—আমাকে যে কোম্পানি এখন অনসাইট পাঠাতে চাইছে, সেটা হঠাৎ মাকে বলার দরকার হলো কেন তোর?
—তুই সব লুকোস বলে আমি কেন লুকোতে যাবো? তাছাড়া আজকাল কোনটা তোর সিক্রেট, সে আমি কী করে জানবো?
—আমার কোনো সিক্রেট নেই।
তিতির ভুরু নাচিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বললো—তাই বুঝি? ওর কথার ধরন টিটো খুব ভালো করে বোঝে।
—কোনটাকে সিক্রেট বলছিস?
—এই যে, রিসেন্টলি খুব নিষ্ঠাভরে রোমিওর ভূমিকা পালন করে চলেছিস...দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বললো তিতির।
ওর কথায় খুব মজা পেয়েছে এমনভাবে হাসলো টিটো। তারপর নিশ্বাসে কিছু গন্ধ নেওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
—কোথাও কিছু জ্বলে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছি...
—মাই ফুট... বলেই উঠে দাঁড়ালো। ফ্রিজ খুলে একটা জলের বোতল বার করে নিয়ে আবার এসে বসলো তিতির।
আজই সকালে টিটোকে ফোন করেছিলো—সাড়ে পাঁচটায় দিল্লি পৌঁছোচ্ছি। তোর ফ্ল্যাটে উঠবো। অফিস যাওয়ার আগে মনে করে পাশের ফ্ল্যাটে চাবি রেখে যাস। আমার ডেসক্রিপশান দিয়ে বুঝিয়ে বলে রাখিস।
ওর ফ্ল্যাটে থাকবে, তিতিরের এই নোটিশে একটু অবাক হলেও পাশের ফ্ল্যাটে চাবি রেখে সব বলে গিয়েছিল টিটো। গুজরাটি ভদ্রমহিলার হাজার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবে তার কাছ থেকে চাবি নিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ ফ্ল্যাটে ঢুকেছে তিতির। নিজেই সব খুঁজে নিয়ে কফি করে খেয়েছে। তার আধঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে টিটো ফিরেছে। আরো পরে ওর রুমমেট।
দিল্লিতে এই সাতশো স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাটটা টিটো ওর অফিসেরই একটি ছেলের সঙ্গে শেয়ার করে থাকে। ছেলেটির বাড়ি চেন্নাই-এ। দুটো ছোট বেডরুম, একটা ডাইনিং কাম ড্রয়িং রুম, কিচেন, আর একটাই বাথরুম। দুই বেডরুমে ঘুমোনোর জন্যে দুটো ম্যাট্রেস,আর ড্রয়িংরুমে একটা সোফা কাম বেড, একটা কাচের সেন্টার টেবিল, দুটো প্লাসটিক চেয়ার, একটা ফ্রিজ, কিচেনে কিছু চায়ের সরঞ্জাম দুই ব্যাচেলারের সংসার বলতে এই। ডিনারে হোমডেলিভারি আসে। টিটোর বেডরুম আজ তিতিরকে ছেড়ে দিয়েছে, ও নিজে ড্রয়িংরুমে থাকবে। এখন ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে দুজনে। খাওয়া দাওয়ার পরে ওর রুমমেট নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ নিজেদের অফিস নিয়ে কথা বলার পর ল্যাপটপ অন করে নিয়ে টিটো বললো,
—যা শুয়ে পড় তিতির।
—কেন, ফেসবুকে বসবি? আমার সামনে প্রেম করতে লজ্জা করবে তাই না?
টিটো একটা চাঁটি মারলো তিতিরের মাথায়।
—কোম্পানি প্রেম করার জন্যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয় না, সেটা তো তুইও জানিস বাবা। কেন ভাট বকছিস? বুঝতে পারছি এইসব নিয়ে মায়ের সঙ্গে জোর পিএন পিসি করে এসেছিস? কলকাতায় তো এখন এটাই হট টপিক...
এতক্ষণ বেশ মজা করেই কথাবার্তা বলছিল দুজনে। তিতির হঠাৎ খুব রেগে গেল।
—দেখ টিটো, তোর এই ফালতু নেট-অ্যাফেয়ার নিয়ে কথা বলার মতো সময় ইচ্ছে কোনোটাই আমার নেই।
বলেই জলের বোতলটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই টিটো ওকে হাত ধরে টেনে জোর করে আবার বসালো। তিতির বসার পরেও হাতটা ছেড়ে দিলো না। নিজের ল্যাপটপটা কোলের ওপর থেকে নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখলো। আড় চোখে তিতির দেখলো স্ক্রিনে অফিস ফাইলই খোলা। টিটো কিছুক্ষণ চুপ করে তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, —আমি যাচ্ছি না বাংলাদেশে। খুশি?
টিটোকে হতভম্ব করে দিয়ে তিতির আচমকাই জোর করে হাতটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বেডরুমের দিকে চলে গেল। ওর এই নাটকীয়ভাবে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক লাগলো টিটোর। আচরণটা তিতিরের সঙ্গে একেবারে মানানসই না। নিজেদের মধ্যে যাই ঘটুক, যত ঝগড়াঝাঁটিই হোক, বরাবর সামনাসামনি ফেস করে দুজনে। হাতাহাতি করতেও ছাড়ে না। সেন্টিমেন্টের প্রশ্রয় থাকে না। তিতিরের আজকের আচরণটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। খুব কনফিউজড লাগলো টিটোকে।
এর আগেও তিতির দিল্লি এসেছে নিজের কাজে। ওর মাসি মেসো থাকেন চিত্তরঞ্জন পার্কে। এলে সেখানেই থাকে। টিটোর সঙ্গে দেখা করে, দুজনে বেড়ায়, আড্ডা দেয়। টিটোর আগের ফ্ল্যাটেও এসেছে। থাকতে নয়, আড্ডা দিতে। এবার ও যখন ফোন করে জানালো এখানে থাকবে, একটু অবাক হয়েছিল টিটো। কিন্তু ওইটুকুই। পরে মনে হয়েছিল অনেকদিনের জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছে, তাই হয়তো একসঙ্গে খানিকটা হৈহৈ করার জন্যে এখানে থাকার কথা ভেবেছে। এখন ভাবছে ছোটবেলা থেকে চেনা জানা সেই তিতিরের ভেতর কি আর একটা তিতির আছে? ছিল কি বরাবর? যাকে ও দেখতে পায়নি, বা দেখতে চায়নি। নিজেকেই কি পুরোটা দেখতে পেয়েছে? তিতিরের পাশাপাশি নিজেকেও নতুন করে দেখতে পেলো যেন।
তিতির শোয়ার ঘরের জানালার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। টিটো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে ওর কাছে যেতেই বাইরের দিকে চোখ রেখেই তিতির বললো, তুই আবার এখানে এলি কেন? যা নিজের কাজ কর।
—তোকে গুডনাইট বলতে এলাম।
—তুই গুডনাইট না বললেও আমার ঘুম আসবে।
—আমার আসবে না।
—ঠিক আছে, বল। বলে চলে যা।
টিটো এবার কাছে গিয়ে জোর করে তিতিরকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো।
—শুধু গুডনাইট বললেও ঘুম আসবে না। আমাকে তো জানতে হবে তোর আর আমার মাঝখানে এইরকম একটা ড্রামাটিক সিচুয়েশান তৈরি হলো কেন?
—প্লিজ টিটো তুই যা এখন।
—তোর চোখে জল তিতির...
—যা টিটো... চীৎকার করে টিটোকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো তিতির। মুখের রেখায় একটা আন-ন্যাচারাল কম্পন দেখতে পেলো টিটো।
টিটোর কি যে হলো নিজেই জানে না, আচমকাই তিতিরকে বুকের মধ্যে টেনে আনলো প্রায় জোর করে। মুহূর্তে তিতিরও ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। দুজনের মাঝখানে যে এত আদর জমা হয়ে ছিল, কেউই কোনোদিন একমুহূর্তের জন্যেও সেটা আগে বুঝতে পারেনি। একটিও কথা হলো না।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের পাশে শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল তমা। মা ঘুমোচ্ছে। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলো, মায়ের উদ্বেগহীন নিশ্চিন্ত ঘুম। দেখতে ভালো লাগছে, আদর করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ছুঁতে গেলেই ঘুমটা ভেঙে যাবে। মাকে স্পর্শ না করেই আদরের ভঙ্গি করলো। ভাবলো আব্বু আসবে বলে এমন আরামের ঘুম। মা আর আব্বুর মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটা প্রেম... তীব্র কিন্তু নিরুচ্চার। তমাকে বড্ড আনন্দ দেয়, আরাম দেয়। নিশ্চিন্ত করে।
আস্তে করে মায়ের পাশ থেকে উঠে বাইরে এলো।
এই দুপুরবেলায় বারান্দার দক্ষিণ দিকটায় খুব সুন্দর রোদ আসে। সেখানে নানারকম আচার, বড়ি শুকোতে দিয়েছে মনিরা। এখন বসে বসে বড়িগুলো উল্টে পালটে দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান করছে। মেয়েটা ভারি মজার। পায়ে পায়ে ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তমা। মনিরা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে একটা মোড়া এনে দিল ওর সামনে। সারাক্ষণ তমাকে খুশি করার চেষ্টা ওর।
—এত সব কে বানিয়েছে রে?
—আমি ছাড়া আর কেডায়, আম্মার কি আর টাইম আছে?
ও কখনো সময় বলে না, ওর কাছে টাইমটাই বাংলা শব্দ।
—কিসের আচার রে?
—এইডা জলপাই, ওই যে টুকটুইক্যা লাল ওইডা চুপোড়ের আচার আরএইডা চাইলতা। তুমি এইডা ভালোবাসো, তাই না আপা? এট্টু টেস করবা?
তমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই দৌড়ে গিয়ে একটা কাচের বাটি নিয়ে এলো। খানিকটা তুলে দিয়ে বললো, খাও।
সত্যি দারুন খেতে। মনিরার দিকে তাকালো তমা। ওরই একটা পুরোনো সালোয়ার কামিজ পরে আছে,ভেজা চুল পিঠে ছড়ানো। কপালে একটা ছোট কালো টিপ। গায়ের রং শ্যামলা হলেও ভারি মিষ্টি মুখশ্রী। ও তাকিয়ে আছে দেখে একটু সন্ত্রস্ত হলো মনিরা, কী দ্যাহো আপা? অ, চুলে চিরুনি দিই নাই তাই? চুল শুকায় নাই।
—না না ঠিক আছে, দেখছি সালোয়ার কামিজটা পরে তোকে খুব সুন্দর লাগছে। রাতে মনে করে দিস তো আরও গোটা কয়েক বার করে দেবো তোকে, আমি পরি না সেগুলো।
হঠাৎ মনে পড়তে বললো, তুই কাল বিকেলে কী একটা গান করছিলি রান্নাঘরে, বলতো।
—কোনডার কথা কও?
—কথা তো বুঝতে পারিনি দূর থেকে। সুরটা এইরকম... বলে গুন গুন করে সুরটা ভাজলো তমা।
—ওইডা ত...
‘...বাপুই চ্যাংড়া রে, গাছত উঠিয়া দুইডা ও মোক জলপই পাড়িয়া দেমনিরা গাইতে শুরু করলো, শুনতে ভালো লাগছিল, তবু ওকে থামালো তমা।
... ও তুইও দুইটা নেরে বাপু মোকে দুইটা দে
... আরো দুইটা দে রে বাপু আচারের ভাগে
...আরো দুইটা দে রে বাপুই ছওয়ালের পাতে...’
—এখন থাম, মা জেগে যাবে। বিকেলে বসে তোর গান শুনবো। মা-ও শুনবে। মায়ের মন ভালো হয়ে যাবে তোর গান শুনলে। তুই আমাকে ওই চুপোড় না কি বললি, ওই আচারটা একটু দে তো।
মনিরা হঠাৎ তমার দিকে তাকিয়ে সন্ত্রস্ত মুখে জিভ বার করলো।
—কী হলো রে?
—ওই দ্যাহো আম্মার ঘুম ভাঙ্গাইছি...
পিছন ফিরে তাকালো তমা। কান্তা এদিকেই আসছে।
—ওর গানে তোমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো?
—না রে বাবা। তেষ্টা পেয়েছিলো, তাই উঠলাম।
—হায় আল্লা, আম্মা তুমি দ্যাহো নাই পানি তো আমি তোমার হাতের নাগালেই রাখছিলাম।
—জানি। সেটাই খেলাম। কত আর ঘুমোবো। দিনে বেশি ঘুমোলে রাতে আর ঘুম আসবে না।
—আজ আসবে। ইকবাল হায়দার আসছে যে। বলে মুচকি হাসলো তমা।
তমা ভুলে গেছে আব্বুর ওপর প্রবল অভিমানের কথা। খুব হালকা লাগছে, কদিন ধরে একটা ভার চেপে ছিল বুকের মধ্যে।
অবশেষে ফোনে পাওয়া গেছে উপলকে। হোয়াটসআপে অনলাইন দেখে ফোন করলো তমা।
—ভুলে গেছ তো।
—আমার স্মৃতিশক্তির প্রতি এতটা অবিশ্বাস কি ঠিক?
—বাব্বা আজ কতদিন হলো বলো তো আমাদের কথা হয় না। এই ক’দিন একবারও ভেবেছ আমার কথা?
—একেবারেই যে ভাবিনি তা বলবো না, ভাবনাটা চাপা পড়ে যাচ্ছিল। ভীষণ কাজের চাপ, এখনও আছে। আজ কিছুটা ফ্রি। ভাবছিলাম তোমাকে অল্পক্ষণের জন্যে হলেও একবার ফোন করবো।
—-যাক ভাবনায় ছিলাম তাহলে। সত্যি সত্যি আসছো তো?
—আমি এখন তোমাদের ওখানে যেতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না। রাগ কোরো না।
—জানতাম। আসলে ওটা তোমার কথার কথা ছিল।
—একদম তা নয়। আমার তো ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। ওটা হয়তো ক্যানসেল করতে হবে...সরি তমা।
—আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার সময় সুযোগ মতো এস। নিমন্ত্রণটা ভ্যালিড রইলো। তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং কথা জানাই। তোমার মা কিন্তু আমার আব্বু আর মাকে খুব ভালোভাবে চেনেন।
—সে কি? মা আমাকে কিছু বলেনি তো। মাকে জিজ্ঞেস করবো তো। মায়ের সঙ্গে কী কথা হলো তোমার?
—এমনি খুব সিম্পল কথাবার্তা। জানো তো আমার আব্বু আসছে নেক্সট উইকে। ইস কতদিন পর আমরা তিনজন একসঙ্গে হবো।
—তোমাদের এই ফ্যামিলি গেট-টুগেদারের মধ্যে আমার না যাওয়াটা ভালোই হলো।
কথাটা বলতে পেরে টিটো স্বস্তি পেলো অনেকটা। ব্যাপারটা চাপ হয়ে ছিলো মনের মধ্যে। পাশাপাশি ভাবতে চেষ্টা করলো, না যাওয়ার জন্যে কোনো আক্ষেপ অনুভব করছে কি না। মনে হলো গেলে মা বাবার দেশটা দেখতে পেতো। ছোটবেলা থেকে এত গল্প শুনেছে বিশেষ করে দিদার কাছে যে নানা রকম ছবি তৈরি হয়ে ছিল মনে সীমান্তপারের দেশটা সম্পর্কে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তমার মৃদু আকর্ষণও। দুইএ মিলেই তাৎক্ষণিক আবেগে ইচ্ছেটা জেগেছিল।
তমারও মনে হলো এটা ভালোই হলো, ওকে নিজে থেকে কিছু বলতে হলো না। বাড়ির পরিস্থিতি এমন ভারাক্রান্ত, নিজেও যার কারণ বুঝতে পারছে না। এর মধ্যে উপল এলে অস্বস্তিতে পড়তো তমা। মনে মনে একটা উভয়সঙ্কটে পড়েছিল। তাছাড়া উপলের আসাটা আব্বু কীভাবে নেবে তা নিয়েও একটু দুর্ভাবনায় ছিল তমা। ইকবাল সাধারণত ওকে কিছু নিষেধ করে না, তবু। নিষেধ বা প্রশ্রয় সবই কান্তার দায়।
বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানে গুলমোহর গাছের নিচে একটা সিমেন্টের বেঞ্চ আছে। কান্তা আর ইকবাল বসে গল্প করছে। কান্তা কিছুটা অনুতাপের সুরে বললো, —সত্যি বলতে কি আমার খুব খারাপ লেগেছে অরুণিমার সঙ্গে ওইরকম ব্যবহার করে। ও এত ইনোসেন্টলি আর খুব আহ্লাদের সঙ্গে কথাগুলো বলছিল। আমিও তো একসময় সারাক্ষণ গল্প শুনে শুনে ওর খুব ফ্যান হয়ে গিয়েছিলাম। তখন কতবার তাকে বলেছি, অরুণিমাকে একবার বাড়িতে নিয়ে আসতে। সম্ভবত একবার এসেওছিল, আমি তখন ঢাকায়।
ইকবাল মুখ নিচু করে বসে আছে। কান্তার কথাগুলো ওকেও যে খানিকটা বিচলিত করছে না তা নয়। খুব কি দরকার ছিল রুমার সব কথা ওকে জানানোর? অন্যভাবে কি ব্যাপারটা হ্যান্ডল করা যেতো না? আসলে সেদিন কান্তা এমন আতঙ্কিতভাবে ফোন করেছিল যে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল ইকবাল। প্রায় সবহারানোর হাহাকার ছিল ওর গলায়। কেউ যেন তমাকে এক্ষুণি কেড়ে নিতে চাইছে ওর কাছ থেকে। ওদের জীবনে অরুণিমার উপস্থিতি মানেই যেন রুমার ফিরে আসা।
—আমারও যে খারাপ লাগেনি তা নয়, কিন্তু পরে ভেবেছি সবটুকু ওর জানা দরকার, তবেই তোমার উদ্বেগটাকে বুঝতে পারবে, গুরুত্ব দেবে। ও আমাদের শুধু বন্ধু নয়, খুব আপনজন ছিল। আমাদের দুজনকেই খুব ভালোবাসতো। জানো বড্ড সহজ মানুষ অরুণিমা। ওর মধ্যে কোনো জটিলতা নেই।
ইকবালের মুখে দৃশ্যত মনখারাপের ছায়া। কান্তার অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ইকবালের চোখের দিকে তাকালো,
—অরুণিমাকে আর একবার ফোন করবে নাকি তুমি? আমার কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু ফোন করে কথা বলতে পারবো না।
—বুঝতে পারছি না। কি অদ্ভুত কো-ইন্সিডেন্স। এত মানুষ থাকতে সেই অরুণিমার ছেলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হলো তমার! ভাবছি ছেলেটা আসবে বলেছে আসুক না। আমি তো আছি। ম্যানেজ করে নেবো। অরুণিমার ছেলেকে আমারও তো দেখতে ইচ্ছে করছে। তমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্বটা ঠিক কেমন?
—জানি না তো। আজকাল ইন্টারনেটে তো এগুলো চলছেই। ইনফ্যাক্ট অরুণিমা যদি কোনোভাবে এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত না হতো আমি কিছু মনে করতাম না। সেদিন আমার সত্যিই ভয় করছিল। একবার মনে হয়েছিলো চাকরি-টাকরি ছেড়ে তমাকে নিয়ে আমি তোমার কাছে চলে যাই।
—কান্তা, ইন্টারনেটের দৌলতে পৃথিবীটা এখন এত ছোট হয়ে গেছে, একটা বড় একান্নবর্তী পরিবারের মতো। কারো কাছেই কেউ অপরিচিত থাকতে পারে না। চাইলে যে কেউ তোমাকে জেনে নিতে পারে। কাউকে কারো কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবে না তুমি।
—ও যখন সব জেনেই গেছে, আমি একবার ফোনে কথা বলবো অরুণিমার সঙ্গে? একবার সরি অন্তত বলি, নাহলে ভেতরের গ্লানিটা কাটছে না।
—এখনই তার দরকার নেই। আর একটু ভাবতে দাও আমাকে।
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তমা। এখান থেকে কিছুই শোনা যাচ্ছে না ওদের কথা, কিন্তু কোনো সিরিয়াস কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছে।
প্রথমে খুব উচ্ছ্বসিত হলেও তমা পরে ভেবেছে আব্বুর এই হঠাৎ আসাটা কি মায়ের শরীর খারাপের কারণে? না কি অন্য কোনো কারণ আছে? মায়ের হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে যাওয়াটা এখনো ভাবাচ্ছে তমাকে। এটা নিয়ে আব্বুর সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে তমার। মা উঠে আসছে। ওপর থেকে তমা চেঁচালো — আব্বু কফি খাবে?
ইকবাল ওপর দিকে তাকিয়ে ওকে হাত ইশারায় নিচে ডাকলো। তমা কফি বানাবে বলে রান্নাঘরে ঢুকে বাসনের আলমারি থেকে খুব সুন্দর দুটো কফিমগ বার করলো। কান্তা ওপরে উঠে এসেছে।
—তোকে ডাকছে,তুই যা। আমি মনিরাকে বলছি কফি বানিয়ে তোদের দিয়ে আসবে।
—মা, তোমার মনিরা আর কফি! দুধের মধ্যে একগাদা চিনি আর এক চিমটি কফি গুলে নিয়ে আসবে। আব্বু মুখেও তুলবে না।
কান্তা আর কথা বাড়ালো না। বাপবেটিতে এই সখ্য ওকে স্বস্তি দিচ্ছে।
—আব্বু তোমাকে বলা হয়নি, আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল বেড়াতে... ওকে মাঝপথে থামিয়ে উদ্গ্রীব ইকবাল জানতে চাইল — কথা ছিল, মানে আসছে না?
—না, অফিসের ভীষণ একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। সেই জন্যে আসাটা ক্যানসেল করেছে। ইকবালের বুকের ওপর থেকে একটা ভার নেমে গেল। আপাতত একটা অপ্রিয় পরিস্থিতি থেকে বাঁচা গেল। তমার সঙ্গে এটা নিয়ে কোনো বিরোধ, মনকষাকষির ভেতর যেতে হলো না। এমনিতে ওর ওপর মেয়ের অভিমানের অন্ত নেই।
—আমি তোমাকে যেটা বলতে চাইছি সেটা খুব ইন্টারেস্টিং। উপল, মানে আমার ওই বন্ধুর মা রাজশাহীতে পড়তেন। তোমাদের খুবই পরিচিত। মানে তোমাকে আর মাকে খুব ভালো করে চেনেন।নাম বললে তুমি হয়তো চিনতে পারবে।
—বাহ দারুণ হয়েছে কফিটা।
—এ আর নতুন কি! শোনো না, যা বলছিলাম—ভদ্রমহিলার নামটা খুব সুন্দর। অরুণিমা। উপল বলেছে ওর মা নাকি খুব সুন্দর গান করেন। তোমার মনে আছে তাকে?
—কি জানি কত বছর আগের কথা কত মেয়ের সঙ্গেই তো পরিচয় ছিল। ঠিক বুঝতে পারছি না কে।
—সে কিন্তু তোমার নাম শুনেই চিনতে পারলো। কিন্তু আমার খটকা লাগছে মাকে চিনলো কীভাবে, মা তো রাজশাহীতে পড়েনি। মায়ের সম্পর্কে যেভাবে কথা বললো তাতে মনে হলো মা তাঁর খুব কাছের। মাকে ফোন করবে বলেছিল। করেনি সম্ভবত। তাহলে তো মা বলতো।
—তোর মায়েরও হয়তো মনে নেই। ছাড় ওসব। বল তোর চাকরি কেমন লাগছে?
—আলাদা করে বলার মতো কিছু না।
—তাহলে চাকরিটা তুই ছেড়ে দে।
—অন্য কিছু একটা না পেলে এটা ছেড়ে তো ঘরে বসে বোর হবো। আমি কলেজে চেষ্টা করছি। দেখা যাক কী হয়।
—আমি একটা অন্য কথা ভাবছি ।
—কী?
—তোদের কিছুদিন আমার কাছে নিয়ে রাখবো। একা আর ভালো লাগছে না। তোর মায়ের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না ইদানিং।
—মাকে নিয়ে যাও।
—তোর কী ধারণা তোকে এখানে একা ফেলে তোর মা যাবে আমার সঙ্গে?
—আরে বাবা আমি কি আর ছোট আছি? একটা ছড়ানো পৃথিবীর সঙ্গে আমার পরিচয় হচ্ছে। তার মাঝখানে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। চিনতে হবে চেনাতে হবে নিজেকে। নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে হবে। সেটা তো আমাকেই করতে হবে।
—বড্ড বড় হয়ে গেছিস তো!
—তা তো হয়েছিই। তোমরাই শুধু মানতে চাও না।
—তুই যে বড় হয়েছিস, সেটা তোর মা জানে?
তমা হাসছে।
—তুমি কতদিন থাকবে এখানে?
—পনের দিন। এর ভেতর যদি তোদের ভিসার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারি, তোদের নিয়েই ফিরবো এবার।
—আব্বু আমাকে একবার রাজশাহী নিয়ে যাবে? খুব যেতে ইচ্ছে করে। কতবার বলেছি তোমাকে। আজ অব্দি নিয়ে গেলে না।
—সে পরে কখনও হবে। ভাবছি এবার আমরা এক সপ্তাহের জন্যে কক্সবাজার যাবো। কী খুশি? তোর তো খুব ইচ্ছে ছিল কক্সবাজার যাওয়ার।
তমা সত্যিই খুব খুশি। মায়ের একটা চেঞ্জ দরকার। তিনজনের এই বৃত্তের মাঝখানে ও নিজেও খুব আরামে থাকে, সেটা নতুন করে অনুভব করলো।
প্রত্যেকবার মহালয়ার দিন অরুণিমা যাদবপুরে আর সুপ্রিয় কোন্নগরে যায়। সারাদিন থেকে রাতে ফিরে যাদবপুরে খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফেরে দুজনে। সুপ্রিয়র মা যতদিন বেঁচে ছিলেন এই নিয়মই ছিল, এখনো সেটা চালু রেখেছে সুপ্রিয়।
টুপুর বলে, মহালয়ার দিন বাড়িতে পিসির আগমন মানেই শারদীয় উৎসবের সূচনা।
অরুণিমা এবার ভেবেছিল সুপ্রিয়র সঙ্গে কোন্নগর যাবে। আগের রাতে মাকে ফোন করে কথাটা বলতেই টুপুর তেড়ে উঠলো, তুমি না এলে আমাদের দেবীপক্ষের সূচনা হয় না জানো না?
অগত্যা পুরোনো নিয়মই বহাল রইলো।
চারপাশের বাড়ি থেকে মহিষাসুরমর্দিনীর গান আর স্তোত্রপাঠের আওয়াজ ভেসে আসছে। শেষের দিকে। সুপ্রিয়র স্নান করে রেডি হতে হার্ডলি দশ মিনিট। অরুণিমা ভোরে উঠে একেবারে স্নান করে বাথরুম থেকে বেরোলো। টুপুরের দেওয়া মঙ্গলগিরি শাড়িটাই বের করে রেখেছিল। ব্লাউজটা তৈরি হয়নি। একটা কলমকারি প্রিন্টের ব্লাউজ দিয়ে শাড়িটা পরে নিলো। কপালে একটা বড় লাল টিপ। নিজে রেডি হয়ে কোন্নগরের সবার জন্যে কেনা জামাকাপড়গুলো আর একবার চেক করে নিলো। স্নান করে বেরিয়েই অরুণিমার দিকে চোখ পড়তে কাছে এলো সুপ্রিয়। ওর দুটো কাঁধ ধরে নিজের সামনে দাঁড় করালো। চোখে মুখে দুষ্টুমির হাসি।
—কী হলো?
—দেখছি।
—কী দেখছো, ঠিকঠাক লাগছে তো?
—শাশুড়ি হিসেবে বেমানান। এখনও আমার প্রেমিকাই আছো। বলেই জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুমু। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অরুণিমা সুপ্রিয়র শার্ট প্যান্ট বার করে সামনে রাখলো। গিফটএর জিনিসগুলো ব্যাগে ঢোকানোর আগে সুপ্রিয়কে আর একবার মনে করিয়ে দিলো, দেখে নাও একবার। সবার নাম লেখা আছে। দেয়ার সময় যারটা তাকে দিও।
অরুণিমাকে গেটের সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে সুপ্রিয়। একগাদা জামাকাপড়ের প্যাকেট হাতে বাড়িতে ঢুকতেই টুপুর চীৎকার করলো, ঠাম্মা তোমার উমার আগমন।
তাড়াতাড়ি অরুণিমার হাত থেকে প্যাকেটগুলো নিলো। বরাবর মহালয়ার দিনই সবার পূজোর গিফটগুলো দিয়ে দেয় অরুণিমা। পছন্দ না হলে যাতে চেঞ্জ করে নিতে পারে। এখানে সচরাচর তার দরকার হয় না। ও যা কেনে সবারই পছন্দ হয়। এবার টুপুরের জন্যে মেখলা চাদর কিনেছে। পরবে কি না, সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল। কিন্তু টুপুর প্রায় লাফিয়ে উঠলো, অরুণিমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো।
—ওহ পিসি আমার বাবার পছন্দটা যদি তোমার মত হতো...
—কেন তোর বাবার পছন্দ আবার কী করলো?
—ডিজাস্টার।
বলেই ঘর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে এলো, সন্তর্পণে ভেতর থেকে একটা জমকালো কাঞ্জিভরম শাড়ি বার করলো। প্যাকেটটা আনতে দেখে অনির্বাণ এসে দাঁড়িয়েছে। একটু অপ্রস্তুত মুখে বললো,
—তুই বল ঝুমুর শাড়িটা বেশ অভিজাত না? তোর বৌদির কাছে শুনেছিলাম ও সাউথের শাড়ি পছন্দ করে, দোকানে গিয়ে বলতে ওরা এই শাড়ি বার করে দিল। রঙটা ভালো লাগলো নিয়ে এলাম।
—বাবা, সাউথ মানেই কাঞ্জিভরম? কখনো দেখেছ আমাকে এসব পরতে?
—এবার পরবি, সারাক্ষণ তো ময়লা ময়লা রঙ-জ্বলা শাড়ি পরে ঘুরিস।
—আচ্ছা,এবার বুঝতে পারছি মা তোমার ব্রেন ওয়াশ করেছে। তোমাকে দিয়ে আমার বিয়ের বাজার করাচ্ছে।
এক চোট হাসির হুল্লোড় হলো। টুপুরের উপস্থিতি মানেই সেখানে প্রাণের বন্যা বয়ে যায়। ওর দিকে তাকিয়ে অরুণিমার মনে হলো, এত প্রাণোচ্ছল মেয়েটা নিজের জীবনে এমন একটা অস্বাচ্ছন্দ তৈরি করে রেখেছে। পাশাপাশি নিজের কথাও মনে হলো। নিজেওতো একটা বিশ্রী জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর পাথর নিয়ে ঘুরছে। যাতে ওর নিজের কোনো দায়ই নেই, তাই নিয়ে যন্ত্রণা পাচ্ছে। টিটোর মুখটা মনে হতেই চোখে জল এলো। কি জানি টিটোও সত্যি সত্যি জড়িয়ে গেছে কিনা সেই জটিলতার মধ্যে।
পুজোর মধ্যে ষষ্ঠীর দিনটা ওরা বরাবর কোন্নগর থাকে। সপ্তমীতে কোলকাতায় ফেরে। সুপ্রিয়র মা মারা যাওয়ার পরও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। সুপ্রিয়র দাদাবৌদি ভাইপো ভাইঝি সবাই খুব ভালোবাসে অরুণিমাকে। অরুণিমা ভেবেছিল এবার পুরো পুজোটা কোন্নগরেই কাটিয়ে আসবে।একটা কিছু চেঞ্জ দরকার। সুপ্রিয় হ্যাঁ না কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, টুপুর তোমাকে ছাড়বে পুজোর সব কটা দিন কোন্নগর থাকতে চাইলে?
—এবার টুপুরকেও নিয়ে যাবো। ওর ভালো লাগবে। মফস্বলের পুজোয় বেশ একটা পারসোনাল অ্যাটাচমেন্ট থাকে, একথা টুপুরই আমাকে বলেছে অনেকবার।
টুপুরকে সেকথা বলতেই মুচকি হেসে বলেছিল, সে দেখা যাবে।
টুপুর জানে পুজোর সময় অরুণিমাকে এই সারপ্রাইজটা দেবে সুপ্রিয়... সপ্তমীর দিন কোন্নগর থেকে ফিরেই রাতে দার্জিলিং মেল ধরবে ওরা... সোজা সিকিম... পেলিং একটু ক্রাউডেড...তাই পেমিয়াংসিতে হোটেল বুক করেছে চারদিনের জন্যে।
কোন্নগর থেকে সকালে খুব তাড়াহুড়ো করে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েও সারা রাস্তা জুড়ে পুজোর ভিড় কাটিয়ে বাড়ি পৌঁছুতে এগারোটা বেজে গেল। শোভার কাছে চাবি থাকে মেইন গেটের আর রান্নাঘরের। ঘরদোর পরিষ্কার করে ওদের অপেক্ষা করছিল। সুপ্রিয় বললো এবেলার মতো খুব হালকা কিছু রান্না করতে, তারপর অরুণিমার হাতে দার্জিলিং মেলের টিকিট আর পেমিয়াংসির হোটেল বুকিং ধরিয়ে দিলো। অরুণিমা অবাক হলেও ভেতর থেকে কোনো উৎসাহ বা উচ্ছ্বাস বোধ করলো না। এটাও একবার মনে হলো, এই টিকিটটা তো দিল্লির হতে পারতো। টিটো আসবে না, ওরা দুজন তো টিটোর কাছে ঘুরে আসতে পারতো। সুপ্রিয় কিছু একটা প্রত্যাশা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে হেসে বললো, তলায় তলায় এইসব চলছে, নিশ্চয় টুপুরও জানে।
—জানে, ইনফ্যাক্ট টুপুরই আমাকে আইডিয়াটা দিয়েছিলো। নাও প্যাকিং করে নাও চটপট। শরৎকালের আকাশ, সকালে ঝকঝকে রোদ্দুর ছিল, দুপুরের পর থেকে মেঘলা হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মেঘও ডাকছে। এই রকম ওয়েদারে এমনিতেই বাড়ি থেকে বেরোতে ভালো লাগে না। তার ওপর মনমেজাজের এই হাল। সকালের দিকে ফোন করেছিল তিতির। তখন ওরা গাড়িতে, বাড়ি ফিরছে। —কাকিমা বিকেলে ঠাকুর দেখতে বেরোচ্ছো না তো?
—না, না। তুই আসবি আজ? আয় না। রাতে তোকে তোর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
—দেখছি, আমার এক বন্ধুর আসার কথা আছে, ওকে এয়ারপোর্টে আনতে যাবো। দেখি তারপর যদি যেতে পারি।
বেড়াতে যাওয়ার কথাটা তখনও জানতো না অরুণিমা।এখন ভাবলো, ওকে জানিয়ে দিলে হয়। আবার মনে হলো, তিতির এলে তো আসবে বিকেলে বা সন্ধেয়, আসুক না। যাওয়ার পথে ওকে নামিয়ে দিয়ে যাবে। ওরা রাতে ট্রেন ধরবে শুনলে হয়তো আর আসতে চাইবে না। টিটোর কাছ থেকে ঘুরে এলো। একবার ওর সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগতো। খুঁটিয়ে সব কথা জানাও হয়নি।
দিনের বয়েস যত বাড়ছে প্রতিমা দর্শনের লাইন লম্বা হচ্ছে। এ পাড়ার প্রতিমা নাকি খুব ভালো হয়েছে। টিভিতে পুজো পরিক্রমায় উল্লেখ করেছে। ভিড়টাও তাই বেশি।
স্নান করে অরুণিমা আজ একটা নতুন শাড়ি পরেছে। তিতির আসতে পারে। তাছাড়া পুজোর ক’দিন নতুন শাড়ি পরলে সুপ্রিয় খুশি হয়। ও নিজেও আজ স্নান করে নতুন পাঞ্জাবি পরেছে। সুটকেস খুলে আর একবার সুপ্রিয়র করে দেওয়া প্যাকিং লিস্ট মিলিয়ে দেখে নিয়ে বাইরে এলো অরুণিমা।
সামনের রাস্তায় সুসজ্জিত মানুষের স্রোত চলেছে। মেয়েরাই বেশি। নিজে সেজেগুজে প্রতিমা দেখতে বেরোনোর চেয়ে এখানে বসে মানুষ দেখাটা বেশি এনজয় করে ও। টিটো ছোট থাকতে পুজোর চারদিন প্রায় রোজই বেরোতে হত। টিটো হিসেব করতো কটা প্রতিমা দেখলো। বন্ধুদের সঙ্গে এটা নিয়ে কম্পিটিশান চলতো। শেষ পর্যন্ত এমন হতো, ওর দর্শন সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে সুপ্রিয় একাই ওকে নিয়ে অলি গলি ঘুরে প্রতিমা দেখিয়ে নিয়ে বেড়াতো। তখনকার কথা ভেবে নিজের মনে হাসি পেলো। সুপ্রিয় ঘুমোচ্ছে। খুব সকালে উঠেছে আজ। ছুটির দিনের বাড়তি ঘুম পুষিয়ে নিচ্ছে। একটু আগে দেখে এসেছে শোভাও তার রুটিন দিবানিদ্রা দিয়ে নিচ্ছে। একটু গড়িয়ে নেবে ভেবে সুপ্রিয়র পাশে এসে শুয়ে থাকতে থাকতে ওরও ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো।
.........ডোরবেলের আওয়াজে উঠে গিয়ে দরজা খুলেই অবাক অরুণিমা। তমা। হাসছে। একটা সাদা কুর্তা আর নীল রঙের রাজস্থানি ওড়না পরে আছে।
—দেখুন সঙ্গে কে? এতবছর পর চেনা যাচ্ছে তো?
অরুণিমা দেখলো তমার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ইকবাল। ও দরজা খুলে দিয়েছে। তবু ডোরবেল বেজে চলেছে সমানে। সেই আওয়াজেই ঘুমটা ভেঙে গেল অরুণিমার। ধড়মড় করে উঠে বসল। স্বপ্নের ঘোরটা কাটেনি, বুক কাঁপছে। সত্যি যদি গিয়ে দেখে তমা আর ইকবাল এসেছে।
—বৌদি, চা করবো?
শোভা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে এসে দাঁড়িয়েছে। অরুণিমা একবার উঁকি দিয়ে দেখলো, সোয়া পাঁচটা বাজে।
—শোভাদি বেল বাজলো না?
—কি জানি মাইকের শব্দে আমার কানে কিছু ঢোকে না।
—তোমার দাদা উঠেছে?
—বিছানায় তো নেই।
—তাহলে উঠেছে। বাথরুমে গেছে। তুমি চা করো। আমি গিয়ে দরজা খুলছি ।
প্রায় দৌড়ে দরজা খুলতে চলে গেল অরুণিমা। সত্যিই বেল বাজছিল। বাজাচ্ছিল তিতির। অরুণিমার ঘুমের মধ্যে পৌঁছে গেছে সেই ডাক। তিতির আজ শাড়ি পরেছে। এর আগে কখনও ওকে শাড়ি পরতে দেখেনি। ভারি সুন্দর লাগছে। ও ভেতরে ঢুকতেই জড়িয়ে আদর করলো অরুণিমা, মনে হলো টিটোর ছোঁয়া পেলো। দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তিতির বাধা দিলো।
—বন্ধ করো না, তোমাকে বলেছিলাম না আমার এক বন্ধু্কে আনতে এয়ারপোর্ট যাবো। ও আছে সঙ্গে।
অপ্রস্তুত অরুণিমা দরজা খুলে একটু সরে দাঁড়ালো। তিতির ডাকলো, তুই তো চিনিস। লজ্জা কি রে ভেতরে আয়।
অরুণিমা দেখলো ভেতরে যে এলো, সে টিটো। অরুণিমার মুখ দিয়ে বিস্ময়, আনন্দ মেশা একটা অদ্ভুত চীৎকার বেরিয়ে এলো। টিটো ভেতরে আসতেই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আসলে এই ক’দিনের যাবতীয় ঘটনার অভিঘাতে যে অশান্তি আর উদ্বেগ জমেছিল ভেতরে সেটাই কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো।
ভেতরে শোভার হৈচৈ উল্লাস শোনা যাচ্ছে, ও দাদা দেখোগে যাও কে এসেছে...।
তিতির মুখ টিপে হাসছে।
—খুব করে পেটাও তো ওকে। বাড়ি আসবো না, ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে যাবো। দাম বাড়ায়, বুঝলে? তুমি আর আহ্লাদ দিও না তো কাকিমা। চল না কালই তোকে বাংলাদেশের যে কোনো একটা ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আসবো।
টিটো অদ্ভুতভাবে তাকালো তিতিরের দিকে।
—মুখ খোলাস না তিতির। কেন যাওয়া হলো না বলি?
—আই ডোন্ট কেয়ার। তোর মুরোদ থাকে তো বল।
ওদের দুজনের মধ্যে কোনোদিন কোনো রহস্য ছিল না, খোলা দরজার মতো ছিল সম্পর্কটা। সবটুকু দেখতে পেতো অরুণিমা। আজ মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা অন্যসুর বাজছে। এতদিনকার সেই খোলা দরজার ওপাশে খানিকটা যেন আলো আঁধারি। সেটা উপভোগ করলো অরুণিমা। মনে হলো সহসা আজই আগমনী বেজে উঠেছে।
তবু নিজের নিশ্চিন্ত আনন্দের তলায়, বুকের ভেতর কোথায় যেন একটুকরো মনখারাপের মেঘও ভেসে বেড়াতে দেখলো। তিতিরের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হলো রুমার মেয়েটা ভালো আছে তো?
(শেষ)