এই লেখাটা লিখব বলে যখন আমি বসলাম, তখন আমার বয়েস পঁয়তাল্লিশ বছর তিন মাস তেইশ দিন তেরো ঘণ্টা চোদ্দো মিনিট সাড়ে পঁয়তিরিশ সেকেন্ড। আর সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেই আশৈশব। বলতে গেলে ঘুমপাড়ানি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার দিনকাল থেকেই। কিন্ডারগার্টেন স্কুলে দিন শুরুর ঠিক আগে যে সভা হত বা স্কুলে আবৃত্তির ক্লাসে ‘আবোল তাবোল’ থেকে কত ছড়াই-না আবৃত্তি করেছি। আবৃত্তি করতে করতে হেসেছি, হাসতে হাসতে আবৃত্তি করেছি।
শুধু স্কুলই-বা কেন, বাড়িতেও হত আবৃত্তির ক্লাস, সেখানেও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সমবেতভাবে আবোল তাবোল-এর একটার পর একটা ছড়া আবৃত্তি করেছি। এমনকী প্রতিযোগিতাতে অংশ নিয়েও সেই আবোল তাবোল-এর ছড়া!
এইভাবে দিনের পর দিন আবোল তাবোলকে জাপটে বাঁচার ফলে ছড়াগুলোর লাইনগুলো যেমন মনে গেঁথে গেছে, পাশাপাশি হেড আফিসের বড় বাবু, কাতুকুতু বুড়ো, কুমড়োপটাশ-এর মতো চরিত্রগুলো আর কাল্পনিক থেকে যায়নি। বরং, অনেক আপন, যেন বহুদিনের চেনা হয়ে উঠেছিল। আসলে প্রতিটা কবিতার যে অপূর্ব ছন্দ সেটাই আমার শিশুমনকে অমোঘ টানে ধরে রেখেছিল তার বৃত্তে। শুধু আমি কেন, মনে হয় সবার ক্ষেত্রেই এটা সত্যি।
‘আবোল তাবোল’-এর ছড়াগুলো পড়ামাত্র সুকুমার রায়ের আশ্চর্য জগতের ছবি চোখের সামনে হয়ে ওঠে জলজ্যান্ত। কত বিচিত্র চরিত্র, বিচিত্র ব্যাপার-স্যাপার তিনি সৃষ্টি করেছেন। আমার মতো করে দুটো-চারটে নিয়ে দু-কথা বলেই ফেলি তবে।
আমাদের অনেকেরই প্রিয় খাবার হল খিচুড়ি। বৃষ্টির দুপুরে গরমাগরম ঝাল ঝাল খিচুড়ির সঙ্গে ডিমভাজা– স্রেফ একঘর! আবার দৈনন্দিন জীবনে খিচুড়ি বললেই মনে হয় এইরে একাধিক জিনিস যেন জট পাকিয়ে একশা। সুকুমার রায় ‘আবোল তাবোল’-এর দ্বিতীয় কবিতা ‘খিচুড়ি’-তে ঠিক এই ব্যাপারটা নিয়েই বেশ মজা করেছেন। তিনি দুটো প্রাণীকে জুড়ে দিয়ে তৃতীয় একটা প্রাণীর সৃষ্টি করেছেন। যেমন, হাঁস আর সজারু মিলে হাঁসজারু, বক আর কচ্ছপ মিলে বকচ্ছপ, হাতি আর তিমি মিলে হাতিমি। এইসব জীবেরা সত্যি সত্যি পৃথিবীতে থাক বা না থাক আমার মনের জগতে স্বচ্ছন্দে জায়গা করে নিয়েছে বরাবরের জন্য।
আমার এক বোন আমাকে একটা মাটির গোল দেওয়াল ঘড়ি উপহার দিয়েছে। ঘড়িটা তার এক বন্ধুর বানানো। ঘড়িটার বিশেষত্ব হল, তার ধার বরাবর, সংখ্যার বদলে ‘খিচুড়ি’র প্রায় সবকটা প্রাণীর মূর্তি খোদাই করা। যেদিন ঘড়িটা দেওয়ালে টাঙিয়েছি, তার পর থেকে শুরু হয়েছে মানুষজনের অবাক হবার পালা—‘আরে! খিচুড়ি!!’ ছোটোরা দেখে লাফিয়ে উঠে বলেছে, ‘মা, দেখো! হাঁসজারু!! আরে, ওইটা কী যেন? মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। বকচ্ছপ! কী মজার, তাই না?’
আমি হেসেছি আর মনে মনে বলেছি, ‘জয়! সুকুমারের জয়!’
প্রায় গোটা পঞ্চাশেক ছড়া নিয়ে ‘আবোল তাবোল’। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কোনটা? না না, এর উত্তর মোটেই সহজ নয়। এককথায় তো দেওয়াই যাবে না। নোটবই আর পেনসিল হাতে থাকলেও না। এখন মুশকিল হল, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি।
কিন্তু শুরু তো করতে হবে। তাই প্রথমেই ধরা যাক ‘হেড আফিসের বড় বাবু’র কথা। অমন গোবেচারা শান্তশিষ্ট মানুষটি যে এমন তিড়বিড়িয়ে খেপে উঠলেন তার কারণ কি কেউ বুঝতে পেরেছে যতক্ষণ না পৌঁছেছে শেষ লাইনে—‘গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল, কেউ রাখে না খবর’!
বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিকোণ বদলায়। বড়ো হয়ে যখন ‘আবোল তাবোল’-এর পাতা উলটোই, তখন দেখি, সুকুমার রায় বলছেন, ওই ছড়াতেই-- ‘কাউকে বেশী লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।’
এক-শো বছর পার করে আজও একথায় লুকিয়ে থাকা ব্যঙ্গ কতটা প্রাসঙ্গিক তা আমরা বোধ হয় সবাই অনুভব করতে পারি।
ছড়াকার সুকুমার গোড়াতেই নিজেকে বলছেন খেয়াল-খোলা পাগল যে তার আবোল তাবোলের মাদল বাজাতেই মত্ত। তাঁর ছড়ার মিঠাই যে খেয়ালরস আর হাস্যরসেই মাখামাখি তা নিয়ে কোনো ধন্দের অবকাশ তিনি দেননি। তবে তার মধ্যেও যে কীভাবে মিশে যায় এক অন্তর্লীন বেদনার সুর!
চলে এলাম ‘কিম্ভূত!’ ছড়াটায়। একটা ‘বিদঘুটে জানোয়ার’। সারাদিন ধরে তার হাজার বায়নাক্কা। এটা চাই, ওটা চাই, সেটা চাই। অথচ, সত্যিই যে সে কী চায় তা সে নিজেই বুঝতে পারে না। খালি তার মনে হয়, ওর মতো ওটা চাই, তার মতো সেটা চাই, আর একজনের মতো আরও অন্য কিছু চাই। ভাবতে ভাবতে মনে আর তার কোনো শান্তি নেই। অবশেষে কোনো গতিকে ইচ্ছেমতো সব পেয়ে গিয়ে আহ্লাদে আটখানা হলেও কেউ যখন এসে তাকে তার নাম, ধাম, পরিচয় জিজ্ঞেস করে, তখন তার টনক নড়ে। সত্যিই তো! এটা তো সে ভেবে দেখেনি? এত কিছু চাইতে গিয়ে সে যে আসলে কে সেটাই তো সে জানে না। যে মুহূর্তে সে এটা অনুভব করে, সেই মুহূর্তে তার মনে জেগে ওঠে এক প্রবল হাহাকার—আইডেন্টিটি ক্রাইসিস!
আবার ‘নেড়া বেলতলায় যায় ক’বার?’ ছড়ায় সুকুমার রায় ‘রাজা’ সম্পর্কে একটা অদ্ভুত এবং একইসঙ্গে অনবদ্য উক্তি করেছেন, ‘ঠোঙাভরা বাদাম ভাজা খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না।’ এরকমও হতে পারে? এই উক্তি শত বছরে প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে। ঘর্মাক্ত রাজার এই অনবদ্য আচরণের অর্থ প্রকট হয় তার ঘিলু চমকানো প্রশ্নের সামনাসামনি হলে; সত্যিই তো নেড়া যদি লাখোবার বেলতলায় যায় তাহলে তা ঠেকায় কে?
ছড়া ছেড়ে এবার আসি ছবির কথায়। ছড়ার পাশাপাশি যেসব ছবি সুকুমার রায় ‘আবোল তাবোল’-এ এঁকেছেন, প্রতিটি ছড়ার সঙ্গে সেগুলোও এককথায় অতুলনীয়। ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’ ছড়াটা শুরুই হচ্ছে এভাবে—
‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা বাড়ী তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই, দেখেছ?’
এই হুঁকোমুখো হ্যাংলার ছবি সুকুমার যা এঁকেছেন তাতে আমরা দেখতে পাই, হাসি তো দূর অস্ত্, তার মুখে যেন রাজ্যের বিরক্তি বাসা বেঁধেছে। শুধু তাই-ই নয়, সে যেন এই কেঁদে ফেলল বলে!
‘আহ্লাদী’ ছড়াটায় আবার এর ঠিক উলটো। ছড়াটা শুরু হচ্ছে এভাবে—
‘হাসছি মোরা হাসছি দেখ, হাসছি মোরা আহ্লাদী,
তিন জনেতে জট্লা ক’রে ফোকলা হাসির পাল্লা দি’।’
এই ছড়াটার সঙ্গে ‘আবোল তাবোল’-এর পাতায় তিনটে চরিত্রর ছবি আছে। তারা তিনজনেই ফোকলা এবং হাসছে। কিন্তু তাদের সেই ফোকলা হাসির ছবি দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে যে তারা ‘আহ্লাদি’। এখানেই চিত্রকর সুকুমার রায়ের সার্থকতা। এই যে ‘এক্সপ্রেশন’ বা ‘অভিব্যক্তি’—কলমের কয়েকটা আঁচড়ে তা এমন অব্যর্থ দ্বিধাহীনভাবে ফুটিয়ে তোলা এ একমাত্র ‘তাঁর’ পক্ষেই সম্ভব বলে আমার মনে হয়। সুকুমারের নিজস্ব ভঙ্গিমার অলংকরণ ছাড়া ‘আবোল তাবোল’ যেন নুন ছাড়া পঞ্চব্যঞ্জন!