(দিল্লী, ১৭৩৯)
রুখসানা বেগম
নাদির শাহ সবে হিন্দুস্তান থেকে রফাদফা হয়েছে। ইরানী ফৌজের হাতে যারা কৎল হয়েছিল তাদের রক্তের দাগ শাহজাহাঁবাদের গলিগুলো থেকে মোছেনি। তরুণ শায়র মীর মোহম্মদ তকীকে তখন মেরেছিল ইশ্ক। এক আগ্রাওয়ালির হাতে থাপ্পড় খাবার পর আগ্রা থেকে দিল্লীতে ফিরে এসেছিল সে। পতঙ্গরা যেমন মরার সময়ে একসঙ্গে মরবে বলে আগুন খোঁজে, তেমনই চোট খাওয়ার পর শায়রদের দিল্লী যাওয়ার দস্তুর।
আগে মীর শরাব ছুঁত না। একে ফকিরের ছেলে, তায় বয়স কম, কুসঙ্গে পড়ার সময় বা সু্যোগ কোথায়? দিল্লীতে পৌঁছে সেই সুবিধেগুলো পাওয়া যায়। - মদ যদি খেতেই হয়, জীবনের শেষ রাত মনে করে খাও। সঙ্গীরা বুঝিয়েছিল। কিন্তু রাতের পর সকাল হলে মীর দেখত তার নিঃশ্বাস চলছে, দিলের ধড়কনও বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়েছে শুধু কলমের প্রবাহ। আগ্রা ছাড়ার পর গজল তো দূর একটা শেরও সে লিখতে পারেনি। উলটে যে কটা লেখা সন্ধ্যেবেলা নেশার ঘোরে পুড়িয়ে ফেলেছিল সেগুলো আর সকালবেলা মনে করতে পারেনি। এর জন্য অবশ্য মীরের কোনো নালিশ বা দুঃখ ছিল না। কারণ যার পুরোনো গজলগুলো দুশমনের কোলে বসা মাশুকার মতো তাকে লজ্জা দেয় সে আরেকটা পয়দা করে নিজের কষ্ট বাড়াবে কেন?
থাপ্পড় মারনেওয়ালির ক্ষমতার মনে মনে প্রশংসা না করে পারেনি মীর। এক চড়ে ছেলেবেলা থেকে চেপে বসা শায়রীর ভূতটা তার ঘাড় থেকে গায়েব, যেন কোনোদিন সে জিনিসটার অস্তিত্ব ছিল না। দিনের বেলা যখন কোনো কাজ থাকে না তখন খালি ঘাড়ে একটা অন্য পাগলামির ভূত এসে চাপে। যে চোখদুটোকে সে আর কোনোদিন দেখবে না বলে আগ্রায় ফেলে এসেছিল, তারা দেহ্লীর পুরোনো হভেলীগুলোর আড়াল থেকে উঁকি মেরে মেরে তাকে উন্মাদ বানিয়ে ছেড়েছে। ধরতে গিয়ে বহুবার আছাড় খেয়ে পড়েছে মীর। লোকজন তখন পথ ছেড়ে দেয়। দোকানিরা ঝাঁপ ফেলে সরে পড়ে। অথচ এত ধ্বংসের পরেও এটা একটা এমন শহর, যেখানে কেউ মীরকে দেখে হাসে না বা টিটকিরি দেয় না। দিল্লীর সবচেয়ে বড়ো বিশিষ্টতা এটাই। কে এখানে ইশ্কে ঘায়েল নয়?
দিল্লীর উত্তরে পানিপত। আরো খানিকটা উত্তরে গেলে করনালের মাঠ। সেখানে নাদির শাহের ফৌজকে থামাবার জন্য দিল্লীর বাদশাহ মোহম্মদ শাহ রঙ্গীলা বহিরাগতদের চেয়ে দেড়-দুগুণ বড়ো একটা সেনাবাহিনী পাঠায়। ইরানী ঘোড়সওয়াররা মোঘলদের বিরাট বাহিনীকে আসতে দেখে পিছন ফিরে ছুট মেরেছিল। আসলে সেটা ভান। মোহম্মদ শাহের ফৌজ যখন ব্যূহ ভেঙে তাদের তাড়া করতে যায় তখন ইরানের বাছাই করা অশ্বারোহীদের একটা দল তাদের ডান দিকের পাঁজর ভেদ করে গাছ কাটার করাতের মতো বেরিয়ে গেছে। তারপর সেই পথেই ফিরবার আগে অর্ধশিক্ষিত উজবেক যোদ্ধা নাদির শাহ শাহজাহাঁবাদ আর দেহ্লীর চল্লিশ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশুকে বধ করেছিল। যথাসময়ে আগ্রায় সরে না পড়লে মীরও এদের হাতে কাটা পড়ত।
দিল্লীর রাস্তায় সেই কৎল-এ-আম যখন চলছে তখন বাদশাহ মোহম্মদ শাহকে মেয়েদের বিয়ের সানাই বাজাতে হয়। নিজের মাথা বাঁচাবার জন্য শত্রুর হাতে মেয়েদের তুলে দেওয়ার চেয়ে দুঃখের আর কী আছে? কিন্তু মোহম্মদ শাহ ভোলেনি তার পূর্বপুরুষ বাবর যখন হিন্দুস্তানে আসে তখন দিল্লীর সুলতান ছিল ইব্রাহিম লোদী। পানিপতের প্রথম লড়াইতে হারার পর সে তার মাথাও বাঁচাতে পারেনি। হাজার বছর ধরে এই নিয়মে চলছে পৃথিবী।
শহরের সীমান্ত ধরে হেঁটে চলার পথে এবার ধ্বংস আর মৃত্যুর একটা পৃথিবীকে আবিষ্কার করেছিল তরুণ তকী মীর। যেখানে আগে ফুলের বাগান ছিল সেখানে এখন জঙ্গল, যেখানে হাট বসত সেখানে শকুনের আস্তানা। বসতির পর উজাড় বসতি অতিক্রম করেও তরুণ মীর কোনো মানুষের মুখ দেখতে পায়নি।
দিল্লীতে মীর যাঁর আশ্রয়ে থাকে, সেই ঘন্টেওয়ালার পাশের গলির বেগম রুখসানা ছিলেন মীরের বাপ ফকির মোহম্মদ মুত্তকীর ভক্ত। তিনি সকালবেলা যা পারেন মীরের মুখে ঠুসে দিয়ে তাকে বাড়ি থেকে চল্তা করে দেন। বলেন – এখান থেকে ফৌরন পালাও। এ হল হলওয়াইদের গলি। হরদম নোকর-চাকরদের যাতায়াত। সারাবেলা ধরে গাঁওয়ারদের কোলাহল। হুলো বেড়ালের ডাক। ফুটো বর্তনের আওয়াজ। এর মধ্যে তোমার লেখাপড়ার কাজটা দিলের অরমান হয়েই রয়ে যাবে। তুমি মুশতাক আলী বা জাফর ইকবালের বাড়িতে গিয়ে কুতবখানায় বসো না? তাদের কিতাবঘর দখল করো।
- কে জাফর ইকবাল?
- চেনো না বুঝি? খারী বাওলীতে গিয়ে মসজিদের কাছে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। তিনটে কমসিন, অপূর্ব সুন্দর মেয়ে আছে ও বাড়িতে, যেন তিনটে ময়ূরী। থাকবে না পড়ে কেউ। দেখতে দেখতে বিয়ে হয়ে যাবে।
আসলে রুখসানারই অসুবিধে। একটা ষোলো-সতেরো বছরের ছেলের উথলে ওঠা শোক, আর ফোঁস ফোঁস করে তুফানের মতো দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে বাড়ির কাজ কে করতে পারে? সকালের কয়েকটা ঘন্টা অবশ্য একটু সুস্থ বোধ করে মীর। দু-চারজন দোস্ত আর রেখ্তার কদরদান, অর্থাৎ উর্দু কাব্যের অনুরাগী পাঠক, হয়েছে তার। তাদের বাড়িতে ঢুঁ দিয়ে বই-টই পড়া যায়। নিজেকে শিক্ষিত করা আর রেখ্তায় শের লেখা ছাড়া আর কোনো কাজ তো তার দ্বারা হবার নয়। একে সৈয়দ, তার উপরে ফকিরের ছেলে। দোকান চলাবে জুয়াড়ির মতো, আর তলোয়ার চালাবে শরাবীর মতো, এ তো সবার জানা। তাই সে না পাবে মুন্সীর কাজ, না ফৌজের নোকরী।
ফারসী কেতাবের সবচেয়ে বড়ো সংগ্রহ যাঁর সেই মুশতাক আলী খাঁ দেহ্লবী প্রথম দর্শন থেকে মীরের দিওয়ানা। একদিন ছলছলে চোখে জমীনে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। মীর বলে – খাঁ সাহিব, যার নিজেরই বুক জ্বলছে সে অন্যকে কী সান্ত্বনা দেবে? আপনি আর কাউকে খুঁজে নিন না?
- এই দামন আমি ছাড়ব না। অন্তত একটা চুম্মা দিয়ে যাও। এই বলে খাঁ সাহেব মীরের কুর্তার উপর ঝুলিয়ে রাখা পাতলা সুতোর শাল ধরে ঝুলে পড়লেন। পালাতে গিয়ে মীর আছাড় খেয়ে পড়ে যায়। মুশতাক আলীর গায়ের ওজন মীরের তিনগুন। তিনি চুম্মা দিয়ে শুরু করে আরো কিছু উসুল করে নিলেন। খানিকটা ধস্তাধস্তির পর মীর নিজের জুতো, শাল, আর টুপি খাঁ সাহেবকে নজরানা করে খিড়কি দিয়ে লাফায়। তারপর থেকে শহরের দু-চারটে গলি এড়িয়ে চলতে হয়।
পরে মীর রুখসানাকে ঘটনাটা জানিয়ে পরামর্শ চেয়েছিল।
রুখসানা বললেন – তাহলে মুশতাক আলীর বাড়িতে না যাওয়াই মুনাসিব। তোমার কোনো দোষ নেই, কাউকে বোলো না, তাঁর কাছে আমারও একটা চুনরী পড়ে আছে। তবে ভয় নেই, উনি আর কাউকে পেয়ে গেছেন এতক্ষণে।
আরেকজন অনুরাগী হল ওয়জীর বদাউনী। অল্প বয়স, লাল টুকটুকে ঠোঁট। নিজে লেখে এবং খরচা চালাবার জন্য মনসবদারদের দফতরে মুনীবের কাজ করে। সে মীরকে বলেছিল – আমার বোনের সঙ্গে শাদী করে নাও। সঙ্গে আমাকেও পেয়ে যাবে। কিন্তু দুচোখ বুজলেই পরীর মতো যে শকলটা মীরের সামনে চলে আসে তার কাছে এরা কী? আগুন আর বেগুন।
রুখসানা বেগমকে বন্ধু-বান্ধব, রিশ্তেদাররা বলে যাচ্ছিল – খোদা কে লিয়ে ছেলেটাকে সারাও। চোখ দেখলে মনে হয় কামড়ে দেবে। একটা দুল্হন উল্হন জুটিয়ে দাও না?
- কোন অভাগীর সঙ্গে এরকম শত্রুতা করব? এটা একটা খোঁয়াড় ভাঙা পশু। সারাদিন টোটো করে রাস্তায় ঘোরে। রুখসানা প্রতিবাদ করেছিলেন।
- কিচ্ছু ক্ষতি হবে না মেয়ের। আস্তাবলে ভালো ঘাস আছে দেখলে পাগলা ঘোড়াও অপনে আপ ঘরে ফিরে আসে।
বাড়িতে এসে রুখসানা মীরকে বললেন – সৈয়দের মেয়ে চাই তো বলো, ফকিরের চাই তো বলো। একটু বয়সে বড়ো আর তজুর্বেওয়ালি চাই তো বলো। হাট্টা-কাট্টা যতগুলো পুরুষ শহরে ছিল সব তো ইরানীদের তলোয়ারে কাটা পড়ে গেছে। মেয়েদেরকে জুলুমের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তাদের পরিবাররাই কেটে ফেলেছিল। তাও বেশ কিছু বেঁচে গিয়েছে। এখন সবাই বেওয়া। দোকান, ব্যবসা, এসব তাদের চালাতে হচ্ছে। এমন কাউকে নিলেই সবচেয়ে ভালো। বিবিও পেলে, থাকা খাওয়ার একটা সংস্থানও পেয়ে যেতে পারো। চাই কি বাচ্চাও।
- আপনাদের উপর এতই যদি বোঝা হয়ে গিয়ে থাকি তাহলে ঘুমোবার সময়ে আমার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দেন না কেন? তলোয়ার তো এই বাড়িতেই মওজুদ থাকে। মীর জানায়। - এমনিতেও বেশিদিন বাঁচব বলে মনে হয় না।
- তওবা, তওবা। মোহম্মদ মুত্তকীর সাহিবজাদাকে আমরা বোঝা বলেছি নাকি? যতদিন ইচ্ছে থাকো। যা খুশি করো। শুধু সন্ধ্যেবেলা খারাপ ছেলেদের চক্করে পড়ে মাতাল অবস্থায় পাড়ায় ঢুকো না।
মীর বেরিয়ে যাওয়ার পর রুখসানা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। মীরের প্রেমরোগ যদি বা সারে, তার গরীবী সারাবে কে? দেহ্লীতে ডাকাতি করার পর যা ধনরত্ন পাওয়া গিয়েছিল শোনা যায় তা দিয়ে নাদির শাহ ইরান দেশের তিন বছরের রাজস্ব মাফ করতে পারে। সেই কোহিনূর লুটে যাওয়া শহরে রুখসানা এমন একজন রঈসের তলাশে ছিলেন যে ভদ্রতাবশত মীর তকীর জন্য একটা মাসোহারা বরাদ্দ করে দিয়ে তারপর সেটা রদ করতে ভুলে যাবে। কাজটা এমনিতেই কঠিন। মীরের বাউণ্ডুলে হাবভাবের জন্য এখন প্রায় অসম্ভব মনে হচ্ছিল।
মনে মনে মীরের বাপ ফকির মুত্তকীর কাছে অঙ্গীকার করলেন রুখসানা বেগম। - আপনার খাপছাড়া ছেলেটাকে আমি ঘরে ফিরিয়ে আনবই।
অঙ্গুরী বাগের অজুবা
জাহাঁজেব আর তৌহিদ মির্জা নামের দুই চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে মীর কিছু পুঁথি দেখতে গিয়েছিল। লোহার চানার মতো দাঁতভাঙা কঠিন ফারসী। লেখকের নাম অজানা। মির্জারা বলে – শায়র মনে হয় বেদিল। জন্মসূত্রে ছিলেন পটনার বঙ্গালী। ফারসীতে সনদ। খুসরোর পর ওরকম ফারসীর দখল হিন্দুস্তানে কারো ছিল না। অওরঙ্গ্জেবের আমলেই আল্লাহ্ কা পেয়ারা হয়েছেন। আজকাল দারুণ চলছে এই ধরনের লেখা। ভাবছি এই ধাঁচে আমাদেরও কয়েকটা লেখা উচিত।
শহর এবং ফৌজের অর্ধেক লোক মরে গেলেও মির্জাদের মতো পরিবারে শায়রীর শওক মরে না। খুদা আপনাদের সলামত রাখুন। মনে মনে বলে মীর। জাহান্নুমের আগুন আমার বুকের মধ্যে সীমিত থাকুক। আপনারা লিখে যান।
নিজে না লিখলেও সে লেখার সহায়ক হতে পারে। মুনীবীর কাজ। যুৎসই শব্দ এগিয়ে দেওয়া। ছন্দ ধরে রাখতে সাহায্য করা। এই সব করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যায়।
এখন অবশ্য মীরের মাথায় ঢং ঢং করে একটা ঘন্টা বাজছিল। সন্দেহ হচ্ছে তার সাহায্যে বেদিলের অচেনা গজলগুলো একটু এদিক ওদিক করে নিজেদের নামে চালাবে মির্জা ভাইরা।
হরেক রকমের পুঁথি আর বইয়ের সংগ্রহ থেকে দক্ষিণী কবি ওয়লীর স্বহস্তে লেখা বাঁধানো এবং নকশা করা একটা খাতা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি পেড়ে নামায় মীর। ওয়লীর শৈলী এবং ভাষা মীরের খুবই পছন্দ। দক্কনের জবানে লেখা। দিল্লীর খড়ী বোলী, হিন্দভী, আর পাঞ্জাবী মিশিয়ে তৈরি। অচিন দক্ষিণ ভারতীয় শব্দ ছেটানো থাকলেও তাদের মানে প্রসঙ্গ থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না।
কিছুদিন আগেই ওয়লীর দুটো ছত্র মীরকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। তখনও আগ্রাওয়ালি তাকে পথে বসায়নি।
যোধা জগত কে কিঁউ না ডরেঁ, তুঝ সুঁ অয় সনম
তরকস মেঁ তুঝ নয়ন কে হ্যাঁয় অর্জুন কে বাণ আজ
এ কি কবীরের অনুকরণ? না খুসরো? ভেবেছিল মীর। ‘অর্জুন’ আর ‘সনম’-কে একই খাঁচার মধ্যে তাঁরাও ঢোকাতে পারেননি। একটা এসেছে হিন্দুদের মহাভারত থেকে, অন্যটা খাঁটি আরবী। দুটো শের এক খাঁচায় থাকতে পারে। কিন্তু একটা লঙ্গুর আর একটা সাপ? মীর ভাবত ওয়লীর লেখা কারো ভালো লাগুক আর না লাগুক, পরাক্রম সম্বন্ধে সন্দেহ থাকা উচিত না।
- এগুলো একটু পড়ে দেখা যাক না? সহজ কিছু? বেদিলের অজানা লেখাগুলোকে মির্জা ভাইদের কবল থেকে বাঁচাবার জন্য সে তাদের ওয়লীর দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
- মীর ভাই, ওয়লী দকনীর লেখা আগ্রাতে পড়া যেতে পারে। গোয়ালিয়রে চলে। ইন্দোরে, অওরঙ্গাবাদে দৌড়োয়। অওরঙ্গাবাদকে ছোটি দিল্লী বলে কেন জানো? সেখানে চাঁদনী চক নেই। যমুনা নদীও নেই। দিল্লীতে সব আছে। এখানে দশ বছর আগে পাজামার যে সিলাই, যে ধাঁচ চলত, এখন সেটা অচল। দুবছর আগে পর্যন্ত লোকে সাদা বেড়াল পুষত। এখন পোষে হলুদ। সাদা বেড়ালগুলোকে জুতো মেরে রাস্তায় বের করে দেওয়া হয়েছে। কোনো দাম নেই তাদের।
- তাই বলে ওয়লী দকনীও অচল হয়ে গেছেন? আমি যে শুনেছিলাম অওরঙ্গাবাদ থেকে আস্তানা তুলে দেবার পর জনাব দিল্লীতেই সারা জীবন কাটান? এবং সবার ভালোবাসা আর কদর পেয়েছিলেন?
- তকীজান, দকনী হলেন ধবধবে সাদা বেড়াল। মুশায়রাগুলো থেকে তাঁর জিক্র গায়েব। তোমার ঝোঁক যদি পুরোনো মালের দিকে হয় তো আগ্রাতেই থেকে গেলে না কেন? দিল্লী হল নতুন আর সেরাদের জায়গা। জিনিসটা আবর্জনা হয়ে গেলে আমরা শহর থেকে বার করে দিই।
‘হ, হ’ করে জাহাঁজেব আর তৌহিদ হাসতে শুরু করে দেয়, যেন চল্লিশ হাজার মানুষ খতম হয়ে যাবার পরেও দিল্লীর গরিমা অক্ষুণ্ণ, অহংকারে চিড় ধরেনি।
মীর ওয়লীর অনুকরণ করতে গিয়ে দেখেছে পড়তে যেমন সহজ লেখার বেলা তেমনই কঠিন। ফারসীর ছন্দের সঙ্গে পার্থক্য। দুটোতে সমান দখল না থাকলে এরকম লেখা অসম্ভব। খানিকক্ষণের জন্য মনটাকে ভোলাতে এসেছিল, এখন চাচাতোদের আনতাবড়ি মন্তব্যে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। সে খাতা থেকে একটা পছন্দের শের খুঁজে দুই মির্জার নাকের সামনে গুঁজে দেয়। - এরকম কজন লিখেছে হিন্দুস্তানে? দিল্লীর মুশায়রায় এটা চলেনি?
ওয়লী উস গোহর-এ-কান-এ-হয়া কী কেয়া কহুঁ খুবী
মেরে ঘর ইস তরহ আতা হ্যায় জ্যুঁ সীনে মেঁ রাজ আওয়ে
ওয়লী এই লজ্জার খনি থেকে বেরোনো মুক্তোর কথা কী বলি
চুপিচুপি এসেছিল ঘরে যেমন বুকের ভিতর আসে গোপনীয়তা।
জাহাঁজেব আর তৌহিদ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। মীর জানত গজলটা এককালে দিল্লীতেও ওয়াহ্ ওয়াহ্ কুড়িয়েছে। তখন মির্জারা জন্মায়নি। মীর তো নয়ই। ওয়লী দক্ষিণ থেকে একটা নতুন ভাষা একা হাতে তৈরি করে গোটা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে দিলেন। ফারসীর জৌলুসে যারা অন্ধ তারা না বুঝলেও সাধারণ মানুষ সে লেখা অবজ্ঞা করেনি। আকবর নিজের দরবারের উপযোগী একটা জবান দেশে চালু করেছিলেন। এটা তার শায়রানা সংস্করণ। মৌখিক উর্দুর সাহিত্যিক রূপ। দক্ষিণী শব্দগুলোর জন্য আরো মধুর শোনায়। ওয়লীর কবিতা থেকেই জন্মেছে শায়রীর নতুন ভাষা, যাকে আজকাল রেখ্তা বলা হচ্ছে।
- এই যে একটা মানুষের উপস্থিতিকে গোপনীয়তার সঙ্গে তুলনা করা হল, এই তরকীবটা ফারসীতে কোনোদিন দেখেছ তোমরা? মীর জিজ্ঞেস করে। - দেখোনি। কারণ এটা একটা হিন্দী উপমা। ওরা যাকে চোর উচক্কার তরকীব বলে। তোমাদের মনে হয় না ওয়লীর তরকীবগুলো হিন্দুস্তানে ঠিক এইভাবেই নিঃশব্দে চোরের মতো সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়বে?
চাচাতো ভাইরা পাঁচ সাত বছর জ্যেষ্ঠ, এবং কিনারী বাজারের ঘানি থেকে বেরোনো নির্ভেজাল দুটি নমুনা। সরাসরি তর্কে যায় না তারা, কথা ঘুরিয়ে পিছলে যাওয়াতে ওস্তাদ। তৌহিদ বলে - তরকীব মন্দ নয়। কিন্তু ভাষাটাই ঠিকমতো ফারসীতে লেখা যায় না। শাহী দরবারের মুশায়রায় খান-এ-আরজুর মতো বিদ্বানরা বসে থাকেন। শেরের প্রত্যেকটা অক্ষর নিয়ে অক্ষরমালায় তাদের স্থানসংখ্যা কি সেটা মুখে মুখে যোগ করে ফেলতে পারেন। তুমি যদি নাম করতে চাও তো এমন কসা হুয়া টান-টান ফারসীতে লিখতে হবে যে সেই অক্ষরের যোগফল থেকে শের-এর তারীখ বেরিয়ে আসবে। এই সব কায়দাগুলো জলের মতো গড়িয়ে যাওয়া হিন্দুস্তানী ভাষায় করা অসম্ভব।
শায়রী নিয়ে তর্ক আগে মীরকে চাঙ্গা করে দিত। এখন নিরর্থক। তবু মির্জা ভাইরা পয়সাকড়ি দিয়ে সাহায্য করে বলে তাদের একটু খাতির করা উচিত। মীর বলে - জনাব, আমি মনে করি যে শায়রীর প্রাণ তার উপমায়, তার বক্তব্যে। বাকি সব কায়দা কানুন নিজেদের জায়গায় থাকুক, তাদের আমি ছোট করছি না। কিন্তু সেগুলো কি প্রধান হতে পারে?
লাঠি ঠুক ঠুক করতে করতে এক সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ এসে বইয়ের তাকগুলোতে গিয়ে ধাক্কা মারলেন। ধড়াধ্ধড় অনেক বই মাটিতে পড়ে গেছে। মীর তাড়াতাড়ি গিয়ে ভদ্রলোককে একটা খালি চৌপায়ায় বসিয়ে দিল।
- এই তো আসল লোক এসে গেছেন। মামুজান, ওয়লী দকনীকে আপনি দেখেছিলেন? জাহাঁজেব শুধোয় বৃদ্ধকে।
- নিজাম-উল-মুল্ক? আমি তো ওঁর দলেই ফৌজী ছিলাম। দেখব না কেন? আজ যদি মোহম্মদ শাহ রঙ্গীলা তাঁর কথা শুনত তাহলে দিল্লীর এই অবস্থা হত না।
- মামু কানে কম শোনেন। জাহাঁজেব মীরকে বুঝিয়ে দেয়। - কিন্তু এককালে দিল্লীর প্রত্যেকটা নামকরা লোককে চিনতেন।
সবাই মামুকে ইজ্জত দেখিয়ে তাঁর কানের একটু কাছে সরে যায়। মামু বলতে শুরু করলেন – আসফ জাহ্, যাঁকে পরে নিজাম-উল-মুল্ক উপাধি দেওয়া হয়, অওরঙ্গ্জেবের সেনাপতি ছিলেন। খাঁটি তুর্কী রক্ত। একটা মাত্র লোক যার মাথায় বুদ্ধি ছিল। বাকিগুলো গর্দভ।
- মামু, একটু খেয়াল করে। দিনকাল ভালো না।
- কী বললি? সয়ীদ ভাইরা? সে দুটো তো মুজফ্ফরনগরের জংলী শের। দু চারটে বকরা খেতে পারে, কিন্তু বন্দুক-টুকড়ির সামনে পড়লে নিজেরাই কুরবানীর বকরা। অওরঙ্গ্জেব মারা যাওয়ার পর গর্দভদের বারাতে এরাই ছিল সেরা। ক্ষমতায় চলে আসে। বাদশাহের ছেলে আর নাতিদের দাবার ঘুঁটির মতো দিল্লীর সিংহাসনে বসাত আর ইচ্ছে হলে কৎল করিয়ে দিত। তেরো বছর ধরে এরকম চলার পর অওরঙ্গ্জেবের পোতার ছেলে মোহম্মদ শাহ রঙ্গীলার পালা এল। মাত্র আঠেরো বছর বয়স। তার মা আসফ জাহের কাছে মিনতি করেছিলেন ছেলেকে বাঁচাবার জন্য। আসফ জাহ্ তখন দক্কনে। সয়ীদ ভাইদের পাঠানো রাজপুত, পাঠান, আর মুজফ্ফরনগরের বর্হাদের মিলা-জুলা দু-দুটো ফৌজকে রতনপুর আর বালাপুরে শিকড় সুদ্ধু নির্মূল করে দেন। তারপর সয়ীদ ভাইদেরও একে একে গুপ্তঘাতক লাগিয়ে সরিয়ে ফেলা হল।
- মামুজান আসফ জাহের বাহিনীতে সিপাহী ছিলেন। অওরঙ্গ্জেব মারা যাবার পর সে সব ছেড়ে বনিয়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কারখানা খুলে নেন। তৌহিদ জানায় মীরকে। - কী মামুজান! ঠিক বলিনি?
- মোঘলদের পুরো সরকার এইভাবে হাত মিলিয়ে চলে, ভান্জে! যাহোক, আসফ জাহ্ দক্কনে চলে গেলেন আর ওরা আমাকে দিল্লীতে রেখে নিল। হিজড়াদের ফৌজে থেকে কী করতাম? পরে মোহম্মদ শাহের সমস্ত পথের কাঁটা সরিয়ে আসফ যখন দক্কন থেকে দিল্লীতে ফিরে এলেন তখন আমার আর নোকরির দরকার ছিল না। কারখানা চালু হয়ে গেছে। প্রথমে রঙ্গীলা আসফ জাহ্কে নিজাম-উল-মুল্ক উপাধি দিয়ে প্রধান ওয়জীর বানায়। কিন্তু পরে জোঁকের মতো ভিড় করে থাকা নামাকুল চাটুকার আর মোসাহেবদের প্ররোচনায় সেই বোকচন্দর নিজেরই নিজাম-উল-মুল্কের বিরুদ্ধে একটা সৈন্য পাঠিয়ে দিয়েছিল।
- খোদা কে লিয়ে মামু-উ! যাকে তাকে গাল দেওয়া বন্ধ করো নইলে তোমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। এরা আমাদের গায়ে হাত দেবে না। কায়র সবাই। বুজদিল। রঙ্গীলা যখন নিজামের উপর চঢ়াই করে তখনও নিজামেরই জিত হয়েছিল। তারপর তিনি হায়দারাবাদে নিজের আলাদা রাজ্য গড়ে নেন। নাদির শাহের বেলা আসলে কী ঘটেছিল জানিস তোরা? নিজামের ফৌজ বাদশাহকে বাঁচাবার জন্য দিল্লীতে এসে অপেক্ষায় বসে। রঙ্গীলা না তো নিজামের কথা শুনল আর না তাঁর তুর্কী আর ইরানী ঘোড়সওয়ারের বাহিনীটার সাহায্য নিল। ইরানী ঘুসপ্যায়ঠদের মোকাবিলা হিন্দুস্তানে ওই একটা লোকই করতে পারত। দিল্লীতে যখন কৎল-এ-আম চলছিল তখন সেই বুজুর্গ মানুষটাই নাদিরকে গিয়ে বলেছিল – এই চল্লিশ হাজার লোককে বাঁচিয়ে আরেকবার নিজের ফৌজের হাতে সঁপে দিতে যদি পারেন তো ভালো হয়, নইলে আপনার সিপাহীদের রক্তের তেষ্টা মিটবে না। এটা শোনার পর লজ্জায় নাদির শাহ কৎল-এ-আম থামায়। নইলে হয়তো আজ আমরা কেউ এখানে নয়, একেবারে জন্নতে বসে গল্প করতাম।
মামু থামার পর জাহাঁজেব তাঁর কানের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলল – নিজামের গল্প শুনে শুনে কান পচে গেছে। ওয়লী দকনীর কথা হচ্ছে এখানে! সে তোমার চেনা ছিল না?
- সেটা আবার কে? সিপাহ্সালার?
মীর ওয়লীর খাতায় আরেকটা ভালো গজলের দৃষ্টান্ত পেয়ে গিয়েছিল। সেটা সে মির্জা ভাইদের হাতে তুলে দেয়। মির্জারা মামুর কানে ঠুসে দিল।
মেরে দিল কো কিয়া বেখুদ, তেরী অঁখিয়োঁ নে আখির কো
কে জ্যুঁ বেহোশ করতী হ্যায় শরাব, আহিস্তা আহিস্তা
ওয়লী মুঝ দিল মেঁ আতা হ্যায়, খয়াল-এ-ইয়ার বে-পরওয়াহ
কে জ্যুঁ অঁখিয়াঁ মলে আতা হ্যায় খ্বাব, আহিস্তা আহিস্তা
না ব্রজবুলি, না দকনী। পরিষ্কার দেহলভী হিন্দীতে লেখা। মির্জারাও মানতে বাধ্য হয়, খারী বাওলীর গলিতে তেজপাতার কারোবারীদেরও বুঝতে কোনো অসুবিধে হবে না। আর গজলের রদীফ, অর্থাৎ শের-এর অন্তিমে যে ধুয়োটা রাখা আছে সেটা যে ফারসীর বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা একটা সেরা ফল সে বিষয়েও সন্দেহ নেই।
মন কেড়েছিল চোখেরা তোমার এমন ভাবে
যেভাবে আমার হুঁশ কেড়ে নিত শরাব, আহিস্তা আহিস্তা।
হৃদয়ে আসত বন্ধুর স্মৃতি সঙ্কোচহীন
যেভাবে চোখের পাতায় নামত খোয়াব, আহিস্তা আহিস্তা।
- অজীব ব্যাপার ভাই! গজলটা আমার চেনা। মামুজান অনেকক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর বললেন। - এতদিন আগেকার কথা তো? তাই সময় লাগল একটু। অওরঙ্গ্জেব তখন বেঁচে। আমার বয়স অল্প। দকনী শায়র কম কথার মানুষ। একটু তোতলাতেন মনে হয়। তাই যা বলতেন গানের সুরে বলতেন। বিকেলবেলা লাল কিলার সামনে অঙ্গুরী বাগের দিওয়ানে মহ্ফিল বসেছিল। বাদশাহের নিজের ছেলে আজম শাহ মওজুদ। এই গজলটা গেয়ে শোনানো হল। তারপর যে কাণ্ডটা হয় সেটাকে অঙ্গুরী বাগের অজুবা বলে। তোরা শুনেছিস?
- না, মামু। তুমি না বললে কী করে শুনব?
- তো কান খুলে শুনে নে। এখন যারা কাবিল আর বুজুর্গ শায়র, সেই সিরাজুদ্দীন আলী খান-এ-আরজু, মজ্হর জান-এ-জাহান, এরা তখন নওজওয়ান। সবে লিখতে শুরু করেছে। বঙ্গালী বেদিল ছিলেন সেই মহ্ফিলের আসমানে একলা চাঁদ। সবাই ফারসীতে শের বলেন। আজকাল তোরা যাকে রেখ্তা বলিস সেই ভাষাটা তখন একেবারে অচেনা। ওয়লী নিজের দকনী রেখ্তা নিয়ে এসেছেন। গজলের এই শেরটার কাফিয়ায় পৌঁছে একটু দম নিতে থেমেছিলেন। তারপর ‘কে জ্যুঁ বেহোশ করতী হ্যায়’ বলার পর হঠাৎ গলার পর্দা আর আওয়াজ দুটোই ইচ্ছে করে খাদে নামিয়ে দেন। প্রায় কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।
- ওয়াহ্! ওয়াহ্! কেয়া বাত হ্যায়! মির্জারা বলে ওঠে।
- হ্যাঁ। তাই ঘটেছিল। ফিসফিস করার মতো কায়দায় যখন তিনি পরিষ্কার ফারসী উচ্চারণে বললেন ‘আহিস্তঃ আহিস্তঃ’ তখন শাহজাদা নিজের আসন ছেড়ে উত্তেজনায় উঠে পড়েছিলেন, আর সভায় এমন একটা সন্নাটা, এমন নৈঃশব্দ্য নেমে এসেছিল যে পাঙ্খাওয়ালারা পাঙ্খা নাড়াতে ভুলে গিয়েছে। এমন সময়ে কোত্থেকে একটা বিজাপুরী ক্যাঁয়চি এসে হাজির।
- বিজাপুরী ক্যাঁয়চি? সে আবার কী? জাহাঁজেব, তৌহিদ আর মীর একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে।
- জানিস না? একধরনের দকনী তোতা পাখি, বিজাপুর থেকে অওরঙ্গ্জেব যাদের নিয়ে এসেছিলেন। হিন্দুস্তানের লোকেরা বলে শুক। প্রায় পাওয়াই যায় না এখন।
- তো নামে ক্যাঁয়চি কেন?
- কারণ অওরঙ্গ্জেবের আনা তোতাগুলো তিনটে ভাষায় কথা বলতে পারত, আর তাতে ছিল কাঁচির ধার। এগুলোকে পোষা হত রঈসদের খিল্লি উড়িয়ে উড়িয়ে অপদস্থ করার জন্য। বিজাপুরী তোতার মুখে কেউ কোনোদিন একটা ভালো কথা শোনেনি। শুধু গালি আর খিল্লি। তো এই মুলাজিমটা আজম শাহের হাঁটুর উপর বসে বলে ওঠে ‘সুভানাল্লা’। আরো আশ্চর্য ব্যাপার হল সে দকনীকে নকল করে ভীষণ অদব সে ফিসফিসিয়ে বলেছিল সেটা। শাহজাদা নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি পাখির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন – কী বললি বেটা? আবার বল। তো পাখিটা কুঁ কুঁ করে শাহজাদার আদর খেয়ে নেবার পর তাঁর কানে নাকি বলে দেয় – গজল নে তো পাগল কর দিয়া জনাব, আহিস্তা আহিস্তা।
- মামু-উ-উ-উ! তৌহিদ চিৎকার করে ওঠে। - তুমি আবার দিন দুপুরে ভাঙ খেয়েছ? শাহজাদার কানে কী বলা হয়েছিল তুমি শুনেছিলে?
- আরে বেশর্ম্, তোদের বাড়িতে তাম্বাকুও বানিয়ে দেয় না কেউ! নিজের চোখে দেখলাম ঘটনাটা। কানে তোতা কী বলেছিল সেটা আমি শুনব কী করে? শাহজাদাই সবাইকে শুনিয়েছিলেন। যাহোক, যে কিস্সাটা তুই অন্যদের কাছেও যাচাই করে আসতে পারিস সেটা হল এই যে আজম শাহ দকনীকে একটা সোনার হার পরিয়ে দেন আর দিল্লীর বাকি শায়ররা তাকে খুব হিংসে করতে থাকে, কারণ যে যতই ইনাম আর উপাধি পেয়ে থাকুক, একশো বছরের মধ্যে কেউ বিজাপুরী ক্যাঁয়চির সেলাম পায়নি। অওরঙ্গ্জেবের নাতিদের অবধি তারা ‘বাতোঁ কে শের’ আর ‘লেজ কাটা লঙ্গুর’ বলে সম্বোধন করত। তবে লোকে বলত বিজাপুরী ক্যাঁয়চির মুখ দিয়ে প্রশংসা বেরোনো নাকি ভীষণ অপয়া। এবং সেটাই হয়েছিল। তারপর অঙ্গুরী বাগে কোনোদিন মুশায়রা জমেনি। অওরঙ্গ্জেবের মৃত্যুর পর বড়ো ভাই বাহাদুর শাহের কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে আজম জানটাই খোয়ালেন। আর বেদিল এবং দকনী শায়র দিল্লী থেকে চিরকালের জন্য গায়েব হয়ে যান।
মামুকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে এসে জাহাঁজেব মীরকে সাবধান করে দেয়। - ওয়লীর নকল ভুলেও করতে যেও না। দকনী কাপড় হলে দরিবাকলাঁর দোকান থেকে বিক্রী হয়ে যেত। দকনী শায়রী লিখলে আমাদের বিরাদরীতে ছ্যা ছ্যা করবে সবাই।
- অর্রে ভই, আমি দকনীতে লিখতে বলেছি নাকি? এই ভাষাটা তো আসলে তোমাদের দিল্লীরই ভাষা। অচেনা শব্দগুলোকে বাদ দিয়ে লেখো। যা রয়ে যাবে তার আভাস খুসরো আগে দেখিয়ে গেছেন। সেটাই খাঁটি রেখ্তা। নইলে তোমরা যা লেখো সেটা না ইয়াহাঁ কা, না ওয়াহাঁ কা।
পরে দুপুরের দিকে মির্জারা একটা গজল লিখে দেবার জন্য মীরকে আরো তাগাদা দিচ্ছিল। মীর বাধ্য হয়ে মনের সন্দেহটা ব্যক্ত করে - তোমরা কি আমাকে কোনো মুশায়রাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ? আগেই বলে দিচ্ছি, লাভ হবে না। আমি কোনো কাজের নই আর। বিদ্বানদের সামনে বলার মতো কিছু নেই। লেখাও বন্ধ।
মির্জারা বলে - মুশায়রা নয়, মহ্ফিলে নিয়ে যেতে চাই। রুখসানা বেগম কসম খাইয়ে দিয়েছেন যে সারাদিন তোমাকে হয় গাধার খাটুনি খাটাই অথবা উম্দা উম্দা তরীকায় মনোরঞ্জন করি। তাই এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যেখানে গেলে তবিয়ত ভালো হয়ে যাবে। আর তুমি সেই জিনিসটাও খুঁজে পাবে যার জন্য সব দেশের শায়ররা দিল্লীতে আসতে বাধ্য হয়।
- কী সেই জিনিসটা?
- বোলি। জবান। এখানকার মুখের ভাষা। বাজারে একরকম, মদের আড্ডায় আরেকরকম, ময়দানে এক, ম্যায়খানায় আরেক। আরে ভাই, তামাম দুনিয়ায় তুলনাহীন আর বেমিসাল দিল্লী শহর আসলে একটা চিড়িয়াখানা। সব দেশের পন্ছি উড়ে আসে। এখানে কত রকমের চিড়িয়া আছে যদি দেখতে চাও তো এই মহ্ফিলে যেতে হবে। কারণ এই আড্ডায় পাওয়া যায় না এমন চিড়িয়া নেই। তাদের প্রত্যেকের ডাক আলাদা, পালকের রং আলাদা।
মীর ‘না’ বলতে পারে না। আগ্রার মীরকে দফন করে সে একটা নতুন মীর হতে চাইছিল। পূর্বজন্মের কিছু যার মনে থাকবে না। সারাজীবনে কটাই বা মানুষ দেখেছে? বেশির ভাগ তার বাপের বন্ধু বা সহযোগী, যার অর্ধেক ছিল হতদরিদ্র ফকির। বাকি অর্ধেক আরো গরীব ফারসীর ছাত্র। ম্যায়কদায় মাতাল দেখেছে কিছু। বাকিরা নিম্ন বর্গের হিন্দু শ্রমিক। দেখার মতো শুধু ছিল এক আগ্রাওয়ালি। মীর হল এই সব রঙের মিশ্রিত একটা ধূসর জমি। সে চাইছিল নিজের মধ্যে থেকে এই সব কটা রং বরখাস্ত করে নতুন রঙের ধুলোয় নিজেকে গড়তে।
মির্জারা বলে – প্রথমবার যাচ্ছ। একটা তোহ্ফা তো কিছু নিয়ে যাবে? খালি হাতে সেখানে যাওয়া ভালো দেখায় না। যদি কেউ বলে মীর তকী কী উপহার এনেছেন আমাদের জন্য? তখন দেবার জন্য কী খুঁজবে তুমি? না গজানো দাড়ির চুল?
- আমি ওয়লী কিংবা বেদিলের একটা গজল পেশ করে দিতে পারি। ভূরি ভূরি এমন উদাহরণ আছে যা বেশির ভাগ লোক জানে না।
- নাঃ। নিজে যদি কিছু লিখে থাকো তো তাই নিয়ে চলো। পুরোনো হলেও চলবে।
মীর ওয়লীর জনপ্রিয়তাকে অতিক্রম করার আশায় সহজতম রেখ্তার ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছে অনেকবার। আগ্রার গরমে শুকনো আমবাগানে বসে সে লিখেছিল -
পত্তা পত্তা গুলশন কা তো হাল হমারা জানে হ্যায়
অওর কহে তু জিস সে এ গুল বে-বরগী ইজহার করেঁ
বাগানের প্রত্যেকটা পাতা হাল তো জানেই সারাক্ষণ
ফুল বলো আর কাকে এবার রিক্ত শাখার দেখাই মন
লেখাটা প্রকাশিত নয়। আগ্রাওয়ালিকেও শোনাবার সময় হয়নি। শোনাবার যোগ্য কিনা ভাবতে ভাবতে সুযোগ চলে গেছে। মীরের হাতের লেখা দিলকশ, মনোরম। লোকে বলে পেশাদার আঁকিয়েদের চেয়ে কম না। সে পুরো গজলটা যথাসম্ভব ছবির মতো নস্খের কায়দায় নকল করে মির্জাদের হাওয়ালে করে দেয়। - একমাত্র দরকারেই ব্যবহার কোরো। সাবধান করেছিল মীর। - নইলে না দেখানো ভালো। যদি আরো কিছু পালটাই।
শায়রীতে মীরের চাচাতোরাও একেবারে এলেবেলে নয়। গজলটা নিয়ে দুজনে খুঁটিয়ে পড়তে শুরু করেছিল। - বে-বরগী কথাটা কি এখানে ঠিক হল, তকী? পরে তৌহিদ সন্দেহ প্রকাশ করে। - কেউ কি বুঝবে? তার চেয়ে বেসব্র বললে কেমন হয়? যার সবুর সইছে না। অথবা বেকাবু? কারণ মন যার নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই তার কথাই তো বলা হচ্ছে। তোমার শরাব আর ম্যায়খানা নিয়ে ধাঁসু কিছু শায়রী আছে। তার মেজাজের সঙ্গে বেকাবু বেশ মানিয়ে যায়।
- তৌহিদ ভাই, বে-বরগী মানে পাতা ঝরে যাওয়া গাছের ডাল। যখন একটা ডালের সমস্ত পাতা ঝরে গেছে তখন সে কার কাছে নিজের ইশ্কের ইজহার করবে? তার তো আর কোনো পাতাও অবশিষ্ট নেই।
- কিন্তু আমি তো ভাবতাম বে-বরগী মানে মজবুরী। নিরুপায় হওয়া।
- হ্যাঁ সেটাও। দুটো মানেই হয় কিনা তাই শব্দটা বসেছে এখানে।
এত খাটনির পরেও মীর গজলটা লিখে সন্তুষ্ট হয়নি। ওয়লীকে ছাড়াতে হলে দ্বিতীয় ছত্র আরো সহজ করা দরকার। শায়রীর উপমার মধ্যে বুদ্ধিদীপ্ততা নয়, তাতে এমন একটা কিছু চাই যা শ্রোতারা তাদের শরীরে, মনে, জীবনের অভিজ্ঞতায় অনুভব করতে পারে। ‘বে-বরগী ইজহার করেঁ’ সত্যিই দিল্লীর গলির ভাষা হয়নি। এই পঙ্ক্তিটাতে মীর তার সারাজীবনের তালিম দেখতে পায়। যে তালিমটাকে আগ্রাতে জ্বালিয়ে দিয়ে সে নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছিল।
মির্জাদের বাড়িতেই রুটির ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল। বিকেলবেলা দুভাই যত্ন করে গায়ে ইত্র লাগাতে শুরু করেছে। মীর প্রমাদ গুনেছিল।
- আমরা কোথায় চলেছি? সে শুধোয়।
মির্জা ভাইরা জবাব না দিয়ে হাসে। তৌহিদ মীরের লেখা একটা পুরোনো শেরই তাকে শুনিয়ে দিয়েছিল। ম্যায়খানার গজল। দিল্লীর মাঝখান দিয়ে শরাবের নদী বয়ে যায়। সেই শহরের লোকেদের মদ ছাড়া আর কী চাই? শোনা মাত্র লুফে নেয়। মদ আর শরাবখানার জয়গান করে তাই সবাই লেখে। মদের বদলে মীর চেয়েছিল একটা খালি পেয়ালার আশ্রয়। সেটাই এখন সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে গেছে।
ইয়ারোঁ মুঝে মুআফ রখো ম্যাঁয় নশে মেঁ হুঁ
অব দো তো জাম-এ-খালী হী দো ম্যাঁয় নশে মেঁ হুঁ
বন্ধুরা মাফ কোরো আমায় - নেশায় রয়েছি আমি
এবার পেয়ালা খালিই দিও - নেশায় রয়েছি আমি
সত্যি বলতে কি, মীর এই ছত্রগুলো শরাবের নেশায় চুর হয়ে মোটেও লেখেনি। সে অন্য একটা নেশার কথা বলতে চাইছিল। জীবনের নেশা। বেঁচে থাকার আনন্দ। যে অনুভূতিটাতে সে অষ্টপ্রহরের প্রত্যেকটা মুহূর্তে এমন অসহায় ভাবে ডুবে থাকত যে তার নিজেরই ভয় হত এর বেশি কারো সহ্য হয় না।
তৌহিদ তাকে বলছিল - মীর তকী, আসল দিল্লীকে কব্জা করতে হলে মুশায়রা নয়, যে মহ্ফিলটাতে আমরা যাচ্ছি সেরকম মহ্ফিলগুলোকে জিতে নিতে হয়। আসলি দিল্লী একটা নিজাম-উল-মুল্কের যুদ্ধের ময়দানের মতো। এখানে পাত্তা পেতে গেলে বুদ্ধি আর জিগর দুটোই লাগে। ওয়লী যেটা পারেননি। বেদিলের ক্ষমতায় কুলোয়নি। শহরের সব গলি জেতার হাতিয়ার তাঁদের কাছে ছিল না।
- সে হাতিয়ারটা কী? মীর প্রকৃতই কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে।
- বে-শরমী। বদ্তমীজী। বে-লাগাম গুস্তাখী। তৌহিদ জাহাঁজেবের দিকে চোখ টিপে মীরকে জানিয়েছিল। - কিস্মত সে তোমার মধ্যে যেটা অতিমাত্রায় আছে।
‘হ, হ’ করে দুই ভাই আবার হাসছিল, আর তারা সত্যি বলছে না সব বানানো সেটা মীর ধরতে পারছিল না।
(বইমেলা ২০২৫-এ পরবাসের প্রকাশনা)