• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • ওর নাম রুথ : নূপুর রায়চৌধুরি

    গ্রেহাউন্ড বাসের ড্রাইভার মাইকে এনাউন্সমেন্ট করল—১০০১ হাওয়ার্ড স্ট্রিট, ডেট্রয়েট এসে গেছে, এই বাসের শেষ স্টেশন এইটা, যাত্রীরা যেন তাদের সঙ্গের জিনিসপত্র সংগ্রহ করে নামার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নেয় দিয়া, মনিবন্ধের ঘড়িতে চোখ রাখল সে—রাত ১-৩২। বাসটা প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা দেরিতে পৌঁছাল। এ তো জানাই ছিল; প্রথমত ন্যাশভিল থেকে ছেড়েছেই আধ ঘন্টা দেরিতে; তার উপর লুইভিল, ইন্ডিয়ানাপলিস, টলিডো এতগুলো জায়গা হয়ে আসা-প্রতিটি কানেকটিং স্টেশনে গাড়ি বদল করা, মালপত্র তোলা-নামানো, টিকিট চেক, হ্যানা ত্যানা করে শেষমেশ এই ডেট্রয়েট। না, এত রাতে, এই কুখ্যাত শহরে হোটেল খুঁজতে যাবার কথা চিন্তা করতেও দিয়ার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। এই সেদিনই তো খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল: গ্রেহাউন্ড বাস স্টেশন থেকে মাত্র এক ব্লক দূরত্বেই একজন মহিলার ব্যাগপত্র সব ছিনতাই হয়ে গেছে, রীতিমতো বুকে ছুরি-ঠেকানো অবস্থায়—তখন এমন কিছু বেশি রাতও হয়নি। নাহ, যেভাবেই হোক আর কয়েক ঘন্টা এই বাস স্টেশনেই কাটিয়ে দিতে হবে। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে বসল দিয়া। শিকাগো-র লাস্ট বাসটা ডেট্রয়েট ছাড়ল এই রাত দুটোয়, একজন যাত্রিনী ওর স্টাফড কুকুরটা ফেলেই চলে গেছে, দেখো, সেটা কেমন জুলজুল করে দিয়ার দিকেই তাকিয়ে যেন হাসছে, যাহ, ভ্যাট! কুকুরটাকে জিভ ভেঙাল দিয়া।

    পুরো বাসস্টেশন এখন শুনশান। স্টেশন-সুপারভাইসার দিয়ার কাছটিতে এসে দাঁড়াল, বলল, ম্যাডাম, আমরা এখন স্টেশন বন্ধ করে দেব, তুমি এখানে আর থাকতে পারবে না, তবে, ম্যানেজারের সাথে কথা বলে দেখতে পার একবার! ম্যানেজার লোকটি বেশ দয়ালু। সে দিয়াকে জানাল, এই অন্ধকার রাতে সে দিয়াকে বাইরে যেতে দিতে চায় না। যাক বাবা, রাতের হিল্লে হলো তবু!

    দিয়া নিজের জায়গায় ফিরে এসে জমিয়ে বইপত্র খুলে সাজিয়ে বসল, আইপডে ওর প্রিয় ডায়ার স্ট্রেটস-এর ‘’টানেল অফ লাভ’’ বাজছে, গোলাপী স্বপ্নের বুদবুদ যেন আলতো করে জড়ায় দিয়াকে। সুপারভাইসার আবার দিয়ার কাছে এসে বলল, আমার নাম উইলসন, এই শিফ্টের দায়িত্ব আমার, ওই ডান দিকের অফিসটায় আমি আছি, কোনো দরকার হলে জানিও! আমি দিয়া, বলে, কৃতজ্ঞ চোখে, স্মিত হেসে করমর্দনের জন্য উইলসনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় দিয়া। পরিচয়পর্ব শেষ হতে শিষ দিতে দিতে নিজের কামরায় ফিরে যায় উইলসন।

    চারপাশটা ভালো করে দেখে দিয়া— সারি সারি স্টিলের অপেক্ষমান চেয়ার, দূরেই গোটা চারেক ভেন্ডিং মেশিনে নানারকমের স্ন্যাকস, সুইট ড্রিঙ্কস, কফি, আর অল্পস্বল্প কোল্ড লাঞ্চের পসরা, পাশেই একটা মাইক্রো ওভেনও দিব্যি সাজানো রয়েছে, ওয়াই-ফাই কানেকশনও রয়েছে - গতি তার আহামরি না হলেও বিনাপয়সায় দিচ্ছে বাস কোম্পানি—সেই তো ঢের; এমনকি, পাশের ছোট্ট কিউবিকলে ইলেকট্রনিক-গেমসের দুটো মেশিনও শোভা পাচ্ছে, ব্যবসা ভালই চলে মনে হয়।

    অসুবিধে একটাই-চারিদিকে এত আলো যে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে, ঘুমোবার কোনো সুযোগই নেই| যাক গিয়ে, মোটে তো কয়েক ঘন্টারই মামলা, কেটে যাবে এটা-সেটা করে।

    বই পড়তে পড়তে চোখ একটু লেগে এসেছিল, হঠাৎ একটা ঘড়ঘড় শব্দে তন্দ্রা ভেঙে গেল দিয়ার। তাকিয়ে দেখে, এক কিশোরী মেয়ে একটা চাকাওয়ালা ক্যারি-ব্যাগ টানতে টানতে, বাস স্টেশনের কাচ-দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল, দরজা বন্ধ দেখে একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ মাটিতেই বসে পড়ল মেয়েটা। দিয়া ভালো করে লক্ষ করল ওকে। কতই বা বয়স হবে? বড়োজোর সতেরো-আঠারো, রোগাটে চেহারা, পরনে আকাশি রঙের সোয়েটার আর নেভি ব্লু জিন্স। হাতের ব্যাগটা নেহাতই মাঝারি মাপের, কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে ওটা টেনে আনছিল, যেন প্রতিটি পদক্ষেপ ওর শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিংড়ে নিচ্ছে! বাস স্টেশনের দেয়ালঘড়িতে এখন রাত তিনটে বাজে —দিয়া অবাক হয়ে ভাবল, এত রাতে একা একা ও কী করছে এখানে? শ্বাপদের দল যে এরকম পরিস্থিতিতেই লুকিয়ে আঘাত করে ও কি তা জানে না? বাইরের তাপমাত্রা এখন প্রায় ৩৭ ডিগ্রী ফারেনহাইটে নেমে এসেছে - কনকনে ঠান্ডা—মেয়েটা জবুথবু হয়ে বসে ব্যাগের উপরই মাথা রেখেছে- ওর সোনালী চুলগুলো হাওয়ায় বিশ্রস্ত্র। দিয়ার বড্ডো মায়া হচ্ছে কিশোরীটির জন্য। মৃদু হিটিং চলায় স্টেশনের ভিতরটা বেশ আরামদায়ক, একটা অপরাধবোধ যেন দিয়াকে গিলে খেতে চাইছে, ও দ্রুত উঠে এসে উইলসনের দরজায় টোকা দেয়, দিয়া কিছু বলার আগেই উইলসন জিজ্ঞেস করে -তুমি কি ধূমপান করতে চাও? তাহলে ওধারটায় যেতে পারো- বলে আঙ্গুল দিয়ে একদম পিছনের একটা জায়গা সে নির্দেশ করে। না, না, আমি একদম ঠিক আছি, দিয়া বলে, আসলে মেয়েটা অনেকক্ষণ ধরে ঠান্ডায় অপেক্ষা করছে, ওকে একটু ভিতরে ঢুকতে দেবে, উইলসন?

    কে মেয়ে? কোথায়?

    ওই তো, দরজার বাইরে, তাকিয়ে দেখো!

    অফিসঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে উইলসন; দিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে মেয়েটাকে এবার দেখতে পেল সে। রীতিমতো অবাক হল উইলসন —ঘড়ির সময়টা নজর করল— রাত তিনটে —এই মেয়ে আবার কোথা থেকে এসে জুটল এই রাতদুপুরে? মেয়েটার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করল সে, তারপর দিয়ার দিকে ফিরে বলল, মিস দিয়া—ভোর ৬টার আগে কোনো বাস ছাড়ছে না এই স্টেশন থেকে আর বাস ছাড়ার ঠিক এক ঘন্টা আগেই কেবলমাত্র দরজা খোলার নিয়ম এখানে।

    ও একেবারেই ছেলেমানুষ—কিছু হয়ে গেলে? উইলসনের হাতটা ধরে এবার অনুরোধ করে দিয়া, প্লিজ।

    উইলসন একবার দিয়ার ছলোছলো চোখদুটো, আরেকবার মেয়েটাকে দেখে, নাহ, মিস দিয়া তুমি দেখছি আজ আমার চাকরিটার বারোটা বাজিয়েই ছাড়বে—এ তো মহা ঝামেলায় পড়লাম! গজগজ করতে করতে দরজার দিকে এগোয় সে।

    দিয়া দেখল দরজা খুলে মেয়েটাকে ভেতরে ঢুকে আসতে নির্দেশ করল উইলসন, আর কী আশ্চর্য! মেয়েটা গুটি গুটি এসে দিয়ার পাশের চেয়ারটাতেই বসল।

    দিয়া নাম জিজ্ঞেস করতে মেয়েটা বলল, ওর নাম রুথ। দিয়া বাল্টিক সী চোখে দেখেনি, কিন্তু সেদিন ``কোপেনহেগেন'' সিনেমাতেই দেখল, সেই ঘন নীলচে-সবুজ জলরাশি, কালস্রোতও বুঝি ক্ষণিকের তরে স্তব্ধ হতে চায় সেই রঙের বন্যায় ডুবে, রুথের চোখ যেন সেই সমুদ্দুরেরই এক চুমুক, সোনালী চুলত কপাল ছাড়িয়ে দুই টানা ভুরুর কোল ছুঁই ছুঁই, ডালিম-রাঙ্গা ঠোঁটে এক চিলতে সঙ্কুচিত হাসির ঝলক, দিয়ার মনটা দ্রবীভূত হয়ে ওঠে, একই বয়সি আরেকটা কিশোর মুখের ছবি মনের আয়নায় যেন উঁকি দিয়ে গেল — ওর নিজের নাড়িছেঁড়া সাত রাজার ধন এক মানিক। এক নিমেষেই রুথকে খুব কাছের বলে বোধ হলো। রুথের হাতে গুটিকয় বাস-রুটের প্রিন্ট আউট, কোথায় যাবে তুমি? ইতস্তত করে জানতে চাইল দিয়া,

    বোবা চোখে তাকাল রুথ—বুঝতে পারছি না।

    অবাক হয়ে ভাবে দিয়া—তার মানেটা আবার কী?

    তোমার বাড়ি কি এই শহরেই?

    হুঁ, মাথা নাড়ে রুথ।

    তুমি কি একাই যাচ্ছ?

    দিয়ার দিক থেকে মুখটা সরিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বলে রুথ— হুঁ।

    রুথের এরকম সংক্ষিপ্ত উত্তর শুনে দিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, আর বেশি প্রশ্ন করাটা উচিত হবে কি না, এই বয়সি ছেলেমেয়েগুলো এত একাচোরা হয়—দেখছে তো একটাকে কাছ থেকে!

    দুই রাত আগে আমার সব টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে একটা দুর্বৃত্ত—দিয়াকে চমকে দিয়ে কথাগুলো বলে রুথ। সে কী, কেমন করে হলো এসব? অতর্কিতেই কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে কথাগুলো দিয়ার ভিতর থেকে। ডাউনটাউনের একটা সস্তার খাবারের দোকান থেকে ফিরছিলাম, ওখানে একটা ক্যাসিনো আছে, ক্যাসিনোর পাশের রাস্তা দিয়ে যাবার সময়, একটা শয়তান কোথা থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভয় দেখায়, বলে, রেপ করবে, খুন করবে, কী করব? সঙ্গে যা পয়সাকড়ি ছিল, ছিনিয়ে নিয়ে গেল — কথাগুলো বলেই মাথা নিচু করে রুথ, তারপর ওভাবেই চুপচাপ বসে থাকে।

    দিয়ার মনে হল— ও এখন কাঁদছে নীরবে।

    তুমি রাতের খাবার খেয়েছ? প্রসঙ্গটা ঘোরাতে চায় দিয়া।

    মাথা নেড়ে না জানায় মেয়ে।

    দিয়া বলে, এস কিছু খাবার খাও!

    না, না, রুথ ইতস্তত করে।

    দিয়া জোর করে না, আবার বইয়ের পাতায় মন দেবার ছল করে, কিন্তু বুকে ওর হাজারো প্রশ্নের ঝড়।

    অনেক দোনামনা করে একটু বাদেই দিয়া আবার জিজ্ঞেস করে, রুথ তুমি ভারি সুন্দর দেখতে, এত রাতে তুমি কেন বাইরে ছিলে? এ অঞ্চলটা মোটেই নিরাপদ নয়!

    দুই দিন ধরে আমি এই বাস স্টেশনে আসছি, কিন্তু ওরা তো একটিবারও এল না, অথচ …. কথা বলতে বলতেই অকস্মাৎ থেমে যায় রুথ, দিয়া চুপ করে থাকে, নিজের দুর্ভাগ্যের গল্প অন্যকে বলা—সে কি চাট্টিখানি কথা? ওর থেকে বেশি কে আর জানে? তার উপর একজন সম্পূর্ণ অজানা অচেনা মানুষের কাছে?

    ভেবেছিলাম আমার বাড়ির লোকগুলো আমাকে ফেরাতে আসবে, কিন্তু এখন বুঝছি ওরা আমাকে বরাবরের জন্যই ত্যাগ করেছে, ওদের কাছে আমি একটা বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়— দিয়ার দিকে চেয়ে একটু হাসে রুথ।

    সে হাসি কান্নার চেয়েও করুণ—দিয়ার বুকের ভিতরটায় যেন কেউ মোচড় দেয়।

    নিজের মায়ের কথা আমার তেমন করে মনে নেই—আসলে মা যখন চলে যায়, আমি তখন মাত্র দুই বছরের ছিলাম তো!

    কোথায় গেল তোমার মা? বিস্ময় ঝরে পড়ে দিয়ার কথায়।

    আকাশের দিকে আঙ্গুল দেখায় রুথ— তারাদের দেশে হারিয়ে গেছে মা আমার।

    কী বলবে এবার আর ভেবে পায় না দিয়া, ওর সারা অস্তিত্বে এখন জমাট বাঁধা পাষাণ মৌনতা।

    —শুনেছি আমরা সেইসময় থাকতাম ওয়াশিংটন ডি সি-তে; হাসি গান হুল্লোড়ের ভাসা ভাসা কিছু ছবি মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো ছুঁয়ে যায় আমার চোখের পাতা; কিন্তু এখানে সৎ মায়ের সংসারে, বড় হয়ে উঠলাম শুধু এই শুনতে শুনতে যে, আমি বাজে, আমি খারাপ, আমি অসুন্দর, একটুও ভালোবাসে না কেউ, উঠতে বসতে সবাই দুচ্ছাই করে আমাকে।

    তোমার বাবা?

    সৎ মায়ের হাতের পুতুল এখন।

    দিয়া অবাক হয়ে ভাবে কেমন সে নিষ্টুর পরিবেশ, যার জন্য ঘর ছেড়ে পথে নেমে অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করতে বাধ্য হয়েছে রুথ?

    চেয়ার ছেড়ে উঠে দেয়ালে বসানো জলের কল থেকে আঁজলা ভরে জল খায় মেয়েটা।

    দিয়ার বুকটা টনটন করে, ও উঠে গিয়ে ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা স্যান্ডউইচের প্যাকেট কিনে রুথের হাতে সেটা জোর করে গুঁজে দেয়, খুঁটে খুঁটে খায় রুথ—প্রতিটা টুকরো, প্রতিটা দানা।

    দিয়ার চোখে জল, যদি পারত রুথকে ওর সাথে নিয়ে যেতে, যদি পারত এরকম একটা কচি মুখে আশার আলো ফোটাতে! কিন্তু ও নিজেই তো আজ ঘরের খোঁজে পথ হাঁটছে!

    রুথ স্যান্ডউইচের খালি প্যাকেট-টা ফেলার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে আবর্জনা ফেলার ড্রামটার দিকে —ওর পা দুটো যেন অবশ, টেনে টেনে হাঁটছে, হাঁটছে আঁকাবাঁকা।

    দিয়ার ভয় হচ্ছে, সব ঠিক আছে তো? চেয়ারে ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ে রুথ, দিয়া নিজের গায়ের আলোয়ানটা দিয়ে ঢেকে দেয় ওর শরীরটা, একটু বাদেই লক্ষ করে দিয়া রুথের সারাটা শরীর কাঁপছে, থর থর করে—বেতসপাতার মতো, দিয়া ভয় পায় খুব, আচমকা মনে একটা নিদারুণ আশঙ্কা উঁকি দিয়ে যায় ওর, ড্রাগের অন্ধকার গলিতে পা দেয় নি তো রুথ? কে বলে দেবে? ও তো এখনো একটা না-ফোটা কুঁড়ি; সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় উন্মুখ—সেকি অকালেই ঝরে যাবে? হারিয়ে যাবে অন্ধকারের কানাগলিতে? কিন্তু দিয়া এখন কী করবে? পুরোনো জীবনটাকে পিছু ফেলে দিয়ে ও নিজেও তো এক মুসাফির। এই অচেনা শহরে এসেছে, নতুন ঠিকানার খোঁজে। আজ থেকে ওর নিজেরও সংগ্রামী যাত্রা শুরু হতে চলেছে, একটু থিতু হলেই ছেলেটাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবে ও ভেবে রেখেছে,—ওই কচি প্রাণটাও তো দিয়ার পানেই বহু প্রত্যাশায় হাঁ করে তাকিয়ে আছে! কি জানি পথ হারাবে কি না? মাথাভরা এই বোঝার উপর আবার আরেকটা? ওর ক্ষমতাই বা কতটুকু? দিয়ার প্রথমে খুব কান্না পায়, অসম্ভব রাগ হয় তাবৎ জীবনের প্রতি, ইচ্ছে হয় দৌড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে, কিন্তু পরক্ষণেই প্রত্যয়ের আলোয় জ্বলজ্বল করে ওর দুচোখ: না এ হতে পারে না—ওরা কেউ এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না; না দিয়া, না রুথ! দিয়ার সামনে এখন আরেক প্রস্থ দায়িত্ব —রুথ নাবালিকা- রুথের পরিবারের সঙ্গে প্রথমে ওকে কথা বলতেই হবে—ওদের বুঝিয়ে বলবে দিয়া—যদি ওরা ওকে মেনে নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তো ভালো, না নিলেও কুছ পরোয়া নেই—দিয়া আছে না? একটার জায়গায় না হয় দুটো জীবন জুড়ে গেল ওর চলার পথে! রুথের ওই সুকুমার হৃদয়ে স্বপ্নের বীজ বুনে দেবে সে, ওকে স্বপ্ন দেখাবে, স্বপ্ন দেখবার সময় দেবে, একদিন রুথ নিজেই নিজস্ব স্বপ্নপূরণের পথে হেঁটে যাবে। অসীম জীবনের কাছে সর্বান্তকরণে সেই প্রার্থনাটুকুই করে দিয়া এই মুহূর্তে।

    ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। এক দুই করে নতুন যাত্রীদের ভিড় কাচ-দরজার বাইরে, চাবির গোছা হাতে দরজা খুলতে চলেছে উইলসন, রুথ এলিয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। গভীর মমতায় ওর মাথায় আলতো করে আঙ্গুল ছোঁয়ায় দিয়া, উইলসনকে ডাকে দিয়া, উইলসন, আমাকে একটু সাহায্য করবে ভাই?

    আবার কী হলো দিয়া? আমার ডিউটি শেষ, সকালের শিফট-বদলের সময় হয়ে এসেছে। অন্য লোক এল বলে।

    আমি কি আরও একটু সময় এই স্টেশনে অপেক্ষা করতে পারি উইলসন?

    রীতিমতো অবাক হয় উইলসন? দিনের আলো ফুটলেই এখান থেকে চলে যাবে এমনটাই তো গত রাতে কথা হয়েছিল তোমার সাথে।

    রুথের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলে দিয়া, ও ঘুম থেকে এই উঠল বলে, দুজনে মিলে একসাথে বেরিয়ে যাব, আজকের দিনটা দেখো, কী সুন্দর, সম্ভাবনাময়, এরকম দিনে দুজনে হাত ধরাধরি করে পথ চলার আনন্দই আলাদা। তুমিও আসবে না কি আমাদের সাথে?

    যারপরনাই অবাক হয়ে গেছে উইলসন, কিন্তু খুব ভালো লাগছে ওর দিয়ার কথাগুলো শুনে, সত্যি আজকের সূর্যটা যেন বেশি চনমনে, অকৃপণ উষ্ণতায় ভরিয়ে দিচ্ছে চরাচর, বেশ হতো ও-ও যদি দিয়াদের সঙ্গী হতে পারত—নাহ, আজ তাড়াতাড়ি ঘরে পৌঁছেই ছেলেমেয়েদুটোকে নিয়ে একবার পার্কে খেলতে যেতে হবে—ওরা দারুণ খুশি হবে! শিষ দিতে দিতে চাবি জমা দেবার জন্য দ্রুত পিছু ফেরে উইলসন।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments