মহারাজের বালিকা কন্যা রত্নলেখা ছাদের আলসেতে ভর দিয়ে রোজ দূরের সেই বনের দিকে চেয়ে থাকে। “কী যে আছে ওই বনের ভেতর?” খুব জানতে ইচ্ছে হয় তার। রানীমাকে জিজ্ঞেস করে কোন স্পষ্ট জবাব পায় না সে। আইমাও বলে, “ও বাবা ওখানে কেউ গেছে নাকি কখনো? কেউ জানে না বনের ভেতর কী আছে?” এসব শুনে রাজকন্যার কৌতূহল আরো বাড়ে।
রাজবাড়ির ছোটদাসী মঞ্জরী-আইমা চলে গেলে, সে এসে চুপিচুপি বলে, -- -
”আমি জানি বন কীরকম।”
“তুই কী করে জানলি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রত্নলেখা।
“আমাদের গাঁয়ের পাশে ডিহিং নদী, তার ওপারেই তো বন।”
“তুই কখনো বনে গেছিস মঞ্জরী?” অধীর আগ্রহে প্রশ্ন করে রাজকন্যা।
মঞ্জরী বলে, “না দিদি, ও তো দেবতার বন, ওখানে গাঁয়ের মানুষ যেতে পারে না, শুধু বুনোরা যায়, ওরা ওখানেই থাকে কিনা।”
“সে কীরে?”
“হ্যাঁ দিদি, শুনেছি, দেবতা নিজে বনের দেখাশোনার ভার দিয়েছেন ওদের। অন্য কারুর বনে ঢোকা বারণ। তবে ডিহিং নদীর তীরে দাঁড়ালে স্পষ্ট দেখা যায় ওপারের নদীর কিনারা থেকেই ঝুপসি সব গাছ উঠেছে একেবারে আকাশ অবধি, আর তার তলায় লতায় পাতায় জড়াজড়ি করে অন্ধকার যে চোখ একটু গিয়ে আটকে যায়।”
মঞ্জরীর গল্প আর এগোয় না। আইমা ফিরে এসে তাড়া লাগিয়ে মঞ্জরীকে কাজে পাঠিয়ে দেয়। রত্নলেখার সেদিন আর বনের গল্প শোনা হয না, কিন্তু অর্ধেক শোনা সেই গল্প সারাদিন তার মাথায় ভোমরার আওয়াজ এর মত গুনগুন করতে থাকে। এরপর থেকে ফাঁক পেলেই সে মঞ্জরীকে টেনে ধরে বনের গল্প শুনতে চায়। মঞ্জরীও আধেক জানা আর আধেক কল্পনায় কত কথা যে বলে--শুনতে শুনতে রাজকন্যার চোখের পলক পড়ে না, মন তোলপাড় হয়ে যায়।
সেদিন বিকেলে রাজামশায় তখনও সভায় যাননি, দুপুরের আহারের পর রানীমার সঙ্গে বসে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলছিলেন--রত্নলেখা কোথা থেকে ছুটে এসে বাবার কোলে মুখ গুঁজল।
রাজামশায় আর রানীমা চোখাচোখি করে হাসলেন। দুজনেই বুঝলেন কোন আবদার আছে মেয়ের। মহারাজ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, “কী হয়েছে মা?” কিন্তু তারপর রাজকন্যার আবদার শুনে তাঁর তো যাকে বলে আক্কেল গুড়ুম। শুধু আবদার নয়, জেদ ধরে বসেছে রত্নলেখা-- উত্তরের বনে সে যাবেই, কোনো কথাই শুনবে না।
বুড়ো মন্ত্রীমশায় সব শুনে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়লেন-- “না মহারাজ, দেবতার নিষেধ।” বয়োবৃদ্ধ সভাসদরা মন্ত্রীর মতেই মত দিলেন। কিন্তু অত সহজে কি সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়! সভার মধ্যে পেছনের সারি থেকে একটি প্রতিবাদের স্বর উঠল, সেটি মন্ত্রীপুত্র ভদ্রসেনের। তার সঙ্গে তাল মেলালো চিত্রভানু, অমাত্য বিজয়বর্মার পুত্র। এরা দুজনেই বয়সে নবীন, প্রায় কিশোরই বলা যায় কিন্তু এদের অসাধারণ মেধা ও নানা বিদ্যায় পারদর্শিতার জন্য মহারাজ নিজে এদের আমন্ত্রণ করে সভায় স্থান দিয়েছেন। ভদ্রসেন বলল “ক্ষতি কি মহারাজ, একবার গিয়েই দেখা যাক না। এই বন আপনার রাজ্যের অঙ্গ অথচ এই বিশাল অঞ্চল আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা।” মহারাজ চিন্তিত মুখে বললেন-- “কিন্তু দেবতার নিষেধ আছে।” উত্তরে ভদ্রসেন বলল, “সে তো কোন আদ্যিকালের কথা, সত্যিই কি কেউ পরখ করে দেখেছেন কখনো? হয়তো দুর্গম অরণ্য বলে, গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে এ কথা রটেছে?” বুড়ো মন্ত্রী পুত্রের প্রগল্ভতায় বিরক্ত হয়ে থামিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু মহারাজ বাধা দিলেন। ভদ্রসেনকে তিনিও পুত্রবৎ স্নেহ করেন, তাছাড়া তার কথায় যে যুক্তি ও প্রত্যয় আছে তাকে সহজে অস্বীকার করা যায় না। রাজসভায় অনেক আলোচনা ও তর্ক ও বিতর্কের পর ভদ্রসেনের নবীন উৎসাহেরই জয় হল। মহারাজ তার সঙ্গে একমত হলেন। ফলত সব পারিষদেরাও প্রস্তাবটি মেনে নিলেন। শুধু বুড়ো অমাত্য বিষ্ণুদত্ত, মন্ত্রীমশায়ের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন--“বাপ পিতেমোর আমল থেকে এই নিষেধ, এর যে কোন মানে নেই তা কি হতে পারে?” মন্ত্রীমশাই গম্ভীর মুখে নীরব রইলেন।
রাজজ্যোতিষী দিনক্ষণ দেখলেন। তাঁর নির্দেশ মত সেই মাসেরই শুক্লা পঞ্চমীতে মহারাজের অরণ্য যাত্রা শুরু হল। রানীমা ও রাজকন্যাও সঙ্গে চললেন। লোকলস্কর নিয়ে সে এক এলাহি বন্দোবস্ত। রানীমা মঞ্জরীকেও সঙ্গে নিলেন। মহারাজ এই অভিযানের নেতা নিযুক্ত করেছেন ভদ্রসেনকে, আর তার সহকারী হল চিত্রভানু। সাত দিন সাত রাত চলে মহারাজের বাহিনী অষ্টম দিনে ডিহিং নদীর তীরে এসে পৌঁছোল। রাজপুরোহিতের বিধান অনুযায়ী বনে প্রবেশের পূর্বে মহাসমারোহে বনদেবতার পূজা-অনুষ্ঠান করা হলো। পূজা দেখতে সাত গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল। পূজা শেষে পুরোহিত জানালেন, দেবতা প্রসন্ন হয়েছেন। আগামী কাল ভোরেই নদীর পার হয়ে অরণ্যে প্রবেশ করা যাবে। মহারাজের আসার খবর পেয়ে বনবাসী মানুষেরাও রাজ দর্শনে এসেছিল। তাদের সর্দার রাজাকে প্রণাম করে বললে--“মহারাজ, দেবতার আদেশে আমরা এই বনের রক্ষক। আজ যখন দেবতা স্বয়ং আপনাকে বনে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়েছেন, তখন আপনার সেবার ভারও আমাদের। সর্দারের কথা শুনে মহারাজ ভারি নিশ্চিন্ত হলেন, তাঁর মনে আর দ্বিধার লেশমাত্র রইল না। মহারাজের অনুমতি নিয়ে ভদ্রসেন সেই দিনই বুনোদের চার জন জোয়ান ছেলেকে বাহিনীতে নিযুক্ত করল। ওদের সাহায্য ছাড়া এই গভীর বনে যে এক পা চলাও সম্ভব নয়, এ বিষয়ে কোনো মতদ্বৈধ ছিল না।
তখন শীতের শুরু, সামনে রুপোলি ফিতের মত বয়ে চলেছে ডিহিং নদী। তার অপর পাড়ে জমাট বাঁধা সবুজের প্রাচীর, এক গভীর বন। সেই বনে আকাশছোঁয়া গাছের সারির ফাঁক দিয়ে তিরতিরে সব নালা নেমে এসেছে ডিহিং নদীতে। হরিণ আর হনুমানেরা সেই নালায় জল খেতে এসেছে। রত্নলেখার মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। মহারানীও কিশোরীর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “কী অপরূপ তাই না!” রাজপুরীর অবরোধের ভেতর থাকতে থাকতে উনিও বোধহয় নিজের অজান্তেই হাঁফিয়ে উঠেছিলেন।
অরণ্যের গভীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বনবাসীদের চার-পাঁচটি বসতি। পরদিন সকালে নিকটতম বসতিটির উদ্দেশ্যে রওনা হল মহারাজের বাহিনী। বসতিটি ক্রোশ খানেক দূরে, আধবেলার পথ। গভীর বনে পায়ে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। শুরুতে কষ্ট হলেও, মহারানী ও রাজকুমারী দুজনেই অচিরেই অভ্যস্ত হয়ে গেলেন। ঘন অরণ্যের বুক চিরে পায়ে চলা পথ, গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢোকে কি ঢোকে না-- হরেক রকম পাখির ডাক, নাম-না-জানা ফুলের লতা, অথবা ঝোপের ফাঁকে চট করে লুকিয়ে পড়া কোন বনের জীব--অসাধারণ এই অভিজ্ঞতার উত্তেজনায় সব কষ্টই মেনে নিলেন তাঁরা। দ্বিপ্রহর নাগাদ মহারাজের বাহিনী প্রথম বসতিটিতে পৌঁছে গেল।
বনের ভিতর একটি তৃণভূমি। সেখানে গড়ে উঠেছে বসতিটি। পাশ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে একটি নালা। উত্তর দিকে গভীর অরণ্যের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক রুপোলি পর্বতের চূড়া। সর্দার বললেন, রজতগিরি। সেখানেই নাকি বনদেবতার বাস। বসতিটির মধ্যস্থলে একটি বড় চারকোনা প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের তিনদিক ঘিরে রয়েছে আট-দশটি কুটির। প্রতিটি কুটির মাটি থেকে হাত পাঁচেক উঁচু কাঠের খুঁটির উপর তৈরি। প্রাঙ্গণের চতুর্থ দিকে একটি উঁচু কাঠের বেদি নির্মাণ করা হয়েছে। সেই বেদির উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এক অদ্ভুতদর্শন বিশাল কাঠের মূর্তি। ইনিই বনদেবতা। সর্দারের অনুসরণে সকলেই সেখানে প্রণাম করলেন। প্রাঙ্গণে সব বনবাসী স্ত্রী-পুরুষেরা জমা হয়েছিল। তারা বাজনা বাজিয়ে মহারাজকে সম্বর্ধনা জানাল, টাটকা মধু আর বনের ফল দিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করল। বনবাসী মেয়েরা রাজকন্যা আর রানীমাকে বনফুলের মালায় সাজিয়ে দিল।
নাগরিক মানুষ, বনবাসীদের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আগে কখনো আসেনি। তামাটে গাত্রবর্ণের সুঠাম স্বাস্থ্যের মানুষগুলির বিনীত অথচ মর্যাদাপূর্ণ আচরণ দেখে সকলেই মুগ্ধ হলেন। মহারাজ ভদ্রসেনকে বললেন, “দেখো আমরা ভাবতাম এরা সভ্যতার স্পর্শ পায়নি, অথচ, কী সুন্দর এদের আচরণ, তেমনই সুন্দর চেহারা।” ভদ্রসেন অন্যমনস্কভাবেই মহারাজের কথায় সায় দিল। মহারাজ সেটা লক্ষ্য করেই জিজ্ঞেস করলেন--“কী ভাবছ বলোতো তুমি?” ভদ্রসেন বলল--“কিছু না মহারাজ, অবাক হয়ে সব দেখছি।” তারপর সর্দারের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল-- “আচ্ছা সর্দার, সবার গলায় ওই নীল সবুজ পাথরের মালা কেন?” সর্দার হেসে বললে, ”ও, ওই নুড়ি এই বনে অনেক ছড়িয়ে আছে, ছেলে-মেয়েরা কুড়িয়ে মালা গেঁথে পরে।” রত্নলেখাও বলল-- “সত্যি, কী সুন্দর এই মালাগুলো!” সর্দারের হুকুমে তার অনুচরেরা তৎক্ষণাৎ একগুচ্ছ মালা নিয়ে এসে হাজির। মহারাজের বাহিনীর সকলেই একটি করে মালা পেল। এক বনবাসী বালিকা সবথেকে সুন্দর মালাটি পরিয়ে দিল রাজকন্যার গলায়। সতেজ কিশলয়ের মতো বালিকাটিকে দেখে মহারানীর ভারি ভাল লাগল, আর রত্নলেখা এক মুহূর্তে তাকে ভালবেসে ফেলল। সর্দারের নাতনি সারি, তার সঙ্গে রয়েছে আরেকটি ক্ষুদ্র বালিকা, তার ছোট বোন তিরি।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর মহারাজের বাহিনী দ্বিতীয় বসতিটির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ওই বসতিটি আরেকটু বড়। ওখানেই সর্দারের কুটির। মহারানী ও রাজকন্যা সারি ও তিরিকে কাছছাড়া করলেন না। সারাটি পথ তিনটি বালিকা হাসি ও কলতানে ভরিয়ে তুলল। ভাষার বাধা সত্ত্বেও কীভাবে যে তারা ভাববিনিময় করছে সে একমাত্র তারাই জানে। তাদের সেই নির্মল আনন্দের ছোঁয়ায় সহযাত্রীদের মনও প্রসন্ন হয়ে উঠল। দ্বিতীয় বসতিতে একদিন অবস্থানের পর মহারাজ অন্য বসতিগুলি পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, সেগুলি আরো গভীর অরণ্যে অবস্থিত। পথও অনেক দুর্গম। মহারানী ও রাজকন্যা সর্দারের পরিবারের আতিথ্যে দ্বিতীয় বসতিতেই থেকে গেলেন। মহারানী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ও রাজকন্যা বনবালাদের সাহচর্যে ভারি আনন্দে ছিলেন, কাজেই এই ব্যবস্থায় দুজনেই সানন্দে সম্মত হয়েছিলেন।
মহারাজের বাহিনী সেদিন পঞ্চম বসতিটিতে পৌঁছে গেছে। শিবির স্থাপনের পর মহারাজ সপারিষদ বিশ্রাম করছিলেন, কিছু জরুরি আলোচনাও চলছিল তার সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে মহারাজ বললেন-- “এত সুন্দর জায়গা যে পৃথিবীতে আছে তা তো জানাই ছিল না। ভদ্রসেন যদি জোর না করত, তাহলে এই স্থান চিরকাল আমার অদেখাই থেকে যেত।” ভদ্রসেন মৃদু কন্ঠে বলল-- “মহারাজ, জায়গাটা শুধু পৃথিবীতে আছে তাই নয়, এই জায়গা আপনার রাজ্যেরই অন্তর্গত।” মহারাজ প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন-- “তা ঠিক, এই অরণ্য আমার রাজ্যের সম্পদ।” ভদ্রসেন তেমনই মৃদু কন্ঠে বলল-- “মহারাজ, আপনার রাজকোষে যত সম্পদ আছে তার চেয়েও এই সম্পদ অনেক বেশি মূল্যবান।” ভদ্রসেনের কথা শুনে মহারাজ প্রথমে বিস্মিত হলেন তারপর নীরবে হাসলেন, ভাবলেন, সত্যিই তো, রাজকোষের সম্পদের পরিমাপ সম্পর্কে, এই কিশোরের কোন ধারণা থাকার তো কথা নয়। যত বুদ্ধিমানই হোক, রাজ্যের অনেক গূঢ় তত্ত্বই এখনও ভদ্রসেনের অজানা।
পূর্ব পরিকল্পনা মতো পরের দিনটি মহারাজা ওই স্থানেই কাটালেন। পঞ্চম বসতিটি রজতগিরির খুবই কাছে। ভদ্রসেন ও চিত্রভানু রজতগিরি পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করল। ওই পবিত্র পাহাড়ে আরোহণ করা দেবতার নিষেধ। তাই সর্দারের পরামর্শমত মহারাজ তাদের পাহাড়ের সানুদেশ পর্যন্ত যাওয়ারই অনুমতি দিলেন। চার জন বনবাসী যুবকও তাদের সঙ্গী হলেন।
সেদিনের পর আরো দশটি বছর কেটে গেছে। সম্প্রতি ভদ্রসেনের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। এই বিবাহে সকলেই খুব খুশি। পুত্রহীন মহারাজা ভদ্রসেনকেই যুবরাজ নির্বাচিত করেছেন। এখন রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দায়িত্বই তাঁর ওপর। মহারাজও যোগ্য পাত্রের ওপর রাজ্য ও রাজকন্যার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছেন। বিবাহের পরেই যুবরাজ ও যুবরানী রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিভ্রমণ করে প্রজাদের সঙ্গে পরিচিত হবেন এটাই বিধেয়। নবপরিণীতা পত্নীর অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারলেন না যুবরাজ ভদ্রসেন। রত্নলেখা উত্তরের বনে যাওয়ার জন্য খুব উৎসুক। সুতরাং সর্বপ্রথম উত্তরের বনের দিকেই যাত্রা করা স্থির হল, যদিও প্রশাসনের মাপকাঠিতে অঞ্চলটি মোটেই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
এই দশ বছরে রাজ্যের পথ ঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। ডিহিং নদীর তীরে পৌঁছতেও খুব বেশি বেগ পেতে হল না। যুবরানী চমৎকৃত হয়ে দেখলেন, নদীর ওপর তৈরি হয়েছে এক সুদৃশ্য সেতু। এই সবই সম্ভব হয়েছে ভদ্রসেনের প্রচেষ্টায়। স্বামীর জন্য গর্ব ভরে উঠল তাঁর বুকটা। অপুত্রক মহারাজা উত্তরাধিকারী নির্বাচনে ভুল করেননি। সেতু অতিক্রম করে রাজকীয় বাহিনী কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য থামল। রত্নলেখা দেখলেন বনের বুক চিরে সরল রেখার মত চলে গেছে শকট চলাচলের উপযোগী একটি চওড়া সুন্দর পথ। সেই আঁকাবাঁকা আলোছায়ায় ঘেরা পায়ে চলা পথটা আর নেই। বিস্মিত কণ্ঠে স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন- “এত চওড়া পথ বানাল কারা?”
“স্থানীয় লোকেদের প্রয়োজন, তাই বানানো হয়েছে।”
“সে কী! ওরা কি এখন শকট ব্যবহার করে?” -
“প্রয়োজনে করে।” -
“আমরা সর্দারের বসতিতে যাব তো?”
“হ্যাঁ, তবে তাঁর তো দেহান্ত হয়েছে।” –
“আহারে, তাই বুঝি!” রত্নলেখা দুঃখিত হয়ে বললেন।
“তবে তার নাতনিরা, সারি, তিরি, তারা তো আছে!”
রত্নলেখা বাইরের দৃশ্য দেখছিলেন। স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানকে একেবারেই মেলাতে পারছিলেন না। খেয়াল করলেন না, তাঁর প্রশ্নে স্বামীর মুখের ওপর দিয়ে একটা হালকা ছায়া ভেসে গেল। ভদ্রসেন বললেন--“বসতিগুলো ঠিক আর আগের মত নেই।”
“মানে?”
“এখন সকলে একসঙ্গে একটা বড় গ্রামে থাকে।”
“কোথায়?” . –
“রজতগিরির সানুদেশে নতুন এক গ্রামের পত্তন হয়েছে, সেখানে।”
“সেকী! কেন? ওখানে বসবাস করা তো দেবতার নিষেধ ছিল!”
ভদ্রসেন নিরুত্তর রইলেন, কিন্তু স্বামীর ওষ্ঠের বঙ্কিম রেখাটি রত্নলেখার নজর এড়াল না। তিনি যে দেবতার নিষেধে বিশ্বাস করেন না, সেকথা যুবরানীর অজানা নয়।
ইতিমধ্যে স্থানীয় কিছু অধিবাসী উপস্থিত হয়ে নবদম্পতিকে স্বাগত জানিয়েছে। রত্নলেখা লক্ষ করেছেন বনবাসী মানুষ হলেও এদের বেশভূষায় নাগরিকতার স্পষ্ট প্রভাব। অরণ্যে প্রবেশের পর ভদ্রসেন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য রাজকর্মচারীদের সঙ্গেই ভ্রমণ করছেন। যুবরানীর সঙ্গিনী হল খাসদাসী মঞ্জরী।
রত্নলেখার শকট এগিয়ে চলছিল দ্রুত বেগে। সেই একই বন, তবু সব কিছু আর এক নেই। যুবরানী দেখলেন গাছের পাতাগুলো ধুলোয় বিবর্ণ, পাখির ডাকও তেমন শোনা গেল না, কোন জীবজন্তুও চোখে পড়ল না তাঁর। শকট কিছু দূর অগ্রসর হতেই কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মধ্যে এক পর্বতের চূড়া দেখা গেল। বনে প্রবেশের পর থেকেই এক অস্বস্তি ঘিরে ধরেছিল রত্নলেখাকে, এবার সেটা কেমন এক আতঙ্কে পরিণত হল।
শকট চালক ঘোষণা করল-- “সামনেই রজতগিরি।” .
রত্নলেখা স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, ক্ষতবিক্ষত ওই পর্বতের গায়ে পিপীলিকার সারির মতো অগুনতি মানুষ চলাচল করছে। পর্বতের ঢালে মাঝে মাঝেই বড় বড় আগুনের কুণ্ড জ্বলছে আর তার ধোঁয়ায় চতুর্দিক কালো হয়ে আছে।
মঞ্জরীর বিস্মিত প্রশ্ন শোনা গেল--“ওখানে অত আগুন জ্বলছে কেন?”
শকট চালক উত্তর দিল-- “ওখানে তো রুপোর খনি রয়েছে। তাছাড়া পাথরের গায়ে দুর্মূল্য সব মণিমাণিক্যও পাওয়া যায়। সেসবও খনন করে বের করা হয়।”
রজতগিরির সানুদেশে তৈরি হয়েছে নতুন গ্রাম, তবে সে এক ঘিঞ্জি বস্তি। তার কিছু দূরে পড়েছে যুবরাজের শিবির। স্থানীয় রাজকর্মচারীদের কাছ থেকে রত্নলেখা জানলেন ওই বস্তির স্ত্রী-পুরুষ সকলেই রজতগিরির খনিতে কাজ করে। ভদ্রসেন স্ত্রীর অনুরোধ মনে রেখেছেন। রাজকর্মচারীরা খুঁজে এনেছে যুবরানীর বাল্যসখী সারি আর তিরিকে। শীর্ণকায় দুই শ্রমিক রমণীকে দেখে বাক্যস্ফূর্তি হল না রত্নলেখার। বনের গাছের পাতার মত ওরাও বিবর্ণ হয়ে গেছে। সারি আর তিরি এখন নাগরিক ভাষা বলতে পারে, বুঝতেও পারে, তবুও আলাপ জমল না । রত্নলেখা লক্ষ্য করেছিলেন প্রথম দর্শনে তিরি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে চেয়েছিল, সারি সন্তর্পণে তার হাত চেপে ধরে তাকে সংযত করেছে। ওদের জন্য আনা উপহারগুলো যখন যুবরানী ওদের দিলেন, তখন তিরি ভীত চোখে সারির দিকে তাকাল। সারি নিঃশব্দে উপহারের ডালিটি গ্রহণ করে বিনম্র অভিবাদন জানাল। রত্নলেখা মৃদু কন্ঠে বললেন--“সারি, তোমাদের যদি কিছু প্রয়োজন থাকে তো আমাকে বলো।” সারির ঠোঁটে ক্ষণিকের জন্য এক বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, তারপরই সে করজোড়ে বিনীত কন্ঠে বলল--“না দেবী, আর কিছু চাই না, অনেক তো পেয়েছি।”
সারি চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ স্থানু হয়ে বসেছিলেন যুবরানী। সারির মুখের হাসিটা অনেক না বলা কথা বলে দিয়ে গেছে--আজ দেবতার নিষেধের অর্থ পরিষ্কার হয়ে গেছে রত্নলেখার কাছে। রাজ্য পরিভ্রমণের পর বেশ কিছু দিন কেটে গেছে। রাজ্যে সব কিছু সুষ্ঠুভাবেই চলছে। শুধু রাজকন্যা আজকাল কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকেন। তিনি চিরকালই স্বল্পভাষিণী, কিন্তু ইদানিং প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন কথাই প্রায় বলেন না। ভদ্রসেনও এটা লক্ষ্য করেছেন, প্রশ্নও করেছেন--রত্নলেখা মৃদু হেসে এড়িয়ে গেছেন। কর্মব্যস্ত যুবরাজও আর প্রশ্ন করার সময় পাননি।
সে বছর বর্ষাকালে, প্রবল বর্ষণে ডিহিং নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠল। রাজধানীতে খবর এল নদী তীরের গ্রামগুলি ভেসে গেছে। জলের তোড়ে নতুন সেতুটিও ভেঙে পড়েছে। বন্যার জল অবশেষে রাজধানীতেও ঢুকে পড়ল। স্মরণাতীত কালে ডিহিং নদীর এই রুদ্র রূপ দেখা যায়নি। নিকটবর্তী ত্রিকুটগিরিতে অবস্থিত দুর্গে রাজপুরীর অধিবাসীদের স্থানান্তরিত করা হল। সাধারণ প্রজাদের অনেকেই দুর্গপ্রাকারের ভিতরে বা বাইরে পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নিল। দুর্গের গবাক্ষ থেকে উন্মত্ত জলরাশির দিকে তাকিয়েছিলেন রত্নলেখা। উত্তরের বন কোন দিকে কিছুই ঠাওর করতে পারলেন না।
বৃষ্টির তীব্রতা কিছু কমেছে, আশু ত্রাণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই বহু প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ এসে পৌঁছেছে। সে বিষয়েই মহারাজ তার অমাত্যবর্গের সঙ্গে জরুরি আলোচনায় ব্যাপৃত ছিলেন। ঠিক তখনই সবচেয়ে ভয়ানক সংবাদটি এসে পৌঁছল। রজতগিরিতে এক বিশাল ধস নেমেছে এবং ডিহিং নদী গতিপথ পরিবর্তন করে উত্তরের অরণ্যকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সম্ভবত বনবাসীদের গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এই ভয়ংকর দুঃসংবাদে সভায় এক সমবেত আর্তনাদ উঠল, শুধু মহারাজ প্রস্তরবৎ বসে রইলেন-- আর সেই আর্ত কলরবের মধ্যে অতি বৃদ্ধ অমাত্য বিষ্ণুদত্ত প্রায় অস্ফুটে বলে উঠলেন-- “দেবতার অভিশাপ।” তাঁর সেই স্বগতোক্তি পাশের ব্যক্তিটিরও শ্রুতিগোচর হয়নি, কিন্তু কী জানি কীভাবে দুর্গের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে তার প্রতিধ্বনি উঠেছিল।
দুর্গবাসীদের বহুজনেরই আত্মীয়স্বজনের কোন সংবাদ নেই। মঞ্জরীও তার গ্রামের কোন খবর জানে না। আজকের দুঃসংবাদে সকলেই মুহ্যমান। ত্রিকুটগিরির পাদদেশ তখনও জলমগ্ন, তারই মধ্যে সৈন্যবাহিনী ত্রাণকার্যে বেরিয়ে পড়েছে, ভদ্রসেন নিজে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সে রাতে অন্য সকলের মত মঞ্জরীর চোখেও ঘুম ছিল না, কিন্তু চরম ক্লান্তিতে কোন অশুভ ক্ষণে চোখ বুঁজে এসেছিল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে দেখল রত্নলেখার শয্যা শূন্য। গতকালের দুসংবাদের পর মূক হয়ে গিয়েছিলেন যুবরানী। এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল মঞ্জরীর মন। রত্নলেখার খোঁজে সে তাঁর প্রসাধনকক্ষে গেল, তারপর কক্ষান্তরে, গলিপথে, অলিন্দে, দালানে--কিন্তু কোথাও তাঁকে খুঁজে পেল না। চারপাশে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করার পর এক বৃদ্ধ প্রজার কাছ থেকে জানা গেল, যে কাল গভীর রাতে, তার মনে হয়েছিল, দুর্গের উচ্চতম তলের প্রাকারে, এক মুহূর্তের জন্য সে এক ছায়াময় অবয়ব দেখেছে। তারপর সেই মূর্তি পাখির ডানার মত দুই হাত ছড়িয়ে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। অতিপ্রাকৃত ঘটনা না দৃষ্টিবিভ্রম, শুক্লার ত্রয়োদশীর প্রায়ান্ধকার রাতে সে তা বুঝে উঠতে পারেনি।
দুর্গরক্ষীরা তন্ন তন্ন করে ত্রিকুটগিরির প্রতিটি কন্দরে অনুসন্ধান চালালো, কিন্তু রাজকন্যার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেল না। শুধু একজন প্রহরী এক পাথরের খাঁজ থেকে যে নীল রঙের বস্ত্রখণ্ডটি উদ্ধার করে এনেছিল, সেটি চিনতে মঞ্জরীর ভুল হল না। মহারানী সংজ্ঞা হারালেন, মহারাজ নীরবে সভাগৃহ ছেড়ে নিজ কক্ষে গিয়ে দ্বার রুদ্ধ করলেন। দেবতার অভিশাপ অথবা প্রকৃতির প্রতিশোধ! বহু বছর আগে এক অবুঝ বালিকার অভিলাষ পূর্ণ করতে স্নেহান্ধ পিতা যে ভয়ংকর অভিশাপ ডেকে এনেছিলেন, কাল রাতে রত্নলেখা তার প্রায়শ্চিত্ত করে গেছেন । তবে রুষ্ট দেবতার কোপ এতেও কি প্রশমিত হবে, প্রকৃতি কি এত সহজে সব লাঞ্ছনার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারবে ? এ প্রশ্নের উত্তর উপস্থিত অমাত্যবর্গের কারুরই জানা ছিল না। তাঁরাও নিঃশব্দে সভা ত্যাগ করলেন। সেই নৈঃশব্দ্যের ভার এক কালো ধোঁয়ার আবরণের মত চারদিক যেন অন্ধকারে ঢেকে দিল। সেই অন্ধকার থেকে মুক্তির উপায়ও কেউ খুঁজে পেল না।