• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৫ | জুলাই ২০২৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পশ্চিমবঙ্গের চূড়ায় পাঁচজন : রাহুল মজুমদার



    ৩রা মার্চ

    তুমলিংয়ের ৩রা মার্চের ভোর ৬টা ডেকে বলল, সবাই ঘুমোচ্ছে ঘুমের, তুমি একবার গিয়ে দেখে এসো কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি দিল কি না। গুরুজনের আদেশ শিরোধার্য। গেলাম এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে বড় বড় কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে এলাম — কাঞ্চনজঙ্ঘা দু একবার পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে আবার মেঘের লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। মেঘের জ্বালায় কখন যে সূর্যোদয় হলো, টেরই পেলাম না। অগত্যা ন-টা বাজতে — 'চল মুসাফির বাঁধ গঠরিয়া'। মেঘের পাতলা মোটা দেয়াল দেখতে দেখতে ২০ মিনিটে তুমলিং ফটক। পারমিট দেখিয়ে SSB ক্যাম্প পেরিয়ে গৈরিবাসের পথে গোঁত্তা মারল গাড়ি; জোবাড়ির পথ পড়ে রইল বাঁয়ে। এঁকে বেঁকে দু দিকের রডোডেনড্রনদের পাঁচিলের মাঝ দিয়ে নামা জারি রইল। মাসখানেকের মধ্যেই এই পথটা লালে গোলাপীতে হোলি খেলবে।



    পাক্কা ৪০ মিনিট নেমে তবে গৈরিবাসের নাগাল পাওয়া গেল। পারমিট চেক আর কফি ব্রেকের মাঝে তিন নবীন এখানে ভারত-নেপাল এক্কা দোক্কা খেলায় মাতল। ১৪টা মিনিট গৈরিবাসকে দিয়ে গাড়ি চড়াই বাইতে আরম্ভ করল। চড়াইয়ের পালা আপাতত সাঙ্গ করে একটু নেমে কায়াঁকাটাকে বুড়ি ছুঁয়ে আবার চড়াইকে সঙ্গী করা গেল। বড় বড় গাছপালাদের এই চড়াই ভাঙায় বিশেষ উৎসাহ আছে বলে মনে হলো না। মাঝেমধ্যেই তাদের ভীড় পাতলা হচ্ছিল। ১১টায় ডাইনে একটা মোচড় মারতেই চড়াই আর সঙ্গ দিতে রাজি হলো না; হঠাৎ দেখা দিয়ে কালপোখরি কাছে ডেকে নিল, আমরাও তার ডাকে সাড়া দিয়ে তার কাছে দম নিতে থামলাম। নেপালকে খানিক এন্ট্রি ফী আর চায়ের দোকানকে চায়ের দাম মেটানোর ফাঁকে মিনিট ২০ কালপোখরিকে মন ভরে দেখে নেওয়া গেল। এরপর ভারতীয় চড়াই এড়িয়ে নেপালী সহজ পথে ১৫ মিনিটে চমরি চক। ছোট্ট সুন্দর গ্রামটা দেখলে সবারই থামতে ইচ্ছে করে, গাড়িও থামল। আমরাও নামলাম। আর বাঙালি সময় নষ্ট করে না— কফির অর্ডার হলো। কফি আড্ডায় পৌনে এক ঘন্টা কাটানো বাঙালির কাছে কিছুই না। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি এলো গেল। বয়েই গেল। সোয়া বারোটায় গাড়ি আমাদের নিয়ে নড়ল। সামনে আকাশে মাথা তোলা সন্দকফু বলল, 'অপেক্ষা করে করে তো হেদিয়ে গেলুম, এবার এসো দিকিনি।' চড়চড়িয়ে পাক খেয়ে চড়াই আরম্ভ হলো। অবস্থা দেখে কয়েক বাঁক পরেই ফার গাছেরা এগিয়ে এসে দু পাশ থেকে সাহস জোগাতে লাগল। মাঝে মধ্যে দু চারজন রডোডেনড্রন লাল ফুলের আলো জ্বালিয়ে আমাদের যাত্রাকে রঙীন করার চেষ্টা চালাতে লাগল। পৌনে এক ঘন্টা চড়ে সন্দকফু-র লজ বসতিতে পৌঁছে গেলাম। নেপালের দিকের 'হোটেল সানরাইজ' স্বাগত জানাল। কাঞ্চনজঙ্ঘাও হয়ত জানাল, মেঘের জ্বালায় বুঝতে পারলাম না। বারো হাজারি সন্দকফু ৮ ডিগ্রির ঠান্ডা দিয়ে পাঁচজনকেই হোটেলে ঢুকিয়ে ছাড়ল।


    আমরা যতই কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখতে চাই, মেঘেরা ঠিক করেছে— দেখিতে নাহি দিব। অতএব বরফমাখা পাথুরে পথে হাঁটাহাঁটিই সার হলো। তবে, বরফের আলপনা আঁকা পাহাড়ের রূপের সৌন্দর্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। সুয্যিঠাকুর পশ্চিমে হেলান দিতেই (আন্দাজেই সেটা বুঝে নিতে হলো; হাতের ঘড়িও সাহায্য করল, অস্বীকার করব না) ঠান্ডাটা শূন্যের দিকে হাঁটা লাগাল। সবাই হোটেলের ভিতরে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল। ৪ঠা মার্চ সকাল ৬টায় বাইরে বেরোতেই মেঘলা আকাশ ০ ডিগ্রির ধাক্কা মেরে ফের ভিতরে ঢুকিয়ে ছাড়ল। সাড়ে ৯টায় ব্রেকফাস্ট অবধি খালি উঁকি মারা কাঞ্চনজঙ্ঘার উঁকি মারার দুস্তর আশায়।



    শেষমেশ দুত্তোর বলে ল্যান্ডরোভারে চেপে বসা গেল। সেও আমাদের নাচতে নাচতে নিয়ে চলল। নতুনদের এই হাড়গোড় নড়িয়ে দেওয়া গাড়ি-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নেই। তাদের তো পরাণ ওষ্ঠাগত। তার সঙ্গে অবশ্য হাসির হেঁচকিও জারি। ১০টা ১০-এ মেঘঢাকা আল-এ কফি বিরতি (কারণ, দৃশ্য বলতে শুধুই মেঘ) দিয়ে গাছপালাদের নিচে রেখে চন্দু হোম স্টে-র সুবিশাল ঢেউ খেলানো চত্বরে ২২টা মিনিট সানন্দে কাটানো হলো কফির কাপ হাতে কল্পনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা আর এভারেস্ট দেখে। এবার চলো থোকুম ভ্যালির দিকে পাহাড়ের মাথায় মাথায়। চন্দা লেক এখন জলশূন্য কাদার পুকুর। চতুর্দিকে বাজে ন্যাড়া গাছের মাঝ দিয়ে সাড়ে ১১টায় থোকুম ভ্যালি। পাশের পাহাড়ে নেপালের দিকে 'চাররাতে'র একমাত্র বাড়িটা অদ্ভুত সুন্দর এক ছবি তৈরি করেছে। মেঘের দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও অপরূপ তার রূপ। আধিভৌতিক এক নৈঃশব্দ বিছিয়ে রয়েছে। আধ ঘণ্টা তার তো পাওনা হয়ই।

    ফেরার পথে আল ছুঁয়ে সন্দকফু ফিরলাম সাড়ে ১২টায়। তাপমাত্রা প্রতিজ্ঞা করেছে ৩-এর ওপর উঠবে না। অতএব, বাইরের থেকে ভিতরেই বেশি সময় কাটাতে বাধ্য হতে হচ্ছে।





    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ লেখক
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments