• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | রম্যরচনা
    Share
  • মধুপুরের পাঁচালি: কনিকোপলি : সমরেন্দ্র নারায়ণ রায়

    তিন বিখ্যাত বাঙালি। (১) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। (২) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। (৩) প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

    (অবশ্য আরো কয়েকজন নামী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বোধ হয় এককালে উজ্জ্বল করেছিলেন সেই তখনকার বাংলার মুখ। সে যাকগে।)

    একজন ছিলেন ব্যারিস্টার ও লেখক। আরেকজন লিখেছিলেন কবি-জীবনী। অন্যজন ছিলেন বিলাত-খ্যাত আইনজ্ঞ, বোধ হয় করতেন আইনের অধ্যাপনা।

    কে যে কোনটা করতেন তা তো আমার গেছে গুলিয়ে। তবে কি না এনাদের মধ্যে একজন ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের জামাতা। কেন জানি না আমার এখন মনে হয় ঐ তৃতীয় ভদ্রলোকই তিনি। গুগলবাজ পাঠিকা বা পাঠক অন্যরকম জানতে পারলে দয়া করে আমাকেও জানাবেন।

    আমাদের ওই ছোট্ট শহরে স্যার আশুতোষের ছিলো প্রাসাদোপম চকমেলানো অট্টালিকা "গঙ্গাপ্রসাদ হাউস"। জামাতা ও কন্যাকে স্যার আশুতোষ রাস্তার উল্টো পারে সামান্য উত্তরে বিঘে কয়েক জমি উপহার দেন কোনো এক শীতের তত্বে। সেই জমিতে একটি বড়ো সড়ো বাংলোও তৈরি শুরু হয়।

    এদিকে কিন্ত নানারকম খুঁটিনাটি নিয়ে শ্বশুর-জামাই দুজনের যধ্যে মতভেদ একটু ছিলোই। এবারে মেয়ে-জামাইয়ের ঐ বাংলোটির নক্সা ইত্যাদি শ্বশুরমশায়ের পছন্দ হলো না। জামাইবাবুও "দুত্তোর" বলে প্রজেক্টটি পরিত্যাগ করলেন। আংশিক ছাদহীন বাংলোটির দরজা জানালার জন্য তখনো স্থানীয় শাল-সেগুন কাটা শুরু করা হয়নি। হাতার চত্বরের মধ্যে একটি প্রাচীন কাঁঠাল আর একটি তরুণ জারুল। যে জারুলকে আমি বৃদ্ধ বয়সে দেখেছি। তার বার্ধক্যে, আমার নয়।

    সম্পত্তিটা পোড়ো হয়ে রইলো।

    বছর তিরিশ চল্লিশ পরে এক বুড়ি মাঝিন ওই বাড়িটির জমির মধ্যেই পিছন দিকে একটি ছোট কুঁড়ে ঘর তুলে বসবাস শুরু করলো। তার প্রয়াত বুড়ো মাঝি নাকি ঋক্ষজন্ম গ্ৰহণ করে তাকে রাতে পাহারা দিতো। অন্ততঃ আমরা তাই শুনতাম। বুড়ি ছিলো ভয়ঙ্করী অথচ সম্মানিতা, সমাদৃতা ডাইনী!

    এসব কিন্তু আমাদের পাশের পাড়া বড়বাদের মধ্যেই। এই তো আমাদের ১৫ নং কুণ্ডু বাংলোর ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁয়ে পুব দিকে দু'পা গেলে রাস্তাটা ডাইনে বেঁকতো, মানে দক্ষিণ দিকে নিয়ে নিতো মোড়। ঐ বাঁকের মুখে বাঁয়ে পড়তো ১৩ নং/১৪ নং (পঞ্চাননদাদু), "ব্রজ ধাম" (বোসদাদু), "গিরি কুটীর" (শৈলেনদাদু), ডাইনে ৩১ নং (কাশীবাবু)। তার পরে ডাইনে বারো নম্বরের বারোয়ারী কুয়ো, ১২ নং (পিসিমা)/১১ নং, কুণ্ডুবাড়ির রাস্তা, কুণ্ডু-দীঘি। তারপরে বাঁয়ে "মহেন্দ্র স্মৃতি" (যেখানে আমাদের পরিবার এককালে থেকেছে), ডাইনে ভুতুড়ে "শৈল নিবাস" (যার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো ভাদুড়ীদাদুর কুশমা মহল্লার বাড়ি "ননী ভিলা"-র রাস্তা) আর তার পরেই সেজদাদুর দিদি আর জামাইবাবুর সেই অসমাপ্ত বাংলো। সেজদাদু মানে স্যার আশুতোষের সেজছেলে উমাপ্রসাদ। ফাঁকে ফাঁকে ইদিক উদিক কয়েকটি নিকটবর্তী আদিবাসী গ্ৰামে যাওয়ার পথ।

    ওদিকে বেড়াতে বেড়াতে সেজদাদু বলতেন - বুঝলে দাদুসকল, মাঝে মাঝে ভাবি, এই বাংলোটা থাকলে আজ কি ভালোই না হতো। আত্মীয়-স্বজন আসতেন, এটাতেও থাকতেন, ছুটি কাটাতেন।

    উল্টোদিকের ওই "গঙ্গাপ্রসাদ হাউস" প্রাসাদের মাত্র একটি ছোটো ঘর খুলিয়ে সেটিতে সাদাসিধে ভাবে থাকতেন আমাদের সেজদাদু। ঘরটি ঝাড়ু দেওয়া, মোছা, স্পিরিট ল্যাম্প আর প্রাইমাস স্টোভে নিরামিষ রান্না করা, কুয়োয় বাসন মাজা, কাপড় কাচা সব নিজে হাতে করতেন। সে সব অন্য গল্প।

    ফিরে আসি - কয়েকটি দেওয়াল ছাড়া বাংলোটির বিশেষ কিছু তখন আর বাকি ছিলো না। কয়েক গজ পেছনেই ডাইনী বুড়ীর সেই ভল্লুক-সুরক্ষিত কুঁড়ে। তা ওসব ডাইনী টাইনী সত্বেও সোম-শুক্কুরের হাট ফেরৎ কয়েকজন মাঝি মাঝিন সেই ভাঙা দেওয়ালগুলির আড়ালে গিয়ে ভীষণ চেঁচামেচি করে শোনা গেলো। সদ্য-ভাঙা হাটের পর তখন ওদের ট্যাঁকে নগদ, পেটে চিংড়িভাজার সঙ্গে পর্য্যাপ্ত ইয়ে। তবে চেঁচামেচিটা কেন? কিসের জন্য?

    ভাবলুম একবার দেখা যাক। মানে গিয়েই দেখি একবার। যদিও সেদিন ছিলো শুক্লপক্ষের প্রতিপদ।

    তা গিয়ে দেখি ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। সেদিন সন্ধ্যের মুখে কুঁয়ারা বলে বসেছে যে তার অতি বিশ্বস্ত প্রাণের বন্ধু বাজারের ফড়ে রামপ্রসাদ, যার তেইয়ান (জামাইবাবু) লাগাতার তিন বছর পাদ্রীদের রবিবারের ইস্কুলে গিয়েছিলো, নিজে হাতে গুণে তাকে বলেছে যে সে সেদিন রোজগার করেছে বাইশ সিকে। আর তার পর দু'বোতল সরকারী খেয়ে সেই রোজগার কমে গিয়ে হয়েছে পঁচিশ সিকে। তখন তার বৌদি রুকমী বলেছে যে হ্যাঁ, ভারী তো বন্ধু, গুণতে গিয়ে কত সরিয়েছে কে জানে, বাজারী লোক ওরা, সব পারে। বন্ধুর নামে এমন অপবাদ সহ্য করা যায় না, তাই কাঁধ থেকে হাতে নেমে এসেছে কুঁয়ারার টাঙি, শুধু স্খলিত পায়ে ঝাপসা চোখে অমন তিথিতে কিছুই তার ঠাহর হচ্ছে না, তাই রক্ষে।

    এমন সময়ে রতনের আর আমার ধমক - অ্যাই কি হচ্ছেটা কি, বলবো গিয়ে কোতোয়ালীতে - ব্যস সবাই চুপ।

    সব কিছু শুনলাম আমরা। সকলের সব শিকায়ৎ, যার যা ফরিয়াদ। আপনারাও ব্যাপারটা শুনুন।

    সারাদিন হাটে একনাগাড়ে ঠকে যাওয়ার পর শুঁড়িখানায় একটু উত্তেজনা জুটিয়ে নিয়ে ফার্লং দুয়েক যেতে যেতে লোকগুলোর হুঁশ হতো - দেখি তো আজ কত রোজগার হলো?

    কিন্তু এইখানে সামান্য জটিলতার জাল আছে। সকালবেলা হাটে আসার সময় এরা হাতে করে কি এনেছিলো বেচবার জন্যে? পাঁঠা, শজারু, গোসাপ, মোরগ, হাঁস, ডাহুক, বটের, ডিম, ভুট্টা, রামকন্দ, কলাই, বেগুন ইত্যাদি। আমার পরিচিত একটি ছেলে একবার দুটি চিতাবাঘের বাচ্চা নিয়ে এসেছিলো - সে আবার আরেক কাহিনী।

    সন্ধ্যায় যা কিছু পণ্য ওদের হাতে পড়ে থাকতো বাজারের দোকানীরা জলের দরে ন্যাশানালাইজ করে নিতো। দু'একজন অবশ্য এমনিই রেখে দিতো পরের হাট পর্য্যন্ত, মাঝিরা তখন ভাড়া বাবদ সামান্য কিছু দিয়ে স্বীয় সম্পত্তি ফেরৎ নিতো।

    লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ঐ সব দ্রব্যের কোনো কিছুই ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গ্যারান্টিযুক্ত নয়। আর টাকাপয়সা তারা হাটে আনেইনি, পাছে কেউ ঠকিয়ে সেগুলো নিয়ে নেয়?

    এই অর্থনীতির অবধারিত অর্থ হতো যে আদিবাসীরা সে যুগে হাটের শেষে, একটু সরকারী খাবার পর হাতে যা নগদ থাকতো তাই লাভ বলে ধরে নিতো। কেউ মুদ্রা বা নোট তেমন চিনতো না, ঠিক মতো গুণতেও জানতো না।

    এদিকে কিন্তু প্রবল ইচ্ছে কত "লাভ" হয়েছে তা জানবার। তাই হাটের পরে সরকারী গেলবার জন্য শুঁড়িখানায় বসবার আগে বিশেষ পরিচিত, বাজারের "বন্ধু" দোকানীদের কাছে জেনে নেওয়া হতো লাভের সেই পরিমাণ। কুবেরের সেই ধন দোকানীরা গুণে দিতো।

    এসব সত্ত্বেও তাদের আবার ইচ্ছে হতো জানবার - এই রে, সরকারীর দোকানে তো আবার খরচা হয়ে গেলো, তাহলে শেষমেষ কত রোজগার হলো? মানে আজ কত লাভ হলো?

    সারাদিন ওরা পরস্পরের ওপর চোখ রাখতো - পাছে কেউ একজন কিছু একটা করে ফেলে যাতে ওদের গাঁয়ের সামাজিক ভারসাম্য ঢিলে হয়ে যায়। ফলে ওরা কমবেশী "জানতো" অন্যেরা কে কত নগদ রোজগার করলো।

    তা এ সবের মধ্যে রুকমী করেছে কি? কোথায় চুপচাপ পা চালিয়ে গাঁয়ে ফিরবে, তা না দেওর কুঁয়ারার বন্ধু দোকানদার রামপ্রসাদের নামে অন্যায় কথা বলেছে! হবে না গোলমাল?

    বুঝিয়ে টুঝিয়ে সবাইকে শান্ত করলাম আমরা। আর ওদের সর্বসম্মতিক্রমে সেইদিন থেকে ঠিক হয়ে গেলো যে এবার থেকে সোমবারের হাটের পর ওই পোড়ো বাড়িতেই সকলের রোজগার গুনে দেবে রতনা, আর শুক্কুরবারে গুনে দেবো আমি।

    হাস্যকরুণ হাটসাঁঝের সব ঝামেলা গেলো অমন করেই চুকে।

    আপনার জেবটা অত ভারী কেন? দিন, খুচরোগুলো গুনে দিচ্ছি, বাজারে গিয়ে নোট বানিয়ে নেবেন।



    অলংকরণ (Artwork) : দীপঙ্কর ঘোষ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments