জানুয়ারির কলিকাতা। প্রত্যহকার মতন আমি ও ব্যোমকেশ হ্যারিসন রোডের বাসার বৈঠকখানার ঘরে আলোয়ান জড়াইয়া বসিয়া একখানি খবরের কাগজ ভাগাভাগি করিয়া পড়িতেছি। খোলা জানালা দিয়া তেরচা রোদ পিঠে পড়িয়া আলস্যজনিত ওম সৃষ্টি করিয়াছে। নীচে কলিকাতা শহর জাগিয়া উঠিয়াছে। একটি কাক জানালার পাল্লায় বসিয়া ঘাড় বেঁকাইয়া তাহা জরিপ করিতেছে। দীর্ঘ ময়াল সাপের মতন পড়িয়া থাকা হ্যারিসন রোড যানবাহন ও মনুষ্যে কোলাহলমুখর। ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিলাম সকাল সাড়ে নয় বাজে। ঠান্ডাও যেন আজ একটু বেশিমাত্রায় পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল, "আরেকবার চা খাওয়া যাক? যা ঠান্ডা পড়েছে।" ব্যোমকেশের ইঙ্গিত পাইয়া পুঁটিরামকে দু পেয়ালা চায়ের হুকুম করিলাম। "এখানেই এই। বিহারে তো হাড় অব্দি কালিয়ে দিচ্ছে। আজকের কাগজে আছে, পূর্ণিয়া অঞ্চলে নাকি শৈত্যপ্রবাহ চলছে। যাবে নাকি?" আমার প্রশ্নের পিছনে একটি খোঁচা ছিল। সুকুমার সত্যবতী ও খোকাকে লইয়া বিহারে হাওয়াবদলের জন্যে গিয়াছে। আমাদেরও যাইবার কথা ছিল। কিন্তু রওয়ানা হইবার ঠিক পূর্বে পুলিশ কমিশনার সাহেব ব্যোমকেশের স্কন্ধে একটি গুরুদায়িত্ব চাপাইয়া দিয়া ভ্রমণের দফা রফা করিয়া দিলেন। এর পূর্বে চিত্রচোর ও বহ্নিপতঙ্গের সময়ে শীতের বিহারের ঠান্ডা আমি যথেষ্ট খাইয়াছি। আর খাইবার ইচ্ছা ছিল না। এই সুযোগে আমিও ব্যোমকেশের ছুতো ধরিয়া পশ্চাদপসরণ করিলাম। ব্যোমকেশ একা কলিকাতায় পড়িয়া থাকিবে ইহা সত্যবতীর পছন্দ হয় নাই। তাই সে সহজে রাজী হইয়া গেলেও বিলক্ষণ চটিয়া কমিশনার ও ব্যোমকেশের মুণ্ডপাত করিতে করিতে সুকুমারের সহিত বিহারযাত্রা করিয়াছে। তাহার পরে মাসাধিককাল কাটিয়া গিয়াছে। গত পরশু চিঠি আসিয়াছে। উহারা আগামীকাল সকালের গাড়িতে ফিরিবে। ব্যোমকেশের সরকারী কাজ শেষ হয় নাই, অতি শ্লথ গতিতে চলিতেছে। নেহাত কমিশনার সাহেবের হুকুম, তাই ব্যোমকেশ যতই বিরক্ত হউক, কাজ ছাড়িয়ে চলিয়া যাইতেও পারে নাই। উপস্থিত অবশ্য তাহার প্রয়োজনও নাই।
পুঁটিরাম দু পেয়ালা ধূমায়িত চা রাখিয়া গেল। পেয়ালা হাতে তুলিয়া চুমুক দিবার পূর্বেই সদর দরজায় করাঘাত শুনিলাম। দরজা খুলিয়া দেখি বছর পঁয়ত্রিশের এক ব্যক্তি। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি, রেশমের পাঞ্জাবী, গায়ে কারুকার্য করা পশমের শাল। দেখিলে ধনী বলিয়া সন্দেহ থাকে না। নমস্কার করিবার জন্যে যখন দুই হাত তুলিলেন একটি হীরার আংটি জ্বলজ্বল করিয়া উঠিল। "ব্যোমকেশবাবু আছেন?" আমি তাঁহাকে ঘরে প্রবেশ করিতে অনুরোধ করিলাম। ভদ্রলোক আসিলেন। ব্যোমকেশকে হাত তুলিয়া নমস্কার করিলেন। আবার হীরার চমক দেখিলাম। ব্যোমকেশ প্রতিনমস্কার করিয়া বসিতে বলিল। ভদ্রলোক আসন গ্রহণ করিতে করিতে বলিলেন, "আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করলাম ব্যোমকেশবাবু। কিছু মনে করবেন না। ভীষণ বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে আসছি। আপনার আমাকে সাহায্য করতেই হবে।" ব্যোমকেশ ভদ্রলোককে আশ্বস্ত করিয়া বলিল, "আপনি আগে বসুন। চা খান।" এই বলিয়া নিজের জন্য বরাদ্দ চায়ের পেয়ালাটি আগাইয়া দিল। আমি পুঁটিরামকে আর এক পেয়ালা চায়ের ফরমাইশ করিয়া আসিলাম। ভদ্রলোক অনেকগুলি চুমুকে প্রায় অর্ধকাপ চা গলাধঃকরণ করিলেন। কিছুটা আত্মস্থ হইয়াই বলিলেন, "ব্যোমকেশবাবু, আমার মামা মারা গেছেন। মারা গেছেন মানে খুন হয়েছেন।" ব্যোমকেশ ভদ্রলোকের অবস্থা দেখিয়া বলিল, "আপনি সুস্থ হয়ে বসে সব খুলে বলুন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই।" আমি আর ব্যোমকেশ উৎসুক হইয়া চাহিয়া রইলাম। ভদ্রলোক একটি লম্বা চুমুক দিয়া বলিতে শুরু করিলেন।
"আমার নাম ভবেশ মিত্র। জোড়াবাগানের মিত্রদের নাম শুনে থাকবেন। আমরা ওই বংশের ছেলে। উপস্থিত আমি পরিবার নিয়ে বিডন স্ট্রিটে থাকি। সেখানে আমার পৈতৃক বাড়ি, মানে শরিকি ভাগাভাগিতে পাওয়া বাড়ি আছে। আমি আর আমার স্ত্রী থাকি। বাবা-মা জোড়াবাগানের বাড়িতেই থাকতেন। দুজনেই গত হয়েছেন।" ভবেশবাবু আবার থামিলেন। কী যেন ভাবিয়া, আবার বলিতে শুরু করিলেন, "আসলে আমার বিয়েটা আমার বাড়ির লোক মেনে নেননি।"
- নিজে পছন্দের বিয়ে? ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল।
- হ্যাঁ, নিজে পছন্দের বিয়ে। তার ওপর আমাদের ঘরও পাল্টি নয়। আমার বাবাই বিয়ের পরে আমাদের বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছিলেন। সেই থেকে সেখানেই আছি। বাবা মারা গেছেন আজ প্রায় সাত বছর হল। আমার মা মারা যান তিন বছর আগে।
- আপনার বাবা মারা যাবার পরে আপনার মা জোড়াবাগানের বাড়িতেই থাকতেন?
- হ্যাঁ। আমার মা শেষদিন অব্দি আমার স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপ করেননি।
- তার মানে আপনার বাড়িতে শুধু আপনি আর আপনার স্ত্রী থাকেন?
- একজন ঝি আছে। আর থাকেন মামাবাবু। থাকেন মানে থাকতেন। আমার মামা, শ্রী শিবকালী দত্ত। আমার দাদুর প্রচুর সম্পত্তি, জমিজিরেত আছে দিনাজপুরে। একমাত্র ছেলে হিসেবে দাদুর সব সম্পত্তির ভাগীদার মামাবাবু। কিন্তু সেসবে মামাবাবুর আগ্রহ নেই। এক এক করে সব সম্পত্তি উনি বিক্রি করে দিচ্ছেন। আসলে যৌবনে বিলেত গিয়েছিলেন বিজ্ঞান পড়তে। বিলেত থেকে বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এলেন বটে, তবে তার সঙ্গে নিয়ে এলেন ছবি তোলার শখ। বিজ্ঞান ছেড়ে সেই শখটাই নেশা হয়ে দাঁড়াল। আমার দাদুর দার্জিলিং শহরে একটা বাড়ি আছে। মামাবাবু বছরের অনেকটা সময় সেখানেই কাটান আর পাহাড়ে পাহাড়ে ছবি তুলে বেড়ান। আর শীতকালটা কাটান জামতাড়াতে।
- জামতাড়া?
- দার্জিলিং ছাড়া আমার মামার আরও কয়েকটি বাড়ির একটি ছিল জামতাড়াতে। জামতাড়া ঠিক নয়, সেখান থেকে মাইল কয়েক এগিয়ে। জামতাড়া আর বেনা বলে একটা জায়গার মাঝামাঝি। আমার দাদু বাড়ি করেছিলেন। মামাবাবু ফিবছর শীতটা ওখানেই কাটান। তাছাড়া যে সময় দার্জিলিং বা জামতাড়াতে থাকেন না, সে সময়ের অনেকটাই কলকাতায় আমাদের কাছে থাকেন। একা মানুষ। বিয়ে-থা করেন নি। দিনাজপুরে থাকতে পারেন না। তার ওপর আজকাল সম্পত্তির বিলিব্যবস্থা করতে উকিলবাড়ি যাতায়াত করতে হয় বলেও অনেকটা সময় কলকাতায় থাকতেই হয়। তা ছাড়া ছবি তোলার কাগজপত্র, কেমিক্যাল এসব কলকাতায় পাওয়ার সুবিধে। আমাদের বিডন স্ট্রিটের চিলেকোঠার ঘরটাকে উনি ওঁর স্টুডিও করেছিলেন। সারাদিন সেখানেই কাটাতেন।
এই বলিয়া ভবেশবাবু চুপ করিলেন। উপস্থিত উত্তেজনার বশে কিঞ্চিৎ ত্বরা থাকিলেও ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গীটি চিত্তাকর্ষক। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, "আপনার মামা তাহলে আপনাদের বিয়ে মেনে নিয়েছিলেন?" ভবেশবাবু বলিলেন, "মামাবাবু এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। নিজের মনে থাকতেন।"
- আপনি কী করেন?
- আমার ব্যবসা আছে কাঠ সাপ্লাইয়ের। আমি রেলকে স্লিপারের কাঠ সাপ্লাই দিই। নিমতলায় গঙ্গার ধারে আমার কাঠগোলা।
পুঁটিরাম ব্যোমকেশকে আর এক পেয়ালা চা দিয়া গেল। ব্যোমকেশ একটি আয়েসি চুমুক দিয়া বলিল, "এইবার ঘটনাটা বলুন।" ভবেশবাবু একটু ভাবিয়া শুরু করিলেন, "শনিবার, মানে গেল-পরশু, আমাদের জামতাড়া যাবার কথা ছিল চেঞ্জে। আমাদের মানে আমি, আমার স্ত্রী আর মামাবাবু। সঙ্গে ঝিও। শনিবার রাতের ট্রেন ধরে রবিবার সকালে জামতাড়ায় পৌঁছনো। শনিবারই খবর পেলাম রেলে একটা টেন্ডার খুলেছে। আমি রেবা আর মামাবাবুকে বললাম চলে যেতে। সোমবার সকাল-সকাল টেন্ডার জমা দিয়ে আমি চলে যাব। সেইমত আমি ওদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এলাম। রোববার সারাদিন টেন্ডারের কাজ করেছি। আজ রেলের আপিস খুললেই টেন্ডার জমা দিয়ে দুপুরের গাড়ি ধরে চলে যাব, এই পরিকল্পনা। আজ সকালে জামতাড়া থেকে একটি লোক এসে খবর দিল মামাবাবু কাল রাতে আমাদের বাড়িতে খুন হয়েছেন। রেবা খবর পাঠিয়েছে।
- জামতাড়াতে?
- হ্যাঁ, জামতাড়ার বাড়িতে।
- এই লোকটিকে আপনি চিনতেন?
- না ব্যোমকেশবাবু। অপরিচিত লোক। বললেন, জামতাড়ায় থাকেন। কলকাতায় আসছিলেন। আমি খবরটা পেয়ে এতই হতভম্ব হয়ে গেছিলাম যে আর কিছু জিগেস করিনি। একটু ধাতস্থ হতেই আপনার কাছে ছুটে এলাম। ব্যোমকেশ ইহার উত্তরে কিছু না বলিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। আগেও লক্ষ্য করিয়াছি ব্যোমকেশ এরূপ অবস্থায় নীরব হইয়া অপর ব্যক্তিকে স্বঃপ্রণোদিত বচনের সুযোগ দিয়া থাকে। তাহার মতে বক্তাকে নিজের মত বলিতে দিলে অনেক সময় এমন তথ্য তাহারা উন্মুক্ত করিয়া দেয় যাহা অন্যথায় প্রশ্নোত্তরে বাহির হইয়া আসে না। আর সেই তথ্য অনেকসময়ই তদন্তের কাজে মহামূল্যবান হইয়া উঠে। তাছাড়া অনেকেই নীরবতা বেশিক্ষণ সহ্য করিতে পারে না। নীরবতার গহ্বর বুজাইতে এমন সব কথা তাহারা বলিয়া ফেলে অন্যথায় তাহারা সে কথা বলিত না।
কিয়ৎক্ষণ পরে ভবেশবাবু বলিলেন, "যা শুনলাম, আপনাকে তাইই বলছি ব্যোমকেশবাবু। সত্যাসত্য বিচারের ভার আপনার। রবিবার সকালে ব্যবস্থামতন মামাবাবু আর রেবা বেনায় পৌঁছে যান। রাতের দিকে ঝি এসে খবর দেয় কে একজন নাকি মামাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। মামাবাবুর বাড়ির বৈঠকখানার ঘরে গিয়ে কথা বলছিলেন। অনেকক্ষণ পরে রেবা বৈঠকখানার ঘরে গিয়ে দেখে মামাবাবু বুকে ছোরা ঢোকান। রেবা ঝি আর মালিকে লোকজন ডাকতে বলে। অত রাতে ওখানে আর লোকজন কোথায় বলুন? মালি হেঁটে এসে থানায় খবর দেয়। ভাগ্যে রেবা একটা হাতচিঠি করে দিয়েছিল। মালিই স্টেশনে গিয়ে স্টেশনমাস্টারকে খবর দিলে স্টেশনমাস্টার একজন যাত্রীর হাতে চিঠি পাঠানর ব্যবস্থা করেন।"
ব্যোমকেশ বলিল, "চিঠিটা সঙ্গে আছে?" ভবেশবাবু পাঞ্জাবীর জেব-টেব চাপড়াইয়া চিঠি পাইলেন না। "আমার মাথার ঠিক নেই ব্যোমকেশবাবু। কোথায় যে ফেলেছি! কিন্তু আমি আপনাকে যা বললাম চিঠিতে তার বেশি কিছু লেখা ছিল না।" ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিলাম, "আপনার জানা মতে সে সময়ে বাড়িতে কে কে ছিলেন?"
- রেবা, মামাবাবু আর ঝি ছাড়া আর কারুর থাকার কথা নয়। মালি হাতার মধ্যেই থাকে, কিন্তু পেছনে, মালির ঘরে।
- ওইসময়ে কে আপনার মামার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
- এ ব্যাপারটাই আমার কাছে সবথেকে বড় ধাঁধা ব্যোমকেশবাবু। বেনার বাড়ি বড় হাতার মধ্যে। কাছাকাছি দুশো-আড়াইশো গজের মধ্যে কোন বাড়ি নেই। থাকার মধ্যে যে কটি বাড়ি আছে সে সবই কলকাতার বড়মানুষদের বাড়ি। চেঞ্জার ছাড়া কেউ সেখানে থাকে না। প্রতিবেশী চেঞ্জারের সঙ্গে খুব আলাপ করার মতন মিশুকে লোক মামাবাবু ছিলেন না।
- কলকাতায় আপনার মামার বন্ধুবান্ধব, চেনাশুনো কীরকম?
- বললাম যে, মামাবাবু তো কলকাতায় বড় হননি। তাই এখানে ওঁর আলাপী ছিল না বললেই হয়। যাওয়ার মধ্যে উকিলবাড়ি আর ফোটোগ্রাফির দোকান, কেমিক্যাল-টেমিক্যাল কিনতে।
- ওঁর কাছের লোক বলতে আপনারা ছাড়া আর কে?
- দিনাজপুরে তো আর কেউই নেই প্রায়। থাকলেও যোগাযোগ নেই। একমাত্র ওঁর খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে আছেন। খুব যোগাযোগ আছে বলব না। তবে মাঝেমধ্যে আসতেন মামাবাবুর কাছে।
- কোথায় থাকেন?
- থাকেন শুনেছি বেলগেছিয়ায় পৈতৃক ভিটেয়। লালবাজারে দোকান আছে। হার্ডওয়্যারের।
- শত্রু কেউ থাকতে পারেন?
প্রশ্ন শুনিয়া ভবেশবাবু স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। টেবিলে রক্ষিত চায়ের পেয়ালার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া যেন কিছু বলিবেন কিনা ভাবিতেছেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মুখ খুলিলেন। "শত্রুর কথা আর কী বলব? বলতে গেলে সারা জগতকেই ওঁর শত্রু বলতে হয়। মানে কারো সঙ্গেই ওঁর বনিবনা হত না। মেজাজটি ব্রিটিশ করে এনেছিলেন। পান থেকে চুন খসার উপায় ছিল না। বাড়ির সবাই তটস্থ থাকতাম। এমনিতে খুব চাহিদা ছিল না। কিন্তু মেজাজে দুর্বাসা। বাইরের লোকেদের সঙ্গেও একই ব্যাপার। একটু কিছু হলেই খটাখটি লেগে যেত। তারা বাইরের লোক। তাদের কোন দায় নেই ঘরের লোকের মতন মিটমাট করতে। কাজেই বলতে পারেন সারা পৃথিবীশুদ্ধ লোকই মামাবাবুর শত্রু।"
অল্পক্ষণ চুপ করিয়া ভবেশবাবু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, "এই ঘটনা আপনার কাজে লাগবে কিনা জানি না, তাও বলি। শনিবার সকালে একটি ভদ্রলোক মামাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। মামাবাবু তাঁকে নিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। ভদ্রলোক ছিলেন বোধহয় আধঘন্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বন্ধ দরজার ওপারে বেশ কয়েকবার দুজনেরই চড়া গলা শুনলাম, যেন বচসা হচ্ছে। বারকয়েক জামতাড়া নামও শুনেছি। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোকটি বেরিয়ে চলে যান।"
- বেরোবার সময়ে কি ভদ্রলোক উত্তেজিত ছিলেন?
- না, একেবারে শান্তভাবেই বেরিয়ে গেলেন।
- আপনি আগে কখনও দেখেছেন তাঁকে।
- না, ব্যোমকেশবাবু, এই প্রথম দেখলাম।
- কীরকম পোষাক পরে ছিলেন?
- সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবী। বিশেষত্ব কিছু চোখে পড়েনি। মাঝে মাঝে মামাবাবুর কাছে লোক আসত। মাসে এক-দুবার। এও সেরকম ভেবে খেয়াল করিনি।
- মামাবাবুর সম্পত্তির ওয়ারিশ কে তা জানেন?
- সে ওঁর উকিল হয়ত বলতে পারবে। তবে আমি ছাড়া আর তো কেউ ওঁর ছিলেন না। খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলেও অবশ্য আছে, কিন্তু মামাবাবু তার ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন বলে মনে হয় না।
- ওঁর উকিলের নাম জানেন?
- দাঁ, মিত্র অ্যান্ড অ্যান্ডারসন। ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে বড় অফিস আছে।
ব্যোমকেশ কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ হইয়া চা পান করিল। ভবেশবাবু বেশিক্ষণ ব্যোমকেশের নীরবতা সহ্য করিতে পারিলেন না। "সত্যি বলতে আমার বিহারের পুলিশের ওপর কোন ভরসা নেই। মামাবাবুরও ছিল না। যদি কেউ কিছু করতে পারে তো সে আপনি। ব্যোমকেশবাবু, একটিবার আমার সঙ্গে চলুন। আপনি ছাড়া এ রহস্য কেউ সমাধান করতে পারবে না। খরচাপাতি সব আমার। পুলিশ পুলিশের মতন কাজ করবে। আপনি আমার দিক থেকে তদন্ত করবেন।"
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, "পুলিশের হুকুমে আমার এখন কলকাতা ছাড়া চলবে না ভবেশবাবু। তবে আপনাকে একেবারে নিরাশ করব না। অজিত আপনার সঙ্গে গিয়ে সরেজমিনে দেখে আসবে। ওর কথা শুনে যদি মনে হয় কিছু করতে হবে, আমি কথা দিচ্ছি আমি সে সবে আপনাকে সাহায্য করব।" ব্যোমকেশের পরিবর্তে আমি যাব শুনিয়া ভবেশবাবু হতাশ হইলেও তাহা প্রকাশ করিলেন না। বরং উৎসাহই দেখাইলেন, "বেশ তো, বেশ তো। অজিতবাবুই চলুন। সত্যিই তো আপনার মত ব্যস্ত লোকের কি এমন হুট বলতে যাওয়া যায়! অজিতবাবু কি আজ যেতে পারবেন? কলকাতা থেকে দিনে দুটো গাড়ি ছাড়ে। একটা সকাল এগারোটায়, জামতাড়ায় পৌঁছয় রাত আটটায়। আর রাত নটায় একটা গাড়ি ছাড়ে, সেটা পৌঁছয় সকাল ছ'টা নাগাদ। বেলার গাড়ি ধরার পক্ষে দেরি হয়ে গেছে। আজ সন্ধ্যের গাড়িতে চলুন। কাল সারাদিন তদন্ত করে ওখান থেকে রাতের খাওয়া সেরে সাড়ে দশটার গাড়িতে চলে আসবেন। আর নইলে রাতটা আমার ওখানে থেকে পরশু সকালের গাড়িতেও ফিরে আসতে পারেন।" ব্যোমকেশ বলিল, "সারাদিনে এই দুটোই ট্রেন?"
- জামতাড়াতে থামে সারাদিনে এই দুটো আপ আর দুটো ডাউন।
- আর স্টেশন থেকে আপনাদের বাড়ি?
- টাঙ্গা পাবেন স্টেশন থেকে। আধাঘন্টাটাক লাগে। স্টেশনে আসাটা একটু ভজকট। আগে থেকে টাঙ্গা বলে রাখতে হয়।
স্থির করিলাম হাওড়ার রেলওয়ে স্টেশনে বড় ঘড়ির নীচে সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় সাক্ষাৎ করিব।
ভবেশবাবু চলিয়া গেলে ব্যোমকেশকে জিগেস করিলাম, "কীরকম বুঝছ?" ব্যোমকেশ কহিল, "বোঝাবুঝির এখন কিছু নেই। এখন শুধু তথ্য সংগ্রহ। তুমি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খবর নেবে ওখানে পৌঁছন থেকে খুন হওয়া অব্দি কে কী করেছে। আর খবর নেবে কেউ এসেছিল কিনা। এ কাজ হয়ে গেলে থানায় তোমার পরিচয় দিয়ে দারোগার সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা কোরো। দারোগা হাতে থাকলে কাজ অনেক সোজা হয়ে যাবে। কীভাবে খুন হয়েছে, খুনের অস্ত্র পাওয়া গেছে কিনা, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কখন পাওয়া যাবে এসব জিগেস করে নিও।"
ব্যোমকেশ ব্যতীত আমার তদন্ত এই প্রথম নয়। মাকড়সার রস সংক্রান্ত তদন্তেও আমিই জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছিলাম ও একটি সমাধানের প্রস্তাব করিয়াছিলাম। তাহার পরিণতি সুখের হয় নাই। এইবার তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিবই এই স্থির করিয়া স্নানঘরের উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
দুই
পরদিন ভোরে জামতাড়া স্টেশনে যখন গাড়ি হইতে নাবিলাম, তখনও ভাল করিয়া দিনে আলো ফোটে নাই। একজন কর্মচারী গ্যাসের বাতিগুলি নিভাইতেছে। প্লাটফর্মে নাবিতেই বিহারের শীত শরীর কামড়াইয়া ধরিল। পরনে গরম উলের পোষাকের উপর বালাপোষ, মাথায় বাঁদুরে টুপি, পায়ে উলিকটের গরম পাতলুন, উলের মোজা এইসকল ভেদ করিয়াও ঠান্ডা আসিয়া বিঁধিতে লাগিল। সঙ্গে মালপত্র বিশেষ ছিল না। সেইদিনই ফিরিয়া যাইব বলিয়া একটি ছোট চামড়ার বাক্সেই কাজ চালাইয়া লইয়াছিলাম। ভবেশবাবুর সঙ্গেও একটি ছোট বাক্স। শীতের দিন বলিয়া ট্রেনে শয়ন করিবার জন্য একটি করিয়া বেডিং ছিল। কাজেই কুলির প্রয়োজন হইল। বাহির হইবার সময়ে দেখিলাম স্টেশন মাস্টারের ঘরে তালা। কুলি বলিল 'টিসনবাবু' ভোরে আসিয়া গাড়ি পার করিয়া দিয়া যান। পাকাপাকি আসিতে আসিতে সকাল দশ ঘটিকা বাজিয়া যায়।
আমরা স্টেশন হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। ছোট স্টেশন। বাহিরে গোটা দুয়েক ঘোটকবিহীন-টাঙ্গা দাঁড়াইয়া আছে। দুটি ঘোড়া গাছের তলায় রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় জাবনা চিবাইতেছে। অনুমান করিলাম টাঙ্গার অনুপস্থিত ঘোটকই আপাতত জাবনা গলাধঃকরণ করিতেছে। অনুসন্ধান করিতে জানা গেল যে আমার অনুমান শুধু সঠিক তাহাই নহে, ঘোড়া থকিয়া আছে, দশ মিনিটের মধ্যেই টাঙ্গা টানিবার উপযুক্ত বল পাইবে। অন্য দুটি সমর্থ টাঙ্গা আগেই যাত্রী লইয়া চলিয়া গিয়াছে। অগত্যা অপেক্ষা ভিন্ন সময় কাটাইবার আর কোন উপায় দেখিতেছিলাম না। সামনেই একটি দোকানের উনানে আঁচ পড়িয়াছে। জিলিপি ভাজিবার প্রস্তুতি চলিতেছে। ভবেশবাবু চা-পানের প্রস্তাব করিলেন। আমি দ্বিরুক্তি করিলাম না। কলিকাতায় রসগোল্লা যেরূপ ভাঁড়ে দেয়, সেইরূপ এক ভাঁড় অধিক-দুধ-চিনি সম্বলিত গরম চা গলাধঃকরণ করিয়া শীতের বিরুদ্ধে যুঝিবার শক্তি সঞ্চয় করিলাম।
চা খাইতে খাইতে নজরে পড়িল স্টেশনের পাশেই পুলিশ চৌকি। দিনের কোন একসময়ে পুলিশ চৌকিতে হানা দেব স্থির করিয়াই রাখিয়াছিলাম, ব্যোমকেশ পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের খোঁজ করিতে বলিয়াছে। রিপোর্ট এত শীঘ্র আসিবে না জানি, তাও দারোগার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়া রাখা ভাল। এই ভাবিয়া আমি আর ভবেশবাবু থানা-অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম। একটি কনস্টেবল দিনের প্রথম খৈনিটি পাকাইতেছিল। আমাদের দেখিয়া বিশেষ হৃষ্ট হইল বলিয়া মনে হইল না। দারোগাসাহেব নাই, এই বলিয়া ভাগাইয়া দেবার উপক্রম করিতেছিল। ভবেশবাবু দেখিলাম ব্যবসায়ী লোক। পুলিশ কনস্টেবলকেও বাক্যজালে বাঁধিয়া ফেলিলেন। জানা গেল দারোগাবাবুর বাসস্থান থানার হাতার ভিতরেই। দশটার আগে থানায় দারোগাবাবুকে প্রয়োজন হইলে এত্তালা পাঠাইতে হয়। আমরা এত্তালা পাঠাইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলাম।
ছোট থানা। দুই ধাপ সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া লম্বা বারান্দায় অপেক্ষমান অভিযোগকারীদের বসিবার বেঞ্চি পাতা। বারান্দা পার হইয়া মূল থানায় প্রবেশ করিলে মাঝে একটি বড় ঘর, ঘরের সংলগ্ন দারোগাবাবুর খাস কক্ষ। বারান্দার এক পাশে দলিল-দস্তাবেজ রাখিবার একটি ছোট ঘর। অন্যপাশে গরাদঢাকা লক-আপ, আপাতত শূন্য। দলিল-দস্তাবেজের কক্ষে একজন কনস্টেবল টেবিলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইতেছে। অন্য কনস্টেবল দারোগাবাবুর ঘরে ঝিমাইতেছিল, অতি অনিচ্ছার সঙ্গে সেই কনস্টেবলই দারোগাবাবুর বাসস্থানে গিয়া খবর দিয়া আসিয়াছে। প্রায় কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পরে দারোগা আসিলেন প্লেন ড্রেসে। দারোগাকে দেখিয়া আমি চমকাইয়া গেলাম। আরে, এ তো সেই সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারি! বহ্নিপতঙ্গের সময়ে আলাপ হইয়াছিল। তখন তিনি সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। এতদিনে বোধকরি পদোন্নতি হইয়া জামতাড়াতে ইন্সপেক্টর হইয়া আসিয়া বসিয়াছেন। তিওয়ারি আমাকে দেখিয়া পান-খাওয়া দাঁতে হাসিয়া বুঝাইয়া দিলেন, চিনিয়াছেন। ব্যোমকেশের কুশল নিলেন। পুরন্দর পাণ্ডে পদোন্নীত হইয়া সদরে চলিয়া গেছেন, এ খবর কলকাতায় বসিয়াই পাইয়াছিলাম। তিওয়ারি তাহা পাকা করিলেন। কনস্টেবল ডাকিয়া চা ও জিলিপি আনিবার হুকুম করিলেন। তাহার পরে হিন্দিতে যাহা কথোপকথন হইল তাহা এইরূপ - খবর পাইয়া তিওয়ারি স্বয়ং দুজন কনস্টেবল-সহ "যোগমায়া কুঠি'-তে গিয়াছিলেন। গিয়া দেখিলেন বাড়ির বৈঠকখানার ঘরের মেঝেতে শিবকালী মরিয়া পড়িয়া আছেন। তাহার বক্ষে ছুরির ক্ষত। অস্ত্রটি পাওয়া যায় নাই। বাড়িতে কেবল এক মহিলা, একটি ঝি ও মালি ছিল। মালিই আসিয়া থানায় খবর দিয়াছিল। রাত হইয়াছিল বলিয়া বাড়ির আশপাশ খুঁজিয়া দেখা হয় নাই, শুধু ঝি, মালি ও মালকিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াই চলিয়া আসিয়াছিলেন। গাড়ির বন্দোবস্ত করিয়া দেহ সদরে পাঠাইতে এত দেরি হইয়াছিল যে প্রাথমিক রিপোর্ট লেখা সুযোগ মেলে নাই। আজ সকালে রিপোর্ট লিখিয়াই তিওয়ারি আবার যাইবেন সরেজমিনে অস্ত্র-সন্ধানের তদারকি করিতে। বৈকালে ব্যোমকেশের জন্য রিপোর্টের একটি নকল দিবার প্রতিজ্ঞাও করিলেন। সদর হইতে পোস্ট-মর্টেমের রিপোর্ট আসিতে আরও অন্ততঃ তিনদিন লাগিবে।
তিওয়ারি বলিলেন বেলা দশটা নাগাদ তিনি সদলবলে তদন্ত করিতে আসিবেন। আমরা গরম জিলিপি সহযোগে আরেকপ্রস্থ চা খাইয়া বিদায় লইলাম। আমার অনুরোধে তিওয়ারি আমার বেডিং থানায় গচ্ছিত রাখিতে সম্মত হইলেন। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম টাঙ্গাও প্রস্তুত। আমরা চড়িয়া বসিলাম। ততক্ষণে সূর্যদেব সম্পূর্ণরূপে উদিত হইয়া তেরচা রোদ বিতরণ করিলেও সে রোদের তেজ নাই। চলমান টাঙ্গায় সামনে হইতে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা তিনপ্রস্থ পুরু শীতের পোশাক ভেদ করিয়া হাড়মাস কালাইয়া দিতেছে। বিশেষ কথাবার্তা না বলিয়া জবুথবু বসিয়া পথ পার করিয়া দিব মনস্থ করিলাম।
আন্দাজ পনেরো-কুড়ি মিনিট ভ্রমণের পরে টাঙ্গা আসিয়া একটি ফটকের সামনে দাঁড়াইল। ফটকের পাশে পাথরে গৃহের নাম লিখা - 'যোগমায়া কুঠি'। ফটকটির দুপার্শ্বে পাথরের প্রাচীর ভিতরের জমিসহ বাড়িটি বেষ্টন করিয়া আছে। প্রাচীরের বেষ্টনি ধরিয়া উঁচু গাছের সারি পথিকের দৃষ্টিপথ রোধ করিতেছে। শুধু ফটকের সামনে দাঁড়াইলেই বাড়িটি দৃষ্টিগোচর হয়। ভবেশবাবু টাঙ্গার ভাড়া মিটাইয়া দিলেন। আমরা স্ব-স্ব বাক্স লইয়া ফটক পার হইয়া মোরামের পথ ধরিয়া বাড়ির সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলাম। দ্বিতল গৃহ। তিন ধাপ সিঁড়ি দিয়া উঠিলেই সম্মুখে বিস্তৃত দাওয়া। দাওয়ার পিছনে ও পাশে দুইটি দরজা। দ্বিতল হইলেও গৃহটি ছোট। কিন্তু চতুর্পার্শ্বের জমির পরিমাণ কম হইবে না। অন্ততঃ দশ-বারো বিঘা তো হইবেই। প্রাচীরপার্শ্বের বড় গাছের কথা আগেই বলিয়াছি। ভিতরে ফুলের বাগান। শীতের সময়ে বিভিন্ন রঙের প্রস্ফুটিত ফুলে বাগানটি ঝলমল করিতেছে। ভবেশবাবু জানাইলেন, পিছনে ফলের বাগান আছে।
আমরা দাওয়ায় উঠিলাম। দাওয়ায় ক্যানভাসের চারিটি চেয়ার ও একটি ছোট টেবিল রাখা আছে। ভবেশবাবু বলিলেন, "অজিতবাবু আপনি বসুন। আমি পিছনের দিকে গিয়ে দেখি। হয়ত রেবা রান্না করছে, দরজা ধাক্কা দিলে শুনতে পাবে না।" ভবেশবাবু বাড়ির পাশ দিয়া পায়ে-হাঁটা পথে পিছনদিকে অন্তর্ধান করিলেন। আমি দাওয়ায় দাঁড়াইয়া চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। আসিবার পথে দেখিয়াছি বাড়িটির লাগোয়া কোন বাড়ি নাই। পূর্বের বাড়িটি অন্ততঃ সিকি মাইল পূর্বে। দুই বাড়ির মাঝে বাঁশের হাল্কা জঙ্গল। অন্যদিকের প্রাচীরের ওপারে কী আছে ঠাহর হইল না।
কিয়ৎক্ষণ বাদে দরজা খুলিয়া ভবেশবাবু আমাকে অন্দরে আহ্বান করিলেন। আমি আমার বাক্সটি লইয়া প্রবেশ করিলাম। সম্মুখেই একটি প্রায়ান্ধকার বৈঠকখানার ঘর। ভবেশবাবু লম্বাটে ঘরের একটিমাত্র জানালা খুলিয়া দিলেন। কিছু আলো প্রবেশ করিল। জানালার ঠিক বাহিরে একটা বড় গাছ আলো প্রবেশে বাধার সৃষ্টি করিতেছে, তাই ঘরটি সম্পূর্ণ আলোকিত হইল না। ভবেশবাবু হাসিয়া বলিলেন, "এ ঘরটা একটু অন্ধকার। ঝগড়ুকে বলেছিলাম বাইরের গাছটা কেটে দিতে, কিন্তু তা সে করবে না। আমাদের স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে চাকর-মালিরাও এখানে সবাই স্বাধীন। বলেন তো বাতি দিতে বলি।" আমার বাতির প্রয়োজন ছিল না। ঘরে আসবাবের মধ্যে একটি আরামকেদারা ও একটি সাধারণ কেদারা, তাহাদের মাঝে একটি টিপয়, আর জানালার সম্মুখে একটি চৌকি ভিন্ন কিছু নাই। চৌকিটি ন্যাড়া। চাদর, ফরাস কিছুই বিছানো নাই। আমি একটি আরামকেদারায় বসিলাম। ভবেশবাবু অন্য কেদারায় বসিয়া পকেট হইতে নস্যির ডিবে বাহির করিয়া টিপয়ের উপরে রাখিলেন। বলিলেন, "ইন্সপেক্টারের সঙ্গে কথা বলে কী বুঝলেন?" আমি বিশেষ কিছু বুঝি নাই। বুঝিবার যে কিছু আছে, তাহাই বুঝি নাই। কিন্তু সে কথা প্রকাশ না করিয়া বলিলাম, "তিওয়ারি তো দশটা নাগাদ আসবে। তার আগে আমি আপনার স্ত্রী, ঝি আর মালির সঙ্গে কথা বলে নিতে চাই।" ভবেশবাবু হাসিলেন, "বিহারের কাজকর্ম সম্বন্ধে আপনার ধারণা নেই। ইন্সপেক্টর দশটায় আসবেন মানে আসবেন দুপুর পেরিয়ে গেলে। তাও আমি আপনার সঙ্গে ওদের কথা বলিয়ে দিচ্ছি। রেবা রান্না করছে, আগে ঝিকেই ডাকি?" আমি সম্মতি দিলাম। ভবেশবাবু অন্দরে চলে গেলেন। অন্দরের দরজার ওপারে আরও একটি দাওয়া। দাওয়া পার হইলে উঠান। ঘর হইতে উঠানের কিয়দংশ দেখা যায়। বিহারের সকালের রোদে উঠান ভাসিয়া যাইতেছে।
ভবেশবাবুর সঙ্গে ঝি আসিয়া দরজায় দাঁড়াইল। ভবেশবাবু আরামকেদারায় আসিয়া বসিলেন। ঝির পরনে ডুরেপাড় শাড়ি, আকণ্ঠ ঘোমটায় মুখ ঢাকা, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে কুণ্ঠা স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে। ভবেশবাবু শাসাইলেন, "এই বাবু কলকাতা থেকে এসেছেন মামাবাবুর খুনের খবর করতে। তোমাকে যা যা জিগেস করবেন, ঠিক ঠিক জবাব দেবে।" তাহার পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, "আমি কি বাইরে চলে যাব?" আমার সেরূপ ইচ্ছা ছিল না। তাঁহাকে থাকিতে বলিলাম। ঝিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, "কী নাম তোমার?" ঝি অস্ফুটে কী বলিল তাহা গোচর হইল না। ভবেশবাবু ধমকাইয়া বলিলেন, "যা বলবে জোরে বলো।" তাহার পর আমার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, "নাম মেনকা।" আমি বলিলাম, "পরশু সন্ধ্যেবেলা কী হয়েছিল?" মেনকা অতি ক্ষীণস্বরে বলিল, "আমি কিছু জানি না বাবু।" ভবেশবাবু আবার মধ্যস্থতা করিলেন, "আহা, তোমাকে তো কিছু জানার কথা বলছেন না। পরশু বিকেল থেকে কী কী হয়েছে, সে কথা বলো।" ঝি পুনরায় ক্ষীণস্বরে বলিতে আরম্ভ করিল। কিছু শুনিলাম আর কিছু আন্দাজ করিয়া যা বুঝিলাম তাহা এইরূপ - বিকালে মামাবাবু প্রত্যহকার মতন চা পান করিয়া বৈকালিক ভ্রমণে বাহির হইয়া গিয়াছিলেন। সন্ধ্যার প্রাক্কালে ফিরিয়া বৈঠকখানাতেই ছিলেন। ঝি যখন বাতি লইয়া আসে, মামাবাবু তখন একটি যন্ত্র লইয়া ঘাঁটিতেছিলেন। কী যন্ত্র তাহা মেনকা জানে না। তাহার পরে মামাবাবু কী করিয়াছেন তাহা সে জানে না। সে পিছনের ভাঁড়ারে বসিয়া প্রথমে চাল বাছিতেছিল, তাহার পরে রাত্রের খাদ্য প্রস্তুত করিতেছিল। বৌদিদি উপরে ছিলেন। মেনকা হলফ করিয়া বলিতে পারিবে না, কিন্তু পায়ের শব্দ শুনিয়া মনে হয় মামাবাবু বার কয়েক বৈঠকখানা ও বৈঠকখানার পার্শ্ববর্তী নিজের ঘরে যাতায়াত করিয়াছিলেন। কিয়ৎ পরে বাহিরের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। বৈঠকখানার ঘরে অপরিচিত কন্ঠস্বর শুনিয়া মেনকা বুঝিতে পারে মামাবাবুর নিকট অতিথি আসিয়াছে। সাধারণ স্বরেই কথা হইতেছিল, কাজেই তাহার পক্ষে শুনিয়া কথোপকথন বোঝা সম্ভব হয় নাই। কথোপকথন কখন বন্ধ হয়েছে সে কথাও খেয়াল করে নাই মেনকা। ইহার পরে বৌদিদি নীচে আসিলেন। বৌদিদি ও মেনকা মামাবাবুর রাত্রের খাবার থালায় সাজাইতেছিল, হঠাৎ বৈঠকখানার ঘর হইতে এক আর্ত চিৎকার শুনিয়া তাহারা ছুটিয়া বৈঠকখানায় গিয়া দেখে বৈঠকখানার দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। করাঘাত করিয়া, মামাবাবুর নাম ধরিয়া ডাকিয়াও যখন কোন উত্তর আসিল না, তখন বৌদিদি পাশে মামাবাবুর ঘর দিয়া বাহিরের বারান্দায় গিয়া দেখেন বৈঠকখানা হইতে বাহিরে যাবার দরজা হাট করিয়া খোলা। সেই পথে প্রবেশ করিয়া বৌদিদি ভিতরের দরজা খুলিলে মেনকা প্রবেশ করে। প্রবেশ করিয়া দেখে দেখে মামাবাবু মরিয়া পড়িয়া আছেন। বুকের কাছে ক্ষত হইতে রক্ত ঝরিতেছে।
- তখন ঘরে আর কে ছিল?
- শুধু বৌদিদি।
- বাইরের দরজা খোলা ছিল?
- হ্যাঁ।
- তখন তোমরা কী করলে?
- বৌদিদি আমাকে পরিষ্কার কাপড় এনে দিতে বললেন। আমি ছুটে মামাবাবুর ঘরের আলনা থেকে কাচা ধুতি এনে দিলাম।
- তারপর?
- তারপর আমি আর বৌদিদি মিলে রক্ত পরিষ্কার করলাম। বুকের কাছটা কাপড় বেঁধে দিলাম।
- দেখলে না মামাবাবু বেঁচে আছেন কিনা?
- বৌদিদি বলেছিল মরে গেছে।
- তারপর?
- তারপরে বৌদিদি বলল, মালিকে ডাকতে। আমি মালিকে ডেকে নিয়ে এলাম। বৌদিদি মালিকে লোক ডাকতে বলল। মালি কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, কোন লোক নেই। বৌদিদি তখন মামাবাবুর ঘর থেকে কাগজ এনে চিঠি লিখে মালির হাতে দিয়ে বলল, পুলিশে খবর দিতে। আর চিঠিটা স্টেশনবাবুকে দিতে। মালি চলে গেল। তার অনেকক্ষণ পরে পুলিশ নিয়ে মালি এল।
ঝিকে আর প্রশ্ন করিবার কী আছে খুঁজিয়া পাইলাম না। আমি ভবেশবাবুর দিকে চাহিলাম। ভবেশবাবু মেনকাকে বলিলেন, "ঠিক আছে তুমি এখন যাও। বৌদিদিকে পাঠিয়ে দাও।" ঝি বলিল, "বৌদিদি স্নানে গেছেন।" ভবেশবাবু বলিলেন, "ঠিক আছে, স্নানের পরে আসতে বলো।" তাহার পরে আমার প্রতি চাহিয়া বলিলেন, "বাইরেটা দেখে আসবেন নাকি?" স্মরণ হইল ব্যোমকেশ এমতাবস্থায় চতুর্দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে। গোয়েন্দা গল্পেও অনুরূপ পড়িয়াছি। ভবেশবাবুকে বলিলাম, "সে তো অবশ্যই। চলুন বাইরেটা দেখা যাক।" দরজা দিয়া বাহিরে দাওয়ায় আসিলাম। অপর দরজাটি দেখাইয়া ভবেশবাবু বলিলেন, "এই দরজা দিয়ে মামাবাবুর ঘর। ভেতরের বারান্দা দিয়েও ঢোকা যায়।" দাওয়াটি লাল সিমেন্টে বাঁধান। যে আসবাবের কথা বলিয়াছিলাম তা ভিন্ন দাওয়াটি পরিচ্ছন্ন। দাওয়া হইতে নামিলে মোরামের পথ মূল ফটকের দিকে গিয়াছে। পথের দু-পাশে ফুলের বাগান। বামদিকের বাগানটি ছোট। সেইদিকে গৃহ ও প্রাচীরের মধ্যে ব্যবধান দুই হাতের বেশি হইবে না। প্রাচীরের ওপারে বাঁশের জঙ্গল, যাহা টাঙ্গায় আসিবার কালে দেখিয়াছিলাম। বামদিকের বাগানটি পরীক্ষা করিয়া সন্দেহজনক কিছু দেখিতে পাইলাম না।
ডানদিকের বাগানটি পরিসরে বামদিকের বাগানের দ্বিগুণ কি তাহারও অধিক হইবে। দুই বাগানেই ঘাসের আধিক্য নাই, কিন্তু ইঁট পাতিয়া গোলাকার ফুলের অংশের মাটি কোপান ও গাছগুলি সতেজ। গৃহের সংলগ্ন যে পথে ভবেশবাবু পশ্চাতে গিয়াছিলেন, আমরা সে পথ অগ্রসর হইলাম। প্রথমেই পড়িল বৈঠকখানার জানালা। তাহার বাহিরেই একটি বড় আম গাছ। আম গাছের শাখাই পত্রভারে নীচু হইয়া রৌদ্র ও আলোর গতিপথ রোধ করিয়া বৈঠকখানাটি প্রায়ান্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। জানলার নীচের মাটি শুকনো। এই শীতের সময়ে পায়ের কোনরূপ চিহ্ন আশা করা বৃথা। যদিও এখনও ভূমি শিশিরে সিক্ত হইয়া আছে। পায়ের চিহ্ন দূরস্থান, একটি সন্দেহজনক কাগজের টুকরারও দেখা পাইলাম না, যদিও শুকনো পাতায় ভূমি আচ্ছন্ন। এই পথ ধরিয়া আরও চলিলে গৃহের সীমানায় আসিয়া পৌঁছিলাম। গৃহের পিছনে প্রাচীরের গাত্রে খিড়কির দরজা। অধুনা বন্ধ। বোধকরি এই পথে পিছনের যে উঠান দেখিয়াছিলাম সেখানে প্রবেশ করা যায়। গৃহের প্রাচীর হইতে হাতার প্রাচীর মধ্যবর্তী জমি একশো হাত হইবে। এই জমিতে আম, পেয়ারা প্রভৃতি ফলের গাছ রহিয়াছে। ইহাই ভবেশবাবু বর্ণীত ফলের বাগান।
বাগানের শেষে, কোণে প্রাচীরগাত্রে একটি ছোট ঘর। তাহার সামনে দাঁড়াইয়া ভবেশবাবু ঝগড়ু-ঝগড়ু বলিয়া ডাকিতে ঘর হইতে মালি বাহির হইয়া আসিল। বুঝিলাম ইহাই মালির বাসস্থান। মালির বয়স আন্দাজ চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হইবে। শীর্ণকায়, পাকানো চেহারা, বসা গাল ও রক্তবর্ণ চক্ষু দেখিয়া তাহাকে নিয়মিত গাঁজা-চরসসেবনকারী বলিয়া সন্দেহ থাকে না। মুখমণ্ডলে ভীষণদর্শন একজোড়া গোঁফ বোধ করি চেহারার শীর্ণতাকে ঢাকা দিবার উদ্দেশ্যে রক্ষিত। সে গোঁফও অধুনা গাঁজার ধোঁয়া খাইয়া পাকা রং ধারণ করিয়াছে। ভবেশবাবু ঝির ন্যায় মালিকেও প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার নিমিত্ত শাসাইলেন।
- তোমার নাম ঝগড়ু?
- জী।
- কতদিন এখানে কাজ করছ।
- কোই দো-চার সাল হোবে।
- পরশু রাতে কী হল?
- হামি কুছু জানে না। হামি খানা পাকাচ্ছিলাম। ঝি আকে বোলা কি, বড়াবাবু মর গয়া। মাইজি বুলা রহি হ্যায়। সো হামি গেলাম। গিয়ে দেখলাম বড়াবাবু মরা হুয়া হ্যায়। বহোত জাদা খুন বাহার আয়া। মাইজি হামাকে আদমি বুলানে কো লিয়ে বোলা। ম্যায় বাহার রাস্তে মে যাকে খাড়া হুয়া। কোই আদমি নেহি মিলা। মাইজিকো যাকে বোলা। তব মাইজি এক খত দেকে মেরেকো থানেমে যানে কো কহা। হামি থানায় যাকে বোলা। অউর উও খত যাকে টিসনমাস্টারকো দিয়ে দিলাম।
- কাছাকাছি বাড়িতে লোক পেলে না?
- দো হি অউর মকান হ্যায় ইধার। অভি কোই নেহি হ্যায় উঁহা। বন্ধ পড়া হুয়া হ্যায়।
- যখন ঝি এসে ডাকল, তুমি নেশা করেছিলে?
- হাম রোজই গাঁজা পিতা হুঁ। উসমে কুছ নেহি হোতা।
- কোন লোক এসেছিল সন্ধ্যেবেলা? ফটক খোলার আওয়াজ পেয়েছিলে?
- নেহি, কঊন আয়েগা রাত কো?
এই প্রশ্নের সদুত্তর না থাকায় কথোপকথন অগ্রসর করিবার যৌক্তিকতা পাইলাম না। ডানদিকের বাগানের প্রাচীরের ওপারে উঁকি দিয়া দেখিলাম। সেদিকেও অপরপ্রান্তের মতনই হাল্কা বাঁশ ও অন্যান্য গাছ ও গুল্মের বন। হাতার পিছনেও তদ্রূপ। বাগানে আরও কিছুক্ষণ ইতস্তত ক্লুয়ের সন্ধান করিলাম। কিন্তু কিছু না পাইয়া হতোদ্যম হইয়া বৈঠকখানায় ফিরিয়া যাওয়াই মনস্থ করিলাম।
তিন
- পরশু সন্ধ্যেয় কী হয়েছিল, একটু মনে করে যদি বলেন।
- দুপুরে আমি একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আগের দিন যাতায়াতে ধকল গেছে। মেনকা চা এনে আমায় ডেকে দিল। আমি মেনকাকে জিগেস করলাম, মামাবাবুকে চা দিয়েছে কিনা। মেনকা বলল মামাবাবু চা খেয়ে বেরিয়ে গেছেন। আমি তখন চা খেয়ে, গা ধুয়ে, পুজোয় বসলাম। পুজো শেষ করে নীচে নেবে দেখি মেনকার রান্না প্রায় শেষ। আমি হাত লাগিয়ে রান্না শেষ করে থালায় মামাবাবুর খাবার বাড়ছিলাম। হঠাৎ বৈঠকখানার দিক থেকে একটা চিৎকার শুনলাম। (রেবাদেবীর গলা ধরিয়া আসিল।)
- তার আগে আপনি যখন রান্নাঘরে ছিলেন, বৈঠকখানার ঘর থেকে কোন শব্দ শুনেছিলেন?
- না। আমি কিছু শুনিনি।
- ঠিক আছে। আপনি বৈঠকখানায় গিয়ে কী দেখলেন?
- বৈঠকখানার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। আমি মামাবাবুর নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোন সাড়া নেই। তখন আমি মামাবাবুর ঘর দিয়ে গিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখি বৈঠকখানার ওদিকের দরজা খোলা।
- কাউকে দেখতে পেয়েছিলেন?
- না। বাইরে তো কোন আলো নেই। বাগান তো ঘুরঘুট্টে অন্ধকার।
- তারপর?
- তখন আমি খোলা দরজা দিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকলাম।
- গিয়ে কী দেখলেন?
- সে এক বীভৎস দৃশ্য। মামাবাবু চেয়ারে পড়ে আছেন। বুকে ক্ষত। ক্ষত থেকে রক্ত বেরিয়ে মামাবাবুর সারা শরীর ভিজিয়ে দিয়েছে। মামাবাবু কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছেন বটে, কিন্তু আমি দেখেই বুঝলাম দেহে প্রাণ নেই।
- তখন আপনি কী করলেন?
- আমি তখন ভেতরের দরজা খুলে দিলাম। মেনকা এল। আমি আর মেনকা তখন ধরাধরি করে মামাবাবুকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে মেনকাকে বললাম, ঝগড়ুকে ডাকতে। ঝগড়ু এলে আমি ঝগড়ুকে লোক ডাকতে বললাম। সে কিছুক্ষণ পরে এসে বলল, কোন লোক নেই। তখন আমি একটা চিঠি লিখে তার হাতে দিয়ে থানায় পাঠালাম।
- তারপর।
- আমি আর মেনকা মড়া আগলে বসে রইলাম। দারোগাসাহেব যখন এলেন তখন অনেক রাত। দারোগাসাহেব আমার, মেনকার আর ঝগড়ুর জবানবন্দী নিয়ে মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলেন।
আমি ডাইরির পাতা বন্ধ করিলাম। ব্যোমকেশের জন্য আজ সকাল হইতে যাহা ঘটিয়াছে তাহা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতেছিলাম পাছে কিছু বিস্মৃত হই। উপরের বিবরণ রেবাদেবীর সহিত কথোপকথনের। বাগান হইতে ফিরিয়া বৈঠকখানায় বসিবার পরেই ভবেশবাবুর আহ্বানে রেবাদেবী আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিলেন। সুন্দর মুখশ্রীর মধ্যম গড়নের যুবতী নারী। যথেষ্ট সপ্রতিভ। প্রশ্নের জবাব দিতে কোনপ্রকার জড়তার প্রকাশ নাই। প্রশ্নোত্তর পর্ব সমাধা হইলে কলঘরে যাইয়া প্রক্ষালন করিয়া বৈঠকখানায় ফিরিতেই বড় কাঁসার থালায় দ্বিপ্রাহরিক ভোজন আসিয়ে উপস্থিত হইল। ভবেশবাবু জানাইলেন যে ভোজন সাধারণতঃ ভূমিতে আসন পাতিয়া বসিয়া পিছনের দাওয়াতেই সমাধা হইয়া থাকে। শীতের প্রকোপ বাড়িলে বৈঠকখানার ঘরই ভোজনকক্ষে পরিণত করা হয়। আজও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই।
ভোজনান্তে আমি ডাইরি খুলিয়াছিলাম। ভবেশবাবু প্রস্তাব করিয়াছিলেন আমি পাশের মামাবাবুর কক্ষে যাইয়া বিশ্রাম করি। আমি প্রস্তাবটি সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করিলাম এই বলিয়া যে বৈঠকখানার আরামকেদারায় আমার বিশ্রামের পক্ষে যথেষ্ট আরামদায়ক। তদুপরি দিনের সালতামামি লিপিবদ্ধ করিবার ইচ্ছাও ছিল। ইতিমধ্যে দুইজন কনস্টেবল-সহ ইনস্পেক্টর তিওয়ারি আসিয়া পড়িলেন। বৈঠকখানার ঘরে বসিয়া কিঞ্চিৎ বিশ্রম্ভালাপ করিলেন। তাহার পর মামাবাবুর ঘর, পিছনের উঠান, রাঁধিবার কক্ষ ও তৎসংলগ্ন ভাঁড়ার ঘর পরীক্ষা করিলেন। আমি ও ভবেশবাবু সঙ্গে রহিলাম। মামাবাবুর ঘরটি মাঝারি আকারের। ঘরে দুইটি জানালা। একটি সম্মুখের বাগানের দিকে। অপরটি পাশের প্রাচীর সংলগ্ন গলিপথে। যে দেওয়াল বৈঠকখানার সহিত সংলগ্ন, তাহারই কোণে বাহিরের দাওয়ায় যাইবার দরজা। আমরা প্রবেশ করিলাম পিছনের দাওয়া হইতে। কক্ষটি নিরাভরণ। একটি একজনের শুইবার তক্তাপোষ - তোষক, গদি, বালিশ, চাদর ও বালাপোষে পরিপাটিরূপে সজ্জিত। ইহা ভিন্ন একটি চেস্ট অফ ড্রয়ার আছে। তাহার দুইটি দেরাজে মামাবাবুর পরিধানের কাপড়জামা ভিন্ন বাকি সব দেরাজই ক্যামেরা ও ছবি তুলিবার অন্যান্য সরঞ্জামে পরিপূর্ণ। চেস্ট অফ ড্রয়ারের উপরে একটা কলমদান, কতকগুলি কাগজের ফাইল, লিখিবার কাগজ, একটি সিগারেটের টিন ও সুজনি ঢাকা একটি জল খাইবার গেলাস আছে।
তাহার পর তিওয়ারি দ্বিতলের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। আমি ও ভবেশবাবু তাহার সঙ্গী হইলাম। উপরের নক্সা একতলার অনুরূপ। সিঁড়ি উঠিয়াছে একতলার পিছনের দাওয়া হইতে। শেষ হইয়াছে দ্বিতলের পিছনের বারান্দায়। বারান্দা সংলগ্ন দুইটি ঘর - নীচের বৈঠকখানা ও মামাবাবুর ঘরের অনুরূপ। বড় ঘরটি ভবেশবাবুর শয়নকক্ষ। অন্যটিতে কিছু তোরঙ্গ ইত্যাদি রহিয়াছে। রেবাদেবী এই ঘরেই দেখিলাম ঠাকুরের আসন পাতিয়াছেন। দেখিবার বিশেষ কিছু ছিল না। ইন্সপেক্টর তিওয়ারির ইচ্ছাও ছিল না। একপ্রকার দায়সারা পরীক্ষা করিয়া নীচে নামিয়া আসিলেন। ইহার পরে দুইজন কনস্টেবল-সহ বাগান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমার মতই খুঁজিয়া দেখিলেন। ফল কিছু ভিন্ন হইল না। ইহার পরে তিওয়ারি প্রস্থান করিলেন।
বৈঠকখানার ঘরে বসিয়া ডাইরি লেখা সমাপ্ত করিয়া ঘড়ি দেখিলাম বেলা চার ঘটিকা বাজে। রাত সাড়ে দশটার আগে গাড়ি নাই। স্থির করিলাম স্টেশনের রিটায়ারিং রুমে বিশ্রাম লইয়া সময় কাটাইব। ইহা জানাইতে ভবেশবাবু বলিলেন, "ঝগড়ু তবে টাঙ্গা ডেকে নিয়ে আসুক।" আমি স্থির করিয়াছিলাম, হাঁটিয়াই যাইব। হাতে অজস্র সময়। কিছুটা সময়ও কাটিবে, কিঞ্চিৎ শারীরিক ব্যায়ামও হইবে। ভবেশবাবু বলিলেন, "ঝগড়ু তবে সঙ্গে যাক। মাল বইতে পারবে।" আমি আপত্তি করিলাম না।
রোদ পুরোপুরি পড়িবার পূর্বেই এক পেয়ালা চা সেবন করিয়া পদদলে স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। সঙ্গে ঝগড়ু মাথায় গামছার বিড়ে বাঁধিয়া, তাহাতে সুটকেস বসাইয়া সঙ্গে চলিল। রোদ পড়িয়া আসিতেছে। সেই সঙ্গে শীতের কামড়ও ক্রমশঃ জোরদার হইয়া উঠিতেছে। সিগারেট সেবনেও শীতের আক্রমণ হইতে রক্ষা নাই। ভাবিলাম ঝগড়ুর সহিত বাক্যালাপে মন বিক্ষিপ্ত হইবে। জানিলাম বড়বাবু, অর্থাৎ মামাবাবু খেয়ালি লোক ছিলেন। কখন কী যে করিবেন ঝগড়ু তাহার ঠাহর পাইত না। কখনও পান হইতে চুন খসিলে হাতে মাথা কাটিতেন, কখনও আবার দু-হাত ভরিয়া দক্ষিণা দিতেন। সেই তুলনায় মাইজি অনেক নরমসরম মানুষ। বাবুজি, অর্থাৎ, ভবেশবাবুও শান্তচিত্ত ব্যক্তি।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটিয়া স্টেশন চত্বরে পৌঁছিলাম। ছোট স্টেশন হইলেও বাঙালি চেঞ্জারদের সুবাদে একটি চলনসই রিটায়ারমেন্ট রুম আছে। সুটকেসটি ক্লোকরুমে জমা করিয়া থানায় গিয়া তিওয়ারির সঙ্গে দেখা করিলাম, যদি কোন নূতন সংবাদ থাকে তাহার আশায়। নূতন সংবাদ ছিল। তিওয়ারি জানাইলেন আসানসোল জংশন স্টেশনের শৌচাগারে একটি পরিত্যক্ত বর্ষাতি ও তন্মধ্যে একখানি রক্তাক্ত ছুরি পাওয়া গেছে। মনে করা হইতেছে ইহাই শিবকালী-হত্যার অস্ত্র। খুনী হুঁশিয়ার লোক, বর্ষাতি পরিয়া খুন করিতে গিয়াছিল যাহাতে পোষাকে রক্তে ছিটা না লাগে। বর্ষাতি ও অস্ত্র পরীক্ষাগারে পাঠানো হইয়াছে রক্ত পরীক্ষা ও আঙুলের ছাপ পরীক্ষার জন্য। পূর্বপ্রতিজ্ঞামত ব্যোমকেশের জন্য রিপোর্টের একটি নকলও দিলেন।
চার
পরদিন ফিরিয়া দেখিলাম গৃহ পরিপূর্ণ। খোকা ও সত্যবতী ফিরিয়া আসিয়াছে। খোকা বাড়িময় দৌরাত্ম্য করিয়া বেড়াইতেছে। সত্যবতী তাহার পশ্চাতে কখনও দুধের বাটি, কখনও জামা লইয়া ছুটিতেছে। ঋষিবাক্য মিথ্যা নয়। সত্যই গৃহিণী গৃহমুচ্যতে। সত্যবতীর উপস্থিতিই গৃহের শ্রী প্রদান করিয়াছে যা একমাস যাবৎ অনুপস্থিত ছিল। সত্যবতী ও খোকার কুশলবাদ নিয়া, খোকাকে আদর করিয়া, এক কাপ ধূমায়মান চা গলাধঃকরণ করিয়া আমি স্নানে যাইবার আগে ব্যোমকেশের হস্তে আমার ডাইরি ও পুলিশের রিপোর্টটি সমর্পণ করিয়াছিলাম। স্নানে দু-রাত্রির রেলযাত্রার ক্লান্তি অনেকটাই অপনোদন হইল। স্নান সারিয়া আসিলে দেখিলাম ব্যোমকেশ দুইই পড়িয়া ফেলিয়াছে। বলিল, "মোটামুটি সব প্রশ্নই করেছ দেখলাম, শুধু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো বাদে।" আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "কীরকম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন?" ব্যোমকেশ বলল, "এই যেমন টাঙ্গায় যখন শিবকালীবাবু পৌঁছলেন, তখন ঝগড়ু কী করছিল?" ব্যোমকেশ রসিকতা করিতেছে কিনা ঠাহর করিতে পারিলাম না।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল "তুমি ঘটনাপ্রবাহ কী বুঝলে, বলো।" আমি রেলে আসিতে আসিতে ভাবিয়াছিলাম। নিজের যুক্তিপারম্পর্য্যে ছিদ্র পাই নাই। তাহাই ব্যোমকেশকে বলিলাম। "মূল সন্দেহভাজন হল ঝি। ঝিয়ের সঙ্গে খুনীর কোনরকম যোগসাজস আছে। ভেবে দেখো, একতলায় ঝি আর শিবকালীবাবু আছেন। রান্নাঘরের জানলায় এসে খুনী কোনরকম সংকেত দিল। ঝি গিয়ে শিবকালীবাবুর ঘরের দরজা খুলে খুনীকে ভেতরে আসতে দিয়ে দরজা আবার বন্ধ করে দিল। সে তারপরে রান্নাঘরে চলে গেল। রেবাদেবী দোতলায় আছেন। খুনী বৈঠকখানায় শিবকালীকে খুন করে বৈঠকখানার দরজা খুলে পালিয়ে গেল।"
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, "কী ব্যাপার অজিত? আজ যে একেবারে যুক্তি মেনে কথা বলছ? তোমার এই থিওরি মেনে নিলে আসানসোল জংশনে বর্ষাতি আর অস্ত্র ফেলে যাবারও একটা অর্থ পাওয়া যায়।" ব্যোমকেশ আমার থিওরি মানিয়া লইতেছে দেখিয়া খুশীর সীমা রহিল না। "ঠিক। জংশনে নেবে খুনী যেকোন লাইন ধরে চলে যেতে পারে। যাবার পথে বর্ষাতি আর অস্ত্র ফেলে গেছে। ওগুলো বওয়ার আর মানে নেই।" ব্যোমকেশ বলিল, "ঠিকই, ঠিকই। তোমার যুক্তিতে ফাঁক নেই। কিন্তু কিছু একটা খটকা লাগছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না, খটকাটা কিসে। এটা সময় নিয়ে ভাবতে পারলে ভাল হল। কিন্তু কমিশনার সাহেবের কাজে এমন ফেঁসে আছি, আর কিছু ভাবতে পারছি না। সে কাজ শেষ হলে এটা নিয়ে ভাবব।"
পরবর্তী সাত দিন ব্যোমকেশ নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়া নিজের ঘরে বন্ধ হইয়া রহিল। মাঝে মাঝে বিকাশ আসে। দন্তবিকশিত করিয়া ব্যোমকেশের ঘরে ঢুকিয়া যায়, আবার দন্তবিকশিত করিয়া বাহির হইয়া আসে। যে তদন্ত এতদিন ঢিমে-তেতালায় চলিতেছিল, সে হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে আরম্ভ করিল। তবে সে গাড়ির যাত্রী আমি নই, যাহা ঘটিতেছে তাহা গোপন সরকারী বিষয়, আমার জানার অধিকার নাই। আমি সত্যবতীর নিকট তাহাদের বিহারবাসের কাহিনী শুনিতাম। তাহার সিংহভাব খোকার কার্যকলাপের বিবরণ। বৈকালে খোকাকে লইয়া পার্কে যাইতাম। খোকা খেলা করিত, আমি বৈকালিক ভ্রমণ সম্পূর্ণ করিতাম। মাঝে জামতাড়ার কথা ভাবিতাম। কিন্তু ব্যোমকেশের অবস্থা দেখিয়া কিছু বলিবার সাহস করিতাম না।
সাতদিন পরে, এক সন্ধ্যেয় ব্যোমকেশ বিজয়ীর হাসি লইয়া কক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসিল। কেস সমাধান হইয়াছে। টেলিফোন করিয়া পরদিন কমিশনার সাহেবের সহিত সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করিল। তাহার যে ভবেশবাবুর কেসের কথা কিছু স্মরণে আছে তাহা মনে হয় না। সাতদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের অব্যবহিত পরেই সেই কথা মনে করাইতে পারিলাম না। স্থির করিলাম কমিশনারের সহিত সাক্ষাৎ ভালয়-ভালয় মিটিয়া গেলে, সে কথা উত্থাপন করিব।
পরদিন সকাল সকাল ব্যোমকেশ কমিশনার সাহেবের সহিত বৈঠক করিতে বাহির হইয়া গেল। ফিরিল দ্বিপ্রহর পার করিয়া। বলিল, "খবর আছে। বিহার কমিশনারের কাছে থেকে বিশেষ অনুরোধ এসেছে। শিবকালীবাবুর খুনের তদন্তে বাংলা পুলিশের সহযোগিতা চেয়ে। কারণ তদন্ত দুই রাজ্য জুড়ে চলছে। এক সপ্তাহের ওপর হয়ে গেছে। পুলিশ কোন সূত্রই ধরতে পারেনি। তাই কমিশনারসাহেব আমাকে অনুরোধ করেছেন, আমি যেন বাংলা পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত চালাই। যত শীঘ্র সম্ভব অকুস্থলে যেতে হবে। নইলে বিহার পুলিশ মনে করতে পারে বিহার কমিশনারের অনুরোধকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আজ অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। অজিত, সকালে গিয়ে কাল রাতের ট্রেনের দুখানা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে আন। শাস্ত্রে আছে, অপরের ধনক্ষয় হলে ফার্স্ট ক্লাসে যাওয়াই বিধেয়।" কোন শাস্ত্রে এমন জ্ঞানগর্ভ বিধান আছে মনে করিতে পারিলাম না, কিন্তু ফার্স্ট ক্লাসের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। ট্রেনে ঘন ঘন রাত্রিযাপন সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। আমাদের ভ্রমণ সম্ভাবনায় সত্যবতী একেবারেই প্রসন্ন হয় নাই। ব্যোমকেশ সত্যবতীর দিকে মিটিমিটি হাসিয়া আবৃত্তি করিল, "আমরা যাব জামতাড়াতে, চড়ব কেমন ট্রেইনে/ চ্যাঁচাও যদি সঙ্গে নে যাও বলবে কলা এই নে"। সত্যবতী 'আদিখ্যেতা' বলিয়া মুখঝামটা দিয়া রান্নাঘরে প্রস্থান করিল। খোকাকে একখানি 'খাই-খাই' কিনিয়া দিয়াছি। পুরাতন অভ্যাসমত ব্যোমকেশ সেটিও আগাগোড়া মুখস্থ করিয়া রাখিয়াছে, এবং সময়ে সময়ে আবৃত্তি করিতেছে।
পরদিন সকালে উঠিয়া ব্যোমকেশ মত পরিবর্তন হইল। বলিল, সেও আমার সহিত রেলওয়ের টিকিট খরিদে বাহির হইবে। আমরা বাহির হইতে যাইব, এমন সময়ে দন্তবিকশিত করিয়া বিকাশের আবির্ভাব। বোধ করি, পূর্বকর্মনিমিত্ত তাহার কিছু পাওনা ছিল। ব্যোমকেশ তাহার হাতে অর্থ দিয়া বলিল, "বিকাশ আরেকটা কাজ করতে হবে। এও সরকারী কাজ। বিডন স্ট্রিটে ভবেশ মিত্র আর শিবকালী দত্ত সম্বন্ধে খবর জোগাড় করতে হবে। আমরা আজ রাতের গাড়িতে জামতাড়া যাচ্ছি। তার আগে খবর চাই।" বিকাশ চলিয়া গেলে আমরাও বাহির হইলাম। রেলের টিকিট খরিদ হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "অতঃপর?" ব্যোমকেশ বলিল, "চল লালবাজার যাই।" আমি বলিলাম, "তোমাদের ওই সরকারী দপ্তরে ঘোরাঘুরি আমার পছন্দ হয় না।" সে "এসই না" বলিয়া আমাকে লইয়া লালবাজারে চলিল। কিন্তু পুলিশের সদর দপ্তর এড়াইয়া একটি দোকানে ঢুকিয়া প্রশ্ন করিল, "দত্তদের হার্ডওয়্যারের দোকান কোনখানা বলতে পারেন?" বুঝিলাম শিবকালীবাবুর খুড়াতুতো ভ্রাতুষ্পুত্রের সাক্ষাতের চেষ্টা করিতেছে। প্রথম দুইটি দোকান সংবাদ দিতে পারিল না। তৃতীয় দোকানে সংবাদ মিলিল। সেই মত যাইয়া বড়রাস্তার উপরই একটি পুরানো দোকানের সামনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। দোকানটি প্রশস্ত। উপরে সাইনবোর্ডে দোকানের নাম খোদাই করা - "দত্ত মার্ট, জেনেরাল মার্চেন্ট"। দেখিয়া বুঝা যায় দোকানের একদিন সুদিন ছিল, এবং এখন আর তাহা নাই। দুইটি দরজার একটি দিয়া আমরা প্রবেশ করিলাম। কিছু অবিক্রিত হার্ডওয়্যারের দ্রব্য ইতস্তত ছাওড়াইয়া আছে। কাউন্টারে এক বয়স্ক লোক টুলে বসিয়া উৎসুক হইয়া আমাদের দিকে চাহিয়া ছিলেন। ব্যোমকেশ সটান তাহার কাছে যাইয়া প্রশ্ন করিল, "আপনি কি দোকানের মালিক? মালিকের সঙ্গে আমার প্রয়োজন আছে।" ভদ্রলোক মুখ কিছু না বলিয়া দোকানের অপর পার্শ্বে, অন্য দরজার সম্মুখে চেয়ার-আরূঢ় এক যুবককে দেখাইয়া দিলেন। ব্যোমকেশ নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, "উনিই সাধনবাবু?" ভদ্রলোক বলিলেন, "সুধীর দত্ত"। যুবকটি গলায় মাফলার জড়াইয়া বসিয়া কাশিতেছিল। সামনে একটি ধূলিমলিন সবুজ কাপড়ের আস্তরণ দেওয়া টেবিলে ততোধিক পুরাতন কিছু ফাইল। যুবক আমাদের দেখিয়াও দেখিল না। আমরা টেবিলের অপরদিকে দুইটি চেয়ারে বসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, "নমস্কার। আমার নাম গগন মিত্র আর ইনি সুজিত বন্দোপাধ্যায়। ইনি মধুপুর-জামতাড়া অঞ্চলে একটি বাড়ি কিনতে চান। শুনলাম পারিবারিকসূত্রে আপনার একটি বাড়ি আছে। আপনি কি সেটি বিক্রি করবেন? ইনি ভাল দাম দিতে রাজী আছেন।" যুবকটি পুনরায় সেই রূঢ় স্বরেই কহিল, "বাড়ির খবর কোথায় পেলেন?"
- আমাদের এসব খবর রাখতে হয়।
- না, বাড়ি বিক্রি হবে না।
- ভাল দাম পেলেও না?
- বললাম তো, হবে না।
- আপনিই সেই বাড়ির মালিক? আর কোন শরিক আছে?
- সে খবরে আপনার কী দরকার?
- মালিক অন্য হলে তাহলে তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারি।
- বলুন।
- মালিকানা কার?
- নিজে বের করে নিন। ভূপতি, ভূপতি - কাজের সময় আজেবাজে লোক ঢোকাও কেন? আচ্ছা, আপনারা আসুন।
আমরা বাহির হইয়া আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, "এক ধরণের লোক আছে, যারা আগে সুদিন দেখেছে। কিন্তু এখন আর সে সুদিন নেই। সুদিন যে ফিরিতে আনবে সে উদ্যোগও নেই। অপেক্ষা করে আছে কিছু একটা ঘটে যাবে।"
ইহার পরে ব্যোমকেশ লালবাজারে পুলিশের সদর দপ্তরে চলিয়া গেল। আমি গৃহে ফিরিয়া আসিলাম। সেই যে গেল, বিকেলের আগে তাহার দেখা পাইলাম না। ক্লান্ত হইয়া যখন ফিরিল তাহার চেহারা দেখিয়া অনুমান করিলাম যে বিবিধ স্থানে ঘুরিয়া আসিয়াছে। তাহার স্নানাহার ও বিশ্রামের পরে অধিক সময় ছিল না। আমরা স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
আমরা প্ল্যাটফর্মে ঢুকিবামাত্র বিকাশ কোথা হইতে উদয় হইল। বুঝিলাম, সংবাদ আনয়ন করিয়াছে। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, "কী কী খবর জোগাড় করতে পারলে বিকাশ?"
- খুব বেশি কিছু পাইনি স্যার। বেশি সময় পাইনি।
- তাও যা পেয়েছ বলো।
- বুড়ো খুব টেঁটিয়া লোক ছিল। পাড়ায় মিশত না। কিন্তু নানা লোকের সঙ্গে ঝামেলা বাঁধিয়েছে। একটা ছবির মেসিন বেচবে বলে দুটো লোকের থেকে অ্যাডভান্স নিয়ে বসে আছে, কিন্তু মেসিন দিচ্ছে না। বলছে অন্য মেসিন জাহাজে আসছে, সেটা এলে দেবে। এই দুটো লোকের দোকান আছে। ধর্মতলায়।
- এই দুটো লোকের খবর চাই।
- ঠিক আছে স্যার। ছেলে লাগাচ্ছি।
- আর কী পেলে?
- ভবেশ মিত্রর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। বাপ ত্যাজ্য করেছিল। বাড়ির অমতে নীচু ঘরে বিয়ে করেছিল। তার ওপর বউ অ্যাক্টিং করত। মানদাসুন্দরী নাম ছিল। তবে ত্যাজ্য করলেও বিডন স্ট্রিটের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল। কাঠের ব্যবসা আছে। সেটায় স্যার ছেলে লাগিয়েছি খবরের জন্যে।
- বাহ, অল্পসময়ে অনেক খবর হয়েছে।
বিকাশ হেঁ হেঁ করিল। তাহার পর কহিল, "আরেকটা স্যার বেফালতু নিউজ আছে। কিন্তু আপনি তো কোন নিউজই বাদ দেন না, তাই এটাও বলে দিই। মিত্তিরদের বাড়িতে ঝি-চাকর টেঁকে না। বড়জোর এক বছর।" ব্যোমকেশ বিকাশকে বলিল, নতুন খবর পাইলেই বাড়িতে আসিতে। "যদি দেখ, আমরা ফিরিনি, তার করে দিও।" বিকাশ বিরাটভাবে মাথা হেলাইয়া বিদায় নিল।
ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসের ঘরে বিছানা পাতিয়া বসিয়াছি। সত্যবতী লুচি, ডিমের ডালনা, মিষ্টান্ন ইত্যাদি ছাঁদা বাঁধিয়া দিয়াছে। তাহার সহিত ব্যোমকেশকে গঞ্জনা দিতেও পিছপা হয় নাই। ট্রেন ছাড়িলে অধিক বিলম্ব না করিয়া নৈশাহার সারিয়া লইলাম। তাহার পরে সিগারেট ধরাইয়া চৌকির ওপর আয়েস করিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, "আজ আর কোথায় কোথায় গেলে বলো।" ব্যোমকেশ বলিল, "প্রথমে গেলাম কমিশনার সাহেবের অফিসে। সেখানে সরকারী অভিজ্ঞান সংগ্রহ করলাম। আইডেন্টিটি কার্ড। সরকারী কাজে কখন দরকার পড়ে কে জানে! তারপরে গেলাম ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে দাঁ, মিত্র অ্যান্ড অ্যান্ডারসনের অফিসে।"
- সেখানে কী?
- দাঁ-মিত্র-অ্যান্ডারসন শিবকালীবাবুর উকিল ছিলেন। সেখানে নিজের পরিচয় দিয়ে খবর জোগাড় করলাম।
- কীরকম খবর?
- উকিলদের তো জান। সহজে কোন কথাই বলতে চায় না। শিবকালীবাবু যে মারা গেছেন সে খবরই তাদের কাছে ছিল না। শেষ পর্যন্ত জানতে পারলাম যে শিবকালীবাবুর পৈতৃক বাড়ি ছাড়া চারটে বাড়ি ছিল। তার মধ্যে দুটো বাড়ি শিবকালী বিক্রি করে দিয়েছেন। জামতাড়ার বাড়ি বিক্রির কথাও শুরু করেছিলেন। দলিলপত্র তৈরি করতে বলেছিলেন। শীতের ছুটি শেষ হলে খরিদ্দারের খোঁজ করবেন বলে গেছিলেন।
- এই কেসের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক আছে?
- থাকতেও পারে।
- তারপরে?
- তারপরে গেলাম জোড়াবাগানে। ভবেশবাবুর গোলায়। সেখানে জানলাম যে রবিবার সকালে ভবেশবাবু একবার গোলায় গেছিলেন। মিস্ত্রিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আশেপাশের অনেকগুলি গোলা। তাদের মধ্যে দুজন মালিকের সঙ্গে কথা হল।
- সেখানে কী পেলে?
- একগাদা বড় বড় কথা, আর মিষ্টিমুখে অন্য গোলার মালিকদের নামে সত্যিমিথ্যে নানারকম নিন্দেমন্দ।
- তার মানে কাজের কাজ কিছুই হয়নি?
- সে কথা বলা যায় না। ভবেশবাবুর গোলার ছ-সাতজন মিস্ত্রি এবছর অন্য গোলায় কাজ নিয়েছে। একজন সেটি খুব রসিয়ে বললেন।
- ব্যোমকেশ, আমি একটা কথা ভাবছি। এ যদি বাড়ির কারো কাজ হয়? মানে ধর ঝি আর ঝগড়ু ষড় করে কাজটা করেছে। আর এক কাল্পনিক লোকের কথা বানিয়ে বলেছে।
- অসম্ভব হয়ত নয়। কিন্তু যেকোন খুনে তোমায় দুটো জিনিস দেখতে হবে - সুযোগ আর মোটিভ। সুযোগ হয়ত এক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু মোটিভটা কী? তাছাড়া ঝি আর ঝগড়ু একদিনের পরিচয়ে ষড় করে ফেলল?
- তাহলে ঝি আর রেবাদেবী?
- না হে না। ছুরিটুরি মেয়েদের অস্ত্র নয়। তাছাড়া এখানেও মোটিভটা কী?
- আচ্ছা, তোমরা যে ক্রাইম অফ প্যাশন বল, এ সেরকম কিছু নয়ত।
ব্যোমকেশ হাহা করিয়া হাসিয়া উঠিল - "ক্রাইম অফ প্যাশন মানে ক্ষণিকের উত্তেজনায় খুন। বাড়ির ভেতরে এসে খুন করে যাওয়া ক্রাইম অফ প্যাশন নয়। তাও যদি চুরি-ডাকাতি করতে এসে বাধা পেয়ে খুন করে যেত, তার একটা মানে থাকত। এ ঠান্ডা মাথায় হিসেব কষে খুন। যাকগে কাল অকুস্থলে গিয়ে দেখা যাবে। আপাততঃ ঘুমনো যাক।" ব্যোমকেশ বিছানা পাতিয়া নিদ্রা যাইবার উপক্রম করিল।
পাঁচ
আবার সেই জামতাড়া স্টেশন। আবার সেই শীতের প্রকোপ। তবে এইবার টাঙ্গা সন্ধানের পূর্বেই তিওয়ারির সহিত সাক্ষাতের উদ্দেশে থানায় প্রবেশ করিলাম। থানায় অভ্যর্থনা ভিন্ন হইল। তাহা আমাকে চিনিবার ফলে না ব্যোমকেশের তদন্তের ভার লইবার সন্দেশে বুঝিতে পারিলাম না। খবর পাইয়া উর্দি চাপাইয়া তিওয়ারি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আর এক প্রস্থ কুশল সংবাদ আদানপ্রদান হইল। তিওয়ারির কথায় বুঝিলাম তিনি যে কোনদিন ব্যোমকেশের আগমন প্রত্যাশা করিতেছিলেন। এইবারও চা-জিলিপি আসিল। সঙ্গে গরম নিমকি। শীতের কামড় কিছু আলগা হইল।
তদন্তের দিকে অপ্রত্যাশিত কিছু খবর নাই। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসিয়াছে। তিওয়ারি ব্যোমকেশকে পড়তে দিলেন। পড়িতে পড়িতে ব্যোমকেশের ভ্রূ ঊর্ধ্বপানে উঠিল। "খুনের আগে ক্লোরোফর্ম করেছে। তাই কাঁচা হাতে তিন বার ছুরি চালাতে পেরেছে নির্বিঘ্নে। শেষ আঘাত গিয়ে হৃদপিণ্ড ফুঁড়ে দিয়েছে আর তাতেই মৃত্যু। তিওয়ারিজী, আপনি যখন তদন্তে গেলেন তখন ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন দেখেছিলেন?" তিওয়ারিজী বলিলেন, "ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখার কোন উপায় ছিল না। ঘরে আসবাব তো বিশেষ ছিল না। যা ছিল তাও ভিক্টিমের শুশ্রূষার জন্যে নৌকরানী আর ভাবীজী কোণে সরিয়ে দিয়েছিলেন। একটা চৌকি ছিল, কিন্তু কোন চাদর বা তাকিয়া না থাকায় সেখানেও কোন ধস্তাধস্তি হয়েছে কিনা তার চিহ্ন পাবার উপায় ছিল না।" ব্যোমকেশ বলল, "ধস্তাধস্তি একটা হবার কথা। একজন লোকটাকে জোর করে নাকে ক্লোরোফর্ম দিল, ধরে নিচ্ছি রুমালেই দিয়েছিল, আর লোকটা কিছু বলবে না, কিছু করবে না সেটা অস্বাভাবিক। মৃতের সঙ্গে কী ছিল?" তিওয়ারি একজন কনস্টেবলকে ডাকিলেন। সে একটি বাক্স আনিয়া তাহার ভিতর হইতে কতকগুলো সামগ্রী বাহির করিয়া টেবিলে রাখিল। একটি ওমেগা ঘড়ি, একটি এস মনোগ্রাম করা রূপার সিগারেট কেস, একটি রূপা ও ব্যাকেলাইট নির্মিত সিগারেট-হোল্ডার, একটি ঘোড়া-মার্কা অর্ধপূর্ণ দেশলাইয়ের বাক্স। ব্যোমকেশ সিগারেট কেস খুলিয়া দেখিল। দুটি গোল্ড ফ্লেক সিগারেট তখনও অবশিষ্ট আছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের সহিত একটি কাগজে এইসকল বস্তুর একটি তালিকাও ছিল। সেই তালিকায় দেখিলাম মৃত্যুকালে মৃতের দেহে অন্তর্বাস ভিন্ন একটি সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট ও সাদা সোয়েটার ও একটি ধূসর বর্ণের ভেস্ট ছিল। তিওয়ারি আরও দুইটি সংবাদ দিলেন। ল্যাবরেটরি হইতে অস্ত্র পরীক্ষার রিপোর্টও আসিয়াছে। প্রথম খবর হল এই যে আসানসোল জংশনে প্রাপ্ত অস্ত্র দ্বারাই শিবকালীবাবুকে হত্যা করা হইয়াছে। এবং দ্বিতীয় খবর এই যে, অস্ত্রে কোনরূপ আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় নাই। খুনী অত্যন্ত সাবধানতার সহিত সকল চিহ্ন মুছিয়া দিয়াছে। ইহা ভিন্ন আরও একটি সংবাদ ছিল। পুলিশ শহরের সব টাঙ্গাওয়ালাদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছে। এক টাঙ্গাওয়ালা জানাইয়াছে খুনের রাতে এক সাহেবী পোষাক পরিহিত যাত্রী স্টেশন হইতে তাহার টাঙ্গার সওয়ারি হইয়া শিবকালীর মহল্লায় একটি নির্জনস্থানে অবতরণ করেন। সওয়ারির মাথায় টুপি, পরনে কোট-প্যান্ট ছিল। মুখমণ্ডল গুম্ফ-শ্মশ্রু-আচ্ছাদিত।
ব্যোমকেশ যশোদাভবনে যাইবার ইচ্ছাপ্রকাশ করিল। ব্যোমকেশ সরকারী কর্মে আসিয়াছে। কাজেই টাঙ্গা নহে, তিওয়ারি বলিলেন যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিলেই সরকারী জিপে তিনি আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন। ব্যোমকেশ বলিল, "কিন্তু আমি যে পুলিশের হয়ে তদন্ত করছি, সে কথা এখনই জানাতে দিতে চাই না। আমরা একটা টাঙ্গা ধরেই চলে যাব। আপনি বরং আমাদের দুপুরের খাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে রাখবেন।" মালপত্র তিওয়ারির জিম্মায় রাখিয়া ব্যোমকেশের সহিত আবার টাঙ্গায় বসিয়া বিহারের সকালের শীতের হাওয়ার ঝাপটা খাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম।
ভবেশবাবুই দরজা খুলিলেন। ব্যোমকেশকে দেখিয়ে ক্ষণিকের জন্য হতচকিত হইয়া পড়িয়াছিলেন বটে, কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলাইয়া আমাদের আপ্যায়ন করিলেন। আমরা প্রায়ান্ধকার বৈঠকখানার ঘরে বসিলাম। ভবেশবাবু আমাদের বসিতে বলিয়া ভিতরে চলিয়া গেছিলেন। ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, "চায়ের ব্যবস্থা করতে বললাম। আমিও থানায় যাব বলেই তৈরি হচ্ছিলাম। আজ সকালে আমাদের ঝি-টি পালিয়েছে।" আমি ও ব্যোমকেশ যুগপৎ বলিয়া উঠিলাম, "সে কি!" ভবেশবাবু বলিলেন, "সকালে নীচে এসে দেখি বৈঠকখানার দরজা খোলা। ভাবলাম ঝি বোধহয় কোন কাজে বাইরে গেছে। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরেও যখন এল না, আমি বাইরে বাগানে গিয়ে খুঁজলাম। পেলাম না। ঝগড়ু, আমাদের মালি, তাকে জিগেস করলাম। সেও বলল দেখেনি। তখন ফিরে এসে রেবাকে বললাম। রেবা দেখে বলল, জিনিসপত্রও কিছু নেই।" ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, "জিনিসপত্র কী ছিল?" ভবেশবাবু আতান্তরে পড়িলেন, "এ খবর তো আমি দিতে পারব না ব্যোমকেশবাবু। রেবাকে জিগেস করতে হবে।" ব্যোমকেশ বলিল, "সে নাহয় পরে করা যাবে। এই কদিনে নতুন কিছু ঘটেছে কিনা বলুন? কোন কিছু অস্বাভাবিক চোখে পড়েছে?" ভবেশবাবু হাত উল্টাইয়া বলিলেন, "একেবারেই গতানুগতিক ব্যাপার ব্যোমকেশবাবু। কিছুই ঘটেনি। ইচ্ছে ছিল কলকাতায় ফিরে মামাবাবুর পারলৌকিক কাজ করব। কিন্তু দারোগাবাবু এখন জামতাড়া ত্যাগ করতে বারণ করেছেন। তাই এখানকার পুরোহিত ডাকিয়েই নমোনমো করে সেরে নিলাম। সে ছাড়া আর কোন বলবার মতন ঘটনা ঘটেনি।"
ব্যোমকেশ ঘরগুলি দেখিবার ও ঝগড়ুর সহিত কথা বলিবার ইচ্ছা ব্যক্ত করিলে ভবেশবাবুর সহিত আমরা ঘর পরিদর্শনে বাহির হইলাম। ঘরগুলির বিবরণ আগেই দিয়াছি। আজ কোন পরিবর্তন চোখে পড়িল না। ব্যোমকেশ মামাবাবুর ঘরে দেরাজের উপর রাখা ফাইলগুলি নাড়াচাড়া করিয়া দেখিল। তাহার অধিকাংশই বিভিন্ন দোকানের রসিদ। একটি ফাইলে কোন দলিলের খসড়া রহিয়াছে। ইহার পরে ব্যোমকেশ দেরাজগুলি টানিয়া দেখিল। কাপড়জামা ও ছবির তুলিবার সরঞ্জাম ব্যতীত আর একটি জিনিস মিলিল, সেটি তিওয়ারির তদন্তকালে দেখিয়াছিলাম বলিয়া স্মরণ হইল না। সেটি হল একটি চামড়ার মানিব্যাগ। ব্যোমকেশ খুলিল। ভিতরে কিছু খুচরো টাকা ও পয়সা ভিন্ন দুটি দোকানের রসিদ - একটি গরম পোষাক ধুইবার লন্ড্রির, অন্যটি ধর্মতলার একটি ক্যামেরার দোকানের। ব্যোমকেশ দেখিয়া রাখিয়া দিল। দ্বিতলে গিয়া রেবাদেবীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। পূজার ঘরে দেবতার আসন সাজাইতেছিলেন। ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় দিয়া প্রশ্ন করিল, "আপনার সঙ্গে মামাবাবুর সম্পর্ক কেমন ছিল? মাফ করবেন, এ প্রশ্নটা হয়ত খুব শালীন নয়, কিন্তু অবস্থাগতিকে করতেই হচ্ছে।" রেবাদেবী শান্তভাবে জবাব দিলেন, "আপনার যা কাজ তা তো আপনাকে করতে হবে। মামাবাবু আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আমার সঙ্গে সম্পর্ক না হলে কী আর এতদিন একসঙ্গে থাকতে পারতেন? তবে অল্পকথার মানুষ ছিলেন। বছরে যে কটা কথা আমার সঙ্গে হত হাতে গুণে বলা যায়। রাগী মানুষ ছিলেন। অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যেত। তার ঝড়ঝাপটা অবশ্য পুরোটাই চাকরবাকরদের ওপর দিয়ে যেত। তাই আমাদের বাড়িতে চাকর বেশিদিন টেঁকে না। আগের চাকর ওই কারণেই কাজ ছেড়ে চলে গেল।"
- সেটা কবে?
- কবে? গেল মাসে একাদশীর পরের দিন।
- চাকর কতদিন কাজ করেছিল?
- সে প্রায় এক বছর হবে। গেল অঘ্রাণে কাজে লেগেছিল। বছরপোরার আগেই চলে গেল।
- সে কোথাকার লোক ছিল জানেন?
- বলেছিল মেদিনীপুরের। কথায় টানও ছিল। খুব দোক্তাপান খেত।
- সে চলে যাবার পরেই এই ঝি এল?
- হ্যাঁ। মেনকা।
- একে পেলেন কীভাবে?
- এমনি একদিন সদরে কড়া নেড়ে বলল লোক লাগবে?
- আপনি রেখে দিলেন?
- বলল, থাকা-খাওয়া, বছরে দুটো শাড়ি আর মাসে বারো টাকা মাইনে।
- বাড়ি কোথায় বলেছিল?
- হালিশহর।
- সঙ্গে কী ছিল?
- একটা টিনের বাক্স আর তেলচিটে বিছানা।
- সঙ্গেই ছিল?
- না, পরের দিন নিয়ে এল। আমি ওনাকে বলে একটা সতরঞ্চি কিনে দিয়েছিলাম।
- সেগুলো এখানে এনেছিল?
- হ্যাঁ।
- সেগুলো নিয়েই চলে গেছে?
- হ্যাঁ। বাক্স আর বিছানা নেই দেখেই তো বুঝলাম ঝি পালিয়েছে।
- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়।
- না।
আমরা চলিয়া আসিলাম। ঘর দেখা শেষ হইলে ব্যোমকেশ বাগানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিল, বিশেষতঃ পাঁচিলের চারপাশ। ফটকের কাঠের পাল্লা দুচারবার খোলাবন্ধ করিল। তাহার পরে ভবেশবাবুকে বলিল, "চলুন আপনার মালির সঙ্গে কথা বলা যাক।" আমরা তিনজন বাগানের পিছনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মালির ঘরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া ভবেশবাবু 'ঝগড়ু, ঝগড়ু' বলিয়া হাঁক পাড়িতে ঝগড়ু আসিল, কিন্তু ঘরের ভিতর হইতে নহে, পিছনের প্রাচীর গাত্রের ছোট একটি দরজা খুলিয়া। বলিল দোকানে গিয়াছিল লবণ খরিদ করিতে। মাইজি সকালে বলিয়াছিলেন। ভবেশবাবু জানাইলেন, বাড়ির পিছনে দশ মিনিটের হাঁটাপথে একটি ছোট মুদির দোকান আছে। গৃহের আপতকালীন চাহিদা সেইখান হইতেই মিটিয়া যায়। হপ্তাকাবারি ও মাসকাবারি বাজারের জন্যে শহরে যাইতে হয়। ব্যোমকেশ ঝগড়ুকে জিজ্ঞাসা করিল তাহার দেশ কোথায়। ঝগড়ু উত্তর করিল, 'জিলা ছাপরা।' ব্যোমকেশ সকলের আদি বাড়ির সন্ধান করিয়া কেন ফিরিতেছে তাহা বোধগম্য হইল না। ব্যোমকেশের প্রশ্নের জবাবে ঝগড়ু জানাইল মৃত্যুর দিন বৈকালে বড়বাবু ভ্রমণ সারিয়া ফিরিবার কালে তাঁহাকে সে শেষ দেখিয়াছে। ঝগড়ু এও জানাইল, সে পারতপক্ষে বড়বাবুর সম্মুখে যায় না। বড়বাবুর মেজাজের স্থিরতা নাই। কী কথা হইতে মেজাজ বিগড়াইয়া যাইবে তাহা ঝগড়ুর অনুমানের অতীত। উদাহরণ হিসেবে ঝগড়ু জানাইল, এই দু দিন আগে যখন আসিলেন, সবে বড়বাবু ও মাইজি টাঙ্গা হইতে নাবিয়ে ঘরে ঢুকিয়াছেন, মাইজি আসিয়া বলিলেন, বড়বাবুর খুব গুসসা হইয়াছে নিজের ঘরে দেশলাই না পাইয়া। তখনই সব ফেলিয়া ঝগড়ুকে দেশলাই কিনিতে ছুটিতে হইল, অথচ ঝগড়ু হলফ করিয়া বলিতে পারে আগের দিনই সে আধডজন দেশলাই সে কিনিয়া রাখিয়াছিল। তবে প্রতিবারই ফিরিয়া যাইবার সময় ঝগড়ুকে আশাতীত বখশিস করিয়া যাইতেন। বড়বাবুর মৃত্যুতে শোকাহত না হইলেও নিজের মতন করিয়া দুঃখপ্রকাশ করিল।
ঝগড়ুর সহিত কথোপকথন সমাপ্ত করিয়া আমরা ফিরিয়া চলিলাম। যে টাঙ্গায় আসিয়াছিলাম, ব্যোমকেশ তাহাকেই বসাইয়া রাখিয়াছিল। এমনিতেও ফিরতি সওয়ারি পাইত না। তাহার ওপর ব্যোমকেশ কিছু অতিরিক্তও কবুল করিয়াছিল। সেই টাঙ্গায় চড়িয়া আমরা ফিরিয়া চলিলাম।
ছয়
মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা হইয়াছিল থানার হাতার অন্তর্বর্তী তিওয়ারিজীর বাসস্থানে। চৌকি পাতিয়া আচার সহযোগে গরম ঘি-নিষিক্ত পরোটা ও বিভিন্ন ভাজি দিয়া উৎকৃষ্ট ভোজনান্তে আমরা থানায় বসিয়া বিশ্রম্ভালাপ করিতেছিলাম। তিওয়ারি জিজ্ঞাসা করিলেন, "অতঃপর?" ব্যোমকেশ অলসভাবে সামনে পড়িয়া থাকা বাসী সংবাদপত্র উল্টাইতেছিল। বলিল, "পুরো ঘটনাটায় একজন পুরুষমানুষ আছে। তাকে যতক্ষণ না ধরা যাচ্ছে, কিছু করার নেই।" তিওয়ারি বলিল, "তাকে ধরার জন্য কিছু ক্লু তো লাগবে।" ব্যোমকেশ বঙ্কিম হাসিয়া বলিল, "ক্লু তো আছে। জংশনে নেবেছিল।" বলিয়া হাতের কাগজখানি টেবিলে নিক্ষেপ করিল। বুঝিলাম ব্যোমকেশ হতাশ হইয়া পড়িতেছে। আমি বলিলাম, "সত্যিই কোন উপায় নেই?" ব্যোমকেশ বলিল, "একমাত্র উপায় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা, কখন খুনী ভুল করে। মনে রেখো যদি পোড়-খাওয়া অপরাধী না হয়, সে তাহলে খুব চাপে আছে। তিনবার ছুরি চালান দেখে মনে নয় পোড়-খাওয়া অপরাধী নয়। কাজেই ভুল সে করবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।" এই বলিয়া কিয়ৎক্ষণ চেয়ারে বসিয়া চক্ষু বুজিয়া কী যেন ভাবিল। তাহার পরে টেবিলে পড়িয়া থাকা ব্র্যাডশখানা তুলিয়া বলিল, "কাজ যখন নেই তখন দেখা যাক জংশন দিয়ে ওই সময়ে কোন কোন দিকে ট্রেন যায়।" এই বলিয়া সে পরীক্ষার পড়ার মতন মনোযোগে ব্র্যাডশ অধ্যয়নে বসিল। বাহিরে দ্বিপ্রহরের মিঠে-কড়া রৌদ্র, কবুতরের ডাক, পেটে ঘিয়ের আস্তরণ আমার দুই চক্ষু বুজাইয়া দিতেছিল। শরীর শিথিল হইয়া আসিতেছে এমন সময় ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া দেখি সে শিরদাঁড়া সোজা করিয়া বসিয়াছে, দুচোখের মণি স্থির। এ দৃষ্টি আমি চিনি। সে কিছুর সন্ধান পাইয়াছে। কাহাকেও কিছু না বলিয়া ব্যোমকেশ বাহির হইয়া গেল। তিওয়ারি কিছু বলিতে যাইতেছিলেন, আমি হস্তসঞ্চালনে তাহাকে রোধ করিলাম।
প্রায় অর্ধঘন্টা বাদে ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিল। আসিয়াই তিওয়ারিকে বলিল, "তিওয়ারিজী এখনই জিপ বের করতে বলুন। যোগমায়া কুঠি যেতে হবে। সঙ্গে দুজন কনস্টেবল নিন, গ্রেপ্তারি থাকতে পারে।" দশ মিনিটের মধ্যে পুলিশের জিপে আমরা যোগমায়া কুঠির উদ্দেশে যাত্রা করিলাম।
যোগমায়া কুঠিতে গিয়া দেখিলাম সব আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ। একটিও দরজা বা জানালা খোলা নাই। সামনের দরজায় অনেকবার করাঘাত করা হইল। কোন উত্তর আসিল না। ব্যোমকেশ বলিল, "চলুন খিড়কির দরজা দেখা যাক।" আমরা পিছনের দরজায় গিয়া দেখিলাম, সেটিও বাহির হইতে বন্ধ, হুড়কো হইতে তালা ঝুলিতেছে। সেখান হইতে মালির ঘরে যাওয়া হইল। ঝগড়ু-ঝগড়ু বলে ডাকিয়া কোন সাড়া পাওয়া যাইল না। আমরা হতোদ্যম হইয়া সামনের দাওয়ার ক্যানভাসের চেয়ারে বসিয়া পরবর্তী কর্মপদ্ধতি স্থির করিতেছি, এমন সময় গেট ঠেলিয়া ঝগড়ু প্রবেশ করিল। সে কোথা হইতে ফিরিতেছে। জিজ্ঞাসা করিতে জানাইল আমি ও ব্যোমকেশ প্রস্থান করিবার অব্যবহিত পরেই বাবুজি ও মাইজি বেনায় গিয়া বাস ধরিয়া চলিয়া গিয়াছেন। কোথায়, তাহা ঝগড়ু জানে না। সে তাহাদের মাল বহিয়া, বাসে তুলিয়া ফিরিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, "এইটা মন্দের ভাল হল।" আমি মন্দ বা ভাল কোন অংশই বুঝিলাম না। তিওয়ারির মুখ দেখিয়া মনে হইল তাহার অবস্থাও অনুরূপ। আমি বলিলাম, "কী বলছ, ভাল করে খুলে বলো।" ব্যোমকেশ একটি সিগারেট ধরাইয়া পায়চারি করিতে শুরু করিল। "তোমরা কিছুই বোঝনি?" আমি ও তিওয়ারি দুজনেই নিঃশব্দে মস্তকসঞ্চালন করিলাম। পায়চারি করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, "পুরো ঘটনাটা তোমাদের পিছন থেকে দেখতে হবে। শিবকালীবাবু যখন খুন হন তখন বাড়িতে শুধু দুই মহিলা - রেবাদেবী আর মেনকা-ঝি। শিবকালীবাবু খুন হয়েছেন ছুরির আঘাতে। মানুষের দেহে ছুরি চালাতে যে পরিমাণ শক্তির দরকার হয় তা বাঙালি মহিলার খুব কমই থাকে। কাজেই এঁদের দুজনকে আমরা হত্যাকারী হিসেবে বাদ দিতে পারি। তাহলে নিশ্চয়ই বাইরে থেকে কেউ এসেছিল। রেবাদেবী আর ঝিয়ের সাক্ষ্যও তাই বলছে। যে এসেছিল সে শিবকালীবাবুর পরিচিত। কারণ নইলে তিনি তার সঙ্গে অতক্ষণ কথা বলতেন না। তার ওপর সে যখন ক্লোরোফর্ম করেছে, নিশ্চয়ই কথার চাতুরিতে করেছে। নইলে শিবকালীবাবু হাঁকডাক পাড়তেন। এখন কে সেই লোক? ঝগড়ু হতে পারে, ভাইপো সুধীরবাবু হতে পারে, যে লোক শনিবার সকালে এসে বচসা করে গেছে সে হতে পারে, ধর্মতলার স্টুডিওর মালিক বা তাদের ভাড়া করা লোক হতে পারে। ভবেশবাবুকে বাদ দেওয়া যেতে পারে। রোববার তিনি কলকাতায় ছিলেন। তাহলে কে? এদের কেউ, নাকি অন্য লোক?
“এর উত্তর পাওয়া সোজা নয়। তখন ভাবতে শুরু করলাম, যে রেবাদেবী আর ঝি যদি মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়? মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার মোটিভ কী? যদি তাদের পরিচিত লোকই খুন করে থাকে, তাহলে তাকে বাঁচাতে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে পারে। এই সময় হঠাৎ একটা জিনিস মনে পড়ল। অজিত, বিকাশ ভবেশবাবু তাঁর স্ত্রী সম্বন্ধে কী বলল, মনে আছে? বলল, তাঁর স্ত্রী একজন অভিনেত্রী ছিলেন। তখন সব সাক্ষ্যগুলো মনে সাজিয়ে মনে হল, আসলে মেনকা-ঝি বলে কেউ নেই। ঝি পুরো কাল্পনিক লোক। কী করে বুঝলাম কাল্পনিক? কারণ ঝিকে আর রেবাদেবীকে কেউ একত্রে দেখেনি। তুমি তদন্তে এসে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছ। সঙ্গে ভবেশবাবু ছিলেন। তুমি ঝিকে দেখছ আলো-আঁধারিতে। তিওয়ারিজী সকালে বললেন, তিনিও তদন্তে এসে আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এমনকি ঝগড়ুকেও এসেই রেবাদেবী দেশলাই কিনতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, ঝিয়ের আসা সেও দেখেনি। এইটা যখন বুঝে গেলাম তখন শিবকালীবাবুর খুনের সময়ে শুধু রেবাদেবী আর রেবাদেবীর পরিচিত একজন লোক ছিল। সে ভবেশবাবু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। সুধীর দত্ত বা ক্যামেরার দোকানের মালিকের সঙ্গে রেবাদেবীর ষড় থাকবে, সেটা প্রায় অসম্ভব। মোটিভও নেই। কিন্তু ভবেশবাবু কী করে উপস্থিত হবেন?
“ভবেশবাবু প্রথমদিনেই একটা কথা বলেছিলেন, আগে তার গুরুত্ব দিইনি। দিলে এত ছোটাছুটি হত না। বলেছিলে জামতাড়া স্টেশনে দুটো আপ আর দুটো ডাউন ট্রেন থামে। তার ওপর ভিত্তি করেই পুরো খুনের পরিকল্পনা করেছিলেন ভবেশবাবু আর রেবাদেবী। প্রথমেই তাঁরা একজন কাল্পনিক ঝিয়ের সৃষ্টি করলেন। একটি কাল্পনিক চরিত্র থাকলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া সম্ভব। ঝি যে নেই সে ভবেশবাবু, রেবাদেবী আর শিবকালীবাবু ছাড়া আর কেউ জানে না।''
আমি হতভম্ব হইয়া গেলাম। ভাল অভিনয় শুনিয়াছি, তাই বলে এই রকম! "তাহলে দ্বিতীয় টাঙ্গায় কে ছিল? ভবেশবাবু?"
- দ্বিতীয় কোন টাঙ্গাই আসেনি। এসেছিলেন শুধু মামাবাবু আর রেবাদেবী। কিন্তু ঝগড়ু জানে, সঙ্গে একটি ঝিও আছে। এইটাই হল প্রথম ব্রিলিয়ান্ট বুদ্ধির প্রয়োগ।
- তুমি এটা কখন বুঝলে?
- সকালে। সকালে যখন বৈঠকখানার প্রায়ান্ধকার ঘর দেখলাম, দেখলাম তুমি কোথায় বসেছিলে, উঠোনের রোদের ঔজ্জল্য কীরকম এবং তার সামনে কেউ দাঁড়ালে তাকে কতটা ভালভাবে দেখা যেতে পারে - তখন বুঝলাম একজন ভাল অভিনেত্রীর পক্ষে এই ধোঁকার টাটি তৈরি করা সোজা।
- তাহলে ভবেশবাবু কখন, কীকরে এলেন? তিনি তো কলকাতায়।
- সেটাই আরেকটা ব্রিলিয়ান্ট চাল। মনে আছে থানায় বসে ব্র্যাডশ দেখছিলাম? দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল ভবেশবাবু প্রথমদিন ট্রেন সম্বন্ধে যা বলেছিলেন। জামতাড়ায় কলকাতার ট্রেন আসে রাত আটটায়, সঠিকভাবে সাতটা সাতান্নয়। রাতের ট্রেন আসে হাথরাস থেকে, যায় কলকাতা। আসার কথা দশটা ছত্রিশে। প্রায়ই লেট করে। অর্থাৎ কেউ কলকাতা থেকে সকালের গাড়িতে আটটায় এসে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে যোগমায়া কুঠি গিয়ে আবার পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে স্টেশনে ফিরে কলকাতার ট্রেন ধরলেও মাঝে এক ঘন্টা সময় পাচ্ছে খুন করার জন্যে। ভবেশবাবু সহজেই এ কাজ করতে পারেন। সাহেবী পোষাকে এসে টাঙ্গা ধরে যোগমায়ার কুঠির কাছে এসে নাবলে আরও আধঘন্টা বেশি সময় পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই ভবেশবাবু এলেন। সাহেবী পোষাক। হয়ত অন্য ছদ্মবেশও ছিল। টাঙ্গা ধরে যোগমায়া কুঠির কাছে নাবলেন। দেখলেন টাঙ্গা চলে গেল। খুব সম্ভবত পিছনের দিকে গিয়ে নিশ্চিত করলেন যে ঝগড়ু নিজের ঘরেই আছে। ভবেশবাবু ঝগড়ুর নেশার খবর ভালই রাখতেন। অন্ধকারের পরে নেশাগ্রস্ত ঝগড়ু যে ঘরের বাইরে বিশেষ আসে না, সে সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি এবার হাতার ভিতরে ঢুকে রান্না ঘরের জানলায় টোকা দিলেন। আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। রেবাদেবী এসে খিড়কির দরজা খুলে ভবেশবাবুকে আসতে দিলেন।
“এরপরে কী ঘটেছিল সে শুধু ভবেশবাবু আর রেবাদেবীই বলতে পারেন। আমার ধারণা ভবেশবাবু শিবকালীবাবুকে বলপ্রয়োগ করে চেয়ারে চেপে রাখেন, পেছন থেকে রেবাদেবী ক্লোরোফর্ম করেন। তারপর ভবেশবাবু বর্ষাতি পরে আসল কাজটি করে সামনের দরজা খুলে বেরিয়ে যান। তারপরে রেবাদেবী ঝি সেজে ঝগড়ুকে ডেকে নিয়ে আসেন।"
তিওয়ারি জিজ্ঞাসা করিলেন, "মোটিভটা কী?" ব্যোমকেশ বলিল, "সেই পুরনো মোটিভ। অর্থলোভ। ভবেশবাবুর ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। হয়ত মন দিয়ে ব্যবসা করছিলেন না। ভেবেছিলেন মামাবাবুর বিপুল সম্পত্তি পেলে ব্যবসার আর কী প্রয়োজন? কিন্তু শিবকালীবাবু শীঘ্র মরার কোনরকম ইচ্ছাই দেখাচ্ছিলেন না। তার ওপর সম্পত্তি বেচে উড়িয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছিলেন। এমনকি এই জামতাড়ার বাড়িও বিক্রির বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলেছিলেন। আর দেরী করলে যা আছে, তাও আর থাকবে না - এই মনে করেই মামাবাবুকে পৃথিবী থেকে সরাতে মনস্থ করেছিলেন।"
আমি বললাম, "কিন্তু তোমাকে তদন্তের ভার দেওয়ার মতন বোকার মতন কাজ করলেন কেন?"
- তোমার বোধহয় মনে নেই, ভবেশবাবু আসার এক সপ্তাহ আগে আমি যে একটা সরকারী কাজে নিযুক্ত হয়েছি এবং কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোচ্ছে না এই নিয়ে সরকারের সমালোচনা করে একটা খুব ছোট খবর কাগজে বেরিয়েছিল। ভবেশবাবু সেটার সুযোগ নিয়েছিলেন, যদি আমি কাজটা না নিই, বা নিলেও নিজে করতে না পারি, তাহলেও ব্যোমকেশ বক্সীর শিলমোহর পাওয়া যাবে। তাছাড়া নিজে খুব টাইট করে কেস সাজিয়েছিলেন। নিজের প্রায় নিশ্ছিদ্র অ্যালিবাই রেখেছিলেন খুনের দিন সকালে নিজের কাঠের গোলায় গিয়ে। নিজের আর স্ত্রীর বুদ্ধির ওপর অগাধ আস্থা রেখেছিলেন।
“এবার বাকিটা আপনার কাজ তিওয়ারিজী, অপরাধীদের ধরা। এ কাজটা পুলিশ ভাল পারবে। বেনা থেকে দুপুরে কটাই বা আর বাস ছাড়ে!"
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, "তুমি যদি সকালেই বুঝে থাক যে রেবাদেবী আর ঝি একই লোক, তখনই গ্রেপ্তার করলে না কেন?"
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, "নেহাতই ইয়ের মতন কথা বললে অজিত। প্রথমতঃ কোন প্রমাণ নেই। তার ওপর ঝি সাজা তো কোন দণ্ডযোগ্য অপরাধ নয়। অবশ্য জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটকে থানায় নিয়ে আসতে পারতাম, কিন্তু তাতে কিছু সুবিধে হত না। বরং আমি হাবেভাবে বোঝালাম যে আমি বুঝেছি ঝি আসলে কেউ ছিল না, যাতে ভয় পায়। ভয় পেলে অপরাধী এমন কাজ করে ফেলে যা দিয়ে তাকে ধরতে সুবিধে হয়। এখানেও পালিয়ে গিয়ে সেই সুবিধে করে দিল।"
আমরা পুলিশের জিপে স্টেশনের দিকে চলিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, "আসানসোল জংশনে অস্ত্র ফেলা কি আরেক ব্রিলিয়ান্ট বুদ্ধির কাজ?" ব্যোমকেশ বলিল, "হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে। জংশনে বেশি সময় ট্রেন থামে বলে সেখানে অস্ত্র ফেলা সুবিধেজনক। তবে রেললাইনের ধারে কেন ফেললেন না, সেটা নিয়ে ধন্দ থেকেই যাবে।"
জিপ স্টেশনের দিকে ছুটিয়া চলিল।