প্রিতম মুখোপাধ্যায় বিখ্যাত না হলেও অবশ্য ততোটা অপরিচিত নন, তাঁর দু-চারটে গল্প নামী পত্রিকার লেখকসূচিতে কখনও কখনও দেখা গেছে। কিন্তু তাঁর গল্প নিয়ে আলোচনা চোখে পড়েনি কোথাও। কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সৌজন্যে প্রিতমের ‘সাদা রক্ত’ নামে একটি গল্প-সংকলন হাতে এসেছিল। পড়ে মনে হয়েছিল, গল্পগুলি যেন একযোগে এই আধুনিক সময়ের রাজনীতি, বাণিজ্যিক সংস্কৃতি, এবং অন্ধ প্রযুক্তির বিরুদ্ধে অসহায় মানুষের প্রতিবাদের দলিল। তাঁর আঙ্গিকেও বিশিষ্টতা রয়েছে, রয়েছে নিজস্বতার স্বাক্ষর। শ্লেষ-বিদ্রূপে শানিত, তরলায়িত তাঁর গদ্যভাষা। আমার এই পর্যবেক্ষণ সংক্ষেপে জানিয়েছিলাম বন্ধুটিকে। তো তিনি এর বেশ কিছুদিন পরে আমাকে অনুরোধ করে বসলেন বইটির একটি রিভিউ লেখার জন্য। সামান্য বিব্রত বোধ করলাম। পড়তে পড়তে নোট নিয়ে রাখলে রিভিউ লেখা সহজ হয়। সেসব তো করিনি। এখন আবার কেঁচে গণ্ডূষ করতে হবে! বয়স হয়েছে, দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়। নানা কারণে প্রায়ই অবসাদ আচ্ছন্ন করে রাখে মনকে। অতএব কালহরণ করতে করতে নির্লজ্জতার শেষ সীমায় পৌঁছে বইটি নিয়ে বসতেই হল দ্বিতীয়বার।
এই দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে বেশ একটা অভিনব উপলব্ধি হল। কিছু গল্পের প্রথম বাক্যটা পড়তে না পড়তেই পুরোটা ছবির মতো ভেসে উঠল মনে। আর কিছু গল্পে বহুদূর এগিয়েও পূর্বপাঠের স্মৃতি অধরাই থেকে গেল। ফলে আমার কাজ এক লাফে অনেকটাই এগিয়ে গেল। প্রথম ধরনের গল্পগুলি পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ রেখে যাওয়ার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, দ্বিতীয় ধরনের গল্পগুলির বোধ হয় সেই যোগ্যতা নেই। আমি ঠিক করলাম প্রথম ধরনগুলি নিয়ে বিশদ হব, দ্বিতীয়গুলি কেন আমার মনে দাগ কাটতে পারেনি তা সামান্য কথায় ব্যাখ্যা করব।
মোট সতেরোটি গল্প। দশটি প্রথম ধরনেরঃ
১) সাদা রক্তঃ
কলকাতার সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে অনন্ত যাতায়াত হাসনাবাদ-মজিলপুর-ধপধপি-বিরাটি থেকে লোকাল ট্রেন ধরে আসা খেটে-খাওয়া রুগিদের। সব রুগিদের একটাই নাম ধরে নিতে পারেন – বিমলা। তার রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাচ্ছে। রক্তের পরীক্ষা যতো হচ্ছে, ততোই কমে যাচ্ছে হিমো। কমতে কমতে শূন্য দশমিক এক। তবুও বিমলার আসাযাওয়ার বিরাম নেই। তার অসুস্থতা চলে গেছে কিন্তু রোগ আছে। এইভাবেই বিমলারা মেডিক্যাল সায়েন্সের ‘বারোটা পাঁচ’ বাজিয়ে ছাড়ছে। তখনই ঠিকাদারের করা হাসপাতালের নতুন বিল্ডিঙয়ে ফাটল। বিল্ডিঙয়ের শরীরেও হিমো কম। মাটি অর্থাৎ সিমেন্টই সেই হিমো। তার ভাগ চারে এক। তার চিকিৎসা চলছে শাল খুঁটির ঠেকনা লাগিয়ে। তার মধ্যেই হাসপাতালের কর্মচারীদের মিছিল চলেছে ‘সংক্রামক ভাতা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে। হিমো-হীন বিল্ডিং ভেঙ্গে পড়ে কিন্তু তার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে হিমো-হীন সাদা রক্তের অমর বিমলারা শেষ ট্রেন ছাড়ার আগে ঠিক পৌঁছে যায় স্টেশনে।
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসুখটিকে তীব্র শ্লেষে বিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের প্রাণশক্তির জয়গান সরস সূক্ষ্মতায় তুলে ধরেছেন লেখক। সরকারি হাসপাতালের আউটডোরের কর্মকাণ্ড যে-অনুপুঙ্খতায় বর্ণিত হয়েছে সেটিও এই গল্পের এক সম্পদ।
২) সুদর্শন চক্রঃ
প্রিতমের গল্পে ওঠাপড়া নেই – একই গতিতে তিরতির করে বয়ে চলে নিয়তির দিকে যেখানে চাপ চাপ অন্ধকার। যাকে বলি আলো, সে কেবল গল্পের পাশ দিয়ে চলে যায় দ্রুত, যেন অন্ধকারের গায়ে কোনো দাগ না পড়ে। শ্লীলতাহানির শিকার দোলা প্রতিটি পুরুষের দেখতে পায় তার কালো নির্মম হাত, যেটা এগিয়ে আসছে তার শরীরের দিকে। পুরুষ পালটে পালটে যায়, সেই হানিকারক হাত বদলায় না। কোনো বাসুদেব নেই তাকে রক্ষা করার। বাসুদেব প্রকৃতই রক্ষাকারী, না কি তিনিও এক শ্লীলতাঘাতক? -- এই প্রশ্নে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। আর তখনই সে মরিয়া হয়ে লাথি ছোড়ার সাহস অর্জন করে। ‘সাদা মার্বেলের মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মি কৃষ্ণ।’ মনস্তত্ত্বের নিপুণ বিশ্লেষণের সঙ্গে এক ঝলক শ্লেষও ছুড়ে দেন লেখক গল্পের শেষে।
৩) শ্রেণিশত্রুঃ
শ্রেণিসংগ্রামের বাইনারি মেথড। জিরো অথবা ওয়ান। মানুষের পরিচয় মুছে হয় তুমি মার্ডার করবে, নয় মার্ডার হবে। এর বাইরে তৃতীয় দল বলে কিছু নেই। উন্নত প্রযুক্তির এই সংস্থা সরকার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, উগ্রনৈতিক – সব দলকেই পরিষেবা দেয়। পাঠক, আপনিও যোগ দিতে পারেন এই সংস্থায়। মার্ডার না-কি ডেথ, কোন ডিপার্টমেন্টে আপনার পোস্টিং হবে তা জানার অপেক্ষায় মার্বেলের মূর্তি হয়ে অপেক্ষা করতে থাকুন। তাড়া নেই, মাসের শেষে লোভনীয় পে-প্যাকেট পেয়ে যাবেন ঠিকই।
ভয়ংকর বিষয়কেও নির্মোহ ও লঘু দৃষ্টিতে দেখার মধ্যে নিহিত থাকে এক ধরনের পরিহাসপ্রিয়তা। একটি স্রোতহীন গল্পেও তখন তরতর করে এগিয়ে চলার অনুভূতি জাগে। এই গল্পে সেটাও এক পাওনা।
৪) বার্লিন ওয়ালঃ
এই সংকলনের বিষয়-চ্যুত না হয়েও ভাষার তরলতা অতিক্রম করে এটি হয়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রমী এবং অত্যুজ্জ্বল গল্প। নিখাদ প্রেমের মাঝেও দলীয় আনুগত্য কীভাবে দেওয়াল তুলে দেয়, অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করে, তারই এক বাস্তবোচিত আখ্যান। ‘বলটা ধাপ খেতে খেতে এক দেওয়ালে লেগে অন্য দেওয়ালের দিকে চলেছে লাফ দিয়ে দিয়ে। থামছে না। দিন থেকে রাত, রাত থেকে পরের ভোর পর্যন্ত ধাপিয়ে ঘুরে বেড়ানো বলটার অস্তিত্ব এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারত না মৃত্তিকা।' ‘একটার পর একটা শাদা দেওয়ালের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে অভি।’ দেওয়ালের অন্য দিকে ক্রাচে ভর দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সে।
এত সুন্দর একটা গল্পে তথ্যের একটা ত্রুটি বিষফোঁড়ার মতো টনটন করতে থাকে মনে। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল যাওয়ার পথে ব্যান্ডেলের পূর্ববর্তী স্টেশন আদিসপ্তগ্রাম বলে একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে গল্পে। আসলে সেই স্টেশন হল হুগলি। আদিসপ্তগ্রাম ব্যান্ডেলের পরবর্তী স্টেশন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ‘বিভাব’ পত্রিকায় গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হওয়ার সাত বছরের মধ্যেও কেউ লেখককে এই ত্রুটির কথা জানাননি! আবার, রক্তের আগে ‘সাদা’ হয়, দেওয়ালের আগে ‘শাদা’ হবে কেন?
অন্য একটি গল্পেও (টো টো কোম্পানির জয়যাত্রা…) ‘বমালসমেত’-এর ব্যবহার চূড়ান্ত অনবধানতার নিদর্শন।
৫) বদনামঃ
একটি রাজনৈতিক রূপক। এই রূপকটিই বাস্তব রূপে দেখা যাচ্ছে বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির কল্যাণে। গল্পের এফ এফ ডি আর রূপক নেই। প্রতিটি মানুষের প্রাইভেসিতে অহরহ সিঁধ কেটে চলেছে কর্পোরেট এবং রাষ্ট্রের প্রভুরা। গল্প হিসাবেও অতি উপভোগ্য হবে পাঠকের কাছে।
৬) নায়িকার প্রবেশ ও প্রস্থানঃ
থিয়েটারের নিষ্ঠাবান অভিনেত্রী থেকে টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় নায়িকা। স্টারডমের মাদকতায় আচ্ছন্ন থেকেও পূর্বজীবনের ঘনিষ্ঠ, আদ্যন্ত মানবিক জয়িতার জন্য, আদর্শবান পরিচালক বদ্রু সান্যালের জন্য তার হৃদয়ে গোপনে রক্তক্ষরণ হয়। ব্যক্তিজীবনে অনিশ্চয়তার মেঘ নিয়ে বিবেকদংশনে পীড়িত নায়িকা ছুটে চলে তার নিরুপায় আশ্রয় ‘রুপালি জগতের প্রমত্ত উন্মাদনা’র দিকে।
নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে কথকের চালে এই গল্পের নির্মাণ গল্পের বিষয়ের সঙ্গে মানানসই হয়েছে বলে এই পাঠকের মনে হয়নি। লঘু চাল নায়িকার হৃদয়ের একান্ত অসহায়তাকে স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে।
৭) দি ভালচারস আর ফ্লায়িংঃ
এক জমি-শকুনের পেলব মানসিক সন্ত্রাসের কৌশল আদ্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে বয়ন করেছেন প্রিতম। অত্যন্ত মসৃণ গতিতে জমি-বাড়ি দখল সফল করার প্রাকমুহূর্তে অসহায় রোহিত তার মৃত্যুপথযাত্রী মায়ের মুখ থেকে শুনতে পায় ‘ডানা ঝাপটানোর শব্দ…কর্কশ ক্যাঁকক্যাঁক ডাক’ যেন ‘আকাশ কাঁপিয়ে বাতাসের প্রবল শনশন ভেদ করে উড়ে আসছে হাজার হাজার মাংসখেকো প্রাণী।'
৮) অন্যরকম প্লটঃ
সিনেমা প্রোডাকশনের একটা দল, শুটিং-এর লোকেশন খুঁজতে বেরিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমতম প্রান্তের প্রত্যন্ত এলাকায়। সাধারণ চারিত্র্যে দলটি হুল্লোড়বাজ, পানীয়প্রিয়। রাস্তায় এক সামান্য দুর্ঘটনায় গাড়ি বিকল। ঘটনাচক্রে কাছেই একটা পাবলিক হেলথের সরকারি বাংলো। তার কেয়ারটেকার পশুপতি তাদের খাওয়ানোর দায়িত্ব নেয়। নিশ্চিন্ত হয়ে দলটি আশেপাশেই লোকেশন খুঁজতে থাকে। এমন সময়েই ঘটনা বাঁক নয় সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। পশুপতির রুগ্ন, পূর্ণগর্ভা স্ত্রীর প্রসববেদনা ওঠে। দলটি নিজেদের অজান্তেই আপন উদ্দেশ্য ভুলে সামিল হয়ে যায় এক নিঃস্বার্থ ‘রিয়েল লাইফ প্রোডাকশন’-এর কাজে। বিকল গাড়িতে পোয়াতিকে তুলে সবাই মিলে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে সাত মাইল দূরের ‘অগামারা’ গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছয়। মানবপুত্র জন্মগ্রহণ করে। তার কান্না শুনতে পেয়ে ‘যেন জাতীয় সংগীত বেজে উঠেছে তেমনই সতর্ক ভাবে ওরা একসঙ্গে উঠে’ দাঁড়ায়।
এগল্পে আর আলো ফেলে নিছক অন্ধকার দর্শন নয়, স্থূল যাপনকে মানবিকতার আলোয় ফিরিয়েছেন লেখক।
৯) সাইবেরিয়ার মাংসঃ
কেবল মাত্র একটি চরিত্রও কোনো গল্পের বিষয়বস্তু হতে পারে। বাংলা সাহিত্যে এর অজস্র নমুনা পাওয়া যাবে। এই সংকলনের অধিকাংশ গল্পে বিষয়ে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, চরিত্র-চিত্রণের তেমন প্রাধান্য নেই। কিন্তু এই গল্পে ‘স্টান্টবাজ’ ক্যাপ্টেনের চরিত্র অনবদ্য ভঙ্গিতে এঁকেছেন লেখক। মনোহরণ ব্যক্তিত্বের আড়ালে নির্মম, নিষ্ঠুর, সুযোগসন্ধানী এবং আত্মম্ভরি এই প্রৌঢ়, শিকার করা সাইবেরীয় হাঁসের মাংস বলে পোষা খরগোশের মাংস খাওয়ান তাঁর অতিথিদের। তাঁর প্রবঞ্চনা কোমলমতি কিশোরীর চোখে ধরা পড়ে। বিবমিষায় আচ্ছন্ন সুকুমারীর মানসিকতা বিপর্যস্ত হয়। গল্পটি শেষও হয় চমৎকার কৌতুকী শ্লেষে। অতিথিদের ফেরার সময় দেখা যায় প্রতিশোধ নিতে কিশোরী স্টান্টবাজের ‘স্টান্ট’টি অর্থাৎ তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী রূপালি হাতলের সুদৃশ্য লাঠিটি হাতিয়ে নিয়ে এসেছে তাঁর অজান্তে।
১০) ব্যালকনি অথবা পশমিনার গল্পঃ
স্বল্প পরিসরে প্রোমোটারি মাফিয়াদের বিরুদ্ধে এক নারীর হৃদয়-সংবেদী প্রতিবাদের গল্প। প্রতিবাদের দার্ঢ্যে আস্থা রেখে দুটি সপ্রেম হৃদয় যখন মিলন-উন্মুখ, তখনই সন্ত্রাস-কৌশলের কর্কশ অভিঘাত ভেসে আসে। তারা সংশয়ের আবর্তে পড়ল কি-না, তার সূত্র না রেখেই গল্পের সমাপ্তি টেনে দেন লেখক।
উপর্যুক্ত দশটি শিল্পোত্তীর্ণ গল্পের মধ্যে সাদা রক্ত, বার্লিন ওয়াল, সাইবেরিয়ার মাংস, শ্রেণিশত্রু, সুদর্শন চক্র এবং অন্যরকম প্লট বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়ার সামর্থ্য রাখে বলে আমার ধারণা।
তবে কোনো গল্পকারের সব সৃষ্টিই সার্থক তথা শিল্পোত্তীর্ণ হয় না। এই সংকলনের গল্পগুলির ক্ষেত্রেও তা সত্য। যে-কারণে বাকি গল্পগুলি মনে রেখাপাত করতে পারল না, লেখকের গদ্য-ভাষার চলনেই তা নিহিত আছে বলে আমার মনে হয়। প্রিতম মুখোপাধ্যায়ের গদ্যের বিশিষ্ট যে-চলন তাতে আদ্যন্ত কথ্য ভাষা, সেই সঙ্গে তথাকথিত শিক্ষিত শ্রেণির মুখনিঃসৃত অহরহ ইংরেজি শব্দ ও শব্দবন্ধ, সাধারণ্যে প্রচলিত অশিষ্ট শব্দ বা স্ল্যাং পরিবাহিত হয়ে মুক্তকচ্ছে ধাবিত হয় গন্তব্যের দিকে। হয়তো তা শ্লেষ প্রকাশের উপযুক্ত মাধ্যম বলে লেখক মনে করেন। মুক্ত গদ্যের ক্ষেত্রে তা অবশ্যই উপযুক্ত। কিন্তু ছোট গল্পের ক্ষেত্রে বিষয়ের বাছবিচার না করে তার প্রয়োগ গল্পের নির্যাসকে তরল করে দেয়। যে-সব গল্পে ভাষার অতিরিক্ত তরলায়িত হওয়ার প্রবণতায় বাঁধ দিতে পেরেছেন তিনি, সেই গল্পগুলি সার্থক হয়ে উঠেছে। অবশিষ্ট গল্পগুলির ক্ষেত্রে সেই সংযমের অভাব ঘটেছে। ফলে পাঠক-মনে দাগ কাটতে সেগুলি ব্যর্থ হয়েছে। ভাষা তরলায়িত হতে হতে সেখানে ছ্যাবলামিতে পরিণত হয়েছে। কখনও কখনও তা অনাবশ্যক দীর্ঘ হয়ে পাঠকের মনঃসংযোগ ক্ষুণ্ণ করেছে, কখনও আবার অতি-ক্লিশে শব্দবন্ধ তার বিরক্তি উৎপাদন করেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের গদ্যশৈলীতে হয়তো প্রভাবিত হয়েছেন লেখক। কিন্তু ‘ফ্যাতাড়ু’ বা ‘দণ্ডবায়স’ শব্দের ব্যঞ্জনার উচ্চতা তাঁর লক্ষ্য যদি হয়ও, তা ‘লাথখোর’ শব্দ পর্যন্ত গিয়েই আটকে পড়েছে। এই দুই ব্যঞ্জনার ব্যবধান ঠিক কতটা, সেটা লেখককেই মেপে নিতে হবে।
এই আলোচকের বক্তব্যে কতটা সারবত্তা আছে সেটা স্বয়ং লেখক পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি যাচাই করতে প্রবৃত্ত হন, তবেই এই লেখা সার্থক।
দেবাশিস সাহার প্রচ্ছদ অতুলনীয়। ‘তবুও প্রয়াস’-এর গ্রন্থ-নির্মাণও সামগ্রিকভাবে প্রশংসার্হ।