—আমি কী করেছি?
—কিছুই না।
—তাহলে আপনি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছেন কেন?
—আমি তো কিছুই করি নি।
—করেন নি? আপনি আমাকে ফেবুতে আনফ্রেন্ড করেন নি?
—কে আমার বন্ধু থাকবে সেতো আমার অভিরুচি। নয় কি?
সকাল থেকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে এই লোকটির মেসেজ আসছে প্রান্তিকের কাছে। কী কুক্ষণে যে এর বন্ধুতা-অনুরোধ গ্রহণ করেছিল প্রান্তিক! তারপর থেকে যখনই প্রান্তিক কোনো কিছু ফেবুতে পোস্ট করে, এই লোকটি এঁড়ে তর্ক শুরু করে।
ঘটনাটি এইভাবে শুরু হয়: প্রান্তিকের নতুন ধরনের রান্না পোস্ট করার শখ আছে। সেদিন স্ট্রবেরি দিয়ে পাঁঠার ঝোল এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। পাকা লাল টুকটুকে স্ট্রবেরি পিউরি করে নিয়ে একটু দারচিনি গুঁড়ো দিয়ে টক-মিষ্টি রান্নাটি উতরে গিয়েছিল ভালোই! সেই ডিশের ছবি পোস্ট করার পরই এই লোকটি আলটপকা মন্তব্য করল, এ মা! এ ডিশ কোন ভদ্রলোকে খায় না কি?
ফেবুতে ভদ্রলোকের নাম দেখাচ্ছে হোঁদল দত্তগুপ্ত।
প্রান্তিক উত্তরে লিখল, আপনার ইচ্ছে না-হলে খাবেন না।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দেড় গজ লম্বা উত্তর এল, আমি কেন, কেউই খাবে না! আপনি কি জানেন স্ট্রবেরি আদতে একটি বিষাক্ত ফল? বহুদিন ডোমেস্টিকেট করার পর এটি এখন লোকেরা খায়। এই ফলের সঙ্গে অ্যানিম্যাল প্রোটিন মিশলে, ফলটির সেই বিষাক্ত রূপটি আবার ফিরে আসতে পারে। সেটি টক্সিক হয়ে যেতে পারে। এমনকি মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
প্রান্তিক লিখল, আমি খেয়েছি, আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। আপনি কি জানেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে ফল দিয়ে মাংস রান্নার কত রেসিপি আছে! আম, আনারস, কমলালেবু!
—আপনি আদৌ খান নি। আপনি ঢপ দিচ্ছেন। এধরনের রেসিপি পোস্ট করা ক্রিমিনাল অফেন্স! মাংসের সঙ্গে কোন ফলই মেশানো উচিত না! এই যেমন ধরুন, আভোকাডো, লিচু, চেরি বা আঙুর! আভোকাডোয় পার্সিন বলে একটি টক্সিন আছে, লিচু আর চেরি ফলের বীজে সায়ানাইড আছে, আঙুর খেলে কুকুরদের কিডনি ফেল করে!
প্রান্তিক— কী আপদ! আমার রেসিপি সারমেয়দের জন্য আপনি ধরে নিলেন কেন!
হোঁদল— কারণ মানুষ এই রান্না খাবে বলে মনে হয় না!
এরপরই রেগেমেগে প্রান্তিক ভাবে, এনাফ ইজ এনাফ! তারপরই আনফ্রেন্ড বোতাম টিপে দেয়।
সেই সঙ্গে প্রান্তিক ফেসবুক মেসেঞ্জারের ব্লক বোতামটিও টিপে দিল। দেখা যাক এবার কী করে হোঁদলবাবু প্রান্তিককে খুঁজে পায়!
বিদায় হোঁদলবাবু, বিদায়!
সাত দিন নিশ্চিন্তে কাটল।
প্রান্তিক একটি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট সংস্থায় কাজ করে। সদাগরি অফিস। কাজের চাপ আছে। সংস্থার খদ্দেরদের বোঝাতে হয় সফটওয়্যার কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। অনেক খদ্দেরই গাঁট। একই কথা বোঝাতে জীবন জেরবার হয়ে যায়। সোমবার একজন নতুন খদ্দেরকে কোম্পানি প্রান্তিকের জন্য বরাদ্দ করল। খদ্দেররটি বেলা দুটোয় ফোন করবে। কোম্পানির ইনফিনিটি সফটওয়্যারটির ব্যবহার প্রান্তিককে বোঝাতে হবে জ়ুমে। ক্লায়েন্টের নাম মিল্টন হিল্টন। নামটা একটু অদ্ভুত!
ঠিক বেলা দুটোয় জ়ুম বেজে উঠল কম্পিউটারে। মিল্টন হিল্টন কলিং। প্রান্তিক গ্রহণ করল কলটি। একটি গোলাকৃতি স্বল্পকেশ মুখ ভেসে উঠল।
—নমস্কার প্রান্তিকবাবু! চিনতে পারছেন?
—কে আপনি?
—আমি হোঁদল দত্তগুপ্ত!
প্রান্তিকের শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটি ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল।
—আপনি! আপনি আমাদের ক্লায়েন্ট!
—অবশ্যই! আপনার কোন আপত্তি আছে?
—না, মানে আপনাকে আমি এক্সপেক্ট করিনি।
—এখন করুন। আপনাদের ইনফিনিটি সফটওয়্যারটি আমি কিনেছি। আমি ওটি খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারি। সুতরাং এর জন্য আপনার কোন সাহায্য আমার লাগবে না।
—তবে আপনি আমাকে আপনার অ্যাডভাইসর হিসেবে চাইছেন কেন?
—কারণ আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।
—কী?
—আপনি আমাকে আনফ্রেন্ড করলেন কেন?
প্রান্তিক আর ধৈর্য রাখতে পারল না। একটু গলাটাকে চড়িয়েই বলল, আপনি আমার কাছ থেকে কী চান বলুন তো?
—কিছুই না! আপনাকে আমি আবার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাচ্ছি। সেটি গ্রহণ করুন, সব মিটে যায়।
—কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না! কেন জোর জবরদস্তি করছেন?
—কেন কথা বলতে ভালো লাগছে না? আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করি বলে?
—হ্যাঁ, আপনি বড় এঁড়ে তর্ক করেন! ফেবুতে আমি যাই রিল্যাক্স করার জন্য। তর্ক করতে নয়!
হোঁদল বলল, আপনি অমর্ত্য সেনের দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান বইটি পড়েছেন?
—না।
—পড়ুন। আমরা ভারতীয়রা তর্ক করতে ভালবাসি। আপনি তর্ক না করলে আপনি ভারতীয়ই নয়। আপনি অ্যান্টিন্যাশনাল!
প্রান্তিক আর থাকতে পারল না!
—ক্যান ইউ জাস্ট লীভ মি অ্যালোন?
—ইয়েস, অফকোর্স! যদি আপনি আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটিকে গ্রহণ করেন।
প্রান্তিক এবার মরিয়া হয়ে একটি ডাহা মিথ্যে কথা বলল, শুনুন হোঁদলবাবু, আমার একটি গার্লফ্রেন্ড আছে। আমরা এনগেজড।
—আরে না না! আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আমারও বাড়িতে বউ, দুটি বাচ্চা আছে। তবে আমাকে আপনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না!
—কী করবেন যদি করি?
—শুনুন! আমি তাহলে আপনার কোম্পানির বসকে অভিযোগ করব যে আপনি আমাকে আপনাদের সফটওয়্যারটি ব্যবহার করতে সাহায্য করছেন না। এটি তো আপনার কাজের মধ্যে পড়ে, তাই না?
প্রান্তিকের মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। বসা গলায় বলল, ঠিক আছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান!
—থ্যাঙ্ক ইউ!
প্রান্তিক বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই যার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবে। কোন সহকর্মীর কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ নেবে? নাঃ! এটি ওর নিজের সমস্যা। কাজের ক্ষেত্রে এইসব ব্যক্তিগত সমস্যা আনা উচিত নয়। এমনিতেই অফিসের পরিস্থিতি ভালো নয়। ডাউনসাইজিং চলছে।
আচ্ছা, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে ওকে আনফলো করলে কী রকম হয়! তাতেও সমস্যা যাবে না। ফেসবুকে প্রান্তিকের যেকোন পোস্টে হোঁদল মন্তব্য করতেই পারে! সন্ধ্যের দিকে ফেবুর পাতায় হোঁদলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট ভেসে উঠল। দোনোমোনো করে প্রান্তিক গ্রহণ বোতামটি টিপেই দিল। সকালে বড় ধকল গেছে। রাত দশটার মধ্যেই প্রান্তিক ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে উঠেই প্রথম চিন্তা এল এরপর ফেবু অ্যাকাউন্টটিকে কি বাতিল করে দেবে? সেটি করে তো হোঁদলের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না! ফেবু কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবে? সেটি করলে কাজ হতে পারে অবশ্য। তবে হোঁদল তো ওর বসের কাছে তখনই অভিযোগ করে বসবে! তাহলেই তো ওর চাকরি নট! এ কী গেরো রে বাবা! বেয়াড়া লোকটির জন্য প্রান্তিকের রাতের ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড়!
অনেক ভেবে দেখল, সবচেয়ে ভালো হয় যদি প্রান্তিক আর কোন নতুন কিছু পোস্টই না করে ফেবুতে। কোন পোস্ট না করলে হোঁদলও কোন মন্তব্য করবে না! সমস্যার সমাধান!
তাই ঠিক করল প্রান্তিক। ফেবুতে প্রান্তিককে সাতশো জন ফলো করে। তাদের জন্য একটু দুঃখ হল। তিন দিনের মধ্যে কুড়িটি মেসেজ এল ফলোয়ারদের কাছ থেকে মেসেঞ্জারে: কী হল প্রান্তিক? ভালো আছো তো! কোন পোস্ট নেই কেন?
এদের তো আর বলা যায় না পোস্ট না করার কারণ।
খানিকটা অনুরাগীদের চাপেই কিছুদিন বাদে আবার একটি নতুন রান্নার পোস্ট করল প্রান্তিক। উচ্ছে ইলিশের হালকা ঝোল। উচ্ছেগুলো আগের দিন রাতে লম্বা ফালি করে কেটে নুন জলে ভিজিয়ে রাখল, একটু চুন দিয়ে। পরের দিন, সেগুলো ভালো করে ধুয়ে নিয়ে ছাঁকা তেলে ভেজে, ইলিশ মাছের সঙ্গে সর্ষে-পোস্তবাটা ভাপে বসিয়ে দিল চুলোয়। কটা কাঁচা লঙ্কা চিরে ওপরে দিয়ে, এক ফোঁটা কাঁচা সর্ষের তেলও ছড়িয়ে দিল। প্রচুর লাইক, কমেন্ট, করতালি পড়ল ফেবুতে। খানিক পরেই হোঁদলের মন্তব্য ভেসে উঠল।
—এটি একটি বোকা রেসিপি প্রান্তিক! ইলিশ আর উচ্ছে, দুটিরই অপচয়!
প্রান্তিক এর কোন জবাব দিল না। একজন ফেবু বন্ধু প্রান্তিকের রেসিপিটি ডিফেন্ড করল— এটি একটি খুবই অভিনব রেসিপি! প্রান্তিক তাতেও চুপচাপ থাকল।
দু সপ্তাহ বাদে সকালে ঘুম ভাঙল প্রান্তিকের মেসেঞ্জারে একটি ক্রিং করে আওয়াজ শুনে! হোঁদলের মেসেজ।
—কী হল প্রান্তিকবাবু? আমার মন্তব্যের কোন জবাব দিচ্ছেন না কেন? আমাকে আবার অগ্রাহ্য করছেন!
এভাবে তো দিন চলতে পারে না। একজন লোকের এতখানি ক্ষমতা কী করে হতে পারে যে তার অঙ্গুলিহেলনে প্রান্তিককে উঠতে বসতে হবে! প্রান্তিকের হঠাৎ মনে হল, এই হোঁদল সম্বন্ধে সে তো কিছুই জানে না। এর সম্বন্ধে একটু তদন্ত করে দেখলে কেমন হয়? ফেসবুক প্রোফাইলে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না! কোন পোস্টই করে না নাকি? তাহলে কী ভাবে এগোনো যায়! আচ্ছা, একজন গোয়েন্দা নিযুক্ত করলে কেমন হয়? আনন্দবাজারের বিজ্ঞাপন কলমে সেদিনই একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের সন্ধান পেল প্রান্তিক। নাম সোমেন্দ্র রায়। ফোন করে সমস্যাটি খুলে বলার সঙ্গে সঙ্গে সোমেন্দ্র বলল, আমি দেখছি। তিন দিন বাদে আপনাকে জানাব।
তিন দিন বাদে সন্ধে বেলা সোমেন রায়ের ফোন এল।
– শুনুন প্রান্তিকবাবু, এই লোকটির আসল নাম হোঁদল দত্তগুপ্ত নয়। ফেবুর পাতায় এর প্রোফাইল লকড আছে।
প্রান্তিক বলল, আমি যেহেতু ওর ফেবুফ্রেন্ড আমি ওর প্রোফাইল পুরো দেখতে পাই। কিছুই লেখা নেই সেখানে।
সোমেন বললেন, সেটা আমি জানি। আমার টিম হোঁদলকে নিয়ে অনেক তদন্ত করেছে। হোঁদল কোনো আমজনতা নয়। সে একজন নামকরা অর্থনীতিবিদ। পণ্ডিত লোক। অধ্যাপনা করেন লাটাই ইউনিভার্সিটিতে। নাম যুধিষ্ঠির মিত্র। ফেবুতে ওর ডজন খানেক ফেক একাউন্টস আছে। ওর শখ হল ফেবুতে লোকজনকে ট্রোল করা।
—ট্রোল!
—ট্রোল জানেন না? ট্রোলাররা ফেবুতে আপনার মতো নিরীহ মুরগি খোঁজে। তারপর অকারণে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করে। এই হোঁদলগিরিতেই তাদের আনন্দ। তাইতো ফেবুতে নাম রেখেছেন হোঁদল।
‘কিন্তু কেন তিনি এরকম করবেন? কী লাভ লোকেদের উত্যক্ত করে? আমি তো ওঁর কোন পাকা ধানে মই দিইনি!’ প্রান্তিক জিজ্ঞেস করল।
—এর উত্তর আমার জানা নেই প্রান্তিকবাবু। অনেক কারণ হতে পারে। একটি সহজ কারণ হয়তো ওর গিন্নি ওর সঙ্গে প্রতিদিন খ্যাঁচখ্যাঁচ করেন। এর থেকে জটিল কারণও থাকতে পারে। উনি অনেক জার্নালে অর্থনীতি নিয়ে প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে পিয়ার রিভিউ বলে একটি ব্যাপার আছে। এই রিভিউয়াররা, যাঁদের নাম জার্নালের সম্পাদক গোপন রাখেন, লেখাগুলি যাচাই করে তাঁদের অভিমত দেন। হয়তো কেউ খারাপ রিভিউ দিয়েছে। আপনার রান্নার রেসিপির উপর সেই ঝালটা উগরে দিচ্ছেন। কে জানে মশাই! কতরকম পাগল আছে এই দুনিয়ায়।
তাজ্জব হয়ে গেল প্রান্তিক। ‘ধন্যবাদ সোমেনবাবু! আপনি যে আমার কী উপকার করলেন! আপনার বিলটা কালকে আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। নমস্কার।’
—অবশ্যই। ভালো থাকবেন।
প্রান্তিক এরপর গুগুলে টাইপ করল যুধিষ্ঠির মিত্র, লাটাই ইউনিভার্সিটি, কলকাতা। একটি প্রোফাইল ভেসে উঠল। সেই স্বল্পকেশ গোলমুখ যার সঙ্গে প্রান্তিক কয়েক সপ্তাহ আগে জ়ুমে কথা বলেছে। যুধিষ্ঠির একজন নামী চেয়ার প্রফেসর, শ দেড়েক পাবলিকেশন অর্থনীতির নানা বিষয়ে।
এক সপ্তাহ ফেবুতে কোনো কিছু পোস্ট করল না প্রান্তিক। বুধবার সকালে মেসেঞ্জারে আবার সেই ক্লিক, প্রান্তিক আপনার কোনো পোস্ট দেখছি না কেন?
প্রান্তিক এক মিনিট বাদে এক লাইন লিখল, যুধিষ্ঠিরবাবু, কী আর লিখব বলুন! আপনি তো পণ্ডিত লোক! সবই তো আপনার জানা।
মেসেঞ্জারের ওপারে পিন-পতন স্তব্ধতা। প্রান্তিক মেসেঞ্জার বন্ধ করে তড়িঘড়ি ফেবুর পাতা খুলল হোঁদলকে অবন্ধু করবে বলে। কিন্তু কোথায় হোঁদল? ওর নামই তো আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!