• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | উপন্যাস
    Share
  • সন্ত্রাস (শেষ পর্ব) : কৌশিক সেন



    ।।১৩।।
    "Everybody knows that pestilences have a way of recurring in the world, yet somehow we find it hard to believe in ones that crash down on our heads from a blue sky. There have been as many plagues as wars in history, yet always plagues and wars take people equally by surprise."
    “তোমার কি হয়েছে বলতো রনি? সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকো, হাসপাতাল থেকে ফিরে সেই যে ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাও, আমার সঙ্গে গুনে গুনে তিনটে কথা বলো কিনা সন্দেহ” নিপু টিভি বন্ধ করে রিমোটটা ঠকাস করে রেখে দিল। একটু আগে রন আওয়াজ কমাতে বলেছে।

    “কি মুশকিল, আমি কি টিভি বন্ধ করতে বললাম। গাঁক গাঁক করে না চালালেই হয়। তুমি দেখো আমি বরং অফিসে গিয়ে কাজটা শেষ করি” ল্যাপটপ থেকে মুখ না তুলেই বলল রন। নিপুর মনে হল লোকটা বুঝি ঝগড়া করতেও ভুলে গেছে। খাবার পরে ওরা হয় একসাথে হাঁটে কিংবা জিমে যায় হপ্তায় অন্ততঃ তিনবার। আপাততঃ এই প্যানডেমিকের বাজারে জিমে যাওয়াটা বন্ধ আছে। রাত্তির হলে বেডরুমে বসে একসঙ্গে টিভি দেখে ওরা। চিরকেলে এই রুটিন তো নিপুরই বানানো। সবই চলছে কিন্তু পাশের মানুষটা যেন জম্বি, ওর শরীরটা আছে কিন্তু মন উধাও, সঙ্গী বলতে ল্যাপটপ আর হুইস্কির গ্লাস।

    “রনি তুমি অ্যালকোহলিক হয়ে যাচ্ছ। তোমার ব্যবহার ডিপ্রেশনের রুগীর মতন। কিন্তু কারণটা কি বলতে পারো, নাকি আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ। কিসের অভাব তোমার বলো? নাম, যশ, টাকাপয়সা, পরিবার, ছেলেমেয়ে, বন্ধু আত্মীয়স্বজন সবই তো তোমার আছে” অসহায় গলায় বলে উঠলো নিপু। এর আগে কয়েকবার চেঁচামেচি করে দেখেছে, লাভ হয়নি কিছুই। একটা ঠাণ্ডা পাথরের দেওয়ালের সঙ্গে ঝগড়া বা লড়াই করে জেতা অসম্ভব।

    “হ্যাঁ, তুমি যা যা বললে সে সবই আমার কাছে আছে। হয়তো প্রাপ্যের চেয়ে অনেকটাই বেশি” দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অসম্ভব শান্ত গলায় বলল রন।

    “তাহলে একটা প্রশ্ন করতে আমি বাধ্য রনি। আমি স্বপ্নেও যা কখনো ভাবিনি তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি এখন- আর ইউ হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার? তুমি কি প্রেম করছো মিরিয়ম নামের ওই মেয়েটার সঙ্গে? সত্যি কথা বলো রন। তুমিই বলেছিলে না যে ম্যাক্সের সঙ্গে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে?” প্রাণপণ চেষ্টায় কথাগুলো ছুঁড়ে দিল নিপু। ওর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে কেউ। রনি, ওর এত আদরের আর গর্বের রনি, ওকে সন্দেহ করতেও যে বুক ফেটে যায়।

    “তোমাকে এই আইডিয়াটা কে দিয়েছে? রুডি না অপু?” একটুক্ষণ অপেক্ষা করে ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলো রন। ওর মুখের ভাব দুর্বোধ্য।

    “কেন আমার বুঝি নিজের আইডিয়া থাকতে নেই। সেদিন পার্টিতে তোমরা দুজন যা করছিলে” নিপুর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে, গলা এমন শুকনো যে ঠিক করে ও কথাই বলতে পারছেনা। রেফ্রিজারেটর থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে ওর হাতে ধরিয়ে দিল রন।

    “নিপু, মিরিয়ম কারোরই প্রেমিকা নয়, কোনোদিন ছিলও না। ও একটি পাকা গুপ্তচর। শী ইজ অ্যান ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্পাই। অনেক খবর নিয়ে সব আটঘাট বেঁধে ও আমাদের মধ্যে ইনফিলট্রেট করেছিল। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে না হতেই ও কর্পুরের মতন মিলিয়ে গেছে” ক্লান্ত গলায় বলল রন। কথাগুলো বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো নিপু।

    “শী হোয়াট”

    “অনেক গল্প নিপু। রুডিকে জিগ্যেস কোরো সব বুঝিয়ে দেবে। আমাকে কাজ করতে দাও।

    “না আমি তোমায় কাজ করতে দেবোনা” চিৎকার করে উঠলো নিপু, “আমি তোমার স্ত্রী, তোমার জীবনে কি সব ঘটে চলেছে আমার জানা দরকার”

    আধঘণ্টা বাদে বাদে দেখা গেল রনের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে নিপু হাপুস নয়নে কাঁদছে, আর অপ্রস্তুতভাবে ওর মাথায় হাত বুলোচ্ছে রন। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কতো কথাই না বলে যাচ্ছে নিপু তার একটাও ওর কানে ঢুকছেনা। একই রকম শূন্যদৃষ্টি মেলে বিছানার পাশে রাখা ল্যাম্পটার দিকে তাকিয়ে আছে ও।

    “শোনো, কাল শুক্রবার সমু আর ওর বান্ধবী আসছে। ওদের সামনে একটু হাসিখুশি থেকো প্লীজ, নাহলে মেয়েটা ঘাবড়ে যাবে” একটু সামলে নিয়ে রনের টি-শার্টেই নাক চোখ মুছে নিয়েছে নিপু। রন দেখছে আর ভাবছে যে নিপুর কাছে জীবনের হিসেবটা কেমন স্বচ্ছ আর সাবলীল, সেখানে ভালোবাসার পথঘাট সব কেমন পাথরে বাঁধানো মজবুত। ও কিছুতেই সেই নির্দিস্ট পৃথিবীর ঠিকানা খুঁজে পাবেনা। ওর জটিল মস্তিষ্কের ভাঁজে ভাঁজে কেবলি সংশয় আর সংশয়।

    “আমি খুব ভালো হয়ে থাকবো, দেখো” ওর মাথাটা আরেকবার বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল রন। অনেক দিন বাদে শরীর জাগানোর চেষ্টা করলো ওরা দুজনে। করুণ চেষ্টা, তবুও শেষ অবধি শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো নিপু। এখন ওর কাছে রয়েছে সেই দুই সদা বিশ্বস্ত সঙ্গিনী, অনিদ্রা আর টেলিফোন। বাইরে কি বৃষ্টি নেমেছে? জুলাই মাস, বৃষ্টি নামতেই পারে এখন। দেশে বৃষ্টি নামলেই বোঝা যেত, জলের শব্দ আর ভেজা মাটির গন্ধ বলে দিত যে বৃষ্টি এসেছে। তখন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস কোলে নিয়ে জানলার পাশে দিব্যি বসে থাকা যেত অনেক অনেক ঘণ্টা। বইয়ের পাতায় পাতায় আফ্রিকা কিংবা দক্ষিণ আমেরিকায় ঘুরতে ঘুরতে দেখা যেত, সেই ছোট্ট গলিটা কেমন করে বিরাট এক নদী হয়ে যাচ্ছে। সেই নদীই তখন কঙ্গো অথবা অ্যামাজন, সেখানে নৌকো ভাসাচ্ছে সাংধাতিক সব জংলী যোদ্ধারা।এখন এই চারদিক বন্ধ বিরাট বিরাট বাড়িগুলোর মধ্যে বসে কিছুই ভালো করে বোঝা যায়না, শুধু ঘুমোতে ভয় করে, ঘুমের মধ্যে শৈশব কেবলি তাড়া করে বেড়ায়।

    ম্যাক্স জেগে আছো? নাকি আমার মতন তুমিও অনিদ্রায়? ছোট বেলায় একটা কবিতা পরেছিলাম জানো। স্কুলে আমাদের বাংলা পাঠ্যবইয়ের কবিতা, কার লেখা, কি নাম সব ভুলে গেছি শুধু শেষের চারটে লাইন মনে আছে। তোমার জন্য তর্জমা করে দিচ্ছি দাঁড়াও-পথে পথে রাতে, এই বাদলাতে, তুমিও কি ফেরো ভাই?

    তোমারেও তবে ধরেছে বন্ধু আমার অনিদ্রাই।

    মেঘে আর ঘুমে, ঘুমে আর মেঘে ডুবে গেছে যত তারা,

    কোন কেতকীর শোকে হে বন্ধু তুমিও নিদ্রাহারা?

    ধুত্তেরি, কেয়াফুলের আবার ইংরেজি হয় নাকি? নাঃ, তর্জমা ভালো হল না, মাপ করো আমায়। আচ্ছা ম্যাক্স তোমার খারাপ লাগছেনা? নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছেনা তোমার? কোত্থেকে একটা বাচ্চা মেয়ে এসে তোমার আমার মতন পোড়খাওয়া লোকদের বোকা বানিয়ে দিয়ে চলে গেল, এই বয়সে মানবিক দুর্বলতাগুলোকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করলে তুমি। সরি, আবার ভুল বললাম, কেবল তুমি না, আমিও যে আবিষ্কার করলাম অনেক কিছু। কিন্তু সেই সব আবিষ্কারের মধ্যে শান্তির খবর নেই, সেখানে শুধু দুঃখ আর আক্রোশ। আমাদের খাটনির ফল নিয়ে ওরা ফাটকাবাজি করবে, বৈজ্ঞানিক হিসাবে শুধু এইটাই আমাদের পাওনা।

    “রনি ওঠো। অফিসে যাবেনা? রনি”

    মাথার মধ্যে একরাশ কুয়াশা সামলে কোনোরকমে বিছানা ছাড়লো ও। খুব ইচ্ছে করছে এইরকম লেপ চাপা, কুকুরকুণ্ডলী হয়ে দুপুর অবধি ঘুমোয়। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক সকাল সকাল কাজে না গেলে চলবে কেন, লোকেই বা বলবে কি?

    “কফিটা খেয়ে নাও। এত রাত্তির জাগো কেন রোজ রোজ? সকালে কেমন যেন আচ্ছন্ন দেখায় তোমাকে। খুব চিন্তা হয় আমার, ঘুম চোখে গাড়ি চালাতে গিয়ে কখনো যদি-”

    “চুপ। নিপু, প্লীজ চুপ করো। ভয় দেখিও না আমায়, প্লীজ” কথাগুলো নিঃশব্দে ওর চোখের ভেতর থেকে ছিটকে বেরোলো, নিপুও চুপ করে গেল সাথে সাথেই। ঈষৎ টলোমলো পায়ে বাথরুমে ঢুকে গেল রন। এখন অন্ততঃ পনেরো মিনিট ও গরম জলের ধারার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে। এইভাবে ও যেন ধুয়ে ফেলতে চাইবে ওর আত্মার চারিদিকে জমে ওঠা ক্লেদ। আধঘণ্টা বাদে ও যখন ওর বি-এম-ডব্লিউ গাড়ীতে স্টার্ট দেবে তখন ও অন্য মানুষ। সকালবেলায় ক্লিনিকে রোগী দেখা, ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো, দুপুরবেলায় একের পরে এক মিটিং আর ব্রিফিং নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ও। ভ্যাকসিন ট্রায়ালগুলো দ্রুত এগোচ্ছে, আর কয়েক মাসের মধ্যেই বাজার ভাসিয়ে নানান কোম্পানির টীকা এসে হাজির হবে। এ যেন শকুনির শেষ প্রহর, আসন্ন মুনাফার সন্ধানে অতি সজাগ হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। কিন্তু যেই না বিকেল হবে, স্কাইস্ক্যাপারের ছায়া গড়িয়ে পড়বে ওর অফিসের জানলায়, ওর ভেতরকার পাগলামিটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে তক্ষুনি। কিছু হলোনা, শুধু শুধু কেটে গেল আরেকটা মহার্ঘ দিন।

    টুমরো অ্যান্ড টুমরো অ্যান্ড টুমরো, ক্রীপ্স ইন দিস পেটি পেস ফ্রম ডে টু ডে-লাইফ ইজ বাট আ ওয়াকিং শ্যাডো। ইট ইজ আ টেল টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট। ফুল অফ সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি, সিগনিফাইং নাথিং-জীবন আসলে এক বোকার বানানো গল্প, এবং সেই বোকাটি আর কেউ নয়, স্বয়ং ভগবান। এতদিন আগে এমন সহজে এই ভয়ঙ্কর সত্য কথাটি কি করে বললে হে মহাকবি? তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, শুধু শুনি। শুনি আর ভাবি যে আমাদের এই অর্থহীন সাধারন অস্তিত্ব বয়ে বেরানোর কি প্রয়োজন? বিরাটকে যে দেখতে পেয়েছে অথচ ছুঁতে পারেনি তার যন্ত্রণার মহাকাব্য কে লিখবে বলো দেখি? ফোনটা বেজে উঠেছে। রুডির ফোন।

    “রুডি কেমন আছো?”

    “ভালো আছি বস। তুমি কেমন?”

    “ভালোই তো। তোমার আর্লি রিটায়ারমেন্ট কেমন লাগছে?”

    “ফাটাফাটি বস। সকালে উঠে অফিসে ছুটতে হচ্ছেনা, এর থেকে আরামের আর কি আছে বলো? ট্র্যাভেল করা নেই, ক্লায়েন্টকে তেল দেওয়া নেই, শুধু ফ্যামিলির সঙ্গে সময় কাটানো। হেভেনস! আচ্ছা বস ভ্যাকসিন ট্রায়ালগুলো কেমন চলছে? কোন কোম্পানির প্রডাক্ট প্রথম বাজারে আসবে বলতে পারো?”

    “রুডি আমি পার্সোনালি ওই ট্র্যায়ালগুলোতে ইনভলড নই আর থাকলেও এ নিয়ে আলোচনা করা যে আনএথিক্যাল তা তুমি ভালো করেই জানো”

    “আরে জানি। আমিও আর এসব ফাটকাবাজির মধ্যে নেই বস। ছাড়ো ওসব, কবে আবার ওয়েস্ট কোস্টে আসবে সেই কথা বলো। মাম্পি খুব ভালো আছে, গত উইকএন্ডেই এসেছিল। ওর নতুন একজন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে জানো তো? আমেরিকান ছেলে কিন্তু খুব ভদ্র, অপুর তো খুব পছন্দ”

    “আচ্ছা রুডি একটা কথা জিগ্যেস করি? তোমার ওই মেয়েটির কথা আর মনে হয়না? জাই-কু না কি যেন নাম। যার খবর নেওয়ার জন্য ওই অসুস্থতার মধ্যেও ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলে তুমি?”

    রনর গলার মধ্যে কি রুক্ষতা ফুটে উঠলো আবার? কয়েক সেকেন্ড সব চুপচাপ।

    “মাপ করো রুডি, এটা তোমার ব্যক্তিগত ব্যপার। আমার প্রশ্ন করা উচিৎ হয়নি”

    “না বস, প্রশ্ন যখন করেছো, উত্তর দেওয়া আমার কর্তব্য,” খুব ধীরে ধীরে বলল রুডি, “তুমি যাই বলো আমি আর অপু বিশ্বাস করি যে তুমি আমার প্রাণদাতা। তোমাকে সব খুলে বলিনি কেননা তোমার নৈতিক অবস্থান আমি জানি, এবং তোমার চোখে অপরাধী হতে ইচ্ছে করেনি আমার”

    “রুডি, বিশ্বাস করো আমার নৈতিক কাঠামো অনেকদিন আগেই নড়ে গিয়েছে, আমি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা আমি নিজে জানিনা। তোমার বিচলিত হবার কোনও কারণ নেই, আই উইল নট জাজ ইউ”

    “ওকে, সংক্ষেপে বলছি। আমি আর রিচ শী দুজনে মিলে একটা প্ল্যান করেছিলাম। রিচ বুঝতে পেরেছিল প্যানডেমিক আসছে কিন্তু সরকারগুলো, সে চায়নার হোক বা আমেরিকার, যতদিন পারবে সব চেপেচুপে রাখার চেষ্টা করবে। রিচ ইজ আ ব্রিলিয়ান্ট বায়োলজিস্ট কিন্তু লোকটা লোভী, ও অবস্থাটার ফয়দা তোলার চেষ্টা করলো। ঠিক সময়মতন ব্যবসা গুটিয়ে আমরা ইম্পোর্ট-এক্সপোর্ট থেকে বায়োটেকনোলজিতে ইনভেস্ট করতে শুরু করলাম। গোলমাল শুরু হল যখন রাতারাতি উহানে লোকজন মরতে শুরু করলো, এপিডেমিকটা যেন বোমার মতন ফেটে পড়লো আমাদের মুখের ওপর। জাই একজন নার্স, তোমার মতন ওরও কিছু কিছু নৈতিক হাঙ্গামা আছে। ও কি করতে চেয়েছিল আমি জানিনা কিন্তু একদিন সন্ধ্যাবেলা রিচের সঙ্গে ওর জোর ঝগড়া হল, শুধু ঝগড়া নয় মারপিটও। রিচের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল জাই, পরদিন সকালে আমাকে ফোন করে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি যেন চায়না ছেড়ে পালাই। ব্যস, তারপর তোমার কাছ থেকে আমি ওর শেষ খবর পেলাম। রিচ বেকার আমার পেছনে ধাওয়া করলো। প্লেন ছাড়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমার পোর্টফোলিও লিকুইফাই করা হয়ে গেছিল, পুরনো ধান্ধার সঙ্গে সব সম্পর্ক তখন শেষ। তবে আরেকটা কথাও তুমি শুনে রাখো বস। রিচ শেষ অবধি পার পাবে না, বেইমানির শাস্তি ওকে পেতেই হবে” রুডির গলাটা কয়েক মিনিটের জন্য বরফের মতন ঠাণ্ডা শোনালো।

    “ঠক বাছতে গা উজাড় না হয়ে যায় রুডি। যাই হোক তুমি ভালো আছো, অপু, রোহন ভালো আছে, এটাই সবথেকে আনন্দের খবর। বাই”

    ফোন রেখে দিল রন। রুডির ওপর ও কিছুতেই রাগ করতে পারেনা। পরিবার একটা অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান বটে, মানুষকে সুখ আর সার্থকতার যুগল প্রতিশ্রুতি দিয়ে শেষ অবধি তার আত্মাটাকেই কিনে নেয়। যে ভালোবাসায় সে একদিন মুক্তি খুঁজেছিল সেই ভালোবাসাই তার শেষ শৃঙ্খল।

    ফোনটা বেজে উঠেছে আবার। অচেনা নম্বর। একবার ধরলো না কিন্তু ওপ্রান্তের ব্যক্তিটিও নাছোড়বান্দা। ভয়েস মেলে গলার আওয়াজটা শুনেই উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো রন। এ তো ম্যাক্সের গলা! প্রায় মাসদুয়েক হয়ে গেল লোকচক্ষুর বাইরে রয়েছে ম্যাক্স। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, ডাউনটাউনে ওর সেই বিখ্যাত অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় ভাড়াটে চাই নোটিশ ঝুলছে এখন। দেখা যাচ্ছে ফোন নম্বরটাও পালটেছে।

    “ম্যাক্স কেমন আছো এবং কোথায় আছো? তোমার জন্য চিন্তায় রয়েছি আমরা সবাই”

    “মাপ করো রন, তোমাকে না জানিয়েই নিরুদ্দেশ হতে হল, কেননা নাহলে তোমরা সবাই মিলে আমায় রুখে দিতে।

    “ম্যাক্স, আমার একমাত্র বন্ধুকে গুম করে দেবার জন্য অভিনন্দন। একটা কথা পরিষ্কার করে বলো দেখি। বয়েস হলে ফ্র্যাকচার জোড়া লাগতে সময় বেশি লাগে আমি জানি। হৃদয়ের ব্যাপারেও কি ওই একই ফরমুলা?” রন টের পেলো ওর ভেতরটা হালকা হয়ে আসছে, জমে থাকা কথারা একসাথে বেরিয়ে আসতে চাইছে তুবড়ির মতন। বন্ধু ছাড়া জীবন যেন এক অন্ধকূপ।

    “এটা হৃদয়ের সমস্যা নয় রন। ঠিক তোমার মতন আমার কাছেও এটা বৌদ্ধিক সমস্যা। জানো তুমি যখন ছিলেনা, আমি দুটো ট্রায়াল নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম তখন ছায়ার মতন আমার সঙ্গে লেগে ছিল মেয়েটা। কি অদ্ভুত নিষ্ঠা, কি অমানুষিক খাটার ক্ষমতা, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।

    “ম্যাক্স, মাই ফ্রেন্ড, ঠিক ওই সময়টাতেই ও ট্রায়ালের সব কটা অ্যালগোরিদম আর ডাটা সেট ম্যানিপুলেট করেছে, যাতে সেগুলো ইতিবাচক দেখায়। ও এবং ওর কর্পোরেট প্রভুরা ঠিক করেছে যে এম-১২১৯ এবং তার প্রটাগোনিস্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধটি সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ুক, কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা নিশ্চিন্ত হোক। তোমার ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হতে চলেছে। তুমি, আমি সকলেই তো এই দানবিক ঘানিতে আটকে ঘুরে চলেছি, তাইনা?” তিক্ত গলায় রন বলল।

    “আমাকে বাদ দাও, আমি এখন ক্যারিবিয়ানের এক অনামা সমুদ্রতীরে, লড়ঝড়ে একটা বাড়িতে বসে আছি। সভ্যতার সঙ্গে আমার সব সম্পর্ক শেষ। কিছু শুধু তোমাকে নিয়ে এখনও একটু সমস্যা আছে আমার, বলতে পারো অপরাধবোধ।”

    “গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেললে বন্ধু। একটু আগেই বললে না যে সমস্যাটা নাকি হৃদয়ঘটিত নয়, নিছকই বৌদ্ধিক, কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অপরাধবোধের গল্পটা অবান্তর। কি বলতে চাইছো ঝেড়ে কাশো দেখি, এই নিয়ে অনেকদিন ভুগিয়েছো আমায়,” তর্জনের আড়ালে চুপচাপ হাসছে রন।

    “বলতে চাইছি এই যে প্রিন্সিপ্যাল ইনভেস্টিগেটর ডক্টর রন চ্যাটার্জি তার ট্রায়ালের মধ্যে বেআইনি কারচুপিটা ধরে ফেললো এবং সবাইকে জেলে পাঠানোর জন্য যথেষ্ট প্রমাণ হাতে থাকা সত্ত্বেও সে চুপ করে বসে থাকলো কেন? রহস্যটা কি আমাদের পরিচিত কোনো কুহকিনীর বেডরুমে লুকিয়ে রয়েছে?” ম্যাক্সের গলার মধ্যে এক অপরিচিত উত্তাপ। ঈর্ষার গন্ধ অনেকটা রক্তের গন্ধের মতন, বহুদূর থেকেও টের পাওয়া যায়।

    রন শব্দ করে হাসলো এবার। একই দিনে দুজনের কাছ থেকে একই সন্দেহের খবর পাওয়া কম কথা নয়।

    “ম্যাক্স, আমি যা করেছি তার সঙ্গে তোমার কিংবা মিমির কোন সম্পর্ক নেই। আমার সব সিদ্ধান্তের মূলে রয়েছে আমার পরিবার, যেখানে আমি দায়বদ্ধ। মাকড়সার জালের মতন আমাদের জীবনগুলো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, কিন্তু তার জন্য আমি কিংবা তুমি কেউই স্বইচ্ছায় বা সোজাসুজি দায়ী নয়। আমার ধারণা হয়েছিল ফাইপ্রো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির এক বিরাট অঙ্কের শেয়ার তখন আমার শ্যালক রুডির হাতে, এবং তার ওপরে নির্ভর করছিল ওদের সংসারের সুখ এবং সুরক্ষা। তাই সব জেনেশুনেও আমি ওকে বাসের তলায় ফেলে দিতে পারিনি। এখন জানতে পেরেছি যে সেই ধারণাটাও সত্যি ছিলোনা, সবটাই একটা উদ্ভট নকশা” ক্লান্ত গলায় কথাগুলো বলে থামল রন। ওদিক থেকে গভীর নিস্তব্ধতা খানিকক্ষণ।

    “তোমার ইচ্ছে করেনা এই সব কায়েমী স্বার্থের মুখোশ খুলে দিতে, রন?” ওদিক থেকে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস একটুকরো।

    “করে, কিন্তু সেই সব অনাচার যে আমার নিজের বাড়ির উঠোনেই গ্যাঁট হয়ে বসে আছে ম্যাক্স। তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার উপায় আমার জানা নেই। তোমার আছে কি?”

    “আমি ভাবতাম আমার আছে। আমি সারা জীবন মুনাফাসর্ব্বস্ব উন্নয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কোনোদিন কারো তোয়াক্কা করিনি। আমি মেটিরিয়ালিস্ট, শরীর বুঝতাম কিন্তু প্রেম-ভালবাসায় কোনোদিন বিশ্বাস ছিলোনা আমার। প্রথম যখন আলাপ হল তখন মিমির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে অবশ্যই যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু জীবন জড়াতে আদৌ চাইনি। কিন্তু জানো মেয়েটার কি অদ্ভুত ক্ষমতা, একটু একটু করে আমার শক্ত খোলসটার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা ছিদ্র খুঁজে পেল। আমি জানতেও পারলাম না কখন ও সেটার মধ্যে খুব সাবধানে ড্রিল চালিয়ে চালিয়ে আমার অজান্তেই বিরাট একখানা গর্ত বানিয়ে ফেলেছে। এই বয়সে এসে আমি প্রকৃতির সেই প্রাচীন যড়যন্ত্রের গল্পটা আবার নতুন করে শিখলাম। সেই নারীই আমার অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দিল, যাকে আমি ভালনারেবল ভেবে নিজের পাখার তলায় জায়গা দিতে চেয়েছিলাম।

    ভালনারেবল কথাটার বাংলা কি? নিরেট অন্ধকারের মধ্যে মগজ হাতড়ালো রন। উজ্জ্বল একটা মুখ আর সরল অথচ ঋজু এক দেহলতা ঠিক যেন কাটা ঘুড়ির মতন অন্ধকারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওর মনে হল কথাটার বাংলা হবে ভেদ্য। যাকে ভেদ করা যায়, যে সহজেই বিদ্ধ হয়। এ আসলে সেই চিরন্তন গহ্বর, পৃথিবীর তাবৎ পুরুষসিংহের দল যার অতলে তলিয়েছে চিরকাল।

    “ম্যাক্স, একটা কথা ভেবে দেখো। এম-১২১৯ প্যানিক অ্যাপ্রুভ্যাল পেয়েছে ঠিকই কিন্তু ওষুধটা নেহাৎ খারাপ নয়, অনেকে উপকার পেয়েছে, হাসপাতালে থাকার সময় কমেছে। সেটাও তো কম কথা নয়” মরিয়া হয়ে কথা ঘোরানোর একটা চেষ্টা করলো রন। একটানা আত্মনিপীড়ন অসহ্য হয়ে উঠছে এখন।

    “হায় প্রফেসর চ্যাটার্জি তুমিও এই পুরনো বন্ধুর কাছে মিথ্যে বলছ। আমি কি জানিনা তোমার মনের মধ্যে কি হচ্ছে? কার চোখে ধুলো দিচ্ছ তুমি? অন্ধকারের ওপাশ থেকে যেন ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো রন। হ্যাঁ, ওষুধটা কিছু কাজ দিয়েছে কিন্তু ব্যবসা করেছে তার থেকে অনেক বেশি। অনেক কমদামী পুরনো ওষুধ দিয়েও এই অসুখের চিকিৎসা করা যায় কিন্তু তাতে কারোর ফয়দা নেই। কিছুদিন বাদে আরো ভালো ওষুধ বেরোবে, শেষ অবধি হার মানবেই বীজাণু। কিন্তু এর মধ্যে যার টাকা বানানোর মতলব সে এর মধ্যে ঠিক টাকা বানিয়ে কেটে পড়বে।

    “ম্যাক্স, গত শতাব্দীতে ইন্ডিয়ার ফ্রীডম মুভমেন্টের সময় সুভাষ চন্দ্র বোস নামে একজন লীডার ছিলেন জানো। আজকের দুনিয়ায় গান্ধীজির তুলনায় আণুবীক্ষণিক সংখ্যক লোকজন তাঁর নাম জানে কিন্তু আমার বিশ্বাস ওঁর জন্যই তড়িঘড়ি ভারত থেকে পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কলোনিয়াল ইতিহাসে সবচেয়ে শক্ত খুঁটি ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি, যাদের আনুগত্যে চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছিলেন একা সুভাষচন্দ্র। ইতিহাস কিন্তু এই কথাটা মনে রাখেনি। গোলমাল এইখানে হয়েছিল যে ভদ্রলোক সমঝোতা কথাটার বানান বা মানে কোনটাই জানতেন না। সারা জীবন ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে টুথ অ্যান্ড নেইল লড়ে গেলেন, তারপর যুদ্ধের শেষে একদিন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ। বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তাই নিয়ে গপ্পো লেখা হয়ে চলল পঞ্চাশ বছর ধরে। রোম্যান্টিক কাহিনী যারা ভালোবাসে তাদের কাছে উনি এখনও সেই নাইট ইন শাইনিং আর্মর কিন্তু ইন্ডিয়া ওঁকে বাদ দিয়েও দিব্যি এগিয়ে গেছে। ল্যাটিন আমেরিকায় চে গুয়েভারার গল্পটাও অনেকটা ওইরকম। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিষ্ঠান শেষ অবধি ঠিক জিতে যায়, তা সে পারিবারিক হোক কিংবা সামাজিক, বৈজ্ঞানিক অথবা রাজনৈতিক। আর যে কোন প্রতিষ্ঠানের মূলমন্ত্র হচ্ছে সমঝোতা”

    অতি কষ্টে কথাগুলো শেষ করলো রন। ও ঠিক বুঝতে পারছেনা যে ওর মস্তিষ্কের পরতে পরতে ঠিক কোন বস্তুটি বাসা বেঁধেছে এখন। সে কি ঘুম না অবসাদ, অ্যালকোহলের নেশা নাকি ডিপ্রেশন।

    “রন, মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত তাই আর কথা বাড়াচ্ছি না। তোমাকে আমার ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাঠালাম, যাতে দরকার হলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। আমি আপাতত একটা স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার হয়ে কাজ করছি। এই সময়ে অবহেলিত হলেও দূর ভবিষ্যতের জন্য দরকারি কিছু আমি রেখে যেতে চাই। অনেকটা তোমাদের ফরগটেন হিরো সুভাষ বোসের মতন। বলতে পারো এটা আমার প্রায়শ্চিত্ত। গুডনাইট রন”

    “গুডনাইট ম্যাক্স। অথবা গুড মর্নিং কিংবা আফটারনুন, ভগবান জানে,” শেষ কথাগুলো বিড়বিড় করে বলল রন।

    কখন সকাল হয়েছে ওর জানা নেই। ইতিমধ্যে রোদ্দুর এসে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছে কিন্তু নেশার ঘুম ভাঙানো সহজ নয়। অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নের চৌকাঠ ডিঙিয়ে শেষ অবধি দশটা নাগাদ ও চোখ খুললো। প্রকাণ্ড বিছানায় ও একলা, বিরাট বাড়িটাও জনশূন্য। ফোনের মেসেজ দেখে বোঝা গেল যে যে নিপু বাজারে গেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বাড়িটা অনেক মানুষের কলকোলাহলে জীবন্ত হয়ে উঠবে। নিপুর হাবভাব দেখে সন্দেহ হচ্ছে যে শুধু সাম্য আর তার ফিয়ান্সে নয়, রুডি, অপু, রোহন আর শ্রুতিও এসে হাজির হতে পারে। আজ থেকে ছুটি, জুলাই ফোর্থের লং উইকএন্ড, এই সুযোগে দলে দলে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়বে লোকজন। এতদিনের চেষ্টায় অতিমারী কিছুটা হলেও পিছু হটেছে তাই তড়িঘড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে সবাই। এই সময়টা ভালো নয় এর অবধারিত ফল সেকেন্ড ওয়েভ, কিন্তু মাসের পর মাস সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। এই সময় প্রয়োজন ছিল জাতীয় নেতৃত্বের, প্রয়োজন ছিল মানুষকে শিক্ষিত করার। তার বদলে ওয়াশিংটনে তো সম্রাট নীরোর রাজত্ব চলছে এখন।

    দুপুর বারোটা বেজে গেল এখনো নিপুর ফেরার নাম নেই। দুই নম্বর কফির কাপ হাতে নিয়ে সদর দরজাটা খুলল রন। ওদের বাড়িটা বাংলো প্যাটার্নের, সামনে অনেকটা পর্চ, সেখানে বসার জন্য অনেকগুলো কাঠের রকিং চেয়ার, বেতের সোফা আর টেবিল, কিনারায় সারি দিয়ে ঝোলানো ফুলগাছের ঝুরি আর উইন্ড চাইম। রকিং চেয়ারে বসেই ও খেয়াল করলো সামনের কাল-ডি-স্যাকের ঠিক মাঝখানে প্রকান্ড একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোকে এরা বলে রিক্রিয়েশন্যাল ভেহিকল, সংক্ষেপে আর-ভি। গাড়ির মাঝখানে বেডরুম, রান্নাঘর বসার জায়গা বার আর বাথরুম তো আছেই, ছোটোখাটো একটা সুইমিং পুলও থাকতে পারে। পেছন দিকটায় থাকে মালপত্র রাখার দেদার জায়গা আর ক্যাম্পিং করার জিনিসপত্র। এই দেশটার অজস্র ন্যাশন্যাল পার্কে, সমুদ্রের ধারে কিংবা পাহাড়ি এলাকায় ক্যাম্পসাইটেগুলোর পাশে পাশে আর-ভি পার্ক ছড়িয়ে আছে। দিনের বেলা পথ চলে, সন্ধ্যায় আস্তানা গাড়ার কোনই অসুবিধা নেই, সবমিলিয়ে এ এক চলমান লাক্সারি হোটেল। ঝকঝকে কালো আর ইস্পাত রঙের গাড়িটা সূর্যের আলোয় ঝলসাচ্ছে। কাল রাত্তিরে বৃষ্টি হয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে আকাশ।

    কফি খেতে খেতে ও ভাবছিল প্রতিবেশীদের মধ্যে কে আবার আর-ভি কিনল এই বাজারে? এমন সময়ে ঠিক যেন ওর প্রশ্নের উত্তর দিতেই কোত্থেকে আরো দুটো গাড়ি হুস হুস করে এসে ওটার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়লো। তিমিমাছের মতন অতিকায় আর-ভির পাশে নেহাৎ ক্ষুদে দেখাচ্ছে ওদের, কিন্তু গাড়িদুটো রনের বেহদ্দ চেনা। একটা নিপুর লাল রঙের মার্সিডিস, অন্যটা শ্রীমান সাম্যর লড়ঝরে হন্ডা সিভিক। হাইস্কুল পেরোনোর আগেই নিজে পছন্দ করে সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা কিনে দিয়েছিল রন।

    “শোনো, সাবধানে চালাবে, গাড়ি ভাঙলে কিন্তু আর গাড়ি পাবেনা। তারপর যা কিনবে, যা নিজের পয়সায় কিনবে”

    এখন মনে হয় ছেলেকে সঠিক তালিম দেবার ছুতোয় শুধু শুধুই শাসন আর নির্দেশের বেড়াজালে নিজেকে আচ্ছন্ন করে রেখে দিয়েছিল ও। শেষ অবধি সবই তো জলে গেল, সবাই ডানা মেলে দিল যে যার নিজের প্রার্থিত আকাশে। মাঝখান দিয়ে সেই কোন ছোটবেলায় শোনা একটা অদ্ভুত কথার প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসতে থাকলো বারংবার- জেনারেশন গ্যাপ, জেনারেশন গ্যাপ, জেনারেশন গ্যাপ! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই একই নালিশের প্রতিধ্বনি, সেই একই অভিমানের ধারাস্নান।

    রন যখন এই সব কথা ভাবছিল, ওদের বাড়ির সামনে সেই গোলাকার কাল-ডি-স্যাকে তখন রীতিমতন একটা উৎসবের পরিবেশ। আর-ভি থেকে একে একে নেমে এসেছে রুডি, অপু, শ্রুতি, রোহন এবং লম্বাচওড়া এক অপরিচিত আমেরিকান তরুণ। গাড়ি থেকে নেমেছে নিপু, সাম্য আর তার পাশাপাশি কালো চুল, ভরাট শরীরের সেই ছবিতে দেখা মেয়েটি। একঝাঁক প্রশ্নচিহ্ন ঠিক যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন সব একসঙ্গে ওর দিকে ধেয়ে আসছে। ভালো করে কিছু বুঝতে পারার আগেই ওর চারিদিকে ঢেউ ভাঙা জল, সব ওলটপালট, প্রাণপণে পায়ের তলায় মাটি খোঁজা তখন। এ ঢেউ ডোবায় না কেবলই ভাসায়, কিন্তু এমন করে ভাসতেও যে ভয় করে রন চ্যাটার্জির। নিপু অনুযোগ করে ও নাকি দিনকে দিন আরো বেশি করে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে।

    সময় এখন তেজী ঘোড়ার পিঠে ছুটেছে, তাই দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। রন জেনেছে যে শ্রুতির গা ঘেঁষে বসে থাকা তরুণটির সংক্ষিপ্ত নাম জো, পুরো নাম জোসেফ ড্যানিয়েল হান্টার। শ্রুতি ওর বাংলা নাম দিয়েছে জয় এবং সেই নামটা সকলের ভীষণ পছন্দ। সব চেয়ে বেশি ওকে অবাক করেছে রামি। ও যেন গভীর অন্ধকারের মধ্যেও নিজের আলোয় স্বচ্ছন্দ এক নীল জোনাকি। এতখানি সাংস্কৃতিক ফারাক থাকা সত্ত্বেও কে বলবে যে ও পাশের বাড়ির মেয়েটি নয়। রনের বাড়ি এখন যেন এক যাদুবিশ্বের মেল্টিং পট। এবাড়িতে আসার আগে সবাই যে যার জায়গায় কোভিড টেস্ট করিয়ে এসেছে তাই নৈকট্যে কোনো বাধা নেই। হই হই, পানভোজন হাসি আর পাগলামিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি।

    রাত্রি হলে সব একসময় শান্ত হয়ে আসে। তখন একে একে সব আলো নিভিয়ে দেবার পালা। বাড়ির একদিকে বাচ্চারা একত্র হয়ে গুলতানি জুড়েছে, হাওয়ায় ভাসছে হাসির লহর, অন্যদিকে ওপরে শোবার ঘরে দুই বোন আর রুডি মিলে নিবিড় সাংসারিক আলাপে মগ্ন। রন চুপচাপ পালানোর জন্য একটা জায়গা খুঁজলো। ওর মনের মধ্যে আলো অন্ধকারের এক অদ্ভুত আলাপ এখন। কোথাও জায়গা না পেয়ে শেষ অবধি ওই সামনের টানা বারান্দায় একটা বেতের চেয়ারের ওপরেই শরীরটাকে ছেড়ে দিল ও। কোথা থেকে ভারি সুন্দর একটা হাওয়া বইছে, গুমোট নেই একটুও। ইতিমধ্যে রুডির আনা মহার্ঘ সিঙ্গল মল্টের কয়েক পাত্র ওর পেটেও পড়েছে, চোখ দুটো তাই ভারী হয়ে আসছে আরামে।

    কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল জানেনা কিন্তু কোনো এক সময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো ও। ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন ওর মাথার মধ্যে যেন একটা আগুনের শলাকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ও বুঝতে পারলো যে ও কুলকুল করে ঘামছে, গলা খটখটে শুকনো, চোখ জ্বলছে, রগের ওপর দপদপ করছে যন্ত্রণা। ওর জানা আছে যে স্বপ্নের স্মৃতি সব সময়ই অসংলগ্ন কিন্তু তারই মধ্যে পরিচিত আতঙ্কের এলাকাগুলো মানুষের মগ্নচেতনায় ঘুরপাক খেতে থাকে, এবং সুযোগ পেলেই তারা ঘুমের মধ্যে দাঁত বসায়। রন ভাবতো যে নিজের দুঃস্বপ্নের ছকটা ও মোটামুটি চেনে। কোনো অজানা কারণে ওর চাকরি নেই, সামনে পরীক্ষা কিন্তু পাঠ্য বিষয়গুলো ওর অজানা। অ্যালজেব্রা হোক কিংবা অ্যানাটমি, সেটা ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেই অদ্ভুত আশংকা চিরকালই পাশে আছে, রন চ্যাটার্জির সেই ঘুমন্ত নেমেসিস, এত সাফল্য আর সার্থকতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে ওর মনের উঠোনে ঘোরাঘুরি করে। আজকের দুঃস্বপ্ন কিন্তু সেই পরিচিত ছকের বাইরে তাই তার বিভীষিকাও একান্ত অচেনা।

    কাঁপা আঙুলে পকেট থেকে আধমরা ফোনটাকে খুঁজে বার করলো রন। যন্ত্রটা বন্ধ হয়ে যাবার আগে একজনের সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলা দরকার।

    ।।১৪।।
    “He knew that the tale he had to tell could not be one of final victory. It could be only the record of what had to be done, and what assuredly would have to be done again in the never-ending fight against terror and its relentless onslaughts.”
    “বস, তুমি আমার ওপর রাগ করেছো, আমি জানি”

    “রুডি প্লীজ!”

    “তুমি যাই বলো বস, আমি তোমার মুখ দেখলেই বুঝতে পারি যে তুমি কি ভাবছো। এই সময়ে ট্রাভেল করা, সবাইকে এক জায়গায় করা, এ সবই তোমার বিলকুল না-পসন্দ। কিন্তু মানুষ কতদিন এইরকম অস্বাভাবিক অসস্থায় গর্তের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বাঁচতে পারে বলো? আরে আমরা তো সবাই কোভিড টেস্ট করিয়েই এসেছি। হোটেলে যাচ্ছিনা, বাইরের কারো সঙ্গে কনট্যাক্টও নেই। কিচ্ছু হবে না, দেখে নিও। আরে তোমাদের মতন সায়েন্টিস্টরা আছে, টেকনোলজি আছে, দুদিন বাদেই ভ্যাকসিন বেরিয়ে যাবে, তারপর অল অফ দিস উইল বি হিস্ট্রি, রাইট?”

    রন চুপ করে রইলো। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ওর। হায়, ব্যাপারটা যদি এতটাই সহজ হতো, গল্পটা এতখানিই সরল, সহজ, পরিষ্কার। আজ বাদে কাল ভ্যাকসিন এসে যাবে, তারপর জল পড়বে, পাতা নড়বে, তারপর সব শান্ত সব যেমনকে তেমন, সবাই ফিরে যাবে যে যার জায়গায়।

    “আসলে কি জানো বস, সংকট আর সুযোগ, এরা আসলে যমজ ভাই। ক্রাইসিস না থাকলে বাজার ঝিমিয়ে পড়ে, চ্যালেঞ্জ না থাকলে সভ্যতা এগোয় না।ঠিক বলেছি কি না?”

    রুডি ওর পুরনো হাসিটা হাসছে। ও এখন পুরোপুরি সুস্থ, ওকে দেখে কেউ ভাবতেও পারবেনা যে মাত্র কয়েকমাস আগে ওর প্রাণটা গলায় এসে ঠেকেছিল। অপুর আহ্লাদের শেষ নেই, রোহনকেও বেশ বাধ্য ছেলের মতন দেখাচ্ছে। নিউজিল্যান্ডের কাজটা ছেড়ে দিয়েছে ও, তার বদলে মেডিক্যাল স্কুলে যাবার কথা ভাবছে এখন। এটাও নাকি ডাক্তারমামার ইন্সপিরেশনে, অন্ততঃ অপু-রুডির তাই ধারনা। শ্রুতি যেন বাবাকে এড়িয়ে চলছে, চোখাচোখি হলেই একটা লাজুক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে আবার। আমেরিকান ছেলেটি সুভদ্র কিন্তু ওকে আদিখ্যেতা করে জয় বলে ডাকা রনর আদৌ পছন্দ নয়।

    সব কিছু সত্ত্বেও আজ সন্ধ্যা অতি মনোরম। আর-ভি যেখানে পার্ক করা হয়েছে তার চারপাশে ঘনসবুজ পাইনবন। মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় তরুণ-তরুণীরা তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত। হাওয়ায় বুনো গন্ধের সাথে মিশে যাচ্ছে ওদের হাসি আর হট্টগোলের ঐকতান। একটু বাদেই ক্যাম্প ফায়ার জ্বলে উঠবে, নরম উত্তাপ আর ঝলসানো মাংসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে চারিদিকে। একটু দূরেই সমুদ্র, হাওয়ায় ভেসে আসছে তার মৃদু একটানা গুঞ্জন। ওখানে এখন ঢেউরা উঠছে নামছে, বেলাভূমির ওপরে ছড়িয়ে পড়ছে ঝিনুক, শান্ত গুঞ্জনধ্বনিতে ভেসে আসছে চিরন্তন শান্তির দ্যোতনা। অথচ আবার একদিন এই সমুদ্রই ফুঁসে উঠবে, তটরেখা ছিঁড়েখুড়ে ফেলবে হারিকেন, ঘোর আক্রোশে ছুটে আসবে আকাশছোঁয়া ঢেউ। দত্তাপহারী অতি মহান এই প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টাই তো বিজ্ঞান। পণ্যের আসক্তিতে অন্ধ মানুষ যখন প্রকৃতিকে সম্মান করতে ভুলে যায়, মুনাফার জন্য বিজ্ঞানকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে তখন কোথায় কোন সূক্ষ্ম আঘাতে মহাকালের ধ্যান ভাঙে কেউ তার হদিশ জানেনা। অথচ বিপর্যয়ের প্রলয় নাচনের মধ্যেও মানুষের স্বার্থবুদ্ধি ঠিক জেগে থাকে।

    “বাবা ক্যাম্প ফায়ারটা কেমন হয়েছে? তুমি এখানে একলাটি চুপ করে বসে আছো কেন?” শ্রুতি ঠিক একটা ধোঁয়া ওঠা প্লেট নিয়ে হাজির।

    “খুব ভালো হয়েছে রে মাম্পি। তুই তো জানিস আমি একটু একপাশে থাকতেই ভালবাসি” ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল রন।

    “বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালো করে চিনি। কিছু একটা তোমাকে প্রচণ্ড রকম বদার করছে। আমাকে বলবে না?” মেয়ে এবার ছোটবেলার মতন ঠোঁট ফোলাল, ক্যাম্প ফায়ারের অল্প আলোতেও সেটা পরিষ্কার দেখতে পেল রন। হঠাৎ কোত্থেকে একরাশ ভালোলাগা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো ওর ওপর। দীর্ঘদেহী আমেরিকান ছেলেটিকে আগুনের ধারে একলা রেখেও ওর কাছে ঠিক এসে বসেছে মেয়ে।

    “মাম্পি, আই হ্যাভ টু আনডু মাই ওয়ার্ক” ফিসফিস করে বলল রন। শ্রুতি চুপ করে বসে রইল, ওর চোখে নীরব জিজ্ঞাসা।

    “আনডু হোয়াট?”

    “আমরা অতি উৎসাহে বিরাট কতগুলো ভুল করে বসেছি। ওষুধ কোম্পানিগুলো দাবার ঘুঁটির মতন আমাদের ব্যবহার করেছে। এখনও অবধি একটাও অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ করোনাভাইরাসজনিত অসুখের মৃত্যুহার কমাতে পারেনি। অথচ তড়িঘড়ি ছাড়পত্র পেয়ে গিয়ে বিরাট অঙ্কের ব্যবসা করেছে নতুন ওষুধগুলো। কিন্তু পরিচিত পুরনো ওষুধ যারা প্রদাহ কমায় আর রক্ত জমাট বাঁধতে দেয়না, আসল কাজ করেছে সেগুলোই। কিন্তু তাতে কারো লাভ নেই। তাই গরমাগরম নতুন ওষুধ তৈরির চেষ্টা চলতেই থাকবে, ঠিকঠাক ওষুধ একদিন বেরোবেও। কিন্তু এই মুহুর্তে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যা দরকার, যা ম্যাক্সের মতন এপিডেমিওলজিস্টরা গলা ফাটিয়ে বলে চলেছে, কেউ তাতে কান দেবেনা। প্যানডেমিকের একমাত্র ওষুধ কঠোর লকডাউন, যতদিন না নিরাপদ ভ্যাকসিন তৈরি হয়। কিন্তু তাতেও ব্যবসার ঘোরতর ক্ষতি। দেশের নেতৃত্ব, শেয়ার বাজার আর ওষুধ কোম্পানির দালালরা নির্বিকারে সাধারণ মানুষকে ধাপ্পা দিয়ে চলেছে”

    “বাবা, একটা কথা আমাদের বুঝিয়ে বলো। তুমি কি তোমার যথাসাধ্য করোনি? গভর্নমেন্ট পলিসি আর ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ভেস্টেড ইন্টারেস্টের সঙ্গে তুমি একলা কিভাবে লড়বে? লড়াইটা আমাদের সবাইকে লড়তে হবে, যে যার নিজস্ব ফ্রন্টে, তাইনা?” আরেকটা গলা শোনা গেল এবার। রন দেখলো রোহন, সাম্য আর রামোনাও কখন এসে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, কথা বলতে বলতে খেয়ালও করেনি ও। সোনালি চুলের আমেরিকান ছোকরাও ওদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে। অপু, রুডি আর নিপু সমুদ্রের দিকে হাঁটতে গেছে একটু। ক্যাম্পগুলো খাটানো হয়ে গেছে, গাছের ডালে ঝুলছে গ্যাস লন্ঠন, ঝিঁঝিঁর ডাকটাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবার। সব মিলিয়ে একটা স্বপ্নময় পরিবেশ।

    ছেলেমেয়ের মুখগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রন। একবার ভাবলো কথা ঘুরিয়ে দেয়। কি হবে এতগুলো তরুণ বিশ্বাসী মনের ওপর সন্দেহের বিষাক্ত কালি লেপে দিয়ে। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুরু করলো ও।

    “কাল ডিনারের পড়ে একটু ঘুমিয়ে পরেছিলাম, একটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল। তোমাদের হয়তো বলেছি যে ম্যাক্স এখন ক্যারিবিয়ানে কি সব নন-প্রফিট গ্রুপের সঙ্গে কাজ করছে। ম্যাক্সকে আমি যতদূর চিনি ওর কাজ মানেই প্রতিবাদ, প্রতিষ্ঠান নামক গলিয়াথের সামনে ও সর্বদাই সেই গুলতি হাতে ঘাড় বেঁকানো ডেভিড। স্বপ্ন দেখলাম কারা যেন ওকে গুম করে নিয়ে গেছে, টর্চার করছে, মেরেও ফেলতে পারে। ওর নতুন ফোন নম্বরে কল করলাম, পেলাম না। প্রায় সারারাত্রি ধরে নানান জায়গায় খোঁজ নিলাম, যোগাযোগ করতে পারলাম না। আজ ভোরে ইউনিভার্সিটি থেকে খবরটা আমাকে দেওয়া হলো”

    “কি খবর? ম্যাক্স ঠিক আছে তো” প্রায় সমস্বরে প্রশ্ন উঠলো।

    “ম্যাক্স ইজ ডেড। কোভিড হয়ে ও মারা গেছে। একজ্যাক্টলি লাইক হিজ ফেভারিট ক্যারেকটার ইন দি বুক- জাঁ টেরু” ভূতের গলায় ফিসফিস করে বলল রন।

    “ও বাবা, আই অ্যাম সো সরি! তুমি কাউকে বলোনি কেন?”

    শ্রুতি এসে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। সাম্য আর রামোনা অজান্তেই একে অপরের হাত চেপে ধরেছে। বজ্রাহতের মতন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রোহন। সানফ্রান্সিস্কোর সেই দিনগুলোয় ডাক্তারমামা আর ম্যাক্সের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনাদের সাক্ষী ও।

    “মৃত্যুটা হয়েছে দিন দুয়েক আগে জ্যামাইকার একটা গরীব পাড়ায়। ম্যাক্স ওর সারা জীবনের সঞ্চয়, কয়েক মিলিয়ন ডলার আমাদের ডিপার্টমেন্টের রিসার্চ ফাউন্ডেশনে দান করে গিয়েছে। তার সঙ্গে আমার জন্য একটা চিঠি যেটা ওর চলে যাবার মাত্র এক সপ্তাহ আগে লেখা। ক্লেয়ারভয়েন্ট যদি কেউ হয়ে থাকে তাহলে সে নির্ঘাৎ ম্যাক্স”

    ল্যাপটপের ডালাটা খুলল রন। কয়েক মুহুর্তের জন্য ওর স্ক্রীনসেভারে অরোরা বোরিয়লিসের অনুপম আভা ফুটে উঠলো, তারপর স্ক্যান করা চিঠিটা।

    “প্রিয় রন,
    এই চিঠি যদি তোমাকে আহত করে তাহলে জেনো আমি একান্তই ক্ষমাপ্রার্থী। এই বিষণ্ণ সময়ের শেষে, পৃথিবীর কোনো এক অজ্ঞাত পানশালায় যদি আবার জমায়েৎ হবার সুযোগ মিলতো তাহলে হয়তো সব কথা আরো ভালো করে বুঝিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু এই চিঠি যদি তোমার হাতে পৌঁছে যায় তাহলে জানবে যে এযাত্রায় সে সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত।

    তুমি আর আমি জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময় জুড়ে নানান দুরূহ তত্ত্বের বিচার করে কাটিয়েছি। বিশ্বাস করেছি যে শিক্ষা নেওয়া এবং দেওয়ার এই দ্বান্দিক পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত মুক্তির উপায়। এই পরম্পরা মেনে আমার জীবনের শেষ শিক্ষণীয় বিষয়টির নাম দেওয়া যেতে পারে আর্ট অফ ট্রেচারি অর্থাৎ বেইমানির শিল্প। অ্যাকাডেমিক জীবন থেকে ব্যক্তিজীবন হয়ে সাধারন সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে বিশ্বাসভঙ্গকে আমরা শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছি। আমি দেখেছি যে শিক্ষা আর গবেষণার জগতে যা কিছু নবীন, যা কিছু সম্ভাবনাময়, তার পেছনে জোঁকের মতন লেগে রয়েছে সম্ভাব্য বাজারদরের হিসাব এবং ব্যক্তিগত উন্নতির লোভনীয় হাতছানি। এক অদৃশ্য প্লেগ আমাদের সকলকে দুষিত করে ফেলেছে, একজন থেকে আরেকজনে সংক্রামিত হয়ে চলেছে বেইমানির এই অদৃশ্য বীজাণু। মেধা আর অনুসন্ধিৎসার যাবতীয় ফসলকে নিলামে চড়ানোই যেন আমাদের শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে। আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস তো সেই কবেই ঘুচে গেছে, এখন বিজ্ঞানের ওপরেও যেন আর ভরসা রাখা যাচ্ছেনা। এইভাবে চলতে থাকলে শুধু বৌদ্ধিক জগতেই নয়, জীবনযাপনের প্রতিটি এলাকাতেই চরম অরাজকতা দেখা দেবে, তখন শুরু হবে এক নতুন অন্ধকার যুগ।

    তুমি ভাবছো যে ব্যক্তিগত এলাকায় বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস আমাকে বিষিয়ে তুলেছে। এ কথা মিথ্যে নয় যে বিয়ে এবং বিয়ের বাইরে নানান রকম সম্পর্কের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মিমি আমার যতটা ভেতরে ঢুকতে পেরেছিল ততটা আর কেউ পেরে ওঠেনি। কিন্তু সেটা ওর যৌনতার জন্যে নয়। একজন গবেষক হিসাবে ওর নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছিল এবং শুধু আমাকেই নয়, তুমি নিজেকে প্রশ্ন করলেও বোধহয় একই উত্তর পাবে। কিন্তু নিষ্ঠা মানেই সততা নয়। মিমি পরিশ্রমী এবং তীক্ষ্ণধী, জনসংযোগে ওর তুলনা মেলা ভার, কিন্তু এ সবকিছুই সাফল্যের জন্য, সত্যের খাতিরে নয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমাদের তথাকথিত অ্যাকাডেমিক জগতে এই যে দুটোর মধ্যে ফারাকটা অনেকের মনেই অস্পষ্ট হয়ে আসছে এখন। এতদিন যা বিজ্ঞান ছিল ধীরে ধীরে সে আর্টের সুষমা পাচ্ছে। আমাদের পরিচিত ডক্টর রিচ শী, যিনি সারা দুনিয়ায় বিজ্ঞান দেবতার রকমারি সোনার মুর্তি বিক্রি করে বেরান, তিনি সেইরকম একজন আর্টিস্ট। তুমি জানলে সুখী হবে যে ভদ্রলোক আপাততঃ ফেরার কেননা এফ-বি-আই ওঁর পিছনে লেগেছে। ওর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ আর তথ্য পাচার থেকে শুরু করে খুনের চেষ্টা অবধি একরাশ অভিযোগ। এই খেলার অনেক খেলুড়ে বহাল তবিয়তে আছে, অথচ উনিই এমনটা ফেঁসে গেছেন কেন, সে প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।

    পরিবারের সকলকে আমার শুভেচ্ছা জানিও। বিশেষ করে তোমার ছেলে আর তার বান্ধবীর জন্য আমার উষ্ণ অভিবাদন রেখে গেলাম। প্রকৃতির নিয়ম মেনেই একদিন প্যানডেমিক শেষ হবে, ভ্যাকসিন বেরোবে, নতুন নতুন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধে ছেয়ে যাবে বাজার। এর মধ্যে যে মানবিক ট্র্যাজেডি থেকে গেল, কিছুদিন বাদে তার চিহ্নও থাকবে না। ভুলবে না শুধু তারাই, যারা প্রিয়জন হারালো আর বিনা স্বার্থে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্লেগের সঙ্গে লড়াই করলো যারা। করোনাকাল তাদের স্মৃতির মধ্যে প্রদীপের মতন জ্বলতে থাকবে আজীবন।

    মিমি ভালো আছে। ও এখন বিখ্যাত একটা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির রিসার্চ ডাইরেক্টর, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডিজাইন করে। ওর মাইনে, বোনাস আর স্টক অপশনের গপ্পো শুনলে তুমি ভির্মি যাবে। আন্দাজ করছি এবং এটা খুবই স্বাভাবিক যে তুমিও ওকে মনে মনে ভালবাসতে শুরু করেছিলে। মধ্য জীবনের যদি কোনো অধিষ্ঠাত্রী দেবী থেকে থাকেন, ধরে নাও এটা তাঁরই প্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে একটা। খেলা শেষ, এবার উঠে দাঁড়াও হে বন্ধু, তোমার এখনো অনেক পথ চলার আছে।

    আমি যে সংস্থার হয়ে কাজ করছি তারা পুরনো বিজ্ঞানের নিয়মকানুনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। অন্ধকার যুগের শেষে আবার যখন আলো ফুটবে তখন মানুষ যেন তাদের নতুন করে আবিষ্কার করতে পারে। কেন জানিনা আমার কেবলই মনে হচ্ছে যে আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। পৃথিবীর সব কাজেই শ্রম আর অর্থ লাগে কিন্তু আমি সচেতনভাবেই এ দুটোকে আলাদা করতে চাই। আমার শ্রম একজায়গায় থাকবে, আমার সামান্য আর্থিক সঞ্চয় থাকবে অন্য জায়গায়। আমি জানি যে আমার ভুলের মাশুল তুমি ভেতরে ভেতরে গুণেই চলেছো যদিও বাকি দুনিয়ার কাছে ব্যাপারটা হাস্যকর। তাই সামান্য যা কিছু জমিয়েছি সেটুকু তোমার জিম্মায় দিয়ে নিশ্চিন্ত হলাম।

    ইউরোপে ক্লাসিক্যাল যুগের শেষে মধ্য যুগের শুরু হবার সময় বোয়েথিয়াস নামে এক অভিজাত রোমান ভদ্রলোক একটা বই লিখেছিলেন। বইটা লেখা হয়েছিল জেলে বসে, যাকে বলা হয় প্রিজন লিটারেচার। ভদ্রলোক খুবই উঁচু পদের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, কিন্তু বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতা আর যড়যন্ত্রের জন্য তাঁর শেষ জীবনটা জেলেই কাটে। শেষ অবধি মধ্যযুগীয় অত্যাচার করার পরে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ল্যাটিনে লেখা বইটার নাম De consolatione philosophiae, ইংরেজিতে consolation of phylosopy, দেবী দর্শনার স্বান্তনাবাক্য। বিশ্বাস হারানো থেকে যে রোগের জন্ম হয়, তার চিকিৎসা ওখানেই দেওয়া আছে। যেহেতু জীবনের শেষটা কেউ জানেনা তাই সুখদুঃখের চরম হিসাব করা মানুষের অসাধ্য। তার বলছি তোমার সঙ্গে যে সময় কাটিয়েছি তা আমার ব্যক্তিগত সুখের অ্যাকাউন্টে অনন্তকালের জন্য জমা রইলো।

    ইতি তোমার বন্ধু,

    ম্যাক্স



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments