।

    তৃতীয় প্রতীক : আলো (Light)

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর তেইশতম অধ্যায়ের শিরোনাম --- ‘Poirot’s Little Reunion’। শেপার্ড লিখছেন, ‘Poirot ran to and fro rearranging things. Pulling out a chair here, altering the position of a lamp there, occasionally stooping to straighten one of the mats that covered the floor. He was specially fussing over the lighting. The lamps were arranged in such a way as to throw a clear light on the side of the room where the chairs were grouped, at the same time leaving the other end of the room, where I presumed Poirot himself would sit, in dim twilight.’

    এই অংশ পড়তে পড়তে মনে হয়, প্রায় যেন একটা স্টেজ-শো প্রত্যক্ষ করছেন পাঠক। এখানে আলোর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘He was specially fussing over the lighting. The lamps were arranged in such a way as to throw a clear light on the side of the room where the chairs were grouped.’ এই চেয়ারগুলো কাদের জন্য নির্দিষ্ট করছিল পোয়ারো? এই কেসে প্রত্যেক সন্দেহভাজন ব্যক্তির জন্য। এখন, ‘to throw a clear light’ দ্ব্যর্থবোধক। একদিকে বাচ্যার্থে সেটা যেমন পোয়ারোর ঘরের আলো-কে নির্দেশ করে, অন্যদিকে ব্যঞ্জনায় তা হয়ে দাঁড়ায় সন্দেহভাজন মানুষগুলোর ওপর সত্যানুসন্ধানের আলোকপাত।

    ৪. কাহিনির অমীমাংসিত প্রশ্ন :

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’ আমাদের মনে এমন অনেক প্রশ্নকে উস্‌কে দেয়, যে-প্রশ্নের উত্তর এই কাহিনিতে নেই। যেমন ---

    ১. রজার অ্যাক্রয়েডের বাড়ি ফার্নলি পার্কে কেন কোনো লোক বেশিদিন টিঁকত না?

    ২. রজার পোয়ারোকে চিনলেন কীকরে?

    ৩. ডঃ শেপার্ডের স্মরণশক্তি। ১৭ সেপ্টেম্বর, খুনের ঘটনার রাতে, র‍্যাল্ফ ও একজন মহিলার কথোকথন শোনা প্রসঙ্গে ক্যারোলিন বলেছিলেন, ‘The girl said something—I didn’t quite catch what it was, and Ralph answered. He sounded very angry. ‘My dear girl,’ he said. ‘Don’t you realize that it is quite on the cards the old man will cut me off with a shilling? He’s been pretty fed up with me for the last few years. A little more would do it. And we need the dibs, my dear. I shall be a very rich man when the old fellow pops off. He’s mean as they make ’em, but he’s rolling in money really. I don’t want him to go altering his will. You leave it to me, and don’t worry.’ Those were his exact words.’ --- ক্যারোলিন ‘exactly’ কীকরে এই কথাগুলো মনে রাখতে পারলেন, তার পাশাপাশি আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, ডঃ শেপার্ড-ও এই কথাগুলো হুবহু মনে রাখলেন কীকরে?

    ৪. ডঃ শেপার্ড র‍্যাল্ফকে খুব ভালোভাবে চিনতেন --- ‘more than anyone.’ কীভাবে, সেই ব্যাখ্যা এই কাহিনিতে নেই।

    ৫. ঘটনার দিন, স্টাডি রুমের জানলা বন্ধ আছে কি না, রজার নিজে কেন সেই পরীক্ষা করলেন না?

    ৬. মিসেস ফেয়ার্সের চিঠির গুরুত্ব বুঝেও তক্ষুনি তা পড়ে শেষ করলেন না রজার? কেন ফেলে রাখলেন? নিজে খুন হওয়ার জন্য? নাকি, শুধু ‘স্টাবর্ন হার্ড-হেডেড ম্যান’ হওয়ার জন্য? শেপার্ড বারবার বলছিল, তাই পড়ব না --- শুধুই এই একগুঁয়েমি মানসিকতা থেকে?

    ৭. রজারকে খুন করার পর ডঃ শেপার্ড চিঠিটা কী করেছিলেন? ফায়ারপ্লেসের আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন?

    ৮. শেপার্ড কুড়ি নম্বর অধ্যায় পর্যন্ত লিখে সেই পাণ্ডুলিপি দেখিয়েছিলেন পোয়ারোকে। পোয়ারো বাকিটা শেষ করতে বলে। একুশ থেকে সাতাশ --- এই বাকি সাতটা অধ্যায় কবে লিখলেন শেপার্ড? যখন কিনা, তিনি জানেন, তাঁর খুনিসত্তা আর কেউ না হোক, পোয়ারোর কাছে উন্মোচিত হয়ে গেছে, যখন তিনি জানেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করা ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় নেই, সেইসময় তিনি ওই সাতটা অধ্যায় লিখেছেন। এই সাতের মধ্যে দুটো অধ্যায় খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছাব্বিশ নম্বর ‘And Nothing But The Truth’ আর সাতাশ নম্বর ‘Apologia’। পঁচিশ নম্বর অধ্যায় অবধি পড়ে পাঠক বুঝতে পারছিল, খুনির আশপাশে জাল গুটিয়ে ফেলেছে পোয়ারো। কিন্তু কে সেই খুনি, সেই উত্তর তখনও পায়নি তারা। কিন্তু প্রশ্ন হল, খুনি শেপার্ডই যখন এখানে কথকের ভূমিকায়, তাঁর কী দায় পড়েছিল ওই শেষ দুটো পরিচ্ছেদ লেখার? ওই দুটো না লিখে, পাণ্ডুলিপি অসমাপ্ত অবস্থাতেই তিনি যদি ভেরোনল খেয়ে আত্মহত্যা করতেন, ব্যক্তিগতভাবে কী অসুবিধে হত তাঁর?

    ৯. পোয়ারো আগেই জানত, কে খুনি। তাই সে সবসময় ক্যারোলিনের সাহায্য নিলেও, তেইশতম অধ্যায়ে সে ‘regretfully’ ক্যারোলিনকে বলে, ‘I should much like to have had you present, mademoiselle ... but at this juncture it would not be wise. See you, all these people tonight are suspects. Amongst them, I shall find one person who killed Mr Ackroyd.’ ‘Mademoiselle Caroline, believe me, I do everything possible to render you service. Good evening.’

    ১০. আমাদের মনে এই নিয়েও প্রশ্ন জাগে যে, নিজের অন্তিম পরিণতি জেনেও ডঃ শেপার্ড কীকরে এক আশ্চর্য নিরাসক্ত ভঙ্গিতে একুশ থেকে সাতাশ পরিচ্ছেদ অবধি লিখতে পারলেন? পাঠক যখন প্রথমবার এই কাহিনি পড়েন, সাতাশতম পরিচ্ছেদে পদাপর্ণের আগে তিনি বুঝতেই পারেন না, কথক শেপার্ড যে মানসিকতায় এক থেকে কুড়ি নম্বর অধ্যায় লিখছিলেন, একুশতম অধ্যায় থেকে তার কোনো পরিবর্তন ঘটল কি না।

    ৫. কাহিনির থিম :

    ক্যালাইডোস্কপটাকে আরেকটু ঘুরিয়ে এবার দেখে নেওয়া যাক এই আখ্যানের কয়েকটা থিম।

    প্রথম থিম - সরকারি পুলিশ বনাম প্রাইভেট ডিটেকটিভের কর্মপ্রণালী

    র‍্যাগলান যখন পোয়ারোকে আঙুলের ছাপের খুঁটনাটি বোঝাতে থাকে, পোয়ারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করে বলে, কোনটা লুপ, কোনটা হোর্ল২৭ --- এসব টেকনিক্যাল ব্যাপার সে কিছুই বোঝে না।

    কিন্তু একটা বিষয়ে তার খটকা লেগেছে যে, ছোরার ওপর আঙুলের ছাপ যেভাবে পড়েছে, সেটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। ছোরা বাগিয়ে কাউকে খুন করলে যেভাবে আঙুলের ছাপ লাগার কথা, র‍্যাগলানের দেখানো আঙুলের ছাপ সেইকথা বলছে না। মনে হচ্ছে, ছোরাতে ইচ্ছে করে কোনোরকমে সেই ছাপ লাগানো হয়েছে।

    র‍্যাগলান সবসময় এই নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিল যে, এই কেসটা সমাধানের শেষে প্রকৃত কৃতিত্ব সে পাবে কি না। উল্টোদিকে পোয়ারো? সে বলে, মিস ফ্লোরা তাকে নিযুক্ত করেছে ঠিক-ই। কিন্তু কোনো অর্থের প্রলোভনে এই কেস সে নেয়নি। বলে, ‘Money, it means much to me and always has done. No, if I go into this, you must understand one thing clearly. I shall go through with it to no end. The good dog, he does not leave the scent, remember!’ ডঃ প্রাণপণ চেষ্টা করেছে যাতে এই কেসের সঙ্গে পোয়ারো কোনোভাবেই জড়িয়ে না পড়ে, ফ্লোরাকে সে বলেছে, ‘Are you quite sure it is the truth we want?’ কিন্তু ফ্লোরা ‘কোয়াইট সিওর’ ছিল সে কী চায়। পোয়ারোর চোখে চোখ মিলিয়ে সে সটান বলেছে, ‘I want the truth.’ পোয়ারোর প্রশ্ন ছিল, ‘All the truth?’ ফ্লোরা-- ‘All the truth.’

    যেহেতু এই কেস সমাধানে র‍্যাগলানের সাহায্য তার লাগবেই, পোয়ারো বলেছে, ‘I have had much experience. But most of my success have been obtained by the aid of the police. I admire enormously your English police. If Inspector Raglan permits me to assist him, I shall be both honoured and flattered.’ এই কেসে র‍্যাগলান ছাড়া অন্য কেউ সরকারি তথ্য অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দিতে পারবে না; তাই পোয়ারো এই কেস সমাধান করলেও তার কৃতিত্বের ভাগিদার সে করবে র‍্যাগলানকেই --- পোয়ারো পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, ‘Above all things, I have a horror of publicity. I must beg, in the case of my being able to contribute something to the solution of the mystery, my name may not be mentioned.’

    র‍্যাগলান খুনির লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে প্রথম থেকেই নিশ্চিত যে, এটা কোনো পুরুষের কাজ। সে বলে, ‘We ought to get hold of HIM without much difficulty.’ এটা ঠিকই, যে, এই কাহিনির খুনি একজন পুরুষ। কিন্তু তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ এত জোরের সঙ্গে কীকরে বলতে পারে? কোনো মহিলার খুনি হওয়ার সম্ভাবনাকে সে ধর্তব্যের মধ্যে আনবে না কেন? র‍্যাগলান পরিস্থিতির গভীরতা বিচার না করে একবার বলে বসে, পার্কারই খুনি, একবার বলে বসে, র‍্যাল্ফ প্যাটন-ই খুনি। পোয়ারো কিন্তু পার্কারের খুনি হওয়ার সম্ভবনাকে নাকচ করে। এপ্রসঙ্গে স্যার রোনাল্ড নক্সের ‘Ten Commandments of Detective Stories’ মনে পড়ে যায়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘the butler should never be the killer.’ আর, র‍্যাল্ফ প্যাটন-ই যদি খুন করে, তাহলে সে অত প্রমাণ রেখে খুন করবে কেন, সেই প্রশ্নও তুলে ধরেন পোয়ারো। কাহিনিতে এরকম আরও অজস্র নিদর্শন আছে, যেখানে সরকারি পুলিশের কর্মদক্ষতাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ফেলছে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হারকিউল পোয়ারো। ‘Circumstantial evidence’-এর চেয়েও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হল অপরাধের মনস্তত্ত্ব --- সাইকোলজি অফ ক্রাইম। তাই, সে অপরাধীর মনস্তত্ত্ব বিচার করে রহস্যের সমাধানে এগোয়। তার তদন্তপদ্ধতিতে, ‘dead things speak sometimes --- chair, tables --- they have their message!’

    দ্বিতীয় থিম : Law vs. Ethics

    এই কাহিনিতে আমরা আইন ও নীতিবোধের একটা লড়াই দেখি। কাহিনিতে আইনের প্রতিনিধিত্ব করছেন ইন্সপেন্টর র‍্যাগলান, যিনি সরকারি পুলিশ অফিসার হিসেবে রজার অ্যাক্রয়েডের খুনের তদন্তে সামিল হয়েছেন। তাঁর উল্টোদিকে আমরা পাই হারকিউল পোয়ারোকে, যে কিনা নীতি-মূল্যবোধ অর্থাৎ, এথিকস্‌-এর প্রতীক। পোয়ারো, এই কাহিনিতে, মূলত দুটো আইনবিরোধী কাজ করে ---

    এক. র‍্যাল্ফকে লিভারপুল থেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, এই ভুয়ো খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ করে দেয়। এটা আইনবিরোধী। পোয়ারো এটা করে তার তদন্তের স্বার্থেই --- ‘for greater good of solving the case.’ কিন্তু র‍্যাগলান সরকারি পুলিশ। তাই সে আইনের বাইরে কিছুই বোঝে না, আইন বহির্ভূত কাজের কথা ভাবতেই পারে না।

    দুই. ডঃ শেপার্ডকে পোয়ারো যেভাবে শাস্তি দেয়, সেটাও চূড়ান্ত আইনবিরোধী। র‍্যাগলান হলে ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করত, স্বীকারোক্তি আদায় করত, তার দোষ প্রমাণের তথ্য হাজির করত আদালতে, কেস চলত, তারপর কোনো একদিন আদালত সাজা ঘোষণা করত ডঃ শেপার্ডের। কিন্তু পোয়ারো সেই পথে হাঁটেনি। ডঃ শেপার্ড জেনেবুঝে দু-দু’জন মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। তাই এইরকম ঠান্ডা মাথার খুনিকে আদালতে বিচারের নামে, সমাজে আরও কিছুদিন বাঁচতে দিতে চায়নি পোয়ারো। সে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রহস্যের সমাধান তার পেশা নয়, নেশা। তাই সরকারি পুলিশের মতো আইনের প্রতি সবসময় বাধ্য থাকার দায় নেই। সেকারণেই, আইন বহির্ভূতভাবেই, সরকারি পুলিশ র‍্যাগলানের হাতে সমর্পণ না করে শেপার্ডকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয় পোয়ারো, ঠিক যেভাবে শেপার্ড ঠেলে দিয়েছিল মিসেস ফেরার্সকে।

    মিসেস ফেরার্স তাঁর কনফেশন লেটারে লিখেছিলেন তাঁর আত্মহত্যার কারণ। সেইসঙ্গে রজারের কাছে তাঁর মিনতি ছিল যে, রজার যেন তাঁর ব্ল্যাকমেলারকে যথোচিত শাস্তি দেয়। রজার অ্যাক্রয়েড ডঃ শেপার্ডকে মিসেস ফেরার্স ও তাঁর ব্ল্যাকমেলার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘She’s paid the penalty. Is he to go scot free?’ ডঃ-এর উত্তর ছিল, ‘I agree with you that the villain ought to be punished, but the cost has got to be reckoned.’ রজার সেই ব্ল্যাকমেলারকে শাস্তি দিয়ে যেতে পারেননি, তার আগেই খুন হতে হয় তাঁকে।

    কাজেই, শেপার্ডকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে, মিসেস ফেরার্স এবং রজার --- দুজনকেই যেন ‘জাস্টিস’ পাইয়ে দেয় পোয়ারো। পোয়ারো বলেছিল, ‘I am acting in the interests of Justice.’ আর এভাবেই পোয়ারো তৈরি করে ফেলে তার নিজস্ব মূল্যবোধ, জীবনদর্শন --- জীবনে ঠিক-ভুলের মানদণ্ড --- one kind of personal ethical code of right and wrong. পোয়ারো জানে, কিং অ্যাবো, যতই ছোট একটা গ্রাম হোক না কেন, সেখানেও ডঃ শেপার্ডের একটা সম্মান আছে। সরকারি পুলিশ দিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করিয়ে সেই সম্মান পোয়ারো ধূলিসাৎ করেনি মূলত ক্যারোলিনের কথা ভেবে। সত্য যতই সুন্দর হোক না কেন, সেই ‘সৌন্দর্য’কে গ্রহণের ক্ষমতা তো সকলের সমান নয় ! অপ্রিয় সত্য জানাই পোয়ারোর কাজ, সেখানেই তার আনন্দ। কিন্তু ক্যারোলিন? নিজের ভাই খুনি --- এই সত্য মেনে নেওয়া কি মুখের কথা?

    পোয়ারোর এই আচরণ পাঠকের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে, সমাজে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে অপরাধীকে শাস্তি দিতেই হবে। কিন্তু সেইসঙ্গে এই চেষ্টাও জারি থাকবে, যে, অপরাধীর পারিবারিক বা পরিচিত মানুজনের প্রতি সেই শাস্তির অভিঘাত কীভাবে যথাসম্ভব ন্যূনতম করা যায়।

    ৬. কাহিনির কথক :

    ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এ কথকের ভূমিকায় এক আশ্চর্য দ্বন্দ্ব দেখা যায়। যেমন ---

    রজার যখন ব্ল্যাকমেলারের প্রসঙ্গ তোলেন, ডঃ অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো, রজারের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে জিগেস করে্ন, ‘Who was the man?’ রজারের মতো পাঠকের এখানে কোনো সন্দেহ-ই হয় না যে, এই প্রশ্নটা যে করছে, সে নিজেই আসলে ব্ল্যাকমেলার। কিন্তু ব্ল্যাকমেলারের লিঙ্গ পরিচয় প্রসঙ্গে ডঃ যখন জোর দিয়ে বলেন, ‘It must have been a man.’ তখন সচেতন পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগেই, ব্ল্যাকমেলার যে কোনো পুরুষ-ই, একথা এত জোর দিয়ে কীকরে বলতে পারেন কথক শেপার্ড? কোনো মহিলাও তো ব্ল্যাকমেলিং-এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারেন ! আসলে কাহিনি লিখলেও, কথক শেপার্ড খুব ভালোভাবেই জানেন, কে সেই ব্ল্যাকমেলারের। তাই অবচেতনেই তিনি ব্ল্যাকমেলারের প্রসঙ্গ উঠতেই একজন পুরুষের কথা বলেন।

    আবার, খুনি প্রসঙ্গে ডঃ শেপার্ড জানান, ‘The blow was delivered by a right-handed man standing behind him, and death must have been instantaneous. By the expression on dead man’s face, I should say that the blow was quite unexpected. He may have died without knowing who his assailant was.’ লক্ষ করার মতো, আবার-ও ‘man’। তখনও রজারের দেহ অটোপ্সি হয়নি। তাহলে শুধু চোখে দেখে ডঃ এতগুলো কথা বললেন কীকরে? তাঁর এই অতিরিক্ত কথন পাঠকের মনে সন্দেহ জাগিয়ে দেয়। কারণ, খুনি যে ডানহাতি, সেটা তিনি বুঝলেন কীকরে? খুনির অতর্কিত আক্রমণেই রজার মারা গেছেন, সেটাই-বা এত নিশ্চিত বলেন কীকরে তিনি?

    আসলে, এই কাহিনির কথক কখনও অত্যন্ত সচেতনে নিজের খুনি সত্তাকে ঢাকার জন্য এমন প্রশ্ন করেন, যাতে পাঠক তাঁকে সন্দেহ না করতে পারেন। আবার কখনও, সেই প্রশ্নগুলোই খতিয়ে দেখলে ডঃ শেপার্ডের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন ব্যক্তি শেপার্ড। সমগ্র কাহিনি জুড়েই এভাবে পাঠকের সঙ্গে কথকের তঞ্চকতা করান আগাথা ক্রিস্টি।

    ৭. কাহিনির প্রচ্ছদ :

    ক্যালাইডোস্কোপের অবস্থান বদলে, এবার আমরা আলোচনাসূত্রে, ‘The Murder of Roger Ackroyd’ গ্রন্থের দশটি প্রচ্ছদ ২৮ দেখে নিই।

    মাঝখানেরটি হল ১৯২৬-এর জুনে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ। একেবারে বাঁদিকের ওপরের প্রচ্ছদটি আমরা দেখছি, শিল্পী টেলিফোনকে গুরুত্ব দিয়েছেন, হয়তো তাঁর মনে হয়েছে, ডঃ শেপার্ডের কাছে আসা টেলিফোন কল-টাই এই কাহিনির মূল ভরকেন্দ্র। ডানদিকের ওপরেরটিতে গুরুত্ব পেয়েছে খুনের অস্ত্র --- ছোরা। কিন্তু ছোরাটা যেভাবে আঁকা হয়েছে, তাতে যেকেউ বুঝতে পারবেন, এটা বিশেষভাবে কোনো টিউনিশিয়ান ছোরা নয়। বাঁদিকের দ্বিতীয় প্রচ্ছদে রজারের জামার কলারের নিচে কীভাবে ছোরাটা বিঁধে ছিল, সেটা দেখানো হয়েছে। গল্প পড়ার আগে এই ছবিতে, ছোরার অবস্থান দেখামাত্র পাঠক বুঝতে পারবেন, এটা খুনের গল্প --- কারণ, নিজে ওইভাবে ছোরা বিঁধিয়ে আত্মহত্যা করা যায় না। আর ডানদিকের নিচের প্রচ্ছদ এবং গ্রন্থের প্রথম প্রকাশিত প্রচ্ছদ প্রায় একই --- মূলত একটা টেলিফোনের ছবি। বোঝাই যাচ্ছে, ডঃ শেপার্ডের বাড়ির টেলিফোন সেটা। কিন্তু টেলিফোনের সামনে বা উন্মুক্ত দরজার সামনে ওই নারীমূর্তি কে? চট করে মনে হতে পারে, ক্যারোলিন-ই এই নারী। কিন্তু, সচেতন গল্প পাঠক একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে, ওই নারী ক্যারোলিন হতেই পারে না। কেন? কারণ, ডঃ শেপার্ডের বাড়ির টেলিফোন সেট থাকত একতলায়। আর, তিনি এবং ক্যারোলিন থাকতেন দোতলায়। রহস্যময় ওই ফোন যখন আসে, তখন দুজনেই দোতলায় ছিলেন। ডঃ নিচে নেমে ফোন রিসিভ করেন। ক্যারোলিন কখনোই তখন একতলায় ছিলেন না, ফলে টেলিফোনে পাশে সেইসময় তাঁর থাকাটা একটা অসম্ভব ব্যাপার। ফলে, এই দুটো প্রচ্ছদ-ই বেশ বিভ্রান্তিকর।

    এখানে বাঁদিকের ওপরের প্রচ্ছদটি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। এর নিচের প্রচ্ছদটি বেশ ধাঁধায় ফেলে দেয়। কারণ, রজার যে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় খুন হয়েছেন সেটা কাহিনির কোনো নারী চরিত্র কি লুকিয়ে দেখেছিল? না। তাহলে? তাছাড়া সেইসময় দরজা তো ছিল ভেতর থেকে বন্ধ! ফলে এই প্রচ্ছদটি পাঠককে গল্পপাঠের শেষে বেশ বিভ্রান্ত করে। ডানদিকের ওপরেরটিতে খুব সুন্দরভাবে এই কাহিনিতে খুনের মূল তিনটে উপাদানকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে --- একেবারে পিছনে আছে ডিক্টাফোন যেটা এই কাহিনিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। সেটা কী? এইরকম দেখতে একটা যন্ত্র ২৯ ---

    ডিক্টাফোন আসলে একটা ট্রেডমার্ক। দেখবেন, যন্ত্রের নিচে রোমান হরফে ‘ডিক্টাফোন’ লেখা আছে। এটার কাজ কী?। এটা এমন একটা যন্ত্রকে নির্দেশ করে, যেটা যেকোনো ভয়েস রেকর্ড করতে পারে এবং পরে সেটা শোনা যায়। কোন্‌ সময় সেটা শোনা যাবে, সেই সময়কেও এখানে আগে থেকে নির্দিষ্ট করা যায়। ১৯২০র ডিসেম্বরে ‘The Saturday Evening Post’-এ ডিক্টাফোনের এরকম একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল।৩০

    কাহিনির ঘটনাকাল আমরা জানি ১৯২০-র সেপ্টেম্বর। এই বিজ্ঞাপন তখন-ও প্রকাশ পেতে দেরি আছে। কিন্তু Curtis and Troute কোম্পানির এই ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন দেখেই কি ডিক্টাফোন কেনার কথা ভেবেছিলেন রজার অ্যাক্রয়েড?

    আলোচ্য প্রচ্ছদটিতে দেখছি, একেবারে পিছনে আছে এই ডিক্টাফোন। আর, একেবারে সামনে মিসেস ফেরার্সের কনফেশন লেটার, এই স্বীকারোক্তিমূলক চিঠির ওপরে-লেখা ডিটেলিং-ও পাঠকের নজর এড়ায় না। আর, এই চিঠিকেই বিদ্ধ করে আছে একটা ছোরা --- খুনের অস্ত্র। ডানদিকের নিচের প্রচ্ছদটিতে জিজ্ঞাসাচিহ্ন দেখেই সচেতন পাঠক বুঝে যান এটা whodunit ঘরানার গল্প, যেখানে, প্রচ্ছদ অনুযায়ী কে ছোরা বিঁধিয়ে খুন করল, সেই রহস্য উদ্ঘাটন-ই কাহিনির মূল ভরকেন্দ্র। একেবারে মাঝখানের প্রচ্ছদটি হল ‘The Murder of Roger Ackroyd’-এর গ্রাফিক নভেলের প্রচ্ছদ।

    ৮. শেষের কথা :

    উপসংহারে পৌঁছে ক্যালাইডোস্কোপটাকে শেষবারের মতো ঘোরানো যাক।

    মিসেস ফেরার্স ভেরোনল খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। Veronal কী? এটা আসলে Barbital ড্রাগের ব্র্যান্ডনাম। ১৯০৩ থেকে শুরু করে প্রায় ১৯৫০-এর দশক অবধি এই ভেরোনল ঘুমের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হত৩১

    তাঁকে সেই পথ বেছে নিতে কার্যত বাধ্য করেছিলেন ডঃ শেপার্ড। গল্পের একেবারে শেষে দেখি, ডঃ শেপার্ড-ও ভেরোনল খেয়ে আত্মহত্যার পথ নির্বাচন করছেন। আমাদের মনে হতে পারে, history repeats itself. কিন্তু আধুনিক যুগে যে history doesn’t repeats itself! আধুনিক যুগে যে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে না! সেই ইতিহাসের গতি, circular নয় --- linear. আধুনিক যুগে, ইতিহাস, তার বৃত্তীয় পরিক্রমা ছেড়ে সরলরেখায় যাত্রা করে। ঘটনার একটা মাত্রা সেখানে মেলে ঠিক-ই; কিন্তু বাকি স্থান, কাল, পাত্র সবই যায় বদলে।

    মিসেস ফেরার্স ব্ল্যাকমেলারের হাত থেকে বাঁচতে নিরুপায়ভাবে আত্মহত্যা করেছিলেন। আর শেপার্ড, পোয়ারোর নির্দেশে, আত্মহত্যা করতে বাধ্য হলেন যাতে মানুষের কাছে তাঁর ব্ল্যাকমেলার সত্তা অনুদ্‌ঘাটিত থাকে! কিন্তু কীকরে থাকবে? শেপার্ডের লেখা ‘দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাক্রয়েড’-এর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের পর তো সবটাই জানাজানি হয়ে যাবে! তা যাক। শেপার্ড তো তখন মানুষের সমালোচনার ধরাছোঁয়ার বাইরের জগতে পাড়ি দিয়েছেন!

    কাহিনির ষোলো নম্বর অধ্যায়ে মা জং খেলা হয়েছিল চারবার। তিনবার জিতেছিলেন মিস গ্যানেট। শেয বার জেতেন ডঃ শেপার্ড --- চোদ্দটা টাইলসকে যথাযথ বিন্যাসে সাজিয়ে। কিন্তু জীবন? সেটা তো মা জং খেলা নয়। তার নিয়ম যে আলাদা! তাইতো, রজারকে খুন করলেও, শেপার্ড, সেটাকে ‘পারফেক্ট ক্রাইম’-এ পরিণত করতে পারেননি। মা জং খেলায় ঠিকঠাক টাইলস সাজাতে পারলেও, নিজের জীবনে, খুনের সূত্রগুলো তিনি পারেননি পারফেক্টলি মুছে ফেলতে। বরং, তাঁর ফেলে-আসা সূত্র ধরেই, যুক্তিসংগত অনুমানে, তথ্যের নির্ভুল বুনোটে, জীবনে সত্য উদ্ঘাটনের মা জং খেলায় জিতে গেছেন --- হারকিউল পোয়ারো। ‘The Murder of Roger Ackroyd’ কাহিনির প্রারম্ভে যে-হত্যারহস্যের সমাধান মনে হয়েছিল অসম্ভব, কাহিনির পরিসমাপ্তিতে তাকেই সম্ভব করে তুলে ব্যক্তি পোয়ারো নিজে জিতে যাওয়ার পাশাপাশি এভাবে জিতিয়ে দিলেন সত্যকেও।

    উৎস ও অনুষঙ্গ :

    ১. Charles Osborne, ‘The Life and Crimes of Agatha Christie’, London, William Collins Sons & Company Limited, First published in 1982, Revised and updated edition in 1999, p. 41.
    ২. তত্রৈব
    ৩. তত্রৈব
    ৪. তত্রৈব
    ৫. তত্রৈব
    ৬. https://www.openculture.com/2016/02/20-rules-for-writing-detective-stories.html এবং https://mysteryfictions.web.unc.edu/10-commandments-ronald-knox/
    ৭. তত্রৈব, পৃ. ৪১-৪২
    ৮. তত্রৈব, পৃ. ৪২
    ৯. http://luirig.altervista.org/calendar/index.php?year=1926
    ১০. http://luirig.altervista.org/calendar/index.php?year=1925
    ১১. http://luirig.altervista.org/calendar/index.php?year=1924
    ১২. https://www.generalblue.com/calendar/1923
    ১৩. https://print-a-calendar.com/printable-calendars/1922
    ১৪. https://www.alamy.com/calendar-of-year-1921-image226485534.html
    ১৫. https://www.generalblue.com/calendar/1920
    ১৬. https://print-a-calendar.com/printable-calendars/1919
    ১৭. https://www.canstockphoto.com/calendar-of-year-1918-37724065.html
    ১৮. https://www.generalblue.com/calendar/1917
    ১৯. Charles Osborne, ‘The Life and Crimes of Agatha Christie’, London, William Collins Sons & Company Limited, First published in 1982, Revised and updated edition in 1999, p. 43.
    ২০. মা জং খেলার প্রথমিক নিয়মটি এই লিঙ্কে জানা যাবে --- https://www.youtube.com/watch?v=pka0nVIahb0
    ২১. https://www.gamblingsites.com/skill-games/mahjong/
    ২২. তত্রৈব
    ২৩. https://www.shutterstock.com/image-vector/winner-mahjong-majiang-set-vector-tilebased-1203467125
    ২৪. https://symbolismandmetaphor.com/goldfish-symbolism-spirit-animal/
    ২৫. তত্রৈব
    ২৬. https://www.opera-online.com/en/items/works/pelleas-et-melisande-debussy-maeterlinck-1902
    ২৭. http://www.forensicsciencesimplified.org/prints/principles.html
    ২৮. https://www.goodreads.com/work/editions/1073110-the-murder-of-roger-ackroyd?page=1 এবং https://www.goodreads.com/work/editions/1073110-the-murder-of-roger-ackroyd?page=2
    ২৯. https://recording-history.org/history-of-dictaphone/
    ৩০.https://commons.wikimedia.org/wiki/File:The_Dictaphone,_1920_advertisement.jpg
    ৩১. https://en.wikipedia.org/wiki/Barbital



    অলংকরণ (Artwork) : উইকিপেডিয়া ও অন্যান্য আন্ত্রর্স্থল থেকে নেওয়া
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments