• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৭ | জুলাই ২০২২ | গল্প
    Share
  • একটি হালফিল সময়ের গপ্পো কিংবা প্রপঞ্চতন্ত্রের ভূমিকা : দিবাকর ভট্টাচার্য



    বহুকাল আগের কথা নয়। বরং বলা যায় এক্কেবারেই হালআমলের গপ্পো। কিংবা বলা যায় - নাহ্। সেকথা থাক। আমরা সরাসরি সেই গপ্পোতে আসি। যে গপ্পোটা হলো এই রকম –

    "জয়কালী করালবদনী! জয় মা!"- বললেন ঠাকুরমশাই। এক যজমানের বাড়ি থেকে একটা কচিপাঁঠা দান হিসেবে পেয়ে। গরিব পুরুতঠাকুর তো খুব খুশি হয়ে সেই পাঁঠাটার গলায় দড়ি বেঁধে নিয়ে চলেছেন রাস্তা দিয়ে। কোথাও সেটাকে বেচে দেবেন না কি নিজের জন্যই সেটির সদ্গতি করবেন তা তিনিই জানেন।

    কিন্তু যেটাই হোক না কেন তাঁর বড্ডো তাড়া। পাঁঠাটাকে নিয়ে হনহন করে চলেছেন তিনি ঠাঠা রোদ্দুরে রাস্তা দিয়ে। আর সেই রাস্তায় ওৎ পেতে ছিলো তিন জোচ্চোর। তারা পুরুতমশাইকে ওইভাবে ছাগল নিয়ে যেতে দেখেই একটা মতলব আঁটলো। মতলবটি হলো ছাগলটিকে হাতাবার। তারা সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিল কিভাবে এই কাজটা তারা হাসিল করবে। সেই অনুযায়ী যে যার জায়গা মতো দাঁড়িয়ে গেল বুদ্ধি করে।

    একটু বাদেই পুরুতমশাই শুনতে পেলেন পিছন থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলছে - "ঠাকুরমশাই! ও ঠাকুরমশাই!" উনি পিছনে ঘুরে দেখলেন একটা রোগা ঢ্যাঙামতো লোক একটা রকে বসে বলছে কথাগুলো। পুরুতমশাই ভাবলেন নিশ্চয়ই কোনো যজমান। উনি খুব উৎসাহে সেই লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন - "কি বলছ ভাই?"

    লোকটি আগের মতোই চেঁচিয়ে বলে উঠলো - "দিনদুপুরে একটা কুকুরের গলায় দড়ি বেঁধে সেটাকে এভাবে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন? কোনো মায়াদয়া নেই? অবলা জীবকে পুষবেন যদি তো তাকে একটু ভালোবাসতে শিখুন।"

    পুরুতমশাই খুব অবাক হয়ে একবার তাঁর সঙ্গের ছাগলটিকে ভালোভাবে দেখলেন। তারপর ওই ঢ্যাঙা লোকটির মুখের দিকে তাকালেন। এবার রাগে ফেটে পড়ে বললেন - "মস্করা হচ্ছে? আমার সঙ্গে ভরদুপুরবেলায় মস্করা হচ্ছে? এটা কুকুর? এটাকে কুকুর মনে হচ্ছে তোমার?"

    লোকটা উত্তর দিল - "অবশ্যই মনে হচ্ছে। কারণ পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি এই ঠাঠা রোদ্দুরে কি নিষ্ঠুর কাজ করছেন! বাচ্চা কুকুরটাকে দয়া করে কোলে করে নিয়ে যান। কিসের ঠাকুর সেবা করেন? জানেন না জীবেই শিব থাকে?"

    লোকটার কথা শুনে পুরুতমশাই থতমত খেয়ে গেলেন। আরেকটিবার সঙ্গের চারপেয়েটিকে ভালো করে দেখলেন। নাহ। কোনো ভুল নেই। সাদাকালো রঙের ছিটেয় নধর একটি ছাগলছানা। তাঁর মনে হলো ভরদুপুরে একটা পাগলের পাল্লায় পড়ে মাথা গরম করে লাভ নেই। বরং তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করাই ভালো।

    "জয় কালী করালবদনী! মা গো! তোমার ইচ্ছেয় কতদিন বাদে এমন দান পেলাম। এবার ভালোয় ভালোয় বাড়িতে পৌঁছোই মা!" - বলে তিনি আবার আগের মতোই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন নিজের বাড়ির দিকে। অবশ্যই সেই ছাগলটাকে সঙ্গে নিয়ে।

    *

    "ডালমেশিয়ান না স্প্যানিয়েল?" - প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলেন ঠাকুরমশাই। রোদ্দুর মাথায় করে হাঁটতে হাঁটতে শরীরটা খুব কাহিল লাগছিল তাঁর। তাই একটা গাড়িবারান্দার নীচে রকে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কখন যে দুচোখ বুজে আসছিল, তা তিনি টেরই পান নি। হঠাৎ শুনলেন পাশ থেকে কেউ যেন খুব মিহি গলায় বলছে এই কথাগুলো। চোখ কচলিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন একটি বেঁটেমতো টাকমাথা গোলগাল চেহারার লোক। চোখে নীলচে রোদচশমা। একগাল হাসি দেখিয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করল - "কতোয় দর রেখেছেন দাদু?"

    পুরুতমশাই রাগে ফেটে পড়লেন। চিৎকার করে বললেন - "দাদু? আমি তোমার কোন সম্পর্কের দাদু?"

    লোকটি আগের মতোই হাসিমাখা মুখে মিহিগলায় উত্তর দিল - "সরি মেসোমশাই। আসলে আমার শালা এই কুকুরবাচ্চার বিজনেস করে তো। আর আপনাকেও তো দেখেই বুঝেছি যে আপনিও -"

    "চোপরও!"- পুরুতমশাইয়ের চেঁচানিতে কথাটা থেমে গেল লোকটির। "এটা কুকুর? এটা কুকুর?" - বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলেন পুরুতমশাই। লোকটি বেশ আয়েশ করে ওই রকের উপর বসে পড়ে তার চোখ থেকে নীল রোদচশমাটা খুলে পুরুতমশাই ও তার সঙ্গের চারপেয়েটিকে একনজরে দেখে নিয়ে মুখের হাসিটাকে আরো চওড়া করে বললো -"এগজ্যাক্টলি। রেয়ার ব্রিড।"

    "দূর হও" - বলে একটা প্রচণ্ড চিৎকার করে পুরুতঠাকুর নিজেই গটগট করে দূর হয়ে গেলেন ওই জায়গাটা থেকে।" একটা জলজ্যান্ত ছাগলকে ইংরেজি নামের কুকুর বলে ফাজলামি করছে আমার সঙ্গে! মা! শক্তিরূপা মা আমার! তুমি এই অর্বাচীন পিশাচকে শাস্তি দিয়ো!” - রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলেন তিনি। সঙ্গের চারপেয়েটিও ঠিক তখনই ব্যা করে ডেকে যেন পুরুতমশাইয়ের কথাকেই সম্মতি দিল।

    *

    "বেদে আছে কুকুর অতি অপবিত্র জন্তু - কুকুরের দৃষ্টি পড়লে যজ্ঞ পণ্ড হয় - কুকুর কেবল শূদ্রের ঘরেই থাকতে পারে - তা সে বেদের কাল তো এখন আর নেই - সেই বর্ণাশ্রম প্রথাও উঠে গেছে কবে - তাই ব্রাহ্মণের সেই তেজ সেই মর্যাদা আজ কোথায় পাবো? তাই আপনার মতো লোক গলায় মোটা পৈতে ঝুলিয়ে কুকুর নিয়ে রাস্তায়-" লোকটির কথাটা মাঝপথেই থেমে যায় পুরুতমশাইয়ের উত্তেজিত কন্ঠে - "এটা কুকুর নয় - এটা ছাগল।" লোকটি অতি শান্তকন্ঠে উত্তর দেয় - "এত চেঁচিয়ে বলার কি প্রয়োজন? আমি তো দুহাত দূরেই আছি। আসলে আমি মশাই স্পষ্টবক্তা। সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলে এসেছি চিরকাল। তাই আপনার সঙ্গের এই কুকুর বাচ্চাটিকে আমি নিশ্চয়ই বাঘের বাচ্চা বলব না।" খুব কেটে কেটে নীচু গলায় কথাগুলো বললেন তিনি।

    পুরুতমশাইয়ের সামনে যেচেপড়ে এসেছে এই লোকটা। দেখে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলে মনে হয়েছিল পুরুতমশাইয়ের। লোকটি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন পুরুতমশাইকে - "কোথায় চলেছেন? কাঁধে পৈতের গোছা দেখে তো মনে হচ্ছে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ - তাহলে সঙ্গে আবার একে জুটিয়েছেন কেন? না কি যুধিষ্ঠিরের মতো স্বর্গযাত্রা করছেন?" পুরুতমশাই খুব বিরক্ত হয়ে বলতে যাচ্ছিলেন - "তাতে আপনার কি মশাই? আপনি যেচেপড়ে এত কথা বলছেন কেন?" কিন্তু পুরুতমশাইয়ের বলার আগেই আবার শুরু হলো সেই লোকটির আরেক প্রস্থ ভাষণ। নীচু গলায় গুছিয়ে গুছিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে - "বেদে আছে" ইত্যাদি ইত্যাদি।

    "আসলে আপনারও দোষ নেই। কি প্রচণ্ড রোদ। আর আপনার তো বয়স হয়েছে। এই বয়সে এতটা ধকল কি সহ্য হয়? শরীরের সব রক্ত জল হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। একটা ডাব খান যদি পারেন।" - আবার কথার বন্যা ভাসিয়ে লোকটি যেমন হুট করে সামনে এসে পড়েছিল তেমনিভাবেই কোথায় গায়েব হয়ে গেল কে জানে।

    *

    পুরুতমশাই কিন্তু এবার সত্যিই ঘাবড়ে গেলেন। একটা গাছের ছায়ায় বসলেন। ভাবতে লাগলেন - 'রাস্তায় যেতে যেতে পর পর তিন জন একই কথা বলল কেন? তিন জন কি একই সঙ্গে ভুল দেখল? তিনজনই কি তার সঙ্গে মস্করা করছে? এটা কি কখনো সম্ভব? নাহ। তা হতে পারে না। তাহলে এটা নিশ্চয়ই আমারই ভুল। কি দরকার এত ঝঞ্ঝাটের? তার চাইতে এটাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে ভালোয় ভালোয় বাড়ি ঢুকে যাই। তারপর যা হয় হোক।' তারপর নিজের মনেই বললেন - "জয়কালী! করালবদনী। জয় মা! তুই কি আমার পরীক্ষা নিচ্ছিস মা? আমি লোভী কিনা দেখতে? তাহলে রইল এই দান। তোর এই জিনিস তুই বুঝে না মা!" বলে সেই চারপেয়েটিকে রাস্তায় রেখেই হনহন করে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন তিনি।

    ছাগলটা হঠাৎ বিকটভাবে ব্যা ব্যা করে ডেকে উঠলো। পুরুতমশাই একবারের জন্যেও সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন না। ঠা ঠা রোদ্দুরে ছাগলটা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে ফের ব্যা ব্যা করে ডেকে উঠে যেন খুব করুণভাবে বলল - "আমি ছাগল। সত্যিই ছাগল। বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করো তোমরা।"

    *

    "শাট আপ! একদম স্পিকটি নট!! আর একটা কথাও যেন না শুনি তোর মুখ থেকে!" হঠাৎ গমগমে গলায় কে যেন বলে উঠলো তক্ষুনি। ছাগলটা থতমত খেয়ে দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে এক রোগা লম্বা মানুষ। কপালে বিরাট চন্দনের তিলক কাটা। মাথায় লম্বা টিকি। ধবধবে সাদা ধুতি চাদর পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দেখলেই কেমন যেন ভক্তি হয়। ছাগলটা আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তিনি বলে উঠলেন - "আমার নাম বিষ্ণুশর্মা। হাতে একদম সময় নেই। যা বলছি এখুনি সেইমতো কর। নইলে তোর আর বাঁচার উপায় নেই।"

    ছাগলটা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে খুব আলতো করে ব্যা করে ডেকে যেন বলল - "তার মানে?"

    বিষ্ণুশর্মা চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন - "তুই ব্যাটা ছাগল সেটা তো বিশ্বসুদ্ধু লোক জানে। সেটার মানেটা কি জানিস? সেটার মানে হলো যে তোকে জবাই হতে হবে। কারো না কারো হাতে। কোনো না কোনো দিন। এটাই তোর জীবনের একমাত্র গতি।"

    ছাগলটা অদ্ভুতভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকালো বিষ্ণুশর্মার মুখের দিকে। তারপর বলল - "আমার কি হবে? আমার মালিক আমায় ফেলে দিয়ে চলে গেল?" বিষ্ণুশর্মার মায়া হল ছাগলটার ওই দৃষ্টিটাতে। তিনি এবার আস্তে করে বললেন - "ওরে ছাগল! তোর মালিক তো তোকেই জবাই করবে। সেই জন্যেই তো সে তোর মালিক। আজ পুরুতমশাই তোকে ফেলে পালিয়েছে ওই তিন জোচ্চোরের ফাঁদে পড়ে। এবার ওই তিন জন আসবে। তোকে কেটে খাবে বলে। ওরা নাহলে ওই পুরুতমশাই তোকে বলি দিয়ে খেতো। ব্যাপারটা তো একই। জবাই তোকে হতেই হবে। কারণ তুই যে ছাগল। এটাই তোর ভবিতব্য।"

    ছাগলটা কেমন হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল বিষ্ণুশর্মার মুখের দিকে। বিষ্ণুশর্মা বললেন - "ওরে বাঁচতে চাস তো আমি যা বলি তা কর। হাতে সময় নেই। এখুনি ওই তিন জোচ্চোর এসে পড়বে।" ছাগলটা বিষ্ণুশর্মার দিকে তাকিয়ে ব্যাব্যা করে বললো -হ্যাঁ হ্যাঁ।

    বিষ্ণুশর্মা বললেন - শোন। একটুবাদেই ওরা এসে পড়বে। তুই তখন ওদের চিৎকার করে বলবি - "আমি কুকুর! আমি খুব উঁচু জাতের কুকুর। তোমরা একথাটা ভালো করে শুনে রাখো। আর মনে রাখো।"

    ছাগলটা বিষ্ণুশর্মার কথা শুনে একটানা ব্যাব্যা ব্যাব্যা করে বলতে লাগলো - "তা কি করে হবে? আমি তো কুকুর নই। একথা শুনলে ওরা আমাকেই ধরে মারবে। এমন মিথ্যে আমি কি করে বলব?"

    "মিথ্যে? তুই একটা পাঁঠা, সত্যি মিথ্যের তুই কি বুঝিস? তোর মুখে আমি ভাষা দিলাম। তোর কাজ হচ্ছে কেবল গলা ফাটিয়ে এই কথাগুলো বলা। এরপর কি হয় দ্যাখ। নয় তো হাঁড়িকাঠে চড়ার জন্য তৈরি হ।" - উনি রেগে গিয়ে খুব চেঁচিয়ে বলে উঠলেন এই কথাগুলো।

    ছাগলটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো বিষ্ণুশর্মার মুখের দিকে। বিষ্ণুশর্মার একটু মায়া হলো ছাগলটার ওই দৃষ্টিটা দেখে। এবার উনি খুব নরম গলায় বলতে শুরু করলেন - "শোন। তুই কি হয়ে জন্মেছিস সেটা কোনো ব্যাপার নয়। আসল ব্যাপার হলো তুই নিজেকে কি মনে করছিস। এবং সেটা সবার কাছে কিভাবে মেলে ধরছিস। এই মনে করাটাই হচ্ছে বেসিক প্ল্যাটফর্ম। এর ওপর দাঁড়িয়ে তোকে নিজেকে সবার কাছে প্রোজেক্ট করতে হবে। এই প্রোজেকশনটা একটা আর্ট। হায়েস্ট লেভেল অফ পারফর্মিং আর্ট। এই আর্টটা ঠিকমতো রপ্ত করলে তুই যা চাস তাই হতে পারবি। কুকুর তো তুচ্ছ, একটা আস্ত মানুষ হয়ে যেতে পারবি তখন। আর মানুষ হলে সবচেয়ে সোজা বুদ্ধিজীবী হওয়া। তা সেসব পরে হবে খন। এইসব করতে গেলে সবার আগেই যেটি চাই সেটি হলো মুখের ভাষা। ভাষার বাহার। সেই ভাষাটা আমি তোর মুখে এনে দিচ্ছি একটা ম্যাজিক করে। বাকিটা তোর ব্যাপার।"

    একটানা এতগুলো কথা বলে যেন একটু হাঁপিয়ে গেলেন বিষ্ণুশর্মা। ছাগলটা কিন্তু একবারে স্থির হয়ে একদৃষ্টে বিষ্ণুশর্মার মুখের দিকে তাকিয়ে শুনছিল কথাগুলো। কিন্তু সে আস্ত পাঁঠা তো। তাই তার মাথায় এসব কথা কি ঢুকলো কে জানে। কিন্তু তার কানদুটো সমানে লটরপটর করতে লাগলো এই কথাগুলো শোনার পর।

    *

    "আমি একটি কুকুর। শুধু কুকুর নই দস্তুরমতো একটি উঁচু জাতের কুকুর” - মুখ তুলে গলা ফাটিয়ে বলল সেই ছাগলটা।

    "এ কি রে! এই ছাগলটা কেমন যেন কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছে। ব্যাপারটা কি হলো বলতো? - বলল সেই রোগামতো ঢ্যাঙা চেহারার প্রথম জোচ্চোরটা।

    "ছাগলটা এই গরমে পাগল হয়ে যায় নি তো?" - বলল সেই বেঁটেমতো মিহি গলার দু নম্বর ঠকবাজটা।

    "নাহ্। এ ছাগলকে জবাই করে খাওয়া যাবে না। ওই হতচ্ছাড়া বামুনটা নির্ঘাত কোনো মন্ত্রতন্ত্র করে এই ছাগলটার মধ্যে একটা কুকুরের আত্মাকে পুরে দিয়েছে। এই ছাগলটাকে যে মারবে অমনি ওই আত্মাটা তার ঘাড়ে এসে বসবে। আমি বাবা এসব অশুভ আত্মাটাত্মার মধ্যে নেই।" - প্রায় ফিসফিস করে বলে উঠলো তিন নম্বর বজ্জাতটা।

    "না না আমারও মন সায় দিচ্ছে না এই রকম বিদঘুটে ব্যাপারে"- বললো ঢ্যাঙাটা।

    ঠিক সেই সময় বিকট চিৎকার করে ছাগলটা বলে উঠলো - "জানো আমার শরীরে খোদ জার্মান রক্ত। আমার ট্রেনিং মিলিটারিতে?"

    "উরে ভাই। চল পালাই!" - বলে লাফিয়ে উঠলো বেঁটে শয়তানটা।

    এর পর তিনটি জোচ্চোরই সেইখান থেকে দৌড় মারলো। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ছাগলটা ফাঁকা মাঠে একা দাঁড়িয়ে তার পা ঠুকতে লাগল।

    "এক্সেলেন্ট! এক্সেলেন্ট" - বলতে বলতে হইহই করে তখন সেখানে আবার এসে হাজির হলেন বিষ্ণুশর্মা। "দেখলি তো কি ভাবে বেঁচে গেলি!" - হাসতে হাসতে বললেন বিষ্ণুশর্মা। ছাগলটাও মহা খুশি হয়ে তার পাদুটো সামনের দিকে তুলে ব্যাব্যা করে বলে উঠলো - "বলুন বলুন এবার আমি কি করবো?" বিষ্ণুশর্মা এবার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন - ভাবো! নিজের সম্পর্কে বিরাট করে ভাবো! নিজেকে একটা বিশাল মাপের বলে ভাবা প্র্যাকটিস করো।" ছাগলটা এবার তার কানদুটো লটরপটর করে নাড়তে নাড়তে বললো - "নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই! কিন্তু তারপর কি হবে? আমায় আবার কেউ জবাই করতে আসবে না তো?" বিষ্ণুশর্মা হো হো করে হেসে উঠে বললেন - "জবাই? তোকে? আরে তুই তো ততদিনে সেলিব্রেটি হয়ে গেছিস রে! সেলিব্রেটি বুদ্ধিজীবী হয়ে গেলে তো তোকে আর পায় কে! তুই তো দাঁড়িয়ে থাকবি ক্ষমতার চেয়ারের পাশটিতেই! কে তোকে ছুঁতে সাহস করবে?" ছাগলটা কি বুঝলো কে জানে। সে চাপা গলায় ডেকে উঠলো - "ব্যা হ্যা হ্যা হ্যা"। বিষ্ণুশর্মা বলে উঠলেন - "কারেক্ট। এবার আমি আসি!"

    *

    এই ঘটনার বেশ কিছুকাল পরে বিষ্ণুশর্মার হঠাৎই এক রাতে মনে হলো - 'আচ্ছা! ওই ছাগলটার কি হলো? ওকে যেমনটি বলেছিলাম তেমনটি ঠিক করতে পেরেছিলো তো? না কি জবাই হয়ে গেল এদ্দিনে?' এইকথা ভেবে তিনি ঠিক করলেন যে আগামীকাল সকালেই যাবেন যেখানে সেই ছাগলটাকে দেখেছিলেন তিনি।

    যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন সকালেই বিষ্ণুশর্মা হাজির হলেন ঠিক সেই জায়গায় যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন সেই ছাগলটাকে। তারপরেই তাঁর মনে হলো কি বোকামি করতে চলেছেন তিনি। একটা ছাগলকে এতদিন বাদে এইভাবে খুঁজে পাওয়া তো অসম্ভব। কিন্তু যা ঘটলো তা যাকে বলে অকল্পনীয়।

    বিষ্ণুশর্মা দেখলেন যে সামনেই একটা জায়গায় বেশ জটলা হয়েছে। কি ব্যাপারটা হচ্ছে দেখতে এগিয়ে গেলেন তিনি। শুনলেন যে এক হোমরাচোমড়া কেউ সেখানে এসে কিছু বলবেন। সবাই তার বক্তব্য শোনার জন্য সেখানে ভিড় করেছে। বিষ্ণুশর্মাও খুব আগ্রহে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

    একটু বাদে তিনি এলেন। এবং বলতে শুরু করলেন - "আজকে যে তোমরা এই আমাকে দেখছো” - লোকেরা মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলো। কিন্তু বিষ্ণুশর্মার তখন চোখ কপালে উঠে গেছে! তিনি নিজেই নিজেকে বললেন - "আমার কথার এত জোর এ আমি ভাবতেই পারছি না!" কারণ সবাই যাকে ধোপদুরস্ত এক কেউকেটা বলে দেখছিল, তাকে বিষ্ণুশর্মা একটা ধেড়ে ছাগল হিসেবে দেখছিলেন!

    বিষ্ণুশর্মা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে এইই সেই ছাগল যাকে পুরুতঠাকুর রাস্তায় ফেলে পালিয়েছিলো, যাকে তিনি সেই তিন ঠকবাজের হাতে জবাই হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন কথার জোরে একটা দারুণ ফন্দি করে। কিন্তু তাঁর কথাগুলো এভাবে প্র্যাকটিস করতে করতে ছাগলটা যে সত্যিসত্যিই এমন একটা তালেবর হয়ে যাবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। একটা রামছাগলের কথা এইসব লোকজন এত ভক্তিভরে শুনছে! তিনি নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

    যাইহোক বিষ্ণুশর্মাও ধুরন্ধর লোক। তিনি তক্কেতক্কে রইলেন কখন তাকে ফাঁকা পাওয়া যায়। কিন্তু তা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু বিষ্ণুশর্মা তো নানান রকমের কৌশল জানতেন। সেইমতো কৌশল করেই তিনি হাজির হলেন সেই ছাগলটার সামনে। মধ্যরাতে।

    "যাক। তাহলে আমার কথাগুলো ফলো করে তুই তো এখন বেশ কেউকেটা হয়ে গেছিস দেখছি" - এইভাবেই কথা শুরু করলেন বিষ্ণুশর্মা। সেই 'কেউকেটা' হয়ে যাওয়া ছাগলটি গম্ভীরভাবে উত্তর দিল - "কে আপনি? আমি তো কাউকে ফলো করি না। সবাই আমাকেই ফলো করে। মনে হয় কিছু ভুল হচ্ছে আপনার।" বিষ্ণুশর্মা হইহই করে বলে উঠলেন - "ওরে আমি সেই বিষ্ণুশর্মা, যে তোকে বাঁচার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল - অনেককাল আগে - তুই যখন একটা কচিপাঁঠা ছিলিস!" এবার সেই ছাগলটা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে আরো গম্ভীর হয়ে উত্তর দিল - "হ্যাঁ। মনে পড়েছে। কিন্তু আপনি আবার এখানে এলেন কেন?"

    বিষ্ণুশর্মার মাথায় এবার একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। মুখটা কাঁচুমাচু করে ধরাধরা গলায় বললেন - "বড়ো দুর্দিন এসেছে রে ভাই। যে রাজার বাড়িতে কাজ করতাম এখন সে রাজাও নেই। আর সেই চাকরিও নেই। তাই লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেই করতে করতে তোদের এখানে আবার এসে পড়লাম। এসে তো দেখছি তুই কতো নামজাদা হয়ে গেছিস। তোর কি প্রতিপত্তি।" উল্টো দিক থেকে ছোট্ট করে উত্তর এলো - "হুম।" তখনই তার মনে হলো - 'এ তো আবার খুব ভালোই যোগাযোগ হলো। এই বিষ্ণুশর্মার দেওয়া কৌশলেই সে আজ এইভাবে এত নামডাক করেছে - তাহলে এর থেকে আরো কিছু বুদ্ধি হাতিয়ে অনায়াসে এখানকার সবচেয়ে উঁচু চেয়ারটায় বসা যাবে।'

    এইবার সে খুব গম্ভীর গলায় কেটে কেটে এই কথাগুলো বলল - "হ্যাঁ। তা একটু নামডাক হয়েছে বটে কিন্তু আমার যা লক্ষ্য তার কাছে পৌঁছতে পারিনি। তুমি যদি আমায় ফের বুদ্ধি বাতলে দাও তো আমি আবার চেষ্টা করতে পারি। তা তুমি ইচ্ছে করলে এখন থেকেই আমার কাছে কাজ করতে পারো - এককালে তুমি আমার উপকার করেছিলে - তাই তোমার এই কষ্টের সময়ে আমি নিশ্চয়ই তোমার খাওয়াপরার ভার নেবো - এখন থেকে যদি আমিই তোমার মালিক হই..."

    শেষ কথাগুলো শুনে বিষ্ণুশর্মা একেবারে থ হয়ে গেলেন। যাকে বলে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গেই নিজেকে সামলে নিয়ে খুব মোলায়েম গলায় বললেন - "যাক। তোমার কাছে এসে আমার একটা হিল্লে হয়ে গেল ভাই। তুমি যা চাইছো তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তুমি চাইছো ওই সবচেয়ে উঁচু চেয়ারটায় বসতে। ওটা কোনো ব্যাপারই নয়। তুমি তো জানো কতো কৌশল জানা আছে আমার। কিন্তু তুমি আমায় কটাদিন সময় দাও। তোমাদের এই জায়গাটা একবারটি ভালো করে ছদ্মবেশে ঘুরে নিই। এখানকার লোকজনদের হালহকিকত একটু বুঝে নিই। এদের চিন্তাভাবনা ভাষাটাষা সব বদলে গেছে তো। সেগুলো একটু জানতে হবে যে।"

    ছাগলটা খুব খুশি হয়ে বলে উঠলো - "বেশ বেশ। কিন্তু এতকিছু বদলে গেল বলে মনে হচ্ছে তোমার?"

    বিষ্ণুশর্মা বলতে যাচ্ছিলেন - অবশ্যই। এখানকার লোকগুলো আজ এতটাই পাঁঠা হয়ে গেছে রে যে তুই আজ এদের মধ্যে কেমন বড়ো মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। তুই আজ ছাগল হয়েও আজ এখানে বুদ্ধিজীবী হয়েছিস কারণ তোর চারপাশের লোকগুলো সবাই কেমন রামছাগল হয়ে গেছে কি করে কে জানে। কিন্তু তিনি তা না বলে একগাল হেসে বললেন - "কারেক্ট।" তারপর বললেন – “তা হলে এবার আমি আসি। কিছুদিন বাদেই ফিরে আসছি।" ছাগলটি বলল - "নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই।"

    বিষ্ণুশর্মা মনে মনে বললেন - "ছাগল কোথাকার।" তারপর রওনা হলেন এই ভাবতে ভাবতে - 'এককালে পাঁঠা হয়ে জন্মানো কটি রাজপুত্রকে মানুষ করার জন্য তিনি লিখেছিলেন 'পঞ্চতন্ত্র'। এবার পাঁঠা হয়ে যাওয়া কিছু ব্যক্তিকে আবার মানুষ হওয়ানোর জন্য তাঁকে ফের কলম ধরতে হবে আবার। আবার লিখবেন কিছু বৃত্তান্ত। যার নাম দেবেন – ‘প্রপঞ্চতন্ত্র’।

    এই হলো গপ্পোটা।

    এক্কেবাবেই হালআমলের গপ্পো।

    কিংবা প্রপঞ্চতন্ত্রের ভূমিকা।


    (কাহিনীটি বিষ্ণুশর্মা রচিত বিখ্যাত কথামালা "পঞ্চতন্ত্র"-র অন্তর্ভুক্ত একটি কথিকার দ্বারা প্রাণিত।)



    অলংকরণ (Artwork) : রঞ্জন ভট্টাচার্য
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments