এত কম কথা বলেন যে, ছোটবেলায় একজন মুরুব্বি তাঁর নাম দিয়েছিলেন নিমাত্রা পীরছাব। অর্থাৎ যে পীর কথা বলেন না বা একেবারেই কম কথা বলেন।
তবারক সাহেব সরকারের এক গোপনীয় দপ্তরে কাজ করতেন। এই পঞ্চাশ বছর বয়েসে তিনি আছেন আধা অবসরে। হঠাৎ হঠাৎ বিশেষ প্রয়োজনে তাঁর ডাক পড়ে। অন্য সময়ে তিনি লেখালেখির পেছনে কাটান। আরো স্পষ্টভাবে বললে, তিনি লেখালেখির প্রস্তুতি নেন। দেশের এবং দেশের বাইরের এমন সব জিনিস ও ঘটনার সঙ্গে তিনি পরিচিত হয়েছেন, যা সাধারণ লোকে কল্পনাও করতে পারবে না। সেইসব ঘটনা আবার তিনি হুবহু প্রকাশ করতে পারবেন না কিছু শক্তিশালী সংস্থার গোপনীয়তা নীতির কারণে। তাই ঠিক করেছেন হালকা চালে, রূপকে ও আবছাভাবে উপন্যাস আকারে লিখে যাবেন।
এরকম উপন্যাস লেখতে পরিবেশও লাগে। তাই চলে এসেছেন একটা গ্রামে, নাম হালিয়ার চর। উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে ভারতের পর্বত এবং ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত সীমান্তঘেঁষা এই গ্রাম। শান্ত এবং স্নিগ্ধ তার চেহারা। তবারক সাহেবের এক কলিগ তাঁকে এই সুন্দর গ্রামের কথা বলেছিলেন। এখানে দেখার মত অনেক কিছু আছে। আছে একটি বড় প্রাচীন দীঘি।
তবারক সাহেব যে বাড়িটিতে উঠেছেন সেটা কাঠের তৈরি। ইংরাজ সাহেবদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল অনেক আগে, তাই এর নাম সাহেব বাড়ি। বাইরে থেকে দেখতে অনেক ভালো লাগে। বাড়ি দেখাশোনা করে একটা লোক। তার বয়স হবে ষাটের মত। নাম আব্দুল আউয়াল। হ্যাংলা, পাতলা গড়ন, মুখশ্রী সাধারণ, বাম পা টেনে টেনে হাঁটে। সব সময় চোখে কালো চশমা পরে থাকে।
বিকালের দিকে তবারক সাহেব রেল স্টেশনে নামেন।
স্টেশনে নামতেই সতেরো আঠেরো বছরের একটা ছেলে দৌড়ে এসে বলে, স্যার আমার নাম রতন, আপনারে নিতে আইছি।
বলে সে দাঁত বের করে হাসতে থাকে। তবারক সাহেব খেয়াল করেন তার দাঁতগুলি বড় বড়, এবং ক্যানাইন দাঁতগুলি বেশ ধারালো।
রতন তবারক সাহেবকে নিয়ে আসে সাহেব বাড়িতে।
তিনি যখন সেখানে পৌঁছলেন তখন আব্দুল আউয়াল পা টেনে টেনে দৌড়ে এল।
ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলল, স্যার, আমি আব্দুল আউয়াল। আপনারে আনার জন্য যাইতে পারি নাই, এইখানে সব ব্যবস্থা করতে করতে দেরি হইয়া যাইতেছিল। স্যার, আসতে কোন ঝামেলা হয় নাই তো?
তবারক সাহেব বললেন, না, ঝামেলা হয় নাই। আপনি কি এখানে দেখাশোনার জন্য আছেন?
আব্দুল আউয়াল দাঁত বের করে হেসে বলল, জি জি স্যার। আমি আছি আর এই রতন আছে। আমরাই এই বাড়ি দেইখা রাখি। দারোগাবাবু আমারে ডাকাইয়া নিয়া বললেন একজন বড় স্যার আসতেছেন। আমি সব রেডি কইরা রাখছি স্যার। আপনার কোন অসুবিধা হইব না। আর, স্যার, আমারে তুমি কইরা বলবেন। আমি একজন ছোট মানুষ।
তবারক সাহেব বললেন, নিজেরে ছোট বলবেন না, কোন মানুষই ছোট হয় না। আপনাকে ধন্যবাদ আব্দুল আউয়াল। জেনে ভালো লাগল যে সব ঠিক আছে।
ওই সময়ে এই কথা বললেন ঠিকই, কিন্তু সন্ধ্যার পরে পরেই তাঁর মনে হতে লাগল, এখানে কিছু একটা ঠিক নেই। এইরকম তাঁর হয়। কেন হয় তিনি ঠিক জানেন না। চারপাশে যখন কোন কিছু ঠিক থাকে না তখন তিনি তা অনুভব করতে পারেন।
সন্ধ্যায় তবারক সাহেবের রুমে চা নিয়ে আসল রতন।
চা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, স্যার, আপনে খিয়াল করছেন আব্বায় চউখে কালা চশমা দিয়া রাখে? কন তো ক্যান চশমা পরে?
তবারক সাহেব চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, বলতে পারব না।
রতন বলল, আব্বায় একসময় আছিলেন পাখিশিকারী। বগলা দিয়া বগলা শিকার করতেন। একবার একটা বগলায় তাঁর বাম চউখ খায়া ফেলে। আপনে কি জানেন উনি আমার আমার আসল আব্বা না?
তবারক সাহেব বললেন, না।
রতন বলল, আমি যখন ছোট আছিলাম, আমারে উনি জঙ্গলে পাইছিলেন। পাইলা বড় করছেন। আমি উনারে আব্বা ডাকি।
তবারক সাহেব রতনের কথা শুনতে শুনতে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। এইসময়ে তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পান একজন পুলিশের লোক এসে আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে হাত নেড়ে কীসব কথা বলে চলে গেলেন।
পাহারার জন্য এখানে দুয়েকজন পুলিশের লোক থাকতে পারে। কিন্তু এই লোক সেইরকম কেউ না। মানুষের অঙ্গভঙ্গি দেখলে ধরে ফেলা যায় তার র্যাংক কী। তবারক সাহেব ধারণা করলেন ইনি এইখানকার পুলিশের দায়িত্বে থাকা অফিসার হরিচরণবাবু।
কিন্তু হরিচরণবাবু যখন আসলেন, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা না করে চলে গেলেন কেন? আর কথা বলার সময় তাকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল কেন?
এই দুই জিজ্ঞাসা আসল তবারক সাহেবের মনে।
পরের দিন সকালে নয়টার দিকে তবারক সাহেব ভাবছিলেন গ্রামটা একটু হেঁটে দেখবেন। যেই তিনি গেটের কাছাকাছি গিয়েছেন তখনই স্যার স্যার বলে পা টেনে টেনে দৌড়ে এল আব্দুল আউয়াল।
বলল, স্যার, আপনে যাইতেছেন কোথায়?
তবারক সাহেব বললেন, একটু গ্রাম ঘুরে দেখি।
আব্দুল আউয়াল বিব্রত মুখে বলল, স্যার, এই সকাল বেলায় কেন যাইবেন? এর চাইতে চলেন বিকাল বেলায় আপনারে গ্রাম বেড়াইতে নিয়া যাই।
তবারক সাহেব বললেন, তা যাওয়া যাবে। কিন্তু এখন যদি একটু ঘুরে আসি তাতে কী কোন সমস্যা আছে?
আব্দুল আউয়াল বিব্রত মুখে মাথা চুলকে বলল, জি স্যার, সামান্য একটু সমস্যা আছে। দারোগা স্যার বলছেন আপনারে যাতে একা ছাড়া না হয়। বুঝেনই তো স্যার, যেকোন বিপদ-আপদ হইতে পারে। তাই যদি আমার কথাটা শুনেন, উপকার হয়। হুকুমের বাইরে তো আমি যাইতে পারি না স্যার।
তবারক সাহেবের অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলল আব্দুল আউয়াল কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছে।
তবারক সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। বললেন, ঠিক আছে।
বলে নিজের রুমের দিকে চললেন।
তাঁর পিছু পিছু আসতে আসতে আব্দুল আউয়াল বলতে থাকল, স্যার হাঁস রান্না করতেছি আজ, শুকনা শিমের বিচির সঙ্গে কষাইয়া। সঙ্গে আছে দুই পদের বিলের মাছ। কই মাছ ভাজা ও চিতল মাছের কোপ্তা। আমার রান্নার একটা সুনাম আছে স্যার, খাইয়া বলবেন কেমন হইছে...
।।২।।
আব্দুল আউয়ালের রান্নার হাত চমৎকার। তার প্রতিটি রান্নাই তবারক সাহেবের ভালো লাগল। যারা ভালো রান্না করতে পারে তারা মানুষরে খাওয়াতেও আনন্দ পায়। তবারক সাহেব দেখলেন ঠিকমত খাওয়ানোর ব্যাপারে আব্দুল আউয়ালের উৎসাহের কমতি নেই।
কিন্তু তবারক সাহেবের বিচক্ষণ সতর্ক দৃষ্টিতে এড়ালো না যে, তাকে গ্রাম দেখাতে নিয়ে যাবার ব্যাপারে আব্দুল আউয়ালের উৎসাহ নিষ্প্রভ।
বিকালের দিকে আব্দুল আউয়াল তবারক সাহেবকে বললো, দারোগা স্যার আসবেন বলছেন আপনারে নিয়া বের হইতে। তিনি নিজে সঙ্গে থাইকা আপনারে গ্রাম দেখাইতে চান।
তবারক সাহেব সোজা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনাদের এখানে কি কোন সমস্যা হচ্ছে?
আব্দুল আউয়াল বিব্রত এবং অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না স্যার, সমস্যা কী হবে, সমস্যা কিছু নাই স্যার। আপনে আরাম করেন। কোন দরকারে আমারে ডাক দিলেই পাইবেন।
সেদিন পুলিশের লোক হরিচরণবাবু আসলেন না। সন্ধ্যার দিকে আসলেন আরেকজন ভদ্রলোক। তাঁর বয়েস হবে ষাটের দিকে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত, চোখে চশমা, কাচের পেছনে বড় ঘোলাটে দুই চোখ। লম্বায় তবারক সাহেবের মতোই, হাতে কালো লাঠি, পরনে কালো আলখাল্লা এবং হ্যাট। ভদ্রলোকের গলার স্বর গম্ভীর।
তবারক সাহেব যে বাড়িতে উঠেছেন, এই কাঠের বাড়ির কিছুটা উত্তরে জমিদারি স্টাইলের পুরনো পরিত্যক্ত এক বাড়িতে থাকেন ইনি। বাড়িটাকে কুঠিবাড়ি নামে চিনে সবাই। নীলকর ইংরেজ সাহেবরা ওই বাড়ি ব্যবহার করত একসময়।
সন্ধ্যায় তবারক সাহেব বারান্দার চেয়ারে বসেছিলেন। সন্ধ্যার নেমে আসার সৌন্দর্য অনুভব করা যায় গ্রামীণ পরিবেশের নির্জনতায়। তবারক সাহেব চোখ বন্ধ করে সেই নিস্তব্ধ সন্ধ্যার নেমে আসার কালে তাঁর জীবনের একটি ঘটনার কথা ভাবছিলেন, তখনই গম্ভীর কণ্ঠে ভেসে আসল, আপনি কি এখানে নতুন এসেছেন শহর থেকে?
তবারক সাহেব চোখ মেলে ভদ্রলোককে দেখলেন।
বললেন, হ্যাঁ, আপনি?
ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম অমূল্য ভূষণ বড়ুয়া। এখান থেকে অল্প দূরেই আবার নিবাস। শুনলাম আপনি শহর থেকে এসেছেন তাই দেখা করতে এলাম। এই পাড়াগাঁয়ে কথা বলার মত লোক বড় অল্প। আমার আবার কথা বলার স্বভাব। নিজের চিন্তাগুলা প্রকাশ করতে না পারলে শান্তি পাই না।
বলতে বলতে অমূল্যবাবু বারান্দায় উঠে আসলেন ও একটা চেয়ার টেনে বসলেন।
তবারক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এই গ্রামেরই?
অমূল্যবাবু বললেন, হ্যাঁ, এখানেই আমার থাকা এখন। এটা আমাদেরই গ্রাম, পূর্বপুরুষদের। কিন্তু এখানে আমার জন্ম হয়নি। অবসর নেবার পর ভাবলাম গ্রামে ফিরে যাই। গ্রামের নির্জনতায়, প্রাকৃতিক পরিবেশে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেই। তাছাড়া একটা নেশার টানেও এসেছি বলতে পারেন। তা আপনার আসা কেন?
তবারক সাহেব বললেন, আমিও আপনার মতোই, অবসর নেবার পরে ইচ্ছা হলো কোন এক নির্জন গ্রামে গিয়ে একটা উপন্যাস লেখি। এই গ্রামের খোঁজ পেলাম, চলে এলাম।
অমূল্যবাবু বললেন, আপনি তাহলে লেখক! ভালোই হলো, আমার কাছে অনেক গল্প আছে। আর এই গ্রামের কিছু রহস্যজনক গল্পও আমি আপনাকে বলতে পারব। ভূতের গল্পে আপনার আগ্রহ আছে তো?
তবারক সাহেব বললেন, শুনতে আমার আপত্তি নেই।
অমূল্যবাবু বললেন, আপনি কী কাজ করতেন?
তবারক সাহেব বললেন, ছোটখাট এক সরকারি চাকরি করতাম। বড়াই করে বলার মত কিছু না অবশ্য। বড়াই করার মত কাজটা এখন করতে চাই, উপন্যাসটা যদি শেষ করতে পারি।
অমূল্যবাবু বললেন, পারবেন পারবেন। এখানে যখন এসেই পড়েছেন, পারবেন। আচ্ছা, আপনি কি এখন একটু বের হবেন?
তবারক সাহেব বললেন, এখন, এই অন্ধকারে?
অমূল্যবাবু বললেন, চলেন বাইরে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি। সন্ধ্যার বাতাস খুব উপাদেয়। অন্ধকার নিয়ে কিছু ভাববেন না, এই গ্রামের প্রতিটি রাস্তা আমি চোখ বন্ধ করে চিনে নিতে পারি।
তবারক সাহেব বললেন, চলুন তাহলে।
তারা দুইজন বের হলেন গ্রামের পথে। সন্ধ্যার অন্ধকার পুরো নেমে আসেনি, আস্তে আস্তে ঝেঁকে বসছে।
আব্দুল আউয়াল দিনের বেলায় তবারক সাহেবকে যথেষ্ট সঙ্গ দিয়েছে, কোন কিছুর দরকার হলে বলার সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে হাজির হয়েছে। সন্ধ্যা বেলায় সে ভেবেছিল এবার তবারক সাহেব অন্ধকারে আর কোথায় বের হবেন, তাই গিয়েছিল রান্না ঘরে।
সে দেখতে পেল না তবারক সাহেব অমূল্যবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছেন।
।।৩।।
হাঁটতে হাঁটতে অমূল্যবাবু কথা বলছিলেন।
বলছিলেন, বুঝলেন তবারক সাহেব, এই গ্রামের মূল রহস্য রয়েছে এর বনে, এবং বনের পাশের বড় দীঘিতে। আমি আপনাকে আমার এক নেশার কথা বললাম, সেটি হলো পাখি দেখার নেশা। প্রাকৃতিক পরিবেশে পাখি দেখতেই আমার এখানে আসা। তাই সময়ে অসময়ে এই গ্রামের নানা প্রান্তে, বন জঙ্গল মাঠে আমি চষে বেড়িয়েছি। নিরাশ হতে হয়নি। যা আশা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বেশিই দেখেছি।
তবারক সাহেব হাসিমুখে বললেন, তাহলে তো আপনার গল্প শুনে আমার নিরাশ হতে হবে না বলেই মনে হচ্ছে।
অমূল্যবাবু বললেন, এই নিশ্চয়তা আমি আপনাকে দিতে পারি। দাঁড়ান, এখনই আপনাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই, ওই দীঘিটার কাছে। জঙ্গলে আজ নিয়ে যেতে পারব না। অল্পক্ষণ পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। এই অন্ধকারে জঙ্গলে হাঁটা নিরাপদ না, সাপখোপ থাকতে পারে। কিন্তু দীঘি দেখা যায়। যাবেন নাকি?
তবারক সাহেব বললেন, বেশি দূরে?
অমূল্যবাবু বললেন, আরে না! এখান থেকে শর্টকাট এক রাস্তা ধরে ১০ মিনিটের পায়ে-হাঁটা পথ। তবারক সাহেব বললেন, তাহলে চলুন।
অমূল্যবাবু একটু থেমে বললেন, আপনায় ভয় বা সংস্কার নেই তো, মানে যেতে হবে এক গোরস্তানের ভেতর দিয়ে?
তবারক সাহেব বললেন, চলুন।
অমূল্যবাবু খুশি হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, দেখছেন সন্ধ্যার বাতাস কেমন হালকা ভাবে বইছে। এইরকম বাতাস আপনি শহরে পাবেন না। আমি যখন ছোট ছিলাম আমার মা বলতেন সন্ধ্যার বাতাসে বাইরে না থাকতে। এই সময়ে নাকি অশরীরীরা বের হয়, তাদের গায়ের বাতাস লাগলে অসুবিধা হয় মানুষের। এমন কথা আপনি শুনেছেন কখনো?
তবারক সাহেব বললেন, হ্যাঁ, ছোটবেলায় অনেক শুনেছি।
অমূল্যবাবু বললেন, এখনো মানুষ এগুলি বিশ্বাস করে। এই গ্রামে আপনি ভূত-প্রেতের অনেক গল্প শুনবেন। এই যেমন এখন তারা মেতে আছে একটা গল্প নিয়ে, দিন নেই রাত নেই। আমার অবশ্য ভূত-প্রেতে বিশ্বাস নেই। যে বাড়িতে আমি থাকি ওইটা ছিল এক কুঠিবাড়ি। নীলকর সাহেবরা মানুষদের ধরে এনে বেঁধে রাখত, মারত। অনেকে মরেও গেছে। এই বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ছিল। ভয়ে ওইদিকে কেউ যায় না। রাতে নাকি অত্যাচারিত লোকগুলির আর্তনাদ শোনা যায় তারা বলে। আমি যে থাকছি কয়েকমাস হলো, আমি এরকম কোন শব্দ শুনিনি। কেবল একবার রাতে কয়েকজনকে দেখেছিলাম।
তবারক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, দেখেছিলেন?
অমূল্যবাবু বললেন, হ্যাঁ, সেদিন মাঝরাতে আমার রুমের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাড়ির সামনে কয়েকটা লোক মিলে শলা করছে। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট আমি এদের দেখতে পাই। অবশ্য চোরছ্যাঁচড়ও হতে পারে।
কথা বলতে বলতে তারা গোরস্তানের ভেতর দিয়ে হেঁটে দীঘিটার সামনে চলে এলেন। ততক্ষণে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে, আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে চারপাশ।
তবারক সাহেব দেখলেন দীঘিটা বেশ বড়। এর এক পাশে বন। এক পাশে বাঁধানো ঘাট দেখা গেল, পরিত্যক্ত ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে আছে।
অমূল্যবাবু বললেন, এই দীঘিতেও গ্রামের লোকেরা আসে না। তারা ভয় পায়।
তবারক সাহেব বললেন, কেন?
অমূল্যবাবু হো হো করে শব্দ করে হাসলেন। তাঁর হাসি যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
এই অবস্থায় থাকলে অন্য কেউ হয়ত ভয় পেত। অপরিচিত একটা লোকের সঙ্গে, অপরিচিত একটা গ্রামের এক নির্জন দীঘির সামনে চলে আসা, খুব নিরাপদ শুনায় না। কিন্তু তবারক সাহেবের ভয় লাগল না, ভয় জিনিসটা তাঁর মধ্যে নেই।
অমূল্যবাবু হাসি থামিয়ে বললেন, এটা কিন্তু খুব মজার। এই দীঘি নিয়ে গ্রামের লোক এক গল্প বলে। এই দীঘি খোঁড়া হয় অনেক অনেক দিন আগে। আলামত খাঁ নামে এক জমিদার এই দীঘি খনন করেন। কিন্তু খননকার্য শেষ হলে দেখা যায় আর পানি উঠে না। জমিদার স্বপ্নে দেখলেন তাঁর তিন মেয়েকে এই দীঘিতে দিতে হবে, তাহলেই পানি আসবে। জমিদার তো দিবেন না। শেষে এক রাতে এই দীঘি উঠে গেল জমিদারের বাড়িতে। তাঁর তিন মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে আসল।
তবারক সাহেব বললেন, দীঘি উঠে গেল মানে কী?
অমূল্যবাবু বললেন, মানে দীঘির মধ্যে যিনি ছিলেন তিনি। তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি এই দীঘিতে নেমে গেলেন। এরপর কলকল শব্দে পানি আসতে লাগল। সেই শব্দে গ্রামের লোকদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারা দেখতে পায় দীঘি ভরে যাচ্ছে টলটলা পানিতে। আর এদিকে মেয়েদের হারিয়ে জমিদার আলামত খাঁর উন্মাদ দশা।
তবারক সাহেব বললেন, এই ধরনের গল্প অনেক এলাকাতেই প্রচলিত আছে।
অমূল্যবাবু বললেন, তা আছে। কিন্তু এখানের টুইস্ট হলো, জমিদারের মেয়েগুলাকে প্রায়ই এই দীঘির পানিতে দেখা যেত। তারা মৎস্যকন্যা হয়ে এই দীঘিতে এখনো বাস করে যাচ্ছে। এইজন্যই গ্রামের লোকেরা এই দীঘি ব্যবহার করে না।
অমূল্যবাবু দীঘির পাশের একদিকে একটি কুঁড়েঘর দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখতে পাচ্ছেন একটা ভাঙ্গা কুঁড়েঘর, এটা একজন জাদুকরের। ভাগ্য ভালো থাকলে আপনি হয়ত তার দেখা পাবেন। এর মত অদ্ভুত লোক আর হয় না। মানুষের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। তবে খুব বদমেজাজি, তাই লোকেরা অভিশাপের ভয়ে তার কাছে ঘেঁষে না।
দীঘি দেখার পর অমূল্যবাবু তবারক সাহেবকে নিয়ে ফিরতি পথে হাঁটা দিলেন। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু তাদের পথ চলতে অসুবিধা হচ্ছিল না, দুইজনই অন্ধকারে অভিজ্ঞ।
গেটের সামনে এসে অমূল্যবাবু বিদায় নিলেন। যাবার আগে বললেন, পাখি দেখতে গিয়ে আমি দীঘির মৎসকন্যাদের আমি কয়েকবার দেখেছি, একথা বললে কি আপনি বিশ্বাস করবেন?
উত্তরের অপেক্ষা না করে অমূল্য ভূষণ তাঁর লাঠি দুলিয়ে চলে যেতে লাগলেন।
।।৪।।
তবারক সাহেব বাড়িতে পৌঁছে দেখলেন উদ্বিগ্ন মুখে দুইজন লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তাদের পেছনে আব্দুল আউয়াল।
তবারক সাহেবকে আসতে দেখে আব্দুল আউয়াল বলল, স্যার, আপনে গেছিলেন কোন জায়গায়?
অন্য দুইজন লোকও এতে তবারক সাহেবের দিকে তাকালেন। তারা এগিয়ে এলেন।
দুইজন্যই মধ্যবয়স্ক লোক, গোলগাল চেহারা, মাঝারি আকৃতির।
একজন একটু বেশি এগিয়ে এসে বললেন, স্যার আমি হরিচরণ, এখানকার পুলিশের দায়িত্বে আছি। আপনি যেদিন আসলেন ওইদিনই আপনার সঙ্গে আমার দেখা করতে আসার কথা ছিল। আসছিলামও একবার সন্ধ্যার দিকে, পরে একটা ঝামেলার কারণে চলে যেতে হয়।
হরিচরণবাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন, ইনি ডাক্তার শামসুর রহমান। আমার বন্ধু। আমরা দুইজনই আজ সন্ধ্যার পরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখি আপনি নাই।
তাঁরা তিনজন বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আব্দুল আউয়াল গেল চা আনতে।
উপজেলা থেকে দূরের গ্রাম হলেও সীমান্তবর্তী হওয়ায় এখানে একটা পুলিশের ফাঁড়ি আছে। তারই দায়িত্বে আছেন হরিচরণবাবু।
হরিচরণবাবু বলতে থাকলেন, স্যার, আপনাদের মত বড় মানুষেরা তো এইরকম পাড়া-গাঁয়ে খুব কম আসেন। হয়ত যত্নআত্তি ঠিকমত হবে না। কিন্তু যেকোন প্রয়োজনে স্যার আমারে বলবেন। একেবারে উপরের মহল থেকে ফোন এসেছে আপনার যাতে কোন অসুবিধা না হয়।
তবারক সাহেব বললেন, এখানে সবই ভালো লাগছে। এত ব্যস্ত হবার কিছু নেই আসলে। আমি একজন সাধারণ লেখক।
হরিচরণবাবু এমন সব জায়গা থেকে ফোন পেয়েছেন তবারক সাহেবের আসা উপলক্ষ্যে, যা কেবল সরকারের খুবই উচ্চ পর্যায়ের লোকদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। তাই যদিও তিনি এখনো জানেন না এই লোক কী করেন, তথাপি ধরে নিয়েছেন ইনি বিশেষ কেউ। উচ্চ পর্যায়ে থাকা তাঁর এক বন্ধু এই বিষয়ে খোঁজখবর করছেন। হরিচরণ আশা করছেন কয়েকদিনের মধ্যেই একটা ধারণা পাবেন ইনি আসলে কে।
বন্ধু ডাক্তার শামসুর রহমানের সঙ্গে হরিচরণবাবু সবই শেয়ার করেন। শামসুর রহমান হতাশ ধরনের লোক। এখানে অনেকদিন ধরে ডাক্তারি করেন। শহরের বড় ডাক্তার ছিলেন। কোন এক ঘটনায় একবার তাঁর দোষে একজন প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হয়। তাঁর যে দোষ ছিল এটা কেউ বুঝতে পারেনি। কিন্তু তিনি নিজে জানতেন। এই ঘটনার অপরাধবোধ ও অনুশোচনায় শামসুর রহমান চলে আসেন এই গ্রামে।
তবারক সাহেবের যাতে অযত্ন না হয়, তার দেখাশোনার দায়িত্ব সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারেই নিয়েছিলেন হরিচরণ। কিন্তু গত কয়েক মাসে গ্রামে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় বলা যায়, গতকালই একজনের লাশ মিলেছে একটা জলাধারে, গলা কামড়ে রক্ত খেয়ে নিয়েছে কোন পিশাচ।
অদ্ভুত ঘটনাটার শুরু যখন রাতে আধা মানুষ ও আধা পাখির মত একটা জীবকে দেখা যেতে শুরু করে তখন থেকে। কিন্তু মানুষ খুন হলো এই প্রথম।
সদ্য গ্রামে আসা তবারক সাহেবের কাছে ব্যাপারটা অস্বস্তিকর লাগবে, এইজন্য আব্দুল আউয়ালকে সমস্ত বিষয় গোপন রাখতে বলে গিয়েছিলেন হরিচরণ।
কিন্তু আজ যখন তবারক সাহেব একা একাই বের হয়ে গেলেন সন্ধ্যায়, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁকে বিষয়টা জানানো জরুরি মনে করছেন হরিচরণবাবু।
তবারক সাহেব যখন বললেন, তিনি অমূল্য ভূষণ বড়ুয়া নামে এক লোকের সঙ্গে বেরিয়েছিলেন, শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন ডাক্তার শামসুর রহমান।
ডাক্তার বললেন, ওই লোকটা একটা বদ্ধ উন্মাদ। আমার চেম্বারে মাঝে মাঝে আসেন সন্ধ্যার পরে, আড্ডা দেন। কথাবার্তা বলেন ভালো কিন্তু মাথায় ঝামেলা আছে।
হরিচরণবাবু তবারক সাহেবকে বললেন, স্যার, আপনি হয়ত ভাবছেন আমি কেন আরো আগে আপনার সঙ্গে দেখা করি নাই। কিন্তু এখানে একটা ঝামেলা শুরু হইছে। রাতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না ভয়ে। কয়েকমাস আগে থেকে, হঠাৎ হঠাৎ রাতে এক জীবকে দেখা যায়। আধা মানুষ আধা পাখি। লাফ দিয়া উড়ে উড়ে এক গাছ থেকে আরেক গাছে চলে যায়। চোখ জ্বল জ্বল করতে থাকে অন্ধকারে।
ডাক্তার যোগ করেন, আপনি যার সঙ্গে বাইরে গেলেন, ওই অমূল্যবাবুই প্রথম এটাকে দেখেন। উনি গিয়ে আমাদের বলেন। কিন্তু উনি অনেক কিছুই বলেন আমরা এই কয়েকমাসে দেখেছি, যার আগা মাথা থাকে না। তাই প্রথমে বিশ্বাস করি নাই। কিন্তু পরে আরো অনেকেই দেখতে শুরু করলো। আর সর্বশেষ এই খুন।
হরিচরণবাবু বললেন, কিন্তু স্যার আপনার কোন ভয় নেই। আমি ব্যাপারটা সামলে নিব। রাতে গ্রামে পাহারা জোরদার করা হয়েছে। আর একটা লোককে আমরা খুঁজছি। আমার ধারণা এই সমস্ত কিছুর পেছনে তাঁর কোন হাত আছে। তবে স্যার, সন্ধ্যার পরে বাইরে বের হইয়েন না। দিনের বেলায় বের হলে আব্দুল আউয়ালরে সঙ্গে নিয়ে যাইয়েন।
তবারক সাহেব তাঁর কথায় সম্মতি জানালেন।
কিন্তু তিনি এই বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলেন না। কেবল শুনেই গেলেন। হরিচরণবাবু ও ডাক্তার শামসুর রহমান দুজনেই এতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যান। কারণ তাঁরা আশা করেছিলেন এইরকম একটা অদ্ভুত বিষয় নিয়ে কথা উঠলে অনেক প্রশ্ন উঠবে। আসলেই জীবটা দেখতে কেমন, কে কে দেখেছে, কোন জায়গায় দেখেছে, জীবটা কী করে, কোনদিকে দেখা গেছে, জীবটাই কি খুন করেছে, কারে খুন করেছে, ইত্যাদি বিস্তর প্রশ্ন। হরিচরণবাবু প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন।
তবারক সাহেব এর একটা প্রশ্নও করলেন না।
কথাবার্তা বলে হরিচরণবাবু ও ডাক্তার শামসুর রহমান চলে যাবার পর, রাতে দেখা গেল আব্দুল আউয়ালের মুখ খুলে গেছে।
সে এখন অনর্গল নানা কথা বলে যাচ্ছে।
আগে হরিচরণবাবুর নিষেধ থাকার কারণে সব কথা পেটে নিয়ে বসেছিল।
।।৫।।
রাতের খাবারে কয়েক পদের ভর্তা বাজি করেছিল আব্দুল আউয়াল। এর মধ্যে একটা টাকি মাছের ভর্তা।
খেতে বসে তবারক সাহেবের খুব ভালো লাগল। তিনি এর প্রশংসা করলেন।
আব্দুল আউয়াল উৎসাহ পেয়ে বলল, স্যার, এইটা আমি শিখছি আমার দাদার কাছ থেকে। কোন জায়গা থেকে মাছটা আসতেছে, সেইটাও দেখা জরুরি রান্নার সময়ে। সবচাইতে ভালো স্বাদের ভর্তা হইত আমাদের এইখানের পরীর দীঘির মাছ থেকে। সেইটা তো এখন আপনারে খাওয়াইতে পারব না, খাইলে বুঝতেন টাকি মাছের ভর্তা কী জিনিস।
তবারক সাহেব বললেন, আপনারটা কম কী!
আব্দুল আউয়াল বলল, ওইটার সঙ্গে এইটা কিছু না স্যার। আমার দাদার নিশা হইয়া গেছিল। তিনি পরীর দীঘিতে টাকি মাছের খোঁজে থাকতেন। মানুষ কুকথা বলত, তিনি নাকি পরী দেখতে বসে থাকতেন। এখন আর ওইদিকে কেউ যায় না, দোষী দীঘি। অনেক মানুষ মারা গেছে ঐ দীঘিতে।
তবারক সাহেব খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন, ওইখানে সত্যি পরী আছে নাকি?
আব্দুল আউয়াল বলে, সত্য-মিথ্যা জানি না স্যার। লোকে বলাবলি করে, সেই আমাদের ছোটকাল থেইকা। আর আমার দাদারে তো আমি নিজেই দেখলাম। আমাদের এইখানে এক কবিরাজ আছে। দীঘির পাড়ে থাকে। আমার দাদা তাঁর কাছে মন্ত্র শিখতেন। পরী ধরার মন্তর।
তবারক সাহেব খেতে থাকলেন।
আব্দুল আউয়াল আশা করেছিল তবারক সাহেব জিজ্ঞেস করবেন তাঁর দাদার ব্যাপারে।
তিনি প্রশ্ন করছেন না দেখে নিজ থেকেই বলতে থাকল, আমার দাদারে একদিন পাওয়া গেল দীঘির মধ্যে, মইরা পড়ে আছেন। লোকে বলে তিনি পানির নিচে পরী দেইখা ধরতে গেছিলেন। নির্জন দুপুর বেলায় এবং রাইতে রাইতে কেউ কেউ নাকি দেখছে পানির নীচ থেকে তিনটা পরী ভাইসা উঠে। কী বলব স্যার, লোকে বলে, ওদের গায়ে কোন কাপড় থাকে না। অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছ, পিছলা শরীর চকচক করে। কুন্তল কবিরাজ ছাড়া কেউ অবশ্য দুইবার দেখে নাই।
এবার তবারক সাহেব প্রশ্ন করলেন, এই কুন্তল কবিরাজটা কে?
আব্দুল আউয়াল বলল, ওই কবিরাজ, আমাদের গ্রামেরই এক বৃদ্ধ লোক, তাঁর কত যে বয়স কেউ জানে না। আমার দাদাদের আমলেও ছিল। আমার দাদার বন্ধু ছিল এই কুন্তল কবিরাজ। আপনে যদি কখনো পরীর দীঘিতে যান, দক্ষিণ দিকে, জঙ্গলের পাশে একটা ভাঙ্গা ঘর দেখবেন। ওই ঘরেই সে থাকে এত বছর ধইরা। নানা মন্তর, কালা জাদু করে। সেই অনেকবার দেখছে দীঘির পরীদের। লোকে বলে, ভরা পূর্ণিমার মাঝ রাতে নাকি পরীরা পানি থেকে উঠে তাঁর ঘরে চইলা যায়। লোকে বলে, সত্য-মিথ্যা জানি না স্যার, ওই সময় নাকি কুন্তল কবিরাজের সঙ্গে পানি থেকে উইঠা আসা পরীরা মিলামিশা করে।
তবারক সাহেবের খাওয়া শেষ হলো। তিনি হাত ধুয়ে মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, এই লোককেই তো হরিচরণবাবু খুঁজতেছেন?
আব্দুল আউয়াল বলল, জি স্যার। তারে কিছুদিন ধরে মিলতেছে না। এমনেই তাঁর খোঁজ খবর কেউ রাখত না, ভয়ে তাঁর ওইদিকে যাইত না কেউ। কিন্তু যখন থেকে আধা পাখি আধা মানুষের দানবটারে দেখা যাইতে শুরু করল, তখন কেউ কেউ খোঁজ নেয়। জানা যায় সেই নাকি কালো জাদু দিয়া এই জীবরে নিয়া আসছে। কুন্তল কবিরাজরে না পাইলে এর কোন সমাধান নাই স্যার।
।।৬।।
সেই রাতে ঘুমানোর সময় শুয়ে শুয়ে আব্দুল আউয়াল ভাবছিল পরীদের কথা। পরীর নিশা হইল বড় নিশা, তাঁর দাদা বলতেন। যারে একবার পরীর নিশা পাইয়া বসে তার আর দিন-দুনিয়ার খবর থাকে না।
সেই ছোটকাল থেকেই আব্দুল আউয়ালের সন্দেহ হয় তার দাদারে খুন করেছে কুন্তল কবিরাজ। তার দাদা অনেকদিন পরীদের পিছে পিছে ঘুরে তাদের সঙ্গে হয়ত একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। এটা মেনে নিতে পারেনি কুন্তল কবিরাজ।
এই লোকটাকে খুঁজে পেতেই হবে। এর পেছনে সে তার প্রায় সারা জীবন নষ্ট করেছে। একটা চোখ হারিয়েছে। কুন্তল কবিরাজের শর্ত ছিল তাঁর কথামত চল্লিশ বছর সাধনা করতে হবে। তবেই সে দেবে পরী ধরার মন্ত্র।
সেই চল্লিশ বছর শেষ হয়েছে। সাধনার শেষ ধাপ অতিক্রম করেছে আব্দুল আউয়াল।
কিন্তু কুন্তল কবিরাজ উধাও হয়ে গেছে।
এদিকে হরিচরণবাবুর মাথাতেও একই চিন্তা। তিনি বসে আছেন ডাক্তার শামসুর রহমানের চেম্বারের পেছনের রুমে। মাঝে মাঝেই এখানে রাতে বসে তাঁরা আড্ডা দেন, হালকা মদ খান।
প্রথমে যখন আধা পাখি আধা মানুষ দানবটার কথা শোনা যায় গ্রামবাসীদের মুখে, হরিচরণ কথাটারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। গতকাল রাতে টহলে বের হন সহকর্মীদের সাহস দিতে। এবং তিনি ওই জীবটাকে আবছাভাবে দেখতে পান একটা বাঁশ ঝাড়ের পেছনে। টর্চ লাইটের আলো পড়তেই দপ করে জ্বলে উঠে তাঁর দুই চোখ, এবং হুড়মুড় করে উড়ে চলে যায়।
এইরকম অদ্ভুত কোন জিনিস হরিচরণবাবু তাঁর জীবনে আগে দেখেননি।
তবারক সাহেবের ব্যাপারে নানাদিকে খোঁজ নিয়ে তিনি খুব সামান্য তথ্য পেয়েছেন। কেউ তাঁর ব্যাপারে কিছু জানে না বা মুখ খুলতে চায় না। খুবই উচ্চ পর্যায়ে থাকা তাঁর এক ক্লোজ বন্ধুকে কাজে লাগিয়েছিলেন, সেই বন্ধু কিছুক্ষণ আগে জানিয়েছে, এই লোক মারাত্মক। এমন সব কেইস ডিল করে এসেছেন যার নাম শুনলেও আমাদের আত্মা শুকিয়ে যাবে। আমেরিকার খুবই গোপন এক প্রিমনিশন্স ব্যুরো ছিল, ঐটাতে এডভাইজর হিসাবে কাজ করেন। এই ব্যুরো এখনো আছে কি না, এখনো তিনি এর সঙ্গে যুক্ত কি না জানি না।
হরিচরণবাবু এখন দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন, গ্রামের এই সমস্যাটাতে তবারক সাহেবের সাহায্য নিবেন কি না।
তাঁর বন্ধু ডাক্তার শামসুর রহমান বলেন, পরামর্শ তো নেয়াই যায়। উনি যেহেতু এত কামেল আদমি, সাহায্য করবেন নিশ্চয়ই।
যে লোকটার মৃতদেহ পাওয়া গেল জলাধারে, তার গলায় ছিল একটা অদ্ভুত কামড়ের দাগ, মুখ রক্তশূন্য। কোন প্রাণী তার রক্ত খেয়ে ফেলেছে।
এই লোক আবার চেয়ারম্যান সাদেক হেদায়াত সাহেবের ডান হাত ছিল। চেয়ারম্যান সাহেব চাপ দিচ্ছেন।
হরিচরণবাবু ও ডাক্তার শামসুর রহমান যখন গ্রামের পরিস্থিতি ও ইত্যাকার নানা বিষয়ে আলাপ করছিলেন, তখন সেখানে এসে উপস্থিত হন অমূল্যবাবু, তাঁর অদ্ভুত আলখাল্লা, হ্যাট ও হাতের লাঠি নিয়ে। তিনিও মাঝে মাঝে এই আড্ডায় আসেন।
প্রথম দিন থেকেই অমূল্যবাবু এক কথা বলে আসছেন, গ্রামে ভ্যাম্পায়ার আছে।
আধা মানুষ ও আধা পাখি জীবটাকে তিনিই সবচাইতে বেশিবার দেখেছেন, যেহেতু রাতেবিরেতে ঘুরে বেড়ানো তাঁর স্বভাব। তিনি নিশ্চিত এটা ভ্যাম্পায়ার।
আজকেও বললেন, আমার কথা আমলে নেন আপনারা। আমি ওর লাল চোখগুলা দেখেই বুঝেছি। এসব নিয়ে আমার বিস্তর পড়ালেখা আছে। ওর চোখে আমি দেখেছি রক্তের তৃষ্ণা।
ডাক্তার শামসুর রহমান চানাচুর খেতে খেতে তাঁকে বললেন, আপনি নতুন আসা তবারক সাহেবকে নিয়ে সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন কোথায়?
অমূল্যবাবু শব্দ করে হাসলেন।
বললেন, নিয়ে গিয়েছিলাম পরীর দীঘিতে। ভাবলাম একটু ভড়কে দেই।
ডাক্তার বললেন, ভড়কালো?
অমূল্যবাবু বললেন, না, শক্ত ধাঁচের মানুষ।
হরিচরণবাবু বললেন, কী মানুষ নিয়ে খেলতে গেছিলেন বুঝেন নাই তো অমূল্যবাবু, তাঁর সামনে আপনার সব জারিজুরি মূল্যহীন।
অমূল্যবাবু বললেন, কেন, উনি কি বিশেষ কেউ?
হরিচরণবাবু বললেন, সব তো আর বলতে পারব না। তবে, উনার সঙ্গে আর খেলতে যাইয়েন না। উনি এইসব অনেক খেলা পরিচালনা করে আসা লোক। শেষে কোন বিপদে পড়বেন, আমাদেরও ফেলবেন। আমি ভাবছিলাম গ্রামের এই অদ্ভুত জীবটার রহস্যের ব্যাপারে তাঁর সাহায্য চাইব। আপনি কী মনে করেন?
অমূল্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, উনি কি গোয়েন্দা লোক নাকি? একজন লেখক কী সাহায্য করবেন?
হরিচরণ বললেন, উনি গোয়েন্দারও বাপ।
অমূল্যবাবু বললেন, তাহলে সাহায্য চাইতে পারেন। আমিও আমার আইডিয়াটা তাঁর কাছে তাহলে শেয়ার করতে পারব। আপনারা তো আমলেই নিচ্ছেন না।
হরিচরণ বললেন, সব আমলে নিচ্ছি, কিন্তু আগে কুন্তল কবিরাজকে পেতে হবে না? ওরে না পেলে তো কিছুই করা যাচ্ছে না। আপনাকে বললাম, যেহেতু দিন নেই রাত নেই ঘুরাঘুরি করেন, ওর একটা খোঁজ লাগান। এমনভাবে একটা বুড়ো লোক কোথায় উধাও হয়ে গেল! আপনি কি কোন আলামত পেলেন ওর?
অমূল্যবাবু বললেন, পাই নাই। তবে পেয়ে যাব, আমার হাত থেকে তাঁর নিস্তার নেই।
প্রায় ঘণ্টা খানেক আলাপের পর অমূল্যবাবু বিদায় নিলেন।
তিনি চলে যাবার সময় ডাক্তার বললেন, অমূল্যবাবু, দয়া করে একটু সাবধানে থাকবেন। আপনি যেরকম একা একা চলেন, গ্রামের এই পরিস্থিতিতে যেকোন বিপদ হইতে পারে।
অমূল্যবাবু হেসে তাঁর লাঠি উঁচিয়ে ধরে বললেন, আপনি এর ক্ষমতাকে আন্ডার এস্টিমেট করছেন ডাক্তার।
অমূল্যবাবু চলে যাবার পর ডাক্তার ও হরিচরণবাবু লোকটাকে নিয়ে কথা বললেন কিছুক্ষণ। একেবারে খেয়ালি ও অদ্ভুত শখের লোক। প্যারাসাইকোলজি নিয়ে নাকি কাজ করেছেন একসময়। একদিন বলেছিলেন তাঁর এই কালো লাঠির গল্প। অনেক মন্ত্র ও সাধনার বলে নাকি হস্তগত হয়েছে এই লাঠি। অশুভ শক্তি তাড়াতে তিনি এই লাঠি ব্যবহার করেন।
ডাক্তার তাঁকে পুরোপুরি অবিশ্বাস করলেও হরিচরণবাবু কিছুটা বিশ্বাস না করে পারেন না। তাঁর যদি ক্ষমতাই না থাকে, তাহলে ভুতুড়ে ওই কুঠিবাড়িতে কীভাবে তিনি আরামে বসবাস করছেন।
।।৭।।
সেই দিন শেষরাতের দিকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো।
তবারক সাহেবের ঘুম আসছিল না। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিনি একটা বড় গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্ধকারের কারণে বুঝা যাচ্ছে না কী গাছ। বাতাসে ঝাঁকড়া পাতাগুলি ডালপালা সমেত নড়ছে বুঝা যাচ্ছে। তৈরি করছে এক অবয়ব।
তবারক সাহেব তাঁর পুরনো অনুভূতি ফিরে আসছে টের পেলেন। তিনি টের পেতে লাগলেন চারপাশে অশরীরী কিছু একটা ঘটে চলেছে।
এরকম অবস্থায় তাঁর বাঁ-হাতের কড়ে আঙ্গুল অল্প অল্প কাঁপতে থাকে।
গাছের পাতায় বৃষ্টির পতনের শব্দ, এবং প্রবহমান বাতাসের থেমে থেমে আসা শোঁ-শোঁ শব্দ একসময় তন্দ্রার আবহ নিয়ে আসল। তবারক সাহেব ঘুমিয়ে গেলেন।
সকালেও বৃষ্টি হচ্ছিল। থামার কোন নাম নেই।
বিশাল এক ছাতা মাথায় নিয়ে সকালের দিকে হাজির হলেন অমূল্যবাবু। তিনি এসেছেন তবারক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে।
গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে বললেন, ভাই, আপনি যে বড় পুলিশের লোক তা আমি জেনে গেছি। এখানে আসছেন তদন্ত করতে। তাই আমার কিছু ফাইন্ডিংস আপনার সঙ্গে শেয়ার করতে আসলাম।
তাঁর চরিত্রের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী তবারক সাহেব, সামান্য হাসলেন। কিছু বললেন না।
তবারক সাহেব কথা বলেন একেবারেই কম। তিনি শুনে যান। মানুষের কথা বলার সময়কার অঙ্গভঙ্গি দেখেন। এইগুলাই আসলে বেশি তথ্য দেয় মুখের কথার চাইতে।
তবারক সাহেবের আরেকটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য, তিনি কোন কিছু ধারণা করে দেখেন না। জিনিসগুলা যেমন আছে তেমনই দেখেন।
এটা একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, এবং এর ফলেই চিন্তা বা দুশ্চিন্তা জিনিসটা তাঁর মধ্যে কম। তিনি খুব একটা যে পরিকল্পনাও করেন, এমন না। সম্ভবত এই সব কারণেই ভয় জিনিসটা তাঁর মধ্যে কাজ করে না।
অমূল্যবাবু বললেন, ভাই, আমার নানা শখ আছে। একসময় অলৌকিক, অতিপ্রাকৃতিক জিনিসগুলা নিয়ে চর্চা করতাম। প্যারাসাইকোলজিতে আমাকে একজন বিশেষজ্ঞ ধরতে পারেন। একসময় দেশের নানা স্থানে ছুটে বেড়িয়েছি প্যারানর্মাল ঘটনাগুলিকে বুঝার জন্য। আমার সেইসব কাজ থেকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস খুঁজে পাই। এবং তাঁরপরেই একরকম ওইসব থেকে সরে আসি।
তবারক সাহেব আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। কিন্তু কিছু বলছেন না।
অমূল্যবাবু একটু থেমে গিয়ে বললেন, আমাদের দেশের নানা প্রান্তে ভ্যাম্পায়ারদের একটা সিক্রেট সোসাইটি, মানে গুপ্ত সংঘ একটিভ আছে।
তবারক সাহেব বললেন, কীভাবে বুঝলেন?
অমূল্যবাবু বললেন, আপনি যদি গত ত্রিশ-চল্লিশ বছরের দেশের বিভিন্ন স্থানে অজ্ঞাত কারণে খুন হয়ে যাওয়া মানুষদের তথ্য সংগ্রহ করবেন, দেখবেন এদের কিছু কিছু মৃত্যু একইরকম। একটা প্যাটার্ন আছে এই মৃত্যুধারায়। আমি অবশ্য সব ডেটা বিশ্লেষণ করে, প্যাটার্ন ধরে বের করিনি। একটা প্যারানরমাল কেইসে ভুতুড়ে এক বাড়িতে গিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গে। সেইখানে ভ্যাম্পায়ারদের এক প্রাচীন গ্রন্থ খুঁজে পাই। ওইখানের লেখার সূত্রেই আমি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে এরা একটিভ আছে।
অমূল্যবাবু বললেন, অনেকে মনে করে ভ্যাম্পায়াররা মজা করে রক্ত খাওয়ার জন্য মানুষ খুন করে। কিন্তু এটি আসলে ভুল। ভ্যাম্পায়ারদের ভেতরে রক্তের প্রতি যে ক্ষুধা তৈরি হয় তা একটি প্রাচীন অভিশাপ। এই অভিশাপের জন্যই রক্তের অমানুষিক তৃষ্ণায় তারা মানুষের রক্ত খায়।
অমূল্যবাবু বললেন, ওই বইতেই আমি পাই আদি ভ্যাম্পায়ার কেইন-এর কথা ও তাঁর ইতিহাস। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আব্রাহামিক ধর্ম মতে এডাম এবং ইভের বড় পুত্র কেইন। তাদের আরেক ছেলে ছিল এবেল নামে।
কেইন পশুপালন করত। এবেল ছিল কৃষক। তারা দুই ভাই একবার ঠিক করেছিল ঈশ্বরকে তাদের শ্রেষ্ঠ জিনিস উৎসর্গ করবে। এবেল উৎসর্গ করল তাঁর উৎপাদন করা শস্য। কেইন উৎসর্গ করল তাঁর সেরা পশুগুলি।
ঈশ্বর এবেল-এর উপর বেশি খুশি হলেন।
তা মেনে নিতে পারল না বড় ভাই কেইন। সে ভয়ানক রেগে গেল।
রেগে গিয়ে কেইন তাঁর ভাই এবেলকে মেরে ফেলল। এটাকে খ্রিস্টানরা বলে দুনিয়ার প্রথম হত্যাকাণ্ড। এবেলকে বলে প্রথম শহীদ। মুসলমানেরা কেইন আর এবেলকে বলে হাবিল ও কাবিল। এছাড়া ঘটনা প্রায় একই।
কেইন প্রতিশোপরায়ণ হয়ে হত্যা করেছিল এবেলকে। এজন্য ঈশ্বর তাঁর উপর ক্রোধিত হলেন। এডাম কেইনকে নির্বাসিত করলেন নড নগরীতে। নড নগরী এডাম ও ঈভ নির্বাসিত হবার আগে যে ইডেন শহরে থাকতেন তার পূর্বদিকে ছিল। এই নড নগরে সব সময় এক ধরনের মোহগ্রস্ততা কাজ করত। সব সময় ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থা।
কেইন নড নগরে থাকাকালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় লিলিথের। লিলিথ ছিল ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুবিদ্যায় পারদর্শী। কেইন লিলিথের কাছ থেকে ব্ল্যাক ম্যাজিক শেখার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকলে এক সময় লিলিথ তাকে ব্ল্যাক ম্যাজিক শেখাতে রাজি হয়।
যেদিন ব্ল্যাক ম্যাজিক বা কালো জাদুর জগতে কেইনের প্রবেশ ঘটে সেদিন লিলিথ তাকে নিজের হাত কেটে রক্ত পান করতে দেয়। কেইন সে রক্ত পান করার সঙ্গে সঙ্গে তিন জন এঞ্জেল এসে তাকে এবেলকে খুন করার জন্য অনুশোচনা করতে বলে। কেইন অস্বীকৃতি জানায়। তখন এঞ্জেলরা তাকে তিনটি অভিশাপ দিয়ে যায়। এই তিনটি অভিশাপই হল ভ্যাম্পায়ারদের সেই প্রাচীন অভিশাপ। যার কারণে তারা আজ ভ্যাম্পায়ার।
তবারক সাহেব শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি খেয়াল করলেন আব্দুল আউয়ালও পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছে। অমূল্যবাবুর গলার স্বর, বলার ভঙ্গি, সকালের বৃষ্টিময় পরিবেশ সব কিছু মিলেমিশে গল্প জমে উঠেছে।
তবারক সাহেব অমূল্যবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, অভিশাপগুলি?
অমূল্যবাবু মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললেন,
আগুনের প্রতি কেয়ামত পর্যন্ত দুর্বলতা থাকবে
সুর্যের আলোতে আসতে পারবে না, গায়ে লাগলে পুড়ে যাবে
তার ভেতরে থাকবে পাশবিক রক্তের ক্ষুধা
বলা হয় পৃথিবী ধ্বংসের আগে কেইনের মৃত্যু হবে না। এটাই তাঁর শাস্তি। কিন্তু এতেই ভ্যাম্পায়ারদের আলাদা রাজ্য তৈরি হয়ে গেছে। কেইন ও তাঁর বংশধরেরা।
অমূল্যবাবু বললেন, এই দেশে ও দুনিয়ায় যেসব ভ্যাম্পায়ার আছে তারা নিজেদের ভ্যাম্পায়ার বলে না। আপনি যদি কোন ভ্যাম্পায়ারকে ভ্যাম্পায়ার বলেন তাহলে অপমানিত ফিল করবে। কারণ ভ্যাম্পায়ার শব্দটা এসেছে ভ্যাম্পায়ার ব্যাট থেকে। সকল ভ্যাম্পায়ারেরা নিজেদের কেইনের সন্তান বলে পরিচয় দেয়। এই দেশে তাদের একটিভ গুপ্ত সংঘের নাম কেইনের সন্তানেরা।
তিনি জানালেন, আধুনিক কালে কেইনের সন্তানেরা কাজ করে যাচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি তৈরির কাজে যা তাদের সূর্য রশ্মিতে চলতে সাহায্য করবে। বলা হয়ে থাকে, বিভিন্ন জায়গায় তারা এমন কিছু তরল ওষুধের পরীক্ষা চালিয়েছে যা কয়েকদিন পর্যন্ত সূর্য রশ্মিতে চলাফেরার ক্ষেত্রে প্রটেকশন দেয়। অনেকটা সানস্ক্রিনের মত আর কি।
তবারক সাহেব বললেন, আপনি কি মনে করছেন এই গ্রামে ভ্যাম্পায়ার আছে?
অমূল্যবাবু বললেন, ঠিক ধরেছেন ভাই। এটাই, এইজন্যই আমি আপনার কাছে এসেছি, এবং এই গল্প বললাম। সব বিস্তারিতভাবে বললাম যাতে আপনি বুঝতে পারেন এই বিষয়ে আমার সিরিয়াস গবেষণা আছে। আমি হরিচরণবাবু ও ডাক্তারকে বার বার বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁরা আমার কথাকে পাত্তা দিতে চান না। আপনি যদি শেষ যে লোকটা মারা গেল তার দিকে খেয়াল করেন, জানি না আপনি দেখেছেন কি না, ওর ঘাড়ে একটা হিংস্র কামড়ের দাগ ছিল। মুখ ও শরীর ছিল প্রায় রক্তশূন্য। কোন জন্তু যেন সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। এরকম কী জন্তু হতে পারে ভ্যাম্পায়ার ছাড়া?
তবারক সাহেব বললেন, কিন্তু আপনার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই।
অমূল্যবাবু বললেন, ভাই, আপনি জানেন পৃথিবীতে সব জিনিস বাহ্যিক প্রমাণ দিয়ে বুঝা যায় না। প্যারানর্মাল অনেক বিষয় আছে। যা সায়েন্স ধরতে পারে না, যুক্তি দিয়ে আপনি ধরতে পারবেন না। এগুলি বুঝতে হয় অন্যভাবে। কেউ কেউ বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে আসেন বা সেই ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেন সাধনা করে। তাঁরা বুঝতে পারেন। আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন কীভাবে বুঝেছেন, আপনাকে স্টেপ বাই স্টেপ বুঝাতে পারবেন না। কিন্তু এতে তাদের বুঝাটা ভুল হয় না। আমি বলছি না যে আমি খুব বিশেষ বুঝার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলাম। আমি সাধারণ এক ফরেস্ট অফিসার ছিলাম সুন্দরবনে। সাধারণ চাকরিজীবী। কিন্তু কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে প্যারানর্মাল বিষয়গুলার প্রতি আগ্রহী হই। যা এখন আমি বুঝতে পারি, যা বুঝার ক্ষমতা হয়েছে, তা মূলত আমার সাধনার গুণেই। আমি আমার এই বুঝার ক্ষমতার উপর বিশ্বাস রেখেই বলছি, অচিরেই আরো এমন মৃত্যু দেখবেন এই গ্রামে। এগুলি বন্ধ করতে হলে এই ভ্যাম্পায়ারটাকে জব্দ করতে হবে।
কথাবার্তা বলে অমূল্যবাবু চলে যাওয়ার পর আব্দুল আউয়াল দাঁত বের করে হেসে তবারক সাহেবকে বলল, এই লোকটা পাগল স্যার। ওর কথা বিশ্বাস কইরেন না। একলা থাকে বাড়িতে। রাইতে মাঝে মাঝে চিল্লায়।
।।৮।।
বিকালের দিকে বৃষ্টি একটু ধরে এল। হরিচরণবাবু আসলেন তবারক সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে।
প্রাথমিক কথাবার্তার শেষে তিনি মূল বিষয় শুরু করলেন।
বললেন, স্যার, আমি জানি না আপনি কী কাজ করেন বা করতেন, কিন্তু যতটুকু বুঝেছি, আপনি বিশেষ কেউ। এবং আমাদের লাইনেই কাজ করেন। তা না হলে আপনার ব্যাপারে এত গুরুত্ব দেয়া হতো না উপরের মহল থেকে। আমি স্যার এখানে যে সমস্যাটায় পড়েছি, এর কোন কিনারা করতে পারছি না। আপনিই পারেন স্যার আমাকে সাহায্য করতে।
তবারক সাহেব সামান্য হেসে বললেন, আমার ব্যাপারে আপনি অতিরিক্ত ভেবে বসেছেন হরিচরণবাবু। আমি সাধারণ একজন লোক।
হরিচরণবাবু বললেন, কিন্তু স্যার আমি আপনার সাহায্য চাই। এই আধা পাখি আধা মানুষ জন্তুটার ব্যাপারে আমি কিছুই বের করতে পারছি না। আমি একটা লোককে সন্দেহ করি, এইখানকার এক বয়োবৃদ্ধ লোক, কুন্তল কবিরাজ। কিন্তু হঠাৎ করে সে উধাও হয়ে গেছে। এদিকে যে লোক মারা গেছে সে এখানকার সবচাইতে পাওয়ারফুল, চেয়ারম্যান সাদেক হেদায়াত সাহেবের লোক ছিল। তিনি চাপ দিচ্ছেন। এই অবস্থায় কী করব স্যার?
তবারক সাহেব বললেন, অমূল্য ভূষণ বড়ুয়াকে আপনার কেমন মনে হয়?
হরিচরণবাবু বললেন, তাঁর সঙ্গে কয়েক মাসের পরিচয়। এমনিতে ভালো, আমুদে লোক। নানা বিষয় নিয়ে গল্প করতে পারেন। তাঁর মাথায় বিচিত্র সব আইডিয়া, তিনি শখের গোয়েন্দাও ছিলেন, প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন করতেন। কিন্তু এখন বোধহয় তাঁর মাথা ঠিক কাজ করে না। তাঁর ধারণা এই পাখিমানব জন্তুটা একটা ভ্যাম্পায়ার, এবং এই গ্রামে ভ্যাম্পায়ারেরা ঘাঁটি গাড়বে। যেই হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেটা করেছে ভ্যাম্পায়ার, এটা তাঁর দাবি।
তবারক সাহেব বললেন, উনি কি এই গ্রামেরই লোক?
হরিচরণবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাঁর বাপ -দাদার গ্রাম এটা। উনার জন্ম এখানে না। এখানে এসেছেন এবং সম্প্রতি থাকছেন পুরনো এক কুঠি বাড়িতে। ওই বাড়ি ভুতুড়ে বলে লোকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু তিনি ভালোভাবেই একা একা আছেন। খাবারদাবার কিনে আনেন বাজারের এক দোকান থেকে। রাতবিরেতে বিভিন্ন দিকে ঘুরে বেড়ানো, প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনের চেষ্টা আর উদ্ভট সব গল্প বলার বাইরে তাঁর আর কোন সমস্যা আমাদের চোখে পড়েনি।
তবারক সাহেব বললেন, আর এই কুন্তল কবিরাজ?
হরিচরণবাবু বললেন, এই লোক স্যার আরেকটা অদ্ভুত জিনিস। বয়স কত আপনি দেখে বুঝতে পারবেন না। মুখ দেখলে মনে হয় শত শত বছর, কিন্তু শরীর ভেঙ্গে পড়েনি। দেখলেই বুঝা যায় গায়ে শক্তি হবে আমার চাইতে বেশি। এইখানে একটা দীঘি আছে, যার নামে প্রচলিত কিছু লোককথার গল্প আছে। দীঘির পাশে ঘন দুর্গম জঙ্গল। জঙ্গলের অপর দিকে সীমান্তের পাহাড়। সেই দীঘির পাশে এক ভাঙ্গা কুঁড়ে ঘরে থাকত বলে জানা যায়। কেউ ওইদিকে যায় না, আবার গেলেও তারে দেখতে পেত না। লোকজন বলত সে নাকি বেশিরভাগ সময়েই জঙ্গলে থাকে। জঙ্গলের এক প্রাচীন আত্মার আরাধনা করে।
তবারক সাহেব বললেন, আপনি কি এইজন্যই তাকে খুঁজছেন? আপনার ধারণা সেই উপাসনা করে জঙ্গল থেকে নিয়ে এসেছে প্রাচীন এই দানবকে?
হরিচরণবাবু বললেন, অনেকটা সেরকমই। এছাড়া আমার সামনে আর কোন করার কিছু নেই স্যার। তাও আমি বিশ্বাস করিনি প্রথমে। কিন্তু নিজে যখন স্বচক্ষে দেখলাম দানবটাকে তখন আর অবিশ্বাস করতে পারছি না। অনেক কিছুই তো থাকে দুনিয়াতে স্যার। সব কিছু তো বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞানের এক মহাপুরুষ নিউটনেরও অকাল্ট নিয়ে লেখাপত্র ছিল।
তবারক সাহেব বললেন, ঠিক। সব কিছু এক ব্যাখ্যার মডেল দিয়ে বুঝা যায় না এই জটিল পৃথিবীতে।
সেই দিন সারা সন্ধ্যা জুড়ে থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলো। সঙ্গে হালকা বাতাস। রাতে খাবার পর তবারক সাহেব যখন বিছানায় গেলেন, তখন নেমে আসল মুষলধারে বৃষ্টি, তার সঙ্গে মেঘের গর্জন। এইরকম পরিবেশে এমনিতেই গা জুড়িয়ে আসে।
তবারক সাহেব ঘুমিয়ে গেলেন।
তাঁর ঘুম ভাঙ্গলো বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দে। এবং ঘুম ভাঙ্গার পরেই তবারক সাহেব বুঝতে পারলেন এখন তাঁর কাজ কী। তাঁর এখন বাইরে যেতে হবে।
বৃষ্টি ধরে এসেছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর মেঘ ডাকছে।
তবারক সাহেব খাট থেকে নামলেন, এবং ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন অন্ধকারে। বাতাস বইছে, সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।
তবারক সাহেব অন্ধকারে হাঁটতে লাগলেন। তিনি কোনদিকে যাচ্ছেন জানেন না। কিন্তু তাঁর ভেতর থেকে এই তাড়না আসছে, তিনি অনুভব করছেন এখন তাঁর যাওয়া উচিত। তাঁর জন্য কিছু একটা অপেক্ষায় আছে।
গ্রামের পথঘাট তাঁর চেনা না, তার উপর অন্ধকারে বৃষ্টিতে কাদাময় পথ। তবারক কোন কিছুকে আমলে নেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। তিনি হেঁটে চললেন।
বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে তিনি চলে এলেন একটা বাঁশ ঝাড়ের সামনে। বাঁশ ঝাড়টি অন্ধকারে এক অশরীরী প্রেতাত্মার রূপ ধারণ করে আছে যেন। অথবা, কোন প্রাচীন ভয়ানক অপদেবতার। বাতাসে বাঁশ ঝাড় নড়ছে, আর মনে হচ্ছে সেই প্রাচীন অপদেবতা তার শুঁড়গুলি বিস্তার করে ধেয়ে আসছে।
তবারক সাহেব বাঁশ ঝাড়টির নিচে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালেন।
হুড়মুড় করে কয়েকবার নড়ে উঠল বাঁশ ঝাড়।
বাতাসের সঙ্গে এক ফিস ফিস শব্দ তবারক সাহেবের কানে আসল।
খসখসে গলায় কোন প্রাচীন বৃদ্ধ বলছে, চলে যা, চলে যা এখান থেকে।
তবারক সাহেব নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রইলেন। যেন এক অবুঝ কৌতূহলী শিশু দেখছে একটি পাহাড়কে।
খসখসে গলাটি কয়েকবার বলল, চলে যা এখান থেকে।
তবারক সাহেব যখন নড়লেন না, তখন লাল লাল দুটি জ্বলন্ত চোখ দেখা গেল অন্ধকারে, বাঁশ ঝাড়ের উপরে।
তবারক সাহেব সেই চোখের দিকে তাকাতেই চোখদুটি সরে গেল, এবং কী একটা জন্তু যেন বাঁশ ঝাড় থেকে লাফিয়ে চলে গেল।
বাঁশ ঝাড় নীরব হলো।
।।৯।।
তবারক সাহেব বাঁশ ঝাড় থেকে ফিরে আবার হাঁটতে লাগলেন পথ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যাবার পর তিনি দেখতে পেলেন অপর দিক থেকে কেউ একজন আসছে, হাতে একটা টর্চ লাইট নিয়ে।
লোকটি গুণ গুণ করে গান গাইতে গাইতে এগিয়ে এল।
তবারক সাহেব দেখলেন ছাতা মাথায় অমূল্যবাবু।
অমূল্যবাবু তবারক সাহেবকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হলেন। তিনি বললেন, আরে ভাই আপনি এই রাতে, এইভাবে এখানে কী করেন?
তবারক সাহেব বললেন, হাঁটতে বের হলাম।
অমূল্যবাবু কিছুটা ভড়কালেন। এগিয়ে এসে ছাতা এগিয়ে দিতে চাইলেন।
তবারক সাহেব বললেন, ছাতা লাগবে না, ভিজতেই বের হলাম।
অমূল্যবাবু বললেন, আমি গিয়েছিলাম ডাক্তারের ওইখানে আড্ডায়। শেষ হতে হতে আজ বেশ সময় লাগল। এই পথ দিয়ে বাড়িতে ফিরছিলাম।
তবারক সাহেব বললেন, আচ্ছা অমূল্যবাবু, এইখানকার বাজারে কেরোসিন পাওয়া যাবে তো? অমূল্যবাবু বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই। ক্যান বলুন তো?
তবারক সাহেব বললেন, আমার লাগবে।
অমূল্যবাবু বললেন, তাহলে কাল আমি বাজার থেকে আপনার ওখানে দিয়ে আসব। আব্দুল আউয়ালরে বললেও কাজ হবে।
তবারক সাহেব বললেন, আমার এখন লাগবে।
অমূল্যবাবু বললেন, এখন কীভাবে সম্ভব, এত রাতে দোকান তো বন্ধ!
তবারক সাহেব বললেন, কিন্তু দোকান তো আছে। আপনি আমাকে দোকানে নিয়ে চলেন।
অমূল্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বন্ধ দোকানে গিয়ে কী করবেন?
তবারক সাহেব বললেন, আপনার কাজ নিয়ে যাওয়া। এডভেঞ্চার পছন্দ করেন না অমূল্যবাবু?
অমূল্যবাবু একটু ইতস্তত করলেন প্রথমে। তার পরে রাজি হলেন, কারণ তাঁর মনে হচ্ছিল এই তবারক সাহেব একটা অদ্ভুত লোক, তিনি না নিয়ে গেলেও সে একা একা যাবে। তাছাড়া তাঁর এক আগ্রহ হচ্ছিল দেখতে যে লোকটা কী করে।
অমূল্যবাবু তবারক সাহেবকে নিয়ে গ্রামের বাজারের একটা মুদি দোকানের সামনে গেলেন।
তবারক সাহেব দরজার সামনে গিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দরজার তালা খুলে ফেললেন।
ভেতরে ঢুকে একটা দশ লিটারের কেরোসিনের টিন বের করে আনলেন। সঙ্গে দেয়াশলাই।
অমূল্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করতে চান বলুন তো?
তবারক সাহেব বললেন, কথা না বলে দেখতে থাকেন।
কেরোসিনের টিন নিয়ে হন হন করে ছুটলেন তবারক সাহেব। অমূল্যবাবু ছাতা মাথায় তাঁর পিছু পিছু।
তারা পৌঁছালেন পরীর দীঘিতে।
তবারক সাহেব হেঁটে চলে গেলেন কুন্তল কবিরাজের কুঁড়েঘরের দিকে। খুবই ছোট, শীর্ণকায় এক কুঁড়েঘর। এক ধাক্কায় পড়ে যাবে এমন।
তবারক সাহেব পড়ে থাকা একটা গাছের ডাল তুলে নিয়ে কয়েকটা বাড়ি দিতেই ঘরখানা ভেঙ্গে পড়ল।
অমূল্যবাবু হইহই করে উঠলেন।
বললেন, কী করছেন ভাই! আপনি কুন্তল কবিরাজরে চিনেন না! খুব খারাপ হবে ভাই!
তবারক সাহেব কেরোসিন ঘরটাতে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলেন।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতেও আগুন দাউ দাউ করে উঠল।
অমূল্যবাবু বলতে থাকলেন, এটা কী করলেন! কুন্তল কবিরাজ ফিরে এসে যখন দেখবে তখন কী হবে!
তবারক সাহেব এবার হেঁটে চলে এলেন পরীর দীঘির ভাঙ্গা ঘাটে। তাঁর পিছু পিছু আসলেন অমূল্যবাবু। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে তবারক সাহেবের কর্মকাণ্ড দেখছিলেন।
তবারক সাহেব বললেন, কাদায় ভরে গেছি। একটু পরিষ্কার হয়ে নেই।
বলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পরীর দীঘিতে।
তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই রাতের অন্ধকারে কয়েকটা কাক তারস্বরে কা কা করে ডেকে উঠল জঙ্গল থেকে।
অমূল্যবাবু বাকরুদ্ধ হয়ে দেখে যাচ্ছেন।
তবারক সাহেব কিছুক্ষণ সাঁতরালেন দীঘিতে। তারপর ডুব দিলেন।
কিছুক্ষণ পর ভেসে উঠে একটা মাছ ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পাড়ে।
এইভাবে তিন বার তিনি ডুব দিলেন। তিন বারে তিনটা মাছ ধরে পাড়ে ফেলে দিলেন। অন্ধকারের কারণে দেখা গেল না কী মাছ।
তবারক সাহেব দীঘি থেকে উঠে আসার পর অমূল্যবাবু বললেন, আপনার তো ভাই ভয়ডর বলে কিছু নেই।
তবারক সাহেব অমূল্যবাবুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এবার আপনার অট্টহাসিটা একবার দিন তো। এই অন্ধকারে বেশ জমবে।
অমূল্যবাবু ঢোক গিললেন।
তবারক সাহেব বললেন, গলা শুকিয়ে গেল নাকি? ক্ষুধা, আজন্ম রক্তের ক্ষুধা?
অমূল্যবাবু মুখ শক্ত করে বললেন, ভাই মশকরা করেন?
তবারক সাহেব হেসে বললেন, হ্যাঁ, সামান্য করলাম। এখানে আপনার সঙ্গেই একটু খেলা যায়। বাকিরা তো কিছুই বুঝে না।
অমূল্যবাবু বললেন, আপনে ভাই মারাত্মক এক জিনিস, এটা কি করলেন, আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।
তবারক সাহেব হেঁটে চললেন বাড়ির দিকে। অমূল্যবাবু তাঁর পিছু পিছু।
এক পর্যায়ে অমূল্যবাবু কুঠিবাড়ির দিকে চলে গেলেন, আর তবারক সাহেব ঢুকলেন সাহেব বাড়িতে। শেষরাতের দিকে তাঁর এই প্রবেশ জানলা দিয়ে দেখল আব্দুল আউয়াল।
।।১০।।
পরদিন বেলা করে উঠলেন তবারক সাহেব। দিন ধরে এসেছে, রোদ উঠেছে।
পরীর দীঘির পাড়ের কুন্তল কবিরাজের ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে এই খবর জেনে গেছে গ্রামের লোকজন। একইসঙ্গে বাজারে একটা দোকানঘর তালা-ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া গেছে, এ নিয়েও হালকা চাঞ্চল্য।
চা খেতে খেতে তবারক সাহেব তাঁর লেখার খাতা নিয়ে বসেছিলেন কিছু লিখবেন বলে।
দেখলেন সেখানে কেউ একজন লিখে গেছে, বান্দির পোলা, তরে আমি খাইয়া ফেলব, জিন্দা যাইতে পারবি না।
একটা বড় হাই তুলে তবারক সাহেব পাতা উলটে তাঁর উপন্যাসটা লিখতে বসলেন।
কিন্তু কিছুতেই তাঁর কলম সরছে না। মাথার মধ্যে কোন শব্দই আসছে না। যেন তাঁর পুরো মাথা খালি, বাতাস-ভর্তি। একটা শব্দও নেই। প্রায় এক ঘণ্টা সাদা কাগজের উপর হাতে কলম নিয়ে তবারক সাহেব বসে রইলেন।
তাঁর ঘোর ভাঙল আব্দুল আউয়ালের কথায়।
আব্দুল আউয়াল এসে বলছে, স্যার এইটা আপনে কী করলেন, কুন্তল কবিরাজের ঘর জ্বালাইয়া দিছেন?
তবারক সাহেব তার দিকে তাকালেন। কিছু বললেন না।
আব্দুল আউয়াল বলল, স্যার আপনে চিনেন না কুন্তল কবিরাজরে। সে আসবই।
সেদিন সন্ধ্যায় আরেকটা লোক খুন হলো। ঘাড়ে কামড়ের দাগ, কেউ রক্ত খেয়ে নিয়েছে।
হরিচরণবাবু আসলেন তবারক সাহেবকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যেতে। তবারক সাহেব গেলেন না। তাঁর গা ম্যাজম্যাজ করছে। তিনি শুয়ে রইলেন।
হরিচরণবাবু এক পর্যায়ে কথায় কথায় বললেন, স্যার আপনি কাল রাতে যা যা করেছেন সেসব সম্পর্কে জেনেছি। এগুলিতে কি কোন কাজ হবে মনে করছেন?
তবারক সাহেব বললেন, দেখা যাক।
রাতে একবার উঠে গেলেন রান্না ঘরে, রতনকে গিয়ে বললেন চা দিতে। আব্দুল আউয়াল বাইরে গেছে।
তবারক সাহেব রান্না ঘর থেকে এসে দেখলেন তাঁর জন্য বসে অপেক্ষা করছেন অমূল্যবাবু। অমূল্যবাবু রাতেও কালো চশমা পরে আছেন। তাঁর মাথায় গোল কালো হ্যাট। তিনি যখন লাঠি হাতে, চোখে কালো চশমা, মাথায় কালো গোল হ্যাট আর বড় আলখাল্লা পরে হাঁটেন তখন তাঁকে বেশ অদ্ভুত লাগে। দেখেই মনে হয় এই লোকের মাথায় হয়ত সামান্য সমস্যা আছে, কারণ গ্রামে গঞ্জে এমন বেশভূষার লোক দেখা যায় না।
অমূল্যবাবুকে দেখে তবারক সাহেব খুশি হলেন মনে হলো।
তবারক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কখন এসেছেন অমূল্যবাবু?
অমূল্যবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, এই তো এলাম। আপনি কি খুনগুলোর ব্যাপারে শুনেছেন?
তবারক সাহেব বললেন, হ্যাঁ, সন্ধ্যায় একটা লোক মারা গেছে বললেন হরিচরণবাবু।
অমূল্যবাবু বললেন, একটু আগে আরেকজন গেছে। আমার সন্দেহই ঠিক ভাই, এইসব ভ্যাম্পায়ারের কাজ। আপনি একটু চেষ্টা করে দেখেন কিছু বের করতে পারেন কি না। এরা পারবে না।
ওইদিন রাতে তবারক সাহেব ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ঘুম ভাঙ্গল খসখসে একটা শব্দে। কেউ একজন হেঁটে আসছে।
তবারক সাহেব চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর মাথার উপরে ধারালো দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে কালো চশমা পরা আব্দুল আউয়াল। সে যখন কোপ মারলো তবারক সাহেব দ্রুত লাফিয়ে সরে গেলেন, এবং ক্ষিপ্রগতিতে তাকে ধরে ফেলে দা কেড়ে নিলেন।
আব্দুল আউয়াল তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তবারক সাহেব সরে গেলেন। দা হাত থেকে ফেলে দিয়ে আব্দুল আউয়ালকে একটা চড় মারলেন যে সে তিনহাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল।
আব্দুল আউয়াল ভাবেনি এই লোকটা গায়ে এত শক্তি রাখে, এবং এত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে হাত পা চালাতে পারে। চড় খেয়ে সে ভয় পেয়ে গেছে।
শব্দ শুনে রতন ঘুম থেকে উঠে এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে।
তবারক সাহেব তাঁর খাটে বসে আব্দুল আউয়ালের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন বাইরে যেতে। আব্দুল আউয়াল পা টেনে টেনে, গাল হাতাতে হাতাতে বেরিয়ে গেল। রতনও সরে গেল।
তবারক সাহেব কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তাঁর মাথা তখনো ফাঁকা। বাইরে সামান্য চাঁদের আলোতে গাছের পাতা বাতাসে নড়ছে দেখা যাচ্ছে। সেদিকে দেখতে দেখতে তিনি শুয়ে পড়লেন।
।।১১।।
পরদিন সকালে ঝকঝকে রোদ উঠল। এবং পাওয়া গেল আব্দুল আউয়ালের মৃতদেহ।
সাহেব বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, ঘাড়ে কামড়ের দাগ, রক্তশূন্য চেহারা।
গ্রামের চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। থানা সদর থেকে পুলিশ এসেছে। তবারক সাহেব ঘুমিয়ে ছিলেন।
রতন হরিচরণবাবুর কাছে গিয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে কাল রাতে তবারক সাহেবের সঙ্গে আব্দুল আউয়ালের ঝগড়া হয়েছিল। আব্দুল আউয়াল মারতে গিয়েছিল তবারক সাহেবকে কারণ তিনি কুন্তল কবিরাজের ঘর পুড়িয়ে দিয়েছেন।
থানা সদর থেকে আসা বড় অফিসার তবারক সাহেবকে ডেকে আনতে লোক পাঠিয়েছেন। গ্রামের লোকজনদের নিয়ে একটা মিটিং হচ্ছে আজ।
তবারক সাহেবকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো।
থানা অফিসের কাছের মাঠেই সবাই জড়ো হয়েছে। আকাশে দুপুরের জ্বলন্ত সূর্য। বিশাল একটি ছাতা দেখে তবারক সাহেবের বুঝতে দেরি হলো না অমূল্যবাবুও আছেন সেখানে।
কেউ কিছু বুঝার আগেই আচমকা এক দৌড় দিলেন তবারক সাহেব। দৌড়ে গিয়ে হ্যাঁচকা টানে অমূল্যবাবুর ছাতা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
উপস্থিত সবাই দেখল একটি অত্যাশ্চর্য ঘটনা। যা কখনো কেউ কল্পনাও করেনি। সূর্যের প্রচণ্ড আলোতে অমূল্যবাবুর শরীরে আগুন ধরে গেল। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল।
অমূল্যবাবু লাফিয়ে পড়লেন তবারক সাহেবের উপরে। তবারক সাহেব শূন্যে ঘুরে গেলেন, ও বাতাসে ভর করে একটা লাথি মারলেন অমূল্যবাবুর মাথা বরাবর।
অমূল্যবাবুর লাথি খেয়ে পড়ে গেলেন।
তাঁর চোখের কালো চশমা ভেঙ্গে গেল। দেখা গেল তাঁর লাল জ্বলন্ত দুই চোখ। আগুন যেন ঠিকরে বের হচ্ছে কোটর থেকে।
অমানুষিক জান্তব চিৎকার করতে লাগলেন অমূল্যবাবু।
তিনি বুঝতে পারলেন তবারক সাহেবের সঙ্গে পারবেন না।
গায়ে দাউ দাউ আগুন নিয়ে অমূল্যবাবু দৌড়াতে লাগলেন। মানুষেরা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে লাগল দৌড়ে তিনি জঙ্গলের দিকে চলে যাচ্ছেন। ধাতস্থ হবার পর হরিচরণবাবু, ডাক্তার এবং অন্য অনেকে ছুটলেন তাঁর পিছু পিছু।
তাঁকে ধরা গেল না। জংগলে বেশি গভীরে যাবার সুযোগ নেই, দুর্গম। যতটুকু যাওয়া যায় এর মধ্যে খোঁজাখুঁজি করেও কিছু মিলল না। অবশ্য আগুনে তিনি প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছেন বলে মনে হলো। হয়ত ছাই হয়ে গেছেন।
তবারক সাহেব কথা কম বলেন। হরিচরণবাবু ও অন্য সবার কৌতূহল নিবৃত্ত করতে তবারক সাহেব পরে এইটুকু বলেছিলেন, এই লোক সুন্দরবনে কাজ করার সময় এক ভয়ংকর বাদুড়ের কামড়ে মারা যান। এরপর ভ্যাম্প্যায়ার হয়ে এখানে ফিরে এসেছিলেন।
ওইদিনই তিনি হালিয়ার চড় ছাড়েন। গ্রাম ছাড়ার আগে হরিচরণবাবুকে বলে যান, গ্রামের সব আমি ঠিক করে গেলাম। দীঘিতে আর কোন সমস্যা নেই। শুধু ওই বনের গভীরে কাউকে যেতে দিবেন না। ওটা যেমন আছে তেমন থাক।