• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • পশ্চিমবঙ্গের চূড়ায় পাঁচজন : রাহুল মজুমদার



    সকালের প্রথম আলো গায়ে টোকা মারতেই বিরক্ত হয়ে ঘুমবুড়ি সরে পড়ল। উঠছি উঠব করে আরও মিনিট পনেরো কাটানো গেল। চায়ের খোঁজে সৌরদীপকে সঙ্গী করে বাজারের দিকে পা চালানো গেল। সকালের আলো নাছোড়বান্দা মেঘেদের তাড়াতে ব্যস্ত। আলসে ঠান্ডা জড়িয়ে রয়েছে ধোতরের সর্বাঙ্গে। বাজারে আকাশে তারা ফোটার মতো একটা দুটো করে দোকান খুলছে। দিদির ঝকঝকে দোকানের গরম গরম কফি আর সবজি মোমো পেটে পড়তেই এনার্জিরা ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসতে লাগল — দুজনে হাঁটতে হাঁটতে উঠে এলাম ভিউ পয়েন্টে — কাঞ্চনজঙ্ঘা কোনওমতে মেঘের কম্বল সরিয়েছে, চক্ষু সার্থক। তার থেকেও আনন্দের ব্যাপার, একদম ভিউ পয়েন্টে নতুন হোটেলের দেখা মিলল — আরেক দফা কফির সঙ্গে তাদের কার্ড পাওয়া গেল। আমাদের হোটেলে ফিরেই 'বেড টী'র সেবায় লেগে পড়া গেল বেডে বসে। উপবাসভঙ্গ সেরে বুড়িকে হোটেলের বারান্দায় রোদ পোয়াতে দিয়ে ধোতরের জঙ্গল আর মন্দির পর্যটন সেরে ফেলা গেল। দু-দশটা গাড়ির ব্যস্তসমস্ত আনাগোনা ছাড়া ধোতরে দিনভর আমাদের প্রিয় আলস্যে মোড়া। আগামীকাল লাপচে, মানে লেপচাজগত আমাদের টার্গেট।

    পরদিন চা জলখাবার সেরে ফিরতি পথ ধরে দৌড়— ব্যস্ত মানেভঞ্জ্যাং, সুখিয়াপোখরি পার করে এসে পড়লাম লেপচাজগতে আমাদের আস্তানায়। রাস্তার ওপার থেকে জমাট পাইনের সেনাবাহিনী সস্নেহ স্বাগত জানাল। অনেক বদলে গেছে লেপচাজগত — সেই দু এক ঘরের শান্ত বসতি আজ ঘিঞ্জি হোটেল হোম স্টে-র জমজমাট কংক্রিটের জঙ্গল। তবু লেপচাজগত আজও মোহময় আগন্তুকদের কাছে। টুরিস্টদের আনাগোনা বাদ দিলে দিনের অনেকটা সময় শান্ত রোদ্দুর খেলে বেড়ায় এর অলিতে গলিতে। সেসব দেখে দিনটা কখন যেন সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে গেল। তরুণ তিন মূর্তি অবশ্য দিনভরই টগবগে চনমনে ছিল।

    আগামীকাল দোল, কিন্তু স্বর্গ-ট্যুরের অন্তিম দিন। তাই সকলের মনে দুঃখ আনন্দের বিরিয়ানি। ভালোভাবে সন্ধ্যা নামার আগেই পাইনেরা তাদের দীঘল ছায়ায় ঢেকে দিল লেপচাজগতকে।

    দোলের সকালে অতি চনমনে ছোকরা গাড়ি নিয়ে হাজির; সকাল সকালই সে তরলতরঙ্গে দোলায়মান। গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার প্রভাব প্রত্যক্ষ করা গেল — গাড়িটাকে বুলেট ট্রেন বলে ভ্রম হতে লাগল। দ্যাখ না দ্যাখ সীমানার বড়বাজারি ভীড়ে এনে ফেলল গাড়ি। আমাদের আরেকটু তটস্থ করে এখানে সে আরও এক (নাকি দুই!) পাত্তর চড়িয়ে ফেলল রং মাখার ফাঁকে। এর পর যা হল, তাকে রোলার কোস্টার রাইড বলা উচিত। ভীড়ের মধ্যে দিয়ে অমন স্পীডে, তাও পাহাড়ী পথে, চলেও কেন যে আমরা এবং অন্য লোকজন অক্ষত রইলাম, সেটা আজও বোধগম্য হয়নি।



    মিরিক এখন ব্যস্ত শহর। তার ওই মোটেই চওড়া নয় পথ ধরে ওই গতিতে মিরিক লেকের সামনে এসে কিছুক্ষণের জন্য দম নিল। আমরা নেমে মিনিট কুড়ি সময় নিলাম আমাদের হাত পাগুলো চেক করে নেওয়ার জন্য। এরই মধ্যে আমাদের না জানিয়ে ছোকরা মিথ্যে কথা বলে তিনজন সওয়ারি বসিয়ে ফেলেছে গাড়িতে। আমাদের ধমকে রীতিমতো অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়ে আরও ক্ষেপে গিয়ে এবার রকেটের গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে ফুঁসতে লাগল ছোকরা। মিরিক ছাড়ার মুখে একটা পুলিশ চৌকি আছে। সৌরদীপ ওকে গাড়ি থামাতে বাধ্য করল। ওর বাবা কলকাতা পুলিশের অফিসার; ফলে, এ বিষয়ে ও আমাদের চেয়ে ওয়াকিবহাল। গাড়ি থামিয়ে গাড়ি আর ড্রাইভারের ছবি তুলে ও সোজা পুলিশের কাছে কাছে কমপ্লেন করল। ব্যাপার বেগতিক বুঝে ছোকরা পালানোর তাল করছিল গাড়ি নিয়েই। পুলিশ অফিসার দ্রুত এসে সোজা ওর গাড়ির চাবি খুলে নিলেন আর ওকে কলার ধরে নামিয়ে নিলেন। ব্রেথ অ্যানালাইজার ওকে পরীক্ষা করে নিজেই মাতাল হয়ে পড়ার দাখিল। তার ওপর দেখা গেল, ও বৈধ লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিল। লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করে ওকে দশ দিনের জন্য হাজতে পাঠিয়ে দিয়ে ওঁরা অন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে আমাদের রওনা করিয়ে দিলেন। ওঁদের ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা নেমে চললাম নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। সৌরদীপের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ত্ব আমাদের বিশাল এক বিপদের মুখ থেকে বাঁচিয়ে আনল যেভাবে ঠান্ডা মাথায়, তার তুলনা নেই। এই ট্যুরের হীরো ও-ই।


    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ লেখক
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | শেষ পর্ব
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments