• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গল্প
    Share
  • থাকে শুধু গল্পকার : দিবাকর ভট্টাচার্য



    “এই তো! এই তো পেয়ে গেছি যা চাইছিলাম। একে এবার নিজের মতো করে বানিয়ে নেবো। আর এটাই হবে আমার জীবনের সেরা কাজ”—শুনে চমকে উঠলো সে। কে বললো এগুলো? কোথা থেকে বললো? এখানে তো রয়েছে কেবল সে আর তার মালিক। কেউ তো কখনো আসে না এখানে। তাহলে?

    ব্যাপারটা একেবারেই সত্যি। এই বাড়িটা মানুষজনের বসতি থেকে অনেক দূরে। একজনই থাকে সেখানে। বাড়িটার নামটা ভারি অদ্ভুত—‘সত্যনিবাস’। আর যে এই বাড়ির বাসিন্দা তার নামটা আরো আশ্চর্যরকমের। নাম তার—‘কথা’।

    এই বহু পুরোনো বাড়িটাতে কতকাল ধরে যে সে এইভাবে একা একা বাস করছে কে জানে। অবশ্য পুরোপুরি একা নয়। তার একটা ছায়া আছে। হ্যাঁ। নিজের ছায়াই একমাত্র সঙ্গী তার। আর ওই ছায়ারও সঙ্গী শুধু সে-ই। কারণ মানুষজন সত্যনিবাসে আসে না কখনো। তাহলে?

    “শোনো তোমায় যা বলছি তাতে তুমি কিছু মনে কোরো না—দুঃখ পেও না। আমিই তো এতকাল ধরে তোমার সঙ্গে ছিলাম। আর কেউ ছিলো না কক্ষনো। কিন্তু তুমি কি কোনো দিন কখনো আমার কথা ভেবেছো? আমার দিকে সেইভাবে নজর দিয়েছো? কোনো দিনও না। কিন্তু সে এসে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমায় দেখেছে। আমায় নিয়ে ভেবেছে। কী সুন্দর করে সে বললো আমায়—‘তুমি তো কথার ছায়া। তাই তোমার নাম দিলাম কাহিনী—তুমি চলো আমার সঙ্গে—আমি তোমায় আমার মতো করে গড়ে নেবো’। ওর নাম কথক। আমি ওর সঙ্গেই চলে যাচ্ছি।”—এই বলে কথার ছায়া কথাকে ছেড়ে কোথায় চলে গেল কে জানে!

    কথা অবাক হয়ে দেখলো তার নির্জন ঘরে তার ছায়াসঙ্গীটি আর নেই। কথা কি এবার ওই সত্যিই পুরোপুরি একা হয়ে গেল?

    “কী আশ্চর্য ব্যাপারটা! এই কথক মানুষটা তো ভারি অদ্ভুত। আমার এই সত্যনিবাসে এল—নিশ্চুপে আমাকে ছায়াকে এত মন দিয়ে দেখলো—তার সঙ্গে আলাপ করলো—আর তাকে নিয়ে চলে গেল— আমার ছায়াকে তার এত ভালো লাগলো যে আমাকে সে লক্ষ্যই করলো না”—নিজের মনেই কথা ভাবছিলো এসব।

    “তা বেশ। সত্যনিবাসে এখন থেকে কথা এমন একা হয়ে থাকবে যে তার ছায়াও পড়বে না কোথাও। আর কেউ কোনোদিনও আসবে না তার কাছে। সে থাকবে এইভাবেই। বরাবর।”—নিজেকেই বললো সে। এরপর থেকে কথা পড়ে রইলো একটা পাথরের মতো। নির্জনে।

    তাহলে কাহিনী কি কথাকে ছেড়ে চলে গেল বরাবরের মতো? আর কখনো কোনোদিন ফিরে এল না কথার কাছে?

    “কী গো চিনতে পারছো না আমায়? আমি কাহিনী। তোমার ছায়া ছিলাম অনেক কাল আগে। তারপর সেই কথকের সঙ্গে চলে গেলাম। ওই-ই তো আমার এই ‘কাহিনী’ নামটা দিয়েছিলো। মনে পড়ছে? আমায় অবশ্য চিনতে না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ আমি তো অনেক বদলে গেছি। আসলে বদলে দিয়েছে ওই কথক”—একটানা বলে একটু থামলো সে।

    তারপর আবার বলতে শুরু করলো—“আমি তো ছিলাম তোমার একটা ছায়া মাত্র। ওই কথকই অনেক দিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে আমায় তার মতো করে নিলো। তারপর আমায় নিয়ে এল সবার সামনে। সে বললো এটা তার সেরা কাজ। সবাই তো অবাক। আমি এরপর কতজনের মনে যে ঠাঁই করে নিলাম তা তুমি ভাবতে পারবে না। এতে ভারি তৃপ্তি হলো আমার। রোজ ভাবি এইভাবে আরো আরো অনেক জনের মনে যেন আমি ঠাঁই পাই। একসময় তোমার একটা সামান্য ছায়া হয়ে ছিলাম একটা জনমানবহীন ঘুপচি ঘরে, সেইখান থেকে এত লোকের কাহিনী হয়ে বাসা বেঁধে ফেলতে পেরেছি—সবই ওই কথকের জন্যে। কিন্তু তোমার তো কোনো বদল হলো না দেখছি। একইভাবে পড়ে আছো দেখছি এতদিন ধরে…”

    কথা পাথরের মতো এক কোণে পড়ে থেকে সব শুনলো নিশ্চুপে। তার কাছে কি কোনোই উত্তর ছিলো না এসবের?

    “আমি কথা। অবশ্যই কারো কোনো কথা। কোনো অজ্ঞাতজনের। আমি যদি বদলে যাই তাহলে সেই অজ্ঞাতজনের মুখের দিকে আর তাকাতে পারবো না কোনো দিন। তাই আমি অজ্ঞাতজনের জন্য চিরকাল একই থাকবো। আমার ছায়াটিকে নিয়ে যাও—তাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো গড়ে নাও—ঝলমলে কাহিনীর বাহিনী সবার সামনে নিয়ে এসো—সবাই সেই কাহিনীকে নিজের মনে সাজিয়ে রাখুক—লোকে ধন্য ধন্য বলুক সেই কথক কাহিনীকে—কিন্তু এসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। এই এইভাবেই পড়ে থাকতে চাই। পাথরের মতো। তারপর একদিন এইভাবেই মাটিতে মিশে যাবো। এই সত্যনিবাসে।”—এই উত্তরটা কথা উচ্চারণ করে বলতে পারেনি কাহিনীকে। বলেছিলো নিঃশব্দে। নিজের মনে। নিজেকেই।

    আর কাহিনী কথার এই নীরবতায় ভারি খুশি হয়ে বললো—“তাহলে এখন আসি। আবার সময় পেলে আসবো। তোমার খোঁজখবর নিয়ে যাবো। ভালো থেকে গো।”

    কাহিনী কি সত্যিই চেয়েছিলো কথা ভালো থাকুক?

    “কথা কেমন আছে? কীভাবে আছে? এটা জানা আমার খুব প্রয়োজন। ওর কি এখনো কোনো ছায়া পড়ে? যদি ওর ছায়া থাকে তাহলে তো খুব বিপদ। তাহলে তো আবার কেউ এসে দেখতে পাবে সেই ছায়াকে। আর সেই লোক যদি এই কথকের মতো হয় তাহলে তো সাংঘাতিক সর্বনাশ! তাহলে তো আরেকটা নতুন কাহিনী তৈরি হবে কথার ওই নতুন ছায়া থেকে! এ তো আমি ভাবতেই পারছি না। তার চেয়ে বরং এখনই তার নতুন ছায়াকে সঙ্গী করে, তাহলে ওকে চিরকালের মতো শেষ করে দিয়ে আসবো আমি। যাতে ওই কথার ছায়া থেকে আর নতুন কাহিনী তৈরি হয়ে আমার সামনে না আসে।”—নিজের মনেই বলেছিলো কাহিনী। হঠাৎ একদিন সকালে তার মনে হয়েছিলো এসব।

    আর তার পরেই কাহিনী এসেছিলো কথার কাছে—সেই সত্যনিবাসে।

    সেখানে এসে কথার অবস্থা দেখে কাহিনী খুশিতে ভরপুর হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো। কিন্তু তা কতক্ষণ?

    “এই তো! এই তো পেয়ে গেছি যা চাইছিলাম। একে এবার নিজের মতো করে গড়ে নেবো। আর সেটাই হবে আমার সেরা কাজ।”—শুনে চমকে উঠলো কাহিনী! ‘কে বললো? কোথা থেকে বললো? এতো সে শুনেছিলো বহুকাল আগে। কথকের মুখ থেকে। তাহলে আবার কি কেউ তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে…’ একটা সোনালী আত্মগর্বে ভরে গেল তার মনটা। উপর দিকে তাকিয়ে কাহিনী দেখলো দূর আকাশের কোলে টলটলে পূর্ণিমার চাঁদ। আর নিচের ঘাসজমিতে পড়ে আছে তারই ঘন নীল রঙের একটি ছায়া।

    “আমি গল্পকার। গল্প তৈরি করি। আমার বোধ আর অভিজ্ঞতা দিয়ে।”—খুব শান্তকন্ঠে বললো কেউ।

    কাহিনী খুব উত্তেজিত হয়ে বললো— “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই কাহিনী—এসো, আমার কাছে এসো—আমাকে তোমার মতো করে তৈরি করে নাও। তোমার ওই বোধ আর অভিজ্ঞতা দিয়ে।”

    তাহলে কি এই গল্পকার সেই কাহিনীকে নিয়ে চলে গেল আবার নতুনভাবে তাকে সবার সামনে নিয়ে আসবে বলে?

    “আমার তোমার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার ছায়াকে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি।” গল্পকারের উত্তরে স্তম্ভিত হয়ে গেলো কাহিনী। কোনোক্রমে সে বলতে পারলো—“কেন? আমিই তো বরাবরের আসল কাহিনী।”

    “তুমি কোনো আসল কিছু নও—কোনো কাহিনীই বরাবরের জন্য আসল হয়ে থাকে না। বহুকাল আগে কোনো একজনের জীবনের কোনো কথার ছায়া নিয়ে এক কথক তার নিজের মতো করে একটি কাহিনী বানিয়েছিলো। সেই কাহিনী অনেককে মুগ্ধ করেছিলো। কিন্তু সে অনেককাল আগের ব্যাপার।”—এই বলে গল্পকার একটু থামলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো—“কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমি দেখতে পাচ্ছি সেই কাহিনীর একটি চমৎকার ছায়া। ওই ছায়াকেই আমার চাই। ওই ছায়া থেকে আমি তৈরি করবো আমার পরবর্তী গল্প।”

    কাহিনী কোনোক্রমে বলতে পারলো—“সেকি!”

    গল্পকার উত্তর দিলো—“তোমার এই আকারের একটা ছায়া পড়বে—সেটাই তো স্বাভাবিক। এতকাল সেটা কারো চোখে পড়েনি। কিন্তু আমি তো গল্পকার। আমার চোখে পড়লো। তাই আমি এই ছায়াকে নিয়েই যাবো। এই ছায়াটি থেকে একটি অন্যতম গল্প তৈরি হবে আমার।”

    তাহলে এই কাহিনীর কী হলো এর পর?

    “না! না! এ হতে পারে না! আমি আসল কাহিনী। আমাকে এভাবে সরিয়ে রেখে আমার ছায়া নিয়ে কোনো গল্প তৈরি হতে পারে না—আর হলেও কে শুনবে তোমার সেই গল্প?” মরিয়া হয়ে বলে উঠলো সেই কাহিনী।

    “আছে—একজন আছে—তার নাম সনাতন—কেউ না শুনুক সে শুনবে নিশ্চয়ই—আর আমি তো তার জন্যেই গল্প তৈরি করি বরাবর।”—খুব শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো গল্পকার।

    এরপর?

    এরপর থাকে শুধু গল্পকার। আর তার সনাতন শ্রোতাটি।

    কোনো একদিন এক অজ্ঞাতজনের কিছু কথার ছায়া নিয়ে একটি কাহিনী রচিত হয়েছিলো। এর বহুকাল পরে সেই কাহিনীর ছায়ায় তৈরি হলো আরেকটি গল্প। সেই গল্পের ছায়ায় একদিন সৃষ্টি হবে আরেক বৃত্তান্ত।

    এইভাবে পৃথিবীর প্রতিটি কাহিনীই যথাসময়ে সরে যায়। কিন্তু এর আগেই তার ছায়া পড়ে।

    আর সেই ছায়ার সামনে অলক্ষ্যে এসে দাঁড়ায় এক অনাদিপুরুষ।

    তিনি গল্পকার।

    কারণ তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে সেই সনাতন শ্রোতাটি।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments