• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯২ | অক্টোবর ২০২৩ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • "পূর্ববঙ্গের এক মৈথিল গৃহবধুর আত্মকথা"— কিছুটা স্মৃতি কিছুটা ইতিহাস : পাপিয়া ভট্টাচার্য

    পূর্ববঙ্গের এক মৈথিল-গৃহবধূর আত্মকথা — অনুপমা ঝা; সুপ্রকাশ, কলকাতা; প্রচ্ছদ ও অলংকরণ— সুব্রত মাজী; প্রথম প্রকাশ- অক্টোবর ২০২২, ISBN: 978-81-955495-5-9

    "বাবা রজনীকান্ত ঝা, মা হরিপ্রিয়া দেবী, আমার নাম অনুপমা ঝা"। এই সহজ সরল একান্তই ছাপোষা একটি বাক্যবন্ধ দিয়ে শুরু হল পথ চলা। জীবনসায়াহ্নে এসে যখন সামনের দিকের পথটা থেমে যায় তখন অতীতটা বড় বেশি ছায়া ফেলে। অনুপমা দেবীও বৃদ্ধ বয়সে নিঃসঙ্গতা কাটাতে হাতে তুলে নিলেন ডাইরি আর পেন। আঁকিবুকি কাটলেন নিজের খেয়ালে। চেতনে এবং অবচেতনে কাটা সেই আঁকিবুকি একদিন একটি সুন্দর অবয়ব ধারণ করলো। যার নাম "পূর্ব বঙ্গের এক মৈথিল গৃহবধূর আত্মকথা"।

    অনুপমা দেবীর জন্ম ১৯৩৫ সালে বাংলাদেশের রংপুরের পাঙ্গা গ্রামের এক জোতদার পরিবারে। বাবা ছিলেন ডাক্তার। অনুপমা দেবীর বর্ণনায় পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর পরিবারের বর্ধিষ্ণুতার এবং বনেদিয়ানার। পাশাপাশি উঠে আসে গরীব প্রজাদের প্রতি সহমর্মিতার কথাও। কোনো উৎসব, অনুষ্ঠানে গরীব মানুষদের খালি হাতে ফেরাতো না যে পরিবার, সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যই যে অত্যন্ত উদার হবেন সে কথা বলাই বাহুল্য। আশ্রিতদের জন্যও ছিল অবারিত দ্বার।

    ভারতবর্ষের রাজনৈতিক আকাশে তখন বাঁটোয়ারার মেঘ। আজন্মলালিত শিকড় ছিঁড়ে নতুন শিকড়ের সন্ধানে, একটা নিরাপদ আস্তানার খোঁজে পথে পথে দেশান্তরী হওয়া মানুষের ঢল। সম্বল শুধুই ধর্মীয় পরিচিতি। অনুপমা দেবী তখন নিতান্তই বালিকা। মাত্র তেরো। সেই সময় রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় অস্থিরতা বোঝার বয়স তার নয়। তবুও পরিস্থিতির চাপে তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়। নিরাপত্তার কারণে বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে আশ্রয় নিতে হয় এপার বাংলায় কোচবিহারের বানেশ্বরে কাকার বাড়িতে। তেরো বছর বয়সেই তাঁর বিয়ে হয় দিনাজপুরের দুর্গাপুর গ্রাম নিবাসী সুধীর চন্দ্র ঝার সঙ্গে। নিজের বিয়ের প্রসঙ্গে অনুপমা দেবী বলছেন, "আমি বিয়ে নিয়ে কিছুই বুঝি নাই। শাড়ী, গয়না, আত্মীয়-স্বজন দেখে আনন্দিত। জানতাম না নিজের সবাইকে ছেড়ে অন্যখানে যেতে হবে। বড় বৌদির কোলে বসে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় বিয়ে।" (পৃ-১৪)

    সময় বয়ে যায়, বার্ধক্য পিছু নেয়। বর্তমানটা অতীত হয়ে একদিন সামনে এসে দাঁড়ায়। তখন দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা। কিন্তু ফুরিয়ে যাওয়া আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পিছনে ফেলে আসা জীবন। আর সেই ফেলে আসা জীব্নের প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মুহূর্ত ভিড় করে আসে চোখের সামনে। এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে আমায়। অনুপমা দেবীও তাই বারবার ফিরে গেছেন তাঁর ছেলেবেলায়। লিপিবদ্ধ করেছেন বিবাহ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কে। এখানে নির্দিষ্ট কোন সময়সারণি ধরে তিনি হাঁটেননি। গল্প বা উপন্যাসের মতো কোন কাহিনী বিন্যাসও করেননি, শুধুমাত্র টুকরো টুকরো স্মৃতির মধ্যে দিয়ে নিজের আবেগটাকেই ধরতে চেয়েছেন তিনি।

    আত্মকথাটি কতকগুলি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রতিটি বিভাগেরই আলাদা আলাদা নামকরণ করা হয়েছে। নামগুলি মিশে আছে জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তের সঙ্গে, যেমন আনন্দ-উৎসব, ছেলেবেলা, ঘরের কাজ, স্কুল জীবন, শ্বশুরবাড়ি, শেষ জীবন ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি বিভাগেই বর্ণিত চরিত্র এবং ছোট ছোট জনপদগুলির নাম যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাতে লেখিকার স্মৃতিশক্তি প্রশংসার দাবি রাখে। ছোট ছোট ঘটনাগুলিকেও নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি জায়গায় যেখানে বৌদি মৃত্যুশয্যায় হসপিটালে ভর্তি, সেখানে হসপিটাল ও বাড়ি এই দুই পরিবেশের সেই সময়কার পরিস্থিতির একটি সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন এবং শেষে বলছেন, "আমি ওদের নিয়ে গেলাম। দেখি দাদার প্রায় জ্ঞান নেই। দাদাকে কয়েকজন বন্ধু ধরে আছে। রামদা বৌদির কাছে বসে। পাপড়ি, অসিকে দাদার কাছে রেখে বৌদিকে দেখে এলাম। মনে হল ঘুমায়ে আছে। আমার প্রথম মৃত্যু দেখা।" (পৃ-৬৭)

    এ তো গেল বইটির একটি দিকের কথা। আরেকটি দিকে অনুপমা দেবী শুধু মাত্র বইটির লেখিকা নন, একটি বিশেষ সমাজের প্রতিনিধিও বটে। মৈথিল সমাজ। নতুন প্রজন্ম এই সমাজ সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নয়। লেখিকা যখন জন্মেছেন বা বড় হয়েছেন তখনও পর্যন্ত সাধারণ বাঙালিএবং মৈথিল বাঙালি সমাজের মধ্যে আচরণগত ও প্রথাগত একটা ফারাক লক্ষ করা যেত। কিন্তু দিনে দিনে সেই ফারাক বা বৈপরীত্য কোথাও একটা মিলেমিশে একাকার হয়ে একক বাঙালিয়ানায় পর্যবসিত হয়েছে। এ বিষয়ে বইটির শুরুতেই বিশিষ্ট কবি এবং অনুপমা দেবীর সুপুত্র উৎপল ঝার লেখা 'প্রাক কথন' পাঠককে এই সমাজ সম্পর্কে জানতে এবং একটি সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করবে। প্রথমেই তিনি বলছেন, "আমাদের পূর্বপুরুষেরা, মায়ের বা বাবার দিকের 'ঝা' 'মিশ্র' পদবীধারীরা ঠিক কখন পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন তার হদিশ পাওয়া যায় না। তবে তাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন ছিলেন এবং বহু জমিজমার মালিক। অন্তত তিনশো-সাড়ে তিনশো বছর আগে তাঁরা এখানে এসেছিলেন বলে অনুমান।" (পৃ-৬) বইটির শেষে মৈথিল সমাজে প্রচলিত ধর্মাচরণ, লোকাচার, বার-ব্রত পালনের নিয়মাবলীর কথা লেখা হয়েছে। এই সমস্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এখানে উল্লিখিত পৈতার গান এবং বিবাহের গান বইটিতে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদের মধ্যেও বিয়ের গানের প্রচলন দেখা যায় কিন্তু পৈতের গানের সঙ্গে সাধারণ বাঙালি খুব একটা পরিচিত নয়।

    পৈতার গান… ….. ..

    বাজেরে মঙ্গল বাদ্য বারের (বাইরের) বাড়িতে
    নাচিছে সুন্দর যাদুয়া ভিতর বাড়িতে।
    নাচতে নাচতে যায় যাদুয়া, দয়ার পিতার কাছে
    সুন্দর দেখিয়া পিতা টানিয়া নিল কোলে
    কোলে বসিয়া যাদুয়া গলায় পৈতা খোঁজে
    দিব দিব যাদুয়ার পৈতা, যেমন সাজে।

    বইটির চরিত্রগত সারল্য প্রচ্ছদেও যথার্থ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী সুব্রত মাজী। বইটির নামকরণে 'আত্মকথা' শব্দটির পাশাপাশি আরেকটি শব্দের উল্লেখ আছে সেটি হলো 'মৈথিল'। তাই শুধু মাত্র এটিকে আত্মকথা বলে মনে করলে ভুল করা হবে। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা গোটা সমাজ আর কিছুটা প্রাকৃতিক ভূখণ্ড। তাই বলা যেতেই পারে একটি ভৌগোলিক মানচিত্র থেকে এসে আরেকটি ভৌগোলিক মানচিত্রে মিশে যাওয়ার নাম "পূর্ববঙ্গের এক মৈথিল গৃহবধূর আত্মকথা"। বইটির সাহিত্য গুণ এখানে বিচার্য বিষয় নয়, অনুপমা দেবী তাঁর স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে যে সময়টাকে ধরেছেন এবং যে সমকালীন ইতিহাস তুলে ধরেছেন, ইতিহাস বইয়ের পাতায় তার কোন জায়গা না হলেও সাহিত্য তাতে কিছুটা সমৃদ্ধ হলো তো বটেই।
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments