• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • প্রশ্ন করাই কবির ধর্ম : রাজদীপ রায়

    ‘শুধু তা-ই পবিত্র, যা ব্যক্তিগত’। — বুদ্ধদেব বসুর লেখা এই পঙ্‌ক্তি কেবলমাত্র কোনো কবিতার সূত্রপাত নয়; বাংলা কবিতার অন্তঃকরণ যে আধুনিকতাকে আঁকড়ে ধরে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে চাইছিল, এই পঙ্‌ক্তি সেই ভাবনার অভিব্যক্তি, সেই ভাবনার রাজনৈতিক অবস্থান। অথচ যে রবীন্দ্রনাথের জগতকে তারা নির্বাসিত করতে চাইছিলেন, এবং কবিতা-পড়া কতিপয় মানুষের মনে অন্যতর কোনো জগতের আত্মীয়তা প্রোথিত করতে চাইছিলেন, ব্যক্তিগত অনুভূতি, তনুভূতিকে আশ্রয় করে লেখবার বিষয়ে কিন্তু রবীন্দ্র-কবিতার সঙ্গে সেই মনোভঙ্গির কোনো সংঘাত ছিল না। তবুও আত্মভূমি খুঁজে পাওয়ার তাগিদে এই ভিন্নতা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায়ও খুঁজে পাননি তারা, অর্থাৎ রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের ‘আধুনিক কবিতা’-র সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা পশ্চিম-সাহিত্য-দীক্ষিত কবিব্যক্তিত্বরা। তাদের কাছে তখন একজন হপকিন্স, একজন রিলকে, একজন ইয়েটস, একজন এলিয়ট, এই আধুনিকতার দিগ্‌দর্শন নির্মাণের উত্সবীজ; রবীন্দ্র-কাব্যবলয় থেকে বেরিয়ে আসবার মরিয়া উত্সবীজ। বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ারের অনুবাদ এবং সেই বইয়ের লেখা ভূমিকা এই ব্যক্তিগত রুচির অভিযাত্রাকে আরও বেশি প্রার্থিত করে তুলল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পেরিয়ে আসা অসহায়, দিশেহারা, স্বস্তিহীন, বিষাদক্লিষ্ট একটি প্রজন্মের লেখক কবিদের কাছে। কিন্তু সব সত্যেরই একটা বিরুদ্ধ ভার্সন থাকে, যেখানে কোনো নীতি কিংবা আদর্শ নির্মাণের পাশাপাশি অন্য একটি সংহত বয়ান তৈরি হতে চায়, এবং সেই নির্মাণে খুব বেশি সময় লাগে না। ব্যক্তিগত পবিত্রতার নার্সিসিজম যখন দ্রুতগতিতে বাংলা কবিতাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল, তার সঙ্গেই চোরাস্রোতে প্রশস্ত হচ্ছিল কবিতা থেকে মিছিলে যাবার পথ। মিছিলে না-হোক, অন্তত সমাজ-পরিসরের বাস্তবতায় নিজেকে নিষিক্ত করে নেওয়ার মধ্যেও অনিবার্যতা আছে। যিনি এই আধুনিকতার অন্যতম প্রণেতা, সেই জীবনানন্দ দাশ কী লিখেছিলেন তাঁর ‘আধুনিক কবিতা’ প্রবন্ধে?

    “আজকের যুগের বিশেষ কতকগুলো লক্ষণ এ কালের কবিতায় থাকে; দেশকাল সন্ততি (আজ পর্যন্ত মানুষের ধারণায় তাদের যেরূপ আমরা পাই সেই রূপ) যে কোনো যুগের প্রাণবন্ত বলে পরিগণিত হবার সুযোগ যে-কাব্যে লাভ করেছে সে-কবিতা আধুনিক।”
    তার মানে আধুনিকতার সঙ্গে সমাজ-লগ্নতার কোনো বিরোধ জীবনানন্দ দেখেননি। কবিতা লেখবার সঙ্গে, কবিতাকে নিয়ে বাঁচবার জন্যে ‘দেশকাল সন্ততি’-কে বুঝে ফেলা তার কাছে জরুরি ছিল। এই ‘দেশকাল সন্ততি’ বলতে জীবনানন্দ কী বোঝাতে চাইলেন? আজ পর্যন্ত মানুষের ধারণায় দেশকালের যে সম্মীলিত চেতনাবদ্ধ রূপ দেখা যায়--সেই রূপ। এবং যুগের এই রূপ পরিগণিত না-হলে কোনো কবিতাই আধুনিক হতে পারে না। কিন্তু যুগের এই সংস্থাপনের সঙ্গে তো ব্যক্তিমানুষের পারিপার্শ্বিকতা সন্নিহিত থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিবাদের অতিব্যাপ্তি সেই সংযোগকে গৌণ প্রতিপন্ন করতে চায়। যে উপাদান-নির্ভরতা ছাড়া শিল্পসৃষ্টি হতে পারে না, যে উপাদানের জন্যে শিল্পী কাঙাল, তাকে উপেক্ষা করে কোন সৃষ্টি সম্ভব? সমাজ কি ওই উপাদানের অন্তর্গত নয়? সমাজের অন্তর্গত সেই রূপকে অবশ্যই সময়ের এবং সমূহের চিন্তাস্রোতকে বহন করতে হবে। এমন নয় এই বৃত্তের বাইরে কোনো সংহত ধ্যানে নিহিত লেখাকে আমরা কবিতা বলে স্বীকার করব না। শিল্পে কোনো ফতোয়া চলতে পারে না। কিন্তু সেই সংহত ধ্যানের অন্তর্জগতের বাইরে সমাজের যে ‘প্রাণবন্ত’ উপস্থিতি, সেও এক সমান্তরাল বাস্তবতা নিয়েই সদাজাগ্রত থাকে।

    সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন:

    “...কবির কর্তব্য তার প্রতি দিনের বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতায় একটা পরম উপলব্ধির মাল্যরচনা। কবির উদ্দেশ্য তার চার পাশের অবচ্ছিন্ন জীবনের সঙ্গে প্রবহমান জীবনের সমীকরণ। কবির ব্রত তার স্বকীয় চৈতন্যের রসায়নে শুদ্ধ চৈতন্যের উদভাবন। বৈরাগ্যের দ্বারা, ত্যাগের সাহায্যে, আভিজাতিক মর্যাদাবোধের নির্দেশে এ-সাধনায় সিদ্ধি পাওয়া যায় না—কাব্যের মুক্তি পরিগ্রহণে; এবং কবি যদি মহাকালের প্রসাদ চায়, তবে শুচিবায়ু তার অবশ্য বর্জনীয়, তবে ভুক্তাবশিষ্টের সন্ধানে ভিক্ষাপাত্র হাতে নগরপরিক্রমা ভিন্ন তার গত্যন্তর নেই। কারণ কাব্যের পথে উল্লঙ্ঘন চলে না: সেখানকার প্রত্যেকটি খাত পদব্রজে তরণীয়, প্রতিটি ধূলিকণা শিরোধার্য, প্রত্যেক কন্টক রক্তপিপাসু; সেখানে পলায়নের উপায় নেই, বিরতির পরিণাম মৃত্যু, বিমুখমাত্রেই অনুগামীর চরণাহত।...”
    এই ‘বিশৃঙ্খল অভিজ্ঞতা’ তাকে কে দেবে? সমাজ ও পরিপার্শ্বই তো। স্বকীয় চৈতন্য এখানে বৈরাগ্য বা সমাজ-নিরপেক্ষ কোনো সাধনায় নির্মিত হবে না; কেননা কাব্যের পথে ‘উল্লঙ্ঘন’ চলে না। তাই কবিকে ভিক্ষাপাত্র হাতে নগর পরিক্রমণ করতে হয়। যেতেই হয় সমাজ ও জীবনের সংলগ্নতায়। জীবন-বিচ্ছিন্ন শিল্প বলে কিছুই হতে পারে না। এমনকি, যে মহাকালের প্রসাদ পাওয়ার জন্যে এত হইচই, এত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, এত মরণ-বাঁচন; সেখানেও তো সমাজ নামের আধারটি তার পরিবর্তন ক্রিয়াসহ অনিবার্যভাবে উপস্থিত। শুধুই কি মানুষের অন্তর্গত স্মৃতির বৈচিত্র্য জাগানোই কবিতার কাজ? কবি--সমাজের মূল-স্রোত বিচ্ছিন্ন এক অলীক মানুষ, যার এই প্রত্যক্ষ বাস্তব জীবনবোধের বাইরে বোধের অতিব্যক্তিগত দুনিয়া আছে—এই স্টিরিওটাইপ ধারণা যে ভ্রান্তি ও অবমূল্যায়ন ছাড়া কিছুই না, এ-কথা তো উপনিবেশ-আক্রান্ত ব্যক্তির বিষাদমহিমাকে চিরপ্রতিষ্ঠিত করা ‘কল্লোল’-‘কবিতা’-‘কালিকলম’-‘প্রগতি’-র কবিরা সহজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলা কবিতার প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি করে। সুধীন্দ্রনাথ তো স্পষ্টতই বলেছিলেন: ‘...ব্যক্তি যখন বিশ্ব-মানবের মধ্যে নিঃশেষে ডুবে যায়, তখনই পিঞ্জরিত ব্যক্তিরূপ পায় মুক্তি’। এই ‘পিঞ্জরিত ব্যক্তিরূপ’-এর মধ্যে দিয়ে কি ব্যক্তিবোধের চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতার কথাই বলতে চাইলেন তিনি? যার আবর্তে ব্যক্তিগত বিষাদের উপভোগ্যতা সামাজিক চেতনার পরিধিকে কোনভাবেই আত্মস্থ করতে পারে না। কেন ‘ধুসর পাণ্ডুলিপি’ লেখার পর জীবনানন্দকে ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ লিখতে হয়, কিংবা সুধীন্দ্রনাথকে ‘অর্কেস্ট্রা’-র পর লিখতে হয় ‘সংবর্ত’, এবং এই বিষয়টাই লক্ষ করবার-- কম বয়সের আত্মপ্রসার, ব্যক্তিবাদ, পরিণত বয়সে এসে তরী ভেড়ায় বৃহত্তর সমষ্টিচেতনার শরিক হতে না-হতে পারার অনুশোচনায় এবং তৃপ্তিহীন একঘেয়েমির রূপান্তরে ক্লান্ত কোনো কাব্যভুবনকে চরিতার্থ করতে। এও শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রশ্ন, এও শিল্পী হিসেবে অপ্রাপণীয় পূর্ণতার দিকেই যাত্রা। বুদ্ধদেব বসুও ১৯৭১-এ এসে তার ‘কবিতার শত্রু ও মিত্র: একটি খোলা চিঠি’ প্রবন্ধের একটি বিশেষ অংশে স্বীকার করেছিলেন:
    “...'শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটাও অর্থহীন, কেননা মানুষ ছাড়া কে-ই বা আছে তার স্রষ্টা বা ভোক্তা—স্পষ্টত মানুষের জন্যই শিল্পকলা। স্পষ্টত মানুষের পক্ষে তা প্রয়োজন, যেমন প্রয়োজন ধর্ম ও সমাজনীতি ও বিজ্ঞান তেমনি—কিন্তু ভিন্নভাবে, ভিন্ন কারণে। নীতিশিক্ষা নয়, জ্ঞানলাভ নয়, সাংসারিক শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিশ্চয়ই নয়, মানুষের আত্মার পক্ষে, দেহ প্রাণ ও মনের সমন্বয়ে রচিত তার সামগ্রিক সত্তার পক্ষে—রহস্যময় অবিচ্ছেদী এক প্রয়োজন।”
    মানুষের জন্য শিল্প যে এক-অর্থে প্রয়োজনীয়—সে-কথাই মনে হয়েছিল বুদ্ধদেবের। কিন্তু কোন অর্থে প্রয়োজনীয়? ধর্ম, বিজ্ঞান বা সমাজনীতি যে-অর্থে মানবের উপকার করে, সে-অর্থে নয়। সাংসারিকতা, দেশভাবনা, অর্থনীতি—এসবের মধ্যে আছে মানবকে প্রত্যক্ষভাবে চালনা করবার ন্যায়দর্শী মূল্যবোধ। কবিতা তো ন্যায়াদর্শ মেনে লেখা হতে পারে না! যদি কোনো দেশের শাসনক্ষমতা তার প্রয়োজনে শিল্পকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সে-হবে শিল্পের হত্যা, কবিতার হত্যা। দুঃখের বিষয় এটাই, শাসক কখনো সুশিক্ষিতের মতো নিরবচ্ছিন্ন আচরণ করতেই পারে না। তার উদ্দেশ্যই শিল্পের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। এ-কারণেই পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা নিলেও কখনো শিল্পের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে পারে না কোনো ক্ষমতাশক্তি। আর কোনোদিন পারবেও না। বরং তাকে বশংবদ করে রাখবে নিজের ইচ্ছে ও সুবিধেমতো। নীতিশিক্ষা বা জ্ঞানশিক্ষার যে সর্বসমন্বয়ী পথ, সে-পথে মানুষকে এক ছাদের তলায় এনে বৃহত্তর সমাজ-প্রকল্পে বেঁধে রাখা হয়। অন্যদিকে শিল্পের প্রকাশের প্রথম শর্তই স্বাধীনতা। সে যেমন শুভের, তেমনি একইভাবে অশুভেরও। কবিতা পড়ে সমাজের কী উপকার হচ্ছে? এই আকাট-নির্বোধ প্রশ্ন সেইসমস্ত নীতিবাগীশরা তুলে ধরে কবিকে নির্বাসিত করতে চাইবেন নিশ্চয়ই। শাসক চাইবে হঠাৎ উজিয়ে ওঠা এই উপদ্রবকে কমাতে। না-হলে তো কবিতা কখনোই বৃহত্তর মানুষের চেতনার ভাষা নয়। কবির অহং ভাবতেই পারে, এই কবিতা লিখে বিরাট কিছু কাণ্ড হয়ে গেল, কিন্তু বিষয়টা তা নয় একেবারেই। ক’জন মানুষ ভাল-মন্দের সমান দ্বন্দ্বে জীবনকে স্বীকৃতি দিতে পারেন? পারেন না বলেই শিল্পের অনুভুতি-স্তরে তাদের পৌঁছনো হয় না। তাদের সামাজিক দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ককে বৌদিবাজির রসালো ধর্তব্যে নামিয়ে আনতে পারে মাত্র। সামাজিক সুস্থিরতার যে মায়াবী, সৃজনহীন বিশ্বের ঘেরাটোপ নির্মিত হয়েছে, সেই নিশ্চয়তাক্ষেত্রকে বিরক্ত করলেই তখন শিল্পের প্রত্যয়ে আঘাত পড়ে, তার হাত-পা বাঁধবার বন্দোবস্ত হয়।

    তবুও কি এর মধ্যে দিয়েই উঠে আসে না কোনো অন্যতর চিন্তাস্বর? কবিতা পড়বার ও লেখবার অন্য কোনো চেতনা, যার বীজ কিন্তু ব্যক্তিগত পবিত্রতা রক্ষাকারী সুজাত আত্মার মধ্যেই সংগুপ্ত ছিল, এবং যাকে তারা মনে-মনে সমর্থন করতেন। শিল্পী তো জানেন, এই ভিড়ের হৃদয় তাকে মেনে নেবে না কখনো। যাদের নিয়ে ভেবে, লিখে কবি দিনগত পাপক্ষয় করছেন, তাদের অধিকাংশের এতে কিছুই যায় আসে না। শিল্পীর পূর্ণতা তাহলে কিসে? যখন শিল্পী এসবের তোয়াক্কা না-করে, সমাজের কাছে কোনরূপ প্রত্যাশা না রেখে নীরবে তার ব্যক্তিসত্তার স্বরূপে এই সামাজিক সত্তার সঙ্গে প্রত্যাশাহীন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, তখনই শিল্পীর অবস্থান এই ধরিত্রীতে সুনিশ্চিত হয়। কীভাবে হতে পারে এই প্রত্যাশাহীন সংস্থাপন? ‘শিল্পীর দায়িত্ব’ নামের একটি গদ্যে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন:

    “আমার আনন্দ এক্ষেত্রে আরও বেশি যে, আমি বাংলাদেশের একজন কবি এবং উত্তর-বাংলার দুর্গত মানুষদের কথা মনে রেখে ভিক্ষার খুদকুরো জোটাতে পরপর তিনদিন কলকাতার রাস্তায় ঘুরেছি। উত্তর-বাংলার সর্বহারা মানুষগুলোর ক্ষুধা ও শীত এতে কার কতটা কমবে তা অবশ্যই আমার জানা নেই, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য পালন করেছি।

    কিন্তু সত্যি তাই করেছি কি? এই প্রশ্নের মুখোমুখি অনেকদিন আমাকে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, আজও উত্তর মেলেনি। আমি ভিয়েতনামি মার্কিনী বর্বরতার বিরুদ্ধে কলকাতার রাস্তায় গলা ফাটিয়ে চেচিয়েছি, প্রফুল্ল ঘোষের বর্বর রাজত্বে রাস্তার আইন ভেঙে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে জেলে গিয়েছি।”

    সমাজের সঙ্গে সংলগ্ন থাকবার যে-গুরুত্ব বুঝেছিলেন জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথেরা, সেই সংলগ্নতা কিন্তু ব্যক্তিকই। ব্যক্তিকেই আরও পুষ্ট জল-হাওয়ায় শিল্পী হিসেবে বৃহৎ করে তোলবার অনুশীলনের তাগিদেই বার বার নিজেকে সমাজচেতনার কালেকটিভ আনকনসাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবার তাড়না ওঠে। কিন্তু যদি কখনো শিল্পীর সেই ব্যক্তিস্বার্থকে কেউ পুরোপুরি অস্বীকার করে রাস্তায় নেমে পড়তে পারেন? কারোর যদি মনে হয়, শিল্পীর জীবন মানে কোনো সুস্থিত-সুন্দরের উপাসনা মাত্র নয়। শিল্পী কখনোই আর্টের দোহাই দিয়ে সমাজ-বিযুক্ত কোনো মানবিক চেতনায় বুঁদ হয়ে থাকতে পারেন না। এই জগৎ ও জীবনের যা-কিছু ঘটমান, যা-কিছু অস্তিত্বকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে প্রশ্নাতুর করে তোলে, তার উত্তর খুঁজতে হয় রাস্তায় নেমেই, তাহলে? তখন ব্যক্তিবাদ নন্দিত কালজয়ী সমস্ত কবিতার পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবনার পরিসর তৈরি হয়। কালের চিহ্ন বহন করলেই যে ক্ষণিকের উদ্‌গীরণে সেই বয়ান হারিয়ে যাবে, এমনটা নাও হতে পারে। তাত্‍ক্ষণিক প্রতিক্রিয়াজাত লেখা শাশ্বত হতে পারে না—এমন ধারণা আছে। অবশ্যই কোনো ঘটনা, মুহূর্ত, আর পাঁচজনের সঙ্গে লেখককেও তাড়িত করে একজন সামাজিক জীব হিসেবেই। প্রায়শই নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবা মানুষটি কিন্তু তখন আর ততটা নিঃসঙ্গ বোধ করেন না। বরং সমষ্টিচেতনার একজন অংশীদার হিসেবেই তখন তার ব্যক্তিক অনুভূতি আছড়ে পড়ে। তাত্‍ক্ষণিক রাগ-হতাশা-বিস্ফার তাকে খুব নির্লিপ্তভাবে মগ্ন হতে দেয় না শিল্পিত সংহতি নিয়ে। সে লেখা পড়ে মনে হতেই পারে এ-লেখা তার উত্তীর্ণ, কালজয়ী লেখার পাশে স্থান পাবার যোগ্য নয়। কিন্তু উত্তীর্ণতা থাকে তার মধ্যেও; সময়ের কাছে, সমবায়িক মগ্নচৈতন্যের কাছে। কবিতা তখন শুধুমাত্রই ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের সাথী নয়, বিষাদের অতিবিজ্ঞাপন নয়। এমনও হতে পারে ব্যক্তিবাদী কবিও অন্তরে সমগ্রের সঙ্গে মিশে যাবার দায় অনুভব করেছেন হঠাত্‍ই কোনো অস্থায়ী মনোবিকলনে। এই প্রভাব অচিরেই কেটে গিয়ে তিনি আবার স্বস্থানে ফিরবেন। কিংবা ফিরবেন না। এই সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বগ্রাসী যুগে আবার জনতার দাবি ওঠে—এই ঘটনায় তিনি যদি লিখতে পারেন, তাহলে ওই ঘটনায় লিখবেন না কেন? তাত্‍ক্ষণিকতার তোড়ে আবার কবি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এ-কথাও যেমন সত্য, আঘাত করলেও প্রতিটি তাত্‍ক্ষণিক কোনো ঘটনায় তাকে লিখতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাও থাকতে পারে। তেমনি এটাও ঠিক, শিল্পী যদি সুবিধেকামী জীব হন, তাকেও কিন্তু বুঝে, অতি সাবধানে পা-ফেলতে হয়। কী নিয়ে লিখবেন আর কোনটা সযত্নে এড়িয়ে যাবেন—সে বিষয়টাও তাকে দেখতে হয় বৈকি! কবিতা লেখাও যে সময়ে-সময়ে কেরিয়ার হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে স্নেহধন্য থাকবার সুচিন্তিত পদক্ষেপ। লেখালিখিও, যদি কোনো ক্ষমতাবৃত্তে থেকে নিয়ন্ত্রণ করবার অধিকার অর্জন করতে হয়, তখন কবি নয়, দিকে দিকে কবিতা-মাফিয়ার জন্ম হয়। তখন কোনো-কোনো গা-বাঁচানো প্রতিবাদ আদতে কুমিরের কান্না। মূর্খ পাঠক মাথায় করে রাখে, দীক্ষিতজন ছুঁড়ে ফেলে দেয়। যদিও এই মূর্খ এবং দীক্ষিতজনের ফারাকটাও খুব ধোঁয়াশাপূর্ণ একটি ব্যাপার। অশিক্ষিতের সাম্রাজ্যে আরও অশিক্ষিতরাই সুযোগ পায় নিজের অর্জিত বিদ্যেবুদ্ধিকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে। দয়া-প্রেম-করুণা এসব চড়া দামেই বিক্রি হয়। তখন রাস্তায় নামলে চলে না, প্রশ্ন করলে চলে না। আর দীক্ষিতজন এসব থেকে বহুদূরে সাধনায় মগ্ন। তিনি মতামত জানাবার পরিসর চান, কিন্তু তিনি একা, চূড়ান্তভাবে একা। খুব সহজেই তাকে পাগল চিহ্নিত করে বিস্মৃতির কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।


    বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে অবশ্য আজকের এই ঘূর্ণিপাক দেখে যেতে হয়নি। অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে যাওয়া বোধ থেকেই তিনি বার বার ছুটে যান উত্তর বাংলায়। সমর্থন করেন মুক্তিযুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশকে। তেভাগায় তিনি তাড়িত হন সশরীরে, উপনিবেশ-লাঞ্ছিত সমাজের ফুটপাথে হাঁটতে-হাঁটতে তিনি উপলব্ধি করেন জননী যন্ত্রণা। ফলে রক্ত-মাংসসহ তার ভাবনাবীজ শুধু ব্যক্তির প্রেম, সম্পর্ক, বিষাদের কথা বলে না; সেই চিন্তার পরিধি খুব সুনিশ্চিতভাবেই সমাজের সঙ্গে নিজের সংলগ্নতা বোধ করে। মুশকিল এটাই, সাহিত্যে শুধু লেখকের তো সবটুকু নয়, পাঠকের interpretation আছে। যে রাজনৈতিক, সামাজিক সংরূপ থেকে একজন কবির ব্যক্তি-অভিরুচি সৃষ্টি হয়, সেই একই কর্মকাণ্ড চলতে থাকে পাঠকের জীবন ঘিরেও। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতোই আরও যারা তেভাগায় সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন, তারা তো সবাই কবিতা লেখেন না। তারাও সেই কবিতা পড়বেন, আবার সেই সময় থেকে বহুদূরে--ইতিহাসের পাতায় তেভাগাকে পড়া কোনও শিক্ষার্থী--যে কী-না কবিতাপাঠক--তার কাছেও এই প্রতিবেশ অপরিচিত হলেও দূর থেকে এই উত্তাপ তারা পাবেন ওই কবিতা পড়ে। যদি না পেতেন, শিল্পের কোনও ভবিষ্যৎ থাকত না। কোনো শিল্পই তার জীবৎকালকে দীর্ঘায়িত করতে পারত না--হয়ে উঠতে পারত না অনন্তের অংশ--যার কাছ থেকে অদেখা কোনো সময়--অশ্রুত কোনো চেতনা--অভাবিত কোনো দর্শন পর্যন্ত সমৃদ্ধ হবে; যারা সেই রচনা পাঠ করে তাকে সমসাময়িকতার উর্দ্ধে সাম্প্রতিক রূপে আবিষ্কার করবেন। ব্যক্তিচেতনাই হোক বা সমষ্টিচেতনা, একটি রচনাকে ভাবনার আভিজাত্যে যদি সময়ের গণ্ডি থেকে ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়, পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে সংগ্রামে সেই রচনাবৃত্ত নিজেকে অভিষিক্ত করতে থাকে। এমনকী, লেখক যা ভাবেননি, সেই অভাবিত কোনো পরিপ্রেক্ষিতেও সেই রচনা গৃহীত হয়ে যায় যখন, তখনই শিল্পের সামর্থ্য। কিন্তু সে সামর্থ্য শুধুই শিল্পের সূক্ষ্ম কলাকৌশল মেনে এসেছে এমন নয়; এই সামর্থ্যর অন্যদিকও আছে। লেখার কৃতকৌশল, শিল্পীর জীবন হবে সাধারণের থেকে আলাদাই। কিছুই তলিয়ে না-ভাবা, অগভীর, অতিতরল সাধারণ কিছুতেই তার তল খুঁজে পাবেন না এবং তাদের দিকে অবজ্ঞার পরিভাষা নিক্ষেপ করে একজন শিল্পী আত্মগরিমা নিয়ে সরে যাবেন সমাজের মূল স্রোত থেকে। সমাজের মূল স্রোতের এইসব শিল্প নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা যে নেই, এই নির্ভেজাল সত্যটি যদি লেখক বুঝে যান, তখন তার বিচ্ছিন্নতার মধ্যে কোনো অহংকার নয়, বরং পরোক্ষে সমাজের সঙ্গে সংযোগ করবার তাড়ন তৈরি হয়। আমি শিল্পী—আমি সাধারণের মতো নই—এই মেকি দম্ভের উল্টোদিকে তখন গণতাচ্ছিল্য জোটে শিল্পীর। প্রকৃতপ্রস্তাবে তখনই তার মনে হয়, যা-কিছু লেখা হবে, তার উপাদানের মানসক্ষেত্র, তার ব্যক্তি-ইচ্ছার সঙ্গে এই গণসমাজের অতিঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তার ব্যক্তি-ইচ্ছাও এই সমাজের কাছে ঋণী। তা এই সমাজকে স্বীকারেই হোক, অস্বীকারেই হোক। গণ-ইচ্ছার সঙ্গে নয়, গণচেতনার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পৃক্তি-বোধ না সৃষ্টি হলে শিল্পের সম্ভাবনা জন্মায় না।

    তাহলে কি সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ মেনে এখন থেকে লেখা উচিত? সমাজের নীতিবোধ, ঔচিত্যবোধের এলাকা মাথায় রেখে কবিতার চিত্রকল্প নির্মিত হবে? কখনোই নয়। জনরুচির সমগ্রতার মধ্যে কোনো উদ্ভাবনী শক্তি ও পরিকল্পনা থাকে না। সেই সমগ্রতার প্যারামিটারের কোনো আদি-অন্ত নেই। সুবিধেবাদের মসৃণ অনুসরণে বরং অশিক্ষিত নীতিবাগীশ আচরণমাত্র আছে। সে সর্বদাই ব্যক্তির স্বয়ংক্রিয়তাকে, তার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এ-কারণেই সংবেদনশীল ব্যক্তি, সমাজের এই চাপিয়ে দেওয়ার স্বভাব থেকে দূরে পালাতে চান। তাই তার শিল্পচর্চা ব্যক্তিগত ইচ্ছের ওপর ভিত্তি করেই সেফ খেলতে চেয়েছে। কিন্তু সমগ্রর স্থূলত্বকে অভিনন্দিত না-করেও সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়। সমাজের নিয়ন্ত্রণ না-মেনেও সমাজকে বুঝতে চাওয়ার স্পর্ধা ও দায়িত্ব নেওয়া যায় ব্যক্তিপ্রতিভার সার্থেই। ব্যক্তির শিল্পীসুলভ আত্মকেন্দ্রিকতা তাকে ভিনগ্রহী না বানিয়ে ফেলে। যেন তাকে পৃথিবীর রোদে-জলে পুষ্ট একজন মানুষ বলে মনে হয়। কবিতার সঙ্গে তাহলে একজন কবির এই মানবিক সংযোগটি কোথায়? বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘কবিতার নিজস্ব পৃথিবী’ নামের একটি লেখায় এই সংযোগ নিয়ে কথা বলেছিলেন নিজস্ব ভঙ্গিতে:

    “কবিতার একটি নিজস্ব পৃথিবী আছে, কিন্তু ওই পৃথিবী কোনো দেবভোগ্য স্বর্গরাজ্যের মতো অপরিবর্তনীয় নয়। সময় তাকে অনবরত পাল্টায়, এবং নানাদিক থেকে। যা কিছু কবিতার জলবায়ু, যা আলো, যা তার মাটি, যা আকাশ—দেখা যায় আমাদের চোখের পলক পড়ার আগে তাদের রঙ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। কখনো-বা দেশবিদেশের কবিতা পাঠে আমাদের এমন সন্দেহের মুখোমুখি হতে হয় যে, কবিতার পৃথিবী কবিতার ঠিক নিজস্ব নয়। সেখানে মাঝেমধ্যেই প্রচণ্ড ঝড় বইছে, প্রাকৃতিক ভূকম্পনে সামনের দৃশ্যগুলি তোলপাড় হচ্ছে। যেখানে পায়ের নীচে মাটি থাকার কথা, সেখানে যতদূর দেখা যায় শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। যাঁরা কবিতায় বিশুদ্ধতার চর্চা করেন, যাঁরা কবিতার সঙ্গে একটি শাশ্বত স্বর্গোদ্যানের তুলনা করতে ভালোবাসেন, এই পরিবর্তন তাদের কাছে খুব বেদনাদায়ক সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিবর্তন ঘটছে না, এমন অলীক দৃশ্য দেখতে হলে তাঁদের যে চব্বিশ ঘণ্টা চোখে মায়াবী চশমা পরে থাকতে হবে, এটা কঠিন সত্য।"
    যা কিছু কাব্যময়, সেই সবকিছু থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে—এও এক প্রতিজ্ঞা, কবিতাকে চিরায়ত, পরিচিত ধারণার পরিধি থেকে মুক্তি দিয়ে বিষয় ও ভাবে তাকে আরও সর্বগম করতে হবে । শিল্পের অন্তর্গত বিষয় হতে পারে যে-কোনো কিছুই। কই, উপন্যাস, ছোটগল্প বা নাটকের জন্যে তো এমন কোনো অলিখিত ফতোয়া নেই! আর্টে সব গ্রহণযোগ্য, অথচ গোলাপফুল, রজনীগন্ধার জায়গায় কুমড়োফুল, বকফুল আসবে না, এহেন নির্মম ফতোয়া শিল্পের গণ্ডিকে ছোট ও অসম্মানিত করেছে—সন্দেহ নেই। রান্নাঘরে ব্যবহৃত হয় বলেই তারা সাহিত্যজগতে ব্রাত্য হতে পারে না। কবিতা লিখতে এলে তোমায় গোলাপকেই শ্রেষ্ঠ দেখতে হবে, পূর্বনির্ধারিত এরকম কোনো সত্যিকে ধ্রুবক মনে করে কোনদিনও সৃষ্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। বরং বাংলা কবিতা গোলাপবাগানে ঘুরে-ঘুরে অপমৃত্যু লাভ করেছে অনেক। শিল্পের কাজই নিজের গণ্ডিকে খণ্ডন করা। গোলাপবাগান, রজনীগন্ধার মালা থেকে কবিতাকে মুক্তি দেওয়া। হতেই পারে কুমড়োফুল আর রান্নাঘর মিলে যুগান্তকারী একটি কবিতা সৃষ্টি হল। দেখা গেল, গোলাপবাগানে হেদিয়ে এতদিন এত ক্লোন-প্রতিভার অনাবশ্যক চাষ হয়েছে, কাজের কাজ হয়নি কিছুই। যখন সাজানো প্রতিবেশে আঘাত আসে, ব্যক্তি-আচরণ, ব্যক্তিপ্রশ্ন বদলে যায়, সমষ্টির প্রত্যাশা কোনো অভূতপূর্ব ভাষাবোধ কামনা করে, তখন বিশুদ্ধতা ভেঙে পড়ে। আবিষ্কৃত হয়, কবিতার বিশুদ্ধতা আদতে একটি প্রপঞ্চ-মায়াবিশেষ।

    সমাজের সংলগ্ন হতে হবে সমাজের গণবিধানকে সযত্নে এড়িয়েই। স্থানিকতার অনিবার্যতা আছে। যদিও বিশ্বায়িত সময়ে এই স্থানিক পরিসর ক্রমবিপন্ন। তবু ওই স্থানিক পরিসরের খুঁটিনাটির মধ্যে যেতে পারলে বিশুদ্ধতার ভূত ঘাড় থেকে নামে। ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয়, বা অভিঘাতী দৃশ্য বলেই যদি ঐতিহাসিক কিছু হয়ে থাকে, তাকে চেতনায় সমাকৃত করে নিলেই ব্যক্তিচেতনার পরিসরকে ক্ষতিগ্রস্ত না-করেও সে সমাজের সঙ্গে মিশে ওঠবার কৃৎকৌশল রপ্ত করতে পারে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে দু-জনের কথা বলেছেন, লি পো এবং টু ফু। দু-জনেই প্রাচীন চিনে কবিতা লিখতেন একই সময়বৃত্তে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্পষ্টতই বলছেন, কবি হিসেবে কেউ কারোর চেয়ে কম নন, কিন্তু দু-জনের অভিমুখগত তফাত রয়েছে। লি পো-র কমিটমেন্ট যদি কবিতার প্রতি হয়ে থাকে, তাহলে টু ফু-র দায়বদ্ধতা ‘মানুষের প্রতি’। ‘রাজার সঙ্গে রাজার যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মানুষের আত্মার যন্ত্রণা তিনি অনুভব করেছিলেন এবং তাই নিয়ে কবিতার পর কবিতা রচনা করেছিলেন।’ এই মানুষের আত্মার যন্ত্রণা-র কথা কি কবি হিসেবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও অনুভব করেননি? টু ফু-র লেখায় মানুষের আত্মার যে যন্ত্রণা তিনি দেখতে পান, তার নিজের লেখাতেও তো সেই অসহায় মানুষের পীড়নকেই দৃশ্যমান করতে চেয়েছেন তিনি। শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় (১জুলাই, ১৯৮০) তিনি বলেছিলেন :

    “শুধু বেঁচে বর্তে থাকাই তো একজন মানুষের অন্বিষ্ট নয়। নিজের ছোট্ট চিলে ঘরটিতে বসে একতারা বাজিয়ে সারা জীবন প্রেম আর অপ্রেমের গান গাওয়া—তাও নয়। মানুষ কোনো ঈশ্বরপ্রেমিক বৃক্ষ নয়; সারা জীবন ধরে তাকে রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতে হয়! আর শুধুই কি রাস্তা হাঁটা? অর্ধেক জীবন তো তার পায়ের নিচে কোনো মাটিই থাকে না। তা হলে কি রকম রাস্তা একজন মানুষের? একজন কবির?”
    অনায়াসে লক্ষ করা যায়, উনি কিন্তু একজন মানুষের ক্রাইসিসকে কবির ক্রাইসিসে রূপান্তর করছেন, বা তার মনে হচ্ছে এই তফাত্‍টাই অবান্তর। এটাই তার কবিচেতনার অন্বিষ্ট; তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞান থেকে সামাজিক অভিজ্ঞানের দিকে প্রত্যক্ষ দৃষ্টিপাত। এই প্রত্যক্ষ দৃষ্টিপাতের বীজক্ষেত্রই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যভূমি। অথচ তিনি নিজেই অসামান্য সমস্ত ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতা লিখেছেন! লিখেছেন: “আমি অনেক হৃদয় দেখলাম/ তোমার মতো গভীর কেউ না/ আমি অনেক কবিতা জানলাম/ তোমার পলিমাটির মতো না”। তবুও তিনি স্থির নিশ্চয়ে ভেবেছেন কেবলমাত্র নিজেকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন করে নয়, মানুষকে অবশ্যম্ভাবী ‘রাস্তার পর রাস্তা হাঁটতে হয়’। এই রাস্তায় চলার কোনো শেষ নেই। শুধু একাকী কোনো মানুষ হাঁটে না, তার পূর্বতন মানুষের স্মৃতি যেমন এই চেতনায় পলি দান করে, তেমনি ভবিষ্যতের কোনো মানুষের কাছে সেতুবন্ধন হয়ে উঠতে পারে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা এক কবির যুগানুভব। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই যুগানুভবের কবি। সে কারণেই তিনি লিখেছিলেন: ‘প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয়, প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম’। এই প্রশ্ন করার স্বভাবের ভেতরেই অন্তর্হিত সন্ধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি। কেন তিনি প্রশ্ন করেন? কেন তার মনে হয়, চারপাশে যা-কিছু ঘটমান তাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয় তার? আর সেই আপোষহীন তীরভূমি থেকেই শুরু হয় নরকের মধ্যে থেকেও স্বপ্ন দেখার অঙ্গীকার।

    ১৯৭২-এ প্রকাশিত হয় ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিত্কার করে’। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার তত্কালীন ‘সাম্প্রতিক’ সাহিত্যের সঙ্গে অ-ভারতীয় পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েকজন কবির সাক্ষাত্‍কার নেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। তাকে সহায়তা করেন লোথার লুত্স। বাংলা কবিতা বিভাগে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কথোপকথন ছিল। নাতিদীর্ঘ সাক্ষাত্‍কারটি নেওয়া হয় ১৯৭২-এ প্রকাশিত কবিতাকে কেন্দ্র করে। কোন্‌ বিশেষ মানসিক পরিস্থিতির বশবর্তী হয়ে কবিতাটি রচিত হয়েছিল—মূল প্রশ্ন ছিল সেটাই। এই প্রশ্নের উত্তরে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে কথাগুলি বলেছিলেন, তার মর্মার্থের মধ্যে যত-না কাব্যের তত্ত্ব ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল একজন সামাজিক দায়সম্পন্ন মানুষের অসহায়তার কথা। ছিল স্ট্রিট রিয়েলিটির নির্মম অভিজ্ঞতার অভিঘাত। তিনি কখনোই ভাবেননি, এই প্রত্যক্ষতা তার কবিসত্তার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে কী না। শিল্পের সহজাত আবেগ অথবা সচেতন অনুভবগুলো, তিনি কখনোই তা-থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। বাংলা কবিতাবাজারের যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গণ্ডি, তার মধ্যের দলভাগ, হিংসা, প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধ প্রতিষ্ঠান, পুরস্কার—এসবের নির্মিতি যে সুনিয়ন্ত্রিত কাঠামো গড়ে তোলে, সেই নিশ্চিত ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে নিজের রাস্তাকে সীমাবদ্ধ করতে চাননি। রাজনীতির পীড়নে হতোদ্যম একজন মানুষ যেভাবে নিজের অসহায়তা ব্যক্ত করেন, ঠিক সেইভাবেই নিজের অনুভূতির কথা অলোকরঞ্জনকে জানিয়েছিলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কাব্যচেতনার ধরন বুঝতে এই কথাগুলো একবার জেনে নেওয়া ভালো। সামাজিক হতে-চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থেকে আমাদের মতো যাদের মেরুদণ্ড রুগ্ন হয়ে যায়; প্রতিবাদ হয়ে ওঠে সুচতুর, অর্থহীন; তাদের কাছে সপাট এই কথাগুলো একজন সহৃদয়, ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একজন মানুষের চেতাবনি:

    “আমাদের এখানে গত কয়েক বছরে অত্যন্ত যারা কিশোর ছেলে, বাচ্চা ছেলেমেয়ে, তাদের খুব দুর্দিন কেটেছে। সেই দুর্দিনটা হচ্ছে এই ধরনের যে, তাদের অনেকেরই জীবনে কোনো নিরাপত্তা ছিল না, যখন-তখন যাকে-তাকে রাস্তায় পুলিশ ইচ্ছে করে গুলি ক’রে মেরেছে। আমার নিজের সেই সময় খুব—নিজেকে এবং সমস্ত দেশকে—খুব অসহায় ব’লে মনে হয়েছে। এবং এটাও আমার মনে হয়েছে যে, আমার এই দেশের রাজনৈতিক নেতা যারা—কবি সাহিত্যিক ইত্যাদি—আমরা কেউ এই ভয়াবহ অবস্থার কোনো প্রতিবাদ করিনি। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় যদি একটি কিশোর ছেলেকে পুলিশ-ভ্যানে তুলে নিয়ে অত্যাচার করা হয়ে থাকে, বা তাকে ভ্যান থেকে নামিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি মেরে থাকে, আমরা এগুলো চোখে হয়তো দেখেছি, কিন্তু মোটামুটি জিনিষটাকে অনিবার্য ধ’রে নিয়ে আমরা সে ব্যাপারটাতে চুপচাপই থেকে গেছি। এই অবস্থাটা নিয়ে আমি অনেকগুলো কবিতা লিখেছি, এটা তার একটা।”
    এই বিবরণে একাধিকবার রাস্তার কথা এল। খেয়াল করলে দেখা যাবে কবির মন যেন রাস্তাতেই নিবদ্ধ। এটা ঠিক, তাকে যে কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে—রাস্তা থেকেই উঠে আসা সেই কবিতা, হতেই পারত-- কারোর মুখ থেকে শুনে, সংবাদপত্র থেকে পড়ে, কবি লিখলেন; কিন্তু এই কথাবার্তা প্রমাণ করে এই কবিতা সরাসরি উঠে এসেছে রাস্তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। অভিজ্ঞতাটি কার? অবশ্যই স্বয়ং কবির। সত্যিই তো, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ঘটনাপুঞ্জ, তার মধ্যে যতই অন্যায়, অস্থিরতা থাকুক না কেন, একসময় তাকে দেখতে-দেখতে সহ্য হয়ে আসে সব। যা-কিছু অন্যায়, কখনো তীব্র সুরক্ষার ভয়ে, কখনো সুবিধেবাদের কারণে, আমরা তাকে মেনে নিতে নিতে ঘটনার মর্যাদা দিয়ে দিই। বুদ্ধিমান মানুষের এই অঙ্কের কথা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানতেন। দেশের নাগরিক হয়েও কীভাবে পশুর জীবন অতিবাহিত করতে হয়, সেই ক্লীবত্বের কাহিনিও তার জানা। একটি কিশোরকে অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া, তাকে ভ্যান থেকে নামিয়ে গুলি করে মেরে ফেলার মধ্যে যে পৈশাচিকতা আছে, রাষ্ট্রের যে দানবীয় নিয়ন্ত্রণ-পিপাসা, তাকে তিনি চিনতেন একজন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকের বোধ থেকে। মানুষের বানিয়ে তোলা রাষ্ট্রে এই শোষণ ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে আসে, বিষয়টিকে অনিবার্য সত্য ভেবে নিয়ে শহুরে মানুষের বিবেক চুপ করে থাকে। আর এই অপ্রত্যাশিত নীরবতার তীরভূমিতে দাঁড়িয়েই কবিতার অনিঃশেষ জন্ম হয়।

    বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি চমত্কার গল্প আছে: ‘একটি মৃত্যু’; সেখানে সমস্ত রাত ধরে স্বপ্ন দেখা এক ব্যক্তি ভাবছে স্বপ্ন দেখার কোনো মানে হয় না। যতক্ষণ জ্ঞান ছিল, মনে হচ্ছিল মাথা টুকরো হয়ে ভেঙে যাবে। উত্তরহীন এক প্রশ্নের দিকে ধাবিত হতে-হতে সে মানবসমাজ সম্পর্কে তার সনির্বন্ধ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও সেই মূল্যায়ন আদতে প্রশ্নই। কেননা যে- মানবসমাজের কথা ভেবে সে রণক্লান্ত হয়ে পড়ছে, সেই মানবসমাজের আচরণেই সে বিতৃষ্ণায় সংকুচিত। এই মানবসমাজ সে কোনোমতেই চায় না, তবুও তাকে এই মানবসমাজের অংশীভূত হয়ে থাকতে হয়। বাধ্যত। এও মানুষের বন্দিদশাই। সামাজিক চাহিদার ভোগবাদী পরিসরই তাকে পরিশ্রান্ত করে। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অল্পায়তন গল্পের মধ্যে স্বপ্নের কথা আসে। আরও সঠিকভাবে বললে স্বপ্নভঙ্গের কথা। কী স্বপ্ন দেখে গল্পের কথক? “কে জানে, এখন কত রাত হল? ভয়ংকর ঘুম পাচ্ছে... কিন্তু ওই পর্যন্তই। সারা রাত ঘুম তার ঘরের মধ্যে পায়েচারি করবে, আর সে জেগে থাকবে।" অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটকে প্রবীণ অভিনেতা রজনী চট্টোপাধ্যায়েরও মঞ্চে ঘুম পেত: “…কালো কালো অঙ্গারে লেখা আছে আছে জীবনের শেষ কথাগুলো—কত নড়াচড়া, কত উদ্বেগ, কত প্রেম, কত মায়া। সব মিলিয়ে যেন মৃত্যুর নিঃঝুম ঘুমের আয়োজন করে রেখেছে কারা,…”। নিঃসঙ্গতার বিবিধ সংরূপ তৈরি হয়েছে এই ব্যর্থ ঘুমের ধারাবাহিক ব্যবহারে। এই স্বপ্নভঙ্গের তো উত্তরাধিকার আছেই। নিম্ন-মধ্যবিত্তের হতাশায়, চাকরিহীনতায়, একাকীত্বের অনিবার্য পরিণতিতে, সমাজ-বিচ্ছিন্ন থাকবার অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে কত-কত সুজাত আত্মাকে ডুবে যেতে হয়েছে ওই ‘মৃত্যুর নিঃঝুম ঘুমে’। কেমন হবে নাছোড়বান্দা সেই কবির মুসাবিদা, যিনি এই সমাজ-পংকে নিরন্তর ধ্বস্ত হতে-হতে খানিক আত্মভূমি খুঁজে পাবার এষণা জাগাতে পারেন? কাজী নজরুল ইসলামকে নিবেদিত একটি কাব্যসংকলনের ভূমিকায় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন:

    “কবির নামের পাশে একটি বিশেষ অর্থ আমাদের চেতনায় সকল সময় কাজ করে। সেই অর্থটি হল মনুষ্যত্ববোধ, যা আসে আত্মার ভেতর থেকে, কিন্তু বাইরের জীবনেও যাকে ধারণ এবং লালন করতে হয়। তিনিই সত্যিকারের কবি, যাঁর আত্মার অমলতা বাইরের সমস্ত ঝড়-ঝাপটায়, এমনকি মানবসমাজের মধ্যে যে বিপরীত অমানুষিকতা এই বিংশ শতাব্দীতে আমাদের উন্মাদ করে তার বিষক্রিয়াতেও একইরকম অম্লান থাকে।”
    এমনিতে কবির লেখা গদ্যচিন্তা বিশেষ কোনো সাহিত্যপ্রকরণ নয়। কিন্তু তবু যদি সেই ক্রান্তদর্শী ব্যক্তির অন্তর্গত রক্তে সমাজ-ইতিহাস-অর্থনীতি-মানুষ-প্রকৃতি ক্রমবিবর্তিত হয়, তখন তার চিন্তাস্রোতের ধারা অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যৎকেও মিলিয়ে দিতে পারে। কবিতার ভাষা দুর্জ্ঞেয় হয় না, কবির মন যে বধ্যভূমির ওপর দাঁড়িয়ে নিজেকে সমাজ-সংযুক্ত করতে চাইছে, সেই ভাষা হয়ে ওঠে তার অনিবার্য আধার, অনিবার্য শিল্পকর্ম। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে রাস্তার কথা বারবার বলতে চেয়েছেন, সেই রাস্তায় কি তার পরবর্তী সময়ে কেউ হাঁটেননি? গৌতম বসু-র অধিকাংশ বই পুস্তিকার আকারে। ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’, ‘রসাতল’, ‘অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে’—প্রতিটি পুস্তিকাই বাংলা কবিতার অহংকার। তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতোই প্রকাশ করেছিলেন একাধিক উল্লেখযোগ্য ফোল্ডার। এই যে তিন দশক পেরিয়ে একজন কবি দূর থেকে অগ্রজ কবির আদর্শকে, তার প্রকৃত ধর্মকে অনুসরণ করবার চেষ্টা করে গেলেন এবং নিজস্ব কাব্যাদর্শ, সম্পাদক-সত্তাকে অক্ষুণ্ণ রেখে, এখানেই তো এই চিন্তাস্রোতের উত্তরাধিকার। উত্তরাধিকারের এই দায়িত্ব কি পালন হয়নি এই ২০২২-এ এসেও? ২১ মার্চ রামপুরহাট, বগটুই, গ্রামে যে গণহত্যা সংগঠিত হয়, তার প্রতিবাদে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। ‘রামপুরহাট গণহত্যায় নিহত প্রত্যেক মানুষকে’ উত্‍সর্গ করা এই সংকলন প্রকাশে যেমন ভূমিকা নিয়েছেন রাহুল পুরকায়স্থের মতো কবি, তেমনি আবার তন্ময় ভট্টাচার্য ও আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো নবীন কবিরাও এতে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত থেকেছেন। এই সংকলনের হার্ড কপি ছড়িয়ে গেছে কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায়। এই সংকলনের সফ্‌ট কপিও গেরিলা যুদ্ধের ভঙ্গিতে অতর্কিত ঝাঁকুনি দিয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে, সুধীজনের স্মার্ট ফোনের স্ক্রিনে। কবিতা লিখেছেন জয় গোস্বামী, তাঁর আটটি কবিতার সংকলন নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘দগ্ধ’, এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই। ক্ষমতা তখনও চুপ ছিল, ক্ষমতা এখনো চুপ আছে। মানুষের চটকদার স্মৃতি শীতঘুমে চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছে আড়চোখে। আর কবিতা কী করছে? সমবায়িক চেতনার অমৃত-বিষ ধারণ করতে-করতে এগিয়ে যাচ্ছে সময়ের নিষ্ঠুর পরিধিকে অতিক্রম করে। ওই তো জয় গোস্বামী একটু দূরেই অপেক্ষা করছেন। রাহুল পুরকায়স্থ-র সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন শুভেন্দু সরকার। তাদের সামনে আকাশ-তন্ময়রা নতুন একটা রাস্তার ক্রান্তিপর্বে। ওদেরও আগে কুয়াশাকীর্ণ তেপান্তরে দাঁড়িয়ে ততক্ষণে একটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


    অবলম্বন:

    ১. গদ্যসংগ্রহ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনা: গৌতম মিত্র, ক্রৌঞ্চদীপ, জানুয়ারি, ২০২২

    ২. সাক্ষাত্‍কার সংগ্রহ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদনা: গৌতম বসু, বিদুর, ফেব্রুয়ারি, ২০২১

    ৩. আধুনিক কবিতা, জীবনানন্দ দাশ, ‘কবিতার কথা, সিগনেট প্রেস, নবম সংস্করণ, মাঘ ১৪০৯

    ৪. কবিতার শত্রু ও মিত্র: একটি খোলা চিঠি, বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসংগ্রহ (চতুর্থ খন্ড), জানুয়ারি, ২০১৫

    ৫. কাব্যের মুক্তি, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, স্বগত, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধসংগ্রহ, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ: কার্তিক, ১৩৯০, পুনর্মুদ্রণ: জানুয়ারি, ১৯৯৫



    অলংকরণ (Artwork) : বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কাজী নজরুল ইসলামের ছবিটি বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)