১ (ইং ১৯০৯) উৎকল সীমান্তে মেদিনীপুরের দোহাটা গ্ৰামের শিশু ভুতো পোড়েল স্থানীয় শিব মন্দিরে গিয়ে হয়ে যায় প্রতাপ
৪ (ইং ১৯১২) দেবীকৃপায় বসন্ত রোগে যুগপৎ প্রতাপের বাবা এবং মা মারা যায়
৪ - ১৭ (ইং ১৯২৫) দিদিমার কাছে থেকে মিডল্ ইস্কুলটা আর. . . আচ্ছা ও সব কথা এখন থাক. . .
১৮ (ইং ১৯২৬) গ্ৰামের অন্যদের প্ররোচনায় কলকাতা পৌঁছোয় এবং চুরিতে হাতেখড়ি হয় পোড়েলের
১৯ (ইং ১৯২৭) প্রথম চুরিতেই ধরা পড়ে ও আঠারো মাসের কারাদণ্ড হয়
২২ (ইং ১৯৩০) তৃতীয় চুরিতেও ধরা পড়ে এবং এবার কারাদণ্ড হয় তিন বছরের
২৮ (ইং ১৯৩৬) বৌবাজারের একটি পাইস হোটেলে কর্মরত অবস্থায় প্রতাপের বিয়ে দেন বৃদ্ধা দিদিমা - কলকাতা নিবাসী ঘাটালের মেয়ে আঠারো (!) বছরের চম্পাবতীর সঙ্গে
৬২ (ইং ১৯৭০) ইহলোকের মায়া কাটিয়ে প্রতাপ চম্পাবতীকে বৈধব্যে প্রেরণ করে। একটি বিবাহিতা কন্যা, এক ছেলে ও আরেকটি অনূঢ়া কন্যা রেখে
উপরোক্ত ওই সহজ সরল সাদামাটা জীবনীতেও একটু ইয়ে আছে। সেটাই এবার . . .
ব্রিটিশ আমলে লালবাজারের কাছে মার্কেন্টাইল বিল্ডিঙের ভেতরে একটা জায়গায় একটা ছোট বাজার মত ছিলো। সেখানে আসতো পুলিশ ও চোর ছ্যাঁচোড়ের দল। সবাই সবাইকে ব্ল্যাকমেল করে ভয় দেখাতো ও সাধারণ সমাজে অচেনা নানা পণ্যের বেচাকেনা চলতো। যেমন কয়েকটি চাবির একটি গুচ্ছ যা দিয়ে যে কোনো তালা অন্ধকারে নিঃশব্দে খোলা যায়। অথবা হারাধন পকেটমারের হালের খবর। কিম্বা কোন পাড়ার রায়বাহাদুর পুলিশকে কদিন একটু বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। হয়তো বা পুলিশের বুটজুতোর পালিশ। এই আর কি।
ইং ১৯২৭
- এই হতভাগা এটা কি এনেছিস? তোকে বললুম না সাপমার্কা পুলিশের পালিশ আনবি?
- সিখানে তো উস্তাদ আমাকে যেতেই দিবে না!
এর পরেই পড়লো সর্দারের হাতের একটা চড়। প্রতাপের গালে।
যাই হোক সেদিন মাঝ রাতে বৌবাজারের এক এলাকায় ঢুকে সেই বেড়াল মার্কা দেশী কালি কপালে গালে মাখিয়ে দুজনে একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লো। অবশ্যই কোনো দরজা দিয়ে নয়, একটা গামছাকে ভিজিয়ে নিয়ে সেটা দিয়ে একটা জানলার গরাদ বেঁকিয়ে।
কিছু বাসন কোসন ও একটা চাবি আঁটা বাক্স বাগিয়ে সর্দার সহজেই কেটে পড়লো, কিন্তু আমাদের নায়ক পোড়েল অন্ধকারে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে একটা পর্দায় জড়িয়ে হুড়মুড় করে গেলো পড়ে।
আর ওই দুমদাম আওয়াজে পিতামহীর কাছে ঘুমন্ত বাড়ির একটি ছোট বছর আষ্টেকের মেয়ের ঘুম ভেঙে গেলে সে চোখ খুলে রাস্তার গ্যাসের আলোয় স্পষ্ট দেখলো . . . ভূত!
প্রতাপ যখন জানলা দিয়ে বেরোচ্ছে তখন তাকে বাইরে থেকে হাত ধরে টেনে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে অনেক সাহায্য করলো পাড়ার টহলদার পুলিশ।
পুলিশের "সম্পূর্ণ অচেনা" দুজন লোক যথারীতি আদালতে প্রতাপকে সনাক্ত করায় বেচারীর সামান্য একটু জেল হলো, যদিও সে বামাল ধরা পড়েনি।
ইং ১৯৩০
মাস কয়েক আগে বেহালার দিকে একটা বড় "কাজে" সাফল্য দেখিয়ে প্রতাপের আত্মবিশ্বাস হঠাৎ বেড়ে যায়। এবং তার পরেই তৃতীয় চুরির সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বার শ্রীঘরদর্শনের সৌভাগ্যও হয়ে যায়।
ইং ১৯৩৬
বছর কয়েক আগে বৌবাজারের একটি হোটেলের বাঙালী মালিককে প্রতাপ বিশুদ্ধ ওড়িয়া ভাষায় বোঝাতে সক্ষম হয় যে সে সাক্ষাৎ ভীম ও দ্রৌপদীর সন্তান, অতএব কলকাতার রান্নায় সিদ্ধহস্ত। মালিকের বিকেলের আমেজের সময়ে দেখা করতে গিয়েছিলো, কন্দর্পকান্তি চেহারা, কাজেই পরিবেশনের কাজে ঢুকে পড়তে পারলো।
এই খবর পেয়ে পোড়েলের বৃদ্ধা দিদিমা একটু খোঁজাখুঁজি করে সচ্ছল কন্যাদায়গ্ৰস্ত গৃহস্থ চম্পার পিতাকে পেয়ে যান ও পরবর্তী শুভলগ্নে প্রতাপ বাবাজীবনের তৃতীয় এবং শেষবারের মতো কারাদণ্ড হয়ে যায়। হয়তো সে সব উত্তেজনা সহ্য করতে না পেরেই তার দিদিমাও কিছু দিন পরে অন্য এক জগতের একতরফা টিকিট কাটেন।
ইং ১৯৪২
নানাবিধ আশু দুর্দিনের আগামী সংকেত আঁচ করতে পেরে স্ত্রী ও চার বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে প্রতাপ এবার ফিরলো জন্মস্থান সেই দোহাটায়। যাবার সময়ে হাওড়ার পথে থার্ড ক্লাস ভাগের গাড়িতে বসে চম্পাবতী মেয়েকে--
- কাঁদিসনি খুকু, চুপ করে বোস
- ঐ দেখ, দুটো মেম যাচ্ছে
- দেখেছিস কত বড়ো দোকান
- ঐ বাড়িটায় তোর মা থাকতো ছোটবেলায়
- দেখ দেখ লোকটা কেমন টুপি পরেছে
- কুকুরটার লোম দেখ কেমন ধবধবে সাদা
ইত্যাদি
তারপর হাওড়ায় রেলগাড়ি !
কিন্তু কিছুদিন গ্ৰামে আলস্যে কাটিয়ে আমাদের প্রতাপ পড়লো অসুখে। একদিন স্ত্রীকে ডাকলো।
- শোনো, তোমাকে একটা কথা বলবো বলবো ভাবছি কিছুদিন ধরে
- দেখো তোমার এখনো জ্বর ছাড়লো না, ও সব কথা টথা পরে হবে, এখন এই বার্লি টুকু খেয়ে নাও তো
তা তখন আর কিছু বলা হলো না
ইং ১৯৭০
বহু দিন হলো পোড়েলরা কলকাতায় ফিরে এসেছে। সমর্থ ছেলে একটি ছোটখাটো চাকরীও করে। কনিষ্ঠা কন্যাকে পাত্রস্থা করার কথা ভাবা হচ্ছে, এমন সময় আবার শক্ত ব্যাধিতে ধরলো আমাদের সুপরিচিত প্রৌঢ় প্রতাপকে। চম্পা কাঁদো কাঁদো মুখে পাশে বসে, ডাক্তারবাবু সামান্য আশ্বাস দিয়ে সদ্য গেছেন। এমন সময়ে
- একটা কথা, বুঝলে, অনেক দিন ধরে . . .
- ও সে আমি প্রথম থেকেই জানি গো, তুমি ও সব নিয়ে ভেবো না, ঠাকুমার ঘরের পর্দায় তোমার মুখ থেকে সব কালি যে মুছে গিয়েছিলো গো. . .