• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • ওভারকোট اوور کوٹ : গুলাম আব্বাস
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়



    [ওভারকোট ঠান্ডায় পরার আরামদায়ক পোশাকমাত্র নয়। ওভারকোট সত্যকে আড়াল করে, অস্তিত্বের সংকটকে ঢেকে রাখে। ওভারকোট সরে গেলে উপমহাদেশের উত্তর-ঔপনিবেশিক জাগতিক ও মানসিক সংকটও কি আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়? নিজের ভাষা, আদব-কায়দা ভুলে গিয়ে পশ্চিমি সভ্যতার অন্ধ অনুকরণের প্রয়োজন অনুভব করার মধ্য দিয়ে যে সংকটের সূত্রপাত?

    ভেতরের ফোঁপরা কাঠামোটা কি তখন বেরিয়ে আসে? গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন সান্ধ্য ভ্রমণের মতই যা অন্তঃসারশূন্য?

    গুলাম আব্বাস (১৯০৯-৮২) রচিত গল্পটির অনুবাদের জন্য নাদিম আহমদ সম্পাদিত ‘কুল্লিয়াত-এ গুলাম আব্বাস’-এ মুদ্রিত সংস্করণটি ব্যবহার করেছি।

    —অনুবাদক]

    জানুয়ারির সন্ধ্যা। কেতাদুরস্ত সুবেশ এক যুবা ডেভিস রোড ধরে চলতে চলতে ম্যাল রোডে পৌঁছে চেয়ারিং ক্রসের দিকে ঘুরল। ফুটপাতের ওপর দিয়ে শ্লথগতির পদচারণা। তার লম্বা চুলগুলো আলোয় উজ্জ্বল। সরু গোঁফটি যেন পেন্সিলে আঁকা। গায়ে বাদামি রঙের ওভারকোট। কোটের বোতামঘরে হালকা কমলা রঙের গোলাপ গোঁজা। মাথায় সবুজ ফেল্ট টুপিটি একটু তেরছাভাবে পরা। সাদা রেশমের গলাবন্ধ গলায় জড়ানো। নওজোয়ানের একটা হাত কোটের পকেটে। আরেক হাতে বেতের একটা ছোট ছড়ি। সেটাকে মাঝে মাঝে মনের আনন্দে ঘোরাতে ঘোরাতে সে চলেছে।

    শনিবার। ভরপুর শীতের মরসুম। কনকনে তেজি বাতাস যেন ধারালো ছুরির ফলার মত বুকে এসে বিঁধছে। অন্য অনেকে শরীর গরম করার জন্য জোর কদমে চলেছে। যুবকের অবশ্য কোনও হেলদোল নেই। কড়া শীতের মধ্যে হেঁটে সে যেন মজাই পাচ্ছে। তার চলাফেরার ভঙ্গি এমনই যে টাঙাওয়ালারা দূর থেকে তাকে দেখেই ঘোড়দৌড় করিয়ে কাছে হাজির হয়ে যাচ্ছে। তরুণ ছেলেটি অবশ্য ছড়ির ইশারায় তাদের না বলে দিচ্ছে। একটা খালি ট্যাক্সিও একবার দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু যুবক তাকেও ‘নো, থ্যাংক ইউ’ বলে এগিয়ে গেল।

    যতক্ষণে সেই নবযুবা ম্যালের ঝলমলে পরিবেশে এসে পৌঁছোল, ততক্ষণে তার চনমনে ভাব যেন আরও বেড়ে গেল। কোনও একটা ইংরেজি গানের সুর শিস্‌ দিতে দিতে সে যাচ্ছে। গানের তালের সঙ্গে যেন পা মিলিয়ে চলেছে। একবার আশপাশে কেউ নেই দেখে আবেগের বশে কিছুটা দৌড়ে গিয়ে বল ছোঁড়ার ভঙ্গি করল। যেন কোনও অদৃশ্য ক্রিকেট খেলার খেলোয়াড়। এতক্ষণে সেই রাস্তায় পৌঁছেছে যেটা লরেন্স গার্ডেন্সের দিকে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যের অস্পষ্টতায় আর শীতের কুয়াশায় বাগানটা যেন বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে। তাই সে ওদিকে না গিয়ে চেয়ারিং ক্রসের দিকে সোজা পথ ধরল। রানির স্ট্যাচুর নিচে পৌঁছে সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। পকেটের বদলে কোটের বাঁ আস্তিন থেকে রুমাল বার করে মুখটা পুঁছে নিল। পাশেই এক টুকরো ঘাসের ওপর কয়েকটা ইংরেজ বাচ্চা একটা বড় বল নিয়ে খেলছে। যুবক দাঁড়িয়ে পড়ে সোৎসাহে তাদের খেলা দেখতে লাগল। বাচ্চারা কিছুক্ষণ তো তার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করেই খেলা চালিয়ে গেল। কিন্তু তাকে টানা তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু পরে লজ্জা পেল। হঠাৎই বলটা কুড়িয়ে নিয়ে হাসতে-হাসতে একে অপরকে তাড়া করতে করতে লনটা ছেড়ে পালিয়ে গেল।

    সিমেন্টের একটা খালি বেঞ্চি চোখে পড়ায় তরুণ তার ওপর বসল। সন্ধ্যের অন্ধকার নামতেই ঠান্ডাটাও যেন বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে। কড়া ঠান্ডা খুব যে অস্বস্তির কারণ হচ্ছিল তা নয়। বরং তাতে আরামের হাতছানিই ছিল। যারা আরাম-আয়েশের জীবন কাটায় তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তারা তো ঠান্ডার আমেজ উপভোগ করবেই। কিন্তু যারা নিঃসঙ্গ এমনকী তারাও নিজেদের সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসময় মেহফিল-সম্মেলনের অংশীদার হতে প্রলুব্ধ হয়। অন্য অনেকের শারীরিক উষ্ণতায় নিজেদের সেঁকে নেয়। এই আনন্দ কত মানুষকে ম্যালের ভিড়ে টেনে আনে। যার যেমন সাধ্য রেস্টুরেন্ট, কফি হাউস, নাচঘর, সিনেমা ইত্যাদি উপভোগের কোনও না কোনও মোকামে মানুষ সেঁধিয়ে যায়। ম্যাল রোডে মোটরগাড়ি, টাঙা আর সাইকেলের শোভাযাত্রা লেগেছে যেন। আর ফুটপাতের ওপর পথচারীদের সে কী ভিড়! সড়কের ওপরে দোকানপাটে বেচাকেনার বাজারও সরগরম। আর যে দুর্ভাগাদের হোটেল-রেস্টুরেন্টে ঢোকা বা কেনাকাটার সাধ্য নেই, তারাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দোকানের আলো ঝলমলে জানলাগুলোর দিকে তাকিয়ে সময় কাটাচ্ছে।

    যুবক সিমেন্টের বেঞ্চে বসে উৎসাহভরে সামনের ফুটপাতের ওপর মানুষের এই শোভাযাত্রা দেখতে থাকে। মুখাবয়বের তুলনায় পথচারীদের বেশভূষার বাহার দেখতেই সে বেশি উৎসাহী। সব শ্রেণির, সব ধরনের মানুষ আছে এখানে: বড় ব্যবসায়ী, সরকারি অফিসার, নেতা, শিল্পী, কলেজের ছাত্রছাত্রী, নার্স, খবরের কাগজের প্রতিনিধি, অফিসের বাবুরা। অধিকাংশই ওভারকোট পরে আছে। সব কিসিমের ওভারকোট। চামড়ার তৈরি দামী ওভারকোট থেকে শুরু করে ফৌজিদের পরিত্যক্ত ওভারকোট, নিলামে সস্তায় কেনা।



    যুবকের নিজের ওভারকোটটি বেশ পুরোনো হলেও ভালো কাপড়ের। ওস্তাদ দর্জির হাতে সেলাই করা। দেখে বোঝা যায় সেটা বেশ যত্নে রাখা। শক্ত কলার। হাতাগুলো নিপাট, ভাঁজহীন। শিঙের তৈরি বোতামগুলো বড়-বড়, উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে যেন ওভারকোটটি গায়ে চাপিয়ে নওজোয়ান বেশ গর্ব অনুভব করছে। একটা ছেলেকে পান-বিড়ি-সিগারেটের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে সামনে দিয়ে যেতে দেখে যুবক ডাকে, ‘এই পানওয়ালা।’

    ‘জনাব!’

    ‘দশ টাকার চেঞ্জ হবে?’

    ‘নেই, তবে এনে দিতে পারি। আপনি কী নেবেন?’

    ‘নোট নিয়ে যদি ভেগে যাস্‌ তো?’

    ‘কী বলছেন! আমি কি চোর যে পালিয়ে যাব? বিশ্বাস না হলে আমার সঙ্গে চলুন না। আপনি নেবেনটা কী?’

    ‘না, না, আমি নিজেই চেঞ্জ দিচ্ছি। নে, এই এক আনা। একটা সিগারেট দিয়ে ভাগ্‌।’

    পান-বিড়ির ছেলেটা সরে যেতেই যুবক আরামে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। এমনিতেই তো সে বেশ খুশিতে আছে। অন্তত তাকে দেখে তো তেমনই মালুম হচ্ছে। সিগারেটের সুখটান তাকে যেন আনন্দের চূড়ায় পৌঁছে দিল। এমন সময় একটা সাদা বেড়াল ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বেঞ্চের নিচে তরুণের পায়ের কাছে এসে ‘মিয়াঁও-মিয়াঁও’ ডাকছে। আদরের স্পর্শ পেতেই বেড়ালটা এক লাফে চড়ে বসল বেঞ্চির ওপরে। যুবক ভালোবেসে বেড়ালের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘পুওর লিট্‌ল সৌল!’

    তারপরে দাঁড়িয়ে উঠে যুবক পৌঁছে গেল রাস্তার উল্টোদিকে। সেখানে হলের রংবেরঙের আলো ঝলমল করছে। শো শুরু হয়ে গিয়েছিল। বারান্দায় ভিড় ছিল না। কতিপয় দর্শক শুধু পরে দেখানো হবে এমন সিনেমার স্থিরচিত্রগুলো দেখতে মগ্ন। ছবিগুলো ছোট-বড় আকারের বেশ কয়েকটা বোর্ডে সাঁটা। চলচ্চিত্রের নির্বাচিত দৃশ্যের প্রদর্শনী আর কী! তিনটে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে ছবিগুলো দেখছিল। তাদের হাবভাবে এক ধরনের নিশ্চিন্ত প্রাণোচ্ছলতা তো ছিলই। কিন্তু সে আচরণ এমন নয় যা নারীত্বের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। যুবাও তাদের থেকে ভদ্রজনোচিত দূরত্ব বজায় রেখে ছবির প্রদর্শনী দেখতে লাগল। মেয়েরা নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মজে থাকলেও সিনেমা সম্পর্কে মন্তব্যও করছিল। ওদের মধ্যে একটি মেয়ে তার বন্ধুদের তুলনায় বেশি সুন্দরী আর উচ্ছল। সে তার সঙ্গিনীর কানে-কানে কিছু বলল। সঙ্গিনী হাসিতে ফেটে পড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। তিনটি মেয়েই এইভাবে হাসতে হাসতে চলে গেল। এর কোনও প্রভাব তরুণের ওপর পড়েছে বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পরে সেও সিনেমা হল ছেড়ে রাস্তায় নেমে এল।

    সাতটা বেজে গেলেও নওজোয়ান ম্যালে পায়চারিই করে চলেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে অর্কেস্ট্রার আওয়াজ আসছে। ভেতরে যত লোক তার চাইতে বাইরের ভিড় যেন আরও বেশি। গাড়ির ড্রাইভার, কোচোয়ান, খালি ঝুড়ি নিয়ে ফলবিক্রেতারা আছে। পথ চলতে চলতে দাঁড়িয়ে পড়া পথচারী, মজুর, ভিখিরিরাও আছে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে যারা আছে তাদের তুলনায় বাইরের লোকেরাই যেন গানের সমঝদার বেশি। কারণ এরা কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে গান শুনছে। সুর আর বাদ্যযন্ত্রগুলো বিদেশী। যুবক এক মুহূর্তের জন্য সেখানে দাঁড়ালেও আবার এগিয়ে চলল।

    কিছু দূর এগিয়ে পশ্চিমি সঙ্গীতের যন্ত্রপাতির একটা বড় দোকান। নওজোয়ান নির্দ্বিধায় ভেতরে ঢুকে পড়ল। চারিদিকে কাচের আলমারিতে বিভিন্ন ধরনের পশ্চিমি বাদ্যযন্ত্র সাজানো। একটা লম্বা টেবিলের ওপরে পশ্চিমি সঙ্গীতের স্বরলিপির বইগুলোও দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক হিট গান এসব। প্রচ্ছদগুলো ঝকমকে বটে, কিন্তু সুরগুলো বাজে। যুবকের নজর দ্রুত সরে গিয়ে বাদ্যযন্ত্রের আলমারিগুলোর ওপর পড়ল। দেওয়াল থেকে একটা স্প্যানিশ গিটার ঝুলছে। মন দিয়ে যন্ত্রটার আগাপাশতলা দেখার পরে তার নজর পড়ল ঝুলতে থাকা দাম লেখা টিকিটের ওপর। যুবক দ্রুত সরে এল একটা বড় জার্মান পিয়ানোর কাছে। পিয়ানোর বোতামের ঢাকনাটা সরিয়ে দুয়েকটা বোতাম টিপে দেখে আবার ঢাকনা বন্ধ করে দিল।

    পিয়ানোর আওয়াজ শুনে দোকানের এক কর্মচারী এগিয়ে এল।

    ‘গুড ইভনিং, স্যার। আপনাকে কোনও সাহায্য করতে পারি?’

    ‘না, ধন্যবাদ। ওহ্‌ আচ্ছা, এমাসে বেরোনো গ্রামোফোন রেকর্ডের তালিকাটা দিতে পারেন?’

    লিস্ট ওভারকোটের পকেটে চালান করে দিয়ে নওজোয়ান বাইরে বেরিয়ে এসে আবার চলতে শুরু করল। রাস্তায় একটা ছোট বুক স্টল দেখে যুবক সেখানেও দাঁড়াল। সবে বেরোনো কয়েকটা পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখে সযত্নে আবার তাকে রেখে দিল।

    আরেকটু এগোলে একটা কার্পেটের দোকান। লম্বা আলখাল্লা আর মাথায় টুপি পরা দোকানি এগিয়ে এসে যুবককে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাল।

    ‘এই ইরানি কার্পেটটা একটু দেখাবেন? নামাবেন না, যেখানে রাখা আছে সেখানেই আমি দেখে নেব। এটার দাম কত?’

    ‘চোদ্দ শো বত্রিশ টাকা।’

    নওজোয়ানের ভুরু কোঁচকানো দেখে মনে হল যেন বলতে চায়, ‘ওহো, এত?’

    ‘আপনি পছন্দ করুন না। আমি যতটা সম্ভব দাম কমিয়ে দেব।’

    ‘ধন্যবাদ। কিন্তু এখন তো আমি শুধু এক নজর দেখতেই এসেছি।’

    ‘মনের শখ মিটিয়ে দেখুন। আপনারই তো দোকান।’

    তিন মিনিটের মধ্যেই তরুণ ছেলেটি সেই দোকান থেকেও বেরিয়ে এল। ওভারকোটের বোতামের সঙ্গে লাগানো হালকা কমলা রঙের ফুলটা বেরিয়ে এসেছিল। যুবক যখন ফুলটাকে আবার বোতামের ঘরে জায়গামত গুঁ‍জে দিচ্ছে, তখন এক মুহূর্তের জন্য তার ঠোঁটে যেন রহস্যময় হাসির ঝিলিক। পর মুহূর্তেই আবার সে চলতে শুরু করল।

    এবার সে হাই কোর্টের সামনে চলে এসেছে। এতটা পথ হাঁটার পরেও উদ্যম কমেনি। এতটুকু ক্লান্তি নেই। এই পথ চলা তার একঘেয়ে লাগছে বলেও তো মনে হচ্ছে না। এপাড়ায় পথচারীদের সংখ্যা কম, তাদের মধ্যে দূরত্বও যেন বেশি। যুবক তার বেতের ছড়িটি এক আঙুলে ঘোরানোর চেষ্টা করে পারল না। ছড়িটা ফুটপাতে পড়ে গেল। ‘ওহ্‌ সরি’ বলে যুবক একটু ঝুঁকে ছড়িটি তুলে নিল।

    এই সময় তার পেছনে থাকা একজোড়া যুবক-যুবতী তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল। লম্বা ছেলেটির পরনে কালো কর্ডুরয়ের ট্রাউজ়ার আর চেন লাগানো চামড়ার জ্যাকেট। তার মোটাসোটা সঙ্গিনী পরেছে সাদা সাটিনের ঢিলেঢালা সালওয়ার আর সবুজ কোট। লম্বা বিনুনিটি কোমর ছাড়িয়ে নেমেছে। চলনের সঙ্গে তাল রেখে সেটি ওপরে-নিচে দোল খাচ্ছে। তাদের পেছনে আসতে থাকা নওজোয়ানের কাছে দৃশ্যটি আকর্ষণীয় তো বটেই! যুগল কিছু সময় নিঃশব্দে চলার পর ছেলেটি নিচু গলায় কিছু একটা বলতেই যুবতী রেগে উঠে বলল, ‘কখনই না! কখনই না! কখ্‌খনও না!’

    ‘শোনো, আমার কথাটা তো শোনো।’ যুবক বোঝানোর চেষ্টা করে।

    ‘ডাক্তার আমার বন্ধু। কেউ জানতে পারবে না।’

    ‘না, না, না!’

    ‘দেখো, তোমার একটুও কষ্ট হবে না।’

    মেয়েটি এবার কোনও জবাব দিল না।

    ‘তোমার বাবা কী দুঃখ যে পাবেন! ওঁর সম্মানের কথাটা কখনও ভেবে দেখেছ?’

    ‘চুপ করো! না হলে আমি পাগল হয়ে যাব!’

    সারা সন্ধ্যে হাঁটতে হাঁটতে যুবক যত মানুষ দেখেছে, তাদের কেউই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। হয়ত তাদের মধ্যে মনে রাখার মত কিছু ছিল না। অথবা সে নিজের ভাবনায় এমনই মগ্ন হয়ে ছিল যে কারও দিকে নজর দেওয়ার কথা মনেই হয়নি। কিন্তু এই জুড়িটির মধ্যে কিছু একটা ছিল – এরা যেন কোনও গল্পের দুটি চরিত্র যারা তার মনকে আকৃষ্ট করেছে। মনে হচ্ছে ওদের কথা আরেকটু শুনতে পারলে ভালো হত। কাছে গিয়ে তাদের মুখদুটি যদি একবার দেখতে পারত!

    এতক্ষণে তারা বড় পোস্ট অফিসের সামনের মোড়ে এসে পৌঁছেছে। যুবক-যুবতী এক লহমার জন্য সেখানে দাঁড়াল। তারপরে রাস্তা পার হয়ে ম্যাকলিয়ড রোডে ঢুকে পড়ল।

    নওজোয়ান কিছুক্ষণ ম্যাল রোডেই দাঁড়িয়ে রইল। হয়ত ভাবছিল যে জুড়ির খুব কাছে গিয়ে পড়লে কেউ পিছু নিয়েছে বলে তাদের সন্দেহ হতে পারে। একটু দাঁড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

    যুবক-যুবতী যখন এক শো গজের মত এগিয়ে গেছে, তখন নওজোয়ান যেন লাফ দিয়ে এগোনোর চেষ্টা করল। রাস্তার অর্ধেক সবে পেরিয়েছে। ইট-বোঝাই একটা লরি ঝড়ের গতিতে ধেয়ে এসে তাকে পিষে দিয়ে ম্যাকলিয়ড রোড ধরে পালিয়ে গেল। যুবকের আর্তচিৎকার শুনে লরির ড্রাইভার বোধহয় এক মুহূর্তের জন্য গাড়ির গতি শ্লথ করেছিল। কিন্তু কী ঘটেছে বুঝতে পারার আগেই গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দু-চারজন পথচারী চিৎকার করছে, ‘নম্বরটা দেখো, নম্বরটা দেখো!’ কিন্তু ততক্ষণে লরিটি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এর মধ্যে আরও কিছু লোক সেখানে জড় হয়েছে। মোটর সাইকেলে পুলিশের এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টরও সেখানে হাজির। নওজোয়ানের দুটো পা চাকার তলায় পিষে যাওয়ায় খুব রক্তপাত হচ্ছে, সে কোনওক্রমে শ্বাস নিচ্ছে।



    তাড়াতাড়ি একটা গাড়িকে দাঁড় করিয়ে যুবককে কোনও মতে তুলে বড় হাসপাতালের দিকে রওনা করে দেওয়া হল। পৌঁছোতে-পৌঁছোতে প্রাণটা প্রায় বেরিয়েই গেছে। বড় হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন ডক্টর খান আর দুই যুবতী নার্স মিস্‌ শাহনাজ় আর মিস্‌ গুল তখন ডিউটিতে। যুবককে স্ট্রেচারে তুলে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার সময়ও যুবতী নার্স দেখছে তার পরনে বাদামি রঙের ওভারকোট আর গলায় সাদা সিল্কের মাফলার। জামাকাপড়ে রক্তের বড় বড় ছোপ। সহানুভূতিশীল কেউ সবুজ ফেল্টের টুপিটি তার বুকের ওপর রেখে দিয়েছে, যাতে হারিয়ে না যায়।

    শাহনাজ্‌ গুলকে বলল, ‘মনে হচ্ছে বেচারা কোনও বড় ঘরের ছেলে।’

    গুলের মৃদুস্বরে উত্তর, ‘শনিবারের সন্ধ্যা উদ্‌যাপন করতে বেশ সেজেগুজে বেরিয়েছিল দেখছি।’

    ‘ড্রাইভার পাকড়াও হয়েছে কি না?’

    ‘না, পালিয়েছে।’

    ‘কী লজ্জার কথা!’

    শুধু চোখ দুটো খোলা এমন মুখোশ পরে অপারেশন থিয়েটারে অ্যাসিস্টেন্ট সার্জেন আর নার্সরা রোগীর শুশ্রূষায় ব্যস্ত। যুবক মার্বেল পাথরের টেবিলে শুয়ে আছে। তার চুলের খুশবুদার তেলের গন্ধ তখনও নাকে আসছে। চুল অবিন্যস্ত হয়নি। দুর্ঘটনায় পা দুটি চুরমার হয়ে গেলেও মাথার টেরিটি যেমন ছিল, তেমনি আছে।

    এবারে নওজোয়ানের কাপড় খোলার পালা। গলা থেকে সাদা সিল্কের গলাবন্ধটা খুলে নেওয়া হল। হঠাৎই নার্স শাহনাজ্‌ আর নার্স গুল অবাক হয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ওই পরিস্থিতিতে তার বেশি আর কীই বা করতে পারত? তাদের মুখ তো বন্ধ, অনুভূতি যা কিছু তাও তো মুখোশের তলায় ঢাকা পড়ে আছে। স্কার্ফের নিচে নেকটাই বা কলার বা শার্ট – কিছুই নেই। ওভারকোট খুলে নিতেই বেরিয়ে পড়ল একটা ছেঁড়াফাটা সোয়েটার। তাতে বড় বড় ফুটো। তারও নিচে একটি শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি। ময়লা গেঞ্জিটার অবস্থা সোয়েটারের থেকেও খারাপ। স্কার্ফটা গলায় এমনভাবে বাঁধা ছিল যাতে ছাতির ওপর দিকটা সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে। শরীরও ভীষণই নোংরা। মনে হয় অন্তত দুমাস একবারও স্নান করার সুযোগ জোটেনি। কিন্তু গলায় তখনও হালকা পাউডারের দাগ দেখা যাচ্ছে। তাই গলার কাছে চামড়ার রং ফরসা বলে মনে হচ্ছে। সোয়েটার-গেঞ্জির পরে পাতলুনের দিকে তাকিয়ে শাহনাজ্‌ আর গুল আবার দৃষ্টি বিনিময় করল। বেল্ট নেই, একটা খুব পুরোনো নেকটাই দিয়ে পাতলুনটি কষে কোমরের সঙ্গে বাঁধা আছে। বোতাম-বকলশ উবে গেছে। হাঁটুর কাছে পাতলুনের চেহারা খুবই জীর্ণ, কোথাওবা ফুটোও চোখে পড়ছে। পাতলুনের বেশিটাই ওভারকোটের নিচে থাকায় এই খুঁতগুলো চোখে পড়ছিল না।

    এবারে বুটজোড়া আর মোজার পালা এলে মিস্‌ শাহনাজ্‌ আর মিস্‌ গুলের চার আঁখি আবার এক হল। বুট জুতো পুরোনো হলেও পালিশ করে চকচকে করা হয়েছে। কিন্তু দুপায়ে দুরকম ছেঁড়াফাটা মোজা। আর তার ভেতর দিয়ে যুবকের ময়লা গোড়ালির অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে।

    কোনও সন্দেহ নেই যে নওজোয়ান ইতিমধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। তার প্রাণহীন দেহটি মার্বেল পাথরের টেবিলের ওপর পড়ে। টেবিলে শোওয়ানোর সময় সে ছাতের দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু জামাকাপড় খোলার সময় শরীরটা ঘুরিয়ে দেওয়ায় এখন সে আছে দেওয়ালের দিকে ফিরে। তার শরীর আর মনের যা কিছু গোপন ছিল তা প্রকাশিত হয়ে পড়ায় সে যেন অন্য মানুষের দৃষ্টি এড়াতে চাইছে।

    ওভারকোটের বিভিন্ন পকেট থেকে বেরোল একটা ছোট, কালো চিরুনি; একটা রুমাল; সাড়ে ছ’আনা পয়সা, আগুন-নেভানো অর্ধেক খাওয়া সিগারেটের একটা টুকরো; নাম-ঠিকানা লেখার একটা ছোট্ট ডায়েরি; সে মাসে বেরোনো নতুন গ্রামোফোন রেকর্ডের একটি তালিকা, আর কিছু বিজ্ঞাপনী বিল যা ঘুরে-বেড়ানোর সময় কিছু লোক তার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। যুবক সেগুলো হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোটের পকেটে চালান করেছে।

    হায়, বেতের ছড়িটি দুর্ঘটনার সময় হারিয়ে যাওয়ায় যুবকের নিজস্ব সম্পদের এই তালিকায় আর রইল না।


    অলংকরণ (Artwork) : শুভময় রায়
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments