(দিল্লী, ১৭৩৯)
সজ্দাবাঈ
বিকেলে মির্জারা যেখানে মীরকে ধরে নিয়ে যায় সেটা চাওড়িবাজারের এক তওয়্যাইফের কোঠা।
সজ্দাবাঈয়ের ঝরোখার বাইরে আগেকার দিনে ছোকরা থেকে প্রবীণ বিশ-বাইশজন পুরুষ উপর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকত কোনো নতুন হসীনার এক ঝলক মুখ দেখার আশায়। এখন দিল্লীর ভোল আলাদা। চারটে মোটে লোক দাঁড়িয়ে। দুজন সজ্দাবাঈয়ের কর্জের সুদ নিতে এসেছিল। বাকি দুজন তওয়্যাইফের দালাল।
এই তাহলে আসলি দিল্লী?
সেদিন কোঠায় প্রবেশ করার সময়ে মীর বুঝতে পারেনি যে তার জীবনের স্রোত একটা অন্য খাতে বইতে শুরু করেছে।
ঢুকেই মীর সজ্দাবাঈকে দেখতে পায়। সলমা-চুমকি-জরি আর গয়নায় অপ্সরার মতো সেজে সজ্দাবাঈ বুক চাপড়ে কাঁদছিলেন। - নাদির শাহ এতগুলো মাথা কাটল, আমার মুণ্ডুটা কেন কেটে নিয়ে গেল না? আসলে তিনি যাই করেন অপূর্ব নাচের ভঙ্গিমায় করেন। চোখ ফেরানো যায় না। মীরও ফেরাতে পারেনি। তাঁর প্রতিটি হাতের ভঙ্গীকে সে সম্মোহিতের মতো অনুসরণ করে চলেছে।
সজ্দাবাঈ কাতরভাবে বলে যাচ্ছিলেন – নবাবরা ইরানীদের সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে যান। সকলেই বেঁচে গেছেন। কিন্তু তারপর রাতারাতি কেউ গোরুর গাড়ি, কেউ ইক্কায় চেপে গাজিয়াবাদ, মেরঠ, ফতেহপুরে পালিয়ে গেলেন। সিপাহী-উপাহী, মনসবদারদের নোকর, আর কারখানার উস্তাদরা আগে আসত। কেউ দিত চাঁদির সিক্কা, কেউ দিয়ে যেত নিজের হাতে তৈরি রসোইয়ের সরঞ্জাম। এদের অর্ধেককে পাষণ্ডরা নির্মমভাবে গলিতে কচুকাটা করেছিল। বাকিরা বিবি-বাচ্চাদের নিজের হাতে কৎল করার পর আত্মহত্যা করেছে। যারা মরতে পারেনি তাদের হাতে পায়ে শিকল বেঁধে গোলাম বানিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন যে কজন পড়ে আছে তাদের জন্য আগের কারখানাগুলো আছে নাকি? না আছে বাদশার তোষাখানা, না আছে কোনো ফোতাখানা। কাউকে চাকরি দেবার মতো পয়সা আসবে কোথা থেকে?
সজ্দাবাঈয়ের মহ্ফিল সত্যি ফাঁকা। মোটে ছ-জন আজ। তার মধ্যে দুটো ভাঙোড়ি আর দুজন লাহোরী। মীর প্রথমে তাদের ভালো করে নজরও করেনি। যতই রাত এগোচ্ছিল, ততই অবশ্য চরিত্রগুলো তাকে কখনো মুগ্ধ এবং কখনো বিস্ময়ে হতবাক করতে শুরু করে। ফারসী গজলে এবং সুখনে সে এইধরনের চরিত্রের উল্লেখ পায়নি। এদের মুখের বুলিরও কোনো ছায়া নেই সেখানে। বিশেষ করে ভাঙোড়ি দুজন তাকে আকৃষ্ট করে। জামাকাপড় নোংরা নয়, কিন্তু অগোছালো। চুল উস্কোখুস্কো। এরা না ফকির, আর না দোকানদার। তাহলে এদের পরিচয় কী?
ঠিক একটা ছোট ঠুংরি যতক্ষণ চলে ততক্ষণ কান্নাকাটি করার পর সজ্দাবাঈ পান আনিয়ে দিলেন। মির্জা ভাইদের একটা করে টাকা সেলামি দিতে হয়। কোঠার মালকিন টাকাগুলো দু-চোখে ঠেকাবার পর লাহোরীদের জিজ্ঞেস করলেন – আপনারা এত দূর থেকে এখানে কী কাজে এসেছেন? কারোবারে গণ্ডগোল বুঝি? কিছুদিন গা ঢাকা দেওয়া প্রয়োজন?
লাহোরীরা হাত তুলে দেন। - না, না। একটা শখ বলতে পারেন। আসলে, আমরা দিল্লীওয়ালা হয়ে যেতে চাই।
- বাঃ, সে তো খুবই ভালো কথা। এখানে হভেলী-উভেলী নেবার ইচ্ছে? মাথা গোঁজার কোনো আস্তানা কিনেছেন কি?
- বলতে পারেন। মানে একটা করে পগড়ি…।
- পগড়ি? সর্-পে পেঁচিয়ে বাঁধে যেটা?
- হ্যাঁ, সজ্দাবাঈ। এসেই কিনে নিয়েছি।
- লে হল্ওয়া! চোখ কপালে উঠে যায় কোঠার মালকিনের। - কিন্তু কেন?
- বাদশার ফোতাখানা খালি…
- তো?
- শুনেছি পগড়ির জন্যও খাজনা দিতে হয়। এখন তাই সেটাকে আস্তানা বলে কবুল করা হচ্ছে শহরে। ছোটি হভেলী বলা হচ্ছে নাকি…।
সজ্দাবাঈ পশ্চিমী লোকগুলোর বোকামিতে ছটফট করে ওঠেন। - বিলকুল ঝুট! মোটেও সত্যি নয়। এইসব ভুলভাল খবর আপনারা দাদ আর খুজলির মতো চারদিকে ছড়ান। ফলে লাহোর থেকে লখনউ অবধি দিল্লীর বদনামী হয়। আরে তিজোরী সেঠ, বড়ো হভেলী কিনেও দিল্লীওয়ালা হওয়া যায় না। দিল্লীওয়ালা হতে গেলে সব হারাতে হয়। এখানকার গলি আর কুচায় বাপ-দাদা-পরদাদার কাছ থেকে পাওয়া হৃদয়টাকে চকনাচুর হতে দিতে হয়। তার গুঁড়োগুলো যখন দিওয়ার আর ঝরোখার ধুলো হয়ে চিরকালের জন্য শহরের আহ্-এর মধ্যে মিশে যায় তখন একটা মানুষ নিজেকে দিল্লীওয়ালা বলতে পারে। তারপর তার শরীরটাকে ঘষটে টেনে ইলাহাবাদে নিয়ে গেলেও সে দিল্লীওয়ালাই থাকে।
লাহোরী সেঠরা মাথা নিচু করে বললেন – কী মুশকিল! ঢিলে পাজামাও কিনেছিলাম সজ্দাবাঈ। এত ঢিলে যে তার মধ্যে অর্ধেক লাহোর ঢুকে যেত। কিন্তু দিল আর জিগর আমাদের কিছুতেই চকনাচুর হচ্ছে না। সেটা কী করে করতে হয়?
সজ্দাবাঈ হাসতে লাগলেন। নিজের সাঙ্গোপাঙ্গোদের ডেকে বললে – কোথায় তোরা মুন্নি, চুনারী, জোহারা, শুনে যা লাহোরী মেহমানরা কী বলছেন। দিল্লীতে এসেও এঁদের দিল চকনাচুর হচ্ছে না। আমাদের পক্ষে কী লজ্জার ব্যাপার। তারপর নিজের দেহটাকে মেঝের উপর সর্কাতে সর্কাতে তিজোরী সেঠের কাছে গিয়ে তাঁর বুকে কান রেখে বললেন – যা ভেবেছি তাই। কোনো ধড়কনই নেই।
লাহোরী সেঠরা চমকে গেছেন। - ধড়কন নেই? কী বলছেন সজ্দাবাঈ?
- কিছু মনে করবেন না তিজোরী সেঠ, আপনার নরম বুকের ভিতর ক্যাঁচ-কোঁচ করে যেন একটা কলুর ঘানি চলছে। তাতে না আছে কোনো উঁচনীচ, না কোনো থরথরানি। মাঝে মাঝে থেমে উলটোদিকে যাচ্ছে না। একটা বেজান বলদের মতো চলতে থাকার নাম কি ধড়কন হতে পারে?
- তার মানে আমরা লাহোরে খালি হাত ফিরে যাব?
- তা কেন যাবেন? হভেলী চাইলে হভেলী কিনুন, চশমা চাইলে চশমা। ব্যবসা বাঢ়ান এখানে। আমাদের গরীবখানায় তশরীফ রাখতে থাকুন। দিল আপনার চকনাচুর হবেই। সেটা আমাদের উপর ছেড়ে দিন। আগে ধড়কনটাকে জাগাতে হবে। তারপর চাওড়িবাজার থেকে দরিবাকলাঁ অবধি গলিতে গলিতে আপনাদের হৃদয় কাঁচের আতশদানের মতো ভেঙে ছড়িয়ে যদি না যায় তো শহর থেকে কোঠা তুলে দেব আমি।
মীরের দুই সঙ্গী এতক্ষণ বসে মুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছিল। তারা বলল – আমাদের এই তরুণ অথচ ফারসীতে উস্তাদ দোস্তের দিল-ও-জিগরে কিন্তু এই বয়সেই গহরী চোট লেগেছে। দিন কে দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। তার কী করা উচিত বলুন?
সজ্দাবাঈ তাঁর কাজলের গণ্ডিতে শক্ত করে বেঁধে রাখা বড়ো বড়ো চোখ দুটো মির্জাদের দিকে তুলে বললেন - ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছেন এঁকে। সবচেয়ে ভালো হবে আমাদের কাছে ছেড়ে যান। জন্নতের হুরীর মতো এক সে এক সুন্দরী আছে আমার কাছে। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। আপনাদের দোস্তকে বলুন ছ-জনকে বেছে নিতে।
- ছ-জন? চোখ কপালে তুলে বলে তৌহিদ। - ছ-জনকে সামলাবে কী করে? ছেলেটা মাসুম।
- অসুখ কঠিন হলে একটা মাত্র দাওয়াইয়ে কাজ হয় না। এদের কারো স্বভাব চাঁদের আলোর মতো ঠাণ্ডা, কেউ আতিশের মতো গরম, আর কেউ ফুলঝুরির মতো না ঠাণ্ডা না গরম। কত যে মেয়ের ঘর উজড়ে গেছে। রোজ কিছু বেওয়া আওরত এসে আশ্রয় চায়। আমি এতজনকে রাখব কোথায়? কিছু তো কাজে লাগাতে হবে? দুটো ঘর দেব। এক মাস থাকুন। ইশ্কের আগুন এমন জিনিস তার হাত ছাড়িয়ে পালানো যায় না। তার মধ্যে আরো ভালো করে ডুবে যেতে হয়। জিগর একদম পুড়ে ছাই হবার পর যমনাজীর জল ঢাললে তবে শান্তি।
মীর এই রকম খুলে-আম স্পষ্টবাদিতায় অভ্যস্ত নয়। নিঃসন্দেহে বেদিলও এখানে বে-আওয়াজ হয়ে যেতেন। কিন্তু আগ্রা থেকে পালানো মীর জানত এই নতুন রঙগুলোতেই নিজেকে সিক্ত করা তার প্রয়োজন।
- আপনি হিন্দু ছিলেন? সে কথাটা ঘোরাবার জন্য সাহস জুটিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল।
- ফারসীতে হিন্দু শব্দটার একটা মানে চোর। আরেকটা মানে দিল-চোর। আপনি কোনটার কথা ভাবছেন তরুণ মেহ্মান? সরলভাবে জিজ্ঞেস করলেন সজ্দাবাঈ।
- আমি বুতপরস্ত্দের কথা বলছি। যারা মূর্তির সামনে নত হয়ে সজ্দা করে।
- তওয়্যাইফের কি কোনো মজহব হতে পারে? আমাদের সব রঙে রঙিন হতে হয়। এখানে আসতে থাকুন। এর মানে কী ঠিক বুঝে যাবেন।
জাহাঁজেবদের একটা কারখানা আছে। কোনো এক কালে তাদের পূর্বপুরুষরা সিপাহী ছিল। এখন ফৌজের জন্য ঢাল আর জুতো বানায়। তার প্রথম চিন্তা হল পয়সার ফিজুল খরচ না হওয়া আর মুনাফা। সে বলে - আচ্ছা সজ্দাবাঈ, যদি একমাস পরেও জিগর ছাই না হয় তো? টাকাও গেল আর আরামও হল না। তখন?
সজ্দাবাঈ আকাশের দিকে তাকাবার পর একটু হেসে বললেন - আরে মির্জা, জওয়ান আদমীর ভিতরটা যদি না জ্বলে তো তার দুনিয়া রোশন হবে কী করে? সে কি যমনাজীর কিনারে ফকিরী করে জিন্দগী গুজরে দেবে? ইশ্কের আগুন কিস্মত সে হাথে আসে। একে কখনো নিভতে দিতে নেই। শুধু জ্বালাটা অন্যকে দিয়ে দিতে হয়। হুরীর মতো সুন্দরী ছজন মেয়ে সেই দুষ্প্রাপ্য জিনিস একটু একটু করে ভাগ করে নেবে। তোমাদের এই গুণী দোস্ত যখন তাদের প্রত্যেকের গলার গমক, ঘুঙুরের ছমক, চুলের মহক, চলার ঠমক, দিলের ধড়ক, নিঃশ্বাসের তড়প, আর চোখের আলো আলাদা করে চিনতে শিখে যাবে, আর এদের কারো মন খারাপ হলে যখন তোমার বন্ধুর চোখ দিয়ে ছটা আলাদা রকমের জল বেরোবে, তখন সেই আতিশ-এ-জিগর আর তাকে কোনো কষ্ট দেবে না। এখন প্রশ্ন হল দিনে এক টাকা করে ঘর ভাড়া কি তোমাদের বন্ধু দিতে পারবে?
- আজ না পারলেও একদিন পারবে। আপনাকে বলিনি সজ্দাবাঈ, এই ছেলেটা যে সে মানুষ নয়। ওর নাম মীর তকী। শায়রী লেখে ‘মীর’ তখল্লুস নিয়ে। এই বয়সেই শাহজাহাঁবাদে লোকে ওর গজলের জন্য পাগল। এক দিন পুরো দুনিয়ার লোক চিনবে। খ্বাজা নাসিমুদ্দীন ওকে এত ভালোবাসেন, ঘাড়ে ধাক্কা দেবার আগে জরুর একবার বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেন।
- খ্বাজা একে বুকে লাগান? তাহলে তো খুব কাম কী চীজ, কারণ আমরা সেখানে মুখ ঢেকে গেলেও বসতে বলে না কেউ।
- আপনি ওকে এমনিতেই রেখে নিন না। যেখানে ইচ্ছে সঙ্গে নিয়ে যান। সব জায়গায় দরজা খুলে যাবে।
- হুম্, তাই নাকি? আচ্ছা, সে যবে হবে তবে হবে। এখন সবাই পান তো খান।
বুলবুল, ইলায়চী, আর বাইস-কা-বীসের রুমাল
ভাঙোড়িরা পান তুলছে না। কোঠার মালকিন তাদের দুজনের দিকে নিজের কৌতূহলের মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন এবার। নাচের ললিত মুদ্রায় একটা করে আদাব উপহার দিয়ে তিনি বললেন – জনাব, আপনাদের তো এ-পাড়ায় আগে কোনোদিন দেখিনি, যদিও মনে হয় এই শহরের লোক। আপনাদের তারীফ কী এবং কী দেখে আজ এমন জংলী জানোয়ারের মতো আমার কাছে পালিয়ে এসে লুকিয়েছেন সেটা মেহেরবানী করে জানান।
ভাঙোড়িরাও আদাব ফরমায়। তারপর একজন বলে - সজ্দাবাঈ, আমার নাম বুলবুল খান আর আমার সঙ্গীর নাম নূর আলী যাঁকে ইলায়চী আলী বলে হিন্দুস্তানের সবাই চেনে। আপনি কী করে বুঝলেন আমরা পালিয়ে এসেছি?
- একজনের পায়ে একপাটি চটি, ঘামের জন্য সব সূর্মা গলে গেছে, জামা-কাপড় ফর্দাফাঁই, হাত-পা ছড়েছে। মাথার চুলগুলো খাড়া। সন্ধ্যেবেলা কি জনাবে-আলীরা এইভাবেই সাজগোজ করেন?
- ওঃ, তাই বলুন। ফয়েজ বাজার থেকে দৌড়োচ্ছি। সেখানে আবার পল্টন বেরিয়েছিল।
লা হওল বিলা কুব্বত! একটা সমবেত আর্তনাদ উঠে আসে সবার গলা থেকে। - আবার পল্টন? ইয়া খুদা। কবে এই আফতের হাত থেকে আমরা মুক্তি পাব?
পল্টন আবার কী? কার পল্টন? মীর এসবের অস্তিত্বের কথাই জানত না। লাহোরীরাও ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি। – কীসের পল্টন? তাদের একজন জিজ্ঞেস করে। - ইরানীরা কি দিল্লীকে ভালোবেসে আবার ফিরে এল? নাকি মারাঠা? আরেকজন বলল - লাহোরের সিখ হলে তো গজব হয়ে যাবে। না একটা হভেলী ছাড়বে, না ছাড়বে পাগড়ি।
সজ্দাবাঈ হাত তুলে বলেন - তিজোরী সেঠ, তরকারী সেঠ, মাথা ঠাণ্ডা করুন। কিছুই জানেন না দেখছি। সিখদের কথা হচ্ছে না। নাদির শাহের ফৌজ ফিরে যাবার পরে শহরে যে শাহজাহানের সময়কার কাটা নালা আর নহর আছে সেগুলো থেকে মুর্দা মানুষদের পল্টন উঠে এসে চাঁদনি রাতে কুচকাওয়াজ শুরু করেছিল। দেখলে মনে হয় অবিকল একটা ফৌজ। আসলে ছায়া আর নর্দমার বাষ্প দিয়ে তৈরি।
তিজোরী সেঠ আর তরকারী সেঠ চোখ কপালে তুলে বললেন – মানে ভূত?
- ভূত ভাবলে ভূত। সপনা ভাবলে সপনা। লোকে বলে শুধু মোহম্মদ শাহ নয়, অওরঙ্গ্জেব আর বাবরের যে সব বদ্নসীব পেয়াদা আর ঘুড়সওয়ারগুলো পানিপত বা গোলকুণ্ডায় হালাল হয়েছিল তারাও পল্টনে আছে নাকি। হাজার হাজার রাজপুত, চৌহান, তুর্ক, তাজিকী। শাহী ফরমানের দম এত কমে গেছে যে খুলে-আম মুর্দারা এসে রাতের শহরে কুচকাওয়াজ করে।
বুলবুল খান নামের ভাঙোড়ি বললেন – সজ্দাবাঈ, শহরে জিন্দা মানুষ অবশিষ্ট না থাকলে এই হয়। শুধু ফৌজী নয়, একশো বছর আগে দফনে দেওয়া মুচি, নাপিত, লুহার, ছুতোর, বঢ়ই, কারো নোকর, কারো দাদি, বাচ্চাদের দাই… রাত হতেই খুরপি, সাঁড়াশি, ক্ষুর, কাঁচি নিয়ে মার-মার বলে উঠে আসে রাস্তায়। তাদের চোখ থেকে বেরোনো লাল আগুনের ফুলকি দেখলে কব্জ্ ঢিলে আর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।
ইলায়চী আলী, যিনি একটা চটি রাস্তায় ছেড়ে এসেছিলেন, যোগ করলেন – শুধু মানুষ নাকি? ঘোড়া, হাতি, বাঁদর, সজারু, ছাগল, আর মুরগিদের যারা পল্টনের সাথে মরেছিল তাদেরও রাগের চোটে পুরীর মতো ফুলে কস্বার নালি-নালা থেকে উঠে আসতে দেখেছি। মুখ দিয়ে তুবড়ির মতো ছুটছিল এমন কদর্য গালিগালাজ যে জাহিলরাও কানে আঙুল দেবে। গুস্তাখী মাফ হলে কয়েকটা শোনাতে চাই।
সজ্দাবাঈ ভাঙোড়িদের থামিয়ে বললেন – এখানে একটা কমসিন নওজওয়ান ছেলে বসে আছে, যার দাড়িও গজায়নি, আর আপনি গালি-গলৌজের ভাষা ইস্তেমাল করতে চাইছেন? অক্ল্ কি ঘাস চরতে গেছে? আজ ওসব থাকুক, পরে এসে আমাকে জানিয়ে যাবেন। এখন বলুন ফয়েজ বাজারে রাত্রিবেলা কী করছিলেন এবং সেখান থেকে এতদূর চলে এলেন কী করে?
ইলায়চী আলী সবাইকে বারবার আদাব করে বললেন – আমার নাম ইলায়চী। বুলবুল খান আর আমি ছোটবেলা থেকে পরস্পরের বন্ধু। আমাদের এক তৃতীয় বন্ধুর নাম লছমীপরসাদ ওরফে লালা লচ্ছু। আমরা তিনজন রোজ বিকেলবেলা শা’অদদুল্লাহ্ চকে চলে যাই। সেখানে বহু মুসাফির কেনাকাটা করে। দেশ পরদেশের জাদুগররা খেলা দেখায়। সেখানে আমরা বাইস-কা-বীস বানাবার কাজ করি।
এখানে সজ্দাবাঈ ইলায়চী আলীকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেন – মেহেরবানী করে বাইস-কা-বীসটা কী ধরনের কাজ একটু বুঝিয়ে বলুন।
ইলায়চী আবার বুলবুল খানের সঙ্গে চোখাচোখির পর বললেন – লাল কিলা থেকে শুরু করে শহরের আকবরাবাদী দরওয়াজা পর্যন্ত গিয়েছে ফয়েজ বাজার। তার মাঝ বরাবর বেহেশ্ত নহরের একটা ধারা বয়ে যায়। কিলার ঠিক বাইরে শা’অদদুল্লাহ্ চকের একধারে আমরা একটা রেশমের রুমাল পেতে রাখি। তার মাঝখানে পঁচিশটা চৌকো ঘরের উপর পঁচিশজন ফেরেশতার নাম লেখা। সেই রুমালটাকে বলে বাইস-কা-বীসের রুমাল। পুরো দুনিয়ায় এরকম মাত্র তিনটে আছে। দূর দূর থেকে লোকেরা বাইস-কা-বীসের রুমালে টাকা গায়েব করতে আসে।
- টাকা গায়েব করতে আসে? সজ্দাবাঈ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন? – তার মানে?
- ঘরগুলোর মধ্যে জেব বানানো আছে। লোকেরা বাইশটা নিজের পছন্দ মতো ঘর বেছে নিয়ে প্রত্যেকটার ভিতরে একটা করে সিক্কা রেখে দেয়। তারপর আমরা রুমালকে চার ভাঁজ করার পর একটা ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে একটু দোয়া করি। ঝুড়ি সরিয়ে নিলে দেখা যায় বাইশের জায়গায় কুড়িটা সিক্কা পড়ে আছে। সবার চোখের সামনে দুটো একেবারে উধাও। এই হল বাইস-কা-বীসের খেলা যার জন্য রাত অবধি লোকেরা আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে।
- হ্যাঁ-য়-য়-য়! বিস্ময়ে সজ্দাবাঈয়ের চোখদুটো প্যাঁচার চোখের মতো গোল হয়ে গেছে। তিনি বাকি সবার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এদিক ওদিক তাকালেন। মীর কম অবাক হয়নি। শহরে এরকম বিচিত্র মানুষ আছে এবং এত রক্তপাতের পরেও তাদের জীবনের ধারা অব্যাহত সেটা চাওড়িবাজারের কোঠায় না এলে সে জানতে পারত না। সেও সজ্দাবাঈয়ের চোখে চোখ রেখে মাথাটা নাড়িয়ে দেয়।
- সিক্কা দুটো যায় কোথায়? সজ্দাবাঈ সবাইকে জরিপ করার পর শুধোলেন।
- যে ফেরেশতার জেব থেকে রুপিয়া গায়েব হয়, বুঝতে হয় সেই ফেরেশতা খরচ করে ফেলেছেন।
- লা হওল বিলা কুব্বত! মাশা-আল্লা, এই দুর্দিনে টাকা বানাবার যা তরকীব বার করেছেন, ‘বহুৎ খুব’ বলব না ‘লানত হ্যায়’ বলব জানি না। লোকেরা আদৌ আপনাদের রুমালে টাকা লাগায়?
- কী বলছেন, সজ্দাবাঈ? মুসাফির যে কজন আসে প্রায় সবাই একবার লাগিয়ে যায়। এখন লোক কম, তবে ইরানীরা আসার আগে এমন সময় ছিল যখন রুপিয়া গায়েব করাবার জন্য মানুষের কাতার পড়ে যেত। আজও যার কাছে একটা সিক্কা আছে সে একুশজন সঙ্গী নিয়ে এসে সাঁঝা করে লাগায়। যে যত বেশি টাকা লাগিয়েছে সে তত বেশি ইয়ার-দোস্ত ভাইপো ভাগ্নেকে টেনে নিয়ে আসে যাতে তারাও টাকা গায়েব করাতে পারে।
- লাভ হওয়ার কোনোই উপায় নেই? প্রতিবার দুটো করে সিক্কা লোকসান?
- ফায়দার উম্মীদ বিলকুল শূন্য। বরং সিক্কা গায়েব না করাতে পারলে আমরা পাঁচজনের চড়-চাপড় কবুল করি। রুমালের উপর ভরসা না থাকলে কে খেলত বলুন? রঈস দিল ইন্সান হলে পুরো পচ্চীস রুপিয়া লাগিয়ে এক লপ্তে গায়েব করায়। এই কাণ্ডটা ঘটে গেলে তো গোটা বাজার জুড়ে শুধু ‘ওয়াহ্ বুলবুল’, আর ‘ওয়াহ্ ইলায়চী’, আর ‘ওয়াহ্ রে লচ্ছু’!
- ওয়াহ্ রে বুলবুল, ওয়াহ্ ইলায়চী! অবশ্য করবেনই বা কী? আপনাদের অবস্থা আমাদের মতো। শহরে কাজ নেই, মানুষ নেই। মুসাফির আর বিদেশীরা ভরসা। আজ আপনাদের কত রোজগার হয়েছিল?
- সজ্দাবাঈ, ভুল বুঝবেন না। গায়েব হওয়া সিক্কাগুলো ফেরেশতারাই নিয়ে নেন। আমরা কখনো চার আনা, কখনো ছ আনা বখশিশ পাই। কিন্তু আজ সব হারিয়ে শুধু প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছি। সেই কিস্সাটা এবার বুলবুল খান বয়াঁ করবেন।
– তাই যদি হয় তো তনিক দাঁড়ান, আমি এক্ষুনি আসছি। সজ্দাবাঈ নিজের আসন ছেড়ে উঠে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পথে বললেন। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে আসেন তখন তাঁর সঙ্গে পান চিবোতে চিবোতে নাচের মুদ্রায় হেঁটে আসরে অবতীর্ণ হলেন আরো দুজন অল্পবয়সী খাতুন। সজ্দাবাঈ পরিচয় করিয়ে দেন। - ইনি হলেন লুৎফ আর ওনার নাম চমন। এরকম একটা খাস কিস্সা, শুধু একা শুনব কেন?
সবাই আসন গ্রহণ করার পর ভাঙোড়ি বুলবুল খান মহ্ফিলের অনুমতি নিয়ে শুরু করলেন। - আজ বাইস-কা-বীসের খেলা দেখিয়ে ফেরার পথে আকাশে চাঁদ উঠে গিয়েছিল। শা’অদদুল্লাহ্ চকের লোকগুলো ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে, রাস্তার দুধারের আলোগুলো মিটমিট করছিল। নহরের পানি একটা অতিকায় জন্তুর মতো ফুলছে। আমরা যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব গা ছমছমে জায়গাটা পেরিয়ে আসছিলাম। লম্বায় খাটো আর হৃষ্টপুষ্ট লালা লচ্ছু বেজায় হাসিখুশি আর দিলদরিয়া লোক। সন্ধ্যেবেলা কয়েকটা গাঁজার লাড্ডু খেয়ে উম্দা মেজাজে ছিলেন। ফয়েজ বাজারের মাঝামাঝি এসে উনি, “গুনাহের বোঝা একটু হালকা করা যাক”, এই বলে নিজের থলে থেকে একটা টাকা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে এই চলতি গানটা গেয়ে ওঠেন –
সোনা লে লে, চাঁদি লে লে, চুহে কী চুস্তানী লে লে
দুম দবাকর ভাগ রে ফৌজী, দিল্লী যায়ে ভাড় মেঁ -
সজ্দাবাঈয়ের মুখে চোখে অবিশ্বাস ফেটে পড়েছে। – লচ্ছু মিঁঞা বাদশার ফৌজীদের এইভাবে বেইজ্জতী করে দিলেন?
- লালা লচ্ছু ঠিক ওই ধরনের মানুষ। এদিকে চাঁদির সিক্কাটা বন বন করে ঘুরতে ঘুরতে সেই খালের দিকে চলেছে, সন্ধ্যের পর যার দিকে তাকানোও মুনাসিব না। ইলায়চী আলী আর আমি দুদিক থেকে বাজ পাখির মতো লাফ মারি। কিন্তু কিস্মত খোটা, ইলায়চী আলীর আঙুল ছুঁয়ে দেবার পরে টাকাটা ছিটকে খালের উপর চলে যায়। তারপর একটা অশৈলী ব্যাপার। বেহেশ্ত নালার অন্ধকার পানি জ্যান্ত পাঞ্জার আকার ধারণ করে সিক্কাটাকে হাওয়াতেই লুফে নেয়।
তওবা-তওবা আর বাপ-রে-বাপ ধ্বনি উঠেছিল মহ্ফিল থেকে। সজ্দাবাঈ চমন আর লুৎফকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন – ভয় করলে আপনারাও একটু কাছাকাছি এসে বসুন। এবার বলুন বুলবুল খান। কী হল এর পর?
সবাই সবার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসার পর বুলবুল আবার শুরু করলেন – লালা লচ্ছুর সুরেলা গলার রেশ তখনো যায়নি এমন সময়ে নহরের গভীর থেকে শত শত তলোয়ার, বর্শা, কুল্হাড়ি হাতে ছায়ার ফৌজ উঠে এসেছে। নাঙ্গা তলোয়ার ধরা তাদের ধূর্ত আর দোগ্লা সর্দার হাসি হাসি মুখ করে এসে মিষ্টি গলায় বলল – কী গাইছিলি সেটা আরেকবার গেয়ে দে না? আমরা তোকে কিচ্ছু বলব না। বেচারা লচ্ছু তাকে বিশ্বাস করে গেয়ে দিলেন – দুম দবাকর ভাগ রে ফৌজী, দিল্লী যায়ে ভাড় মেঁ…। ব্যাস, আর কী চাই? মার-মার আওয়াজ তুলে সেই ছায়ার ফৌজ আমাদের তাড়া করে আসে। আমরা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে আবার লাল কিলার দিকে দৌড়োই। ভারী-ভরকম লচ্ছু সবার পিছনে। ফৌজীরা ঘোড়া আর হাতির পিঠে তলোয়ার হাতে আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। খানিকক্ষণ পরে আমাদের জিগরী দোস্ত, আজন্ম হাসিখুশি লালা লচ্ছু, টলতে টলতে বেহেশ্ত নহরের জলে ঝপাং করে পড়ে যান।
- ইয়া খুদা! আপনারা কিছু করতে পারলেন না?
- আমরা দুজন সাঁতার শিখিনি, সজ্দাবাঈ। তাছাড়া ফৌজ এখন পুরো দমে আমাদের তাড়া করছিল। কখনো কানের পাশ দিয়ে ছোরা বেরিয়ে যাচ্ছে, কখনো ভালা। বুদ্ধি করে জামী মসজিদের পাতলি গলি ধরেছি, কারণ হাতি আর ঘোড়া সে গলিতে আঁটে না। দূর থেকে শুনছি – পকড়ো, পকড়ো, মারো, মারো! সবে ভাবছি যে হয়তো এই যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেলাম তখন গলির মধ্যে ছাগল আর মুরগির বাহিনী ঢুকে পড়ে। ফৌজের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে এইসব জন্তু থাকে। তাদের কাজ সিপাহীদের খাদ্য হওয়া। কিন্তু এই অক্কা পাওয়া রসদের জানোয়াররা উল্লুর মতো নিজেদেরকেও ফৌজের সিপাহী ভেবে আমাদের উপর হামলার জন্য চিৎকার করতে করতে আসছিল।
- এরাই অকথ্য গালিগলৌজ করে?
- বিলকুল ঠিক। তাদের তাড়া খেয়ে আমরা বাতাসাওয়ালা আর খুজলিওয়ালা গলি পিছনে ফেলে কসাইখানার কাছে এসে পড়েছি। দাহিনে বাঁয়ে গোশ্ত, কাবাব, আর নিহারীর দোকান। সামনের দেয়ালের গায়ে শিক থেকে লটকানো একটা মুর্গার ছবি। এইখানে আমাদের তাড়া করে আসা সবচেয়ে প্রকাণ্ড মুর্গাটা রাগে আগুন হয়ে উড়তে শুরু করে।
- বাপ রে বাপ! এত তেজ?
- হ্যাঁ, সাহিবান। অনেকটা উঁচুতে উঠে সেটা চিলের মতো নেমে আসছিল। তার উন্মত্ত দৃষ্টির মধ্যে যেরকম ঘৃণা ছিল তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই। যেন তোপ থেকে বেরোনো একটা ফিদায়ীঁ জিন। নিজের গুস্সার ভাট্টিতে ঝলসে বোটি কাবাব হয়ে যাচ্ছে। পালকগুলো আগুনের ফুলকি হয়ে ফুলঝড়ির মতো ছড়াচ্ছে। আমাদের সারা শরীর ঠাণ্ডা পড়ে গিয়েছিল, আর আমরা খোদার কাছে আত্মসমর্পণ করে কুরবানীর বকরার মতো দাঁড়িয়ে যাই। জালিম মুর্গাটা পর্যায়ক্রমে আমার এবং ইলায়চী আলীর বুকের মাঝখান দিয়ে ঢুকে দুটো শরীর এফোড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর সে সামনের দেয়ালটাকে চুরচুর করে ভিতরে সাজানো তন্দুরের শিকগুলোর মধ্যে একটায় গেঁথে “হায়, ম্যাঁয় মরা” বলে নিজের আখরী সাঁস ছেড়ে দেয়।
বুলবুল খান দম নেবার জন্য থেমে নিজের জেব থেকে একটু গুটকা বের করে খাচ্ছেন। হাসা উচিত না কাঁদা উচিত বোঝা না যাওয়ায় কারো মুখে কথা নেই। শেষ পর্যন্ত সজ্দাবাঈ নিজের কপালে একটা চাপড় মেরে বললেন – বুলবুল সাহিব, মুর্গাটা তো আগেই মরা ছিল! সে আবার মরবে কী করে?
- কে জানে, বাঈ। হয় ছায়ার সিপাহীরা ভাগ-দৌড় করতে গিয়ে জিন্দা হয়ে যায়, অথবা তারা কোনোদিন ভালো করে মরেইনি। মুর্গাটা বেরহমভাবে শূলবিদ্ধ হয়ে বহুক্ষণ তড়পায়। বাকি ছাগল আর মুরগিগুলো ‘বাঁচাও বাঁচাও’ ডাকতে ডাকতে পিছনে ফিরে পালিয়েছিল। কারণ আমাদের মতো তারাও সদ্য সদ্য বুঝতে পেরেছিল যে নাদির শাহের চঢ়াইয়ের সময়ে বুলবুল খান আর ইলায়চী আলী নামের মানুষ দুটো ছায়ার সিপাহী হয়ে গেছে। নইলে একটা জ্যান্ত মুর্গা দুজনেরই শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গেল কী করে? আমরা এখন না এই দুনিয়ার, না ওই দুনিয়ার। সেই সদ্মা আর শোক নিয়ে ছুটতে ছুটতে চাওড়িবাজারে এসে পড়ি। এখানে কোঠার নিচে দাঁড়ানো একটা লোক জিজ্ঞেস করল – বুক চাপড়াচ্ছিস কেন, রঙ্গীলা? আমরা কারণটা বললাম। তো সে বলল – শহরের অর্ধেক বাসিন্দা এখন না এই দুনিয়ার, না ওই দুনিয়ার, তো তোরা কোন ক্ষেতের মূলো? এইভাবেই টিকে থাকতে শেখ। যা ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যা, ওখানে সবার জায়গা আছে।
একটা সম্মোহিত বিরতি। সজ্দাবাঈ এদিক ওদিক করুণ দৃষ্টিতে সাহায্যের জন্য তাকাচ্ছিলেন। একটু আগেই যাদের জীবনস্রোত কোনোদিন থামবে না বলে মনে হচ্ছিল এখন দেখা যাচ্ছে তারা জীবিত না মৃত এ বিষয়ে নিজেরাই নিশ্চিত নয়। মীরের অবস্থা অবশ্য আরো শোচনীয়। তার ভিতরের শায়রটা মরে বেঁচেছিল। কিন্তু কোত্থেকে একটা ফারসী জানা মুনীব উড়ে এসে দেহটাকে চামড়ার থলের মতো টানতে টানতে নিয়ে ঘুরছে দিল্লীর রাস্তায়।
সে তার আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে বুলবুল আর ইলায়চীকে ছুঁয়ে বলল – মুর্গাটা এঁদের ভেদ করল কীভাবে জানি না, কিন্তু ছায়ামানুষ হলে এত হাড়, এত মাংস, আর বড়ো বড়ো দাঁত থাকত কি?
সজ্দাবাঈ চোখের ইশারায় মীরকে বললেন আরো ভালো করে দেখতে। মীর আরেকটু পরীক্ষা করে জানায় – দিলের ধড়কন আছে, নব্জ্ চলছে, গরম গরম নিঃশ্বাস পড়ছে নাক দিয়ে।
লুৎফ নামের মেয়েটা বলে – উপকার হবে যদি বলে দেন কারো মাথায় লুকোনো শিং আছে কিনা।
শুনে সবাই ‘জ্যাল তু জ্যালাল তু’ আওড়াতে লাগল। অনুরোধটা আদবসম্মত না। তাও মীর দুই ভাঙোড়ির মাথায় হাত বুলিয়ে শয়তানের এই দৈহিক নিশানার কোনো চিহ্ন নেই দেখিয়ে দেয়। অতঃপর লুৎফ নামক পাজি মেয়েটার বিনীত গুজারিশ আসে – মেহেরবানী করে লেজ আছে কিনা সেটাও তাহলে বাৎলে দিন।
মোহম্মদ মুত্তকীর ছেলে মীরের আর সহ্য হয়নি। সে বলে – দুটো জীতা-জাগতা খোদার হাতে তৈরি বান্দা আপনাদের সামনে বসে আছে। এঁদের জিল্লতী করে কি আপনাদের শোহরত বাড়বে, না রাতে ঘুম ভালো হবে? আমি ফকিরের অওলাদ, লোকে যা ইচ্ছে বলে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনো গানেওয়ালি নেই যার জন্য আমি ভুলে যাব যে আমার রগ দিয়ে সৈয়দের খুন দৌড়োচ্ছে।
রাগ উঠে গেলে মীর আর সেখানে দাঁড়ায় না। এটাও বাপের শিক্ষা। কথাটা বলে ফেলে সে সবাইয়ের উদ্দেশ্যে একটা আদাব ছুঁড়ে দেবার পর পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করেছিল। কোঠায় এমন একটা নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে যা নাদির শাহের চঢ়াইয়ের সময়েও কেউ দেখেনি। লাহোরী সেঠরা পান চিবোতে ভুলে থ হয়ে তাকিয়ে আছেন। মির্জা ভাইরা মীরের গুস্তাখীর জন্য ক্ষমা চাইবে না তার সঙ্গে উঠে যাবে ঠিক করতে পারছে না। মীর এই সমবেত কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার সুযোগ নিয়ে দরজার কাছ থেকে চটি গলাবার পর সিঁড়ি দিয়ে ফটফট করে নামতে থাকে।
অধুরা মীর
সাত-আট পা নামার পর একটা ক্ষুদ্র চাতাল। তারপর সিঁড়িটা ডানদিকে ঘুরে আবার নেমেছে। জায়গাটা ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। মীর পড়ে যাবার ভয়ে দেয়াল ধরে নামছিল। কিছুদূর গিয়ে একটা বন্ধ দরজা। ভিতর থেকে তবলায় হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজ আসছে। এর পর সিঁড়ি কোথাও যায় না। এ আমি কোথায় চলে এলাম? মীর ভাবে।
বিরাট পুরোনো বাড়িগুলো একাই একটা গোটা শহর। কোঠার নিচে তবলার দোকান। পাশে হয়তো মুসাফিরখানা। মীর তাড়াতাড়ি উপরে ফেরত যাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু চাতালটা পেরোবার আগে আবার রাস্তা বন্দ্। এবার আটকে দিয়েছে একটা জেনানার দেহ। মীরের জন্য ওৎ পেতে ছিল বলা যায়। দু হাত দিয়ে ঠেলে মীরকে সে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছিল। জাফরান আর চামেলির গন্ধের মধ্যে হাঁসফাঁস করে তরুণ সৈয়দ। জরির চোলী এসে গায়ে লাগে একবার। হাত দুটো ক্রমশ চাপ বাড়িয়ে দম বন্ধ করে দিচ্ছে। চরিত্রটা কে বোঝা যায় না। কানের কাছে সে বলেছিল –
কিস কা কাবা, ক্যায়সা কিব্লা, কৌন হরম হ্যায়, কেয়া এহ্রাম
কুচে-কে উসকে বাসিন্দোঁ নে, সবকো ইয়হীঁ সে সলাম কিয়া।
চাওড়িবাজারের কোঠায় এসে নিজের লেখা শায়রী শুনতে হবে এটা তরুণ মীর স্বপ্নেও ভাবেনি। বেদিল না। ওয়লী নয়, নুসরতী নয়, কুতব শাহ নয়, খান-এ-আরজ়ু নয়। অর্বাচীন নওসিখিয়া মীর! প্রকাশও হয়নি। মুখে মুখে রটেছে একটু। আগ্রার তকী প্রস্তরীভূত হয়ে যায়। মির্জা ভাইরা যা বলতে পারত না সেটা একজন তওয়্যাইফ বলে দিল কী করে? এদের আনপঢ় আর স্থূল রুচির মহিলা হিসেবে জানত মীর। অবশ্য শহরের পঢ়ালিখাদের রুচির প্রতিও যে তার খুব একটা শ্রদ্ধা আছে তা নয়। আট-দশ দিন ধরে নিজের সমস্ত লেখা জ্বালিয়ে দেবার কথা ভাবছে।
কার এই কাবা, কেন সেই অভিমুখ,
মসজিদ, হজের পোষাকই বা কী
তার গলির বাসিন্দারা সে বাড়ি থেকেই
সবাইকে দূরের সেলাম করেছিল।
- একটা গজল লিখে ফেললেই তার পুরো মানে ধরা যায় না। মীরের ছাতির উপর সওয়ার হওয়া জেনানা প্রাণীটা গলার স্বর গোপন করার জন্য তার কানে বলছিল। - সব গলি পেরিয়ে, যখন আশিকের আর হারাবার মতো কিছু নেই, তখনও একটা গলিতে যাওয়া বাকি থাকে। বাবুজী, এটা সেই গলি। এই গলির দাগ যার গায়ে লেগে যায় তার কি শরীফ পরিচয়ের প্রয়োজন আছে? সে তখন না মর্দ, না আওরত, না সিপাহী, না সৈয়দ। না তার মসজিদ, না তার কাবা। সে শুধু রাত আর দিন মরতে চায়। আজ বাড়িতে চলে যান মিঁঞা। কোঠায় যদি আর কোনোদিন আসেন তো সেদিন আসবেন যেদিন বুকের ভিতর না থাকবে আমীরীর রোয়াব, আর না থাকবে খানদানের গুমর। যেদিন একটা পাথরের উপর খড়ি দিয়ে লেখা অক্ষরের মতো নিজেকে মিটিয়ে দেবার ইচ্ছে ছাড়া আর কোনো খ্বায়েশ থাকবে না মনে সেদিন এ জীবন সম্পূর্ণ হয়। নইলে সে অধুরা।
তারপর অবয়বটা মীরের পশ্চাদ্দেশে একটা হালকা চাপড় মেরে তাকে রওয়ানা করে দেয়।
(বইমেলা ২০২৫-এ পরবাসের প্রকাশনা)