• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮৯ | জানুয়ারি ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ত্রাস : কৌশিক সেন



    লেখকের বক্তব্য- এই উপন্যাস ২০২০-২০২১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তথা পৃথিবীর এক গভীর অসুস্থতার সময়ে লেখা। কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত অতিমারীর আবহে কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী ও তাদের পরিবারের মানুষদের লড়াই করার এই কাহিনী অনেকটাই লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। সে লড়াই শুধু হাসপাতাল আর ল্যাবরেটরিতে অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধেই নয়। সমাজের প্রতিটি স্তরে জমাট বেঁধে থাকা দম্ভ, মূর্খামি, কুসংস্কার আর কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে তাদের। সে লড়াই এখনো শেষ হয়নি।

    এই বইয়ের সব উদ্ধৃতি আলবেয়ার কামুর সুবিখ্যাত La Peste উপন্যাসের ইংরাজি অনুবাদ থেকে নেওয়া।

    ।।১।।
    To state quite simply what we learn at the time of pestilence; that there is more things to admire in men than to despise.
    “আমার ভীষণ ভয় করছে রনি। আই অ্যাম প্যানিকিং! তুমি রোজ এত দেরি করে বাড়ি ফিরো না প্লীজ!! আমার কথাটা একটু ভেবো” টেলিফোনটা কানের ওপরে চেপে ধরে প্রায় ধরা গলায় বললো নিপু । কথাগুলো নিজের কানেই বোকা বোকা মেলোড্রামাটিক শোনালো, তখন ফোনটা সোফার ওপরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো ও। এপ্রিল মাস, বস্টন শহরে বসন্ত এসে গেছে, কিন্তু এ এক অসুস্থ অপরিচিত বসন্ত কাল। এখনো বিকেল, হাওয়ায় উড়ছে চেরিফুলের পাপড়ি আর পাইনগাছের রেণু। শেষ বিকেলের রোদ্দুর অ্যাজেলিয়া ঝোপের ওপর যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দেখতে দেখতে রোদ্দুর নিভে যাবে, অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, তার সাথে সাথে চেপে ধরবে একাকীত্ব। যদিও শহরের সবাই ওরই মতন গৃহবন্দী তাও দিনের বেলায় অফিসের ওয়ার্ক ফ্রম হোম, বন্ধুদের ফোন আর মেসেজ, মাঝে মাঝে জুম মিটিং, এইসব নিয়ে সময়টা মোটামুটি কেটে যায় নিপুর। কিন্তু সন্ধ্যা নামতে শুরু করলে, পাইন গাছের ছায়ারা যখন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে ওর জানলার ওপর হালকা ধূসর রঙের পর্দা টেনে দেয়, ঠিক তখনই ভেতর থেকে একটা ফাঁদে পড়া জন্তুর আর্তনাদ শুনতে পায় ও। পাগলের মতন সারা বাড়ির আলো জ্বালিয়ে দিয়ে অকারণ অথচ অশুভ আশংকায় ছটফট করতে থাকে নিপু। মেঘলা দিনে যখন রোদ্দুর ওঠে না তখন সেই দমবন্ধ ভাবটা সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায়। কাজে মন বসে না, ইচ্ছে করে ল্যাপটপটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গাড়ি নিয়ে কোথাও বেরিয়ে যায়। কিন্তু যাবেই বা কোথায়, এতদিন যেসব জায়গা ওর প্রিয় গন্তব্য ছিল যেমন কিনা বইয়ের দোকান, ফার্মার্স মার্কেট কিংবা কফিশপ, সে সবই তো এখন তালাবন্ধ। তারপর রাত যত গভীর হতে থাকে, রণজিৎ হাসপাতাল থেকে ফেরার নামই করে না, ঠাণ্ডা খাবার নিয়ে টেবিলে বসে থাকতে থাকতে ঝিম ধরে যায় নিপুর। বারান্দায় বেরিয়ে ও তখন আকাশের দিকে তাকায়। মনে হয় যে গ্রহতারাদের জগতে এই পৃথিবী গ্রহটাই হয়ত এখন ব্রাত্য, অসুস্থ, নিভৃতবাসিনী।

    রাত এখন সাড়ে নটা, অবশেষে রণজিৎ ফিরেছে। ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ওকে তাও দু একটা অভিমানের কথা না বলেও তো পারবে না নিপু। লোকটা যদিও ওসব কথায় কান দেবার পাত্র নয়।

    “প্যানিক করলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না,” হাত ধুতে ধুতে অসম্ভব শান্ত গলায় রণজিৎ বলল। এবার ও জামাকাপড় খুলে ওয়াশারে দেবে, স্নান করবে, তার আগে ওকে কেউ ছুঁতে পারবে না। ততক্ষণে আশংকার বদলে একটা অদ্ভুত অসহায় রাগ এসে চেপে ধরবে নিপুকে। সামনের মানুষটা বারো ঘণ্টা কাজ করে ফিরেছে, তার এখন আদর দরকার, বিশ্রাম দরকার অথচ রোজ ঠিক এইরকমটাই হয়। অক্ষম রাগটা ঠিক ওর ওপরেই গিয়ে পড়ে।

    “একলা একলা বসে এইসব খবর দেখতে শুনতে কেমন লাগে তুমি কি করে বুঝবে রনি? আচ্ছা শহরের সব ডাক্তার কি তোমার মতন সারাদিন হাসপাতালে আর ল্যাবে বসে আছে। না নেই, কারণ তারা ফ্যামিলির কথাটাও ভাবে।” খাবারগুলো মাইক্রোওয়েভে ঢোকাতে ঢোকাতে নিপু বলল। বাসনপত্র নাড়ানাড়ি করার সময় অকারণেই বেশি করে ঠোকাঠুকির আওয়াজ উঠছে, রাগের মাথায় কাজ করলে যেমনটা হয়।

    “ফ্যামিলির কথা সবাই ভাবে নিপু। সবাই হাসপাতালে বসে নেই কেননা ভিড় বাড়ালেই কাজ ভালো হয় না। যাদের দরকার শুধু তারাই আছে, যেমন আমার মতন ইনফেকশাস ডিজিস স্পেশালিষ্টরা আছে, এমার্জেন্সি স্টাফ, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, ইনটেন্সিভ কেয়ার আর পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের লোকজন, তারা সবাই রয়েছে।”

    “থাক থাক আমার আর লিস্ট শুনে কাজ নেই। খাবার গরম করে দিচ্ছি, দয়া করে খেয়ে উদ্ধার করো।”

    “আরে তুমি দেখছি ঠিক মায়ের ভাষায় কথা বলছো,” রণজিতের ক্লান্ত মুখের ওপর দিয়ে একটুকরো হাসি খেলে গেল হঠাৎ। গড়পড়তা বাঙালি পুরুষমানুষের তুলনায় ওকে বেশ লম্বা চওড়াই বলতে হবে, পরিশ্রম করার ক্ষমতাও ওর অসীম। অল্প বয়েস থেকেই ওর চুল হালকা হতে শুরু করেছিল, এখন মাথার সামনের দিকে পুরোটাই ইন্দ্রলুপ্ত। নিপুণার অনেক সময় মনে হয় যে ওর মুখের সঙ্গে তাবৎ বাঙালির খুব পরিচিত একটা মুখের বেশ খানিকটা মিল আছে, কিন্তু আজ অবধি সেকথা ও মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি। সেই লোকটির নাম সুভাষচন্দ্র বসু, রণজিতের লাইব্রেরী ঘরের দেওয়ালে ওঁর একটা ছবি ঝোলানো রয়েছে। শুধুমাত্র বিরাট চওড়া কপাল আর গোল চশমাই নয়, রণজিতের মুখের মধ্যে দৃঢ়তা আর কোমলতার এক অদ্ভুত মিশ্রণ রয়েছে, ঠিক যেমনটা ওই ছবির মুখে। হয়তো সেইজন্যেই ওর হাসি দেখে নিপুর অর্ধেক রাগ জল হয়ে যায়।

    ওরা দুজন, রণজিৎ আর নিপুণা চ্যাটার্জি ওরফে রন আর নিপু, বস্টন শহরের অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। অধ্যাপক ডক্টর রন চ্যাটার্জি যতটা ডাক্তার ততটাই গবেষক এবং অসভ্য রকমের কাজ-পাগল। যেমন কিনা এই মুহূর্তে ওর শরীরটা বাড়িতে হাজির হলেও নিপু জানে যে মানসিকভাবে ও এখনও কাজের দুনিয়ায়, ওর চোখদুটো ল্যাপটপের পর্দার ওপরে স্থির, ওর আঙুলগুলো কীবোর্ডের ওপর অভ্যস্ত দক্ষতায় দৌড়ে চলেছে। রাত এখন সাড়ে দশটা, ও বাড়ি ফিরেছে মিনিট পঁয়তাল্লিশ হবে, এর মধ্যেই ডিনার সেরে আবার ল্যাপটপ নিয়ে ধ্যানস্থ। এক এক সময় ওর এইরকম তন্ময় নির্লিপ্ততা দেখে অসহ্য লাগে নিপুর। মনে হয় একটা হতচ্ছাড়া ল্যাবরেটরির সঙ্গেই বুঝি বিয়ে হয়েছে ওর। মনে পড়ে যায় উনিশ বছর আগের সেই ভয়ংকর দিনটার কথা, যখন ও এদেশে নতুন, সদ্যবিবাহিত, রণজিৎ নিউ ইয়র্ক শহরে রেসিডেন্সি করছে। আকাশছোঁয়া দুটো বাড়ি যখন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, ক্রোধে হুংকার দিয়ে উঠেছে দেশ, ক্ষুদে ক্ষুদে দুটো বাচ্চা আগলে পুরো তিনটে দিন ওকে ফাঁকা বাড়িতে বসে থাকতে হয়েছিল। রন হাসপাতাল থেকে ফেরেনি, ফোনে কথা বলতে গেলেও বিরক্ত হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে কাঠ হয়ে থেকেছিলো ও। একলা অ্যাপার্টমেন্টের অচেনা অন্ধকার ভেদ করে প্রতিবেশীদের খরদৃষ্টি ওকে যেন গিলে খেতে এসেছিল পুরো সময়টা। চার দিনের দিন বাড়ি ফিরে রন সব শুনেছিল তারপর শান্ত অথচ কঠিন গলায় উত্তর দিয়েছিল প্রতিটি অভিযোগের। সেই কথাগুলো আজও মনের মধ্যে গেঁথে রয়েছে নিপুণার।

    “শোনো নিপু, এই মুহূর্তে তোমার আমার ব্যক্তিগত ফীলিংসগুলো মোটামুটি অবান্তর। বিরাট একটা দুর্ঘটনায় হাজার চারেক লোক মারা গেছে, আহত হয়েছে অন্তত ছয় হাজার। যারা মারা গেছে তাদের কথা না’হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু যারা সারভাইভ করেছে দে নিড ট্রিটমেন্ট তাই এরকম সময়ে আমার হাসপাতাল ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। এর পরে অনেক পলিটিক্যাল নাটক হবে, অনেক রথী মহারথীর মাথা কাটা যাবে, সাধারণ মানুষের কি যে ভোগান্তি হবে তা ভগবানও জানেন না কিন্তু সেসব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। আমার কারবার শুধু সামনে শুয়ে থাকা অসহায় আহত মানুষগুলোকে নিয়ে। যতক্ষণ না তাদের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হচ্ছে ততক্ষণ অবধি নিজের কথা ভাবার সময় নেই আমার। কথাগুলো সিনেমার ডায়ালগের মতন শোনালেও ডাক্তার হিসাবে এটা আমার কোড অফ এথিকস, আমার বিশ্বাস। কোনো একটা বিশ্বাস ছাড়া মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না নিপু।”

    সেই প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে এইরকম কেতাবি বাংলাতেই কথা বলতো রন। প্রচণ্ড রাগ হতো, আবার তার পরেই কোত্থেকে ভালোবাসার ঢেউরা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেত সব অভিমান। এইভাবেই কখন রেসিডেন্সির দিনগুলো ফুরিয়ে গেল, রন ঝড়ের গতিতে ফেলোশিপ শেষ করে প্রথমে জুনিয়র, তারপরে সিনিয়র ফ্যাকালটি। সাফল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ওর ব্যস্ততাও যেন বেড়েই চলেছিল প্রতিদিন। নিপুও পিছিয়ে থাকেনি, নতুন করে পড়াশুনো করেছে, নতুন ডিগ্রি নিয়ে, চাকরিতেও ঢুকেছে যথাসময়ে। এরই মধ্যে কখন যে ওর ক্ষুদে মানুষদুটো, হাঁটতে, কথা বলতে শিখল, স্কুল পেরিয়ে কলেজে গেল, সেসব ভাবতে গেলে তাজ্জব লাগে এখন। মনে হয় বছরগুলো ঠিক যেন কোনো লম্বা টেলিভিশন সিরিয়ালের এক একটা এপিসোড। বানানোর সময় কত না পরিশ্রম আর উৎকণ্ঠা কিন্তু ফিরে দেখলে মনে হয় সবটাই বেশ সহজ আর স্বাভাবিক, যেমনটা হবার কথা ঠিক তেমনটাই হয়েছে। ইচ্ছে হলে, সময় থাকলে রিওয়াইন্ড করে বিঞ্জ ওয়াচ করতে বেশ লাগে। কোনো এপিসোড হয়তো হাসি দিয়ে শেষ, কোনো এপিসোড কান্নায়, কিন্তু মোটের ওপরে সিরিয়ালটা বেশ ভালোই, স্বচ্ছন্দে আর পাঁচজনকে ডেকে দেখানো যায়। ঘরের মানুষটি বড়ো ডাক্তার তো বটেই তার ওপর আমেরিকার বিখ্যাত একটা ইউনিভার্সিটির টেনিওরড অধ্যাপক। ওর নিজেরও একটা চমৎকার মাঝারিগোছের চাকরি আছে, খুব উঁচুস্তরের নয় যে ঝড়ে উড়ে যাবে, খুব নিচুতেও নয় যে ছাগলে মুড়োবে। ওদের দুটি ছেলেমেয়ে, দুজনেই বুদ্ধিমান, সুস্থ স্বাভাবিক, যে যার পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত, তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। নিপুর একমাত্র বোন, যার নাম অপর্ণা ওরফে অপু থাকে দেশের অন্যপ্রান্তে, সানফ্রান্সিস্কো শহরে। অপুর বর এঞ্জিনিয়ার, কিন্তু বছর দশেক হয়ে গেল সে চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় নেমেছে, সেই ব্যবসা এখন যাকে বলে জমজমাট। সব মিলিয়ে নিপুর জীবনটা অনুকূল বাতাসে পাল তুলে ছুটে চলেছিল এতদিন। ছেলেমেয়েরা কলেজে চলে যাবার পর কর্তা-গিন্নি মিলে খুব করে দেশ বেড়াতে শুরু করে দিয়েছিলো ওরা, আজ ইউরোপ যায় তো কাল পাড়ি দেয় দক্ষিণ আমেরিকায়। দেশ দেখতে নিপু খুব ভালোবাসে, ওর পীড়াপীড়িতে রনও কাজের চাপ কমিয়ে ছুটি নিতে শুরু করেছিল দেদার। দিনরাত্তির ক্লিনিক আর ল্যাবরেটরিতে পড়ে থাকার বদলে বউয়ের সঙ্গেও বেশ খানিকটা সময় কাটাচ্ছিল গত কয়েক বছর। এদিকে বিস্তর খরচ করে নিজের চেহারাটা বেশ পালটেই ফেলেছিল নিপু। নিয়মিত জিমে যেত, সপ্তাহে অন্তত তিনদিন সাঁতার কাটতো, মিষ্টি খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল অনেক। চুলটা কায়দা করে কেটেছেঁটে, কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করিয়ে একদম নতুন রকম করে ফেলেছিল। কলেজ জীবনে ওর ভক্তের সংখ্যা কম ছিলো না কিন্তু বিয়ের পরে কাজ আর সংসারে মজে নিজের দিকে নজর দেওয়া ছেড়েই দিয়েছিল এক্কেবারে। এতগুলো বছর কেটে যাবার পর আবার ওর শরীরে পুরনো বসন্তের হাওয়া বয়েছিল, ফাঁকা বাড়িটার মধ্যে দুজন অতি চেনা মানুষ আবার অচেনা চোখে তাকিয়েছিল পরস্পরের দিকে। হারিয়ে যাওয়া আকর্ষণ, শরীর আর মনের অবাধ ঘনিষ্ষ্ঠতাকে আবার নতুন করে ফিরে পাবার চেষ্টায় ছিল ওরা। এতদিনে মনে হয়েছিল ঝড়ঝাপটার দিন শেষ। কাজ আর খেলার মধ্যে একটা নিটোল সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছে ওরা দুজনে, এখন থেকে জীবনতরী মন্দাক্রান্তা ছন্দে বয়ে যাবে। ভাবতেও অবাক লাগে কেমন করে সব একদিন থমকে দাঁড়িয়ে গেল, ভয়ের সবুজ কুয়াশা এসে ঢেকে ফেলল তামাম দুনিয়া। এই অদ্ভুত সময়ের অশনি সংকেত অবশ্য রনের কাছ থেকেই এসেছিল, আকাশ যখন ঝলমলে পরিষ্কার। রোদ্দুর ভরা ওদের আউটহাউসে বসে আগামী ছুটির পরিকল্পনা করছিল নিপু।

    “এক্ষুনি টিকিট কেটো না, কদিন অপেক্ষা করো।” রন বলেছিল সেদিন। নিপুর খুব রাগ হয়েছিল কথাটা শুনে।

    “কেন বলো তো? প্রিন্সেস কোম্পানির মেডিটেরেনিয়ান ক্রুজ, রোম থেকে পম্পেই হয়ে অ্যাথেন্স। নাকি তুমি সোজা অ্যাথেন্সে যেতে চাও। বাচ্চারা আবার ক্রুজ পছন্দ করে না, ওটা নাকি শুধু বুড়োবুড়িদের জন্য। তা যাই বলো বাপু ওদের মতন ব্যাকপ্যাকিং করা আমার এই বয়সে পোষাবে না। আমার ক্রুজই ভালো, বেশ যেখানে যাবে হোটেলটাও সঙ্গে সঙ্গে যায়।”

    “ক্রুজে এখন না যাওয়াই বোধহয় ভালো। আমার মনে হয় অনেক দূর থেকে একটা ঝড় আসছে নিপু, এমন ভয়ঙ্কর ঝড় যা সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে। আই হোপ আই অ্যাম রং,” রন বলেছিল।

    “কি বলছো ঠিক করে বলো দেখি।” ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলেছিল নিপু। পণ্ডিতদের নিয়ে ঘর করার এই এক বিষম সমস্যা। সব বক্তব্যই ওদের কাছে হেঁয়ালি, সব আলোচনাই তাত্ত্বিক।

    “সামথিং ইস লার্কিং দেয়ার। টাইম ইজ রাইপ ফর আ প্যানডেমিক। ২০০২ সালে চীন থেকে একটা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল ক্যানাডা অবধি, তারপর ২০১২ সালে মিডল ইস্টে ঠিক ওই জাতের ভাইরাস থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল অনেক লোক। আমরা পাত্তা দিইনি কিন্তু আমার বিশ্বাস ঘটনাটা আবার ঘটতে চলেছে। এবার কেউ রেহাই পাবে না, অসুখ ছড়াবে বস্তি থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত।” কেমন একটা অদ্ভুত গলায় ফিসফিস করে উঠেছিল রন। নিপু এখন বুঝতে পারে যে ওই শব্দগুলোর মধ্যে ছিল আশংকা আর উত্তেজনার এক ধাতব মিশ্রণ, ফ্রন্টে যাবার আগে ঝানু সৈনিকদের মনের অবস্থা যে রকম হয়।

    সেদিনটা ছিল গতবছর ডিসেম্বর মাসের আঠাশ তারিখ, ওরা সবাই তখন ফ্লোরিডায় ছুটি কাটাচ্ছে। এই সময়টা নিপুর দুনিয়ার সক্কলের সঙ্গে ক্যাচ-আপ করার সময়। পৃথিবী ছোটো হতে হতে এক্কেবারে হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে, এখানে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাই সবথেকে মজার খেলা। কে কোথায় আছে, কখন, কোথায়, কার জীবনে কি হচ্ছে তার ঠিকানা নেই কিন্তু বছরের শেষে সকলেই এক অদৃশ্য ক্লাবঘরে হাজির। নিপুর পুরো বিশ্বাস জন্মে গেছিল যে এমনটাই চলবে, বন্ধুরা, ছেলেমেয়েরা এবং বাকি সক্কলে মিলে একসাথে এই অভূতপুর্ব সময়ে বেঁচে থাকার ফয়দা তুলতে থাকবে চিরকাল। এইরকম একটা ঝকঝকে দিনে সুইমিং পুলের পাশে বসে বোমাটা ফেলেছিল রন।

    “কাল আমাকে ফিরতে হবে নিপু। সরি তোমার ছুটিটা নষ্ট করলাম কিন্তু কিছু তথ্য এসেছে যেগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। অবশ্য ইচ্ছা হলে তুমি থেকেও যেতে পারো।” রন কথাগুলো পরিষ্কার বাংলায় বলেছিল কিন্তু নিপু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি তখন।

    “ফিরে যাবে! ওখানে এখন বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা, বরফ পড়ছে। এখানে না আমাদের নিউ ইয়ার্স সেলিব্রেট করার কথা! তোমার ডাটা অ্যানালিসিস হপ্তাখানেক পরে করলে হয় না? আর তাছাড়া কবে আমি একলা একলা ছুটি কাটিয়েছি বলো তো?” নিপু ফেটে পড়েছিল একেবারে।

    “আমি সত্যিই সরি নিপু, আই উইল মেক ইট আপ টু ইউ, আই প্রমিস। কিন্তু আমার ল্যাবে ফিরে যাওয়াটা সত্যিই জরুরি।” রনের গলা শান্ত অথচ কঠিন। খুব রাগ করে ফ্লোরিডা থেকে ফিরেছিল ও। তিন দিন ঠিক করে কথা বলেনি কারো সঙ্গে। ছেলেমেয়েদের ফোন করে নালিশ করেছিল যে বাবার মাথা থেকে ভূত নামার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না।

    একত্রিশে ডিসেম্বর, নিপু আর রণজিৎ ফ্লোরিডা থেকে ফিরে আসার ঠিক চার দিন পরে দুনিয়ার লোক যখন শ্যাম্পেনের ছিপি খুলছে ঠিক তখন চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকে একগুচ্ছ নিউমোনিয়া কেসের খবর পাওয়া গেল, তার মধ্যে সাতাশ জন ইতিমধ্যেই মৃত। তার পরে পুরো এক মাস চীন সরকার আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মধ্যে চাপান উতোর চলতে থেকেছে, যখন দুনিয়ার বাকি লোকজন, তাদের মধ্যে চীনের জনসাধারণও পুরোদস্তুর সামিল, মহানন্দে শীতের ছুটি উপভোগ করতে ব্যস্ত। জানুয়ারি ২৩ তারিখ নাগাদ উহান শহরে কারফিউ কিন্তু তার আগেই বেশ কিছু লোকজন সেই তল্লাট থেকে উধাও, তারা নাকি দল বেঁধে ইউরোপে বেড়াতে গেছে। জানুয়ারি ২৪ থেকে ৩০ তারিখের মধ্যে দুনিয়ার নানান প্রান্তে লোকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করলো কিন্তু তখনও কর্তাব্যক্তিরা বেশ ঢিলেঢালা। ভাবখানা এই যে চীনের সমস্যা চীন বুঝবে, বড়জোর ২০০২ সালের মতন বাইরের কিছু লোক অসুস্থ হবে, তারপরে সব ধামাচাপা।

    ফেব্রুয়ারির সাত তারিখে একটা মৃত্যুসংবাদ নেটদুনিয়ায় ঝড় তুললো, সদা রক্তচক্ষু চীনা প্রশাসনও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে বাধ্য হল তখন। ডক্টর লি ওয়েনলিয়াং ছিলেন উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালে কর্মরত একজন আপাত সাধারণ চক্ষু চিকিৎসক যিনি তিরিশে ডিসেম্বর এই নতুন অসুস্থতার সঠিক ডায়াগনোসিস করে কর্তৃপক্ষকে সজাগ করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর বয়ানে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে হুয়ানান নামে একটি মাছের বাজার থেকে অন্তত সাত জন এমন উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয়েছে যার সঙ্গে ২০০২ সালের ভয়ঙ্কর অসুখ ‘সারস’ (SARS- Severe acute respiratory syndrome) রোগীদের পরিষ্কার মিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে খবরটি খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। গুজব রটানোর দায়ে স্থানীয় পুলিশ ডাক্তারবাবুকে ধমকে দিয়েছিল, তাঁকে দিয়ে একটি মুচলেখাও লিখিয়ে নিতে ভোলেনি। তিরস্কৃত ডাক্তার চুপচাপ তাঁর কাজে ফিরে যান এবং জানুয়ারির তিরিশ তারিখ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আট দিন বাদে মাত্র ৩৪ বছর বয়েসে তাঁর মৃত্যু হয়।

    ফেব্রুয়ারির তেরো থেকে চব্বিশ তারিখ অবধি করোনাভাইরাসের দিগ্বিজয়ের গল্প। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য, অ্যাটল্যান্টিক ছাড়িয়ে ইটালি, ফ্রান্স এবং স্পেন, প্যাসিফিক ছাড়িয়ে ওয়াশিংটন স্টেট, ক্যালিফোর্নিয়া--মানুষের বানানো প্রমোদ তরণী আর এরোপ্লেনে চেপে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়িয়েছে ভাইরাস। এইবার কর্তাদের টনক নড়েছে, অহংকার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে, একের পর এক দেশ লকডাউন জারি করেছে, সমাজের প্রতিটি দরজায় একে একে তালা পড়েছে, কিন্তু সবই বড্ডো দেরিতে। হোটেল থেকে ট্যুরিস্টরা উধাও, সমুদ্রতটে পুলিশের টহলদারি, শপিং মলে ঘুঘু চরছে, নিউ ইয়র্কের টাইম স্কোয়ারে কবরখানার পরিবেশ। প্রবল আত্মবিশ্বাসী এক প্রজন্ম, যারা প্রযুক্তির পক্ষীরাজে সওয়ার হয়ে ইতিহাসের শেষ দেখবে বলে আকাশে উড়েছিল, তারা সবাই আজ অদৃশ্য শত্রুর সামনে ধরাশায়ী। ইউনাইটেড নেশনের হিসাব বলছে যে কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের ফলে আর্থিক ক্ষতি ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দাকে ছাড়িয়ে যাবে, বেকার হবে কুড়ি কোটি মানুষ, শুধু আমেরিকায় মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে বেশ কয়েক লক্ষ। লকডাউনে গৃহবন্দী হয়ে বসে থেকেও সবাই এখন এই আজব আতঙ্কে দিশাহারা।

    একলা ঘরে বসে বসে নিপুর খুব রাগ হয় আজকাল। অচেনা, উৎকট রাগ, ও নিজেই তার মাথামুণ্ডু খুঁজে পায় না। ওর খালি মনে হয় বেশ তো চলছিল সব, সাংহাই থেকে সানফ্রান্সিস্কো, তাজমহল থেকে কলিসিয়াম, মানুষের স্রোত বয়ে চলেছিল অবাধ উত্তেজনায়। ইতিহাসে এই প্রথম সাধারণ মানুষ বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছিল। জীবনে অন্তত একবার প্রমোদ তরণীর রোমাঞ্চকর আলো-অন্ধকারে চোখ মেলতে পেরেছিল এই দুনিয়ার হরিপদ কেরানির দল। কথা নেই বার্তা নেই, বেমক্কা এই ভাইরাসের উৎপাত শুরু হলো কোথা থেকে? আর হলোই যদি, পৃথিবীতে নিপুর বরের মতন মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতের তো অভাব নেই-- তারা সবাই মিলে ঝড়াকসে একটা ওষুধ বার করে ফেললেও তো পারে। তার বদলে ওরা সবাই মিলে বেবাক দুনিয়ার ঝাঁপ বন্ধ করে দেবার মতলবে আছে কেন, ভগবান জানেন।

    “শোনো, ছেলেমেয়েগুলোকে দিনে একটা করে ফোন করলেও তো পারো। ওদের খবর নেওয়া শুধু কি আমার একার দায়িত্ব নাকি?” চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঝাঁঝিয়ে উঠলো নিপু।

    “ওরা নিজেদের মতন ঠিক আছে নিপু, দে আর অ্যাডাল্টস। তুমি শুধু শুধু চিন্তা কোরো না।” ঈষৎ জড়ানো গলায় কথাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে দিল রন। ল্যাপটপের বদলে ওর হাতে এখন একটা চামড়া বাঁধানো বই, অন্য হাতে হুইস্কির গ্লাস। বইটা অবশ্য ঠিক বই নয়, ওটা অ্যামাজন কোম্পানির বানানো ইলেকট্রনিক বই, যার ডাকনাম পেপারহোয়াইট। ওই ছোট্ট ট্যাবলেট আসলে ছোটখাটো একটি লাইব্রেরি, ল্যাপটপের পাশাপাশি ওটাও রনের নিত্যসঙ্গী। রাত এখনও নটা বাজেনি কিন্তু এর মধ্যেই পাড়া জুড়িয়ে নিঃঝুম অন্ধকার নেমে এসেছে। নিজের স্টাডিতে বসে অন্তত আরো ঘন্টা চারেক লেখাপড়া চালিয়ে যাবে ও। নিপু তখন বেডরুমে আধশোয়া হয়ে টেলিভিশনের চ্যানেল বদলাবে। গভীর রাত্রে যখন টেলিভিশনটাও বন্ধ হয়ে যাবে, তন্দ্রার মধ্যে টের পাওয়া যাবে চাদর বালিশের খসখসানি। পাশের মানুষটা তখনও সাদাকালো অক্ষরদের দুনিয়ায়। অন্যদিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ার ভান করবে নিপু। সকাল বেলায় যখন ওর ঘুম ভাঙবে, রন তার আগেই স্নান সেরে, এক কাপ কফি খেয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়ে গেছে।

    “কি পড়ছ? জার্নাল?” অনেকক্ষণ নীরবতার পরে কথাবার্তা শুরু করার আরেকটা চেষ্টা করলো নিপু। কাঁহাতক একলা একলা বসে টিভি দেখা যায়। পরিচিত প্রায় সকলকে অন্তত একবার করে ফোন করা হয়ে গেছে, টেক্সট করা হয়ে গেছে অন্তত শ’খানেক। ছেলেমেয়েরা যখন ছিল, বিরাট লিভিংরুমটা ওদের উৎপাতে তটস্থ হয়ে থাকতো সবসময়। ডিনারের পরে একসঙ্গে ভিডিও গেম খেলতে বসতো ওরা। দুমদাম আওয়াজের মধ্যে ঝপাঝপ উল্টে পড়ে যেতো বিকটাকৃতি দত্যিদানবেরা, গাড়ি ছুটতো, ফাইটার প্লেনেরা কাঁপিয়ে দিত টেলিভিশনের আকাশ। ওদের বাবাও মাঝে মাঝে যোগ দিতো, তার আবার পছন্দ ছিল স্ট্রাটেজিক গেমস, যেখানে যুদ্ধ আর রাজনীতির নানান প্যাঁচ কষতো তিনজনে মিলে। খুব রাত্তির হয়ে গেলে ছদ্ম রাগে ওদের বকাবকি করতো নিপু, নিজেকে তখন মনে হতো পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী আর সার্থক। ঘন্টা খানেক বাদে ছেলেমেয়েদের বিছানায় পাঠিয়ে সন্তর্পণে নিজেদের ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিতে হত। রন তখনও ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকতো, এখনকার তুলনায় সেই ল্যাপটপ ছিল থান ইটের মতন ভারী আর গুবরে পোকার মতন শ্লথগতি। বিছানার ঠিক উল্টোদিকে ছিল ওর ড্রেসার, সেখানে বিরাট এক আলোকিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার ভালো করে দেখে নিত ও প্রতিদিন। মিরর, মিরর অন দি ওয়াল। প্রতিবিম্ব বেশ খুশি হয়েই তাকাত ওর দিকে। ডিমের আকারে ওর মুখ ঢেউখেলানো কালো চুলের মধ্যে ভেসে আছে, বড়ো বড়ো চোখের মধ্যে শান্ত অথচ গভীর স্বচ্ছতা। ওর দাঁতের সারি একটু অসমান, নাক আর চিবুক আহামরি কিছু নয়, চওড়া কপাল, পরিচ্ছন্ন গাল, চিবুকের বাঁ-দিকে একটা বিউটি স্পট। ওর মুখের খুঁতগুলো যেন একে অপরের সঙ্গে মিশে অন্যরকম একটা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে। রন বলে ওটার নাম নাকি ওয়াবি-সাবি, বিউটি অফ ইমপারফেকশন। অতসব না বুঝলেও নিপুর জানা ছিল যে ও যখন একটু সময় নিয়ে, একটুখানি বিশেষ ভঙ্গিতে চুল আঁচড়াবে, মুখে ক্রীম মাখবে ঠিক তক্ষুনি ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে পিছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরবে রন। গলায় আর কাঁধের ওপরে অজস্র চুমু খাবে, দুই হাতে আঁকড়ে ধরবে ওর বন্ধনহীন কোমল বক্ষদেশ। ঠিক তখনই মিথ্যে রাগ দেখিয়ে সরে যেতে চাইবে নিপু। ল্যাপটপ তার জায়গায় ফিরে যাবে, খুব আস্তে করে আলো আঁধারির মধ্যে জেগে উঠবে রাত্রির টেলিভিশন, ছবির স্রোত আর বিছানার নীল উষ্ণতার মধ্যে গা ভাসাবে ওরা।

    অনেক চিন্তাভাবনা করে ওরা ছেলেমেয়েদের নাম রেখেছিল সাম্য, আর শ্রুতি, স্কুলে যেতে না যেতেই ওগুলো ছেঁটেকেটে দাঁড়িয়ে গেল স্যাম আর স্যু। দুজনের মধ্যে মাত্র আঠেরো মাসের তফাত। সেই দুটো উজ্জ্বল অথচ অসহায় প্রাণ কবে যে বড়ো হয়ে উঠলো, গুটি গুটি পায়ে হাইস্কুল শেষ করে কলেজ আর ইউনিভার্সিটির আজব দুনিয়ায় পা রাখলো, সেসব কথা ভাবতে বসলে থৈ খুঁজে পায় না নিপু। আজকের এই একলা অন্ধকারে বসে ওর কেবলি মনে হয়, সব কিছুই আসলে অবাস্তব, অতীত বলে সত্যি সত্যি কিছু নেই। সাম্য এখন থাকে নিউ ইয়র্কে, শ্রুতি লস অ্যাঞ্জেলসে, দুজনেরই বাসা শহরের মধ্যিখানে পাঁচমিশালি ভিড়ে ঠাসা ক্ষুদে অ্যাপার্টমেন্টে। সাম্যর ডাকনাম সমু, শ্রুতিকে ওরা মাম্পি বলে ডাকে। সকলের মতন ওরাও যে যার এলাকায় গৃহবন্দী।

    “কি গো, কথা বলছি উত্তর দিচ্ছ না যে? কি বই পড়া হচ্ছে শুনি?” সন্ধি করার মুডে রনের সামনে এসে দাঁড়ালো নিপু। ভালোবাসার মানুষটার ওপর কতক্ষণ আর রেগে থাকা যায়। চোখ তুলে নিপুর দিকে তাকালো রন, তাকিয়েই রইলো বেশ কয়েক মিনিট, ওর দৃষ্টির মধ্যে একটা অদ্ভুত বোবা যন্ত্রণা।

    “কি হয়েছে। ক্লান্ত লাগছে তোমার? লাগবে না, দিনরাত্রি যা খাটান খাটছ! আর ড্রিঙ্ক কোরো না প্লীজ শুতে চলো।” নিপুর গলায় স্পষ্ট মিনতি এবার।

    “লা পেস্ত!” ফিসফিস করে বলল রন। ওর গলায় একরাশ ক্লান্তি।

    “কি বললে?”

    “এই যে বইটা দ্যাখো, এটার নাম লা পেস্ত, ইংরেজিতে দ্য প্লেগ, লেখক আলবেয়ার কামু। ১৯৪৭ সালের গল্প।” বিড়বিড় করে বলল রন, ওর দৃষ্টি জানলার দিকে যেখানে এখন শুধুই অন্ধকার। অসময়ে দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে শহর। একদা নিশ্চিন্ত এবং ফুর্তিবাজ এই দুনিয়ায় হঠাৎ করেই সব কিছু উলটপালট হয়ে গেছে। কারো চাকরি নেই, কারো বা স্কুল বন্ধ, কারো প্রিয়জন হাসপাতালে কিন্তু তাদের সাথে দেখা করার উপায় নেই। অদ্ভুত এক বিপন্নতার মেঘ ঘনিয়ে এসেছে সবার মাথার ওপর।

    “তুমি গল্পের বই পড়ছ? আমি ভাবলাম--”

    “ভাবলে আমি রিসার্চ করছি? তা একরকম রিসার্চই বলতে পারো। রিসার্চ ইনটু দি সোল অফ আ ফিজিশিয়ান। কিংবা হয়তো নিখিল মানবাত্মার। কে জানে? বলতে পারো নিপু, কিছু কিছু মানুষ কেমন করে এমন অনায়াসে চিরন্তন সত্যের হদিশ পেয়ে যায়, আর বাকিরা চোখের সামনে জলজ্যান্ত সত্যটাকে নড়েচড়ে বেড়াতে দেখেও বেমালুম অস্বীকার করতে পারে?"

    “প্লীজ শুতে চলো, তোমার নেশা হয়ে গেছে। চলো, তোমায় ঘুম পাড়িয়ে দেবো।” ওর মুখে সাধু বাংলা শুনে রাগ গলে জল হয়ে গেল নিপুর। অভ্যাসের পরতে পরতে জড়ানো এই শ্লথগতি মাঝবয়েসকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। একদিন ছিল যখন হাজার ব্যস্ততার মাঝখানেও ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে পেরে উঠতো না এই কাজপাগল হাড়বজ্জাত লোকটা।

    “চলো। এই অন্ধকারে একলা জেগে থেকে লাভ নেই। কামুও সেই কথাই বলেছেন। রোগজীবাণু নয়, আমাদের আসল লড়াই নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে। তাছাড়া জীবন যতই উদ্ভট হোক না কেন, ঘটনাক্রমে এখনও আমরা তার প্রতি দায়বদ্ধ।” রণজিৎ বললো। মাথাটা ওর কাঁধের ওপরে রেখে নিপুও ঘুমিয়ে পড়লো একসময়।


    ।।২।।
    The evil that is in the world always comes of ignorance, and good intentions may do as much harm as malevolence, if they lack understanding. On the whole men are more good than bad; that, however, isn't the real point. But they are more or less ignorant, and it is this that we call vice or virtue; the most incorrigible vice being that of an ignorance which fancies it knows everything and therefore claims for itself the right to kill.
    তিন সপ্তাহ আগে এই বোর্ডরুমে দাঁড়িয়ে কথাগুলো সবাইকে পড়ে শুনিয়েছিল রণজিৎ। ডাক্তারি পরিসংখ্যান, গ্রাফ, চার্ট এবং পরিভাষার যাবতীয় কচকচানি যখন বেকার, তখন মরিয়া হয়ে সাহিত্যের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল ওকে। শহরের মেয়র, পুলিশ কমিশনার, সেনেটর, কংগ্রেসম্যান এবং চেম্বার অফ কমার্সের কেষ্টবিষ্টু লোকজনেরা সবাই হাজির ছিলেন। হাসপাতালগুলোর বড়োকর্তারা সামনের সারিতে অতীব গম্ভীর মুখে বসেছিলেন, আরো নানান এলাকার তালেবর ব্যক্তিরাও আশপাশে হাজির ছিলেন সবাই। তর্কের বিষয়বস্তু একদিকে যেমন সরল, অন্যদিকে তেমনি বিদঘুটে রকমের কঠিন। কলরবমুখরিত এই শহরকে স্তব্ধ করে দিতে হবে, জনজীবনের প্রতিটি এলাকাকে বস্তাবন্দী করে ফেলতে হবে যতদিন সংক্রমণের গতি রুদ্ধ না হয়। কথাবার্তা শুনে প্রায় সকলেই অগ্নিশর্মা। তাঁদের একটাই সাধারণ বক্তব্য যে কয়েকজন সবজান্তা ডাক্তারের কথা শুনে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব। বৈজ্ঞানিকদের সব উপদেশ শুনতে হলে তো দুনিয়ার তাবৎ ব্যবসাই তড়িঘড়ি গুটিয়ে ফেলতে হয়। চক্রব্যূহের মাঝখানে অভিমন্যুর মতন দশা হয়েছিল রনের সেদিন, চতুর্দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছিল প্রশ্নবাণ।

    নাঃ, অভিমন্যুর উদাহরণটা ঠিক হলো না, কেননা রনের সঙ্গে আগাগোড়া আরেকজন ছিল, প্রশ্নবাণে সেও আগাগোড়া বিদ্ধ হয়েছে। রণজিতের অনেক দিনের বন্ধু ও সহকর্মী ম্যাক্স, ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক এবং বিশ্ব-স্বাস্থ্য-সংস্থার এপিডেমিওলজিস্ট। ম্যাক্স অ্যারোনস জাতে জার্মান ইহুদী, ওর পরিবারের পুরনো সদস্যেরা প্রায় সবাই আউৎউইজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ক্রিমেটরিয়ামে ধোঁয়া হয়ে গেছেন। দু-চারজন কোনওরকমে পালিয়ে ঠাঁই পেয়েছিলেন নিউইয়র্কের ইহুদী মহল্লায়, সেখানেই ম্যাক্সের জন্ম। খুব ঠাহর করে দেখলে ওর চোখেমুখে সেমেটিক রক্তের হদিশ পাওয়া যাবে কিন্তু ২০২০ সালের বস্টন শহরে ও একজন উস্কোখুস্কো চেহারার শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক যাকে দেখলেই বোঝা যায় অধ্যাপক এবং মাথায় ছিট আছে। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির দৌলতে এই শহরে নানান অদ্ভুত টাইপের লোকজনের দেখা পাওয়া যায়, অন্যত্র যাদের দেখলে লোকজন পুলিশে খবর দিতো। কাজের বাইরে ওর জীবনটা অতিশয় অগোছালো, বাউন্ডুলে বললেও হয়। ম্যাক্স মনুষ্যসমাজের কোনোরকম নিয়মকানুনই মানতে চায় না, ওর বন্ধুরা নানা ভাষা এবং জনজাতির মানুষ হলেও তাদের একটা সাধারণ চরিত্র আছে। তারা সকলেই দুনিয়ার নানা প্রান্তে ল্যাবরেটরির আলো অন্ধকারে কিংবা অসুস্থ মানুষের বিছানার পাশে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কাটিয়ে দিয়েছে। ম্যাক্স বেজায় বন্ধুবৎসল, ওর বন্ধুরা প্রায়ই এই বসার ঘরে মান্ধাতার আমলের চামড়া মোড়া বিরাট একটা সেকশনাল সোফার ওপরে জমায়েত হয়। সেখানে কয়েক পাত্তর কড়া বুর্বন হুইস্কি অথবা এক রাউন্ড গঞ্জিকা সেবনের পরে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হয়ে থাকে।

    ম্যাক্স যেমন পণ্ডিত, তেমনি অভিজ্ঞ এবং ঠিক সেই অনুপাতেই ঠোঁটকাটা। নানান জাতের বীভৎস সব রোগজীবাণুর পিছনে ছুটতে ছুটতে ওর তিন বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ হয়ে গেছে, দুটো ডিভোর্স হয়েছে। ওর রাজনৈতিক মতামত রীতিমতন বিপজ্জনক, কিন্তু ছোঁয়াচে রোগের ব্যাপারে ওর জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা এতটাই গভীর যে ওকে বাদ দিয়ে এইসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। সেক্ষেত্রে মিডিয়ার মারফত জল আরো ঘোলা হবে কেননা ম্যাক্স মুখ বন্ধ করে বসে থাকার লোক নয়। তাই প্রচুর অস্বস্তি হজম করেও কর্তারা ওকে না ডেকে পারেননি এবং চাপানউতোরের শুরু থেকেই ম্যাক্স রনের পাশাপাশি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। ছয় ফুট লম্বা পেটানো চেহারা ওর, গায়ের রং রোদে পুড়ে তামাটে, বাদামি রঙের এক মাথা উস্কোখুস্কো চুল, চিরুনির সঙ্গে তার বিশেষ যোগাযোগ নেই। ওর মুখের প্রতিটি রেখা, ভুরু থেকে শুরু করে নাক, গালের হাড়, চোয়াল এমনকি কণ্ঠার হাড় অবধি সবকিছু যেন সঙিন উঁচিয়ে খাড়া হয়ে আছে, চোখের দৃষ্টিও ঠিক সেইরকম তীক্ষ্ণ আর অন্তর্ভেদী। দুনিয়ার নানান প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ওর বন্ধুরা কিন্তু পরিষ্কার জানে যে বাইরের এই রুক্ষ চেহারাটা ম্যাক্সের ছদ্মবেশ। ওর ভেতরটা অহেতুক করুণার রসে সর্বদাই রসগোল্লা হয়ে আছে। আজকের যুগে খুব কম লোক মিলবে যারা ব্যক্তিগত জীবনচর্চা আর সামাজিক দায়বদ্ধতাকে আলাদা করে দেখতে রাজি নয়, তাদের কাছে বেঁচে থাকা মানেই আন্দোলন। এদের সাধারণ নাম অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলায় বলা যেতে পারে সক্রিয়তাবাদী কিংবা সাদা কথায় কাবাবমে হাড্ডি। দেশের যারা ক্ষমতাশালী লোকজন, যাদের হাতে সরকার এবং ব্যবসাবাণিজ্যের ভার, তাঁরা এই জাতীয় লোকজনকে আদপেই পছন্দ করেন না। ব্যাটারা সব সময় মাচার ওপর থেকে চেল্লাচ্ছে, সব কাজে বেফয়দা শুধু বাগড়া দিতে ওস্তাদ। যাই হোক, সেই কমসংখ্যক, বেয়াড়া টাইপের লোকদের মধ্যে একজন হল ম্যাক্স।

    “দেখুন মহাশয়েরা, রন যা বলছে তার সঙ্গে আমি একশো ভাগ একমত। বড়ো শহরগুলোতে মোটামুটি কারফিউ জারি করা উচিত, রেস্টুরেন্ট, বার, সিনেমা, থিয়েটার সব যেন বন্ধ থাকে। এয়ারপোর্ট, ট্রেন এবং বাস স্টেশনে কড়া পাহারা বসাতে হবে, ইন্টারন্যাশন্যাল সব ফ্লাইট যেন অন্তত চার হপ্তার জন্য বাতিল করা হয়। এই সময়টার মধ্যে আমরা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং অর্থাৎ রোগের সংস্পর্শে আসা প্রতিটি লোককে খুঁজে বার করে তাদের কোয়ারেন্টিন করার ব্যবস্থা করবো। শহরের হাসপাতালগুলোর ক্ষমতা কমপক্ষে দ্বিগুণ করা হোক, আই-সি-ইউ বেড আর ভেন্টিলেটরের সংখ্যা তিনগুণ। আমরা যদি এক্ষুনি এই ব্যবস্থাগুলি না নিই তবে কিছুদিনের মধ্যেই এর থেকে একশোগুণ বেশি বিপদ আমাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।”

    ম্যাক্সের বক্তব্য শেষ হবার আগেই আরেক দফা কোলাহল উঠলো। সবাই জানতে চায় যে এই লোকগুলো কি দ্রব্য নেশা করে এসেছে! সাত হাজার মাইল দূরে ইঁদুর বাদুড় খেয়ে কিছু লোকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিন্তু তাই বলে নিউইয়র্ক বা বস্টনের মতন পৃথিবীর সবথেকে জীবন্ত শহরগুলোকে তালাবন্ধ করে ফেলতে হবে? এর ফলে যে নগদ ক্ষতিটা হবে তার হিসাব করার ক্ষমতা আছে কি এই সবজান্তা ডাক্তারদের? ভোটের বছরে বেমক্কা এইরকম জল ঘোলা করে করে এরা কার পাকা ধানে মই দিতে প্রবৃত্ত হয়েছে এবং কোন মুরুব্বির ভরসায়?



    চারঘন্টা বাদে বিধ্বস্ত এবং বিরক্ত অবস্থায় রন আর ম্যাক্স রাস্তায় নামলো। ফুটপাথের ওপরে তখন গা এলিয়ে শুয়ে আছে মার্চ মাসের মিঠে রোদ্দুর। হাওয়ায় একটা মিঠে শিরশিরানি কিন্তু শীতের কামড় নেই, তার বদলে একটা আলতো উত্তাপের ছোঁয়া। ঋতুরাজ এই দেশে অনেক আড়ম্বর করে আসেন, তাঁর জন্য পথের দুধারে চেরিফুলের গাছগুলো ইতিমধ্যেই সাজতে শুরু করেছে। উচ্ছ্বাসমুখরিত এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে ওদের দুজনের চারপাশ দিয়ে স্রোতের মতন বয়ে চলে গেল প্রবাল প্রাচীরের মধ্য দিয়ে মাছেরা যেমনি অনায়াসে সাঁতরে চলে যায়। ডান দিকে একটা পার্ক, সেখানে লোক গিজগিজ করছে, বাঁ-দিকে সারি দেওয়া নানান স্বাদের রেস্টুরেন্ট, সেখানেও খদ্দের যথেষ্ট। লম্বা চুলদাড়িওয়ালা কিছু লোকজন গীটার, ড্রাম আর স্যাক্সাফোন নিয়ে হল্লা বাঁধিয়েছে, তাদের চারদিকে উৎসাহী শ্রোতাদের ভিড়। ওরা পায়ে পায়ে একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো। বেশ খানিকক্ষণের জন্য দুজনেই চুপচাপ।

    “তোমার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে রন?” ম্যাক্স নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললো।

    “দুজনে দেশের দুই প্রান্তে, একজন নিউ ইয়র্কে অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়ায়। তোমার ছেলেমেয়েদের কি খবর?” রন কথাটা বলেই মনে মনে জিভ কাটলো কেননা ম্যাক্স আদৌ একদারনিষ্ঠ নয় এবং ওর কোন পক্ষের কে যে ঠিক কোথায় আছে তার হিসেব রাখা কঠিন।

    “খবর তো অনেক কিন্তু সেসব তুমি সত্যিই শুনতে চাও নাকি? নাকি এমনি এমনি বলছ, যেমন আমি এক্ষুনি বললাম? হাউ আর ইয়োর কিডস?” অদ্ভুত গলায় প্রশ্ন করলো ম্যাক্স।

    রন চুপ করে থাকলো। ওর মনে হল সত্যিই কি ও অন্য আরেকজনের জীবনের গল্প শুনতে উৎসুক। আমরা প্রতিদিন হাজার বার করে এখানে ওখানে “কেমন আছো” কথাটা উগরে দিই কিন্তু তার পেছন পেছন তোতাপাখির মতন “ভালো আছি” উত্তরটাও প্রত্যাশা করি। অথচ এর থেকে বড়ো মিথ্যে কথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে খুঁজে পাওয়া কঠিন। ভাগ্যিস আমাদের অহংকার আমাদের মুখ দিয়ে কথাটা বলিয়ে নেয়, নাহলে কি যে হতো বলা মুশকিল। রন বুঝতে পারলো এই মুহূর্তে ইচ্ছে থাকলেও ম্যাক্সের মনের কথা শোনার মতন অবকাশ ওর নেই, রাত্রি ঘনিয়ে আসার আগে আজ বাড়ি ফিরতেই হবে ওকে। এই মিটিংটার আগে হপ্তাখানেক ও দিনরাত কাজ করেছে, সব রকম তথ্য আর পরিসংখ্যান একজায়গায় করতে কালঘাম ছুটে গেছে ওর। অথচ এখন তো দেখা যাচ্ছে সবই অরণ্যে রোদন। পৃথিবীর একদিকে মহামারীর কালো মেঘ ঘনিয়ে আসছে জেনেও অন্যদিকের প্রভুরা শেয়ার বাজারের গতিবিধি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন, মানুষের বাঁচামরা নিয়ে তার এক শতাংশও নয়। মাঝে মাঝে রণজিতের মনে হয় যে হিউম্যান বা মানুষ কথাটার কোনো সাধারণ সংজ্ঞা কস্মিনকালে ছিল না, এখনও নেই। এককালে ক্রীতদাস, কুলি অথবা ভূমিদাস হিসাবে তাদের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। আজকালকার চাকুরিজীবীরা তাদের থেকে কতখানিই বা আলাদা? যাদের আমরা ইয়ুথ বা তারুণ্য বলে বন্দিত করি, যুদ্ধের সময় তাদেরই পাইকারি হারে আগুনে ফেলে দিই। দেশপ্রেমের সেই আগুন নাকি পবিত্র, তরুণ প্রাণের সেই আহুতি পেয়েই যুগে যুগে জ্বলে ওঠে সভ্যতার শিখা। ভাইরাসের কিন্তু দেশ নেই, ধর্ম নেই, অর্থনীতি নেই, ধর্মতত্ত্ব, এথিকস বা দর্শন তার কাছে তামাশা, সে শুধু প্রাণের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষাটি নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সেই শিক্ষা শুধু যেন তেন প্রকারেণ টিঁকে থাকার বীজমন্ত্র, নিউক্লিক অ্যাসিডের অবাধ স্বেচ্ছাচারীতার ইতিহাস। হয়তো মানুষের মধ্যে যতখানি চেতনা আছে, ভাইরাসের মধ্যেও ঠিক ততখানিই, বাকিটা মানুষের অলীক আত্মগরিমা থেকে উঠে আসা বাষ্প ছাড়া কিছুই নয়।

    “গুডনাইট রন। এখনই এমন উদাস হয়ে যেও না, অনেক রাস্তা বাকি, নাইট ইজ স্টিল ইয়াং।” গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করতে ম্যাক্স হাসলো। ওর হাসির শব্দ শুনে চিন্তার ঘোর কেটে গেল রনের। গত দশ মিনিটে ওরা হাঁটতে হাঁটতে কারপার্কে পোঁছে গেছে, তার মধ্যে ওদের মধ্যে কিছু কথাও হয়েছে, কিন্তু কি অকারণ আর অবান্তর সেই সব কথোপকথন! আসলে ওরা যে যার নিজস্ব ভুবনে বাস করেছে, কথা যা বলেছে সে সবই শেখানো বুলি। প্রতিটি মানুষ যখন তার নিজের বুকের মধ্যে যন্ত্রণার পাথর নিয়ে ঘুরছে, তখন কোত্থেকে সে আরেকজন দুঃখের দরিয়ায় ডুব মারার সাহস পাবে। তার জন্য যে সময় আর সংসক্তির প্রয়োজন, প্রতিদিন তা শুষে নিচ্ছে দুনিয়াজোড়া এই বাজারের কানফাটানো হট্টগোল।

    “গুড নাইট রন।”

    “গুড নাইট ম্যাক্স।”

    দুটো গাড়ি দুদিকে বেরিয়ে গেল। রন থাকে শান্ত শহরতলিতে, ম্যাক্সের বাসা ডাউনটাউনের কংক্রীট অরণ্যে, চোদ্দ তলার ওপরে ওর একলা অ্যাপার্টমেন্টে। একলা বললে ভুল বলা হবে কিন্তু ম্যাক্স যে জাতীয় সামীপ্যের সন্ধানী, তার সঙ্গে রনের পরিচিত ভুবনের এতটাই অমিল যে সামাজিকভাবে ওর এবং আরো অনেকের জন্য ম্যাক্স একলাই। অতীতে যতবার ম্যাক্সের লিভিংরুমে প্রশস্ত সোফার ওপর গা এলিয়ে বসে স্কচ অথবা বিয়ার সহযোগে আড্ডা মারার সুযোগ হয়েছে ততবারেই নতুন নতুন লোকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে রনের। তাদের সকলেরই কোন-না-কোন উদ্ভট নেশা আছে। কেউ সিরিয়ান রিফিউজিদের নিয়ে কাজ করে, কেউ অ্যানোনিমাস নামক হ্যাকার সংঘের সভ্য, কেউ নিরামিষাশী ভেগান, প্রাণীহত্যা নিবারণ করার জন্য জীবন উৎসর্গ করে বসে আছে, কেউ ট্রি হাগার, গাছ কাটা হলে শোকসভা বসায়। এই সব ছিটগ্রস্থ লোকেদের অনেকেই যে যার নিজের ক্ষেত্রে মহারথী, তাদের তর্কযুদ্ধও সেই অনুপাতে রোমহর্ষক। রনের সঙ্গে দোস্তি হবার আরেকটা কারণ এই যে ম্যাক্স ভারতীয় উপমহাদেশের খাদ্য থেকে শুরু করে ইতিহাস এবং সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ভক্ত, ওর ভাষায় ইন্ডোফাইল। ওর পূর্বপুরুষদের মধ্যে একজন নাকি খোদ ম্যাক্সমূলারের ছাত্র ছিলেন, সংস্কৃত এবং লাতিন, দুটো ভাষাতেই তাঁর সমান দখল ছিল। সেই প্রপিতামহের লেখা ধুরধুরে হলুদ পাতাযুক্ত জার্মান বই ম্যাক্সের কাছে সযত্নে রাখা আছে। ভারতপ্রেমের দিক থেকে ওর বাবাও কম যাননি, ষাটের দশকের শেষদিকে উনি মহর্ষি মহেশ যোগীর শিষ্য হয়ে হৃষীকেশের আশ্রমে আস্তানা গেড়েছিলেন, সেতার বাজাতে শিখেছিলেন, কে জানে স্বয়ং রবিশঙ্করের কাছেই হয়তো। সেতার নামক সেই অদ্ভুত যন্ত্রটি এখনও ওর অ্যাপার্টমেন্টের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে। তারের ওপরে সজীব আঙুলের ছোঁয়া লাগেনি বহুদিন, কিন্তু জীবনের বাকি সব অকারণ ভালোবাসার গল্পের মতন সেই সেতারটিও রয়ে গেছে একলা, অপাপবিদ্ধ এবং চিরন্তন। বাবা ভদ্রলোকটি মারা গেছিলেন এইডস রোগে, ম্যাক্সের বয়েস তখন পনেরো। সেই থেকে ও মায়ের কাছে মানুষ যদিও পায়ের ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে ওর সময় লাগেনি। স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি, সেখান থেকে মেডিক্যাল স্কুল, সবটাই হয়েছে স্কলারশিপের টাকায়। ম্যাক্স খুব অল্প বয়েস থেকে নিজেই নিজের অভিভাবক। বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে ও পেয়েছে তার ছেঁড়া সেতার, ভারতপ্রেম এবং অবাধ, অকুণ্ঠ বাউন্ডুলেপনা। তফাৎ শুধু এইখানে যে ওর পিতৃদেব আধ্যাত্মিকতার আকাশে ডানা মেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু ঘটনাক্রমে ম্যাক্স হয়ে উঠেছে এপিডেমিওলজিস্ট। বৃহৎ নিয়ে ও আদৌ চিন্তিত নয়, ওর কারবার শুধু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রদের নিয়ে। বীজাণুদের অদ্ভুত জগৎ, যা কিনা আণুবীক্ষণিক হলেও পরম শক্তিমান, তার বাসিন্দারা ঈশ্বরের মতই অদৃশ্য, নির্মম এবং সমদর্শী।

    এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই বাড়ি। নিপু রোজকার মতন আজও খাবার নিয়ে বসে আছে, কিন্তু ওর চোখমুখ দেখেই রন বুঝতে পারলো যে বড়ো রকমের কিছু একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে আজ।

    “ইস, তুমি এতক্ষণ না খেয়ে বসে আছো?”

    ব্যাস ওইটুকুই যথেষ্ট, তুবড়ির মুখে ফুলঝুরি লাগালে যেমনটা হয়, ঠিক সেইভাবে ফেটে পড়লো নিপু।

    “আচ্ছা তুমি কি গো? অপু তোমাকে তিন বার ফোন করেছিল, আমি কম করে পাঁচ বার। একটা টেক্সট করে বলে দিতে পারতে যে ব্যস্ত আছো! জানি আমরা সাধারণ মানুষ, ওদিকে তোমার কাঁধে দুনিয়ার ভার, তাও এইটুকু করতে কি হয় বুঝি না!”

    যেন প্রচুর কষ্ট করে ফোনটাকে পকেট থেকে টেনে বার করলো রন। সত্যিই তো প্রায়, গোটাদশেক মিসড কল সঙিন উঁচিয়ে খাড়া হয়ে আছে। সেই সকাল সাড়ে সাতটায় পয়লা মিটিংটায় বসার সময় ওটাকে নীরব করা হয়েছিল, তারপরে প্রায় বারো ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল তার হিসাব রাখার সময় ছিলো না রনের। কিন্তু নিপুর কাছে ওসব অজুহাত অচল, তার চেয়ে বোকা সাজাই সবথেকে বুদ্ধিমানের কাজ।

    “কি হয়েছে অপুর? ওরা সবাই ঠিক আছে তো?” রন অতিশয় ক্যাবলার মতন প্রশ্নটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল, যদিও এক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসূত্র এবং দুশ্চিন্তার মাত্রাটা ওর পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব।

    ওরা দুই বোন নিপুণা আর অপর্ণা একে অপরের ছায়া বললেও হয়। ওদের দুজনের বিয়ে হয়েছিল একই দিন, একই লগ্নে, বিয়েবাড়ি, ক্যাটারার, পুরুতমশাই, এমনকি অনারারি ঘটক ঠাকুরাণী অবধি সবই ছিল অভিন্ন। সেই আমলে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় একজাতীয় তুখোড় সংসারী মহিলাদের দেখা মিলতো, বৌদি উপাধিতে যাঁরা বিখ্যাত ছিলেন। ম্যানেজারি দক্ষতায় আজকালকার এম-বি-এ ডিগ্রীধারীদের কান কেটে নিতে তাঁদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হতো না। তাদেরই একজনের কারসাজিতে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ার জোড়া পাঁঠা একসঙ্গে বলি চড়েছিলো সেদিন। অপুর বর রুদ্রনাথ, সকলে ওকে রুডি বলেই জানে, মাইক্রোসফটের বড়ো চাকরি ছেড়ে এখন নিজেই একটা কোম্পানি খুলেছে। গুজব অনুযায়ী ওর বাজারদর নাকি বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই, তাই নিয়ে অপুর থেকে নিপুই যেন বেশি গর্বিত। ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছায় হোক তুলনামূলক একটা বিচার মাঝে মধ্যেই মাথা চাড়া দেয়। রনের সমগোত্রীয় যারা গবেষণা শিকেয় তুলে রেখে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নেমে পড়েছিল, তারাই আদতে বুদ্ধিমান কিনা সেই নিয়ে তর্ক ওঠে কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে রুডি সর্বদাই জামাইবাবুর এক নম্বর সাপোর্টার।

    “বস তুমি যেটা করছো সেটাই সলিড কাজ। আমরা সবাই আসলে গ্লোরিফায়েড জুয়াড়ি, এই গর্তের মাটি ওই গর্তে ফেলে পয়সা বানাচ্ছি, কিন্তু তোমরা না থাকলে এ সবই তাসের প্রাসাদ। উল্টোপাল্টা হাওয়া উঠলে কে কোথায় থাকবে কেউ জানে না। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বস।”

    জামাইবাবু কথাটা রুডি পছন্দ করে না, রনকে ও বস বলে ডাকে। চলনে বলনে, ধ্যানধারণায় রুডির সঙ্গে রনের বিস্তর ফারাক, কিন্তু ওরা গলায় গলায় বন্ধু। রুডির চরিত্রের মধ্যে যে জিনিষটা রনের সত্যিই পছন্দ সেটা হচ্ছে ভণ্ডামির অভাব। ওর কনসালটেন্সি ফার্মের আদত কাজ আমেরিকার চাকরি চীন দেশে চালান করা। আমেরিকার পুঁজিপতিরা সস্তায় উৎপাদন চায়, চায়নার পলিটিক্যাল প্রভুরা দেশের ছেলে বুড়ো সবাইকে চব্বিশ ঘণ্টা কাজে ব্যস্ত রাখার কসম খেয়েছে। এই দুই অতিকায় কায়েমী স্বার্থের মাঝখানে রুডির সামান্য ব্যবসা। নিজেকে নিমিত্তমাত্র বিচার করে ও দুহাতে পয়সা কামিয়ে চলেছে। এর মধ্যে ন্যায়, নীতি, পরিবেশ, দেশপ্রেম, মানবজাতির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি জটিল প্রসঙ্গ টেনে আনতে ও নারাজ। ও যা করে দুই দেশের নিয়মকানুন মেনেই করে, ট্যাক্স ফাঁকি দেয় না, নানান ভালো কাজে দেদার দানধ্যান করে এবং রাত্রিবেলা নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।

    “আচ্ছা রুডি, তুমি চাইলে তোমার ক্লায়েন্টদের ইন্ডিয়াতেও তো নিয়ে যেতে পারো। আফটার অল ইন্ডিয়া তোমার নিজের দেশ।” রন প্রশ্ন তুলেছে অনেক সময়।

    “দেখো বস ইন্ডিয়াতে কাজ করার প্রচুর হাঙ্গামা, তার চাইতে ইন্ডিয়ানদের এখানে আমদানি করে কাজটা করিয়ে নেওয়া ঢের সহজ। চায়না হচ্ছে গিয়ে কনফুশিয়াসের দেশ, ঘোর প্র্যাগম্যাটিক তোমরা যাকে দুর্নীতি বলো সেটাও ওখানে দস্তুরমতন একটা প্রতিষ্ঠান; তার নিজস্ব আইনকানুন আছে, সেগুলো সবাই মেনে চলে। ইন্ডিয়াতে সব কিছুই জগাখিচুড়ি, কে যে কখন কোন অবতারে দেখা দেয় বোঝা শক্ত। এক এক জায়গায় গভর্নমেন্টের এক এক রকম পলিসি, তার ওপরে আছে নানান রঙের পলিটিক্যাল দাদাগিরি, পুলিশ, গুণ্ডা, মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি, সোশ্যালিস্ট আঁতেল, ওঝা, জ্যোতিষী, ধর্মগুরু। সক্কলের আলাদা আলাদা অ্যাজেন্ডা, কেউ কারো সাথে কোঅপারেট করতে রাজি নয় কিন্তু কাঠি করতে ওস্তাদ। সেই জন্যেই তো তোমার মতন ব্রিলিয়ান্ট ছেলেরা সবাই দেশের বাইরে।”

    রুডি চালাক ছেলে, খুব সূক্ষ্মভাবে ও রনকে মনে করিয়ে দেয় যে পাসপোর্ট বদল করার পরে দেশপ্রেমের কথা না বলাই ভালো। রনও সাথে সাথেই গুটিয়ে যায়, নিজের যুক্তির অন্তঃসারহীনতা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওর কাছে তখন। এসব কথাবার্তা অবশ্য রুডির বীচ হাউসে বসে লবস্টার এবং ভিনটেজ ওয়াইন সহযোগেই হয়ে থাকে, সেখানে ভুলে যাবার অজস্র উপকরণ মজুত রয়েছে।

    “আমি রুডিকে ফোন করছি দাঁড়াও।”

    আশঙ্কা জিনিসটা অদ্ভুত, ঠিক ভাইরাসের মতন একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যায় তার জায়গা নেয় বিশুদ্ধ প্যানিক। রন বুঝতে পারলো কোথা থেকে খানিকটা খুব ঠাণ্ডা বরফ এসে ওর গলার মধ্যে গুলতানি করতে শুরু করেছে।

    “রুডি হাসপাতালে। ওর নিউমোনিয়া হয়েছে। কোভিড।” প্রায় ফিসফিস করে কথাগুলো বলল নিপু। নিঃসীম আতঙ্কে জড়ানো কথাগুলো রন একটু একটু করে শুষে নিল নিজের ভেতরে। রুডি ছয় ফুট লম্বা, ছিপছিপে এবং পেটানো চেহারার পুরুষমানুষ, নিয়মিত গলফ এবং টেনিস খেলে। নিউমোনিয়া তো দূরে থাক, ওকে সর্দিজ্বর বা পেটের অসুখে ভুগতেও কেউ দেখেনি কোনোদিন। ও সেই ধরনের লোক যারা রাত্রি দুটো অবধি উদ্দাম পার্টি করেও ঠিক সকাল সাতটায় ফ্রেশ হয়ে অফিসে পৌঁছে যায়। ওর সঙ্গে শেষবার ফোনে কথা হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে, রন তখন ফ্লোরিডার ছুটি বাতিল করে কাজে ফিরছে। রুডি তখন সাংহাইতে ওর নতুন অফিস খোলার উত্তেজনায় ডগোমগো।

    “বস নতুন একটা ডীল পাক্কা করে ফিরলাম। ক্লায়েন্ট খুব খুশি। ২০২০ বছরটা ভালোই যাবে মনে হচ্ছে। তোমার কি হল আবার, ফ্লোরিডার মিঠে রোদ্দুর ছেড়ে বস্টনের ঠাণ্ডায় ফিরলে যে হঠাৎ?” রুডি বলেছিল।

    “কিছু নতুন ডেভেলপমেন্ট ভায়া, ওই তোমার চায়নাতেই কোত্থেকে এক নতুন একটা ভাইরাসের খবর মিলেছে। আমার কলিগ, প্রফেসর ম্যাক্স অ্যারনস আমার হেল্প চেয়েছে তাই আসতেই হল। ওসব কথা বাদ দাও, তোমার নতুন অফিস খোলার জন্য কংগ্রাচুলেশনস! দু হাজার কুড়ির বিলিয়নিয়ারদের লিস্টে তোমার নামটাও উঠছে তাহলে।” রন হাসতে হাসতে বলেছিল সেদিন।

    “উঠলে উঠবে। ওই নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না বস। যা রোজগার করবো এই জীবনেই খর্চা করে ফেলবো দেখে নিও। দেখে নিও আই উইল ডাই ব্রোক। হা হা হা--” রুডির হাসির আওয়াজে ফোনটা কেঁপে উঠেছিল।

    “রুডি চায়নায় একটা অসুখ হচ্ছে। অনেকটা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতন কিন্তু বেশ কিছু লোক মারা যাচ্ছে। তুমি কিছু শুনলে?” একটুখানি চিন্তিত গলায় বলেছিল রন। মনের একদম ভেতরদিকে যে আশংকা দানা বাঁধছিল, ওর নিজের কাছেই তা অসম্ভব ঠেকেছিল সেদিন।

    “ওই উহানের আউটব্রেকটার কথা বলছো। ও তো একটা বিচ্ছিরি টাইপের সর্দি জ্বর। জায়গাটাকে ওরা সীল করে দিয়েছে, দুদিন বাদেই সব কনট্রোলে এসে যাবে। এই ব্যাপারে চাইনিজ গভর্নমেন্ট একেবারে এক্সপার্ট। শোনো বস, আমি না ফ্লোরিডায় একটা ছোটো ইয়ট ভাড়া নেবার কথা ভাবছি। দুটো ঘর, একটায় তোমরা থাকবে, একটায় আমরা। তোমার আস্তানা থেকেই ফটাফট করে ক্যারিবিয়ানের নানা জায়গায় পাড়ি দেবো। একেবারে জমে মাখন, কি বলো?”

    আবার সেই ফুসফুস ভরা হাসি। সফলতা শিকারি আজ তো অনেকেই আছে কিন্তু উদার জীবনচর্চায় রুডি অনন্য। চেষ্টা করলেও ওকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না।

    “সরি রুডি কিন্তু উহানের ব্যপারটাকে আমরা একেবারেই লাইটলি নিচ্ছি না। আমাদের ধারণা এটা একটা নতুন ভাইরাস, সম্ভবত স্পিসিস জাম্প করেছে, ইট মে বিকাম আ ডেডলি কন্ট্যাজিয়ন। তুমি সাবধানে থেকো, আমি তো বলবো কয়েক সপ্তাহ বাড়ির বাইরে বেরিয়ো না, প্লীজ সেলফ কোয়ারেন্টিন ইয়োরসেলফ।” রন বলেছিল।

    “বস তোমরা বৈজ্ঞানিকেরা বড্ড সিনিক্যাল। কোথায় কিছু লোক অসুস্থ হয়েছে বলে কাজকর্ম বন্ধ করে বাড়িতে বসে থাকা যায় নাকি? চায়নার প্রবলেম, চায়না ঠিক সামলে নেবে দেখো। ঠিক আছে তুমি যখন বলছ তখন আমি নাহয় মাসখানেক ওধার মাড়াবো না। এপ্রিলে কিন্তু যেতেই হবে, বলে দিচ্ছি, নতুন ব্যবসা বলে কথা। ওদিকে তুমি হোম ফ্রন্ট সামলাও, শুধু শুধু ছুটি বাতিল করলে বলে নিপুদি কিন্তু বহুত খচে আছে।” রুডির গলায় তখনও তরল কৌতুক।

    রুডি পাত্তা দেয়নি সেদিন। ওর মতন মানুষের পক্ষে বাড়িতে বসে থাকা অসম্ভব। এপ্রিল মাসে চায়না যাবার উপায় নেই, প্রয়োজনও হয়নি। চায়না থেকে সেই অদৃশ্য পদাতিক কখন চুপচাপ ওরই কাছে এসে হাজির হয়েছে। এখন ও দেশের অন্যপ্রান্তে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, ওর হাসি ঠাসা ফুসফুসে এখন প্রদাহ।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments