• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | প্রবন্ধ
    Share
  • সহকারী থেকে পথ প্রদর্শক : পলাশ দে

    ক্রোড়পত্রঃ তরুণ মজুমদার (১৯৩১-২০২২)


    এক - ধুতি পাঞ্জাবি পরা এক তরুণ পথের পাঁচালী সিনেমা দেখার পর 'পথের পাঁচালী দেখুন' হাতে লেখা প্লাকার্ড নিয়ে নীরবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে তার সঙ্গে সামিল হল আরো কয়েকজন লোক। ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকল...

    দুই - 'ভাল ছবি আর জনপ্রিয় ছবি একই সঙ্গে হতে পারে, হওয়া সম্ভব, হওয়া উচিত, এটাই হলো মডেল।' যাঁর প্রতিটি কাজে চিরকালীন সত্য হয়ে উঠেছিল এই মন্ত্র।

    দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতিন বসু প্রমুখদের সঙ্গ একইসঙ্গে গণনাট্য সংঘ-সঙ্গীত--নাটক-আন্দোলন... আরেক দিকে বিভিন্ন ইউরোপিয়ান সিনেমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং চার্লি চ্যাপলিনের একের পর এক যুগান্তকারী ব্রহ্মাস্ত্র।

    স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারে বেড়ে ওঠা যুবকের সঙ্গে এক নেশা তাড়িত হতে থাকলো। সহজ সাধারণ মানুষের জীবন যাপন তাদের অনুভব দৃষ্টিভঙ্গি আর্থিক অনটন। কিন্তু সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এক অমোঘ লড়াই, যার নাম ভালোবাসা। এটাই সম্বল হয়ে উঠলো সেই যুবকের।

    অবজারভার, সহকারি পরিচালক হিসেবে কাজ করতে করতে সেই যুবকের ভেতরে নানান দৃশ্যকল্প তৈরি হতে থাকল, 'ইশ্, এই দৃশ্যটা যদি এভাবে নেওয়া যেত?' কিংবা 'ওই দূরের আকাশ থেকে ক্যামেরা সরতে সরতে একটা রাধাচূড়া গাছের পাশ থেকে যদি ক্লোজ থেকে লং শটে হেঁটে যেত চরিত্রটি!'

    উত্তম কুমারের চোখ এড়ালো না। এই যুবকের কাঁধে হাত রাখে, 'যদি সিনেমা পরিচালনা করতে চাও কখনো, আমাকে বলো' তৈরি হলো 'চাওয়া পাওয়া' -উত্তম সুচিত্রা। স্মৃতিটুকু থাক -সুচিত্রা সেন।

    ব্যাস, এই পর্যন্ত। 'কাঁচের স্বর্গ' তৃতীয় সিনেমা থেকেই তরুণ পরিচালক বেছে নিলেন নিজস্ব জগৎ। আর কোনো তারকা নয় বরং নতুন অভিনেতা অভিনেত্রী অথবা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত শিল্পীদের নিয়েই নির্মাণ করতে থাকলেন একের পর এক ভালোবাসার সিনেমা।

    কেমন সেসব ভালোবাসা? যেমন এক কিশোর কিশোরী বন্ধু দল গ্রাম বাংলা মাস্টারমশাই জমিদার সমেত গল্প। তার মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামী এক যুবক। সেই আশ্চর্য সিনেমাতেই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রেমের দৃশ্য রচনা করলেন পরিচালক। কিশোরী স্ত্রী যুবক স্বামীর পায়ে ভর দিয়ে আদর বিনিময় করছে। আমরা দেখতে পাই এক জাদু দৃশ্য। অথবা এক সহজ সরল ছেলে, যে চরিত্র গল্প বদলে গেলেও কখনো দাদার কীর্তি কখনো পলাতক বা কখনো ফুলেশ্বরী।

    তরুণ মজুমদার চিরকাল এইসব মানুষের কথা বলে এসেছেন যারা চালাক নয়। যাদের মধ্যে ছোট ছোট সংস্কৃতি বেঁচে আছে। যারা আড্ডা দেয়। মশকরা করে। বিপদে পড়লে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। যারা কাঁদে। সেই কান্নার পাশে আরো একজন। যারা হাসে। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ে দিক দিগন্ত।

    তাঁর সিনেমা দেখতে দেখতে বহু চরিত্রের মধ্যে আমরা নিজেকে সাবলীল ভাবে খুঁজে পাই। কষ্ট হয়, আনন্দ হয়। চিত্রনাট্যের ফাঁক ফোকরে মিশে থাকা আবেগ এবং তার কন্ট্রোল খুব সহজে আসে না। তার জন্য এক প্রাণ লাগে। যে প্রাণের উৎস ও চলাচল হতে হয় প্রবল ভাবে জিজ্ঞাসু।

    মানুষের সঙ্গে মিশে থেকে মানুষের ভেতর উগরে নিয়ে আসা সাধনার বিষয়। সেই সাধনা চিরকাল একান্তে করে এসেছেন মাস্টার শ্রী তরুণ মজুমদার...



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ তিমিরকান্তি ঘোষ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)