• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গল্প
    Share
  • খদিরবনের তারা : অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়



    একটা শুকনো গাছের ডাল দিয়ে কড়াইয়ের ফুটন্ত তরল ঘেঁটে দিতে দিতে শ্যামলা মেয়েটি খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিস করে বলেছিল ...বাদাবনের দেশে আইসো। সাঁতার দিতে জান?

    বাগালটা ততক্ষণে বাড়িতে খবর দিতে গেছে। কোবরেজমশাইযের পাঠানো পুলিন্দা হাতে নিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মেয়েটির পায়ের চুটকীর দিকে চোখ পড়েছিল। একটা রুপোর সাপ যেন বাঁ পায়ের পাতার দ্বিতীয় আঙুলটিকে পেঁচিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। অন্যধারার কথা শুনে চমকে মেয়েটির মুখখানি একবার দেখে নিলাম। শ্যামলা, কাটাকাটা নাকচোখ, অথচ মলিন সলওয়ার কুর্তা, ওড়না দিয়ে গাছকোমর করে বাঁধা। একটা পুটপুটে ছাগলছানা তার পায়ে পায়ে ঘুরছিল।

    পুলিন্দায় একটা হাতচিঠি ছাড়াও যে জিনিষটা আছে তা হচ্ছে জাড় মহুড়া বা বিষ পাথর যা ধীরু শবর দিয়ে গেছিল, কেওনঝড়ের জঙ্গল থেকে যোগাড় করে। অন্তত চার পুরুষ ধরে গোপীরাজপুরের কবিরাজ বাড়ি আর বিলডহরীর এই দৈবজ্ঞ বাড়ির মধ্যে এই নাকি বন্দোবস্ত। একপক্ষ জাড় মহুড়া পাঠাবে, অন্যজন তার জবাবে পাঠাবে শ্বেত খয়ের। দুয়ে মিলে দুজায়গাতেই হবে মহাবিষের চিকিৎসা, শঙ্খচূড়ের বিষও হার মেনে যায় যার কাছে। রওনা হবার আগের সন্ধ্যায় কবিরাজমশাই ঘরের মলিন হলদে আলোতে দেখিয়েছিলেন সেই চুক্তিপত্র। তুলোট কাগজে লাল অক্ষরে লেখা সে প্রাচীন দলিলের হরফ বাংলা মনে হলেও অর্থবোধ হয় না ঠিকঠাক।

    আমি বিনয় জানা। প্রায় বছরখানেক হল কবিরাজমশাইয়ের কাছে এসে ধরে পড়েছি। অভিলাষ, কবিরাজি শিখব। প্রায় ছাব্বিশ হল। মা নেই, বাবা আর সৎমায়ের সংসারে খটাখটি, পড়াশুনায় টিটিপি মানে টেনেটুনে...। কবিরাজি শিখলে এখনো পুরনো গ্রামে--গঞ্জে সম্পন্ন গৃহস্থের ঘরে ডাক পড়ে। ছোটখাটো মেয়েলি অসুখে, বুড়ো--হাবড়া আর একদম কাঁচা ছেলেমেয়ের হাল্কা অসুখে কেউ সহজে হাসপাতাল যেতে চায় না এখনও। একটা পেট, বিদ্যেটা পেলে মোটামুটি চলে যাবে।

    তা কবিরাজমশাই হ্যাঁ না কিছু ঘাড় পাতলেন না। নাড়ি দেখার নাম করে ডান হাতের কবজি ধরে এটা সেটা বলতে লাগলেন আধঘন্টা ধরে। বারোটা বাজলে সেবককে ডেকে বললেন কাছারি ঘরের পাশে আমার থাকার বন্দোবস্ত করে দিতে। বলতে গেলাম, তাহলে শেখাবেন? গুরুদক্ষিণা... আমার কথা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, আগে থাকো তো কদিন, দেখি। ওনার কাছে আগেও নাকি এরকম একজন দুজন বিদ্যে শিখতে এসেছিল, শুনেছিলাম। বিশুদা, ওনার সেবকই পরে এইসব বলেছিল আমায়। একদৃষ্টে আমার প্রতিক্রিয়া মাপতে মাপতে। অবশ্য আমার কীই বা বলার আছে।

    সেই থেকে থাকি, ফাই--ফরমাস খাটি। বিশুদার একটা পা একটু খুঁতো, টেনেটেনে হাঁটে। ওর একটু সাহায্য হয়। চালাঘরদোর সাফ রাখি। সেখানে বসেই রুগি দেখেন কবিরাজমশাই। বাড়ির অন্য কাজের লোকের মতই দৈনিক প্রাপ্য ভাতের খোরাক পাই দুবেলা, একবেলা মুড়ি--ফুলুরি, কখনোসখনো চা। মোটামুটি ফর্সা একসেট কাপড়ও পেলাম এবার পুজোর সময়। কিন্তু আমার ক্লাস নেওয়ার আর সময় হয় না কোবরেজমশাইয়ের। অবশেষে কার্তিক পূর্ণিমার পরের দিন আমার ডাক পড়লো কবিরাজ মশাইয়ের চালাঘরে।

    সেখানেই সব খোলসা করে বললেন কোবরেজমশাই। তিন বছর সাপ্লাই নেই, শ্বেত খদিরের স্টক ফুরিয়ে এসেছে প্রায়, একবারটি না গেলেই নয়। দেখ, তোর আগে অপোগণ্ডদুটোকে পাঠিয়েছিলাম, তা অকৃতজ্ঞ অকালকুষ্মাণ্ড ব্যাটারা এক এক করে গায়েব হয়ে গেল! কোথায় যে গেল একটা পোস্টোকার্ডের পত্তর অব্দি দিলে না।

    হয়তো গুরুর আস্থা অর্জনের এই সুবর্ণসুযোগ। তবু মুখে বললাম, মশয়, আমি জীবনে কাঁসাই নদী পেরইনি, শুনছি সে বাদাবনের দেশ, আরেকটু গেলেই বর্ডার, আমি কি পারবো!

    খুব পারবি বাবা। আমি স--অব লিখে দেব। শিয়ালদা থেকে গাজিডাঙা স্টেশন। বেরিয়েই সাইকেল রিকশা... বললেই দৈবজ্ঞি বাড়ি নিয়ে যাবে। হাওড়া তো চিনিস।

    তা তো চিনি। বুঝে গেলাম এখানে টিঁকে থাকতে হলে যেতেই হবে। বিশুদা পিছনেই দাঁড়িয়েছিল। মুখ ফস্কেই মনে হয়, বলেছিল, দেখো, রাজবাড়ির রাজকন্যে দেখে আবার মাথা যেন ঘুরে না যায়। কবরেজমশাইকে এত রেগে যেতে দেখিনি কখনো, মুখ লাল হয়ে গেল, থমথমে গলায় বললেন, আঃ, বিশ্বনাথ, এতটা বয়স হল, এখনো ফাজলামো করা আর গেল না তোর। বিশুদার মুখে সেই যে কুলুপ পড়ল, আর খুলল না।

    উপস্থিত বিলডহরীর সেই দৈবজ্ঞি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছি। শাদা শাদা চ্যালা কাঠের মত টুকরো পড়ে আছে সর্বত্র। এক কোণে পাশাপাশি দুটো বড় চুলায় বড় ডেগের মধ্যে ফুটছে সেই তরল। পরে জেনেছি ওই কাঠের কুচির ক্বাথ থেকেই খয়ের পাওয়া যায়। নানা ওষধিগুণসম্পন্ন সেই খয়ের বহুমূল্য। মেয়েটি ঘেঁটেই চলেছে ফুটন্ত সেই ক্বাথ।

    আমার দিকে আর মুখ না ফিরিয়েই সে বলল, আহা, ওই দাওয়াটাতে গিয়ে বসলেই হয়! সঙের মত দাঁড়িয়ে থাকতে কে বলেছে!

    তাই তো! হাত পা ধোওয়ার জলও রাখা আছে দেখছি। বসতে যাবো এমন সময় বাগাল ছেলেটি এসে বলল, আপনারে ডাকছে, চলেন।

    প্রায় অন্ধকার ঘরে প্রথমে কিছু ঠাহর হয় না। চোখ সয়ে এলে একদিকে দেখি দেওয়াল জোড়া পট থেকে কোনো দেবী চেয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে পাতা ফরাসে লাল কাপড় পরা এক বৃদ্ধ। দীর্ঘদেহ, টকটকে রঙ। সামনের দিকে পাতলা হয়ে এলেও একমাথা সাদা চুল যেন জ্যোতিশ্চক্র রচনা করেছে। সামনে একটি ছোট ডেস্ক।

    "তিনি শরদিন্দুকরাকারা, সিতকমলোপরিচন্দ্রমণ্ডলস্থা, স্মেরমুখী, নানালঙ্কারবতী মুক্তাহারোপশোভিতাহৃদয়া, স্ফুরদনন্তগভস্তি ও ব্যূহাবভাসিতলোকত্রয়া... " একটানা মিহি গলায় বলে যাচ্ছেন, ইনিই তবে দৈবজ্ঞ। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তাঁর পাশে মোটাসোটা গড়নের কালো এক ভদ্রলোক বসে ছিলেন। সৌজন্যবশে তাঁকে প্রণাম করতে যেতেই, আরে আরে করেন কী বলতে বলতে তিনি ফরাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দৈবজ্ঞ গম্ভীর স্বরে বললেন, বোসো হে।

    পুলিন্দাটা তাঁর ডেস্কে রেখেছিলাম। উনি একঝলক উঁকি দিয়ে ফিরলেন আমার দিকে----নাম কি?

    বললাম। পরবর্তী প্রশ্ন, বাড়িতে কে কে আছে? আচ্ছা, এরা সবাই কি মেয়ের বিয়ে দেবে? এত কিছু জানতে চায় কেন! এবার কী মনে হল, বলে দিলাম, ত্রিসংসারে কেউ নেই।

    একদৃষ্টে আমাকে দেখছিলেন, এবার চিঠিটা বের করে, খুলে পড়তে লাগলেন।

    --পাঁচদিনের মধ্যে পাঠাতে লিখেছে যে! কবিরাজ মশাই কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? পাঁচদিনে খদির তয়ের হয়? তাছাড়া মান্টারা শ্বেত খদিরের কাঠ এনে দেয়, তাদের নৌকা আসার এখনও কোন না হপ্তা বাকি!

    --আসলে ভাণ্ডার ফুরিয়ে এসেছে বলছিলেন কবরেজ মশাই।

    --বললেই হল! শ্রাবণ মাসেই তো পাঠালাম, কী যেন নাম ছেলেটার...আশিস... অসিত, হ্যাঁ, অসিতের হাত দিয়ে।

    বিশুদা বলেছিল বটে অসিত শীলের কথা। তারও আগে সূর্যনাথ দাসের কথা। ওষুধ আনতে যেয়ে আর ফেরেনি। কিন্তু সে তো শ্রাবণ মাসের কথা নয়। তাছাডা, জানানোর হলে কবিরাজমশাই চিঠিতে বিশদে লিখতেন নিশ্চয়ই। চেপে গেলাম বিলকুল।

    দৈবজ্ঞ বলে যাচ্ছিলেন, সবে পঞ্চমী আজকে। দশমী নাগাদ মান্টারা আসবে। যদি ভাল শুকনো কাঠ আসে তাহলে পূর্ণিমা নাগাদ পেয়ে যাবে। ততদিন থাকো তাহলে।

    মান্টারা আবার কারা? প্রশ্নটা মনেই রেখে দিতে হল, এতই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটা।

    অন্য ভদ্রলোকটি বলে উঠলেন, ছোকরার তাহলে এ’কদিন কোনো কাজ নেই দৈবজ্ঞি মশাই?

    --নাঃ, কেন, আপনার শাগরেদী করতে বলব নাকি?

    --তা একবার নাহয় পাঠিয়ে দেবেন ওবেলায়। আমিও এখন উঠি তবে।

    কবিরাজ ফিরলেন আমার দিকে। দেখছো কি! ডাক্তার বাগ কলকেতার কলেজে পড়া ডাক্তার, শুধু গাঁ ছেড়ে যাবেন না বলে থেকে গেলেন মাটি কামড়ে। তা একবারটি যেও যখন বলছেন। এখন এসো। চরণ তোমার থাকার জায়গা করে দেবে বার-বাড়িতে।

    বাগালটা কি বাইরে বসে আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল? কে জানে, কথা শেষ হওয়া মাত্রই দরজা থেকে গলা বাড়িয়ে বলল, আসুন বাবু।

    আবার সেই উঠোন পার হয়ে তার পিছু পিছু যেতে যেতে আড়চোখে দেখলাম সেই মলিন সলওয়ার কুর্তা, চেয়ে আছে এদিকেই। দুহাত জড়ো করে ছাগলছানাটা কোলের কাছে ধরা। পরে শুনেছিলাম, ছানাটার মাকে শেয়ালে মেরে ফেলেছিল বলে ছানাটাকে পেলেছিল সে। নাম রেখেছিল মুন্নি।

    ডাক্তার অজিত বাগের সঙ্গে আমার ভাব জমে গেল অবশ্য।

    বেশ গল্প করতে পারেন ভদ্রলোক। চেম্বার নামেই, গ্রামের লোক বেশি আসতে দেখলাম না, পুরনো পেশেন্ট পার্টি এক আধটা। ফিজও সেরকম কিছু না, ওনার কথায়, দেবেই বা কোত্থেকে, গ্রামে কাঁচা টাকা কোথায়...

    এরই মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে আনিয়ে পেঁয়াজের সুরুয়া খাওয়ালেন। আমি বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে, এত খাতিরে চোখ একটু ছলছল তো করবেই।

    তার উপর প্রেশারের জন্তরটা চালানো শিখিয়ে দিলেন, শরীরের নানান জায়গা প্যালপেট করে দেখার টুকটাক ব্যপারও জানলাম। কবিরাজ মশাইয়ের কাছে যে ট্রেনিং কিছুতেই হচ্ছিল না, সেটার একটা আশা এখানে দেখতে পেলাম। আমার নোটখাতায় সব লিখে নিচ্ছিলাম।

    সেই সলওয়রবালীর সঙ্গে বেশ কয়েকটা দিন আর দেখা হল না। চরণের মুখে তার নাম জেনেছি, তারা। চরণই বলেছে মান্টারা আসলে বেদেদের একটা শাখা, যারা জলে-নৌকায় বসবাস করে, এক দেশ থেকে অন্যদেশে ঘুরে বেড়ায়, জড়িবুটি, তুকতাক এই-ই তাদের জীবিকা। কিন্তু পাঁচদিন কোথায়, দশদিন কেটে গেল, এদের দেখা নেই। মান্টা সর্দার হুমরা তার নৌকা নিয়ে এলে বাঁচি। মিনিমাগনায় দৈবজ্ঞমশায়ের অন্নধ্বংস করতে মন সায় দিচ্ছিল না আর।

    ডাক্তার অবশ্য অভয় দিচ্ছিলেন, এত চিন্তার কী আছে হে? তুমি তো আমার সঙ্গেও কাজ করতে পারো। সেবা করা নিয়ে কথা। আমার আরেকটা চেম্বার আছে, মুকুন্দপুরে। মাসে একবার করে যাই, হপ্তাখানেক কাটিয়ে আসি। যাবে নাকি?

    এক জায়গায় বসে থেকে কোমর ধরে যাচ্ছিল। ভাবলাম দৈবজ্ঞমশায়ের অনুমতি নিয়ে রাখতে হবে। মুখে বললাম, দেখি ভেবে। ডাক্তারের উৎসাহ আমার চেয়ে বেশি। বললেন, তাড়াতাড়ি করো। আচ্ছা, তোমার রক্ত পরীক্ষা করিয়েছ কখনও? ব্লাড গ্রুপ কী জানো?

    ইস্কুলের বইতে পড়েছি, বললাম। নিজের গ্রুপ কী জানিনে, তাও বললাম। উনি বললেন, জানা থাকা ভাল। আমার লোক আছে, এসে স্যাম্পল নিয়ে যাবে।

    আমার কৃতজ্ঞতা আর ভরসা বেড়ে যাচ্ছিল দিন দিন।

    আসা-যাওয়ার পথে সলওয়রবালীর সঙ্গে দেখা হলেও নতুন সম্ভাবনার উত্তেজনায় তার দিকে তাকানোর মত মনের অবস্থা ছিল না। মনে মনে স্বপ্ন দেখছিলাম একদিন মুকুন্দপুরের চেম্বারে অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছি আমি। নামেই অ্যাসিস্ট্যান্ট, মাসের বাকি তিন সপ্তাহ তো চেম্বার আমার হাতে।

    একটা খটকা অবশ্য ছিল। যার কাজ নিয়ে এসেছি, সেই কোবরেজমশাইয়ের কাছে খয়ের পৌঁছবে কী করে তবে? একদিন বলেও ফেললাম সে কথা। উনি শুনে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন প্রায়... আরে দৈবজ্ঞ মশাই যখন দেখবেন তুমিও কেটে পড়েছ, তখন উনি একটা ব্যবস্থা করবেন নিশ্চয়ই।

    --কেটে পড়েছি মানে? আমি তো আপনার সঙ্গেই যাবো!

    --আহা, অমন বলে-কয়ে গেলে উনি চটে যাবেন না! এলোপ্যাথির সঙ্গে কোবরেজি কী মিশ খায়... তাছাড়া, বলেই এদিক ওদিক দেখে উনি থমকালেন।

    --তাছাড়া কী?

    গলা নামিয়ে বললেন --ও খয়ের না কি না কি বয়ে নিয়ে গেলে তোমার বিপদ আছে। ও বস্তু যে বয়ে নিয়ে যায়, সে বাঁচে না বেশিদিন। কিছু একটা অভিচার আছে এঁদের। আর কাউকে বোলো না যেন।

    আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন। অসিত, সূর্যনাথ এদের কাউকেই তো আমি দেখিনি।

    সেদিন ডাক্তারের বাসা থেকে বেরতে বেরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায় প্রায়। এদিকে দৈবজ্ঞমশাই সন্ধে পার করে ফিরেছি জানলে নাকি বেজায় রেগে যাবেন, বাগালটা আমায় বলে দিয়েছিল। রাত্রিবেলা নাকি গ্রামটা পাল্টে যায়, সীমান্তের নিকটবর্তী গ্রাম, এপারে ওপারে আইনি-বেআইনি নানা রাস্তায় চলাচল শুরু হয়ে যায় অন্ধকারের প্রশ্রয়ে। সকালের আলোয় চেনা মানুষগুলির আকার-আকৃতিও বদলে যায় বুঝি।

    রাস্তা দিয়ে ফিরলে নির্ঘাত দেরি হয়ে যাবে বলে একটা শর্টকাট ধরলাম, এখান থেকে দৈবজ্ঞিমশাইয়ের প্রাচীন প্রাসাদ দেখা যায়, কিন্তু যেতে হয় একটা গোচরভূমির মাঝবরাবর। সোজা উত্তর দিকে।

    দিনের বেলা গ্রামের লোক গরু ছাগল নিয়ে আসে চরাতে। কিন্তু এখন এত নির্জন যে মনে হচ্ছিল আকাশে একটা দুটো সাঁঝতারা বাদে গোটা পৃথিবীতে আমিই একমাত্র জেগে রয়েছি।

    দিনের বেলায় রাখালরা সাঁইবাবলার ঝোপের ধারে বিশ্রাম নেয়, মুড়ি খায়, গল্প করে। এখন শুধু ঝিঁঝির ডাক। এক আধটা ঝোপ আলো করে জোনাকির ঝাড়।

    তখনই একটা ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ পেলাম।

    --কে রে! গোপাল, আয় দেখ তো।

    নিজের অজান্তেই হাঁকডাক করে ফেলে পস্তাচ্ছিলাম, কী হবে যদি অনেক লোক থাকে, যদি আমার ভক্কি দেওয়ার চেষ্টাটা ধরে ফেলে। কিছুই হল না, শুধু কারো দৌড়ে পালানোর ধুপধাপ আওয়াজ পেলাম। আর একটা ছাগলছানার ভয়ার্ত ডাক, একটা মৃদু ঘন্টার আওয়াজ। চোখ-সওয়া অন্ধকারে সামনে যাকে দেখলাম, তাঁকে আশা করিনি। প্রায় ভূত দেখার মত অসম্ভব। সলওয়রবালী থরথর করে কাঁপছিল, পড়েই যেত, যদি না ধরে ফেলতাম। কোলে মুন্নি। তারই গলায় ঝুমঝুমি।

    বললাম-- আপনি! এখানে কী করছেন?

    --মুন্নিকে চরাতে দিয়েছিলাম, চরণ ফেরত দিয়ে যায়নি, তাই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম।

    --কিন্তু দৌড়ে পালালো কে?

    মুখে আবার কুলুপ। কী জ্বালা, এরা সোজাসাপটা কথা কয় না কেন?

    মুখে বললাম, হাঁটতে পারবেন?

    মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। ভাবছিলাম মুন্নি যদি ডেকে ওঠে তাহলেই সাড়ে সর্বনাশ। বাড়িশুদ্ধ লোক ড্যাবড্যাব করে দেখবে। কিন্তু মুন্নি মনে হয় ভয় পেয়েছিল। সাড়াশব্দ করছিল না মোটে। নাকি মুখ চেপে ধরে রেখেছিল... কে জানে। বাড়ির আন্দাজ দুশো গজের মধ্যে এসে দেখি লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। লাঠিসোঁটা, টর্চ। পাশে তাকিয়ে দেখি সে অদৃশ্য।

    বাড়ির সামনে পৌঁছতেই সবাই ঘিরে ধরল, কোথায় ছিলে এতক্ষণ? কোন রাস্তা দিয়ে এলে?

    কে বুদ্ধি জোগাল জানি না। বললাম, কেন! এই তো ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে আসছি। কী হয়েছে?

    --শালা, হারামির বাচ্চা চরণটা পালিয়েছে। সঙ্গে তারা। গোয়াল খোলা রেখে দিয়ে...

    তবে কী ওটা চরণ ছিল? কিন্তু জিজ্ঞেস করব কাকে? সে ততক্ষণে ঘুরপথে, খিড়কি দিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে জনতা একটু চুপসে গেল।

    --চরণ কোথায়? একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠল।

    --সে আমার গেল-জন্মের নাঙ না ভাতার যে বলে যাবে! ঝাঁঝিয়ে উঠল। একবার কি চোরা চাহনি ধেয়ে এল আমার দিকে! চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

    --তা তুই কোথা ছিলি এতক্ষণ!

    --গাঙের ধারে গেছিলাম। মুন্নি ডাকছিল, জলে না চলে যায়, তাই আনতে গেছিলাম।

    নদীটা বাড়ির পিছনদিকে। ওই গাঙ বেয়েই নাকি মান্টারা আসে। সারাদিন লোকের চোখ থাকে ওইদিকে। এই অজুহাত কি খাটবে?

    --কিন্তু ঘাটের আশেপাশে তো লোক গেছিল! ওখানে তো কেউ মুন্নিকে দেখেনি!

    --ছিল, ছিল। হিজলতলার দিকটায়।

    মেয়েটা অসম্ভব বুদ্ধিমতী দেখছি। হিজলতলায় একটা বোলতার চাক হয়েছে। লোকে এড়িয়ে চলে। গুঞ্জন থেমে গেল একসময়। তারাও ভিতরবাড়িতে চলে গেল। আজ মুন্নিকে আর গোয়ালে, ছাগলের ঘরে রাখল না।

    আমিও একটা ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। এখানে বিস্তর গণ্ডগোল। এই যে চরণ পালিয়ে গেল, কেউ একটা ডায়েরি করার কথা পর্যন্ত বললো না, যেন পালানোই দস্তুর। এই দেশ ঠিক নিরাপদ বলে মনে হচ্ছে না। আমাকেও তাই করতে হবে। ডাক্তারবাবুকে বলেই পালাব ঠিক করলাম। তবে আজকের সন্ধের ঘটনাটা রেখে-ঢেকে বলতে হবে। মেয়েটা বিপদে পড়তে পারে না হলে। মান্টারা যদি না-ই আসে আমিই কি আর অনন্তকাল এখানে বসে থাকতে পারি?

    দৈবজ্ঞিমশায়ের সঙ্গে যে মুশকো লোকটাকে দেখলাম, সে-ই যে মান্টা সর্দার তা বুঝতে পারিনি। সিন্থেটিক ফুলছাপওয়ালা জামা, পায়ে কেডসের মত জুতো, ... বইতে পড়া ইরানিদের বেশভূষার সঙ্গে কিছুই মেলে না।

    বুঝলাম, যখন দৈবজ্ঞিমশাই ডেকে বললেন, আর কটা দিন হে, তোমার কাঠ এসে গিয়েছে। আর দিন পাঁচেকের মধ্যে জিনিষ তয়ের করে দেবে তারা। তারপর মা জাঙ্গুলীর আশীর্বাদী করে তোমাকে দিয়ে দেব।

    তারা খয়ের জ্বাল দিতে দিতে একবার দেখলো, মুখে রা-টি নেই।

    মনে মনে বললাম, কিন্তু পাখি তো কালই উড়ে যাবে মশাই।

    ডাক্তার আমাকে বলে রেখেছেন, সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ লোকের নজর এড়িয়ে স্টেশন রোডের দিকে এগিয়ে যেতে। ওখানে একটা ওষুধের দোকানের সামনে তাঁর লোক থাকবে। তারপর পাখি ফুরুৎ... সোজা মুকুন্দপুর।

    তখন অবশ্য তারাকে কাজে সাহায্য করতে লাগলাম। লোকদেখানি। যেন যেমন তেমন করে শ্বেত খদির সংগ্রহ করাই আমার জীবনের উদ্দেশ্য। মুশকিল হচ্ছে মান্টারা আসাতে বাড়ির লোকজন মিলে বাড়ির সর্বত্র গুলতানি জুড়েছে। এত লোকের নজর এড়ানো মুশকিল। সদর আর বৈঠকখানা দিয়ে তো অসম্ভব।

    তখনই মনে হল খিড়কির পথের কথা। গাঙের পাশ দিয়ে শুঁড়িপথ গিয়ে পড়েছে সদর রাস্তায়। সন্ধের মুখে সেটা দেখে রাখলে কেমন হয়! নদীর ঘাটের কাছাকাছি এসে দেখি তারা। মুখচোখ থমথম করছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল, এই যে, কোন তালে যে থাকেন, আজকে খয়ের নিয়ে কেটে পড়ুন তো।

    --দৈবজ্ঞিমশাই যে বললেন আরো পাঁচদিন... তারপর আশীর্বাদী করে...

    --আপনার ভালর জন্যই বলছি। কে যে পাঠায়, কেন যে আসেন, বোঝেন না, এদের মধ্যে সাঁট... এই সময়েই একটা চাপা আওয়াজ শোনা গেল। ঝুমঝুমির। তারা উৎকর্ণ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কোনদিক থেকে আওয়াজ আসছে। আন্দাজ করলাম মুন্নিকে আবার চুরি করার চেষ্টা করেছে কেউ। কে? চরণ?

    ঠিক তখনই আমাদের পিছনে, দৈবজ্ঞি বাড়ির সিঁড়ির ঘুলঘুলি জানালাগুলির একটা খুলে গেল। দু’তলা আন্দাজ উচ্চতায়। তার থেকে একটা আবছা-চেনা মুখ বেরিয়ে এসেছে। লোলচর্ম বয়স্ক মানুষের মুখ, ললন্ত জিহ্বা আর ওরকম ভয়ানক চাহনি আমি জীবনে দেখিনি। তার চোখ দুটি ঘুরছে, ভাঙা গলায় কী যেন বলে যাচ্ছে, সে সন্ধ্যা-ভাষার কিছু বুঝি না, শুধু খদিরবনের কোনো দেবীর নামে কিরে কাটছে যেন এক উন্মাদ, রাক্ষসীর সর্পকেশের মত তার সাদা চুলের গুছি হাওয়ায় ফণা দোলাচ্ছে। বাড়ি থেকে ঘাটের পথে বাঁশবন... তার আড়ালে আবডালে আমাদের দেখা যাচ্ছে কি না নিশ্চিত হওয়া গেল না।

    তারা পিছন ফিরে দেখল। তারপর তার ভয়ার্ত চোখজোড়া ফেরালো আমার দিকে, সেই রকমই থমথমে গলায় বলল, সর্বনাশ! পালান। তবে ভুলেও ডাক্তারের খপ্পরে পড়বেন না। ঘাটে নৌকা আছে। ভাঁটার টান শুরু হওয়ার আগে সোজা গাজিডাঙার ঘাটে যাবেন। ওখান থেকে রেল স্টেশন হাঁটা পথ। এখানে রাস্তায় আপনার বিপদ আছে।

    --কিন্তু আমি তো পথ চিনি না! নৌকা বাইতেও জানি না।

    একঝলক কিছু ভাবলো, তারপর আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, চলুন।

    নদীর ঘাটে হাতের সামনে যে ছোট্ট, ছই-ফেলা নৌকাটা ছিল, তাতে পা রাখতেই দুলে উঠল। তারা নৌকা ছেড়ে দিল। সাধারণ দেশী নৌকায় কিভাবে যেন ইঞ্জিন লাগিয়ে ভটভটি করা হয়েছে। বাড়ির দিক থেকে তখন লোকজনের হইহল্লার আওয়াজ আসছে।

    ভটভটি না হলে পালাতে পারতাম না। বাদাবনের পথের সুলুকসন্ধান না জানলেও পালাতে পারতাম না। একটি নদী যে অমন অজস্র নামহীন সুতির খালে বিভক্ত হয়ে যেতে পারে কে জানত! তারা সঙ্গে না থাকলে বাঁচতে পারতাম না।

    অন্ধকার হয়ে গেছিল। আলো নিয়ে লোকলশকর নিয়ে কয়েকটা নৌকা পিছু নিয়েছিল। তারা চট করে একটা খালে ঢুকে পড়ল। তারপর ইঞ্জিন অফ করে দিল। সার্চ পার্টি হাঁকডাক করে একসময় চলে গেল। জন্তুজানোয়ারের ভয় তো ছিলই, কিন্তু মানুষের হিংস্রতার কাছে সে কিচ্ছুটি নয়।

    সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই সোজা গাজিডাঙা ঘাট। শেয়ালদহর ট্রেন যখন ছাড়ল তখনও আমার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। তারপর অনেক পথ পেরিয়ে, আরো অনেক ঘাটের জল খেয়ে এসে থিতু হলাম আরেক নদীমাতৃক দেশে।

    এখানেও দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে আরোগ্যের সন্ধানে। কোচির শাস্তা আর্যবৈদ্যশালার ভাঙা ভাঙা মলয়ালম বলা বঙ্গালি ম্যানেজার। মানুষের রোগ সারানোর বিদ্যা আয়ত্ত্ব হয়নি, তবে তার যতটা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, ততটা গিয়েছি। টুরিস্টের পকেট আর মুড বুঝে পঞ্চকর্মের রশিদ কেটে দিই। সময় সুয়োগ থাকলে কথাকলি শো, মিউজিকাল ইভনিং, ব্যাকওয়াটার ট্রিপের উমেদারি করি। ইচ্ছা আছে যদি একবার গাল্ফটা ঘুরে আসতে পারি তবে নিজে একটা বৈদ্যশালা খুলতে পারি। অবশ্য না হলেও কিছু এসে যায় না। কখনো কখনো স্রেফ বেঁচে থাকাটাই একটা অলৌকিক ব্যপার বলে মনে হয়।

    সে রাতটা আমার চিরদিন মনে থাকবে। সরু খালের দুধারে গরানের ঝোপ আলো করে জোনাকি। নৌকায় দুই অপরিচিত নরনারী। দুজনেরই প্রাণের ভয়। তারা ফিসফিস করে আমাকে বলল সেই দু্ষ্টচক্রের কথা। মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যাদের ব্যবসার মাল। চোখ, যকৃৎ, কিডনি... দেশের নানা প্রান্ত ও সীমান্তে যাদের জাল ছড়ানো, দিনের আলোয় যারা নানান ভেক ধরে থাকে, সাধুসন্ত, গ্রামের আপাত-উচ্চাশাহীন কলেজছুট বদ্যি...দোকানদার, সমাজসেবক ...আরো কত কী

    এদের লক্ষ্যই থাকে একলা, পিছুটানহীন সুস্থ সবল মানুষজন। টুপ করে খসে পড়লে যাদের পৃথিবীতে আর কেউ খুঁজবে না। অসিত, সূর্যনাথ, আমি বিনয়...আমাদের মত আরো কেউ কেউ... সূর্যনাথ বোঝেনি। আমার মত, ডাক্তারের প্রস্তাবে গলে গিয়েছিল। কে জানে ফসল কেটে নিয়ে ক্ষেতের অপব্যবসায়ীরা কোথায়, কোন নরকে তাকে নির্বাসিত করেছে! অসিত বুঝেছিল, পালাতে চেয়েছিল, শেষ রক্ষা হয়নি। হয়ত সেই গাঙেরই কোথাও মাছের দল তখন খুঁটে খাচ্ছিল তার চক্ষুহীন শব।

    ভেবে ভেবে আজ তিরিশ বছর পরেও আমি শিউরে উঠি। আমাকে ঝাঁকি দিয়ে জাগিয়ে দেয় তারা। বলে, পাশ ফিরে শোও, তুমি আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছো।

    কিন্তু যে রাতগুলিতে ঘুম আসে না, সে আরও ভয়ংকর। সে ঘুমায়, আর আমি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করি, কখন রাজকন্যার নাক থেকে এক সূতাশঙ্খ অজগর বেরিয়ে আসবে, যার মুখ অনেকটা মানুষের মত, সাদা চুলের গুছি হাওয়ায় উড়ছে। নাকি তার চর ...

    তারা হয়ত তাকে দেখেনি, আমিও কখনও ভেঙে বলিনি, কিন্তু গাজিডাঙা স্টেশনে শিয়ালদহ লোকালে বসে, ঠিক গাড়ি ছাড়ার সময় তাকে ছুটতে ছুটতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে দেখেছিলাম। কোলে মুন্নি।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments