সেখানে পাইন আর ধুপী গাছের সারির মাঝখান থেকে পথ উঠে গেছে কোন নাম না জানা বনবাংলোর দিকে, যেখানে পাহাড়ের ধাপে ধাপে ছোট ছোট চাষের জমি সবুজে সবুজ হয়ে রয়েছে। নিউজলপাইগুড়ি থেকে এরকমই তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টার এক পথ পেরিয়ে, আমরা পৌঁছেছিলাম রামধুরায়—কালিম্পং-এর অখ্যাত, অথচ অপার সৌন্দর্যে ভরা এক পাহাড়ি গ্রামে।
রামধুরার একদিকে পাহাড় উঠে গেছে আকাশ ছোঁয়ার উদ্দীপনায়, আর অন্যদিকে খাদ, যেখান থেকে নিচে তিস্তা নদী দেখা যায়। বৃষ্টির পরে তার জল ঘোলা, যেন স্মৃতিবাহী কোনো প্রৌঢ়া নারী, যুগান্তরের ইতিহাস বুকে নিয়ে বয়ে চলেছে। দূরে, ওপারের পাহাড় ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ফেনশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা—সাত বোনের মত, পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে—নয়নাভিরাম এক অলৌকিকতা। মনে হয়, দূরের সেই সাতশিরা ধবল শিখর পাহাড়ের আত্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেন এই গ্রামকে ছায়া দিয়ে চিরকাল ঘিরে রাখবে বলেই।
রামধুরায় মূলত নেপালি, লেপচা এবং কিছু ভুটিয়া পরিবার বসবাস করে। নেপালি ভাষা প্রধান, এর পাশাপাশি বাংলা ও ইংরেজিও ব্যবহৃত হয়।এখানকার মানুষের মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মিলিত প্রভাব দেখা যায়। এদের জীবনযাপন মূলত কৃষিনির্ভর। ধান, ভুট্টা, আদা, তেজপাতা ও কমলা চাষ হয়। সিঙ্কোনা গাছের প্ল্যান্টেশনও চোখে পড়ার মত, মংপু খুব দূর নয় বলেই হয়ত। সারাবছর দশৈঁ (দশেরা), তিহার (দীপাবলি), লোসার (তিব্বতি নববর্ষ), গুরুং প্রভৃতি নানা উৎসব পালিত হয়। সম্প্রতি স্থানীয় পর্যটনকে উৎসাহ দিতে প্রচুর হোমস্টে চালু হয়েছে। পর্যটকেরা ট্রেকিং, বার্ড ওয়াচিং, বনভ্রমণ ও গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন রামধুরায়।
রামধুরার কাছাকাছি পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গাগুলো হল ডেলো পাহাড়, ইচ্ছেগাঁও, তিরি ভিউ পয়েন্ট, এবং কাছের সাইলেন্স ভ্যালি ফরেস্ট ট্রেল ইত্যাদি। আবার ছুটোছুটি না করে ছুটি কাটাতে চাইলেও রামধুরা আদর্শ জায়গা। সারাদিন নির্জনতায় মন ডুবিয়ে, শুধু সবুজ দেখে, পাখির গান শুনে দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় দু তিনদিন।
রামধুরা একদিক থেকে যেন বাংলার পাহাড়ি গ্রামের এক প্রতীক— প্রকৃতি, সংস্কৃতি, সরলতা ও অতিথিপরায়ণতা মিশে এক শান্ত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।
হোমস্টে থেকে একটু এগোলে পাওয়া যাবে জলসা বনবাংলো। কপাল ভালো থাকলে, মানে মেঘ না থাকলে বনবাংলোর ভিউ পয়েন্ট থেকে নীচে তিস্তা আর ওপারের কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে মন ভরে যায়। বনবাংলোতে বেশ কয়েকটি ট্রি হাউজ আছে, আগে থেকে বুক করে সেগুলিতে থাকাও যায়। রামধুরা থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া যায় ইচ্ছে গাঁও—নামটা এমন কেন যে! সব ইচ্ছেপূরণের আশ্বাস দেয় যেন। কিন্তু না, সব ইচ্ছেপূরণ চাই না। কিছু অপূর্ণতা জীবনের লাবণ্যে নুন হয়ে থেকে যাওয়া ভালো।
প্রায় ২৭ বছর পর আমি আবার এলাম কালিম্পং-এ। ১৯৯৮ সালের সেই প্রথম সফরের স্মৃতি এখনো স্পষ্ট, কিন্তু প্রকৃতি যেন এখন কেমন বিষণ্ণ, মলিন। সবুজ কমেছে। কমেছে তার গ্রাম্যভাব, তার সারল্য। তবু যা আছে, সেটুকু যেন থাকে, হারিয়ে না যায়—এই প্রার্থনাটুকু রেখে এলাম।
আমরা ছিলাম চার বন্ধু—শৈশবের বন্ধুত্ব, ৪০ বছরের পুরোনো। প্রযুক্তিহীন সেই যুগের মানুষ আমরা, যখন আচার, আলুকাবলি, ঘাসে বসে গল্প আর বিছানার চাদর টাঙিয়ে নৃত্যনাট্যে ভরপুর ছিল জীবন। সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট, আজকের এই সেলফির যুগেও। তাই পেরেছি, শহুরের ক্লান্তি থেকে পালিয়ে পাহাড়ের কোলে অনাবিল আনন্দে কয়েকটা দিন কাটাতে।
রামধুরা আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে রয়ে গেল। ফেরার সময় তিস্তাকে ভালো করে দেখা হল না ঠিকই, কিন্তু মনটা যেভাবে ঝকঝকে সবুজ হয়ে উঠেছিল তাতে তিস্তার ছায়া পড়েছিল, সেটা নিয়েই ফিরেছি। আর তিস্তা? সে জানে, দেখা না হলেও অনুভব মুছে যায় না।