কলকাতা- মুম্বাই -কায়রো। আকাশপথের সূচি।
একা নয়। যাচ্ছি দলের সাথে। ভ্রমণপিপাসু ৩৪ জন। ভ্রমণ সংস্থার নাম Travel Live. সঙ্গে দুজন সংস্থার কর্মী-কাম-ম্যানেজার। কায়রো থেকে থাকবেন আমাদের সাথে একজন ইজিপ্টোলজিস্ট গাইড। বারো রাত তেরো দিনের সফর। সফরসূচি হাতে পেয়েছিলাম আগেই। তাই নিজের মত করে একটু পড়াশোনাও করে নিলাম।
মিশরের ইতিহাস সুপ্রাচীন। সেই হেরোডোটাস বলেছিলেন, "ইজিপ্ট ইজ অ্যান অ্যাকুয়ার্ড কান্ট্রি, দি গিফট অব্ দ্যা রিভার।" সত্যিই তো নীল নদের উপহার হল মিশর। নীল নদ পৃথিবীর ৯ টা দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে- বুরুন্ডি, রাওয়ান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া এবং মিশর। কিন্ত মিশরের মত কেউ এত উপকৃত হতে পারে নি নীল নদের প্রবাহ থেকে। নীল নদ মিশরকে শস্যশ্যামলা করেছে। নীল নদ এই মরুরাজ্যে সুবাতাস বইয়ে দিয়েছে। তাই মিশর সারা পৃথিবীর কাছে এক সেরা পর্যটন কেন্দ্র।
যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগে মিশরের নদী সভ্যতার জন্ম হয়েছিল। মিশরের পূর্বে নীল নদ। আর পশ্চিমে মরুভূমি। এই দুইয়ে মিলে মিশর দুর্দান্ত এক টুরিস্ট ডেস্টিনেশন।
মিশরের পূর্বে লোহিতসাগর। পশ্চিমে লিবিয়া। উত্তরে ভূমধ্যসাগর। দক্ষিণে সুদান। আর মিশরের সুপ্রাচীন ইতিহাস থেকে জানতে পারি হাতবদল ও পালাবদল এর কথা-কাহিনি। সেই ফারাও থেকে শুরু করে একে একে আলেকজান্ডার - টলেমি রাজবংশ- রাণী ক্লিওপেট্রা - তুরস্কের রাজ পরিবার স্যামেলুক্স- নেপোলিয়ন-ব্রিটিশ এবং সবশেষে আরবের সুলতানরা।
বর্তমানে মিশর আধুনিক গণপ্রজাতন্ত্র এক রাষ্ট্র। এর আয়তন ১০,০১,৪৫০ বর্গ মাইল। জনসংখ্যা ১০ কোটি। উত্তর আফ্রিকা, মধ্য প্রাচ্য ও আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র মিশর। আধুনিক যুগে যার নাম হয়েছে ইজিপ্ট।
ডিসেম্বরের শেষে, বড়দিনের ঠিক দুদিন আগে কলকাতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস বিমানবন্দর থেকে সন্ধ্যার এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানে বসে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার আকাশপথে উড়ে পৌঁছে গেলাম মুম্বাইয়ের ছত্রপতি শিবাজী বিমানবন্দরে। এখানে চার ঘন্টার লে-ওভার। বিমান থেকে নেমে ডোমেস্টিক টার্মিনাল থেকে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালে পৌঁছে যাওয়া। লাগেজ চেক ইন। ইমিগ্রেশন করা। এমন জরুরি কাজগুলো করতে করতে সময় কেটে গেল। তারপর একটু বিশ্রাম। হাল্কা গল্পগুজব, আলাপ পরিচয় পর্ব চলতে লাগল নিজেদের মধ্যে।
মধ্যরাতে ছাড়বে ইজিপ্ট এয়ার। লাউঞ্জে চেক ইন করার সময় প্রচুর ইজিপ্টবাসী সাদা চামড়া ও আফ্রিকার কালো মানুষদের লাইনে দেখলাম। বেশ সময় লেগে গেল সব কিছু করতে। ডিনার ফ্লাইটে দেবে। তাই কেউ তেমন কিছু খেলাম না। আর এয়ারপোর্টে কিছু খাওয়া মানেই তো পকেট ফাঁকা! টি জংশনে মাটির কাপে এক কাপ চা তিনশো টাকা চাইল!..
২৩ ডিসেম্বর, ২০২৩; প্রথম রাত - ইজিপ্ট এয়ারে প্রবেশ
আমাদের দলের সবাই একে একে নির্দিষ্ট সময়ে প্রবেশ করলাম বিমানের অভ্যন্তরে। গেটের কাছেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন এয়ার হোস্টেস দুই ইজিপশিয়ান। বেশ বড় বিমান। দেখলাম কলকাতা থেকে আসা আরও দুটো ভ্রমণ সংস্থার পর্যটকরাও যাচ্ছেন মিশরে এই বিমানে। সবাই কলকল করে বাংলায় কথা বলছে। একদম পেছনের দিকে মনে হল সবাই মিশরীয় মানুষজনরা বসেছেন। আরবী ভাষায় নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। আফ্রিকার নানা প্রান্তের মানুষ। কায়রো থেকে চলে যাবেন যে যার নিজস্ব বাসভূমে।
আমি সিট পেলাম বিমানের মাঝের অংশের বামদিকের কোনার একটা সিট। আমার সিটের চোখ বরাবর একটা ছোট্ট টিভি মনিটর ঝুলছে। সেখানে যাবতীয় তথ্য ও বিবরণ ফুটে উঠছে। উচ্চতা, সময়, তাপমাত্রা, যাত্রাপথ সব একে একে ভেসে উঠছে। এদেখায় বেশ রোমাঞ্চ আছে। একটা চাপা থ্রিল অনুভব হয়।
বিমান মুম্বাই থেকে ছেড়ে আরবসাগর পেরিয়ে চলে যাচ্ছে মাসকট, আবু ধাবি, দোহা হয়ে আরও এগিয়ে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘন্টার এই আকাশ সফর। ছোট্ট মনিটরটায় দেখতে পাচ্ছি পরিচিত নামগুলো--আরবসাগরের ওপারে করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ। আরও কত নাম ইরাক, দুবাই, বাগদাদ। আমাদের বিমান উড়ে যাচ্ছে এই সব অতিক্রম করতে করতে।
বিমানে ডিনার ছিল আমাদের ভারতীয় হিন্দু মিল। অর্থ্যাৎ বিফ নয়, চিকেন। আকাশ পথে একটু ভাসতেই ডিনার এসে গেল সবার কাছে। বেশ সুন্দর মোড়কে ননভেজ মিল পেলাম। সুস্বাদু খাবারগুলো যখন খাচ্ছি ঘড়িতে তখন প্রায় একটা। ভারতে ভোর সাড়ে চারটে। আমরা মাঝ আকাশে মিশরে তখন ডিনার করছি। টাইম জোনের হেরফেরে কত কিছু কেমন পাল্টে গেল। এবার আমাদেরও মানিয়ে নিতে হবে সব কিছু আগামী বারো দিন।
আকাশপথে এটাই ছিল আমার দীর্ঘ উড়ান সফর। এর আগে সাড়ে পাঁচ ঘন্টা বিমানে চড়া হয় নি। তাই একটা সময় পর একটু ক্লান্ত লাগছিল। বসে থাকতে আর ভালো লাগছিল না। ঘুমও আসছে না। সিট ছেড়ে উঠে একটু পায়চারি করলাম। কফি চেয়ে খেলাম।
ভোরের আলোয় ঠিক সময়মত বিমান অবতরণ করল কায়রো এয়ারপোর্টে। কেমন যেন নিঝুম ছিল সে সময় কায়রো এয়ারপোর্ট। শান্ত চারপাশ। হাল্কা কুয়াশায় মোড়া কায়রোকে প্রথম দেখলাম। এয়ারপোর্টের সব কিছু যথারীতি নিয়ম মেনে হলো। ইমিগ্রেশন চেক। পাসপোর্টে স্ট্যাম্প, লাগেজ নেওয়া। আমরা যাবতীয় নিয়মকানুন মেনে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখি আমাদের জন্য সুন্দর এক লাক্সারী বাস দাঁড়িয়ে আছে। শুরু হল মিশর সফর।...
২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩; দ্বিতীয় দিন - কায়রো
বিলাসবহুল বাসে করে চললাম কায়রো শহরটাকে দেখতে দেখতে হোটেলের পথে। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে হোটেল। তাই শহরটা দেখার একটা সুযোগ হয়ে গেল। কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে শহরের পথে যেতে যেতে অনেক ভাঙাচোরার কাজ চোখে পড়ল। রাস্তা বড় করা হচ্ছে। ঝকঝকে করা হচ্ছে। প্রচুর অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে। ফ্লাইওভার অনেক। আরও হচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে চলেছি, বিদেশে এসে প্রথমদিনের পথ চলা। হঠাৎ চোখে পড়ল পথের ধারে ফ্লাইওভারের পাশে সারি সারি খুব বেমানান বিশ্রী দেখতে ছোট ছোট খুপরির মত হাউজিং। প্লাস্টার করা নেই বাড়িগুলোর। জায়গাগুলোও অপরিষ্কার। পরে জেনেছিলাম এগুলো বেআইনিভাবে বানানো সস্তার বাড়ি, সব গরীব মানুষদের জন্য!
কায়রোর রাজপথের ধারে প্রচুর খেজুর গাছ দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশের খেজুর গাছের মত নয়। এই খেজুর গাছগুলো বেশ লম্বা। পাতাগুলো খুব ঝিরঝিরে। আর গাছগুলোও বেশ পরিষ্কার। দেখতে ভালো লাগে।
কায়রো এয়ারপোর্ট থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে আমরা চলে এলাম আলেক্সান্দ্রিয়া ডেজার্ট রোডের ধারে অবস্থিত এক অপূর্ব সুন্দর রিসর্টে- পিরামিডস পার্ক রির্সট হোটেল।
রিসেপশন লাউন্জে দাঁড়িয়ে ঘরের চাবি পেয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে গেলাম। আমার ঘরে সঙ্গী হলেন একজন অসমীয়া সুভদ্র মানুষ। তাঁর সাথে পরিচয় করে নাম জানলাম সুরেশ সইকিয়া। কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক। বয়স ৮২। আমার মতই তিনিও একা এসেছেন।
ভারতীয় সময়ের সাথে মিশরীয় সময়ের তফাত সাড়ে তিন ঘন্টার। মোবাইলে দেখলাম মিশরে এখন সময় সকাল ১০টা ১০। ঘড়িতে তখন দেখাচ্ছে ভারতীয় সময় দুপুর ১টা ৪০।
প্রথমদিন চটজলদি তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়তে হবে। সময়ও বলে দিয়েছেন দুই ম্যানেজার। ডাইনিং হলে দেখা হবে সবার সাথে ১১ টায়। আজ আমাদের সফরসূচিতে রয়েছে সাকারা, মেমফিস ও সুগন্ধি স্টোর্স ভিজিট। ইতিমধ্যে আমাদের ইজিপ্টোলজিস্ট গাইড মিডো চলে এসেছেন। আলাপ পরিচয় হয়ে গেল। বেশ হাসিখুশি এক যুবক।
লাক্সারি বাস সময়মত ছাড়তে পারল না। প্রথমদিনই তাই প্রথমেই সবাইকে সময় মেনে চলার সতর্কবার্তা শুনিয়ে দেওয়া হলো।
পিরামিড মিশরীয় শব্দ। এর অর্থ হল উচ্চতা।
প্রাচীন মিশরে প্রায় ১০০ টা পিরামিড ছিল। বর্তমানে নাকি আছে মাত্র ৪০ টা। তার মধ্যে ৬ টা আছে গিজায়। বাকিগুলো কালের কবলে নষ্ট হয়ে গেছে।
সাকারার স্টেপ পিরামিডের ইতিহাস ও গল্প আমাদের ইজিপ্টোলজিস্ট গাইড মিডো সুন্দর করে বললেন। মিশর ভ্রমণে ইতিহাসের হাজারো গল্প শোনার অভিজ্ঞতা বড় অপূর্ব। সব গল্পই খুব রোমাঞ্চকর আর বিস্ময়জড়িত। তাই শুনতে যেমন ভালো লাগে তেমন এ জানার আনন্দও খুব উপভোগ্য।
স্টেপ পিরামিডের চারপাশে পায়ে হেঁটে দিব্যি ঘুরে নিলাম। প্রথম পিরামিড দেখার মুগ্ধতা মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পাশেই মরু অঞ্চল। উট দাঁড়িয়ে আছে অনেক। চাইলে একটু উটের পিঠে চড়েও নেওয়া যায়। কিন্তু সে সময় নেই। তাই ছুটতে হল এবার মেমফিসে।
রামসেস-২ এর মূর্তি ও মিউজিয়ামটা দেখে চলে গেলাম কায়রোর বিখ্যাত এক সুগন্ধির দোকানে। প্রথমে তো দোকানি সুগন্ধির ওপর খুব গুছিয়ে সুন্দর অনেক কথা বললেন। পারফিউম নিয়ে এত সিরিয়াসলি কোনওদিন কিছু ভাবি নি। দোকানির কথা শুনে আজ অনেক কিছু জানকারি হল। নতুন কথা শুনলাম কত। দোকানি আমাদের আপ্যায়ন করলেন মশলা চা ও ইজিপশিয়ান রুটি দিয়ে। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই সুগন্ধি সংগ্রহ করলেন।
সন্ধ্যায় ফিরে এলাম আমাদের নক্ষত্র হোটেলে। অপূর্ব সুন্দর এক হোটেল। মন ভালো হয়ে যায়। চোখ জুড়িয়ে যায় হোটেলের চারপাশ দেখে। আজ সবাই খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই ডিনার করে নিলাম একটু তাড়াতাড়ি। বুফে ডিনার। অন্তত পঞ্চাশ রকমের অপশন। যে যার মত খাবার পছন্দ করে খেতে পারে। এবং খাবারের গুণগত মানও ভালো। সবাই বেশ মজা করে গল্পের ছলে ডিনার সেরে নিলাম। মিশর ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনটা সুন্দর কাটলো কায়রোয়।
২৫ ডিসেম্বর, ২০২৩; তৃতীয় দিন- কায়রো থেকে লুক্সার
আজ আমাদের ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কায়রো থেকে লুক্সার সফর। ইজিপ্টের প্রাইভেট বিমান সংস্থা - Nesma Airlines-এর এক মাঝারি মাপের বিমানে চড়ে বসলাম। কিন্তু তার আগে খুব ঝকমারি পোহাতে হয়েছে এয়ারপোর্টে চেক-ইন করার সময়। খুবই অব্যবস্থা ছিল ডোমেস্টিক লাউঞ্জে। আমাদের মত অনেক বিদেশী পর্যটকদের বিরক্ত হতে দেখেছি। বিমান সফর খুব বেশি সময়ের নয়। কমবেশি এক ঘন্টা মাত্র।
লুক্সারে নেমে এয়ারপোর্টের বাইরে আসতেই দেখতে পেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে দারুণ সুন্দর এক বিলাসবহুল বাস। সারা মিশর সফরে এমন বিলাসবহুল বাসে করেই সফর করেছি। খুবই আরামদায়ক ছিল এই বাস জার্নিগুলো।
লুক্সার এয়ারপোর্ট থেকে আমরা সোজা চলে এলাম কর্নাক টেম্পলের কাছে নীল নদের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ক্রুজে- Hapi 5 Walton Group Nile Cruise. এই বিলাসী ক্রুজে আমরা ছিলাম তিনরাত চারদিন। ক্রুজে থাকার আনন্দ অভিজ্ঞতা অসাধারণ। খুব বিরাট বিশাল নয় ক্রুজটি। কিন্তু খুব সুন্দর এবং আরামদায়ক; সব কিছু দিয়ে যথাযথভাবে সাজানো গোছানো। ছাদে উঠে গেলে নীল জলের ছোট্ট হ্রদ। এই সুইমিং পুলটার আকর্ষণও কম নয়।
ক্রুজে প্রবেশ করতেই ওয়েলকাম ড্রিংক্স হিসেবে হাতে চলে এল সরবত। গলা ভিজিয়ে যে যার কেবিনে জিনিসপত্র রেখে সময় নষ্ট না করে চলে গেলাম Karnak Temple দেখতে।
আজ ছিল ২৫ ডিসেম্বর। তাই প্রচুর পর্যটকদের ভিড়। এবং স্থানীয় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড়।
আমাদের ইজিপ্টোলজিস্ট গাইড আগে থেকেই টিকিট সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। তাই টিকিটের জন্য সময় নষ্ট করতে হয় নি। এখানে প্রবেশ পথের টিকিটের মূল্য হল ৪৫০ ইজিপশিয়ান পাউন্ড।
প্রথম রামসেস এই মন্দির নির্মাণ শুরু করেছিলেন। ১৩৪ টি বিশাল পিলার চারপাশে। ইতিহাস বলে ১৭০ বছর সময় লেগেছিল এই নির্মাণকার্য শেষ হতে! এত বিশাল ও অবিশ্বাস্য এই মন্দিরের সব কিছু যে এখানে প্রবেশ করলে কেমন ঘোর লেগে যায়। চোখের দেখায় যেন সবটা দেখা হয় না! হৃদয় ভেদ করে চলে যায় চিরকালীন স্মৃতি হয়ে এই দৃশ্যসুখের আনন্দ। রাজা রামসেস মিশরীয়দের প্রধান দেবতা আমুন রে কে উৎসর্গ করেছিলেন এই মন্দির। একটা বেলা এই কর্নাক টেম্পলের কোনায় কোনায় ঘুরে বেড়িয়ে ইতিহাসের গল্প কথা শুনে চোখ-মন জুড়িয়ে ফিরে এলাম ক্রুজে। নীল নদের তীরে।
মধ্যাহ্নভোজন ও একটু বিশ্রাম পর্ব সেরে নিয়ে বিকেলে চলে গেলাম Luxor Temple দেখতে। ক্রুজ থেকে লাক্সারি বাসে করে যেতে বেশি সময় লাগল না। এখানে প্রবেশ পথের টিকিট ৪০০ ইজিপশিয়ান পাউন্ড।
লুক্সারের এই টেম্পলটাও দেখার মত সুন্দর। এরও স্থাপত্য আশ্চর্যরকমের অন্যরকম। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চোখ যেন আর নড়ে না। তাও তো আমরা দেখছি ধ্বাংসাবশেষের সৌন্দর্য! সত্যিই পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণ যখন ছিল এই মন্দির, তা যে কী অসাধারণ ছিল ভাবতেই মন কেমন বিভোর হয়ে যায়। আলোকিত লুক্সার টেম্পল দেখতে দেখতে ইতিহাসের পথে হারিয়ে যায় মন প্রাণ। নিজেকে পর্যটক হিসেবে ভাগ্যবান মনে হয়। এসব জিনিস দেখা ও না-দেখার পার্থক্য অনুভব করে মন রোমাঞ্চিত হয়।
লুক্সার-এর এই ভুবন বিখ্যাত টেম্পলটির একাংশ তৈরি করিয়েছিলেন তৃতীয় আমেনহোটেপ ও গ্রীক বীর আলেকজান্ডার। অপর অংশটি করেছিলেন তুতেনখামেন ও দ্বিতীয় রামসেস। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে তৈরি নীল নদের তীরে অবস্থিত এই টেম্পল দেখতে সারা পৃথিবী থেকে দলে দলে পর্যটকরা প্রতিবছর আসেন। এ মুগ্ধ হয়ে দেখার মত এক টেম্পল। মিশরীয় দেবতা মুথকে উৎসর্গ করা হয়েছে এই টেম্পল। আমরা এখানে সানসেটও দেখেছি অবাক বিস্ময়ে।
লুক্সার খুব পরিচ্ছন্ন শহর। সন্ধ্যায় আমরা আবার চলে গেলাম কর্নাক টেম্পলের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো দেখতে। দিনের উজ্বল আলোয় আজ যে টেম্পলকে দেখেছিলাম, এখন সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয়ও দেখছি তার আরেক রূপ। এ দেখার অভিজ্ঞতাও সুন্দর।
লাইট অ্যান্ড সাউণ্ড শো দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের তত ভালো হল না। তার একমাত্র কারণ প্রযুক্তির দুর্বলতা। আলো ও শব্দের খেলা সেভাবে সৃজন করা হয় নি। তাই স্বভাবতই আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছিল, ভারতবর্ষের বিখ্যাত বিখ্যাত সব লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোর তুলনাগুলো। আমাদের সেগুলো সত্যিই অপূর্ব এবং গুণগত মান খুব ভালো।
দিনের শেষে ক্লান্ত শরীরে সবাই ফিরে এলাম আবার ক্রুজে। আজ আমাদের নীল নদের বুকে ক্রুজে প্রথম রাত্রিযাপন। সবাই বেশ উল্লসিত। খুশি। বুফে ডিনারেরও এলাহি আয়োজন। দেশ বিদেশের কত রকম যে কত পদ সাজিয়ে রেখেছে। মন চাইলে নিজের ইচ্ছেমত খাও। আমি মাছভক্ত বাঙালি। তাই স্যামন মাছ, বাসা মাছের বেকড, ও কারি রোজই পেটপুরে খেয়েছি। মাংস চিকেন, বিফ, পর্ক। ওমলেট হরেকরকম পাওয়া যায়। স্যালাড ও ফ্রুট জুস অঢেল। মিষ্টি, প্যাস্ট্রি, আইসক্রিম সব দেদার নিয়ে খাওয়া যায়। তাই সবাই বেশ মনের সুখে ডিনার করে ক্লান্ত শরীরে গুডবাই করে চলে গেল যে যার কেবিনে। আমার মন চাইল, যাই একটু ডেকে গিয়ে দাঁড়াই, নীল নদের রাত্রির শোভা দেখি। উন্মুক্ত ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে ঝলমলে চাঁদকে দেখতে দেখতে চাঁদের আলোয় নীল নদ স্নান করছে এই আবেগী অনুভব বড় মূল্যবান হয়ে ধরা দিল হৃদয়ে। এই হৃদয় জুড়ানো আনন্দ নিয়ে খানিক পর নিচে নেমে এলাম আমার কেবিনে। আরও একটা স্মরণীয় দিন ফুরিয়ে গেল মিশর ভ্রমণে এসে!..
২৬ ডিসেম্বর, ২০২৩; চতুর্থ দিন -লুক্সার থেকে এডফু
আজ অনেক ভোরে উঠে পড়েছি। ক্রুজের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম হাল্কা কুয়াশায় ঢাকা নীল নদ। আলো ফোটে নি আকাশে। সেই প্রথম আলো দেখার জন্যই চটজলদি তৈরি হয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে - যাব Valley of the Kings দেখতে আকাশপথে হট বেলুনে চড়ে।
আমাদের ভোরের এই হট বেলুনে চড়ার রোমাঞ্চকর জার্নিটা ছিল অপশনাল এবং নিজের খরচে। তাই অনেকেই যায় নি এই সান রাইজ স্পটে গিয়ে বেলুনে চড়তে । আমরা বারো- চোদ্দজন গিয়েছিলাম। আমার রুমমেট ৮২ বছরের সুরেশ সইকিয়া যান নি। কিন্তু আমাকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, "তুমি যাও। অনেক শুভেচ্ছা রইল।"
একদম প্রথম ভোরে আর যাওয়া হয় নি আমাদের। দলের সব সদস্য সময় নিয়ে সচেতন না হলে ভ্রমণের অনেক মজা অধরা রয়ে যায়। ক্রুজ থেকে নামতেই আলো ফুটে সকাল হয়ে গেছে। তাই সেই প্রথম আলোয় বেলুনে চড়ে আকাশপথের উচ্চতা থেকে ভ্যালি অফ কিংস দেখার অসাধারণ অনুভূতির অভিজ্ঞতা অধরা রয়ে গেছে।
কাল রাতে যখন প্রথম জেনেছিলাম এই হট বেলুন রাইডের কথা এবং এর খরচ, তখন একবার হলেও একটু ভেবেছিলাম ১০০ ডলার দিয়ে বেলুনে চড়ব!.. একশো ডলার মানে আমাদের ভারতীয় টাকায় আট হাজার চারশো টাকা!... অনেকটা টাকা!...কিন্তু হট বেলুন থেকে নেমে এসে মনে হয়েছিল, এ অভিজ্ঞতার কোনও তুলনাই হয় না!..টাকা পয়সা তো আসবে-যাবে, এই সব স্মরণীয় আনন্দ অভিজ্ঞতাগুলো, আজীবন বেঁচে থাকার সুন্দর সব রসদ হয়ে রয়ে যাবে মনের মণিকোঠায়। কোনও এক অলস দুপুরে, অখণ্ড অবসরে, মন খারাপের একাকীত্বে এরা এসে ডিম পাড়বে!.. সোনার সেই সব ডিম জীবনকে তখন কত রঙেই না রাঙিয়ে দিয়ে চলে যায়। দূর হয়ে যায় একাকীত্ব। অনেক তুচ্ছ মালিন্য, বেদনাও তখন কত ফিকে লাগে। এই সব সোনালী স্মৃতির নামই তো জীবন থেকে পাওয়া সুদ! এই সুদের হিসেব কোনও ব্যাঙ্কই দিতে পারবে না!..
এবার আমরা যাব সড়কপথে Valley of The Kings ও Valley of The Queens দেখতে। এখানেই দেখতে পাব বিখ্যাত তুতেনখামেন এর মমি। রাণী হাটসেপসুট এবং মিশরীয় গুহাচিত্র। তাই খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। সড়কপথে আমাদের বিলাসবহুল বাসটা দুরন্ত গতিতে ছুটতে ছুটতে চলল। পথের দু'পাশের মিশরীয় গ্রাম, জনপদ, জলাশয়, চাষজমি দেখতে দেখতে চলেছি। মিশরের এই সব পথের ধারের দৃশ্য যেন একদম আমাদের চিরপরিচিত গ্রামবাংলার মত। পথের ধারের জমিগুলোতে আলু, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটো, ধনেপাতা চাষ হয়েছে দেখতে পেলাম। নীল নদের অববাহিকায় এই সব গ্রাম, জনপদগুলো হওয়ায় চাষে সমৃদ্ধ ও সুন্দর হয়ে আছে দু'পাশ।
যাওয়ার পথে অনেকটা মরু অঞ্চলও চোখে পড়ল। কিন্তু এই সব রাস্তা ও জনপদের নামগুলো বুঝতে ও জানতে পারলাম না। সমস্যা ভাষা। ইংরেজিতে লেখা চোখে পড়ল না। মিশরের পথে পথে এই ভাষাগত সমস্যা খুব প্রবল। সাধারণ মানুষ আরবী ছাড়া কিছু বলতে ও বুঝতে পারেন না। দোকানে, পথে ঘাটে ইংরেজিতে লেখা নামও ভীষণ কম।
এবার আমরা চললাম Temple of Queen Hatshepsut দেখতে। প্রাচীন মিশরের সবচেয়ে সুন্দরী, বিদুষী, রাজনীতি সচেতন, প্রাজ্ঞ রাণী ছিলেন এই হাটসেপসুট। তাঁরই নামাঙ্কিত এই টেম্পল দেখলাম। এই টেম্পল-এর স্থাপত্য খুবই দৃষ্টিনন্দন। এর চারপাশের রুক্ষ প্রকৃতির সৌন্দর্যও অপূর্ব। সব মিলিয়ে এই দুই বিখ্যাত উপত্যকায় একটা বেলা ঘুরে বেড়িয়ে কাটানোর অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়।
বেলাশেষে ক্লান্ত শরীরে, শ্রান্ত হয়ে সবাই ফিরে এলাম আবার ক্রুজে। প্রায় দিনের শেষে আজ মধ্যাহ্নভোজন করলাম সকলে। "মাঝে মাঝে ভালো লাগে বিনা স্নানে মধ্যাহ্নভোজন" মনে মনে শঙ্খ ঘোষ আওড়াতে আওড়াতে খেয়ে নিলাম আগে। ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম খুবই।
অপরাহ্নের নরম আলোয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে ক্রুজের ডেকে গিয়ে বসলাম। নীল নদে ক্রুজ ভাসছে। দু'পাশের গ্রাম, জনপদ দেখতে দেখতে চলেছি। নীলের জলে অনেক জেলে ডিঙ্গি চোখে পড়ল। নীল নদে অনেক রকম মাছ নাকি পাওয়া যায়। জাল ছুঁড়ে ছুঁড়ে জেলেরা মাছ ধরছে। নদীর ধারের গ্রাম্যজীবন একদম আমাদের পরিচিত গ্রামগুলোর মত। গোরু চরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চারা খেলছে। মাঠে চাষ হচ্ছে। পাখির দল উড়ে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো মনে হচ্ছিল, মিশরে নয়, মনে হয় যেন আমাদের গঙ্গার ধারের সেই সব চেনা গ্রাম- জনপদগুলো দেখছি উলুবেড়িয়া, ফুলেশ্বর, বজবজ, আঁচিপুর, ফলতা...
আজ এভাবে ভাসতে ভাসতেই পৌঁছে যাব এডফু।
এই ক্রুজে ভ্রমণ বড় শান্ত, মনোরম অনুভূতির জন্ম দেয় হৃদয়ে। প্রাচীন এক সভ্যতার ইতিহাস, তার স্থাপত্য সৌন্দর্য, ধ্বংসাবশেষের আলো, ধূসর মরুভূমি আর সাথে নীল নদে ক্রুজে ভ্রমণ কেমন যেন সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
এ এক অনির্বচনীয় ভ্রমণের আনন্দ!...