ছোটবেলা থেকেই আমার আকাশ খুব ভালো লাগত। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মহাকাশযাত্রী হব। হয়েছিও। হয়েছি ঠিকই তবে হওয়া কি চারটিখানি কথা! দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে, অনেক পরীক্ষায় পাশও করতে হয়েছে। যে যে গ্রহ নিয়ে বিজ্ঞানীদের কৌতূহল আছে সে সব গ্রহে আমাকে পাঠানো হয়। আমি একাই মহাকাশযান চালিয়ে সেখানে যাই তারপর একটা জায়গা বেছে নেমে পড়ি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজে লেগে যেতে হয়। নানারকমের বৈজ্ঞানিক মাপজোক করে সব তথ্য হেড-অফিসে পাঠিয়ে দিই। কাজ শেষ হয়ে গেলে আবার মহাকাশযান চালিয়ে ফিরে আসি। এই কাজ করতে করতে অনেক গ্রহ দেখা হয়ে গেছে আমার – এক একটা গ্রহ একেক ধরনের হলেও গ্রহ মূলত দুরকমের হয়। এক হল যেখানে জীবন বলে কিছু নেই। এসব গ্রহতে কাজ করা সহজ। কারণ যা যা তথ্য জোগাড় করতে বলা হয়েছে তা সংগ্রহ করে কিছু ছবিটবির সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই কাজ শেষ। প্রাণিজগতের খোঁজখবর করার কোনো ব্যাপার থাকে না। ভয়ডরও থাকে না – কেউ এসে খেয়ে ফেলবে বা ধরে খাঁচায় ভরে রেখে দেবে এমন তো নয়। তবে আমার ভালো লাগে যে সব গ্রহতে জীবন আছে সেখানে যেতে। আর যদি বুদ্ধিমান জীব থাকে তাহলে তো কথাও নেই। অবশ্য এটা ঠিক যে এ ধরনের গ্রহের সংখ্যা খুব কম। তবু নয় নয় করে সেরকম কতগুলো গ্রহতেও কাজ করে এসেছি। এক এক জায়গায় এমন সব বিপদে পড়েছি কী বলব। লিখতে গেলে তিন-চারটে মোটা মোটা বই হয়ে যাবে। যেমন এক জায়গায় আমাকে ওরা তাড়া করে প্রায় ধরে ফেলেছিল। আমি বাধ্য হয়ে অস্ত্র বার করেছিলাম। সে অস্ত্র ব্যবহার করলে যে কোনো প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কিন্তু ভাগ্য ভালো যে আমাকে সে অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয়নি। আলোর খেলা দেখিয়ে ওদের বোকা বানিয়ে আমি সরে পড়েছিলাম।
সেই থেকে আমাদের মহাকাশযাত্রার ঘাঁটিতে নিয়ম করে দেওয়া হয়েছে যে উন্নত জীব থাকলে সে গ্রহতে ঠিক ওদের মত আকার আকৃতি নিয়ে সেজে থাকতে হবে। ছদ্মবেশ আর কি। যাতে ওরা বুঝতে না পারে। বুঝতে পারলেই যত ঝামেলা। অনুকরণ করে আকার আকৃতি পালটানোর ব্যাপারটা সহজ নয় – আলাদা করে শিখতে হয়েছে।
এছাড়াও আরও অনেক ব্যাপার আছে। যেমন জীবের যদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকে তাহলে তারা সে সব নাড়িয়ে-চাড়িয়ে ভাব প্রকাশ করে। এর তালিম যখন নিতাম তখন আমাদের বলা হয়েছিল জীবটি যদি দ্রুত তোমার দিকে এগিয়ে আসে তাহলে বুঝবে সে তোমাকে শত্রু ভেবে আক্রমণ করতে আসছে। যদি ধীরে এগিয়ে আসে তাহলে বন্ধু ভাবছে। এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে তাহলে সে বোঝার চেষ্টা করছে – তুমি ওর শত্রু না বন্ধু। যদি সে তোমাকে ভয় পায় তাহলে দ্রুত দূরে সরে যাবে। মানে পালাবে। এ নিয়মগুলো, বিশেষ করে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা, সারা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে একই রকম!
তবে জীব যদি বুদ্ধিমান হয় আর তার দেহে কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে তাহলে তারা ভাষা তৈরি করে। গ্রহান্তরের ভাষা কীভাবে তাড়াতাড়ি শিখতে হয় তার তালিমও নিতে হয়েছে আমাদের।
ভাষা যদি থাকে তাহলে তা এক এক গ্রহে এক এক ধরনের, এমনকি একই গ্রহের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা রকমের। কটা ভাষা শিখব? তাই আমাদের বিজ্ঞান আর গণিত মিলিয়ে একটা ভাষা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে ভাষায় সারা বিশ্বের সবকিছু একই ভাবে বোঝানো যায়। আমাদের সেইভাবেই তথ্য পাঠাতে হয়। একটু উদাহরণ দিচ্ছি।
সারা বিশ্বে একশর কিছু বেশি মৌলিক পদার্থ রয়েছে। মৌলিক পদার্থের ভেতরের কণিকাগুলো এক একটায় একেক রকমের। এদের একটা হিসেব আছে। সে হিসেব দিয়ে সবচেয়ে হালকা পদার্থটি এক নম্বর, যেটা দিয়ে গ্রহগুলোতে জীবদেহ তৈরি হয়েছে সেটা ছ নম্বর, যেটা না হলে জীবদেহ টেকে না সেটা আট নম্বর, এইসব। সে হিসেবে জল মানে এক নম্বর আর আট নম্বর। বোঝা গেল?
আর একটা ব্যাপার আছে যা নিয়ে আমাদের সাবধান থাকতে বলা হয়। সময়। সারা বিশ্বে সময় এক ভাবে বয়ে যায় না। তার হিসেবও আলাদা। তাই সূক্ষ্ম কণিকার কম্পন দিয়ে মাপা সময়ই আসল সময়। খুব কঠিন ব্যাপার, আমাদের বড় বড় বিজ্ঞানীরাই এসব ভালো করে জানেন। আমাদের কাজ চালানোর মত কিছু কিছু শেখানো হয়েছে।
এছাড়াও গ্রহ-গ্রহান্তরে ঘুরতে ঘুরতে আমি নিজেও বিশ্বের প্রাণীদের সম্বন্ধে দু-একটা জিনিস শিখেছি। কাজ করার বিদ্যা থেকে এগুলো আমাকে বেশি অবাক করে। দু-একটা বলছি।
গ্রহ যেমনই হোক, সেখানকার প্রকৃতি যেমনই হোক – বুদ্ধিমান জীব যদি থাকে তাহলে তারা প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। আর একটা ব্যাপার হল – শত্রু শত্রু ভাব, ভয়, হিংসা এ ব্যাপারগুলো সব গ্রহতেই আছে তবে এর সঙ্গে আর একটা ব্যাপার বিশ্বের সব জায়গাতেই দেখেছি। তা হল বন্ধুত্ব।
এবার আমার অভিযানের কথায় আসা যাক।
আমাদের বিজ্ঞানীরা একটা গ্রহ নিয়ে বেশ কিছুদিন গবেষণা করছেন তার কারণ গ্রহটি নানাদিক দিয়ে আমাদেরই মতন। প্রচুর জল আর বাতাসও আছে – বাতাস আমাদের মতই সাত আর আট নম্বর মেশানো। আরও বড় মিল জীবন নিয়ে। মোটামুটি একসঙ্গেই জীবন শুরু হয়েছিল – সেখানেও দু রকমের জীব – চলতে পারা জীব আর না-চলতে-পারা স্থির জীব। এতগুলো জীবের ভেতর শুধু একটা জীব বুদ্ধিতে অন্যদের থেকে বহুগুণ উন্নত আর তারাই গ্রহটাতে রাজত্ব করছে। মানে একেবারে আমাদেরই মতন। অভিন্ন বলা চলে।
আমাকে একদিন ডেকে বলা হল যে ওই গ্রহটায় যেতে হবে। কাজ বুঝিয়ে দেওয়া হল। অন্য গ্রহের মত মাপজোক করে তথ্য তো পাঠাতে হবে কিন্তু তাছাড়াও কাজ আছে। সে কাজ মোটেই সহজ নয়।
আমাকে ওই গ্রহের উন্নত প্রাণীদের কাছাকাছি যেতে হবে। তারপর তাদের মধ্যে কোন একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে শিখে নিতে হবে অন্তত একটি ভাষা। আসল ব্যাপারটা হলো যে সে-গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণী দ্রুত উন্নতি করছে – তাদের ওপর নজর রাখা দরকার। যদি কোনোদিন আমাদের আক্রমণ করে বসে!
মহাকাশযান চালিয়ে পৌঁছোতে সময় লাগল – দূর আছে গ্রহটা। আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল যে গ্রহটায় অনেক জল আছে। প্রথমে জলের ওপরেই নামলাম। দেখলাম সত্যিই আমাদের মতো এদের গ্রহে অনেক অনেক জল – কিন্তু গ্রহটা আমাদের থেকে অনেকটা বড় বলে জল পরিমাণে বেশি। আর জলের জায়গাগুলো মানে সমুদ্র আরও অনেক বিস্তৃত। গভীরও বটে। তীরের ওপর এদের বুদ্ধিমান জীবগুলোর নমুনা দেখতে পাচ্ছিলাম। যেমন আমাকে বলা হয়েছে তেমনি আমি নিজের আকার আকৃতি নকল করে এদের মতো হয়ে গেলাম। এবার কাউকে একটা খুঁজতে হবে বন্ধুত্ব করার জন্য। পেয়ে গেলাম – একজন একটা পাথরের ওপর বসে জলরাশি মানে সমুদ্র দেখছিল। ওই যে আগেই বলেছি, প্রাকৃতিক ছবি বিশ্বের সব জীবই দেখতে ভালোবাসে। এর আশপাশে আর কেউ নেই, এই ভালো নমুনা হবে। তবে এর ভাষা তো আমি জানি না। সে যাই হোক কাজটা তো করতে হবে। এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই এ চারপাশে তাকাল। ভাবছিল আশপাশে কেউ তো ছিল না। এ কি জল থেকে উঠে এল? ঠিকই ভাবছিল অবশ্য – আমি তো জল থেকেই উঠে এসেছি।
অচেনা জীবের সঙ্গে কী করে আলাপ জমাতে হয় তা আমাদের শেখানো হয়েছে। আমি চারটে ছোট পাথর নিয়ে লোফালুফি করতে লাগলাম। গতি বাড়াতে লাগলাম যাতে একে অবাক করা যায়। কাজ হলো। একটু কথা বলল। আমি চাইছিলাম এ আরও কথা বলুক – কারণ যা বলছে তা আমি শিখে নিচ্ছি। কিছুক্ষণের ভেতর আমি ওর ভাষায় দুএকটা কথা বলতে লাগলাম। সে খুব খুশি। বুঝলাম বন্ধুত্ব হচ্ছে – বলেছিলাম না বন্ধুত্ব ব্যাপারটা সারা বিশ্বেই রয়েছে।
আগেই বলেছি সময় জিনিসটা বড় গোলমেলে। এদের সময়ের মাপ তো আমাদের মতো নয়। তবু এ কোন পর্যায়ে আছে তা বুঝে নিলাম। এ ধরনের জীবের জীবন যদি একশোটা দাগ দিয়ে বোঝানো হয় তাহলে এ তেরো কি চোদ্দ নম্বর দাগে আছে। যাইহোক কথা বলতে বলতে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বন্ধু একবার জিগেস করল যে আমি কোথা থেকে এসেছি। কী বলব? সত্যিটা বললে এ ভয় পেয়ে যেতে পারে। বললাম – অনেক দূরের দেশ থেকে। তোমাকে আমার দেশের কথা বলব একদিন …।
এর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হল। কাজ তো অনেক। অনেক মাপজোক আর তথ্য পাঠাতে হবে। আমার বাহন নিয়ে আমি উড়লাম কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গেলাম মহাবিপদে। আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে এ গ্রহের জীব বিদ্যুত-চুম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারে। সাবধানে ওড়াউড়ি করবে। তরঙ্গ শুষে নেওয়ার ঢাকা যেন ব্যবহার করা হয়। নতুন বন্ধুর কথা ভাবতে ভাবতে আমি ওটা করতে ভুলে গিয়েছিলাম! হঠাৎ দেখি আমার পেছনে এদের বিচিত্র ধরনের দুটো উড়ন্ত যান! বুঝলাম আমাকে তাড়া করেছে। কখন টের পেল রে বাবা! কী করি? এ গ্রহে জলরাশি যেমন আছে শিলারাশিও আছে। পাহাড়। ভীষণ দুর্গম আর উঁচু। এত উঁচু পাহাড় কোনো গ্রহতে দেখিনি। আমি কায়দা করে পাহাড়ের খাঁজে বাহন নিয়ে লুকিয়ে পড়লাম। বুঝেছিলাম এরকম সরু ফাঁকে এদের এতো বড় উড়ন্ত যান ঢুকতে পারবে না। ভয় হচ্ছিল যদি এরা ছোট কোনো যান নিয়ে আমাকে ধরতে আসে! ঘাপটি মেরে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। বসে বসে চারিদিকের দৃশ্য দেখছিলাম – উফ, কী যে সুন্দর কী বলব। বেশিরভাগ অঞ্চলই সাদা। জল আছে তাই তুষারও আছে। ধরা পড়ে যাবার ভয় ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও শিলারাশির এই রূপ আমাকে অভিভূত করে রাখল। এত মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম যে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । কিন্তু বিপদ যতই থাক আর জায়গা যতই সুন্দর হোক না কেন কাজ তো করতে হবে। তরঙ্গ শুষে নেওয়ার ঢাকাটা ভালো করে বাহনের গায়ে লাগিয়ে আবার উড়লাম।
দেখেশুনে নামলাম একটা নিরিবিলি অঞ্চলে। মাপজোকের কাজগুলো আনেকটা এগিয়ে রাখলাম। এবার আমাকে আগের জায়গায় যেতে হবে, আমার বন্ধু অপেক্ষা করবে বলেছে। ভাষা শেখার কাজটাও অনেকটা বাকি। আর সত্যি বলতে কি, অন্য কাজের থেকে আমার এর সঙ্গে থাকতেই বেশি ভালো লাগছিল।
কথা আমিই শুরু করলাম, তবে আমার উদ্দেশ্য ছিল ওকে বেশি কথা বলানো। গ্রহ অভিযানে গেলে আমাদের মাথায় একটা পাতলা ছোট্ট যন্ত্র লাগিয়ে রাখাতে হয়। তাতে ভাষা শেখার কাজ সহজ হয়ে যায়।
বলা কথা তো বাতাসে মিলিয়ে যায়। তাই সব জয়াগাতেই দেখেছি বলা কথা বা মনের কথা ধরে রাখার ব্যবস্থা আছে। এদের এই ব্যাপারটা আমাদের সঙ্গে দারুণ ভাবে মিলে যাচ্ছে। এরা কথাগুলো চিহ্ন দিয়ে বোঝাতে পারে – সে চিহ্নগুলো ব্যবহার করতে সকলে জানে। যাকে লেখা বলা হয়। বললাম, “বন্ধু, তোমাদের লেখা আমাকে শিখিয়ে দেবে?”
সে তো সঙ্গে সঙ্গে সব জোগাড় করে ফেলল। আমাকে একটা “খাতা” আর “কলম” দিল – এরকম জিনিসের চল আমাদের গ্রহে অনেক কাল আগে ছিল। যন্ত্রসভ্যতা এত এগিয়ে গেছে যে এসবের আর দরকার হয় না। আমার মাথায় তো যন্ত্র লাগানো আছে তাই আমি পটাপট ভাষা আর লেখা দুটোই কাজ চালানোর মতো শিখে ফেললাম। বন্ধু তো ভারি অবাক – এতো তাড়াতাড়ি কি কেউ শিখতে পারে!
আমাদের আলাপ ভালোই চলছিল এমন সময় বন্ধু বলল, “চল, চল, ভিজে যাবে …” সে দৌড়ে মাথার ওপর আড়াল দেওয়া একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল। আমিও গেলাম। দেখলাম এখানেও একই ব্যাপার। জল আছে তাই জলীয় বাষ্পও আছে। আকাশে সে বাষ্প জমা হয়। তারপর অবস্থা অনুকূল হলে জল হয়ে ঝরে পড়ে। সে তো আমি জানি। কিন্তু জল ঝরে পড়া যে এত সুন্দর হতে পারে তা এই প্রথম দেখলাম। সমুদ্র অন্যরকম দেখাচ্ছে, বাতাসে অজস্র জলকণা ভেসে ভেসে আসছে।
কাজ আমার আরও বাকি রয়েছে। তাই বললাম, “আসি, আবার পরে দেখা হবে।” আমি ওর দেওয়া খাতা-কলম নিয়ে উঠে পড়লাম। মাপজোক আর ছবি তোলার কাজ বাকি আছে – তালিকা মিলিয়ে সব কিছু চটপট করে ফেলতে হল। কাজের ফাঁকে আমার এখানে আসার মোটামুটি একটা বিবরণ খাতায় লিখে রাখছিলাম। এতে এদের ভাষাটাও আরও ভালো রপ্ত হয়ে গেল। মনটা ছটফট করছিল বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য। বাহন নিয়ে রওনা দিলাম।
কিন্তু গিয়ে যা দেখলাম তা মোটেই সুবিধের নয়। এদের বুদ্ধিমান জীবের দল কী করে যেন সন্দেহ করেছে যে নতুন কেউ একটা এখানে এসেছে। এদিকে ওদিকে অনেকগুলো পাহারা বসিয়েছে – কয়েকটা প্রাণী আবার জায়গাটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখছে কোথাও কিছু আছে কি না। বুঝতে পারলাম এখানে থাকার ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।
খাতা-কলম রেখে দিয়েছিলাম কিন্তু একটা বুদ্ধি এল। ভাবলাম বন্ধুর সঙ্গে তো আর দেখা করা যাবে না। খাতাটা ওকে দিতে পারলে ও আমার কথা জানতে পারত। খাতাটা বার করে তাড়াতাড়ি কটা লাইন লিখলাম তারপর খুব সাবধানে পাহারা এড়িয়ে খাতাটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে আসলাম ঠিক যেখানে আমার বন্ধুর আসার কথা। তারপর স্রেফ পালালাম।
অনেকটা জলের ভেতর দিয়ে যেতে হলো যাতে এরা টের না পায়, তারপরে আকাশে উঠে গিয়ে এদের নাগালের বাইরে গিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। মনটা খারাপ লাগছিল – বন্ধুর সঙ্গে আর দেখা হলো না। তবে আশা রইল আমার লেখা ও হাতে পাবে।
শ্যামের কথা
শ্যাম বাবা-মা-ভাইএর সঙ্গে বিশাখাপত্তনম বেড়াতে এসেছিল। এখানকার সমুদ্র শ্যামের খুব ভালো লাগছে। ঢেউগুলো পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে তো পড়ছেই। কী সুন্দর! সে মাঝে মাঝে একাই বসে বসে সমুদ্র দেখে। এখানে বসে থাকতে থাকতে দুদিন হলো এক বন্ধুর সঙ্গে শ্যামের ভাব হয়েছে। এখন তার আসার কথা কিন্তু আসেনি তো। আজ আবার সমুদ্রের ধারে এত মিলিটারি নেমেছে কেন? হেলিকপ্টার চক্কর মারছে আকাশে। শ্যাম ভাবল আর একটু বরং অপেক্ষা করা যাক। একি, এখানে সেই খাতাটা রেখে গেছে যে … তার মানে সে কি আর আসবে না? আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে শ্যাম খাতাটা নিয়ে হোটেলের ঘরে ফিরে গেল। বিছানায় আধশোয়া হয়ে খাতাটা খুলল।
যা লেখা ছিল তা পড়ে তো শ্যামের নিশ্বাস, বুকের ধুকধুক, চোখের পাতা ফেলা সব যেন বন্ধ হয়ে গেল। এ তো এক মহাকাশযাত্রীর লেখা বিবরণ! তার বন্ধু অন্যগ্রহ থেকে এসেছিল?! সম্বিৎ ফিরতে খানিকটা সময় লেগে গেল।
একটু ধাতস্থ হতে খাতাটা আরেকবার খুলে দেখল শ্যাম। আরে আরও লেখা আছে যে! পুরোটা পড়া হয়নি তার! কয়েকটা পাতা ছেড়ে কটা লাইন খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। শ্যাম সেই অংশটা পড়তে শুরু করল।
বন্ধু, আমাকে এক্ষুনি চলে যেতে হচ্ছে। তোমাকে বলে আসা হলো না তাই মনটা খারাপ লাগছে। তোমার নামটা কী সুন্দর – শ্যাম। আর তোমাদের ভাষাটাও ভারি মধুর। জানো, এই সময়টুকু আমার খুব ভালো কেটেছে। আমি এত গ্রহতে গেছি কিন্তু তোমাদের মতো এত সুন্দর, এত বিচিত্র গ্রহ আর একটাও দেখিনি। কী সুন্দর নীল সমুদ্র, উঁচু পাহাড়, গাছপালা, কত জীবজন্তু কত পাখি কত পোকামাকড়। আমার ভীষণ ভীষণ ভালো লেগেছে – মনে হচ্ছিল আমি এখানেই থেকে যাই। আর তোমাদের গ্রহের নামটাও খুব ভালো – পৃ থি বী। ভালো থেকো বন্ধু, জানি না আবার কখনো দেখা হবে কি না।
লেখা এখানেই শেষ।
অন্যগ্রহের জীবের সঙ্গে শ্যামের দেখা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে – এর থেকে অবাক করা ঘটনা আর কী হতে পারে?
কতগুলো পাতা ছেড়ে কোনোরকমে তাড়াতাড়িতে লেখা শেষের অংশটুকু শ্যাম আরও একবার পড়ল। পড়ার পর শ্যাম দ্বিতীয়বারের জন্য অবাক হয়ে বসে রইল।
শ্যাম ভাবছিল ওই অতদূর থেকে এসে এইটুকু সময়ের ভেতর তার ভিনগ্রহের বন্ধু পৃথিবীর জল-বাতাস-মাটি-জীবজন্তু-গাছপালা এত ভালবেসে ফেলল। পৃথিবীর মানুষ কি পৃথিবীকে এতটা ভালবাসে?