• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গল্প
    Share
  • অশ্ব ও নারী : শিবানী ভট্টাচার্য দে



    মাধবীর কথা আমরা পাই মহাভারতের উদ্যোগপর্বের অন্তর্গত ভগবদ্‌যান পর্বে, অধ্যায় সংখ্যা ১১৩ – ১২১-এর মধ্যে। নারদের যুদ্ধোৎসুক দুর্যোধনকে উপদেশছলে কথিত গল্পটি আদতে গালবের উপাখ্যান (অধ্যায় ১০৪ - ১২২)। অত্যুৎসুক ব্যক্তির পরাভবের উদাহরণ ঋষি গালব। গালব এই গল্পের মুখ্য চরিত্র, কিন্তু তাঁর অত্যুৎসাহের এই যে পরাভব, এতে যিনি আপন পিতার ইচ্ছায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়ে নিজের পার্থিব জীবনের সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য হারান, অন্যভাবে বলতে গেলে, একজনের পরাভব অন্য যার জীবনে নিদারুণ দুঃখ নিয়ে আসে তিনি হলেন রাজকন্যা মাধবী। মহাভারতের প্রায় প্রতি পর্বেই মূল গল্পের বাইরে প্রচুর আখ্যায়িকা আছে, সেগুলো কাব্যে, নাটকে বা এমনি গল্প হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে, এমন কি তাদের ঘটনাক্রম ব্যাকরণ, অলঙ্কার শাস্ত্রের উদাহরণ হিসেবেও বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। মূল কাহিনির সত্যবতী, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা, উত্তরা ইত্যাদি ছাড়াও আখ্যায়িকাগুলোর নায়িকা যেমন সীতা (রামায়ণের কাহিনীও মহাভারতের বনপর্বে আছে), সাবিত্রী, দময়ন্তী, তপতী, লোপামুদ্রা, ইত্যাদির কথা বহুপ্রচারিত। কিন্তু মাধবীর নাম কোথাও শোনা যায় না। অথচ ত্যাগ ও দুঃখবরণের দিক থেকে বিচার করলে মাধবী অনন্য। অনাত্মীয় এক ব্রহ্মচারী ছাত্রের গুরুদক্ষিণার ঋণ মিটাতে পিতার আদেশপালন তাঁর সারা পার্থিব জীবন, আজকালকার দৃষ্টিকোণে এবং ভাষায়, নষ্ট করে দিয়েছিল। অথচ পিতৃসত্য পালনের বা পিতার সন্তুষ্টিবিধানের গল্পে রাম, ভীষ্ম বা পুরুর যে মহিমাকীর্তন দেখি, মাধবী তার কণামাত্রও পান নি।

    মাধবীর কাহিনির কোনো প্রচার নেই দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয় কাহিনিটি সেই সুপ্রাচীন কালের পুরুষশাসিত সমাজের স্বার্থপরতার অনেকগুলো দিক উন্মোচন করে। একাধিক পুরুষের সঙ্গে সংসর্গ এবং সন্তানত্যাগ--যা মাধবীর জীবনে অন্যের স্বার্থকল্পে এবং তাঁর ইচ্ছানিরপেক্ষ সংঘটিত হয়েছিল, নারীর আত্মত্যাগের সঙ্গে জড়িত হলেও পুরুষশাসিত সমাজের পক্ষে তা দৃষ্টান্তমূলক বলে ধরা হয়নি, বিশেষত পুরুষের স্বার্থপরতার মুখোশ এই নাতিদীর্ঘ গল্পে যেভাবে পরতে পরতে খুলে যায়, তার মুখোমুখি হওয়া বেশ কঠিন, পরে বুঝেছি।

    তাই মনে হল মাধবীকে নিয়ে কিছু লিখি। আগেই বলেছি মাধবী এবং গালবকে পাওয়া যায় উদ্যোগপর্বে, বিশ্বামিত্র ও যযাতির কাহিনির বেশিরভাগই আদিপর্ব থেকে পেয়েছি ( যযাতি ৬৩-৮০, বিশ্বামিত্র ৮৩-৮৮,এবং ১৬৮-১৭০ অধ্যায়, আদিপর্ব)। বনপর্বও কিছুটা সাহায্য করেছে, বিশেষ করে নৈমিষারণ্যের অবস্থানের সূত্র পেয়েছি। চরিত্রগুলোকে যথাসম্ভব তাদের মহাভারতীয় বর্ণে রাখার চেষ্টা করেছি, কিছু ছোটখাট চরিত্র ও ঘটনা নিতান্তই এই নগণ্য লেখকের কল্পনাপ্রসূত।

    এখানে বলা উচিত, আমি মূল সংস্কৃত মহাভারত বিশেষ পড়িনি, ছাত্রজীবনে অবশ্যপাঠ্য কিছু অংশ এবং আন্তর্জালে কিছু বিক্ষিপ্ত খণ্ডাংশ নামিয়ে পড়া ছাড়া। আমার মুখ্য উপজীব্য হল কালীপ্রসন্ন সিংহের অনুবাদিত মহাভারত। কাজেই চরিত্রগুলো বুঝতে খামতি থেকে যেতেই পারে, সেজন্য আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে রাখলাম।

    পাঠকদের মনোযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব।

    ~লেখক

    এক

    স্থান নৈমিষারণ্য। এখনকার এইটুকুন নিমসর গ্রাম নয়। এ বিশাল অরণ্য, হিমালয়ের নিম্নভাগের অনতিউচ্চ শিবালিক পর্বতের পূর্ব থেকে গোমতী নদীর স্রোতধারা পেরিয়ে তার পূর্বতট পর্যন্ত অঞ্চলে বনের বিস্তার। উত্তরেও শিবালিক, অরণ্যের দিকে নিচু হয়ে ধীরে ধীরে উচ্চভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিবালিকের উত্তরে ক্রমোচ্চ পর্বতশৃঙ্খলা যেন একের পর এক সাজানো। তাদের মধ্যে দণ্ডায়মান গিরিরাজ হিমালয় সমুন্নত হিমময় মস্তকে প্রতিদিন প্রভাতে পরেন সুবর্ণের মুকুট ও বেলা বাড়লে শুভ্র রজতের। তাঁর দক্ষিণ সানুদেশে ত্রিদশগণের দেবভূমি, উত্তরে মহাদেবের কৈলাস। স্বর্গকে লোকে আকাশে অবস্থিত বলে জানে। কিন্তু হিমালয়ের নিকট এলে বোধ হয় যে উঁচু উঁচু পর্বতশরীরের তুষারমৌলি কখনো স্বর্ণিম কখনো বা শুভ্র, তাদের দুর্ভেদ্য নিম্নশরীরে সবুজ বনানীর সমারোহ, তাদের উপত্যকায় দেবদারুকুঞ্জের ফাঁকে ফাঁকে ব্রহ্মকমলের চন্দ্রিকার শ্বেতচ্ছটা, তাদের মধ্যে মধ্যে নির্ঝরিণীর কলতানসঙ্গীত -- এই সৌন্দর্য যেখানে খেলা করে, সে স্থান স্বর্গ ভিন্ন আর কিছু হতে পারে না। আকাশ এখানে নিচু হয়ে পর্বতে মিশে গেছে। তাই দেবতারা এখানেই থাকেন; পুণ্যবান মানুষ কর্মময় জীবনের অবসানে এখানেই আসেন অনন্ত বিশ্রামে। স্বর্গ এখানে মর্ত্যের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে, মানুষ ও দেবতা প্রায়ই ভূমিকা বদল করে।

    নৈমিষারণ্য তাই বিশিষ্ট স্থান। উত্তরদিক থেকে পার্বত্য শীতল বায়ু সমতলের উপত্যকায় বয়, উষ্ণ গ্রীষ্মকালকেও এখনে তত গরম বলে মনে হয় না। স্রোতস্বতীরা ও তাদের সহযোগী অসংখ্য নির্ঝরিণী পর্বত থেকে অমৃতোপম শীতল জলধারা নিয়ে বয়ে যায় বনতলে, তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা মিটিয়ে বৃহত্তর নদীতে যাত্রা সমাপন করে। এই বনে আমলক, হরিতকী, বদরী, বিভীতক, ইঙ্গুদী, জম্বু ইত্যাদি ফল ও বিবিধ কন্দ পাওয়া যায়, বনও সব জায়গাতে খুব ঘন নয়, মধ্যে মধ্যে মৃগচারণের উপযোগী মিষ্ট তিক্ত তৃণশষ্পে পরিপূর্ণ তৃণভূমি ও আছে। এখানেই সবচাইতে বেশি তপোব্রত, দেবতাদের দ্বারাও বহুমানিত মুনিঋষির বাস। ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থিত ও সন্ন্যাসধর্মে বৃত—জীবনের চারটি আশ্রমেই স্থিত ব্যক্তিদের দেখা পাওয়া যায় এখানে। সর্বজনমান্য বহু ঋষি এখানে আশ্রম নির্মাণ করে বাস করেন, শিষ্যগণ-সহ। যজন, যাজন, অধ্যয়ন, অধ্যাপন, দান প্রতিগ্রহ এঁদের বৃত্তি। ঋষিরা মন্ত্র রচনা করেন, গুরুরা চতুর্বেদ শিক্ষা দেন। শিষ্যরা বেদপাঠ করেন, যজ্ঞের সমিধ ও জীবিকার জন্য ফলমূল আহরণ করেন, আশ্রমের গাভী চরাতে বনের মধ্যে থাকা তৃণভূমিতে নিয়ে যান, গুরু ও গুরুপত্নীর আদেশের পালন করেন। দিবসের সব যামেই এখানে বেদমন্ত্র উচ্চারিত হয়ে ধ্বনিত হয় চারদিকে। পক্বকেশ দেখা দিলে বহু রাজা যোগ্য উত্তরসূরির হাতে রাজ্যভার সমর্পণ করেন, তারপর বানপ্রস্থ অবলম্বন করে এই অরণ্যে চলে আসেন তপস্যায় মনোনিবেশ করে অনন্ত জীবনের জন্য পুণ্য অর্জন করতে। কেউ কেউ আবার গৃহস্থজীবনের মধ্যেও ধর্মকর্ম করতে উদ্যোগী হয়ে, অথবা কোনো উৎপতিত সংকট নিরসনের জন্য কিছুদিনের জন্য বনে যান, মহর্ষিদের কাছ থেকে প্রতিকারের বিধান ও উপদেশ শোনেন, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, আবার গার্হস্থাশ্রমে ফিরে যান। রাজর্ষিদের অনুষ্ঠিত যজ্ঞের ধূম কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকলে মনে হয় যেন আকাশগঙ্গা পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বগামী হয়ে স্বর্গের দ্বারে আঘাত করছে। তাঁদের দান করা অর্থ এবং পশু গুরুকুলগুলোর একটা বড় আয়ের উৎস।

    চারজন যুবক রাজা এখানে কিছুদিন ধরে বাজপেয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করছিলেন। বাজপেয় যজ্ঞে সাধারণত ঘৃতই হবিঃ রূপে ব্যবহার করা হয়, পশুবলি দিয়ে পশুমাংস অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয় না। এই রাজারা আত্মীয়সম্মিলন উপলক্ষে ইন্দ্রদেবতার তুষ্টির জন্য যজ্ঞ করছিলেন, বিশেষ ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়। তাই পূত যজ্ঞপাবকে ঘৃত নিক্ষেপ করতে যে মিষ্ট সুগন্ধ বিকীরিত হচ্ছিল, তাতে এঁরা যেন প্রিয়জনের সান্নিধ্য অধিকতর উপলব্ধি করছিলেন। এঁরা হলেন অযোধ্যার অধিপতি হর্যশ্বপুত্র বসুমনা, কাশীরাজ দিবোদাসপুত্র প্রতর্দন, ভোজরাজ্যের নৃপতি উশীনরপুত্র শিবি এবং কান্যকুব্জের ভূপাল বিশ্বামিত্রপুত্র অষ্টক। সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ক’জন রাজা এক হয়ে যজ্ঞ করবার জন্য সম্মিলিত হয়েছেন এমন বড় একটা দেখা যায় না। কিন্তু এঁদের কথা স্বতন্ত্র। এঁরা সহোদর, একই মাতার গর্ভজাত সন্তান। এদিক থেকে এঁরা বিশিষ্ট।

    কনিষ্ঠ অষ্টকই আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি জ্যেষ্ঠ সহোদরদের নাম শুনেছেন, কিন্তু মুখোমুখি বড় একটা দেখেননি। হয়তো গুরুগৃহবাসের সময় অল্পদিনের জন্য, কারণ তিনি তো তাদের বিদ্যাশিক্ষার সময়ে গুরুকুলে নিতান্তই কনীয়ান। অস্ত্রশিক্ষা বা যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার জন্য অনেক সময় ক্ষত্রিয়সন্তান বিদ্বান গুরুর শিষ্য হবার জন্য স্বরাজ্যের বাইরেও বিখ্যাত ও পারদর্শী গুরুর কাছে যেতেন। সেরকম গুরুকুলে বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষার্থী একসঙ্গে বিদ্যাভ্যাস করতেন, মেলামেশা হত। এই ক্ষেত্র ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের রাজপুত্রদের মধ্যে মেলামেশা বা দেখাসাক্ষাতের সুযোগ বড় একটা হয় না, যুদ্ধের সময় ছাড়া। আপাতত আর্যাবর্তে শান্তি আছে, এবং এই চার রাজ্যের মধ্যে সদ্ভাব আছে আগে থেকেই।

    অষ্টক মাত্র ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রমে রাজ্যভার গ্রহণ করেছেন। যদিও শিশুবয়স থেকেই তিনি রাজারূপে কল্পিত ছিলেন-- সেটা অবশ্য নামেমাত্র-- প্রধান অমাত্যই রাজ্যভার পরিচালনা করতেন, এবং তিনিই শিশুরাজার অভিভাবক ছিলেন। এখনও সেই অমাত্যের মন্ত্রণা এবং উপদেশে তরুণ রাজা ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছেন। শুধু একটি অভাবের ব্যথা শিশুবয়স থেকেই তাঁর বুকে জমাট পিণ্ডের মত আটকে আছে। মন্ত্রী হোক বা অমাত্য, সেনাপুরুষ হোক বা সাধারণ প্রজা-- তাদের ঘরের বেশিরভাগ শিশুদের মাতা আছেন। সেই মাতা শুধু শিশুদের জন্মই দেন না, শিশুদের কোলে করে স্তন্যপান করান, খাবার খাওয়ান, মৃদু মধুর গান গেয়ে শিশুকে ঘুম পাড়ান। রোগে, ব্যথায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, তার কষ্ট বোঝেন, মাতার চোখ থেকে সন্তানের জন্য স্নেহধারা ঝরে। এমন কি পশুপক্ষীদের জননীও তাদের সন্তানদের কত মমতায় ঘিরে রাখে, গো-জননী তার বৎসকে দুগ্ধ পান করানোর সময় জিহ্বা দিয়ে চেটে দেয়, তার গলকম্বলের নিচের উষ্ণতায় বাছুরটি দাঁড়িয়ে থাকে। পক্ষীমাতা তার ডানার নিচে শাবকদের আশ্রয় দেয়, শিশুশাবকদের মুখে খাদ্যবস্তু পুরে দেয়। অথচ তাঁর ঘরে মাতা নেই। তিনি ধাত্রীমাতার কাছে মানুষ হয়েছেন। শুনেছেন, তাঁর মাত্র একমাস বয়সেই গর্ভধারিণী জননী চলে যান। ধাত্রী বলেছিলেন, মাতাকে দেখলে মনে হত যেন সাক্ষাৎ দেবী ঊষা, সৌন্দর্য এবং কোমলতার প্রতিমূর্তি। কেন তিনি চলে গেলেন, সে বিষয়ে কেউ আলোকপাত করে না। পিতা অবশ্য বৃদ্ধ, তিনিও অষ্টকের শিশুবয়সেই বানপ্রস্থে চলে গেছেন, লোকসংসর্গ ত্যাগ করেছেন। তাঁর কাছ থেকে কিছুই জানবার উপায় নেই। অথচ মাতা জীবিতা, বনচারিণী তপস্বিনী, অষ্টক শুনেছেন।

    ঋষি গালব কখনো কখনো আসেন তাঁর কাছে। তিনি অষ্টকের পিতার শিষ্য ছিলেন, অনেক ঘটনার সাক্ষী। তিনিই অষ্টককে বলেছেন তাঁর মায়ের কথা, মায়ের আরো তিন সন্তান, তাঁর জ্যেষ্ঠ তিন ভ্রাতার কথা। তাঁর তিনজন দাদার জ্যেষ্ঠ বর্তমান অযোধ্যারাজ বসুমনা, তারপর কাশীরাজ প্রতর্দন, এবং তারপর ভোজরাজ শিবি। তাঁদের জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছিল, মাতা তাঁদেরও ছেড়ে যান তাঁদের জীবনের প্রথম মাসটি পূর্ণ হবার অব্যবহিত পরেই। ঋষি গালব তাঁদের কাছেও গিয়েছেন। তাঁদেরও তিনি জননীর কথা শুনিয়েছেন, এভাবেই ভাইয়েরা তাঁদের মাতৃপরিচয় জেনেছেন।

    গালব চার রাজ্যে গিয়ে প্রত্যেক রাজাকেই বলেছিলেন, আপনারা চার সহোদর নিজেদের কাছে তেমন পরিচিত নন। এদিকে রাজকার্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে যাওয়া আপনাদের মত রাজার পক্ষে সহজ হবে না। তাই প্রত্যেকে প্রথমে দূতের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করুন, পরামর্শ করুন, তারপর নৈমিষারণ্যে মিলিত হয়ে বাজপেয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। ভ্রাতৃগণের পারস্পরিক পরিচয় হোক। ইতঃপূর্বে আমি সংক্ষেপে আপনাদের প্রত্যেককে মাতৃপরিচয় জানিয়েছি, সেই যজ্ঞের উপলক্ষ্যে আমি একসঙ্গে চার ভ্রাতাকে আপনাদের জননীর দুঃখময় জীবনচরিতকথা বিস্তৃত শোনাব। আমি নিজেও সেই কথার এক চরিত্র, আমার গুরু তথা অষ্টকের পিতা বিশ্বামিত্র, আপনাদের মাতামহ যযাতি, আপনাদের জ্যেষ্ঠ তিন ভ্রাতার পিতারা, হর্যশ্ব, দিবোদাস এবং উশীনর, সকলেই এই কথার চরিত্র। আমরা সকলেই এই গল্পে আসব, তবে প্রথমপুরুষে, যেন সে একটা অন্য গল্প, আমরা এর সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। তাহলে এর মধ্যে আমাদের যে ভাগ, তা আর আমাদের মনে হবে না। মনে হবে চরিত্রগুলো কোন দূর অতীতের গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে, অথচ নিজেদের সঙ্গে মিলিয়ে নিতেও পারব। আমরা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করব, কিন্তু দগ্ধ হব না। স্মরণে রাখবেন, আপনাদের জননী সারা জীবনে অপরের জন্য দুঃসহ কষ্ট সহ্য করেছেন মাতা বসুন্ধরা মাধবীর মত, কিন্তু কখনো কাউকে দোষ দেননি। আমি যতদূর জানি, তিনি রাজশ্রী ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় বনবাসিনী, ইন্দ্রিয়াদি সংযম করে তপস্যায় নিরতা থাকেন, এবং মৃগচর্যা করে জীবন ধারণ করেন।

    মৃগচর্যা কী, মহর্ষি? প্রতর্দন জিগ্যেস করেছিলেন।

    গার্হস্থ্যজীবনের সমস্ত কিছু ত্যাগ করে বনে মৃগদের সঙ্গে বসবাস, মৃগদের মত কোমল তৃণশষ্প আহার এবং নদী, নির্ঝরিণী বা স্বতঃউৎসারিত প্রস্রবণের জল পান করে জীবন ধারণ করাকেই মৃগচর্যা বলে।

    এর পরপর কাশীরাজ্যে বসুমনার সঙ্গে সাক্ষাতকারে, ভোজরাজ্যে রাজা শিবি, এবং পরে অষ্টক—গালব পৃথক পৃথক সাক্ষাতকারে চারজনকেই তাঁদের জননীর সম্পর্কে বলতে গিয়ে এইসব কথাই বলেছিলেন।

    চার ভাইই গালবের কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে তাঁরা বলেছিলেন, বনবাসী তপস্বী মুনিদেরও অনেকেই অন্তত সপ্তাহে একবার ভিক্ষান্ন ভোজন করেন। মাতা তাও করেন না?

    না। গালব বলেছিলেন।

    তরুণ রাজাদের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল। একজন বিখ্যাত কুলের রাজকুমারী, যিনি একএক খ্যাতনামা রাজার ঔরসে একএকটি রাজচক্রবর্তী পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, যিনি আজ পরম সুখে দাসদাসীসেবিত হয়ে যে কোনো পুত্রের কাছে প্রাসাদে থাকতে পারতেন, অথবা বনে থাকলেও পুত্রেরা তাঁর বাসস্থান, খাদ্য, পেয় জল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তুর সংস্থান করে দিতে পারত, সেই তিনি এখন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসিনী হয়ে মৃগচর্যা করে বনবাসে আছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই গালবকে বললেন, তবে তাই হোক তপোধন। আপনার কথায় সারবত্তা আছে, আপনি আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী। প্রত্যেক ভ্রাতাই গালবকে বললেন, দূত প্রেরণ করে অন্য ভাইদের সম্মতি নেব, তারপর তারপর এক বিশেষ সময় নির্দিষ্ট করে আমরা মিলিতভাবে বাজপেয় যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতে স্থির করব। আপনাকেও তখন জানিয়ে দেব।

    অতঃপর বিশেষ স্থিরীকৃত দিনে সর্বসম্মতিক্রমে বসুমনা, প্রতর্দন, শিবি ও অষ্টক নৈমিষারণ্যে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে যজ্ঞের আয়োজন করলেন। ঋষি গালব ও তাঁদের সঙ্গে সম্মিলিত হলেন।

    দুই

    মহারাজ অষ্টক হয়তো শুনেছেন, তাঁর জন্মের পরই তাঁর পিতা বিশ্বামিত্র বানপ্রস্থে যাবার উদ্যোগ করেছিলেন। তাই তাঁর মনে হয়েছিল, রাজ্যের কাজকর্ম, রাজকোষের সম্পদ, ভাবী রাজার প্রয়োজনে গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আশ্রমে ছয়শত ঘোড়া এসেছে, গুরুদক্ষিণা হিসেবে। কিন্তু আশ্রমে সেসবের দরকার নেই, সেগুলোকে রাজ্যে পাঠিয়ে দিতে হবে। পুত্র শিশু, তাকে রাজ্যে নিয়ে মুখ্য অমাত্যের তত্ত্বাবধানে বিশ্বস্ত ধাত্রীর হাতে তুলে দিতে হবে। সে যেন ক্ষত্রিয়ের আচার আচরণ শেখে, তার ধনুর্বেদ-সহ সব ক্ষত্রিয়োচিত বিদ্যা ও নীতিশিক্ষা হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে রাজা হয়ে অষ্টকের অসুবিধা না হয়। আসলে তিনি বহুদিন হল রাজকার্য অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের উপর ছেড়েছেন, নিজে তপস্যা করতে আশ্রমে থাকেন। ছিলেন ক্ষত্রিয়, তপোবলে, জ্ঞানবলে ব্রাহ্মণ হয়েছেন। এখন শিশু উত্তরাধিকারী পুত্রের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করলেই তিনি নিশ্চিন্তে বানপ্রস্থে যাবার কথা ভাবতে পারেন।

    গালব বললেন, নৃপগণ, এই ক্রম থেকেই আমাদের কথা শুরু করছি, যাতে পারম্পর্য বুঝতে সুবিধা হয়।

    চারজন রাজা গালবের কথায় মনোযোগ দিলেন।

    এই ছয়শত অশ্ব বলতে গেলে তাঁরই উত্তরাধিকার ছিল। এগুলো তাঁর পিতা মহারাজ গাধি কন্যাশুল্ক হিসেবে পেয়েছিলেন রাজর্ষি ঋচীকের কাছ থেকে। এগুলো বিশেষ ঘোড়া, একটা কান এদের কালো, আর সর্বাঙ্গ ধবধবে সাদা। ঋচীক রাজা বরুণের কাছ থেকে একহাজার এমন ঘোড়া নিয়ে এসেছিলেন‌ এবং সেগুলোর বিনিময়ে গাধিনন্দিনী সত্যবতীকে বিবাহ করার অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু গাধির লোকজন যখন সত্যবতীকে পৌঁছে দিয়ে এবং ঘোড়াগুলোকে নিয়ে আসছিল, তখন পথিমধ্যে বিতস্তানদীতে বান ডাকে, এবং চারশত ঘোড়া নদীর জলে ভেসে যায়। বাকি ছয়শত গাধির রাজ্য কান্যকুব্জে পৌছোয়। গাধি পুণ্ডরীক যজ্ঞ করছিলেন, যাতে ঘোড়া দক্ষিণা হিসেবে ঋত্বিকদের দিতে হয়। তিনি পুরো ছয়শত অশ্বই দান করে দিলেন। সেইসব ঋত্বিকেরা ব্রাহ্মণ, ঘোড়া দিয়ে কী করবেন! ঘোড়ার কাজ তো ক্ষত্রিয়ের। ঋত্বিকদের কাছ থেকে সেগুলো অন্য রাজারা স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে কিনে নিলেন। এদিকে গাধিপুত্র বিশ্বামিত্র সদ্য যুবরাজ হয়েছেন, ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবার মত সুন্দর বড় বড় তেজী ঘোড়াগুলো দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাদের উপর আরোহণ করতে এবং রথে জুড়তে তাঁর যুবজনোচিত আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়েছিল, কিন্তু পিতা একটা ঘোড়াও রাখলেন না। সেই ক্ষোভ তাঁর মনের ভেতরে রয়ে গেল। তিনি দেখলেন, বেশ চতুরতার সঙ্গে ব্রাহ্মণেরা বাণিজ্য করে নিলেন।

    এরপরে রাজা গাধি বানপ্রস্থে চলে গেলে তিনি রাজা হলেন। ক্ষত্রিয়ের অভিমান তখন তাঁর মধ্যে প্রবল। ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের মত প্রতিগ্রহ করে জীবিকা অর্জন করেন না, প্রতিগৃহীত বস্তুতে বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করেন না, তিনি বাহুবলে সব অর্জন করেন। একদা বিশ্বামিত্র মৃগয়া উপলক্ষে হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে পরিশ্রান্ত হয়ে মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে সপার্ষদ যান কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য। সেখানে দেখলেন, বশিষ্ঠের একটি গাভী রয়েছে, সেই একটিমাত্র গরুর দুধ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী দিয়ে তিনি সেনা ও সহচর-সহ বিশ্বামিত্রের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। খুব ভালজাতের গরু, স্বাস্থ্যবতী, ঋষি তার একটা সুন্দর নামও রেখেছেন -- নন্দিনী, আর তার সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলেন! আশ্রমের পনসবৃক্ষের ঘন ছায়ায় দাঁড়িয়ে যখন সে আপন মনে তার দুগ্ধপানরত বৎসকে লেহন করে স্নেহ প্রকাশ করতে থাকে, তার স্নিগ্ধ রূপ দেখলেই মন আনন্দে ভরে ওঠে। বিশ্বামিত্র সেই গরুটি নিজে নিতে চাইলেন। তাঁর গোশালায় বহু গোসম্পদ আছে, কিন্তু এমনটি নেই, এমন কি তিনি আর কোথাও দেখেনওনি। এই একটি গরুর বদলে তিনি বহু দুগ্ধবতী গাভী দেবেন, ঋষি চাইলে আরো ধনও দিতে পারেন। কিন্তু রাজার প্রস্তাবে বশিষ্ঠ রাজি হলেন না। তিনি বললেন, মহারাজ, ইনি আমার যজ্ঞধেনু, আমার সম্মাননীয়। আমার সমস্ত ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম এই ধেনুর দুগ্ধেই সম্পন্ন হয়। ইনি আমার কথা শোনেন, বহুদিন ধরে আমার আশ্রমে আছেন, তাই আমি এঁর প্রতি স্নেহশীল। আর আমার এই আশ্রমে বেশি ধন বলুন আর অনেক গরু, কিছুই রাখবার জায়গা নেই, আমার যা আছে তার বেশি প্রয়োজনও নেই। আমি অল্পেই সন্তুষ্ট।

    বিশ্বামিত্রের ক্রোধ জেগে উঠল। তিনি দেশের রাজা, একজন সাধারণ বনবাসী ব্রাহ্মণ তাঁকে গরুটি বিনিময় করতে অস্বীকার করছে, এ তো অপমান! তিনি বললেন, মহর্ষি, আপনি যদি নিজে গরুটি না দেন, তাহলে আমি বলপ্রয়োগে নিয়ে যাব। বশিষ্ঠ শান্তভাবে বললেন, মহারাজ, আপনি রাজা, আপনার কর্তব্য প্রজাসমুদায়ের ধন রক্ষা করা, লুণ্ঠন নয়। বিশ্বামিত্র একথা শুনে আরো রেগে গেলেন। নিজের অনুচরদের আদেশ করলেন গরুটিকে বেঁধে নিয়ে যেতে। তারা তাঁর কথামত তাকে বাঁধতে গেলে বড়সড়ো শক্তিশালী গরুটি তাদের গুঁতিয়ে দিল, পেছনে যারা দাঁড়িয়ে দড়ি টেনে ধরবে ভেবেছিল, তাদের লাথি মেরে মাথা ঝাঁকিয়ে দড়ি ফেলে এমন দৌড় লাগাল যে তারা হাল ছেড়ে দিল।

    বিশ্বামিত্র বললেন, বাছুরটাকে বাঁধ। তখন তারা বাছুরকে বেঁধে নিয়ে চলল। গাভী এবার তো বশে আসবে, তিনি ভাবলেন। কিন্তু সে বিশ্বামিত্রের অনুচরদের কশার আঘাতে এমন জোরে হাম্বা হাম্বা করতে লাগল যে বনবাসী অনার্য জনজাতীয় মানুষ, যারা কাছেপিঠেই থাকত, বশিষ্ঠকে শ্রদ্ধা করত, তাঁর সংযত ও স্নেহশীল স্বভাবের জন্য ভালবাসত, বেরিয়ে এসে রাজার সেনাদের অহিংসভাবে ঘিরে ফেলল। তাদের সমবেত প্রতিরোধের কাছে রাজা হার মেনে ফিরে গেলেন। কিন্তু বিশ্বামিত্র দেখেছিলেন, এই সমস্ত ব্যাপারে বশিষ্ঠ কোনো হস্তক্ষেপ করেননি, কাউকে বারণ ও করেননি, রেগে তিরস্কার বা শাপশাপান্ত করেননি। তিনি শান্তভাবে ধ্যানে বসেছিলেন।

    এই ব্যাপার দেখে রাজা ভাবলেন, নিশ্চয় বশিষ্ঠের বিশেষ কোনো গুণ আছে যাতে এত অবিচলিত থাকতে পারেন। তিনি তাঁর আরো পরীক্ষা নিলেন। বশিষ্ঠের পুত্রদের এক এক করে হত্যা করালেন। মুনি মর্মান্তিক দুঃখ পেলেন, তবুও শোকে মুহ্যমান বা ক্রোধে অন্ধ হলেন না। তিনি শান্তভাব ত্যাগ করলেন না ।

    বিশ্বামিত্র বুঝলেন, তিনি চূড়ান্ত হেরে গেছেন বশিষ্ঠের কাছে। বুঝতে পারলেন, এই অবিচলিত পরম ক্ষমাগুণ, এই শান্তভাবকেই ব্রাহ্মণত্ব বলে, এবং ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করলেই মনুষ্যত্বের চরম উৎকর্ষ হয়। তিনি তাই তপস্যা করতে সঙ্কল্প করলেন। রাজ্যভার অমাত্যদের হাতে দিয়ে তিনি বনে চলে গেলেন, মানসিক স্থৈর্য অবলম্বন করে ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের জন্য কঠোর তপস্যা করতে লাগলেন। ক্রোধ লোভ মাৎসর্য ইত্যাদি রিপু বর্জন করে মনকে সংযত করলেন। তিনি বেদাভ্যাস করলেন, নূতন বেদমন্ত্র রচনাও করলেন, ঋষি হিসেবে চতুর্দিকে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। বহুদিন ধরে এই অভ্যাসের ফলে বড় বড় মুনিরা, এমন কী বশিষ্ঠও বিশ্বামিত্রকে এখন ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃতি দিলেন। অনেক ব্রহ্মচারী তাঁর শিষ্যত্ব নিতে এল, তাঁর আশ্রম একটি বিখ্যাত গুরুকুলে পরিণত হল। এইভাবেই তরুণ বয়সে তাঁর শিষ্য হতে এসেছিল এই অধম গালব, বলে গালব নিজের দিকে তর্জনী নির্দেশ করলেন।

    গালব বলতে থাকলেন, সেই তরুণ তাঁর বিদ্যানুরাগ ও গুরুশুশ্রূষা দ্বারা গুরুর প্রিয়পাত্র হয়েছিল। শিষ্যদের যখন শিক্ষা সমাপ্ত হয়, তাদের গৃহস্থজীবনে প্রবেশের আগে গুরুর মনোমত দক্ষিণা দিয়ে গুরুকে সন্তুষ্ট করতে হয়, এটাই নিয়ম। শিষ্যদের নিজস্ব সম্পত্তি থাকে না, তারা খালি হাতে গুরুগৃহে আসে, বেদ অভ্যাস করে, নানা শাস্ত্র শিক্ষা করে, গুরুসেবা করে। এভাবেই গুরুকুলে কয়েকবছর ব্রহ্মচর্যে কাটিয়ে শিক্ষা শেষ হয়, তখন গুরুর মনোমত দক্ষিণার আদেশ পেয়ে তারা রাজার কাছে যায়, গুরুদক্ষিণার নিমিত্ত ধন যাচ্ঞা করে। রাজারাও সাধারণত ব্রহ্মচারীকে যাচিত অর্থ দিতে পরাঙ্মুখ হন না। অনেক গুরু নিজে কিছু চান না, তাঁরা তাঁদের পত্নীর নিকটে শিষ্যকে পাঠিয়ে দেন যদি পত্নীর কিছু ধনের প্রয়োজন থাকে সেটা বলতে। কিন্তু বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয়জীবনের পত্নী রাজধানীতেই থাকতেন, আশ্রমে নয়। তাই শিক্ষাশেষে যখন শিষ্যেরা কী গুরুদক্ষিণা দিতে হবে জিগ্যেস করত, বিশ্বামিত্র অনেক সময় তাদের শিক্ষা, গুরুশুশ্রূষা ও আচরণ বিচার করতেন, ধনসম্পদ আনতে চাপ দিতেন না। গালবও তেমনি শিক্ষা সমাপ্ত হলে গুরুকে প্রণাম করে জিগ্যেস করল, গুরুদেব, কী দক্ষিণা আপনার মনোমত তা যদি বলেন।

    বিশ্বামিত্র বললেন, গালব, তোমার শুশ্রূষা ও সেবায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার আর গুরুদক্ষিণা দেবার দরকার নেই।

    গালব বলল, গুরুদেব, কিন্তু গুরুদক্ষিণা না দিলে আমার গুরুমুখী বিদ্যা সফল হবে না, এরকমই যে শুনেছি।

    গুরু বললেন, বললাম তো, তোমার প্রতি আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। আর কিছু দিতে হবে না।

    অত্যুৎসাহী ব্রহ্মচারী তবুও বারংবার একই অনুরোধ করতে থাকল। বিশ্বামিত্র ক্রুদ্ধ হলেন, ব্রাহ্মণত্বকে চাপা দিয়ে ক্ষত্রিয়প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। অভিমান জেগে উঠল, মুখভাব কঠিন হল। গুরুর মুখের দিকে চেয়ে গালব ভয় পেল, কিন্তু আর কিছু বলবার নেই। বিশ্বামিত্র নিশ্চয় মনে মনে ভাবলেন, আমি ক্ষত্রিয়, প্রতিগ্রহ করলে ব্রাহ্মণের মত দুটো চারটে নিষ্ক দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে না। আমার বহুকালের পুরাতন সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা আছে, সেটা পুরণ কর। না হলে মুখে কেন বলবেন, যদি তোমার গুরুদক্ষিণা দেবার এতই ইচ্ছা, তাহলে চন্দ্রশুভ্র শ্যামৈককর্ণ অষ্টশত অশ্ব আনয়ন কর!

    গালবকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে বিশ্বামিত্র স্থানত্যাগ করলেন। গালব বজ্রাহতের মত খানিকক্ষণ বসে রইল, তারপর স্খলিতপদে ধীরে ধীরে স্থানত্যাগ করল।

    তিন

    অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের প্রবেশতোরণ থেকে যে রাজপথ বের হয়ে কাশী অভিমুখে গিয়েছে, সেই রাস্তা ধরে দুজন হাঁটছিলেন। পাশাপাশি নয়, আগে পিছে। আগের জন অবশ্যই পুরুষ, বয়সে যুবা, লক্ষণ দেখলে বোঝা যায় তিনি একজন ব্রহ্মচারী। মাথার দীর্ঘকেশ চূড়ো করে বাঁধা, পরিধানে মৃত্তিকারঞ্জিত বস্ত্র ও কটিতে মৌঞ্জীবন্ধন, হাতে দণ্ড ও কমণ্ডলু।

    তাঁর পেছনে একজন তরুণী নারী। সুন্দরী এবং তাঁর রূপ বর্ণনা করতে শুধু এতটুকু বলব, যাকে বলা হয় সর্বসুলক্ষণা, তিনি তাই। দেখলে রাজকুলজাতা মনে হয়। কিন্তু ভূষণবিহীন, এমন কি একটা ফুল ও মাথায় গোঁজা নেই, অতি সাধারণ বসনপরিহিতা, বুকের কাপড়টা যেন খানিকটা ভেজা। তরুণীর দৃষ্টি নত, মুখে গভীর বিষণ্ণতা, চলতে পা দুটো যেন জড়িয়ে যাচ্ছে। তবুও চলছেন, যেন চলতে হবেই সেই কারণে। বারে বারে পুরুষটির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান বেড়ে যায়, তাই পুরুষটি পেছন ফিরে দেখেন, অপেক্ষা করেন, তারপর ব্যবধান কমলে আবার পথ চলেন। তরুণীকে সহানুভূতির সুরে বললেন, ভদ্রে, আমরা এখন কাশীরাজ দিবোদাসের কাছে যাচ্ছি। তিনি অত্যন্ত সংযমী, ধার্মিক এবং সত্যপরায়ণ। তুমি শোক করো না। ধীরে ধীরে চল, তাড়াহুড়োর কিছু নেই।

    নারী বললেন, যথা আজ্ঞা মহর্ষি। তিনি জানেন, তাঁর বলার কিছু নেই। তিনি জানতেন না যে কোথায় যাচ্ছেন। ব্রহ্মচারী যেখানে যেতে বলবেন, সেখানে তাঁকে যেতেই হবে। পিতার আদেশে তিনি এই ব্রহ্মচারী ঋষির সঙ্গে এসেছেন। কী অদ্ভুত! পিতার কন্যাকে রক্ষণ করার কথা, যেমন পূর্বতন ঋষি সমাজনিয়ন্ত্রক মনুর আদেশ ছিল, যে নির্দেশকে রাজা থেকে প্রজা কেউ প্রশ্ন করত না--

    পিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্তা রক্ষতি যৌবনে।

    রক্ষন্তি স্থবিরে পুত্রাঃ ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।।

    তাঁর ক্ষেত্রে তা হল না। অথচ পিতা যে সে মানুষ নন। বিখ্যাত ভরতবংশীয় রাজা নহুষপুত্র যযাতি। পিতামহ নহুষ একসময় অস্থায়ীভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। পিতার এক শ্বশুর শুক্রাচার্যের মত মহাজ্ঞানী ঋষি, অন্যজন বৃষপর্বার মত মহাপরাক্রান্ত অসুররাজ। তিনি যেমন প্রতাপশালী, তেমনই ধনৈশ্বর্যবান বলে খ্যাত। সেই পিতা এক ব্রহ্মচারী ঋষির গুরুদক্ষিণা ভিক্ষা দিতে সমর্থ হননি। তাই তার বদলে কন্যা মাধবীকেই ঋষি গালবকে সমর্পণ করে দিয়েছেন, যাতে মাধবী অন্য রাজার সঙ্গে সঙ্গম করে রাজার পুত্র উৎপাদন করে দেন, আর সেই পুত্রের বদলে গালব রাজার কাছে তাঁর মনোমত গুরুদক্ষিণা চেয়ে নেন। কন্যাকে রক্ষা করার কী ব্যবস্থা! তাঁকে, এক অনভিজ্ঞ কুমারীকে কেউ বুঝিয়ে কিছু বলল না। শ্লোকের প্রথম পাদ অনুসরণ না করলেও --- দ্বিতীয়টি সংশয়ান্বিত, এবং তৃতীয় পাদটির এখনো সময় আসে নি -- মনুর শ্লোকের শেষ পাদ তাঁরা অবশ্যই অনুসরণ করেন-- ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়! তাকে যেমন বলা হবে, তেমনি তাকে চলতে হবে।

    এই তো প্রায় বছরদেড়েক আগের কথা। তিনি সখীদের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপে ছিলেন, তাঁর সখীরা স্বয়ংবরের কথা নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিল। সেইসময় রাজা কন্যাকে দর্শনকক্ষে ডেকে পাঠালেন। মাধবী আশ্চর্য হননি। রাজকন্যা হিসেবে বিশেষ মান্য মুনিঋষিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হয়। এবারও দ্বিতলের অলিন্দ থেকে এক তরুণ ব্রহ্মচারীকে এক সঙ্গীর সহিত রাজার নিজস্ব দর্শনকক্ষের দিকে যেতে দেখে সেরকমই ভেবেছিলেন। তাঁর ধাত্রী ও কাছে ছিল। বেশভূষা দেখে তো ব্রহ্মচারী বলে চেনা যায়, তবে পদক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছিল যেন তার আত্মবিশ্বাস কম, সঙ্কুচিত চলন। সঙ্গীটিকে তিনি চিনতে পারেননি। ধাত্রীকে জিগ্যেস করেছিলেন, দেখো, ঋষির সঙ্গে এ কেমন একজন লোক?

    ধাত্রী বলেছিল, এ তো বিখ্যাত গরুড়।

    গরুড়? বিষ্ণুবাহন যাকে বলে সেই?

    হ্যাঁ, আসলে গরুড় উপেন্দ্র বিষ্ণুর সারথি, খুব দ্রুত রথ চালায় বলে মনে হয় যেন উড়ছে। আর সেও ওই কথা শুনতে ভালবাসে, তাই পক্ষীর মুখোশ পরে থাকে। দ্রুতগতিতে রথ চালানোর সময় এই মুখোশ তার মুখকে রোদের তাপ ও খর বায়ু থেকে রক্ষাও করে।

    মাধবী সেই প্রথম গরুড়কে দেখলেন। কত রকম সাক্ষাৎপ্রার্থী ও অতিথি আসে পিতা মহারাজের কাছে! গরুড়ের মত মান্যগণ্য লোকও আসে, মাধবী পিতার জন্য বেশ গর্বিত বোধও করলেন।

    সখী আলোলিকাও সঙ্গে ছিল, বলছিল, হলা সখী মাধবী, তুমি তো বললে না, তোমার কী রকম বর পছন্দ? স্বয়ংবরে তুমি কেমন বরের গলায় মালা দিতে চাও?

    মাধবী হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আমার এমন একজন পুরুষ চাই যার রূপে স্বয়ং কন্দর্প হার মানে; অথচ সে হবে কার্তিকেয়ের মত ভয়হীন বীর যে আমাকে সর্বদা রক্ষা করতে পারবে; অন্যদিকে সে হবে সিদ্ধ ঋষি যে তপোবলে দেবতাদের ও স্পর্ধা করবে, আবার বহুল ধনসম্পদশালী নরপতি যাতে আমি তোদের ইচ্ছেমত পট্টবস্ত্রের শাটিকা, সুবর্ণের কর্ণভূষা, হার, মণিকংকণ ইত্যাদি দিয়েও পর্যাপ্ত পরিমাণে ভাণ্ডারে কিছু থেকে যায়, নাহলে পরের বৎসরের বসন্তোৎসবে আবার উপহার চাইবি তো--।

    তাহলে তো প্রিয়সখী, মানুষ রাজপুত্র হবে না। এতগুলো গুণ বড়জোর চারজন পৃথক মানুষের মধ্যে পেতে পার, একজনের মধ্যে হবে না, বুঝলে সুন্দরী? আলোলিকাও হাসতে হাসতে বলছিল।

    এমন সময় রাজার আদেশ নিয়ে কঞ্চুকী এল। আলোলিকা জনান্তিকে বলেছিল, সখী, যাও, তোমার পিতা মহারাজ নিশ্চয়ই তোমার মনোনীত বর খুঁজে নিয়ে এসেছেন, তাই দেখতে যেতে বলেছেন।

    বড্ড ধৃষ্ট তুই, দাঁড়া, ফিরে এসে দেখাচ্ছি —-- হাসতে হাসতে মাধবী পিতার কাছে গিয়েছিলেন। তারপর এই আদেশ! আর বিশ্রম্ভকক্ষে সখীদের কাছে ফিরে যাওয়া হয়নি।

    আপাত কারণ এই গালবের অদ্ভুত গুরুদক্ষিণা। গুরু তাকে আদেশ দিয়েছেন গ্রাম্য আটশত শুভ্র শ্যামৈককর্ণ ঘোটক নিয়ে আসতে, অর্থাৎ ঘোড়াগুলো হবে গ্রাম্য, মানে পোষা, বন্য নয়, আর বর্ণ হবে নিষ্কলঙ্ক সাদা, অথচ একটি কান কালো।

    গালবের তো মাথায় হাত! দুটো চারটে নয়, একেবারে আটশত এই বিশেষ ধরণের অশ্ব-দক্ষিণা! দিতে অক্ষম হলে গুরুর অভিশাপের ভয়! সমস্ত অর্জিত বিদ্যা নষ্ট! এই ঋষিরা সংযমী বটে, কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে অস্বাভাবিক আদেশ দেন, এবং সেই আদেশ পালন না হলে অবধারিত অভিশাপ! দরিদ্র বটু এইধরণের অশ্ব দুষ্প্রাপ্য জেনে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল-- হয় গাছ থেকে ঝুলে পড়বে, নয় নদীতে ঝাঁপ দেবে। ভাগ্যিস তার বাল্যবন্ধু গরুড় সেসময় এসে পড়েছিল। গরুড় দেবরাজ ইন্দ্রের ভ্রাতা পরাক্রমশালী বিষ্ণুকে নিয়ে পৃথিবী পরিভ্রমণ করে, ফলে সে নানা সংবাদ রাখে, অত্যন্ত সাহসী, বলশালী এবং বুদ্ধিমানও। গালবের গুরুদক্ষিণা কোথায় পাওয়া যাবে সেই কথা ভাবতে ভাবতে গালবকে নিয়ে প্রথমটা অনেক ঘোরাঘুরি, অনেক জল্পনা করেছিল। গালব দেখেছিল, গরুড় সহায়তা করতে অত্যন্ত আগ্রহী, তবে মধ্যে মধ্যে কুকর্ম ও করে ফেলে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় তারা দুজন শাণ্ডিলী নামে তপস্বিনীর আশ্রমে বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল । শাণ্ডিলী তাদের স্বাগত জানিয়ে যথাসাধ্য আতিথ্য করেছিলেন। একান্তে গরুড় গালবকে ফিসফিস করে বলেছিল, এই ব্রাহ্মণী একা একা আশ্রমে বসে তপস্যা করে যৌবন, শরীরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে, দেখ। আগে একজনের কথা বলেছিলাম না? তোমাকে দক্ষিণদিকে যখন নিয়ে গিয়েছিলাম তখন শিবা নামের বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীকে দেখিয়েছিলাম, মনে আছে? উনি সারা জীবন বেদ পড়লেন, পরে বেদেই সন্দেহ প্রকাশ করলেন, বেদ নাকি অপৌরুষেয় নয়! ভীমরতি আর কী। এইজন্য লোকে ওঁকে নাস্তিক বলে, এই বুড়োবয়সেও ওঁর সঙ্গে কেউ বাক্যালাপ করে না, একাই থাকেন। মেয়েরা বেশি পড়লে এমনি হয়।

    কী যে বল, সখা। গালব বলেছিল।

    গরুড় বলল, ঠিকই বলছি। কী দরকার মেয়েদের ত্রিবেদ পড়বার? ওদের বিয়ে করে সংসার করলেই ভাল। না হলে সারাজীবন সংশয়েই কাটবে। আমার প্রভুপত্নী লক্ষ্মীদেবী আদর্শ নারী। তিনি এত সুন্দরী, ধনধান্যের ভাণ্ডার তাঁর কাছে, তবুও বসে বসে স্বামীর পদসেবা করেন, তপস্যা অধ্যয়ন এইসব নিয়ে মাথা ঘামান না।

    তা ঠিক, লক্ষ্মীদেবী অবশ্যই নারীর আদর্শ। তবে সংশয়ী নারীঋষিই শুধু নয়, সংশয়ী মুনিও তো আছেন। কপিল সংশয়ী নন?

    আরে, আমি নারীদের কথা বলছি। পুরুষ বিদ্যাভ্যাস করবে, সংশয়িত হবে, অর্থোপার্জন করবে, পরিজনের ভরণপোষণ করবে, এ তো স্বাভাবিক। নারী রূপযৌবন দিয়ে পুরুষকে ভোলাবে, আনন্দ দেবে, সেবা করবে, সন্তানের জন্ম দেবে, এই তো। আর দেখ, এই ব্রাহ্মণী শাণ্ডিলী। সুন্দরী, দেহের সৌষ্ঠব এত আকর্ষণীয়। প্রভু বিষ্ণুর দুর্নাম হবে, নাহলে আমিই-- গালবের দিকে চেয়ে গরুড় চোখ মটকাল-- কী দরকার এর এত তপস্যা করার? দাঁড়াও, আমি ওকে তুলে নিয়ে যাব, একদম বিষ্ণুলোকে নিয়ে ছেড়ে দেব। দেখে আসবে স্ত্রীজাতির কী করণীয়। বলতে বলতে হেসে ফেলল গরুড়, চাই কি বিষ্ণুর অনুচর কাউকে ওর ভালোও লেগে যেতে পারে। আর তপস্যা করতে হবে না।

    তাঁকে তুলে নিয়ে যাবার অভিসন্ধি শাণ্ডিলী বুঝে ফেলেন এবং গরুড়কে এমন শাস্তি দিলেন যে পরদিন সকালে সে শরীর তুলতে পারছিল না। গালব ও ভয় পেয়ে গেল, এখন কী হবে! তার গুরুদক্ষিণা কী করে পাওয়া যেতে পারে সেজন্যই না গরুড় তার সঙ্গে বেরিয়েছে। এখন এই বিপদ। সে বলল, সখা, শাণ্ডিলীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, নইলে কে জানে আমাদের কতদিন এখানে থাকতে হবে। আমার তো সবই শেষ হয়ে যাবে। গালব প্রায় কাঁদোকাঁদো। অবস্থার বিপাকে গরুড় শাণ্ডিলীর শরণাপন্ন হল। অনেক প্রার্থনার পর শাণ্ডিলী তাকে পুনরায় এই ধরণের ধৃষ্টতা না করবার সতর্কবার্তা দিয়ে ক্ষমা করলেন এবং গরুড় তার বল ফিরে পেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বিনা বাক্যব্যয়ে স্থানত্যাগ করল।

    সেই ঘোরাঘুরির সময়ে পথে দেখা হওয়ায় বিশ্বামিত্র নাকি গালবকে গুরুদক্ষিণা নিয়ে আসার জন্য আরেকপ্রস্থ তাড়া দিয়েছেন। সে ক্ষমা প্রার্থনা করে আরো পাঁচবছর সময় চেয়ে নিয়েছে।

    গরুড় বলল, বিশ্বামিত্র যতই ব্রাহ্মণত্ব লাভ করুন, অন্তরের ক্ষত্রিয়সুলভ ঐশ্বর্যের আকাঙ্‌ক্ষা, অহংকার, দরিদ্রের প্রতি বিদ্বেষ যায়নি, বোঝা গেল। তাই তিনি বেচারি শিষ্যকে এরকম কঠিন শর্ত দিয়েছেন।

    গালব বলল, সখা, আমি এঁর শিষ্য, আমার কাছে গুরুনিন্দা করো না। বরং কোনো উপায় বল, যাতে আমি এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।

    যা দেখছি, তোমাকে প্রথমে ধন উপার্জন করতে হবে, যাতে এই সংখ্যক অশ্ব ক্রয় করতে পার। কিন্তু ধন আর এমনিতে কে কাকে দেয়। অত দান করার ধন পৃথিবীতে রাজারা ছাড়া কারো কাছে নেই। সব রাজার কাছে আবার বেশি ধন থাকে না, এবং সকল রাজা দানশীল নন। একটা কাজ করা যেতে পারে। রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সম্পদ্‌শালী হচ্ছেন মহারাজ যযাতি, বিখ্যাত চন্দ্রবংশের সন্তান, এবং যতদূর জানি, তিনি দানশীল ও বটেন। লোকে বলে তাঁর ধনভাণ্ডার কুবেরের ভাণ্ডারের থেকে ন্যূন নয়। চলো, তাঁর কাছে যাই।

    পিতা তাঁকে ডাকছেন শুনে দ্বিতল থেকে নেমে এসে মাধবী তাঁর সামনে আসার অবসর খুঁজছিলেন, কারণ তখন রাজার সঙ্গে কারো কথা হচ্ছিল। আড়াল থেকে দেখলেন, সেই দুজন লোকই, একজন দীনভাবাপন্ন বটু, যে নিজের কথাটুকুও বলতে পারছে না, লজ্জায়, ভয়ে ম্রিয়মান। দয়া হয় তাকে দেখে। বোধ হয় এই প্রথম সে রাজদর্শনে এসেছে। তার হয়ে কথা বলছে সেই বিষ্ণুসারথি গরুড়। গরুড়ই গালবের গুরুদক্ষিণার কথা রাজাকে বলল অত্যন্ত বাক্‌পটুতার সঙ্গে। সেই সঙ্গে এ-ও বলল, মহারাজ, অর্থীকে দান করলে পুণ্য হয়, আর গুরুদক্ষিণার জন্য কোনো ব্রহ্মচারীকে অশ্ব দান করলে সেই পুণ্যবান দানী ব্যক্তি অশ্বের শরীরে যত লোম আছে সেই সংখ্যক বৎসর স্বর্গসুখ ভোগ করে।

    মাধবীর পিতা প্রতিষ্ঠান রাজ্যের রাজা যযাতি দানশীল বটে, কিন্তু অসম্ভব ভোগাকাঙ্ক্ষী পুরুষ। বৃষপর্বাদুহিতা শর্মিষ্ঠাকে লুকিয়ে বিয়ে করে জ্যেষ্ঠা পত্নী শুক্রনন্দিনী দেবযানীকে অসুখী করার জন্য শুক্রাচার্য তাঁকে অচিরেই জরাগ্রস্ত হবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। যযাতির ভোগবাসনা তখনো পূর্ণ হয়নি, প্রতিদিন আরো ইন্দ্রিয়সুখ চাই, - -- জরাগ্রস্ত হলে ভোগ থেকে সম্পূর্ণ বিদায় নিতে হবে, তাই অনেক অনুনয়ের পর শুক্র প্রতিকারের বিধান দিয়েছিলেন -- যদি কেউ তাঁর জরা নিজের দেহে নিতে ইচ্ছুক হয় এবং পরিবর্তে তার যৌবন তাঁকে দান করে, তাহলে তিনি আবার যৌবনের ভোগসুখ করতে পারবেন। তাঁর পাঁচটি পুত্র, দুই রানির থেকে। কিন্তু কোনো ছেলেই পিতার জরা দেহে নিয়ে নিজেকে অকালে বৃদ্ধ বানাতে ইচ্ছুক হল না, শেষপর্যন্ত ছোট ছেলে পুরু নিজের যৌবন তাঁকে দিয়ে তাঁর জরাভার গ্রহণ করল। সেই ষোড়শবর্ষীয় তরুণের যৌবন নিয়ে যুবক হয়ে পিতা বহুকাল, খুব সুখে ভোগে কাটালেন তো ঠিক, কিন্তু এত দীর্ঘ যৌবনের যথেচ্ছাচারে রাজকোষের সমস্ত সম্পদ ও শেষ করে ফেললেন। নূতন যৌবন পেয়ে যযাতি যেন আরো উদ্দাম হয়ে উঠেছিলেন। এ বারে পত্নীদের সঙ্গ তাঁর আর বেশিদিন ভাল লাগল না, তাঁরা পুরাতন হয়ে গিয়েছেন, যৌবনও প্রায় পেরিয়ে এসেছেন। তাই ইন্দ্রসভার লাস্যময়ী অপ্সরা বিশ্বাচীকে আনানো হল বহুব্যয়ে, তিনিই হলেন রাজার নবতমা সঙ্গিনী। রাজকার্য সমস্তই রাজা অমাত্যদের উপর ছাড়লেন, নিজে বিশ্বাচীর নৃত্যগীত ও যৌবন উপভোগ করে আমোদপ্রমোদে দিন কাটাতে লাগলেন।

    যযাতির সমস্ত সন্তানদের মধ্যে কনিষ্ঠ এই মাধবী, জ্যেষ্ঠা পত্নী দেবযানীর কন্যা। সে পঞ্চদশী, লোকনিয়মে তার বিবাহের বয়স হয়েছে, কিন্তু তার জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন করা গেল না, কারণ তা লোকবল এবং বহুব্যয় সাপেক্ষ। স্বয়ংবর সভাতে দেশবিদেশের বহু রাজাকে সংবাদ দেওয়া হয়, যাঁরা আসেন তাঁদের সপার্ষদ যথাযোগ্য সংবর্ধনা ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে হয়। বহু ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণের দর্শক আসেন, তাঁদের ও আপ্যায়ন করতে হয়। খাদ্য পানীয় ও আসন ও প্রয়োজনে বিশ্রামের ব্যবস্থা রাখতে হয়। এসব কারণেই লোকবল ও ধনবল চাই। এদিকে জরা না নেওয়ায় জ্যেষ্ঠ যদু থেকে শুরু করে চার পুত্রকেই যযাতি অভিশাপ দিয়েছেন, তারা প্রত্যেকে প্রত্যন্ত দেশে নির্বাসিত হয়েছে। যে কনিষ্ঠ পুত্র পিতৃভক্ত পুরু তাঁকে যৌবন দিয়েছিল, এবং সন্তুষ্টচিত্তে তিনি যাকে আপন উত্তরাধিকারী করেছিলেন, সে রাজার অনুপস্থিতে রাজার কাজ চালায় বটে, কিন্তু একদিকে বয়স অল্প হওয়াতে অনভিজ্ঞ, অন্যদিকে জরাগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় শারীরিক দুর্বল; অতএব রাজকোষের ধনবৃদ্ধির জন্য কাজ করতে সে সক্ষম নয়। যযাতি যখন রাজধানীতে থাকেন, তখন কখনো কখনো রাজসভায় আসেন, বা নিজের দর্শনকক্ষে দর্শনপ্রার্থীকে সাক্ষাৎকার দেন।

    রাজার অতিথি যোগীঋষিরা রাজকন্যার আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হলে তাঁকে আশীর্বাদ করেই যান, সব সময়ই প্রায় একই রকম -- তোমার পতি রাজচক্রবর্তী হোন, বা রাজচক্রবর্তী পুত্রের জননী হও। হ্যাঁ, কোনো কোনো সিদ্ধ পুরুষ কিছু অদ্ভুত কাজ শিখিয়ে যান বটে। যেমন একজন যোগী মাধবীকে কিছু ব্যায়াম শিখিয়েছিলেন, প্রসবের পর সেসব করলে প্রসূতির উদর ও উরুর স্থূলতা হ্রাস পায় এবং প্রায় কুমারীর শরীরের মত হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তিনি কিছু ওষধির কথাও বলেছিলেন, যেগুলো পিষ্ট করে রস লাগালে গর্ভস্ফীতির কারণে উরু, স্তন ও উদরের ত্বকে হওয়া কলঙ্করেখাও দূরীভূত হয়। সেই যোগী যাবার সময় পিতাকেও কন্যার প্রশংসা করে কিছু বলে যান। সেইরকম আরেকজন এক অতিথি যোগী মাধবীকে ‘তুমি বহু রাজচক্রবর্তী পুত্রের জননী হবে’— বলে আশীর্বাদ করেছিলেন। সেই কথাগুলোই যযাতি সেদিন গালব ও গরুড়কে অন্যভাবে বললেন,--- ততক্ষণে মাধবী রাজার সম্মুখে এসেছেন --- আমার এই কন্যাটিকে একজন সিদ্ধ যোগী বর দিয়েছেন, সে চারজন রাজচক্রবর্তী পুত্রের জন্ম দেবে, এবং প্রত্যেক পুত্রের জন্মের পরই কুমারীভাব ধারণ করবে। আমার কাছে আপনার প্রয়োজনীয় সেই বিশেষ অশ্বের অভাব, এবং দুর্ভাগ্যক্রমে সেই অশ্ব ক্রয় করার ধনও অপ্রতুল। কিন্তু আমি আপনাকে বিমুখও করতে পারি না, আপনি ব্রহ্মচারী, গুরুদক্ষিণার জন্য সাহায্য চাইতে এসেছেন; এবং এই বিষ্ণুসহচর গরুড় সর্বজনমান্য, এঁর কথাও অগ্রাহ্য করবার নয়। তাই অশ্বপ্রাপ্তির নিমিত্ত একটি উপায় বলছি-- আমার এই কন্যাকে দিয়ে চারজন রাজার ঔরসে চার পুত্র উৎপাদন করিয়ে আপনি সেইসব রাজার কাছ থেকে শুল্কস্বরূপ অশ্ব পেতে পারবেন, আপনার গুরুদক্ষিণা হয়ে যাবে।

    অতিথিরা রাজার এই কথা শুনে একটু চমকেই গিয়েছিলেন। রাজা বললেন, আমার নিজের এতে কোনো লাভের অভিসন্ধি নেই। শুধু দৌহিত্র পেলেই আমি খুশি।

    পিতা যখন নিজের অপারগতা জানিয়ে মাধবীকে গালবের সঙ্গে দিয়ে দিলেন, কন্যাকে পুত্রোৎপাদনের জন্য কোনো রাজার হাতে দিয়ে পরিবর্তে শুল্কস্বরূপ অশ্ব নিতে, মাধবী বাধ্য কন্যার মত নিরুত্তর রইলেন। তিনি পিতার আদেশের অন্যথা করতে পারেন না। তাঁর উপর এখন দুজন পুরুষের সম্মান এবং ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। পিতার কথার সত্য তাঁকে রাখতে হবে ব্রহ্মচারীর গুরুদক্ষিণা প্রাপ্তির সহায়তা করে, এভাবে তাঁর পিতৃঋণ শোধ হবে। সেই শোধ করাটা কী করে কতদিন ধরে চলতে পারে, তাতে তাঁর নিজস্ব জীবনের কী পরিবর্তন হতে পারে, তা সেই মূঢ় কিশোরীর মাথায় আসেনি, এবং পুত্রের বদলে যদি কন্যা হয় তাহলেই বা কী হবে, তাও কেউ বলেনি।

    রাজা সমস্যা সমাধানের যে পথ বলে দিলেন, তাতে গালব ইতস্তত করছিল। কিন্তু গালবের বন্ধু গরুড় এই ব্যবস্থায় অনেকটা নিশ্চিন্ত এবং সন্তুষ্ট হয়েছিল। সে বহুদর্শী, জানে চলন্ত রথের চাকার নিচে অনেক জীবের পিষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে, যুদ্ধে অনেক নিরপরাধের মৃ্ত্যুর আশঙ্কা থাকে। সেসব কথা নিয়ে চিন্তা করলে এগিয়ে যাওয়া যায় না, যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না। গালবের এখন এগিয়ে যাবার সময়, জীবনযুদ্ধে নামবার সময়। সেখানে এই রাজকন্যাকে ব্যবহার করার দরকার হলে করতে হবে আবেগ ছাড়াই। সে বলেছিল, নারীর গর্ভে তো সন্তান আসেই, নারীকে সেই কারণে ব্যবহার করলে ক্ষতি কী! এ মেয়ে সুন্দরী, অত্যন্ত আকর্ষণীয়া। এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য সিদ্ধির সম্ভাবনা আছে। তুমি নিজে থেকে তো আর মেয়েটির কিছু ক্ষতি করতে যাও নি, তার পিতাই তাকে তোমার হাতে দিয়েছেন। তাহলে তোমার মনে দোলাচল কেন? এ ছাড়া তোমার গুরুদক্ষিণা শোধ করার উপায় কোথায়? গালব নিরুপায় হয়ে সম্মত হল, আর গালবের সমস্যার সমাধান হল ভেবে গরুড় তাকে দু একটা দরকারি কথা বলে চলে গেল নিজের পথে।

    আর গালবের সঙ্গে বেরোনোর সময় মাধবী বেশ খুশিমনে সেটাকে একটা অন্যরকম স্বয়ংবর বলে ভেবে নিয়েছিলেন। অশ্বপতি রাজার মেয়ে সাবিত্রীর কথা জানা ছিল, যিনি নিজেই দেশে দেশে ঘুরে শেষপর্যন্ত সত্যবানকে নিজের পতি নির্বাচন করেছিলেন। এতদিন পিতার প্রাসাদের চতুঃসীমার ভেতরেই চলাফেরা মোটামুটি সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু শাস্ত্রপাঠ, কিছু গার্হস্থ্য কর্মের অভ্যাস, নৃত্য সঙ্গীত কলাবিদ্যা অভ্যাস, মান্যগণ্য অতিথি বিশেষ করে মুনিঋষি এলে তাঁদের পাদ্য, অর্ঘ্য, আসন, খাদ্য, পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন, এসব ছিল রাজকুমারীর নিত্যকর্ম। মাঝেমাঝে প্রাসাদের বাইরের কোনো কাননে, সরোবরে সখীদের সঙ্গে মিলে স্নান করতে, পুষ্পচয়ন করতে যেতেন। এখন রাজপথে বেরিয়ে মানুষ পশু পাখি গাছপালা আকাশ জলাশয় সবই খুব আকর্ষক লাগছিল, বালিকাসুলভ কৌতূহলে পথ এবং পথের চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন। এভাবেই যেতে যেতেই হয়তো কোথাও সেই শ্রেয় রাজপুত্রের সন্ধান পেয়ে যাবেন, কখনো কখনো মনে এই সুখের ভাবনাও উঁকি দিচ্ছিল।

    এখন দেড়বছর সময় পরে, পথে চলতে চলতে মাধবী ভাবলেন, পিতা তো বলতেন, তাঁর ইন্দ্রের সঙ্গে সখ্য আছে, অসুররাজ বৃষপর্বা তাঁর শ্বশুর। তাঁদের কাছ থেকেও তিনি অর্থ চাইতে পারতেন। সেই অর্থ দিয়ে গালব রাজাদের কাছ থেকে ঘোড়া কিনতে পারত। তাছাড়া, অন্য পন্থাও ছিল। অনেক রাজ্যের রাজপরিবারে কন্যাশুল্কের নিয়ম আছে। বরের থেকে শুল্ক গ্রহণ করে কন্যা বিবাহ দেওয়া হয়। কোনো একজন রাজার কাছে অর্থশুল্ক নিয়ে বিবাহার্থে সমর্পণ করলেও হত, তাহলে স্তনন্ধয় সন্তানকে ত্যাগ করে আসতে হত না। পিতা নিজে চাইলে হয়তো হত। সেটা হল না, কারণ অভিমানী ভরতবংশীয়দের অন্যের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করা বা কন্যাশুল্ক গ্রহণ করার নীচ নিয়ম নেই! কন্যাশুল্ক গ্রহণ করার প্রথা তাঁদের কাছে কন্যাবিক্রয়ের সমান। তাঁরা বলেন, কন্যার থেকে তাঁদের একমাত্র আশা হল দৌহিত্র। দৌহিত্র যার আছে সে পুণ্যবান, তার জন্য মাতামহকুলের স্বর্গলোক লাভ হয়। তাঁকে দেবার সময়ে তাঁর পিতা যযাতিও গালবকে এই কথা বলেছিলেন।

    আর এখন সবিস্ময়ে, হতাশার সঙ্গে মাধবী দেখলেন, আসলে যা তাঁকে করতে হচ্ছে, তা হল ব্রাহ্মণের গুরুদক্ষিণার জন্য গর্ভভাড়ার খেপ খাটা! কে জানে কতদিনে এই খেপ খাটা শেষ হবে। আর সংসারের গতি সম্পর্কে অনবহিত তিনি কিছু না বুঝেই পিতার কথা শুনে এবং বালিকাবুদ্ধির বশে নিজেকে চারজন রাজার কাছে শুল্কের বদলে পরিগ্রহ করার জন্য দিতে গালবকে বলেছিলেন, অযোধ্যারাজ হর্যশ্বের সামনেই। কিশোরীর কোমল হৃদয় ব্রহ্মচারীর দুঃখে গলে গিয়েছিল।

    গরুড়ের উপদেশ অনুসারে প্রথমবার যখন মাধবীকে নিয়ে গালব রাজা হর্যশ্বের কাছে গিয়েছিল, তখন শুনল যে রাজার কাছে মাত্র দু’শ ঘোড়া আছে, সে হতাশ হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় তার ধারণা ছিল একজন রাজার কাছেই আটশত ঘোড়া হয়ে যাবে। যখন তা হল না, সে নিরুৎসাহ হয়ে ফেরত যেতে প্রস্তুত হয়েছিল। মাধবী তার মুখ দেখে দুঃখিত হয়েছিলেন, আহা, তরুণটি বড়ই সরল, নিজের কথা একটু গুছিয়ে বলতেও জানে না। একে না আশা দিলে সে হয়তো আত্মহত্যা করতে পারে। তাই তিনি তাকে পিতার সেই কথাগুলোই একটু অন্যরকম ভাবে বলেছিলেন, দ্বিজ, হতাশ হয়ো না। আমাকে একজন সিদ্ধপুরুষ বর দিয়েছেন, আমার গর্ভে চারজন চক্রবর্তী-লক্ষণযুক্ত পুত্র হবে, এবং প্রত্যেক প্রসবের পর আমি আবার কুমারী হয়ে যাব। তাই বলছি, তুমি এই রাজাকে হ্যাঁ বলে দাও, এঁর পুত্রের জন্ম হয়ে গেলে তুমি আমাকে পুত্র উৎপাদনের জন্য আর কোনো রাজার কাছে দেবে, এবং এভাবেই তোমার কার্যসিদ্ধি হয়ে যাবে। মাধবীর কথা শুনে গালব মনে জোর পেয়েছিল।

    রাজা হর্যশ্ব যৌবনপ্রাপ্ত, বিবাহিত, কিন্তু তাঁর পুত্রসন্তান হয়নি এখনো। তিনি উত্তরাধিকারীর কামনায় যজ্ঞ করছিলেন। গালব যখন তাঁর কাছে গিয়ে মাধবীকে দেখিয়ে বলেছিল, এই সুলক্ষণা কন্যা বর পেয়েছে, সে রাজচক্রবর্তী পুত্রসন্তান অবশ্যই প্রসব করবে, রাজা একে গ্রহণ করে চারটি পুত্র পেতে পারেন, তবে প্রতি পুত্রের বিনিময়ে গালবকে দু’শ করে আটশত একটা কান কালো কিন্তু সর্বাঙ্গ সাদা অশ্ব শুল্ক দিতে হবে, রাজার দৃষ্টি পড়েছিল মাধবীর উপর। তাঁর চোখ সরছিল না, কী মোহক এই কুমারীর রূপ! যেমন মিষ্টি এর গলার স্বর, তেমনি লোভনীয় এর শরীর! পদ্মপলাশের মত চোখ, রক্তিম ওষ্ঠাধর, রক্তিম হাতের তালু, চম্পককলির মত অঙ্গুলি, পা, গ্রীবা, স্তনদ্বয়, উদর, কটি, নিতম্ব, উরু -- পরিধেয় বস্ত্র ভেদ করে যুবক রাজার লোলুপ দৃষ্টি মাধবীর সুগঠিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মধুলোভী মৌমাছির ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর মত ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তিনি কামমোহিত হয়েছেন, মাধবী বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর লজ্জা লাগছিল। অন্য সময় হলে তিনি হয়তো সরে যেতেন, বা উত্তরীয় বস্ত্র টেনে শরীর ভাল করে আবৃত করতেন, কিন্তু এখন তিনি তা করতে পারেন না। তাঁকে রাজার দৃষ্টি আকর্ষণই করতে হবে, গালবকে পরিত্রাণের ভার তাঁর হাতে।

    কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে রাজা হর্যশ্ব মাত্র এক চতুর্থাংশ শুল্ক দিতে পারবেন, তাঁর কাছে গালবের চাহিদামত ঘোড়া মাত্র দু’শ আছে। তাই এই শুল্কের বিনিময়ে তিনি এই কন্যাতে একটি মাত্র পুত্র উৎপাদন করবেন-- এই কথা শুনে হতাশ গালবের প্রতি মাধবীর আশ্বাসে দুজনেই রাজী হয়েছেন। শর্ত হল, একবছরের শেষে রাজার পুত্র হলে তিনি এসে শুল্কসহ মাধবীকে নিয়ে যাবেন। মাধবী সেই একটি বছর ঈশ্বরের কাছে কত প্রার্থনা করেছেন, বছর যেন না ফুরায়। তাঁর জীবনের প্রথম পুরুষ এই হর্যশ্ব। শরীরলুব্ধ হলেও তাঁকে তিনি ভালবেসেছিলেন। প্রথম যৌবনে শরীর শরীরকে কামনা করে। সুপুরুষ, তেজস্বী আকার, এরকম পতি তো মাধবীরও কাম্য ছিল। হর্যশ্বও তাঁকে সুখী করবার চেষ্টা করেছেন, তাঁকে নিয়ে কত দিন কত মনোহর স্থানে বিহার করতে নিয়ে গেছেন, কত উদ্যানে, পুষ্পকাননে, শৈলসানুতে, সরোবরে, কলস্বনা নির্ঝরিণীর উপত্যকায়। জ্যোৎস্না রজনীতে সেসব রমণীয় স্থানে বসে দুজনে কত বিশ্রম্ভালাপ করেছেন, কখনো বা এমনি নীরবে বসে পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করেছেন। মাধবীর মনে হত, বলেন, সখা, আমার হাত কখনো ছেড়ো না। কত মহার্ঘ ভূষণ বসন হর্যশ্ব উপহার দিতেন, প্রতিদিন জিগ্যেস করতেন, তাঁর কোনো কষ্ট হচ্ছে কী না। রাজকার্য শেষ করেই তিনি চলে আসতেন মাধবীর কাছে, তাঁকে দেখে দেখে, তাঁকে আলিঙ্গন করে, তাঁর প্রতিটি প্রত্যঙ্গে চুম্বন করে, কামপীড়ন করে যেন তৃপ্ত হতেন না। সেই স্পর্শ, সেই উন্মাদনা কি আর ভোলা যায়!

    অতঃপর তিনি গর্ভবতী হলেন, পুত্র বসুমনা এল। কী সুন্দর সোনার পুত্তলি, মাখনের ডেলার মত নরম, একটি সন্তান! তাঁর প্রথম সন্তান। তার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, তার ছোট ছোট হাতপায়ের প্রত্যেকটি নড়াচড়া, তার মুখের নানারকম ভঙ্গী, তার কান্না, ঘুমের মধ্যে তার হাসির বিদ্যুৎঝলক, একটাও চোখ এড়িয়ে গেলে মনে হয় কিছু হারালাম। ধাত্রী থাকে সবসময়, তার হাতে দিতে ইচ্ছে হয় না, মনে হয় সারাক্ষণ শিশুটিকে বুকে ধরে রাখি। কিন্তু মাত্র একটি মাস তাকে বুকে ধরে রাখতে না রাখতে, তাকে নিজের বুকের দুগ্ধধারা পান করাতে না করাতে সময় এসে গেল যাবার। তিনি প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলেন যে তাঁকে এসব ছেড়ে চলে যেতে হবে বিনা বাক্যব্যয়ে। তাঁর ইচ্ছের কোনো মূল্য নেই, তিনি নিজে বিক্রয়ের পণ্যমাত্র।

    গালব সংবাদ পেয়েছেন মাধবীর গর্ভে অযোধ্যার রাজপুত্রের জন্ম হয়েছে, তাই শর্ত অনুসারে একবছর পর এসেছেন, শুল্কের ঘোড়াগুলো গুণে নিয়ে হর্যশ্বের কাছেই গচ্ছিত রেখেছেন, পুরো দক্ষিণা যোগাড় না হওয়া পর্যন্ত। রাজার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে বলেছেন মাধবীকে বার্তা পাঠাতে।

    শেষবারের মত স্তন্যপান করিয়ে, মনে মনে তার মঙ্গল কামনা করে মাধবী শিশু বসুমনাকে ধাত্রীর কোলে সমর্পণ করলেন। এবার বুকে পাষাণ বেঁধে যেতে হবে। পাষাণ কি আর বাঁধা যায় বুকে! চোখের জল ঝর ঝর করে পড়তে থাকে, দুধের ধারায় বুকের বসন ভিজে যায়, সন্তানকে বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পিতৃসত্য তাঁকে রক্ষা করতে হবে, ব্রাহ্মণের গুরুদক্ষিণার ব্যবস্থা করে তাঁকে অভিশাপ থেকে বাঁচাতে হবে। মাধবী শরীর থেকে বহুমূল্য আভরণ খুললেন, ধাত্রী ও প্রিয়কারী দাসীদের দিলেন। ধাত্রীকে হাত ধরে বললেন, আমার পুত্রকে দেখো। দেখো, ও যেন খিদেয় না কাঁদে। পরনের ক্ষৌমবস্ত্র খুলে ফেলে ভ্রমণের উপযোগী পরিধেয় -- সাধারণ কার্পাসবস্ত্রের অধোবাস, নীবি, কঞ্চুলিকা ও উত্তরীয় পরলেন, আর পেছনে না তাকিয়ে রাজপ্রাসাদের সামনের দরজায় এলেন। হর্যশ্ব সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁকে প্রণাম করলেন, চলি, আর্যপুত্র। আর হয়তো কোনোদিন দেখা হবে না। থমথমে মুখে হর্যশ্ব তাঁকে ধরে উঠালেন, সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিলেন। বললেন, তোমার আর কি। আমার থেকে ধনবত্তর অন্য রাজার শয্যায় শোবে, নূতন সংসার পাতবে।

    বিদায়বেলায় মাধবী এই রূঢ় বাক্য আশা করেন নি হর্যশ্বের কাছ থেকে। জলভরা চোখে কিছু একটা বলতে চাইছিলেন, গলায় আটকে গেল।

    হর্যশ্ব আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন, যাও, গালব অপেক্ষা করছেন।

    মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে চিন্তিত গালব রাজপ্রাসাদের তোরণের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন, বললেন, ভদ্রে, চলো।

    চার

    সদ্যোজননী রাজকন্যা ব্রহ্মচারীর সঙ্গে পথে পদব্রজে বের হলেন।

    প্রথমদিকে চলতে চলতে মাঝেমাঝেই মাধবীর চোখের জলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গাল গড়িয়ে বুকে নামত, ভোক্তার অভাবে বুকের অপীত দুধের প্রস্রবণধারার সঙ্গে চোখের ধারা মিশত, বুকের কাপড় ভিজত, শুকোত, আবার ভিজত। একদিন তাঁরা পথের ধারে বৃক্ষতলে বিশ্রাম করছিলেন। বানরদের একটি দল কাছেই অন্য বৃক্ষে কিচিরমিচির লাফালাফি করছিল প্রচণ্ড। তারা যেন দারুণ উদ্বেলিত-- কিছু একটা সাংঘাতিক ঘটনা বানরপরিবারের মধ্যে ঘটেছে। দেখলেন, একটা শিশু বানর বৃক্ষ থেকে নিচে পড়ে রয়েছে, কিছু দূরে একটি দ্বীপী একটি বড় বানরকে ঘাড়ে কামড়ে নিয়ে গভীর বনে ঢুকে গেল। মাধবী আঁৎকে উঠলেন।

    এই বনাঞ্চলে এসব হিংসা আছে বটে, গালব বললেন, ভদ্রে, এক প্রাণী অন্য প্রাণীর ভক্ষ্য, এ প্রকৃতির নিয়ম, তাই উদ্বেল হয়োনা।

    মাধবী ভাবলেন, তাঁর অবস্থাও কি কতকটা ওই বানরের মত নয়? তিনি স্ত্রীজাতীয় মানুষ, হত্যা করা হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর মানসিক যাতনা হত্যার থেকে কতটুকু কম? এর চাইতে কোনো দ্বীপী ধরে নিয়ে যেত, তার খাদ্য হলেই বা কী হত!

    তিনি বানরশিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। অনুমান করলেন দ্বীপীদ্বারা নিহত বানরটি তার মা। পশুশিশুটি মাতৃভ্রমে তাঁর বুকে গন্ধ শুঁকতে লাগল, তিনি তার প্রয়োজন বুঝতে পেরে নিজের স্তনবৃন্ত তার মুখে দিলেন। সে তাঁর স্তন্য পান করে তাঁর কোলেই ঘুমিয়ে পড়ল। নিশ্চিন্ত নির্ভয় শিশু! সেদিন তাঁরা অনতিদূরের এক গোষ্ঠরক্ষক বনবাসী গোপের আশ্রয়ে ছিলেন। বানরকুল কিন্তু তাঁদের সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে গেল, তারা দেখে রাখতে চাইছিল তাদের কুলের শিশুটিকে। মানুষীর কোলে শিশুটি নিশ্চিন্তে আছে দেখে তারা আশ্বস্ত হল।

    বেশ কিছুদিন বানর শিশুটি তাঁর যত্নে ছিল, তিনি চলতে চলতেই তাকে বহন করছিলেন, মাঝে মাঝে বানরদের মধ্যে ছাড়ছিলেন। বানরেরা সঙ্গেই চলছিল। কিছুকাল অতিবাহিত হলে শিশুটি মাঝে মাঝে তার পরিবারের সঙ্গে যেতে আরম্ভ করল, অন্য বানরশিশুর সঙ্গে তার সখ্য হল, কিন্তু তাঁর কাছে সে দুধ খেতে আসত, কোলে বসে থাকত। দেখাদেখি অন্য বানরশিশুরাও তাঁর কাছে আসত, তিনি তাদের সন্তানস্নেহে স্পর্শ করতেন। পুত্রকে রেখে আসার দুঃখ মাধবীর কিছুটা লাঘব হয়েছিল। গালবও এইসব কারণে তাঁর চলার পথে বিলম্ব হবার কারণকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখছিলেন। কন্যাটি পরিস্থিতির শিকার, তার জন্য তাঁর মনে কষ্ট হয়, কিন্তু উপায় নেই। তার পিতাই তাকে দিয়েছেন, তিনি নিজে তো আর নেননি। রাজা যযাতির কথা নগরে গ্রামে লোকের মুখেমুখে ফেরে। মহাপরাক্রমশালী চন্দ্রবংশীয় রাজা নহুষের পুত্র, যে নহুষ একসময় দেবরাজের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। যযাতিও প্রতাপশালী রাজচক্রবর্তী, দানদক্ষিণা করেন, কখনো অর্থীকে ফেরান না। তাই সবাই ভাবত যযাতি খুব ধনসম্পদ্‌শালী রাজা, তাই গরুড় গালবকে নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। জানা গেল রাজভাণ্ডার শূন্যপ্রায়, নইলে অর্থ ভিক্ষা দিলেও হয়তো অশ্ব ক্রয় করা যেত। রাজা সেদিকেই গেলেন না, মেয়েকে দিয়ে দিলেন।

    অযোধ্যা থেকে দক্ষিণ-পূর্বমুখী পথ। মাসখানেক হেঁটে গঙ্গানদী দেখা দিল। গালব মাধবীকে বললেন, এবার আমরা এই ত্রিপথগামিনী পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনীর উত্তরতীর ধরে যেতে থাকব। আমাদের কষ্ট কম হবে, নদীর আর্দ্র সমীরণ আমাদের ক্লান্তি দূর করে দেবে। নদীর তীরের পল্বলযুক্ত ভূমিতে নিজে থেকেই নানা ফল ও শস্য ফলে, তা আমরা অনায়াসে খাদ্যের নিমিত্ত সংগ্রহ করতে পারব। মাধবী বিশাল নদীর দিকে দু-নয়ন ভরে তাকিয়ে রইলেন। কলকল করে এত জল নিয়ে নদী ছুটে চলেছে, তার নিজের আনন্দে। তার একটা লক্ষ্য আছে, সে সেই পথে চলে। সে যাচ্ছে সাগরের দিকে, তার প্রিয়তম সাগরের বক্ষে সে নিজেকে বিলীন করে দেয়, আর কোথাও তার যাবার দরকার নেই। মাধবীর মত তাকে রাজ্যে রাজ্যে অনিশ্চিত ঘুরে বেড়াতে হয় না।

    কত তীর্থযাত্রী নদীতে স্নান করছে, কত জলার্থী মৃৎকলস ভরে জল নিয়ে যাচ্ছে অনতিদূর গৃহে, ছোটবড় নৌকা নদীতে কোন লক্ষ্যে কে জানে যাতায়াত করছে, জালিকেরা নৌকো থেকে জাল ফেলে মৎস্য ধরছে। কখনোকখনো কোনো বণিক নৌকো বোঝাই করে পণ্য নিয়ে যায়। তারা কেউ আসে প্রয়াগ থেকে, কেউ বা আসে কান্যকুব্জ থেকে, কেউ বা মথুরা থেকে যমুনা বেয়ে গঙ্গায় পড়ে এগিয়ে যায় কাশী, মগধ, বঙ্গের দিকে, হয়তো বঙ্গ পেরিয়ে সমুদ্রে। কোনো কোনো পালতোলা বৃহৎ তরণীর বহর আবার বঙ্গের দিক থেকে না সমুদ্রপারের কোনো দেশ থেকে কে জানে, উজান বেয়ে আসে আরো বেশি দেশবিদেশের পণ্য বোঝাই করে। উজানমুখী নৌকোর সঙ্গে অবশ্য গালবদের এখন প্রয়োজন নেই। তাঁরা যাবেন অপেক্ষাকৃত নিম্নগামী স্রোতের দিকে, ভাঁটির দিকে কাশীতে। এইসব বাণিজ্যতরণীতে সাধারণত যাত্রী নেবার স্থান সংকুলান হয় না। সেগুলোর অগ্রবর্তী নৌকোতে থাকে নাবিক, শ্রমিক, নৌকোর ছাউনিতে নৌকোর প্রভু বসে থাকে, বাকীগুলো পণ্যবোঝাই, সঙ্গে নাবিক ও শ্রমিক। অনেকদিন চলবার পর কাশীগামী একখানা নৌকো পেলেন তাঁরা। গালব মাধবীকে বললেন, এবার তোমার বানরপুত্রকে বিদায় দাও, ভদ্রে। মাধবী কর্তব্য স্মরণ করে শিশুটিকে তাঁদের এতদিনের সঙ্গী বানরদলের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে বললেন, যাও, বৎস, নিজের সমাজে যাও। সেখানেই তোমার প্রকৃত স্থান। তাকিয়ে দেখলেন, সে অন্যান্য বানরশিশুর সঙ্গে খেলায় মেতেছে। সেই অবসরে তাঁরা নৌকায় উঠে পড়লেন।

    নাবিক গঙ্গার অনুকূল বিশাল ধারায়‍ নৌকার পাল তুলে অনেকখানি নিচের দিকে গেল ক’দিন ধরে। রাত্রি অবসান হলে একজায়গায় নৌকা ভিড়ায় প্রাতঃকৃত্য, স্নান, জ্বালানি সংগ্রহ ও রন্ধনের জন্য, তারপর আবার খুলে দেয়। তারপর একদিন কৌণিকভাবে নৌকা বাহন করে নদীবক্ষ উত্তীর্ণ করে নাবিক তাঁদের অপর পারে কাশীর ঘাটে পৌছে দিল। তাঁরা ধীরে ধীরে তীরে উঠলেন, স্নান করলেন, তারপর তীরবর্তী স্নানার্থীদের রাজপ্রাসাদের অবস্থিতি জিগ্যেস করলেন। আগন্তুকদের অজ্ঞতা দেখে নগরীর স্নানার্থী জনেরা হাসল। হে দ্বিজ, মহারাজ দিবোদাসের প্রাসাদের ঠিকানাও জিগ্যেস করতে হয়? এই বিস্তৃত রাজপথ দেখেই বোঝা যায়। রাজার প্রাসাদ দর্শনার্থীদের জন্য সর্বদা খোলা, রাজা আমাদের দানশীল, পরহিতব্রতী, ন্যায়পরায়ণ। সকলেই তাঁর সাক্ষাৎ পেতে পারে, তাই এই রাস্তায় এত পথিক যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন। এই পথ ধরেই এগিয়ে যান, পেয়ে যাবেন সামনেই।

    তাদের কথামত গালবেরা এগোলেন। একসময় নগরতোরণ পেরিয়ে রাজার প্রাসাদে পৌছলেন তাঁরা।

    সমুৎসুক গালব রাজার সঙ্গে বিরলে সাক্ষাৎ করবার প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা মঞ্জুর হলে নারী দর্শনপ্রার্থীদের নির্দিষ্ট স্থানে মাধবীকে অপেক্ষা করতে বলে তিনি রাজদর্শনে গেলেন। বর্তমান রাজা ভীমসেনপুত্র দিবোদাস গালবকে স্বাগত জানালেন। দিবোদাস শ্যামাঙ্গ, সুপুরুষ, মধ্যম উচ্চতার, আয়ত গভীর চোখদুটো যেন প্রেমিকের। তিনি পুত্রের কামনায় দেবতার আরাধনা করছিলেন, গালব গরুড়ের মুখে শুনেছিলেন। দিবোদাসও আগেই চরের মুখে খবর পেয়েছিলেন যে ঋষি গালব মাধবীকে নিয়ে আসতে পারেন। স্বাগত জানিয়ে রাজা গালবকে আগমনের উদ্দেশ্য জিগ্যেস করলেন। গালব বললেন, মহারাজ, আমার সঙ্গে একজন সর্বসুলক্ষণা কন্যা আছেন। তিনি আপনার চক্রবর্তী পুত্র লাভের অভিলষিত সিদ্ধ করবেন।

    রাজা বললেন, কোথায় সেই কন্যা?

    গালব বললেন, নারীদের জন্য নির্দিষ্ট বিশ্রামাগারে অপেক্ষা করে আছেন। তাঁকে নিয়ে আসছি।

    বিশ্রামাগারে মাধবী পরিচ্ছন্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন, গালবের আহ্‌বানে বেরিয়ে রাজার একান্ত দর্শনকক্ষে এলেন। দিবোদাস মাধবীর সুরনন্দিনীর ন্যায় দেহলাবণ্যে মোহিত হয়ে গেলেন। নিজে থেকেই উপস্থিত এই রূপবতী নারী তাঁর অঙ্কশায়িনী হতে পারেন ভেবেই মন উৎফুল্ল হয়ে উঠল, শরীরে শিহরণ হল। রাজা মাধবীতে মোহগ্রস্ত হয়েছেন বুঝে গালব আসল কথাটা বললেন, মহারাজ, এই কন্যার শুল্কস্বরূপ আপনাকে শুভ্র অথচ এককর্ণ কৃষ্ণ এমন ছয়শত অশ্ব প্রদান করতে হবে, তাহলে আপনি এঁর গর্ভে তিনজন চক্রবর্তীলক্ষণযুক্ত পুত্র উৎপাদন করতে পারবেন।

    দিবোদাস একটু দমে গেলেন। বললেন, হে দ্বিজবর, দুঃখিত, আমার কাছে তো শুধুমাত্রই দ্বিশত এই অশ্ব আছে। এই ক্ষেত্রে সেই শুল্ক দিয়ে আমি এই কন্যা থেকে একটি অপত্যই আশা করব। গালব রাজী হলেন। বৎসরান্তে এসে ঘোড়াগুলো বুঝে ও মাধবীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন শর্ত করে তিনি আপাতত আশ্রমে ফিরে গেলেন। মাধবী বুঝলেন, তাঁর যোনি ও জরায়ুকে আরো একাধিকবার অন্য কারো দ্বারা ব্যবহৃত হতে দিতে হবে।

    রাজা দিবোদাস মাধবীকে ভালবাসলেন। মাধবীও রাজাকে ভালবাসতে চেষ্টা করলেন, যদিও সেরকম ভালবাসা আর সম্ভব ছিল না। তিনি মাধবীর পরিচর্যার জন্য রূপচর্চানিপুণ দাসী নিয়োগ করলেন, তারা স্নানের সময় সুগন্ধি তৈলে তাঁর শরীর মার্জনা করে দিত, স্নানশেষে কেশে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে শুকিয়ে সুগন্ধ করে দিত। সুগন্ধি চন্দনের অনুলেপন শরীরে লাগিয়ে দিত, কেশে বেণী করে ফুলের মালা গেঁথে দিত, কেশপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুক্তার মালা লম্বিত করে দিত। রাজার দেওয়া মূল্যবান উজ্জ্বল মণিকুণ্ডল কানে পরাত, গলায় পরাত বিচিত্র মণিরত্নের হার, পায়ে নূপুর। বঙ্গদেশীয় সূক্ষ্ম দুকূল পরিয়ে তাঁকে রাজার বিশ্রামকক্ষে নিয়ে যেত। দিবোদাস মুগ্ধনয়নে সেই অপরূপ রূপের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়েই থাকতেন। ধীরে ধীরে হাত ধরে নিয়ে এসে শয্যায় বসাতেন, যেন এতটুকু জোরে টানলে মাধবী ব্যথা পেয়ে যাবেন।

    তিনি মাধবীর পূর্বতন একবর্ষস্থায়ী বিবাহ এবং সেই বিবাহসঞ্জাত সন্তানের কথা আগেই শুনেছিলেন। এই প্রথা সমাজে বহুলপ্রচলিত না হলেও প্রচলিত। তাই তাঁর মনে কোনো সংকোচ ছিল না। অন্যপূর্বা, এমন কি জীবৎপতিকা নারীতেও উপগত হওয়া খুব বিচিত্র ছিল না সেই সমাজে। দিবোদাস মাধবীকে নিয়ে সুরম্য স্থানে বিহার করতে যেতেন প্রায়ই, তাঁকে যথাসম্ভব সুখী করার চেষ্টা করতেন। সঙ্গীতনিপুণ রাজা সন্ধ্যায় চন্দ্রালোকে কুঞ্জবনে বসে বীণায় মধুর ঝঙ্কার তুলতেন, মাধবীও কখনো সেই তানে গান ধরতেন। যদিও মাধবীর মনে পড়ে যেত, এই সুখ, এই ভালোবাসা তাঁর মাত্র এক বছরের জন্য। যখনি একান্তে থাকতেন, মনে পড়ত ছেড়ে আসা শিশুটির কথা, তার পিতা হর্যশ্বের কথা।

    কাশীরাজ্যবাসের দশম মাস পূর্ণ হলে মাধবী এক পুত্র প্রসব করলেন, তাঁর দ্বিতীয় সন্তান। ছেলের নাম হল প্রতর্দন। রাজা অত্যন্ত খুশি, এবং এই পুত্রকেই ভবিষ্যতে যুবরাজ করবেন নিশ্চয় করলেন। আর একমাস, মাত্রই একমাস, এরপর এই শিশুটিকেও ছেড়ে যেতে হবে, তার প্রেমময় পিতাকেও। এই সুখের ঘরও স্বপ্নের মত বিলীন হবে, মাধবী পুত্রকে কোলে নিয়ে স্তন্যপান করাতে করাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন। নিজেকে দৃঢ় করার চেষ্টা করলেন।

    বৎসর অতীত হতেই গালব কাশীতে উপস্থিত হলেন। দিবোদাস বহুকষ্টে আবেগ দমন করে তাঁকে স্বাগত জানালেন, বললেন, আসুন, মহর্ষি, স্বাগত। আমার বক্ষ বিদীর্ণ হলেও আমি সত্যরক্ষা করব, প্রতিজ্ঞার সম্মান রাখব। তিনি মাধবীকে প্রস্তুত হতে অন্তঃপুরে আদেশ পাঠালেন। গালব বললেন, মহারাজ, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার গুরুদক্ষিণার জন্যই আপনাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।

    দিবোদাস গালবকে অশ্বশালায় নিয়ে গেলেন। গালব অশ্ব দুই শত গণনা করে নিলেন, তারপর সেগুলো সেখানেই সম্পূর্ণ শুল্ক সংগ্রহ না হওয়া অবধি গচ্ছিত রাখবার কথা রাজাকে বলে দিলেন। মাধবী সন্তানকে শেষ বারের মত চুম্বন করে ধাত্রীর হাতে দিয়ে আগের বারের মতই নিরাভরণ হলেন, সূক্ষ্ম উজ্জ্বল দুকূল পরিত্যাগ করে পথভ্রমণের উপযোগী সাধারণ কার্পাসবস্ত্র পরে বেরিয়ে এলেন। দিবোদাস দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁকে গালবের দিকে এগিয়ে দিলেন। মাধবী দৃষ্টি নত রাখলেন, চোখ জলে ভরে এলেও পেছন ফিরে তাকালেন না, বুক টন্‌টন করে উঠলেও দাঁড়ালেন না।

    রাজপ্রাসাদের তোরণ পেরিয়ে পথ শুরু । মাধবীকে সঙ্গে নিয়ে গালব রাস্তার দিকে পা বাড়ালেন।

    একটি একঘোড়ার ছোট রথ দাঁড়িয়েছিল প্রাসাদের নিকটে পথের উপর, গম্ভীরমুখ সারথি ঘোড়ার রাশ হাতে বসেছিল। পাশে আরো একটি ঘোড়া রজ্জুবদ্ধ। রথ দেখে রাস্তায় প্রজারা কৌতূহলবশে জড়ো হয়েছিল, কেউ বলছিল, রাজা কোথাও যাচ্ছেন কি?

    হতে পারে না, একজন বয়স্ক প্রজা বলছিল, রাজা গেলে একটা ছোট রথ আর একটা ঘোড়া বেরোবে না। অন্তত আরো দুতিনখানা বড় রথ, বেশ কটা ঘোড়া বেরোবে।

    একজন নারী বলল, আমি শুনেছি রানি মাধবী আর আমাদের রাজার সঙ্গে থাকবেন না। তিনি চলে যাবেন। বলে সে অন্য একজন নারীর প্রতি অর্থবহ ইঙ্গিত করল।

    রানি মাধবী চলে যাবেন? কেন? এই তো সেদিন রাজপুত্রের জন্ম হল। সে নাকি সমস্ত সুলক্ষণযুক্ত, আমাদের ভবিষ্যৎ রাজা। কত কাড়ানাকাড়া বাজল, কত দানদক্ষিণা হল তার জন্মের পরে। সেই শিশুটি মায়ের কোল পাবে না, মায়ের দুধ খাবে না, কী করে বড় হবে! একজন প্রৌঢ়া নারী বলল।

    আরেকজন লোক বলল, দিদি, ওসব রাজারাজড়াদের ব্যাপার। আমাদের বাড়ির শিশুর মা লাগে, ওদের ছেলে ধাইমার কোলে বড় হয়।

    তবে আমাদের রাজার সঙ্গে মাধবীকে দারুণ মানিয়েছিল। তাঁদের দুজনকে একসাথে দেখে মনে হত যেন সেই যে আমরা গল্প শুনি ইন্দ্র-ইন্দ্রাণীর, বা লক্ষ্মী-নারায়ণের বা চন্দ্র-রোহিণীর বা পুরূরবা-উর্বশীর জুটি, সেই রকমই—- প্রথম নারীটি বলল, আমি রানিকে ফুল ও ফুলের মালা দিতে যেতাম প্রায়ই। কেন যে ছাড়াছাড়ি হচ্ছে!

    আরে, এঁকে তো রাজা দু’শ সাদা ঘোড়া দিয়ে কিনেছিলেন, জান না? একটা ছেলে হলেই ছেড়ে দিতে হবে এই কড়ারে। বছর ঘুরে গেছে, মেয়াদ শেষ। বয়স্ক লোকটি বলল।

    কী আশ্চর্য!

    আশ্চর্যের কী আছে, রাজাদের ব্যাপারস্যাপার আমাদের মত হয় না।

    তা বলে রাজার পত্নীকে স্বৈরিণীর মত আচরণ করতে হবে?

    ওরে, রাজারা তো স্বর্গবেশ্যাদেরও বিয়ে করেন, তখনও এরকমই হয়। এই যে তুমি বললে পুরূরবা উর্বশীর কথা, সেই উর্বশীও স্বৈরিণী ছিলেন, জান না? পুত্রের জন্মের পর ইন্দ্রের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন, বয়স্ক লোকটি বলল।

    আমার স্ত্রীকে ওরকম ছেড়ে দিতে পারব না, মা না হলে ছেলেমেয়েদের কে সামলাবে? আমারও দিনশেষে কাজ করে ঘরে ফিরে বউকে সঙ্গে সঙ্গে না দেখলে বড্ড খালি খালি লাগে। আমি ওকে ছাড়া বাঁচবার কথাও ভাবতে পারি না, অন্য একজন যুবক বলল।

    তোর বউকে কেউ নেবে না, হাসতে হাসতে আরেকজন বলল।

    প্রজাদের মুখে এসব অপবাদমূলক কথা শুনতে শুনতেই মাধবী রথে উঠলেন। মাধবীকে সাহায্য করতে করতে গালব বললেন, মহারাজ দিবোদাস তো তোমার বেশ খেয়াল রেখেছেন মনে হচ্ছে। রথ দিলেন তাঁর রাজ্যের সীমান্ত অবধি।

    মাধবীর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও বললেন, হ্যাঁ, তিনি ভালবাসতেন।

    গালব মাধবীর মুখের দিকে একপলক তাকালেন। দিবোদাসের ভালবাসার ঘর ছেড়ে আসতে কন্যাটির বেশ কষ্ট হচ্ছে। একটু চিন্‌চিনে ইর্ষাও যে হল না, তা নয়। কিন্তু ওই মুখের দিকে তাকানো যায় না, মুহূর্তে ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

    গালব নিজেকে সংবরণ করলেন।

    বললেন, ভদ্রে, আমরা এবারে ভোজরাজ্যে যাব। সেখানে উশীনর নামে রাজা আছেন, সংবাদ পেয়েছি তিনি আমার মনোবাসনা পূর্ণ করতে পারেন। ইনি সদ্‌বংশীয়, অত্যন্ত দানশীল, দয়ালু ও প্রজাপালক। অর্ধেক গুরুদক্ষিণা সঞ্চয় করতে পেরেছি, বাকি অর্ধেক আশা করি হয়ে যাবে।

    মাধবী মৃদুস্বরে বললেন, যথা আজ্ঞা, মহর্ষি। গালব ঘোড়ায় চড়ে এগোলেন।

    সম্মুখে দীর্ঘ পথ। পেছনে তাকিয়ে লাভ নেই, তবুও বিগত কথা মনে আসে। মনে পড়ে যায় দুটো সন্তান, দুটো শিশু। বসুমনা এতদিনে হয়তো এক-পা দু-পা হাঁটতে শিখেছে, হয়তো ভোরের পাখির দুএকটা অস্ফূট বুলির মত কথা ফুটেছে মুখে। হয়তো কয়েকটা ঝিকমিকে দাঁত ও উঠে গেছে তার। তিনি শিশুটির কচিমুখে চারটে বেলকুঁড়ির মত দাঁতের উদ্ভাসের কথা মনশ্চক্ষে দেখতে দেখতে হাসলেন। শিশুটি দুষ্টু হবে না? খাওয়াতে আসবে ধাত্রী, তার আঙুলে কুটুস করে কামড়ে দেবে না? আর এই একমাসের শিশু প্রতর্দন? সে ঘুমের মধ্যে কী সুন্দর হাসত। স্তন্য পান করতে করতে মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকত, যেন মায়ের মুখখানি সে মনে ধরে রাখছে। কিন্তু তারা কী আর মনে রাখতে পারে? শিশু তারা, অবোধ শিশু, তারা জানলই না তাদের গর্ভধারিণীকে। জানা নেই তারা ভবিষ্যতে কেমন হবে, কখনো দেখতে পাওয়া যাবে কী না। মাধবীর বুকের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা করে উঠল। না, আর ভাববেন না তিনি, চোখে জল আসতে দেবেন না। মাতা তো সন্তানের ভস্ত্রা, এই ধারণাই চলে আসছে। ভস্ত্রা মাতা পিতুঃ পুত্রো যেন জাতঃ স এব সঃ। পুত্রের অধিকারী পিতা, যতই মাতা তাকে জন্ম দিক না কেন। ভস্ত্রাই যদি, তবে পুরুষ কেন নারীতে বীর্যক্ষেপ করে? কোনো চর্মপেটিকাতে ফেললেই তো হয়। নারীকে কেন তাহলে ন’মাস গর্ভ ধারণ করতে হয় নিজের রক্তমাংস দিয়ে? কেন নারীর গর্ভে, ওদের কথায় ‘ভস্ত্রা’তে পুরুষ রাজা, রাজচক্রবর্তী জন্মায়?

    এবারে আর একবার সেই পালা। ভালবাসার অভিনয় করে জন্ম দিতে হবে আরেকটি শিশুর, যে শিশু তার মাকে জানবেও না। সেই সন্তানের জনক কেমন হবে কে জানে। গালব বলছে রাজা সচ্চরিত্র, দানশীল, দয়ালু ইত্যাদি ইত্যাদি। তার বিপরীত হলে একবছর দুঃসহ হয়ে যাবে।

    ভোজরাজ্যগামী এই পথ দীর্ঘতর। প্রায় মাসচারেক লাগল রাস্তা পাড়ি দিতে। আপন রাজ্যের সীমা পর্যন্ত রাজা দিবোদাসের দেওয়া রথখানিতে মাধবীর ও ঘোড়ায় গালবের যাবার সুবিধা হয়েছিল। দিবোদাস মনে বোধ হয় কষ্ট পাচ্ছিলেন, মাধবীর কোমল পা-দুখানি কী করে এত দীর্ঘ পথ পদব্রজে অতিক্রম করবে। ভোজরাজ্য কাশীর পশ্চিম-দক্ষিণে, এইদিকের প্রকৃতি কিছু রুক্ষ কঠোর, ভূমি কঙ্করপ্রস্তরময়। তবে তাঁর রথ বা ঘোড়া তো পররাজ্যের ভেতরে যাবে না। দ্বিতীয়ত, মাধবী যখন তাঁর আশ্রয় থেকে চলে গেছেন, তাঁর সুখদুঃখের ভার আর দিবোদাসের উপর নেই।

    পাঁচ

    কাশীরাজ্যের সীমানার আগে থেকেই উচ্চাবচ ভূমি, দুদিকে অনুচ্চ বৃক্ষ, কণ্টকাকীর্ণ গুল্মের জঙ্গল শুরু হয়ে গিয়েছে। দূরে অনতিউচ্চ নীল পাহাড় দেখা যাচ্ছে, দু একটা শীর্ণ নদীও। ভূমি প্রস্তরাকীর্ণ। এর মধ্য দিয়েই সরু পথ গিয়েছে। এ পথে রথ চলে না। বণিক সার্থবাহ গাধা, ঘোড়া ও উটের পিঠে করে মালপত্র নিয়ে যাতায়াত করে।

    রাজ্যের সীমানা কাছাকাছি আসতে গালব ঘোড়া থেকে নামলেন। মাধবীর সারথি রথ থামাল, তিনিও নামলেন। সারথি দুজনকে প্রণাম করে রথ ও ঘোড়া নিয়ে ফিরে গেল। সূর্য মধ্যগগনে, বায়ু বেশ গরম। রথ থেকে নেমে মাধবী খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালেন। মনে হল, শূন্য আকাশের মতই শূন্য তাঁর বুক। আকাশে তবু চাঁদ সূর্য খেলে, তাঁর হৃদয় এই দুপুরেও সম্পূর্ণ অন্ধকার।

    গালব বললেন, ভদ্রে, এবারে পশ্চিমমুখে চলতে হবে। এদিকে ভোজরাজ্যের শুরু। আমাদের একখানি গ্রাম বা গোষ্ঠ পেতে হবে, যেখানে রাত্রিতে আশ্রয় নিতে পারি। মনে হচ্ছে এদিকে রাস্তার ধারে গ্রাম বা নগর বিরল; যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে এই অঞ্চলের বনে অনার্য শবরদের বসতি। তারা হয়তো পথিক চাইলে রাতের জন্য আশ্রয় দেয়, তবে তারা অখাদ্য খায়, তাই অপরিষ্কার এবং অপবিত্র। নিতান্ত আপৎকালীন অবস্থা ছাড়া তাদের আশ্রয় নেওয়া অবিধেয়। গোষ্ঠে আশ্রয় নিলে গোপেরা দুগ্ধ, দধি, তক্র বা ননী দিয়ে অতিথিসৎকার করে, কিন্তু এদিকে গোপদের দেখছি না।

    মাধবী বললেন, এই রুক্ষ মাটিতে গোচারণযোগ্য তৃণ নেই। জলাভূমি ও দেখা যাচ্ছে না। তাই হয়তো এখানে গোপেরা থাকে না।

    গালব বললেন, হতে পারে।

    তাঁরা চলতে থাকলেন। বেলা পড়ে আসছে। আর্যদের আশ্রয়যোগ্য কোনো গ্রাম বা গোষ্ঠের দেখা মিলল না।

    মাধবী বললেন, মহর্ষি, তবে শবরদের কুটিরেই চলুন। এখন তো আপৎকালীন অবস্থাই। মনে মনে ভাবলেন, পরিচ্ছন্ন আর্যদের সঙ্গে তো এত বছর থাকলাম, এখন না হয় দু-এক দিন অনার্যদের সঙ্গে থাকি।

    হাঁটতে হাঁটতে শবরদের গ্রামে পৌছতে সূর্যাস্ত হয় হয়।

    শবরেরা আর্যদের থেকে দূরেই থাকে। আর্যরা সাধারণত তাদের ঘৃণা করে, তাদের কাছ ঘেঁষে না। তাদের জমি দখল করেই আর্যেরা জনপদ বানায়, সেখানে নিজেরা থাকে, কিন্তু একবার আর্যদের জনপদ তৈরি হয়ে গেলে অনার্যদের তার কাছে থাকতে দেওয়া হয় না, তাদের দস্যু আখ্যায়িত করা হয়, আর পরাজিত ও ধৃত শবরেরা আর্যদের দাসে পর্যবসিত হয়। শবররাও ভয়ে এবং সন্দেহে আর্যদের জনপদ থেকে দূরে গিয়ে নিজেদের বাসস্থান বানায়, তাদের গ্রামে ঢুকতে দেখলে সন্দিগ্ধ হয়ে যায়। গালব ও মাধবীকে গ্রামের দিকে আসতে দেখে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে কয়েকজন অভিজ্ঞ যুবক ও একজন বৃদ্ধকে আগন্তুকদের সমীপে পাঠাল। হাতে দীর্ঘ বংশদণ্ড নিয়ে তারা এগিয়ে এসে জিগ্যেস করল,

    কি চাই তুদের? কেন এখানকে এসেছিস?

    লাঠিহাতে কৃষ্ণবর্ণ সবল পেশীবহুল শবরদের দেখে গালব ঘাবড়ে গেলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন,

    আমরা পথিক। আমাদের রাতের আশ্রয় চাই। তোমরা কি আমাদের আশ্রয় দেবে? রাত পোহালেই আমরা চলে যাব।

    তুমরা কুথা যাবে?

    আমরা রাজা উশীনরের রাজধানীতে যাব।

    তুমাদের পিছে আর কেউ আছে?

    আমাদের সঙ্গে আর কেউ নেই। আমরা একা, পথ চিনিনা।

    শবররা দেখল দুজন নিরস্ত্র মানুষ, একজন পুরুষ, একজন নারী, পথশ্রমে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। একজন একটি উঁচু গাছে চড়ে অনেক দূর অবধি দৃষ্টি দিয়ে দেখল, এদের কোনো সঙ্গী দেখা যাচ্ছে কি না। নিশ্চিন্ত হয়ে বুঝল এরা নিরাপদ, রাতটুকুর জন্য আশ্রয় দেওয়া যেতেই পারে।

    তারা তাঁদেরকে গ্রামের ভেতর নিয়ে গেল। মাধবী দেখলেন, শবর পুরুষ ও মহিলারা মাথায় জ্বালানি কাঠ ও পিঠের ঝুড়িতে কন্দ, শাক ও বন্য ফল নিয়ে বনের দিক থেকে ঘরে ফিরছে। পুরুষদের কারো কারো মাথায় মৃত পশু, কাঁধে ধনুক, পিঠে তুণ, হাতে বল্লম। কোনো কোনো নারীর পিঠে ঝুড়ি এবং কোলে স্তন্যপানরত শিশু। একটু বড় শিশুরা মাকে আসতে দেখে মায়ের চারপাশ ঘিরে খুশিতে কলরব করছে, যেমন মা-পাখি খাদ্য নিয়ে কুলায়ে ফিরলে পক্ষীশাবকেরা করে, অথবা গোষ্ঠের গো-শাবক তার গাভীমাতা গোধুলিতে ফিরলে কচি গলায় হম্বারব করে মাকে আহবান জানায়। অজানা অতিথি দেখে লোকগুলো কৌতূহলে থমকে দাঁড়াল। শিশুরা কলরব বন্ধ করে মায়ের আঁচল ধরে হাঁ করে দেখতে থাকল। অভিজ্ঞ বৃদ্ধের ইঙ্গিত পেয়ে দুতিন জন পুরুষ এগিয়ে এসে গালবকে নিয়ে গেল একটি মৃত্তিকানির্মিত, দীর্ঘ তৃণে আচ্ছাদিত ও বহুবর্ণে যত্নসহকারে চিত্রিত কুটিরের দিকে, আর ক’জন মহিলা এগিয়ে এসে মাধবীকে সেরকমই অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেল। মাধবী দেখলেন, এই বনবাসী মানুষেরা, যাদের সম্পর্কে তিনি এতদিন বিশেষ কিছুই জানতেন না, শুধু জানতেন তাদের কৃষ্ণ ত্বক, তারা পশু হত্যা করে মাংস বিক্রয় করে -- যদিও সেই মাংসের ক্রেতা ক্ষত্রিয়রাই-- নিজেরা পোড়া মাংস খায়, তাই তারা ঘৃণিত জাতি। এখন তাদের সম্মুখীন হয়ে দেখলেন সেই তারা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের মৃত্তিকানির্মিত সাধারণ গৃহপ্রাচীর অতি সুন্দর চিত্রাঙ্কন করে সাজিয়েছে। তারা মাধবীকে প্রথমে হাত-পা ধোবার জন্য জল দিল, তারপর ঘরের দাওয়ায় ঘাসের তৈরি আসনে তাঁকে বসতে দিল, সেই তৃণাসন ও কী কারুময়! তারা মৃৎকলস থেকে শীতল পানীয় জল ঢালল একটি নূতন বংশখণ্ডের পাত্রে, তারপর তাঁকে সেই জল, পত্রপুটে মধু ও বুনো ফল খেতে দিল। তাদের আবাসের অনতিদূরে বন, খুব ঘন নয়, সেই বনে হরিণেরা এই অপরাহ্নেও চরছে দেখা যাচ্ছিল। এরা বনবাসীজনকে ভয় পায় না, তাই কাছেই থাকে। বৃক্ষে বৃক্ষে পাখিরা কলরব করে ওড়াওড়ি করছে, এখনও তারা গাছের আশ্রয়ে বসে নি, শেষবারের মত অস্তসূর্যের কিরণ গায়ে মেখে নিচ্ছে।

    শবরনারীরা আকার ইঙ্গিতে, দুচারটে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথায় মাধবীর সঙ্গে কথা বলে, কথা দিয়ে বোঝাতে অপারগ হলে অনাবিল হাসিতে নীরবতাটুকু পুষিয়ে দেয়। তারা বোঝাল, তাদের অন্ধকার কুঁড়ে, শুধু মাঝখানে একটা অগ্নিকুণ্ড আছে, তাতে তারা কন্দ এবং শস্য সেদ্ধ করে, সেই আগুনের আভায়ই তারা অন্ধকারে দেখে, আর আগুনের চারপাশে রাতের বেলা শোয়। সারাদিন তাদের বাইরেই কাটে। তারা বনের সন্তান, বনের ফলমূল আহরণ করে, ঝর্ণা থেকে জল আনে, পুরুষেরা মৃগয়া করে, ভোজ্য উদ্ভিদ রোপণ করে, আবাসগৃহ জীর্ণ হলে রক্ষণাবেক্ষণ করে। দিনের শেষে মৃগয়ার মাংস সবাই মিলে পুড়িয়ে খায়, আর তখন খুশি হয়ে সবাই মিলে নৃত্যগীত করে। তাদের শিশুরাও ছোট থেকেই বনের সঙ্গে পরিচিত, সারাদিন বাইরে খেলে সন্ধ্যাবেলা পাখিদের মত মাতাপিতার কুটিরে ফিরে আসে। এখন শিশুরা খেলাধুলো শেষ করে মায়ের কোলে পিঠে লেপ্টে আছে। মাধবীর তাদের জীবনযাপন বড় আকর্ষণীয় লাগল। আহা, কী সরল এদের জীবন! কী অনাবিল হাসি, শিশুদের কলরব কী মধুর!

    সেই কুটিরের কর্ত্রী পলিতকেশা বৃদ্ধা শবরী মাধবীকে তাঁর সন্তান আছে কিনা জিগ্যেস করল। তিনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক উত্তর দিলেন। সন্তানের কথা মনে পড়তেই তাঁর মুখ মলিন হয়ে এল।

    বৃদ্ধা জিগ্যেস করল, বহুত দিন দেখিস নি বুঝি বাচ্চাদের?

    তিনি মাথা নাড়লেন, চোখ জলে ভরে এল। বৃদ্ধা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাঁদিস নে, বেটি। তুর বাচ্চা আসবে লিচ্চয় তুর কাছে। সে হাত দিয়ে উপরে দেখাল।

    এত সহানুভূতি তাঁকে আজ পর্যন্ত কেউ দেখায়নি। ইচ্ছা করল বৃদ্ধাকে মাতৃসম্ভাষণ করেন।

    এই সরল সহানুভূতি ও আনন্দের জগতে শবররমণীর দেওয়া বন্য কষায় ফল ও লবণহীন কন্দ মাধবীর অমৃত মনে হল। তিনি নিশ্চিন্তমনে তাদের কুটিরে তাদের কাছাকাছি ভূমিশয্যায় শুয়ে পড়লেন।

    পরিব্রাজকদের একরাত্রির বেশি কোথাও থাকা নিষেধ, পরদিন তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন। শবরমহিলাদের অনুরোধ ছিল সন্ধ্যায় তাদের নৃত্যগীত দেখবার জন্য থেকে যেতে, গতরাতে তারা তাঁদের বিশেষ আপ্যায়ন করতে পারেনি। কিন্তু তিনি ভগিনীস্নেহে তাদের হাত ধরে বললেন, ‘ তোমাদের মঙ্গল হোক। ঈশ্বর ইচ্ছে করলে আবার আসব।’ স্নেহের স্পর্শে তারা অভিভূত হয়ে গেল। যদিও পরিব্রাজক হিসেবে তাঁদের কিছুই নেবার নিয়ম নেই, তবুও তাদের দেওয়া পাথেয় কয়েকটা ফল ও কন্দ মাধবী অস্বীকার করতে পারলেন না।

    শবরমুখ্যদের কাছে গালব পথের ঠিকানা নিলেন। পরের তিনদিনের পথে প্রায় জনশূন্য বন পড়বে, তারপর আরো দু একটা শবরগ্রাম পড়বে। মুখ্যদের নির্দেশে একজন তরুণ সঙ্গে এল, সে বন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। বন্য আশ্রয়হীন পথে সে সঙ্গে থাকবে যাতে ওঁরা বন্যপশু থেকে আক্রান্ত না হন। সে বন্য ফল ও জলের সন্ধানও দেবে। রাতের জন্য কোথায় নিরাপদ হবে তাও সে দেখিয়ে দেবে। তিনদিনের পর আবারও রাতে তাঁরা শবরপল্লীতে থাকলেন, মাধবী তাদের জীবনযাত্রা দেখলেন, তাদের সন্তানদের মাতৃসুলভ স্নেহে কোলে তুললেন, তাদের পোষা হরিণের মুখের কাছে তৃণ ধরলেন।

    গালব বললেন, আর দুদিন পর গোষ্ঠ পাওয়া যাবে, যেখানে তাঁরা নিরাপদে থাকতে পারবেন, কিছু হলেও অভ্যস্ত খাদ্য পাবেন। গোপরা বর্ণে বৈশ্য, আর্যদের বর্ণাশ্রমের অধীন, আর্যদের দেবতার আরাধনা করে, রাজা ও ব্রাহ্মণের নির্দেশ মেনে জীবনযাপন করে, তাই তারা ঘৃণিত নয়। মাধবী ভাবলেন, শবরেরা কিসে কম, তাদের সঙ্গে বাস করে তিনি তো অনিরাপদ বোধ করেন নি। বরং তাদের আচরণে ছিল সহৃদয়তা। সকল মানবের একই ধরণের শারীরিক সৌষ্ঠব হতে পারে না। এমন কী দেবতারা ও সকলে একই ধরণের নন। সকলের একই সামাজিক আচরণ কি খুব প্রয়োজনীয়? তাদের তো নিজস্ব দেবতা আছে, সেই দেবতার অর্চনা কেন যথেষ্ট নয়?

    যত দিন যাচ্ছিল, বনবাসীজনদের গ্রামে থাকতে তিনি অভ্যস্ত হচ্ছিলেন। দেখছিলেন তারা কীভাবে বৃক্ষলতা পশুপাখীকেও কেমন সহজ আত্মীয়ের মত করে গ্রহণ করে।

    কখনো গ্রামের পথ, কখনো বন, তাঁরা চলতে থাকলেন। যেখানে নগর আছে, তার কাছাকাছি রাস্তার ধারে স্থানে স্থানে রাজনির্মিত অতিথি বিশ্রামাগার, পানীয়জলের কূপ, আছে, রাজার নিযুক্ত উদ্যানপালকদের দ্বারা কৃতযত্ন ফলবান বৃক্ষও পথিপার্শ্বে আছে। নগর থেকে কিছুটা দূর অবধি মধ্যে মধ্যে গ্রাম আছে। সেরকম হলে গালব মাধবীকে কোনো দেবস্থান কিংবা কোনো গৃহস্থের বাড়িতে বিশ্রামে রেখে শস্যমুষ্টি ভিক্ষা করেন, কুম্ভকারের কুলালে গিয়ে মাটির হাঁড়ি নিয়ে আসেন, মাধবী তাতে দুমুঠো শস্য ফুটিয়ে নিয়ে দুজনে খান, এবং মাঝে মাঝে বনে কন্দ কিংবা ফল পেলে তাই খেয়ে জীবন ধারণ করেন। কখনো কোনো গোযান বা গর্দভযান অনতিদূরের গ্রাম অবধি যায়, চালক তাঁদের যানে উঠতে আহবান করে, তাঁদের পথক্লেশ কথঞ্চিত লাঘব হয়। গালব পথচলায় অভ্যস্ত, বিশেষ ক্লিষ্ট নন। মাধবী অনভ্যস্ত ভ্রমণকৃচ্ছ্রতায় শীর্ণকায়া হয়ে পড়েছেন, দেখতে প্রায় একটি কুমারী মেয়ের মতই লাগে। দীর্ঘ পথের শেষে দুজন ভোজনগরী এসে পৌছলেন।

    ভোজরাজ উশীনর মধ্যবয়স্ক। গালব রাজার একান্ত দর্শনের জন্য প্রার্থনা জানালে তা স্বীকার হল। মাধবীকে যথারীতি নারীবিশ্রামাগারে পরিচ্ছন্ন ও বিশ্রান্ত হতে বলে তিনি রাজার কাছে গেলেন।

    উশীনর গালবকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, বলুন মহর্ষি, আপনার আগমনের উদ্দেশ্য কী।

    গালব বললেন, মহারাজ, শুনেছি যে আপনার উত্তরাধিকারী পুত্র নেই। আর আপনি জ্ঞানী, তাই জানেন, পুত্র না থাকলে পুরুষের মুক্তি হয় না, সে তার পূর্বপুরুষ-সহ নিরয়গামী হয়। আমি আমার সঙ্গে এক কন্যা এনেছি, যিনি আপনাকে দুটি সুলক্ষণ পুত্র দিতে সক্ষম। আপনি এঁকে পরিগ্রহ করলে আপনার পুত্রের অভিলাষ পূর্ণ হবে।

    রাজা কন্যাকে দেখতে চাইলেন, মাধবীকে আনবার জন্য প্রহরিণী প্রেরণ করলেন। মাধবী এলে রাজা গালবের কথার সত্যতার বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন এবং বুঝলেন, এরকম সুন্দরী সুলক্ষণা কোনো নারী তিনি তাঁর এই প্রায়-প্রৌঢ় বয়স অবধি দেখেননি। শরীরে শিহরণ খেলে গেল, তিনি কামার্ত অনুভব করলেন। কিন্তু কামনার আবেগে সাড়া দেবার আগে তাঁর বাস্তববুদ্ধি জেগে উঠল। কত কন্যাশুল্ক চাইবে কে জানে? তিনি জানেন, কামপরতন্ত্র হয়ে অনেক রাজা নিজের রাজলক্ষ্মীকে বিসর্জন দেন। মুখে বললেন, মহর্ষি, এই কন্যার নিমিত্ত নিশ্চয়ই শুল্ক দিতে হবে। একটা কথা, আমার যত ধন আছে সবই পৌর ও জানপদগণের জন্য। আমি এদের রক্ষণের নিমিত্ত রাজা হয়েছি। কাজেই, আপনি শুল্ক বলে দিলে আমার সুবিধা হয়।

    গালব বললেন, মহারাজ, চারিশত শ্যামৈককর্ণ চন্দ্রশুভ্র অশ্ব। তাহলে আপনি চন্দ্র ও সূর্যের মত দুটি পুত্র পেতে পারেন। বস্তুত, আমার অশ্বে কোনো প্রয়োজন নেই। অন্য কোনো ধনেও আবশ্যকতা নেই। আমি গুরুদক্ষিণা দেবার জন্যই এই বিশেষ অশ্ব প্রার্থনা করছি।

    উশীনর বললেন, আমার অন্যান্য অনেক অশ্ব আছে, কিন্তু আপনি যে রকম বললেন, সেরকম অশ্ব মাত্র দুইশত আছে। তাহলে অন্য দুই রাজার মত এই কন্যার গর্ভে তাহলে আমিও এক পুত্রই উৎপাদন করব।

    গালব রাজি হলেন, বললেন, মহারাজের শুভ হোক, মনোবাসনা পূর্ণ হোক। একবর্ষ পরে আমি এসে শুল্ক ও কন্যাকে নিয়ে যাব।

    মাধবী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর উপর হওয়া দরকষাকষি শুনলেন। গালব এখন রাজাদের সঙ্গে কথা বলতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে, বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের কথাটা বলতে পারে; যদিও গুরুদক্ষিণার ব্যাপারটা শেষ হল না, আরো একবার তাঁকে কারো শয্যাসঙ্গিনী হতে হবে।

    কথাবার্তা শেষ করে গালব চলে গেলেন, মাধবীকে রাজা অন্তঃপুরে পাঠালেন। তাঁর জন্য অন্য রানিদের থেকে দূরে বাগানঘেরা পৃথক কক্ষ নির্দিষ্ট হল, দুজন পরিচারিকাও নিযুক্ত হল। প্রৌঢ় উশীনর রাজকার্যের শেষে মাধবীর সঙ্গে পরিচয় করতে এলেন। সুবিধা অসুবিধার কথা জিগ্যেস করলেন। মিতব্যয়ী রাজা নিজের আমোদ আহ্লাদের জন্য বেশি ব্যয় করেন না। মাধবীকে বললেন, দেবী, আমার বয়স হয়েছে। জীবনে অনেক সুখদুঃখ দেখেছি। আমোদপ্রমোদ দুদিনের। তার চাইতে ভাল পুণ্য উপার্জন করা। আমি চাইব আমার পুত্র ও যেন এই পন্থায় চলে, সে যেন নিজে ভোগ করে রাজকোষের অর্থ শেষ করে না ফেলে। সে যেন সত্যব্রত হয়, প্রজাদের সুখী করে, যেমন আমি যথাসাধ্য করছি।

    মাধবীর খারাপ লাগল না উশীনরের কথা। উশীনর বাস্তববাদী। জীবনে তাঁর নিজেরও অনেককিছু দেখা হল। আগের দুই রাজা তাঁকে নিয়ে এদিক ওদিক বিহার করেছেন। তারপর গালবের সঙ্গে এদেশ থেকে ওদেশ অনবরত ভ্রমণ করতে হচ্ছে। তাঁরও এখন আর ঘোরাঘুরি ভাল লাগছে না। তবুও রাজা উশীনর মাধবীর মনোরঞ্জনের জন্য তাঁকে ঘরে বন্ধ না রেখে নিজ রাজ্যের অনেক রমণীয় স্থানে বিহার করলেন। ভাল সন্তান জন্মের জন্য ভাবী জননীকে আনন্দে রাখা প্রয়োজন, অভিজ্ঞ রাজা জানেন। মাধবী জানেন, একবছরের দাম্পত্য। বছরের শেষে তাঁকে অন্তত আরেকবার রাজশ্রী ত্যাগ করে পথে নামতে হবে, আরো কোনো রাজার বীর্য ধারণ করতে। কাজেই রাজা উশীনর যে বেশি আবেগ দেখান না, এতে তিনি দুঃখিত নন, বরং খানিকটা নিস্পৃহ।

    বৎসর শেষ হবার একমাস আগে মাধবী পুত্র প্রসব করলেন। পুত্রের নাম হল শিবি। উত্তরাধিকারীর মুখদর্শনে রাজা উশীনর অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। পুত্রের জাতকর্ম আদি রাজোচিত নিয়মে করলেন। মাধবী পুত্রকে স্তন্যপান করান, তবুও চান অনেকটা নির্বিকার থাকতে। কিন্তু শিশু যে তার ক্ষুদ্র দুটো হাত দিয়ে মাকে ধরে রেখে মায়ায় জড়াতে চায়, তার নিষ্পাপ দৃষ্টি দিয়ে মাকে চিনতে চায়, তার কান্নাহাসি দিয়ে ভোলাতে চায়! তাকে যথাসম্ভব ধাত্রীর কাছে দিয়ে দূরে রাখতে চান -- এই পুত্রের থেকেও বিদায় নেবার দিন ঘনিয়ে আসছে।

    বৎসর পূর্ণ হতেই যথারীতি গালব ফিরে এলেন। উশীনরের দেওয়া দুইশত ঘোড়া নিয়ে তাঁর কাছেই গচ্ছিত রাখলেন কিছুদিনের জন্য। মাধবী আগেই রানির বেশ ছেড়ে সাধারণ বেশ পরে প্রস্তুত ছিলেন, আহবান পেয়ে পুত্রকে ধাত্রীর কাছে রেখে চলে এলেন এবং যন্ত্রচালিত পুত্তলিকার মত গালবকে অনুসরণ করলেন। গালবকে আবার ও বিষণ্ণ, চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে। এবার কোথায় যাবেন, এখনো কিছু বলছেন না।

    এবার কোথায় গন্তব্য, মহর্ষি?

    ব্রহ্মচারী এখন মুশকিলে পড়েছেন। বললেন, ভদ্রে, যে জায়গাগুলোতে ঘোটক প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল, তার সব জায়গাতেই আমাদের যাওয়া হয়ে গেছে। তবু গুরুদক্ষিণা পূর্ণ হয়নি, তিনচতুর্থাংশ পাওয়া গেছে।

    মাধবী বললেন, তাহলে কী কর্তব্য?

    এবারে কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। তোমাকে নিয়ে কোথায় অনিশ্চিত ঘুরব? তীরে এসে তরী ডুবে না যায়।

    আপনার বন্ধু গরুড়ের কাছে চলুন, তিনি যদি কিছু নিশ্চিত করে বলেন।

    গালব বুঝলেন, মাধবী ঠিক বলেছেন। তিনি মাধবীকে সঙ্গে নিয়ে আবার গেলেন বন্ধু গরুড়ের কাছে। তাঁদের আসতে দেখে গরুড় খুশি হয়ে বললেন, সখা, আশা করি তুমি এখন পূর্ণমনোরথ হয়েছ।

    গালব বললেন, তা আর হল কই, সখা। গুরুর অভিশাপ নির্ঘাত আমার কপালে আছে। এখনো একচতুর্থাংশ দক্ষিণা উপার্জন হয়নি। আর কোন রাজার কাছে ওইরকম ঘোটক আছে বলে জানি না। আর সময়ও শেষ হয়ে আসছে।

    গরুড় বললেন, না, সংবাদ নিয়েছি, আর পাওয়া যাবে না। আসলে কী জান, এই অশ্বের ইতিহাস আছে। এগুলো একসময় বিশ্বামিত্রের পিতা রাজা গাধির ছিল। গাধিরাজ নিজের কন্যা সত্যবতীর বিবাহের শুল্কস্বরূপ একসহস্র এই অশ্ব রাজর্ষি ঋচীকের কাছ থেকে লাভ করেন। ঋচীকের পিতা হলেন পশ্চিমদেশের অধিপতি বরুণ। বরুণের পশ্চিমসাম্রাজ্যে অশ্বতীর্থ নামক বাণিজ্যকেন্দ্র আছে, সেখানেই ঋচীক অশ্বগুলো ক্রয় করেছিলেন। তিনি পশ্চিমদিকের উষ্ণ মরুভূমি, উচ্চ সুদুর্গম পর্বতমালার মধ্যকার গিরিপথ দিয়ে বহুদিনে বহু কষ্টে ঘোড়াগুলোকে নিয়ে এসে গাধিরাজকে দেন, তিনি তখন বিতস্তা নদীর তীরে কাশ্মীরে অবস্থান করছিলেন। তো ঘোড়াগুলোকে নিয়ে গাধিরাজ রাজধানী কান্যকুব্জ যাবার সময় বিতস্তা নদীতে হঠাৎ বান ডাকে। প্রচণ্ড খরস্রোতের টানে সেই দুর্লভ পশুগুলোর চা্রশত ভেসে যায়, লোকে বলে বরুণের ঘোড়া বরুণ নিয়ে নিয়েছেন। বাকি ছয়শত ঘোড়া নিয়ে গাধিরাজ নিজ রাজধানীতে ফেরেন। এরপর তিনি পুণ্ডরীক যজ্ঞ করেন, সেই উপলক্ষে ঘোড়াগুলো দান করে দেন ব্রাহ্মণদের। পরে তিনজন রাজা ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে সেই সকল ঘোড়া দু’শ করে কেনেন, সেই ঘোড়াই তুমি পেয়েছ। এর বেশি আর পাবে না। এই অশ্বদের সঙ্গে কোনো সমজাতীয় অশ্বী ছিল না। তাই এদের বংশবৃদ্ধি হয় নি, বয়সও হচ্ছে, তাই আর এরকম অশ্ব কখনো পাওয়া যাবে না।

    গালব বললেন, তাহলে? একচতুর্থাংশ দক্ষিণা যে বাকি রইল? গুরুশাপ আমার মাথার উপর এখনো ঝুলছে, সখা। বিশ্বামিত্র কি মানবেন?

    মানবেন না মানে? তিনি নিজেও জানেন যে বাকি দুশ পাওয়া যাবে না। কিন্তু তুমি তো গুরুর সঙ্গে তর্ক করতে পার না। তবে হতাশ হবার কারণ নেই, তোমার কাছে মাধবী আছে। তিনজন বড় বড় রাজা এর গর্ভের একটি সন্তানের জন্য দু’শ করে ঘোড়া দিয়েছেন। তুমি এই কথাই বিশ্বামিত্রকে বলবে। বলবে, এই কন্যাকেই একটি পুত্র উৎপাদনের জন্য বাকি দু’শ অশ্বের বদলে গ্রহণ করুন।

    গালব হতাশ বোধ করলেন, একটা ক্ষীণ আশামুকুল উন্মোচিত হচ্ছিল, গরুড়ের কথায় উন্মূলিত হল। আগামীতে মাধবী কি তাহলে তাঁর গুরুদার হবেন!

    মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এখন বৃদ্ধ বিশ্বামিত্রের অঙ্কশায়িনী হতে হবে তাঁকে।

    গুরুর অসন্তোষের ভয় গালবের মন থেকে তবু যায় না। তিনি গরুড়কে বললেন, সখা, তোমাকেও আমার সঙ্গে যেতে হবে।

    অতএব গালব গরুড় ও মাধবী চললেন বিশ্বামিত্র সকাশে। সকলে প্রণাম করলেন বিশ্বামিত্রকে। বিশ্বামিত্র বললেন, তাহলে তুমি কৃতকৃত্য হয়েছ, গালব।

    গালব ভয়ে ভয়ে বললেন, গুরুদেব, আমি আপনার অভিলষিত ছয়শত অশ্ব সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। অবশিষ্ট দ্বিশত অশ্বের পরিবর্তে আপনি এই সর্বসুলক্ষণা কন্যাকে পরিগ্রহ করুন। তিনজন রাজর্ষির প্রতিজন দ্বিশত অশ্বের বিনিময়ে এই কন্যার গর্ভে তিন রাজচক্রবর্তী-লক্ষণযুক্ত পুত্র উৎপাদন করেছেন। আপনিও এঁকে দ্বিশত অশ্বের মূল্যস্বরূপ গ্রহণ করে এক নরশ্রেষ্ঠ পুত্র লাভ করুন।

    বিশ্বামিত্র এতক্ষণ অপাঙ্গদৃষ্টিতে নতদৃষ্টি মাধবীর দিকে তাকাচ্ছিলেন। কথা শেষ হলে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালেন। বহুবছর এত সুন্দরী নারী তিনি দেখেননি। সেই কবে স্বর্গসুন্দরী মেনকা জীবনে এসেছিল, তখন তাঁর যৌবন বয়স। রাজ্য ছেড়ে সদ্য তপস্যা করতে এসেছেন ব্রাহ্মণত্ব লাভের জন্য। কিন্তু এত সহজে কি আত্মসংযম করে ধ্যানে মন বসানো যায়! সেই সময় ইন্দ্রের আদেশে মেনকা এসে তাঁর আসনের সামনেই নাচগান শুরু করেছিল। ইন্দ্র নিজে একটা নারীলোলুপ লম্পট, কেউ তপস্যা করতে বসলেই তার কাজ হল অপ্সরা পাঠিয়ে তার ধ্যানভঙ্গ করা। তায় তখন বসন্তকাল, বনস্থলী ফুলে ফুলে, রক্তিম নবপল্লবে মনোহর রূপ ধারণ করেছে, কোকিলের কুহুরব আর দক্ষিণ সমীরণ বারে বারেই মনকে উতলা করে দিচ্ছে। গানের মধুর শব্দে ও নূপুরের নিক্বণে তাঁর বহুচেষ্টিত ধ্যান ভাঙল। দেখলেন, মেনকা নাচতে নাচতে তার বুকের আঁচল উড়িয়ে দিল হাওয়ায়, তারপর নীবিবন্ধও শিথিল করে দিল, উদরের নিম্নদেশে স্বর্ণিম কেশ যেখানে ঘন হয়ে এসেছে, সেখান পর্যন্ত প্রায় দৃশ্যমান, পশ্চাতের মালভূমির বিভাজিকার উপরের আবরণ প্রায় শেষ সীমায় পৌছে গেছে নাচের তালে তালে। বিশ্বামিত্র চোখ বন্ধ করলেন, কিন্তু দুরন্ত কৌতূহল তাঁকে এক মুহূর্তের বেশি চোখ বন্ধ রাখতে দিল না। চোখে চোখ মিলে গেল, সেই চোখে কামনার আহবান। মন বিচলিত হল, ইন্দ্রিয় নারীস্পর্শের জন্য লালায়িত হয়ে উঠল। তপস্যা কিছুদিনের জন্য স্থগিত থাক, বলে তিনি আসন থেকে উঠে মেনকার হাত ধরলেন। মেনকাও প্রস্তুত ছিল, দুজনে সেই নির্জন বনে কামকলায় মেতে উঠলেন। একবছর খুব শরীরসুখ, তারপর হল একটি কন্যা। কিন্তু কন্যাশিশু দিয়ে তিনি কী করবেন। পুত্র হত, রাজকার্যে লাগত, বংশবৃদ্ধি হত, রাজ্যে পাঠিয়ে দিতেন। বিরাগে তিনি আশ্রম ছাড়লেন, মেনকা শিশুকন্যা নিয়ে কী করল তার আর খবর রাখেননি।

    তারপর আরো গভীর বনে চলে গেলেন, যেখানে নারীমুখ দেখাই যায় না, এমন কী এই তপোবিঘ্নরূপিণী নারীদের দিকে তাকানোর অবকাশ বা সুযোগ কোনোটাই নেই, তাই বুঝি তপস্যায় সিদ্ধি হল। এতকাল পর এই নারী তাঁর কাছে এসেছে, একে কি ছাড়া যায়! এই নারী প্রকৃতিগতভাবেই সুন্দরী, প্রত্যেকটি অবয়ব অতি সৌষ্ঠবসম্পন্ন। এর কোনো বিলাস নেই, মুখে রূপবর্ধক প্রলেপ নেই, উজ্জ্বল বসনভূষণ নেই, মন ভোলানোর হাবভাবও নেই, পদ্মপলাশ চোখদুটো কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। বাণপ্রস্থ যাবার আগে, তৃষ্ণা শেষ হবার আগে একবার এই দেবরূপিণী নারীকে ভোগ করে দেখতে হবে, নিস্পৃহ সুন্দরীকে ভোগ করার ব্যাপারটা কুমারী জমি নিজের অধিকারে আনার থেকেও রোমাঞ্চকর।

    তিনি গালবকে বললেন, তুমি প্রথমেই এই কন্যাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারতে। তাহলে আর কিছুই লাগত না, আমি এই কন্যা থেকে চারটি পুত্র উৎপাদন করতে পারতাম। ঠিক আছে, এখন যখন এনেছ, আমি নিশ্চয়ই এর গর্ভে একটি পুত্র উৎপাদন করব। যাও, ঘোড়াগুলো নিয়ে এসে আশ্রমে ছেড়ে দাও। আর একবছর পর এসে এই কন্যাকে নিয়ে যেও।

    গরুড় অপাঙ্গে গালবের দিকে চেয়ে কার্যসিদ্ধির ইঙ্গিত করে মুচকি হাসলেন।

    মূর্খ! বিশ্বামিত্র ভাবলেন আবারও। ওই মূর্খ গালব কি ভেবেছিল, তার গুরু হয়েছি বলে কাম জয় করে ফেলেছি? কামকে কে জয় করতে পারে! এত সুন্দরী এই নারীটিকে সে আগে দিতে পারত, মূর্খ দিল তো শেষ মুহূর্তে দিল, আরো কজন রাজা ভোগ করে ফেলার পর। গুরুদক্ষিণা নিয়ে কড়াকড়ি করার জন্য এখন তাঁর অনুশোচনা হচ্ছিল।

    গালব বিশ্বামিত্রের কাছে আসবার আগেই গরুড়ের অনুচরদের দিয়ে অযোধ্যা, কাশী ও ভোজের রাজাদের খবর দিয়েছিলেন শুল্কের অশ্বগুলো দিয়ে দিতে। অশ্বপালকেরা এতদিনে পৌছেই গেছে, তারা ঘোড়াগুলো আশ্রমে বিশ্বামিত্রের নির্দিষ্ট স্থানে ছেড়ে দিল। তারা আশ্চর্য হচ্ছিল, এই বুড়ো ঘোড়াগুলো দিয়ে ঋষি কী করবে! ঋষি ও তো বুড়ো হয়েছে । তার বাচ্চা ছেলে বড় হতে হতে ঘোড়াগুলো আর বেঁচে থাকবে না। রাজা তো এগুলোকে যত্নে রেখেছিলেন, শুধু দুর্লভ ও সুন্দর বলে। প্রত্যেকটা ঘোড়াকে দলাইমলাই করতে কতগুলো অভিজ্ঞ লোকের দরকার হত! কোনো কাজে লাগত না এগুলো, শুধুই দেখানোর জন্য থাকত, আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যব, চানা আর গুড় খেত।

    বিশ্বামিত্রের তাড়া আছে, তিনি মাধবীকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করলেন না। তিনি শাস্ত্র জানেন, নারী ভোগ্যবস্তুর বেশি কিছু হলে সেটা হল তার গর্ভে নিজের বীজ সেচন করে সন্তান উৎপাদন করা যায়। এইটুকু ছাড়া আর কী। তবে এত সুন্দরী নারী তিনি পাবেন বলে ভাবেননি। তাই আশ্রমের ঘর থেকে তিনি কদিন আর সরলেন না। বহুদিন পর ইন্দ্রিয়সুখ উপভোগ করে মাধবীর গর্ভাধানরূপ ধর্ম পালন করলেন। যথাসময়ে মাধবীর গর্ভে বিশ্বামিত্রের এক পুত্রের জন্ম হল। শিশুটির নাম হল অষ্টক। বিশ্বামিত্র বানপ্রস্থে পাকাপাকি চলে গেলে এই ছেলে কান্যকুব্জের রাজা হবে, ষোড়শ বৎসর বয়স না হওয়া অবধি প্রধান অমাত্য তার খেয়াল রাখবেন। মাধবী চলে গেলে শিশুপুত্র ও অশ্বগুলোকে রাজধানীতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

    ছয়

    শর্তের পাঁচটি বৎসর পূর্ণ হয়ে গেছে। গালব এখন পূর্ণমনোরথ। তাঁর গুরুদক্ষিণা দেওয়া হয়েছে, এবারে মাধবীকে পিতৃগৃহে পৌছে দিয়ে তাঁর কর্তব্য শেষ হবে, ব্রহ্মচর্যের ও সমাপ্তি। তিনি ভাবছেন, অচিরেই তিনি নিজ আশ্রম তৈরি করবেন, তারপর একটি কুমারীকে বিবাহ করে গৃহস্থ হবেন, গুরুকুল সংগঠন করবেন, শিষ্যপ্রশিষ্য হবে। যে একটুখানি মিষ্টি স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সেটুকু বিলীন হলেও একবছরে তিনি হতাশা কাটিয়ে উঠে নূতন জীবনের জন্য তৈরি হচ্ছেন।

    মাধবীকে গালব বললেন, ভদ্রে, আমার কার্য সম্পন্ন হয়েছে, তোমার জন্যই আমি কৃতকৃত্য হয়েছি। তুমি না থাকলে গুরুদক্ষিণা দিতে অক্ষমতাজনিত অপরাধে অপরাধী হয়ে আমি গুরুশাপে নরকবাসী হতাম। আমার জন্য অনেক কষ্ট স্বীকার করেছ, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। হে কল্যাণী, এবার তোমার এই কষ্টকর জীবনের অবসান হল, এখন পিতৃগৃহে গিয়ে সুখে অবস্থান কর।

    মাধবী বললেন, গালব, শুধু কৃতজ্ঞতাতেই শেষ করলে? একত্রে মাত্র সপ্তপদ চললেই দুজন মানুষ মিত্র হয়। বিবাহের অনুষ্ঠানে তাই নারী ও পুরুষ একত্রে সপ্তপদ গমন করে। তুমি আর আমি এই পাঁচবছরে কতদিন, কত মাস একসঙ্গে চলেছিলাম। আমার একএকটা ঘর হয়েছে, পতিপুত্র হয়েছে, আবার একবছরেই স্বপ্নের মত বিলীন হয়েছে, তখন তুমিই আমার মনের দুঃখ বুঝেছ, সান্ত্বনা করেছ, মাঝে মাঝে পথশ্রমে ক্লান্ত হলে বৃক্ষপত্রে বীজন করেছ, কখনো আমার পায়ে কাঁটা ফুটলে নিজে আমার পা কোলে টেনে নিয়ে কাঁটা বের করে দিয়েছ, পিপাসায় জল এনে মুখের কাছে ধরেছ -- এইসব কী শুধুই কৃতজ্ঞতার জন্য? না মানুষ যেমন তার উপকারী পশুর প্রতি কৃতজ্ঞ, সেরকম? তোমার মনে আমার জন্য একটুও জায়গা নেই?

    গালব বললেন, মাধবী, ওরকম বলো না। জানোই তো আমি নিরুপায় ছিলাম। তোমার পিতাও তোমাকে দিয়ে রাজাদের থেকে শুল্ক নিতে বললেন। তাই তোমাকে নিয়ে গেলাম রাজাদের কাছে। কল্যাণী, বারবার নিজের স্বার্থ বলি দিয়ে তুমি আমার কার্যসিদ্ধি করেছ। তোমার স্থান আমার হৃদয়ে চিরউজ্জ্বল রইবে।

    তুমি কৃতার্থ, আমার প্রয়োজন তোমার কাছে আর নেই, তাই এখন আমাকে পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিচ্ছ? জান, ওখানে যেতে আমার আর ইচ্ছে করে না? যে পিতা তার মেয়েকে অন্য পুরুষের কাছে বিলিয়ে দেয় কারণ তার নিজের অর্থ নেই, তেমন পিতার ঘরে থাকতে কোনো দুহিতার ইচ্ছা করে?

    গালব অধোবদনে রইলেন। একটু পরে শুধোলেন, তাহলে কোথায় যাবে?

    তুমিই বলো?

    মাধবী, নারীর বিবাহপূর্ব অবস্থায় পিতাই তাকে রক্ষা করেন। পিতা রক্ষতি কৌমারে --

    চুপ কর, গালব। ওই শ্লোকটি আমাকে আর শুনিও না। তোমার লজ্জা করছে না ওই শ্লোকটা আওড়াতে? কী রক্ষাই না করা হয়েছে কন্যাকে! রক্ষয়িতা পিতা! আর তুমি, যে তোমার কাজ সাঙ্গ হয়ে যাবার পর শুষ্ক কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমাকে বিদায় করছ! আমি তোমার এতদিনের সঙ্গী, স্পষ্ট বলছি, পিতৃগৃহে না পাঠিয়ে তুমিই আমাকে পরিগ্রহ করতে পারতে।

    আমি? কী বলছ মাধবী? তুমি রাজকন্যা, আমি দরিদ্র ব্রাহ্মণপুত্র!

    আমি রাজশ্রী ত্যাগ করে, রৌদ্রে, বৃষ্টিতে ক্ষুধাতৃষ্ণা সহ্য করে তোমার সঙ্গে বনে পথে প্রান্তরে ঘুরিনি? আমি কি খুব সুখে শয়ন করেছি?

    কয়েকবছর তোমাকে বহু কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে বটে, কিন্তু মাধবী, এখন আর কেন করবে? রাজশ্রী এখন তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আরেকটি গুরুতর কথা বলতেই হয়, তুমি বিশ্বামিত্রের পুত্রজননী হয়েছিলে, তাই এখন তুমি আমার গুরুপত্নীর তুল্য‌, আমার অগম্যা।

    মাধবী বললেন, থাক গালব, আমি তোমাদের শাস্ত্র আর শুনতে চাই না। তবে আমি যা বলেছি, তা আর মনে রেখো না। তুমি তোমার পথে যাও, গালব। তোমার মঙ্গল হোক। আমার জন্য ভাবতে হবে না, আমি নিজেই পিতৃগৃহে যেতে পারব। তুমি তো জানই, আমরা এখন প্রতিষ্ঠান নগরীর কাছেই, আমি এই রাজ্যের রাজকুমারী। যে কোনো প্রজা আমাকে সাহায্য করবে।

    তবুও গালব অধোবদনে মাধবীকে তাঁর পিতৃগৃহ পর্যন্ত অনুসরণ করে পিতার কাছে পৌছে দিলেন। মাধবী যে শেষপর্যন্ত তাঁকে চেয়েছিলেন, একথা তিনি ভাবতেই পারেন নি। মনে পড়ল, শত কষ্টের মধ্যেও মাধবী তাঁর খেয়াল রেখেছেন, মায়ের মত, জ্যেষ্ঠা ভগিনীর মত, আশ্বাস দিয়েছেন প্রিয়সখীর মত। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভাগ্যদোষে সব পাল্টে গেল। মাধবীর কথা শোনার পর গালবের আর গার্হস্থাশ্রমে প্রবেশ করার ইচ্ছে রইল না।

    মাধবী ফিরে এসেছেন দেখে তাঁর দুই ভাই, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ যদু ও কনিষ্ঠ পুরু খুব আনন্দিত হলেন। প্রিয় ছোট বোন মাধবীকে পিতা যেভাবে ব্রহ্মচারীর গুরুদক্ষিণা মেটাতে রাজাদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন, সে কথা শুনে যদু খুব দুঃখিত হয়েছিলেন। পুরু জরাগ্রস্ত হয়েছিলেন, সেই সময়ে তাঁর বোধশক্তি কমে গিয়েছিল, নিজের শরীরের বলহীনতার সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন। কিছুদিন আগে পিতা যযাতি পুরুকে তার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছেন, নিজের জরা নিজে নিয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন, ভোগ করতে থাকলে ভোগের তৃপ্তি হয় না। দেখেছেন, তাঁর ভোগের জন্য রাজকোষ শূন্য হয়ে গেছে, তাই বিশ্বাচী ও তাঁকে ত্যাগ করে গেছে। অন্য সুন্দরী ভোগ করবার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা আর তাঁর কাছে নেই। পুরু তারুণ্যেই জরাগ্রস্ত হওয়ায় এতদিন কর্মে অক্ষম ছিল, অন্য ছেলেরা সবাই নির্বাসিত, তিনি নিজেই তাদের তাড়িয়েছিলেন। খবর পেয়েছেন, সেইসব নির্বাসিত পুত্রেরা প্রত্যেকেই নিজনিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যদিও সেসব প্রতিষ্ঠা ভরতবংশীয়দের মত নয়, তবুও তারা ভেসেও যায় নি। বড় ছেলে যদু তো নিজের ক্ষমতাবলে এক বড় ও প্রতাপশালী রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁর নিজের নামেই সেই রাজ্য যাদবরাজ্য বলে বিখ্যাত হয়েছে।

    পিতার মানসিক পরিবর্তনের খবর পেয়ে যদু এসেছেন তাঁর ও পুরুর সাক্ষাত করতে। ইস, স্নেহের ছোট ভাই পুরুর কী দশা হয়েছিল! কী কষ্টই না সে পেয়েছে তারুণ্যেই জরাগ্রস্ত হয়ে! যাক, এখন যদি রাজার আর কিছু খেয়াল না চাপে তবেই ভাল। বাকি তিন ভাই, তুর্বসু, অনু এবং দ্রুহ্যু অনেক দূরে নির্বাসিত হওয়ায় হয়তো এখনো সংবাদ পায়নি। রাজকোষের সমস্ত ধন নিঃশেষিত, প্রতিষ্ঠান রাজ্যের রাজপ্রাসাদে আগের মত আনন্দময় পরিবেশ নেই। মাতা দেবযানী তাঁর ও তাঁর সন্তানদের প্রতি পিতার অবহেলায় প্রায় জীবন্মৃত হয়ে এখন একান্তবাস করেন, কারো সঙ্গে সাক্ষাত করেন না। এত উদাসীন হয়ে পড়েছেন যে সন্তানদের কথাও আর জিগ্যেস করেন না, যেন তাঁর কাছে সকলেই মৃত। মাতা শর্মিষ্ঠাও জীবিত আছেন, কিন্তু তিনিও পিতা দ্বারা অবহেলিত, তাই সর্বদা দুঃখিত থাকেন। তাঁর দুটি পুত্র নির্বাসিত, তৃতীয় পুত্র পুরু রাজ্য পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু অকালে জরাগ্রস্ত হওয়ায় দুর্বল। যদিও এই কিছুদিন হল সে যৌবন ফিরে পেয়েছে, কিন্তু তার যা ক্ষতি তা তো হয়েই গেছে। ছোট বোন মাধবীকে পিতা এক ব্রহ্মচারীর সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার গুরুদক্ষিণা উপার্জনের জন্য। ধনহীন হয়ে তার প্রতি পিতা কী প্রচণ্ড অন্যায় করেছেন! কয়েকবছর পর এখন সে ফিরেছে, এখন তো তার বিবাহের আয়োজন করা উচিত।

    যদু ও পুরু মিলিতভাবে পিতার কাছে আবেদন করলেন, পিতা, ভগিনী মাধবীর স্বয়ংবরসভার আয়োজন করা হোক।

    এতদিনে যযাতিও ভাবলেন, মেয়েটির প্রতি কর্তব্য করা হয়নি। এদিকে তাঁর বানপ্রস্থের সময় হয়ে এসেছে, যেহেতু তিনি জরাগ্রস্ত। যদুকে তিনি গঙ্গাযমুনার সঙ্গমের কাছে একটি আশ্রম তৈরি করতে আদেশ দিলেন। গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্থল অতি রমণীয় স্থান, সেখানে আশ্রমের জন্য শুধু মৃত্তিকানির্মিত ভব্য কুটির করলেই হবে, নূতন অট্টালিকা নির্মাণ করিয়ে বেশী ব্যয় করবার প্রয়োজন হবে না। অভ্যাগতরা এখানকার প্রাকৃতিক শোভা দেখে মুগ্ধ হবেন, তাছাড়া পতিতপাবনী গঙ্গা তো আছেনই। কাছে বনও আছে, অতিথিবর্গের আহারের জন্য সেখান থেকে মৃগয়ালব্ধ মাংস সহজেই পাওয়া যাবে। সেখানেই নিমন্ত্রিত রাজন্যবর্গ আসবেন, তাদের ও ব্রাহ্মণাদি আপামর দর্শকবৃন্দের আপ্যায়নের জন্য ব্যবস্থা রাখা হবে।

    যদুর প্রচেষ্টায় নির্দিষ্ট স্থানে সব আয়োজন করা হল। নিমন্ত্রণ পেয়ে বিভিন্ন দেশের বহু রাজা, বিশ্বামিত্র ব্যতিরেকে মাধবীর ভূতপূর্ব একবছরের স্বামীরাও সেখানে এলেন। সকলে আসন গ্রহণ করলে যযাতিও সভার মধ্যস্থলে আপন আসন গ্রহণ করলেন।

    মাধবীকে স্বয়ংবরের জন্য প্রস্তুত হতে বেশ কিছুদিন আগেই জানানো হয়েছিল। পুরু এসেছিল, বলেছিল, ভগিনী মাধবী, রাজা তোমার বিবাহের জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন করবেন, অদ্যাবধি তিনমাস পর। গঙ্গাযমুনার সঙ্গমে আশ্রম তৈরি করাচ্ছেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। সেখানেই সমস্ত অনুষ্ঠান হবে। মাধবী, তুমি এই সংবাদে আনন্দিত হয়েছ তো?

    মাধবী বলেছিলেন, ভ্রাতা পুরু, তুমি যে জরা থেকে মুক্তি পেয়েছ, তোমাকে যে স্বস্থ দেখাচ্ছে, আমি তাতেই সবচাইতে বেশি আনন্দিত হয়েছি। আমার স্বয়ংবরের আর কী প্রয়োজন ? আমি চারবার চার রাজার দ্বারা পরিগৃহীত হয়েছি, চার সন্তানের জন্ম দিয়েছি, পিতার দৌহিত্রের অভিলাষ পূর্ণ হয়েছে। আমার আর বিবাহের দরকার নেই।

    মাধবী, তোমার তো একটা নিজস্ব গৃহ প্রয়োজন। একজন ভালবাসবার মানুষ প্রয়োজন, সন্তান প্রয়োজন, যে সন্তান তোমাকে বৃদ্ধাবস্থায় দেখাশোনা করবে, তাই না? কৈশোরেই তোমার প্রতি অনেক অবিচার হয়েছিল, এখন তো তোমার একটু সুখ চাই, পিতাও একথা বুঝেছেন, এজন্যই স্বয়ংবরের আয়োজন করছেন।

    মাধবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভাই, সেসব কথা বলে আর কী হবে। সে জীবন আমার আর কেউ ফেরাতে পারবে না। যেমন ফেরাতে পারবে না তোমার তরুণ বয়সে জরাগ্রস্ত হয়ে যাওয়ায় প্রথম যৌবনের স্বর্ণিম দিনগুলো। তুমি সেগুলো কী কখনো পাবে? না।

    এসব কথা বোলো না মাধবী, বলো না। তুমি আর আমি দুজনেই স্বেচ্ছায় নিজেদের যৌবন দিয়ে দিয়েছিলাম, এখন আর সেসব ফিরে পাবার কথাই আসে না। যা আছে, তা নিয়েই বাকি দিন কাটাতে হবে।

    মাধবী বললেন, হ্যাঁ, তা বটে। তুমি যৌবন না দিলে আজ তোমাকেও কোনো প্রত্যন্ত প্রদেশে নির্বাসিত থাকতে হত। আর আমি পিতার অবাধ্য তো হতেই পারতাম না। তখন আমি কিশোরী, আমার কী পছন্দ, কী করলে ভাল হবে, তাও বোঝবার মত বুদ্ধিও ছিল না। আমি তখন কুমারীকন্যা, আমার নিজস্ব পছন্দ বলবার অধিকারও ছিল না। পণ্যের মত আমাকে এর থেকে তার কাছে দান করা হল, কেউ আপত্তি করেনি, মেনে নিয়েছিল।

    পুরু মাধবীর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, প্রিয় বোন, অতীত কথা আর ভেবো না। স্বয়ংবরের জন্য তৈরি হয়ে যেও। পিতা বণিক সমুদ্রসেনকে পাঠাবেন, তোমার মনোমত ভূষণ তৈরি করাবার জন্য। সে তোমার কাছ থেকে তোমার পছন্দের অলঙ্কারের কথা জেনে সেই মত করিয়ে নিয়ে আসবে। তুমি তাকে বলে দিও, ঠিক আছে?

    মাধবী বললেন, দেখি।

    পুরু চলে গেলেন। মনটা তাঁর খারাপ হয়ে গেল। মাধবী আর তাঁর বয়সে খুব বেশি পার্থক্য নেই, বড়জোর বছরতিনেকে তিনি বড়। বালকবয়সে তাঁরা বন্ধুর মত ছিলেন, একসঙ্গে কন্দুক দিয়ে খেলতেন। সেই বোনটার জীবনে এবং মনে যে বিপুল পরিবর্তন এসেছে, সে যে এই আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে আর খাপ খাওয়াতে পারছে না, তা বোঝা যাচ্ছে। হয়তো বিয়ে হলে এবং আবার সন্তান হলে তার মনের কষ্ট কিছুটা ঘুচবে, পুরু ভাবলেন।

    মাধবী গালবের সঙ্গে চলে যাবার পর সখীদের আর রাজপ্রাসাদে প্রয়োজন ছিল না। তাই তারা ফিরে গিয়েছিল আপন আপন আলয়ে। সখী আলোলিকা এখন বিবাহিত হয়ে পতিগৃহে। পূর্বতন ধাত্রীও বয়সের কারণে কর্মে অবসৃত হয়ে গ্রামে আপন আলয়ে চলে গেছে। পূর্বতন সখীদের মধ্যে যে সর্বকনিষ্ঠ ছিল, সেই কুরঙ্গিণীই শুধু এখন পর্যন্ত বিবাহিত হয়নি। মাধবীর ফিরে আসবার পর তাকে আবার রাজপ্রাসাদে ফিরে আসতে বলা হয়েছে। তা ছাড়া আরো দুজন নূতন এসেছে, সুমনসা এবং সৌগন্ধিকা, তারা শুধুই আজ্ঞাকারী। কুরঙ্গিণীই এখন মাধবীর বার্তাবাহক ও কথার দোসর। তবে হাস্যপরিহাস যেমন করে আলোলিকার সঙ্গে চলত, সেসব এখন আর নেই। কুরঙ্গিণী কম বয়সের কারণে আগেও মাধবীকে সমীহ করে চলত, অভ্যাসবশত এখনো চলে। মাধবীও এখন আগের মত হাস্যপরিহাস করেন না, গম্ভীর থাকেন।

    কুরঙ্গিণী সকালবেলা রাজপ্রাসাদে এসে বলল, রাজনন্দিনী, তোমার বিবাহের জন্য স্বয়ংবরের আয়োজন করা হয়েছে, জানোই তো। তোমাকে আজ থেকে একটু বিশেষ ত্বক-পরিচর্যা করতে হবে। আর কেমন দুকূল তোমার মনোমত হবে, ভূষণ কেমন হবে সেগুলো জানবার জন্য সেজন্য পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে বণিকশ্রেষ্ঠ সমুদ্রসেন আসবেন, তোমাকে জানাতে যুবরাজ পুরু বলে দিলেন।

    হ্যাঁ। ভ্রাতা পুরু বলেছে আমায়। আমার নাকি স্বয়ংবর! অথচ আমাকে কেউ জিগ্যেস করেনি স্বয়ংবরে আমি আদৌ আগ্রহী কী না।

    রাজকুমারী, রাজার মেয়েদের তো এরকম ভাবেই বিয়ে হয়, অন্তত বিশ ত্রিশ জন বিবাহার্থীর মধ্য থেকে একজনকে তোমরা বেছে নাও, এ তবুও ভাল। আমাদের মত ছোট রাজকর্মচারীর মেয়েকে পিতা যাকে ঠিক করেন, তাঁকেই বিয়ে করতে হবে।

    কুরঙ্গিণী, তুই জানিস না, রাজকুমারীর কোনো স্বাধীনতা নেই। যে রাজা বা রাজপুত্রকে বিয়ে করে রাজ্যের বা কন্যার পিতা রাজার স্বার্থ রক্ষিত হয়, তার গলায়ই রাজকন্যাদের মালা পরাতে হয়। বাকি স্বয়ংবরের আয়োজন সব লোকদেখানো।

    স্বয়ংবরের দিনে মাধবী নববধূর মত রূপচর্চা করেননি, বহুমূল্য বস্ত্র বা অলংকার পরেননি। কুরঙ্গিণী গত তিনমাস ধরে অনেক পীড়াপীড়ি করলেও একদিনও নবনী দিয়ে গাত্রমার্জনা করেননি, সৌগন্ধিকা হলুদ ও চন্দন উত্তম রূপে পিষ্ট করে আনত, তা একদিনও মাখেননি, সুমনসা স্নান করাতে আসত, তিনি নিজেই স্নান করেছেন, তার সাহায্য নেন নি, ধূপের ধোঁয়া প্রস্তুত রেখেছিল চুল সুবাসিত করবার জন্য, তিনি চুল সুবাসিত করাননি। বণিক সমুদ্রসেন সপত্নীক এসেছিলেন, বণিকপত্নী তাঁর হাতের মাপ নিয়েছেন কঙ্কণের জন্য, অঙ্গুরীর জন্য। কিন্তু মাধবী তাঁদের কয়েকটা সাধারণ সুবর্ণকঙ্কণের জন্য আদেশ করেছেন, আর কিছুই না। বণিক আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বারবার পীড়াপীড়ি করছিলেন, মণিখচিত হার, কুণ্ডল, কেয়ূর, বলয়, অঙ্গুরীয়, নূপুর ইত্যাদি রাজকীয় বিবাহের উপযোগী অলঙ্কার নেবার জন্য। তাঁর পেটিকা থেকে কিছু উৎকৃষ্ট নমুনা বের করে দেখিয়েওছিলেন। রাজার একটিমাত্র কন্যা, তাকে ভাল করে না সাজালে চলে? রাজা ও রাজপুত্র ভাইয়েরা রাগ করবেন, অতিথি রাজবৃন্দও কে জানে কেমন ভাববেন। রাজকন্যা কেন, বিবাহের দিন একজন সাধারণ প্রজার কন্যাও যথাসম্ভব ভাল শাটিকা ও অলংকারে নিজেকে সাজাতে চায়। কিন্তু মাধবী আর কোনো ভূষণের জন্য আগ্রহ দেখালেন না, না কোনো পট্টবস্ত্র, না কোনো গন্ধদ্রব্য। আদেশমত যে কঙ্কণগুলো বণিক দিয়ে গিয়েছিলেন, মাধবী বিয়ের দিনে সেগুলো তাঁর পরিচারিকাদের উপহার দিলেন। বললেন, আমার বিয়ে, আর তোরা সাজবি না?

    আর তুমি? তুমি তো গয়নাই পরনি।

    আমি সাজব ফুলসাজে। নিয়ে আয় বনফুল, নবপত্র। মালা গেঁথে দে, মাথার জন্য, গলার জন্য, হাতের জন্য। সেই তো শ্রেষ্ঠ বিবাহসজ্জা। সুগন্ধি ফুল থাকতে গন্ধদ্রব্যের কী প্রয়োজন? ফুল দিয়ে বরমাল্য গেঁথে দে।

    স্বয়ংবরের দিন মাধবী সাধারণ বস্ত্র পরে সদ্যচয়িত পুষ্পাভরণে নিজেকে সাজিয়ে একা একটি একাশ্ববাহিত রথে বসলেন, হাতে বরণমালা। সারথিকে বললেন এগোতে। যদু ও পুরু তাঁকে অনুসরণ করে অন্য একটি রথে যেতে লাগলেন। মাধবী রথে চড়ে এগোচ্ছেন, যেন সকল রাজা ও রাজপুত্রকে একবার দেখে নিয়ে ঠিক করবেন কার গলা তাঁর বরমাল্য পড়বার উপযুক্ত। এগোতে এগোতে তিনি আশ্রমের উপান্তে বনের সীমায় পৌছলেন, সেখানে রথ থেকে নামলেন। সভায় সমবেত বিবাহপ্রত্যাশী রাজন্যবর্গের চোখ তাঁর দিকে পড়ল। শুধুমাত্র পুষ্পাভরণেই এত সুন্দরী, যেন সাক্ষাত বসন্ত ঋতুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী মধুশ্রী, অথবা স্বয়ং কামপত্নী রতি! এই নারীর চারটে সন্তান আছে কে বলবে! একেবারে কুমারীর মত তন্বঙ্গী, কোমল ত্বক, মুখে সলজ্জ ঈষৎ হাস। কে সেই সৌভাগ্যবান যার গলায় পড়বে এঁর বরমাল্য? প্রত্যেকেই সমুৎসুক হয়ে উঠলেন এই সুন্দরী কন্যাকে লাভ করতে। তাঁদের অনুচরেরা নিজ রাজার গুণরাজি ব্যাখ্যান করবার জন্য আরেকবার মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন।

    সভার দিকে মুখ করে সমবেত রাজন্যবর্গ, অন্য দর্শকবৃন্দ, আপন পিতা ও ভ্রাতাদের সম্বোধন করে সুললিত অথচ গভীর স্বরে ফুলসাজে সজ্জিতা বধূবেশিনী রাজকুমারী বললেন, আমি মাধবী, সমবেত সকলকে প্রণাম জানাই। আপনারা সকলে দেখছেন, আমার পশ্চাতে যিনি আছেন, তিনি অটবী, তিনি মহারণ্য। তিনি বিশাল, সুন্দর, প্রাণিকুলের জীবন, শান্তি ও আশ্রয়দাতা। তাঁর মত মহান এ জগতে আর কেহ নেই। তাই আমি এই অরণ্যকেই আমার পতিরূপে বরণ করলাম। আপনারা আমাকে আশীর্বাদ করবেন। আপনাদের মঙ্গল হোক। অরণ্যের দিকে ফিরে বললেন, হে পতি, আমি আপনাকে বরণ করছি, আমাকে আশ্রয় দিন। বরমাল্য সম্মুখের এক মহাবৃক্ষের পদতলে দিয়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করলেন।

    একটু পরে উঠলেন, এবং কোনোদিকে দৃক্‌পাত না করে মাধবী অরণ্যপ্রবেশ করলেন। খুব শীঘ্রই তন্বীর শরীর বৃক্ষলতাগুল্মরাজির ভেতরে অন্তর্হিত হয়ে গেল। যদু ও পুরু ডাকলেন, মাধবী, ভগিনী! ফিরে এসো। ডাক শুধুই প্রতিধ্বনিত হয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল।

    যযাতি নিজ আসনের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে দুর্বলভাবে বসে রইলেন।

    বুঝলেন, এ সঙ্কল্পের প্রতিরোধ হয় না।

    অভ্যাগত রাজগণ আশ্চর্য হয়ে গেলেন। সমবেত দর্শকগণ ও হতাশ। এ কেমন রাজকন্যা! কোনো রাজাকেই তার মনে ধরল না! অনর্থক আসা হল। তাঁরা স্বয়ং বধূকেই বিবাহবিমুখ দেখে হতাশ হয়ে যযাতির নিন্দাবাদ করতে করতে স্ব স্ব রাজ্যে প্রস্থান করলেন।

    সাত

    গালব বললেন, রাজগণ, এই হল তোমাদের জননী মাধবীর কাহিনি।

    তবুও সন্দেহ যায় না। প্রতর্দন বললেন, মহর্ষি, আপনি কী ভাবে জননীর এখনকার জীবনের বিষয়ে জানেন? জননীর সঙ্গে কী আপনার সাক্ষাত হয়? বসুমনার ও একই জিজ্ঞাসা। শিবি ও অষ্টক কৌতূহলী।

    আমি নিজে স্বয়ংবর সভায় না গেলেও অন্যান্য দ্বিজদের মুখে কাহিনি শুনেছিলাম, মাধবী কিভাবে কোনো রাজাকে পতিত্বে বরণ না করে অরণ্যকে বরণ করেছেন। মাধবীকে যেভাবে জেনেছি, তিনি বিবাহে সম্মত না হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। বৈবাহিক জীবন তাঁর জন্য কোনো নূতন সুখ আনবে না, তিনি বুঝেছিলেন। আমিও বনে চলে গেলাম, গার্হস্থ আশ্রমে প্রবেশ করবার ইচ্ছা আর রইল না। সামান্য পত্রাচ্ছাদন পেলেই বর্ষা পার হয়ে যায়, বাকি দিন বৃক্ষতলই আমার আশ্রয়। জীবনের অনেকদিন পথে চলতে চলতে কেটেছে, এভাবেই আপনাদের রাজ্যে গিয়েছি কয়েকবার। প্রতিদিন ধ্যানে বসি, কিন্তু ধ্যানের মধ্যেও মাঝে মাঝে অস্থির হই, বড় দুঃখিত অনুভব করি, কীভাবে মাধবী আমার নিমিত্তই সমস্ত প্রাকৃত সুখে বঞ্চিত হয়ে বনবাসিনী। তাঁর নিমিত্ত আমি গুরুশাপের বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছি। তাঁর পিতা অর্থীকে বিমুখ করার পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনজন রাজা এবং একজন ঋষি অপুত্রক হবার যন্ত্রণা থেকে, রাজ্যের উত্তরাধিকার নষ্ট হবার বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন, এবং ফলে জনসাধারণ অরাজকতার বিশৃঙ্খলা থেকে নিঃশঙ্ক হয়েছেন। কিন্তু হায়, তাঁর পুত্রেরা তাঁর ত্যাগের কথা জানবে না। বরং তাঁরা লোকমুখে এক স্বৈরিণী নারীর সন্তান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন, এমনই আমাদের সমাজ।

    প্রতর্দন, আমি বনের দিকে তাকাতাম, আমার দৈনন্দিন ধ্যানের পর যথেচ্ছবিহারী বনবাসী মুনিদের জিজ্ঞাসা করতাম, যদি তপস্বিনী মাধবীকে কেউ দেখে থাকেন, যাতে তাঁর বর্তমান জীবনচর্যা সম্পর্কে জানতে পারি। তাঁদের মধ্যেও কেউ বিশেষ জানতেন না। বহুদিন পর এক চারণ আমাকে জানিয়েছিলেন যে এক তপস্বিনীকে তিনি দেখেছেন মৃগযূথের মধ্যে, মৃগদের সঙ্গেই ঘাস তুলে খাচ্ছেন, এবং নিকটবর্তী নির্ঝরিণীর জল পান করছেন, মৃগেরা নির্ভয়ে তাঁর কাছে দাঁড়িয়ে আছে, যেন তাঁর মিত্র। যখন বসেছেন, মৃগশিশুরা কাছে এসে তাঁর কাঁধে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে, তিনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, তাদের গলায় কণ্ডুয়ন করে দিচ্ছেন, তারা নিশ্চিন্তে সেই আদর উপভোগ করছে, যেন তাঁরা পরস্পরের পরম আত্মীয়। কিন্তু তিনি শীঘ্রই বনের অন্তরালে চলে গেলেন, চারণ তাঁর সঙ্গে কিছু কথা বলার অবকাশ পেলেন না।

    জানেন রাজন, সেদিন আমার মনে হয়েছিল এই তপস্বিনী মাধবী ভিন্ন আর কেউ হতে পারেন না। আমি তারপর একদিন চারণের বর্ণিত অঞ্চল ধরে গেলাম, এবং ঠিক তাঁর কথামত মৃগযূথের দেখা পেলাম, কিন্তু তার মধ্যে মাধবীকে দেখতে পেলাম না। তবে হতাশ হইনি। আমি সেই অঞ্চলেই একটি বৃক্ষের নীচে কয়েকদিন থাকলাম, মৃগেরা এর পর ক’দিন আর এল না। দেখলাম, সেখানে ঘাস প্রায় নেই। তাই মৃগেরা খাদ্যের জন্য অন্যদিকে গিয়েছে, বুঝলাম। আমি মৃগদের পথ অনুসরণ করে বনের অন্যদিকে গেলাম, সেইদিকটা বেশ ছায়াচ্ছন্ন, ও তৃণময়। সেখানে মৃগের পাল আছে দেখা গেল। হ্যাঁ, এক তপস্বিনীও আছেন মৃগযূথের মধ্যে, ঠিক যেমনটি চারণ বলেছিলেন তেমনি আচরণ করছেন। সেই একই ভঙ্গিমায় মৃগশিশুকে আদর করছেন, যেভাবে অনেকদিন আগে বানরশিশুকে করতেন। সেই কোমল স্নেহময় মুখ, শুধু এখন তাঁর তপঃকৃশ শরীর, মাথায় জটা ও পরিধানে বল্কল।

    দ্বিপ্রহরের বিজন বনে পত্রের পতন, দুচারটি পাখির কূজন ও হরিণদের মৃদু তৃণচর্বণের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমি অনুচ্চকণ্ঠেই ডাকলাম, মাধবী, দেবী মাধবী।

    তিনি মুখ তুলে তাকালেন। সমাহিত অথচ স্নেহময় মুখ, শান্ত চোখ দুটো যেন একটু অপরিচয়ের দ্বিধার পর নিশ্চিত হল। মাধবী চিনতে পারলেন, এগিয়ে এলেন। স্মিতমুখে বললেন, গালব! তুমি এখানে কেন?

    আমি বনের পশ্চিমদিকে থাকি। আজ তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলাম।

    মাধবী তাঁর স্বাভাবিক মৃদুস্বরে বললেন, আমি তো সাধারণত কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করি না। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, শুভমস্তু তে। তোমার মঙ্গল হোক।

    আমি তবুও বললাম, মাধবী, কিছু বলবে না?

    এখন দ্বিপ্রহর অতীত হয়েছে, আজকের মত আমার মৃগচর্যা শেষ। মৃগেরা এখন বিশ্রামে রোমন্থন করবে, আর আমার ধ্যানের সময়।

    তুমি ভিক্ষান্ন গ্রহণ কর না?

    আমি তো লোকালয়ে যাই না, এখানে মৃগদের সঙ্গে আনন্দে থাকি, তাই তাদের মতই আমার জীবনচর্যা। চলি তবে, বলে মাধবী পেছন ফিরলেন। পুনরায় ডেকে কথা বলে তাঁর শান্তিভঙ্গ করতে আমার ইচ্ছে হল না।

    অক্ষুব্ধ, সংশিতব্রত, প্রসন্ন, অঋণী, মৃগকুটুম্ব, অথচ লোকমুখে স্বৈরিণী নারী মাধবী! কী আশ্চর্য, তাই না?

    গালব চুপ করলেন।

    মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছেন বসুমনা, তিনি জননীর প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়েছিলেন একসময়। তিনি তাঁর কথা পিতাকে জিগ্যেস করেছিলেন। জিগ্যেস করেছিলেন, পিতা, আমার মিত্র সকলেরই ঘরে মাতা আছেন, আমার মাতা কোথায়? তিনি কী মৃত? পিতা ক্ষণিকের জন্য উত্তেজিত হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি গবীধর্ম পালন করতে চলে গেছেন। সেটা কী ধর্ম জিগ্যেস করতে পিতা বলেছিলেন, এখন বলার অবকাশ নয়। যাও, নিজের কাজ করো, ধনুর্বিদ্যা অনুশীলন করতে যাও, তুমি রাজার পুত্র, মনে রেখো। মাতার কথা জিজ্ঞাসিত হলে পিতা ক্রুদ্ধ হন, তাই কৌতূহল হলেও আর প্রশ্ন করেন নি। অনেকদিন পর নিজে বয়ঃপ্রাপ্ত হলে বসুমনাঃ বুঝেছিলেন গবীধর্ম কী। তখন মাতার উপর তাঁর অশ্রদ্ধা হয়েছিল। তিনি সিংহাসনে আরূঢ় হবার পর গালব যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করে মায়ের পরিচয় বলেছিলেন, তিনি প্রথমে খুব একটা শ্রদ্ধা দেখাননি। তারপর গালব যখন তাঁর অন্যান্য ভ্রাতাদের কথাও বললেন, এবং বললেন, প্রতিটি সন্তানের জন্মের পর জননী সন্তানবিচ্ছেদে শোকগ্রস্তা, অশ্রুমুখী অবস্থা সত্ত্বেও রাজশ্রী পরিত্যাগ করে পরিব্রাজিকার ন্যায় রিক্তহস্তে গালবের অনুগামী হয়েছিলেন, কারণ তাঁর একটিই ব্রত ছিল, গালবের গুরুদক্ষিণা অর্জনে সহায়তা করে পিতার সত্য পালন করা, তখন তাঁর মনে কৌতূহল হয়েছিল, এতদিন কিছু না জানার জন্য দুঃখ হয়েছিল। ভেবেছিলেন, মাতা ও তিন সহোদরের সঙ্গে যদি কোনোভাবে দেখা হত!

    দিবোদাসপুত্র প্রতর্দন ও পিতার কাছ থেকে মাতৃপরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। প্রতর্দন দেখেছিলেন, মায়ের কথা শুধোতেই পিতার চোখ জলে ভরে এল, তিনি মুখ ফেরালেন। পুরুষের, বিশেষ করে রাজার অশ্রু দুর্বলতার লক্ষণ, তাই প্রকাশ পেতেই তিনি সরে গেলেন, তাই প্রতর্দন ও মায়ের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেননি। ভাবতেন, মা অতি নিষ্ঠুরা, তাই পিতাকে পরিত্যাগ করে অন্য পুরুষের সঙ্গে চলে গেছেন। রাজপরিবারের কেউই মায়ের কথা বলতে চাইত না। গালব যখন দেখা করে তাঁকে মায়ের কথা বললেন, তখন প্রতর্দন তাঁকে কঠোর স্বরেই বলেছিলেন, সেই কুলটার বিষয়ে কী বলবেন বলুন। গালব শুনে কানে আঙুল দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, কুমার, এমন বলবেন না। আপনার মাতা সত্যসন্ধা পরিব্রাজিকা। তিনি পিতৃসত্য রক্ষার জন্য সমস্ত জীবন ধরে রাজশ্রীকে পরিত্যাগ করেছিলেন। গালবের কথা শুনেই প্রথম মায়ের বিষয়ে তাঁর সত্য কৌতূহল ও শ্রদ্ধা জাগরিত হয়েছিল।

    উশীনরপুত্র শিবিও মাতৃপরিচয় বিশেষ পাননি। পিতা অবশ্য সব সময় তাঁকে ধর্মপথে থাকতে বলেছেন। সত্যপথে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। শিবি তাঁর কথা মান্য করেন আজীবন। মাতার কথা জিগ্যেস করতে উশীনর অবশ্য রূঢ় হননি। শান্তভাবে বলেছিলেন, তোমার মাতা তাঁর পিতৃসত্য রক্ষার জন্য কর্ম করছিলেন, তাই তাঁকে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। হয়তো দেবতাদের ইচ্ছায় তোমার সঙ্গে তোমার মায়ের কখনো দেখা হবে। পুরুষ হোক বা স্ত্রী, আপন কর্ম করে যাওয়াই মানুষের কর্তব্য। এমনিতেই মাতাপিতা কারো বেশিদিন থাকে না। যে মানুষের সঙ্গে চিরকাল থাকে, সে হল ধর্ম। শিবি আশা করেন, এই বনে যে তাঁরা এক হয়ে যজ্ঞ করছেন, এর ফলে দেবতারা সন্তুষ্ট হয়ে নিশ্চয়ই মাতাকে দেখাবেন।

    অষ্টকও আশাবাদী মা-কে দেখতে। গালব তাঁকে এবং তাঁর তিন ভাইকে অরণ্যে গিয়ে যজ্ঞ করতে বলেছেন। এই মহারণ্যেই মাতা থাকেন, নিশ্চয়ই কোনো কোনোদিন দেখা হবে। দেখা হলে মায়ের চরণ বন্দনা করে তিনি ধন্য হবেন। দেবতারা তাঁকে সেই অবকাশ দিন।

    গালবের বর্ণিত মাতৃকথা শুনে চার ভাই অত্যন্ত বিমনা হলেন, অনুতপ্ত হলেন মায়ের প্রতি তাঁদের পূর্ব উদাসীনতা ও বিদ্বিষ্টভাবের জন্য। তাঁরা যজ্ঞে আহুতি দিচ্ছিলেন, সেই ধূমে না শোকে কে জানে, তাঁদের চোখ বারবার বাষ্পাচ্ছন্ন হতে থাকল। মাতা, পুত্রদের ক্ষমা করুন, আমাদের দর্শন দিন, অগ্নিতে আহুতি দেবার স্বাহা উচ্চারণে যেন সেই আকুতিই ধ্বনিত হতে লাগল।

    যজ্ঞের ধূম্রকুণ্ডলী আকাশে উঠতে লাগল, হঠাৎ ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে দেখা গেল এক পুরুষ স্খলিত পদে, পর্বতসানুর পথ বেয়ে প্রায় পড়তে পড়তে তাঁদের দিকে আসছেন। প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন, একজন তপস্বিনী হাত বাড়িয়ে তাঁকে যেন স্থির করলেন। তাঁদের কিছু কথা হল, তিনি আবার চলতে আরম্ভ করলেন, তপস্বিনী ও সঙ্গে সঙ্গে আসছিলেন।

    কাছে এলে তাঁদের আকার বোঝা গেল। পুরুষটি বৃদ্ধ, অভিজাত বেশ, কিন্তু বিবর্ণ এবং মুখ বিষণ্ণ। নারীটির মাথায় জটা, পরণে বল্কল, দেহ কৃশ, কিন্তু মুখখানা তপস্যার দ্যুতিতে উজ্জ্বল, আয়ত চোখের দৃষ্টি থেকে যেন শান্তি বর্ষিত হচ্ছে।

    গালব আপন আসন পরিত্যাগ করলেন, বললেন, তপোধনা মাধবী! দেবী, আগমন করুন। চার ভাই উঠে দাঁড়ালেন। মাতা? তারা সমস্বরে জিগ্যেস করলেন।

    হ্যাঁ, নৃপগণ, ইনিই আপনাদের জননী মাধবী, গালব বললেন। চারজন রাজা তৎক্ষণাৎ মাধবীর পায়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে প্রণাম করলেন। বললেন, আমরা ধন্য, আমাদের প্রার্থনা দেবতারা শুনেছেন, তাই আমরা আজ মাতৃদর্শন করতে পেলাম। তাঁরা আপন আপন নাম ও পিতৃপরিচয় দিলেন।

    মাধবী সস্নেহে পুত্রদের মস্তক স্পর্শ করলেন। তারপর গালবকেও অভিবাদন করলেন। পুত্রদের বললেন, বৎসগণ, আমিও তোমাদের দেখে অত্যন্ত প্রীত হলাম। এখন শোনো, ইনি মহারাজ যযাতি, আমার পিতা, তোমাদের মাতামহ। আমি যখন মৃগচর্যায় বেরিয়েছিলাম, ইনি সাধুসঙ্গ লাভ করবার জন্য তোমাদের দিকেই আসছিলেন। এঁকে দুর্বল ও স্খলিতপদ মনে হওয়ায় আমি সঙ্গে এলাম। এখন ইনিই তাঁর নিজের কথা বলবেন। রাজারা মাতামহকে প্রণাম করলেন। দুজনকে পাদ্য ও অর্ঘ্য দিয়ে বললেন, আসন গ্রহণ করুন, মাতামহ। মাতা, আপনিও আসন গ্রহণ করুন।

    সকলে আসন গ্রহণ করলে রাজাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ বসুমনা বললেন, মাতামহ, আমরা শুনেছিলাম আপনি অমরলোকে প্রস্থান করেছিলেন। কী করে আপনি এখানে এলেন? যযাতি বললেন, আমি একসময়ে অনেক যজ্ঞ, দান, করেছি, নিয়মানুসারে প্রজা পালন করেছি, তাই বৃদ্ধ হলে স্বর্গ লাভের যোগ্য হয়েছিলাম। দেবতারা আমাকে সম্মান করতেন। আমার সঙ্গে সকল দেবতার সদ্ভাব ছিল। কিন্তু একদিন ইন্দ্র আমাকে জিগ্যেস করলেন, মহারাজ যযাতি, বলুন তো, আপনি কী কী পুণ্যকার্য করেছিলেন? আমি বললাম, আমি এত যজ্ঞ করেছি, এত দান করেছি, এবং ধর্ম অর্থ কাম এই ত্রিবর্গেরই নীতি অনুশীলন করে প্রজা পালন করেছি যে আমার সমকক্ষ তো পৃথিবীর আর কাউকে দেখি না। এই অহংকার করাতে আমি ক্ষীণপুণ্য হলাম, এবং ইন্দ্র আমাকে অমরাবতী থেকে বহিষ্কার করলেন। আমি শুধু বলতে পেরেছিলাম, আমাকে যদি মর্ত্যলোকে যেতেই হয়, তাহলে আমি যেন সাধুজনের সংসর্গে থাকতে পারি। দেবতাদের দৌবারিক আমাকে এই যজ্ঞধূমের পথ অনুসরণ করে যেতে বলে স্বর্গের দ্বার রুদ্ধ করে দিল। আর আমি স্বর্গ থেকে পতিত হয়ে সেই ধুমের পথে চলতে চলতে তোমাদের মধ্যে এসে পড়লাম। শুনে প্রীত হলাম যে তোমরা আমার দৌহিত্র এবং তোমরাই দেবদর্শিত সাধুজন।

    আমরা ধন্য যে আপনি আমাদের মধ্যে এসেছেন। এখন বলুন, কী করে আপনার পুনরুত্থান হবে? রাজারা জিগ্যেস করলেন।

    আমার পুণ্যক্ষয় হয়েছে। আমাকে আবার পুণ্য সঞ্চয় করতে হবে।

    মাধবী বললেন, পিতা, আমার সংযম ও তপস্যাতে যদি কিছুমাত্র পুণ্যফল থাকে, আপনি সেইসব গ্রহণ করুন। সেই পুণ্যফলে পুনরায় স্বর্গারোহণ করুন।

    দৌহিত্রেরা প্রত্যেকেই বললেন, মাতামহ, আমরা এপর্যন্ত যদি দান, যজ্ঞ, সত্য অবলম্বন এসবের দ্বারা কিছু সুকর্ম করে থাকি, আপনি সেই সুকর্মের পুণ্যফল গ্রহণ করুন। দেবতারা আপনার জন্য আবার দেবলোকের দ্বার খুলে দিন।

    শেষে গালবও বললেন, মহারাজ, আমার তপস্যার যদি কিছু পুণ্যফল থাকে, আপনি সেসবও গ্রহণ করুন।

    ইন্দ্রাদি দেবতা মাধবী, তাঁর পুত্রেরা, গালব সকলের সমবেত প্রার্থনা শুনে প্রীত হয়ে যযাতির জন্য আবার স্বর্গদ্বার খুলে দিলেন। যযাতির জন্য স্বর্গের রথ এল। তিনি দৌহিত্রদের আশীর্বাদ করলেন, বললেন, তোমরা আমার কথা শুনলে। তোমরা স্বভাবত সাধু। সর্বদা সাধুসম্মত কর্ম করবে, এবং কখনো অহংকারের বশীভূত হবে না। কারণ অহংকারই পতনের কারণ। মাধবীকে বললেন, বৎসে, আমি একবার আমার বাক্যের সত্যরক্ষার্থে তোমাকে গালবের গুরুদক্ষিণার নিমিত্ত তার হাতে সমর্পণ করেছিলাম। তোমার সমস্ত জীবন তুমি আমার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলে। তখন তোমা হতেই আমার অভিশপ্ত হবার ভয় নিবারিত হয়েছিল। আজ তোমা হতেই এইসব দৌহিত্র পেলাম, এবং তোমার এবং তোমার পুত্রদের পুণ্যের জন্যই আমি পুনরায় স্বর্গলাভ করছি। আজ আমি অনুভব করছি, তোমার ত্যাগ আমার জন্য পুরুর যৌবন ত্যাগ হতে ন্যূন নয়, বরং মহত্তর। বৎসে, তোমাকে আশীর্বাদ কী করব, তুমি আশীর্বাদের অনেক ঊর্ধ্বে।

    মাধবী শান্তভাবে বললেন, পিতা, আপনি না হলে তো আমি জীবনই পেতাম না। আমার এই জীবনের জন্য, এই জীবনের সকল অভিজ্ঞতার জন্য আপনাকে প্রণাম করি। আপনার পুনরায় স্বর্গারোহণ হোক, এই প্রার্থনা করি।

    যযাতি সকলকে বিদায় জানিয়ে স্বর্গরথে উঠলেন।

    মাধবীও আসন ত্যাগ করে উঠলেন। পুত্রেরা তাঁকে জিগ্যেস করলেন, মাতা, বলুন, আপনার কী সেবা করতে পারি? তিনি বললেন, পুত্রগণ, আমি সন্তুষ্ট আছি। তোমরা তুষ্টিলাভ কর, তোমাদের শুভ হোক। তাঁরা অনুগমন করতে চাইলে তিনি হাতের ইঙ্গিতে নিষেধ করলেন, তারপর তাদের এবং গালবকে বিদায় জানিয়ে একাকী বনের গভীরে চললেন।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments