না রাখো কান নজ়ম-এ-শায়েরান-এ-হাল পর ইতনে
চলো টুক মির কো সুন-নে কে মোতি সে পিরোতা হ্যায়
[হালের কবিদের কথায় কান দিও না। চলো, মিরের কবিতা শুনি; তিনি শব্দ নয়, মোতির মালা গাঁথেন।]
কে এই কবি যিনি মোতির মালা গাঁথেন? যাঁর সম্পর্কে উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা গালিবকেও বলতে হয়,
গালিব আপনা ইয়ে আকিদা হ্যায় বকোল নাসিখ
আপ বে-বেহরা হ্যায়, যো মোতাক্কিদ-এ-মির নহিঁ
[গালিব, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনি দুর্ভাগা, যদি মিরের ভক্ত না হন। কেন, কবি নাসিখও তো তেমনই বলেছেন।]
তিনি মুহম্মদ তকি ‘মির’ (১৭২৩ – ১৮১০)। তখল্লুস্ অর্থাৎ ছদ্মনাম ‘মির’। মির তকি মির নামেই আমরা তাঁকে চিনি। মিরের আত্মজীবনী ذکر میر (জ়িকর-এ-মির) থেকে জানা যায় আগ্রায় (তৎকালীন আকবরাবাদ) তাঁর জন্ম। মিরের পূর্বপুরুষরা কয়েক প্রজন্ম আগে ইরানের হিজাজ্ থেকে দেশান্তরী হয়ে ভারতে এসেছিলেন। পিতামহ মুঘল সেনার ফৌজদার হলেও পিতা ছিলেন সুফি দরবেশ। অত্যন্ত নম্র, কোমল স্বভাবের মানুষ তিনি। ঈশ্বর ও মানবপ্রেম আর সৌন্দর্য সম্পর্কে কবি হিসেবে মিরের যে দর্শন, তার অনেকটাই পিতার কাছ থেকে পাওয়া। কৈশোরে পিতার মৃত্যুর পরে তিনি ভাগ্যানুসন্ধানে দিল্লি চলে আসেন। নবাবদের অর্থসাহায্যে দিন-গুজরান হয়ে চললেও ১৭৩৯-এ নাদির শাহের আক্রমণে দিল্লি তছনছ হয়ে যায়। তারপরে ১৭৪৮ থেকে একাধিকবার দিল্লির ওপরে চড়াও হলেন আহমদ শাহ আবদালি। অনবরত বিদেশি আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর ছেড়ে অন্য অনেক নাগরিকের মত হতদরিদ্র কবিকেও দিল্লি ছাড়তে হয়।
১৭৮৩-এ হৃদয়ে বেদনা আর চোখে জল নিয়ে তিনি প্রাণাধিক প্রিয় শহর দিল্লি ছেড়ে ধরলেন লখনউয়ের পথ। কিন্তু মিরের অতি সংবেদনশীল মন সেখানেও শান্তি পায়নি। দরবেশের পুত্র হলেও গালিবের মত প্রথাগত ধর্মে তেমন বিশ্বাস না থাকায় সেখানেও মেলেনি আশ্রয়। বরং কঠোর ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিরোধিতা করেছেন সেই গজ়লটিতে যেটি বেগম আখতারের কণ্ঠে অমর হয়ে রয়েছে:
উলটি হো গয়িঁ সব তদবিরেঁ, কুছ না দাওয়া নে কাম কিয়া
দেখা ইস বিমারি-এ-দিল নে, আখির কাম তামাম কিয়া
কিস্ কা কাবা? ক্যায়সা কিবলা? কৌন হারাম হ্যায়? কেয়া এহরাম?
কুচে কে উস্ কে বাসিন্দোঁ নে, সব কো এহিঁ সে সালাম কিয়া
শেখ যো হ্যায় মসজিদ মেঁ নাঙ্গা, রাত কো থা ম্যায়খানে মেঁ
জোব্বা, খিরকা, কুর্তা, টোপি, মস্তি মেঁ ইনাম কিয়া
মির কে দিন-ও-মজ়হব কো আব পুছতে কেয়া হো উন নে তো
কাশকা খেঁচা, দয়ের মেঁ বৈঠা, কব কা তর্ক ইসলাম কিয়া
[আমার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল, ওষুধ কোনও কাজ করল না। দেখলেন, কীভাবে হৃদয়ের এই অসুখ আমাকে শেষ করে দিল? কোথায় মক্কার মসজিদ? কোন্ দিকে? প্রেমিকার গলির বাসিন্দাদের তো পুণ্যযাত্রায় মতি নেই; তারা এখান থেকেই দিল সেলাম ঠুকে। মসজিদে যে নাঙ্গা ফকির, গতরাতে তো সে ছিল শুঁড়িখানায়। মাতালের উৎসাহে জোব্বা-কোট-কুর্তা-টুপির মত পুণ্যবস্ত্র দান করে এল। তা হলে এখন মিরের ধর্ম আর বিশ্বাস সম্পর্কে ওরা কী জানতে চায়? সে কপালে তিলক কেটেছে, বসেছে মন্দিরে, সেই কবে তো সে ইসলামকে ত্যাগ করেছে।]
ভেবে দেখুন মির তকি মির কী দুর্দান্ত সাহসের পরিচয় দিচ্ছেন এখানে। তার চেয়েও বেশি প্রশংসার দাবি রাখেন সে যুগের প্রশাসনিক ভাগ্যনিয়ন্তা যাঁরা। তাঁরা কবিদের এতটাই বাকস্বাধীনতা দিতেন!
মেহেদি হাসানের গলায় ‘পত্তা পত্তা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যায়’ এই বিখ্যাত গজ়়লটি পাঠকবর্গ নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। এটি সত্তরের দশকে একটি হিন্দি সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে সকলের জানা নাও থাকতে পারে যে এই গজ়়লটি উর্দু ভাষার প্রথম ‘আজিম শায়ের’ (বড় কবি) মির তকি মিরের রচনা। উর্দু কাব্য রচনায় তাঁর দক্ষতার জন্য তাঁকে ‘খুদা-এ-সুখন’ (শিল্পের ঈশ্বর) বলা হত। মূল গজ়লে আছে দশটি শের। মেহেদি হাসান সুনির্বাচিত তিনটি শের তাঁর গাওয়া গজ়লে পরিবেশন করেছেন। আমিও এখানে ওই তিনটি শেরের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:
পত্তা পত্তা বুটা বুটা হাল হামারা জানে হ্যায়
জানে না জানে গুল হি না জানে বাগ তো সারা জানে হ্যায়
চারাগরি বিমারি-এ-দিল কি, রসম্-এ-শেহর-এ-হুসন নহিঁ
ভরনা দিলবর নাদাঁ ভি ইস্ দরদ কা চারা জানে হ্যায়
মেহর-ও-ভফা-ও-লুতফ-ও-ইনায়াৎ এক সে ভাকিফ উন মেঁ নহিঁ
অউর তো সব কুছ্ তনজ্-ও-কিনায়া রমজ্-ও-ইশারা জানে হ্যায়
[বাগানের কুঁড়ি-পাতা এরা সবাই আমার মনের অবস্থা জানে; সারা বাগান জানলেও ফুল অর্থাৎ আমার প্রেমিকা কিন্তু সে কথা জানে না। শহরের রীতিনীতি, চালচলনে সৌন্দর্য নেই। তাই আমার মনের এই অসুখ। আর এই মনোবেদনার উপশম কেই বা করবে? যদি শহুরে জীবনে সে সৌন্দর্য থাকত, তাহলে আমার প্রিয়া, তাঁর সারল্য সত্ত্বেও, আমার মনের অবস্থা বুঝতেন। এঁরা (শহুরে নাগরিকরা) কেউ দয়া, বিশ্বাস, সৌন্দর্যবোধ, ক্ষমা ইত্যাদি ইতিবাচক গুণের সঙ্গে পরিচিত নন। তাঁরা আড়ালে ঠাট্টা-বিদ্রূপ-পরনিন্দাই শুধু করতে জানেন।]
মির শহুরে কবি হলেও এবং গজ়ল মূলত প্রেমের কবিতা হলেও এখানে শহুরে আদব-কায়দার কৃত্রিমতাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রেমের কবিতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে সেই কৃত্রিম জীবনের নিদারুণ সমালোচনা। যাঁরা উর্দু গজ়লকে শুধুই প্রেমের কবিতা বলে মনে করেন, তাঁদের ভুল ভাঙাতে পারে মির তকি মির এর এই গজ়লটি।
কেমন মানুষ ছিলেন এই উর্দু কবি? কেমন চলত তাঁর কাব্যচর্চা? আসুন একটা কাহিনী শোনাই। তখন মিরের সময়টা খারাপ যাচ্ছে। শহরের এক মহামান্য নাগরিক, যিনি আবার মিরের গুণগ্রাহীও বটে, কবির বসবাসের জন্য ভদ্র পাড়ায় একটা চমৎকার বাড়ি ঠিক করে দিলেন। ঘরের পেছন দিকে একটা জানলা। জানলা খুললেই ছোট একটা বাগান চোখে পড়ে।
মির সেই বাড়িতে থাকতে শুরু করার পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। এবারে এক বন্ধু মিরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। তিনি দেখে আশ্চর্য হলেন যে পেছনের সেই জানলাটি তালাবন্ধ করা আছে। দেখে মনে হয় না কখনও খোলা হয়েছে। বন্ধু কবিকে বললেন, “পেছনের প্রাঙ্গণে ভারি সুন্দর একটা বাগান আছে। জানলাটা খুলে দিলেই তো বেশ প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করতে পারেন?” মির এই কথা শুনে নিজের লেখার টেবিলের স্তূপীকৃত কাগজের দিকে একবার এমনভাবে তাকালেন যেন বন্ধুর দৃষ্টি সেই জমে ওঠা কাগজের গোছার ওপর পড়ে। তারপর মাথা নেড়ে সেই কাগজের স্তূপ দেখিয়ে বললেন, ‘আমি এই বাগানের পরিচর্যায় এমন মগ্ন হয়ে থাকি, যে অন্য কোনও উদ্যানের সৌন্দর্য উপভোগ করার সময়ই আমার নেই।’ বলাই বাহুল্য মিরের উত্তর শুনে বন্ধুটি একেবারে নীরব হয়ে গেলেন।
এই কাহিনীটি আপনাদের শোনালাম মোহাম্মদ হুসেন আজাদ রচিত آبِ حیات (আব-এ-হায়াত) নামে সেই বিখ্যাত গ্রন্থটি থেকে যেখানে সংকলিত আছে উর্দু কবি ও কবিতা সম্পর্কিত ধারাভাষ্য। বস্তুত, আব-এ-হায়াত’ই হল উর্দু কাব্যের প্রথম কালানুক্রমিক ইতিহাস।
লখনউতে একবার অভিজাত শ্রেণির কয়েকজন মিরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। পারস্পরিক অভিবাদন আদানপ্রদানের পরে তাঁরা মিরকে শের শোনানোর জন্য অনুরোধ করলেন। মির চাইছিলেন সে অনুরোধ এড়িয়ে যেতে। কিন্তু অতিথি মহোদয়রা জোরাজুরি শুরু করলে মির বললেন, ‘আপনারা আমার কবিতা বুঝবেন না।’ অভ্যাগতদের একজনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘কিন্তু আমরা তো ফারসি ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি আনওয়ারি আর খাক্কানির কাব্য বুঝি।’ এবারে কিন্তু মির সেই অর্বাচীনদের সমুচিত জবাব দিতে দ্বিধা করলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি জানি সে আপনারা অবশ্যই বোঝেন। কিন্তু আমার কাব্য বুঝতে হলে আপনাদের তো সেই ভাষা শিখতে হবে যা দিল্লির জামা মসজিদের সিঁড়িতে শোনা যায়। সে ভাষা তো আপনারা জানেন না।’
আত্মসম্মান প্রখর হওয়ায় জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কবিকে পেতে হয়েছে যন্ত্রণা।
এক দিল কো হাজ়ার দাগ লাগা
আনদ্রুনি মেঁ জ্যায়সে বাগ লাগা
[একটি হৃদয়ে লাগল সহস্র কলঙ্ক; আমার অন্দরের বাগানে প্রস্ফুটিত হল ফুল।]
শেষ পর্যন্ত এক সময় লখনউয়ের নবাবের ভাতাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মির দিল্লি ছেড়ে আসার সিদ্ধান্তের জন্য অনুতাপ করতে লাগলেন।
খারাবা দিল্লি কা ওহ্ চাঁদ বেহতর লখনউ সে থা
ওহিঁ ম্যাঁয় কাশ মর যাতা, সরাসিমা না আতা ইয়াঁ
[জনশূন্য দিল্লিও লখনউয়ের চেয়ে ছিল ভালো; যদি বিভ্রান্ত হয়ে এখানে না আসতাম, তাহলে সেখানেই মরতে পারতাম।]
মুহম্মদ হুসেন আজ়াদ আব-এ-হায়াতএ লিখছেন গরুর গাড়ি চড়ে কবি দিল্লি থেকে লখনউ পৌঁছোন। নিজের জন্য আলাদা একটা গাড়ি ভাড়া করার পয়সা না থাকায় এক সহযাত্রীকে সঙ্গে নিতে হল। কিন্তু পারস্পরিক অভিবাদন বিনিময়ের পরেই মির অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন। নাছোড়বান্দা সঙ্গী গল্পগুজব শুরু করতে চান। কবি এক সময় বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, 'সাহেব, আপনি গাড়ি ভাড়া দিয়েছেন। তা বলে আমার সঙ্গে কথা বলার খরচ তো ওর মধ্যে ধরা নেই।’ সহযাত্রীর বক্তব্য: ‘কিন্তু কথোপকথনের মধ্যে দোষের কী আছে? ভ্রমণের একঘেয়েমি তো কিছুটা কাটে।’ এবারে আরও বিরক্ত কবির উত্তর, ‘এতে আপনার আনন্দ হতে পারে; কিন্তু আমার প্রকাশভঙ্গির ওপর আপনার সঙ্গে এই গল্পগুজবের ক্ষতিকর প্রভাব যে পড়বে?’
লখনউ শহরপ্রান্তে পৌঁছে মির হয়ত কোনও সরাইখানায় আশ্রয় নিয়ে থাকবেন। শহরে কোনও মুশায়রার আয়োজন করা হচ্ছে এমন খবর তাঁর কানে এল। তিনি একটা গজ়ল লিখে মঞ্চে অন্যান্য কবিদের সঙ্গী হলেন। কিন্তু তাঁর অদ্ভুত আনুষ্ঠানিক পোশাক-আশাক-তরবারি আর ছুঁচোলো জুতোজোড়া দেখে চারপাশে উঠল গুঞ্জন। ভ্রমণের ক্লান্তি, অতি প্রিয় শহর দিল্লি পরিত্যাগের হতাশায় জর্জরিত কবি এক কোণে চুপ করে বসে রইলেন। আসরে যখন তাঁর বলার সুযোগ এল, তিনি কোথা থেকে আসছেন এমন প্রশ্নও শুনতে হল, তখন মির কবিতায় মেলে ধরলেন তাঁর উত্তর:
কেয়া বুদ-ও-বাশ পুছতে হো পূরব কি সাকিনো?
হাম কো গরীব সমঝ কে হাঁস হাঁস পুকার কে
দিল্লি এক শেহর থা, আলম মে ইন্তিখাব
রহতে থে মুন্তখব হি জাহাঁ রোজ়গার কে
উস্ কো ফলক নে লুট কর ভিঁরাঁ কর দিয়া
হাম রহনেবালে হ্যাঁয় উসি উজরে দেয়ার কে
[পূর্বের মানুষ তোমরা আমার পরিচয় কি জিগ্যেস করছ? আমাকে বেচারা বিদেশী ভাবছ, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছ। দিল্লি এক শহর ছিল, পৃথিবীতে অনন্য। মুষ্টিমেয় নির্বাচিত নাগরিকই সেখানে থাকার সুযোগ পেতেন। নিয়তি সে শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে আজ। আমি সেই ছারখার হয়ে যাওয়া শহরের বাসিন্দা।]
লোকে যখন জানল যে এই নতুন আগন্তুকই দিল্লির প্রখ্যাত শায়ের মির তকি মির, তখন অবশ্যই তারা ক্ষমা চেয়েছিল। অচিরেই শহরে মিরের আগমন বার্তা ছড়িয়ে গেল। লখনউয়ের তদানীন্তন নবাব আসফউদ্দৌলা কবিকে স্বাগত জানিয়ে তাঁর ভরণপোষণের জন্য মাসিক দুশো টাকার ভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। তবু, খোদ নবাব অভ্যর্থনা জানালেও মিরের মন পড়ে থাকত দিল্লিতে:
কুচে নহিঁ দিল্লি কে, আউরাক-এ-মুসাভ্ভির হ্যাঁয়
জো শকল নজ়র আই, তসভির নজ়র আই
[এ দিল্লির গলি নয়, এ যেন শিল্পীর ক্যানভাস, যেদিকেই তাকাই, যাই দেখি, সবই শিল্পীর আঁকা ছবি]
কিন্তু মিরের সঙ্গে নবাবের এই প্রারম্ভিক সুসম্পর্ক খুব বেশিদিন স্থায়ী হল না। অন্য কবিদের মত রৌপ্য আর স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে তিনি নিজের সম্মান বিকিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না।
কবি হিসেবে মিরের আত্মসম্মানবোধ, নিজের কবি প্রতিভা সম্পর্কে তাঁর ধারণা কেমন ছিল তা বোঝা যাবে পূর্বোক্ত আব-এ-হায়াতএ বর্ণিত এই কাহিনীটি থেকে। কেউ তাঁকে জিগ্যেস করেছিল, ‘হজ়রত, বর্তমানে আসল কবি কারা?’ মিরের উত্তর হল, ‘কেন সৌদা আর আমি?’ তারপরে একটু থেমে বললেন, ‘খাজা মির দর্দ-কেও আধা-কবি ধরতে পারেন। তাহলে, মোট হল আড়াই জন।’
‘জনাব, আপনি মির সোজ্ এর নাম বললেন না?’ কেউ শুধিয়েছিল।
মির বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘উনি কি কবি?’
‘কিন্তু আপনি হয়ত জানেন যে মির সোজ্ নবাবের রাজদরবারের কবি।’
মির এক মুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দিলেন, ‘যদি তাই হয়, তা হলে তাঁকে চার ভাগের এক ভাগ কবি ধরতে পারেন। তা হলে সব মিলিয়ে হল দুজন আর চার ভাগের তিন ভাগ।’
এহেন মানুষের সঙ্গে নবাবদের যে বিশেষ বনিবনা হবে না তা তো বলাই বাহুল্য। আসফউদ্দৌলার মৃত্যুর পর সাদাত আলি খান যতদিনে নবাব হলেন, ততদিনে মির রাজসভায় যাওয়া ছেড়েই দিয়েছেন। কবি একদিন তহ্সিন মসজিদের সিঁড়িতে বসে জিরোচ্ছেন। এমন সময় লোকলস্কর-সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে নবাব রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন। নবাবকে দেখে সকলে উঠে দাঁড়ালেও মির বসেই রইলেন। নবাবের সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন কবি ইন্শা। নবাবের প্রশ্ন হল, ‘এই লোকটি কে যে আমাকে দেখেও সম্মান জানাল না?’ ইন্শা কবির নামোল্লেখ করে বললেন যে মির তকি মির এখন অত্যন্ত দারিদ্রে দিন কাটাচ্ছেন। নবাব ফিরে গিয়ে বার্তাবাহকের মাধ্যমে মিরের কাছে এক হাজার টাকা শাহী উপহার হিসেবে পাঠালেন। টাকা দেখে মির বেজায় খেপে উঠে সেই হরকরাকে বললেন, ‘আপনি ওই টাকা কোনও মসজিদে দিয়ে দিতে পারেন।’ পরে নবাবের নির্দেশে ইন্শা মিরের সঙ্গে দেখা করলেন। আজ়িম শায়েরকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে নবাবের উপহার প্রত্যাখ্যান করা উচিত হবে না। কিন্তু মির তকি মির তাঁর জায়গায় অনড়। তাঁর বক্তব্যটি মনে রাখার মত: ‘উনি তো দেশের রাজা। কিন্তু আমিও তো অন্য এক জগতের বাদশাহ। তা হলে বিধান কি এই যে এক রাজা অন্য রাজাকে বার্তাবাহকের মাধ্যমে অর্থ পাঠাবেন?’ মনে হয় সে সময় কবি আপন মনে বলে উঠেছিলেন,
রস্ম উঠ গয়ি দুনিয়া সে ইক্ বার মুরব্বত কি
কেয়া লোগ জ়মিন পর হ্যায়, ক্যায়সা ইয়ে সামান আয়া?
[পৃথিবী থেকে শিষ্টাচার অপসৃত হলে কেমন মানুষ সেখানে বাস করে? কী দৃশ্য সেখানে দেখা যায়?]
কেয়া জ়়মানা থা ওহ্ যো গুজ়রা মির
হামদিগর লোগ চাহ্ করতে থে
[কী এক যুগ সে ছিল যা অন্তর্হিত হল, মির; মানুষ একে অপরকে কী ভালোই না বাসত!]
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইন্শা কবিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজদরবারে যেতে রাজি করিয়েছিলেন। মির নবাবের প্রিয়তম কবিও হয়ে উঠেছিলেন।
মির তকি মিরের মৃত্যু হয় ১৮১০ শতাব্দে। তাৎপর্যপূর্ণ হল এই যে তাঁর মৃত্যুর পরের বছর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে কবির কুল্লিয়াত-এ-মির (মিরের রচনাসমগ্র) প্রকাশিত হয়। কিন্তু কবি সে প্রকাশনা দেখে যেতে পারেননি। মুদ্রণযন্ত্রে ছাপা সেই সুবিশাল গ্রন্থটি ছাপার হরফে কোনও উর্দু কবির প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। সে রচনাসমগ্রের মধ্যে আছে উর্দু গজ়লের ছটি আর ফারসি গজ়লের একটি দিওয়ান থেকে সংগৃহীত কবিতাগুচ্ছ। তা ছাড়া কবি রচিত মসনভি (আখ্যানধর্মী কবিতা), মুসদ্দস্ (ষটপর্ব চরণবিশিষ্ট কবিতা), কাসিদা (প্রশস্তিগাথা/স্তুতিগান), ওয়াসোখ্ত (প্রেমিকার আচরণে রুষ্ট প্রেমিকের প্রেমের জগৎ পরিত্যাগ সম্পর্কিত কাব্য) ইত্যাদি।
আশ্চর্য নয় যে আজকের লখনউতে মিরের বাসস্থান অথবা তাঁর কবরস্থানের কোনও চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি নিজেই তো ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করে গেছেন যে যারা জীবিত অবস্থায় তাঁকে বোঝেনি, তাদের কোনও অধিকারই নেই মৃত্যুর পরে তাঁর গোরস্থানে সম্মান প্রদর্শনে যাওয়ার:
বাদ মরনে কি মেরি কবর পে আয়া ওহ্ মির
ইয়াদ আয়ি মেরে ঈসা কো দাওয়া মেরে বাদ
[হায় মির, সে আমার কবর দেখতে এল মৃত্যুর পর; আমি চলে গেলে পর ত্রাণকর্তার স্মরণে এল আমার রোগের উপশম।]
আর তাঁর গুণগ্রাহী পাঠকদের জন্য মির তকি মির রেখে গেছেন এই বার্তা:
বাতেঁ হামারি ইয়াদ রহেঁ, ফির বাতেঁ অ্যায়সি না সুনিয়েগা
পড়তে কিসি কো সুনিয়েগা, তো দের তলক্ সর ধুনিয়ে গা
[আমার কাব্য মনে রাখবেন, কারণ এমন কথা আর কেউ বলবে না; যদি কাউকে পড়তে শোনেন, তা হলে বহুক্ষণ শুধু মাথা কুটবেন।]
পরিশেষে আবারও ফিরে আসি উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি মির্জা গালিবে। আজকের বড়-বড় মানুষদের মধ্যে পরস্পর কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ি, এই পরনিন্দা-পরচর্চার যুগে গালিব কী বলছেন শুনলে বেশ অদ্ভুতই লাগে। গালিবের অকপট স্বীকারোক্তি:
রেখতা কে তুম হি উস্তাদ নহিঁ হো গালিব
কহতে হ্যাঁয় আগলে জ়মানে মেঁ কোই মির ভি থা
[উর্দুর তুমিই একা ওস্তাদ নও, গালিব; লোকে বলে সে যুগে মির বলেও কেউ ছিলেন।]
তথ্যসূত্র:
১) জ়িকর-এ-মিরএর উর্দু সংস্করণ (মির তকি মিরের আত্মকাহিনী)
২) মোহাম্মদ হুসেন আজ়াদ রচিত আব-এ-হায়াত (শতাধিক উর্দু কবির জীবন ও রচনা সম্বলিত প্রত্যক্ষ গবেষণালব্ধ গ্রন্থ)
৩) মৌলবি আব্দুল হক (বাবা-এ-উর্দু) সংকলিত ইনতিখাব-এ-কালাম-এ-মির (মিরের নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ)