--আচ্ছা যদি জানতে পারো টিটো কারো সঙ্গে প্রেম করছে, তোমার কেমন লাগবে? মানে কী রিঅ্যাকশান হবে?
রাতে ঘুমোনোর আগে রোজকার রুটিন মাফিক সুপ্রিয় চোখের সামনে একটা বই খুলে নিয়ে বিছানায় শুয়েছিল। বই থেকে চোখ না তুলেই উত্তর দিল,
--অবভিয়াসলি ভালো লাগবে। ওকে কংগ্রাচুলেট করবো।
--কংগ্রাচুলেট করবে?
--হানড্রেড পারসেন্ট। এই বয়েসে প্রেম করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। মোস্ট হেলদি ব্যাপার।
--সে না হয় হলো,কিন্তু একবারও মনে হবে না যে তলায় তলায় এইসব চলছে!
এবার অরুণিমার দিকে ফিরলো সুপ্রিয়। আঙুল দিয়ে গালে, ঠোঁটে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বললো, আরে বাবা প্রেম তো সবাই তলায় তলায়ই করে। তুমি কি তোমার মা বাবাকে জানিয়ে প্রেম করতে? নেহাৎ আমার হাত কামড়ে দিতে গিয়ে বৌদির কাছে ধরা পড়ে গেলে তাই জানাজানি হল। আমার বাড়ির লোক তোমাকে পছন্দ করতো বলে ছাদনাতলার ব্যাপারটা মসৃণ হয়ে গেল। কিন্তু তোমার যা দুধভাত মার্কা ছেলে, আমার মনে হয় না কোনো মেয়ের কাছে নিজের ইমোশন প্রকাশ করতে পারবে। আমাকে সেই পাত্রী-চাই অ্যাড দিতে হবে।
--যতোটা ভাবছো, তোমার ছেলে ততটা দুধভাত নয়।
--কেন কী ব্যাপার, ছেলের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছো নাকি? তা ভালো। চমৎকার টাইমপাস।
বইটা বন্ধ করে বেডসাইড টেবিলে রাখলো সুপ্রিয়। অরুণিমা বুঝতে পারলো ঘুম পাচ্ছে সুপ্রিয়র। বন্ধুর বাড়িতে সামান্য পানটান হয়েছে। এখন ওকে কিছু বলা না বলা সমান। অন্যদিন ঘুমোনোর আগে কিছুক্ষন খুনসুটি চলে, কিছু শরীরী সংলাপ। আজ সুপ্রিয় ক্লান্ত বলে অরুণিমাই আর কোনো উৎসাহ দেখালো না। একবার মনে হলো সুপ্রিয় হয়তো এই আলোচনাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই একটু দ্রুত চোখ বন্ধ করলো। সামান্য মন খারাপ যে হলো না তা নয়। তবু অরুণিমা গুটিসুটি হয়ে সুপ্রিয়র বুকের কাছেই মুখটা নিয়ে নিজের পুরোনো ভাবনাকে নাড়াচাড়া করতে করতে নিজেই একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
..................কাজলা গেট থেকে পশ্চিমদিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে রাস্তা ক্রস করলো দুজনে। বাস রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে আমবাগান। আর কিছুটা এগোলেই পদ্মা। এখন চর জেগে আছে। জোয়ারের সময় কোনো কোনো গাছের গোড়া অব্দি জল চলে আসে। আমবাগানের মাঝাখানে একটা অস্থায়ী ঝুপড়ি। উঁচু মাচা করে তার ওপর নারকেলপাতার ছাউনি। ওটা আমের মরসুমে আম পাহারা দেওয়ার জন্যে তৈরি করা হয়। রাতে ওখানে লোক থাকে। এখন পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। বেশ হাওয়া দিচ্ছে। পাতায় পাতায় ছোঁয়া লেগে মৃদু শব্দ হচ্ছে। একেই বোধ হয় মর্মর বলে। হাওয়ায় অরুণিমার চুল উড়ছে, আঁচল উড়ছে। সুপ্রিয় বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে। একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে অরুণিমাকে।
--ভাগ্যিস তুমি চাকরিটা ছেড়েছিলে, না হলে এভাবে হুট করে রাজশাহীতে বেড়াতে আসা যেতো? কতদিন পর কোনো কাজ ছাড়াই দুজনে বেরোলাম বলো তো ।
--টিটোটা এলো না বলে খুব খারাপ লাগছে। ওর কত সখ রাজশাহী দেখবে। কলেজ ছুটি, আসতেই পারতো। ওকে একটা ফোন করো না।
--ছাড়ো না বাবা, ওকে একটু ওর নিজের মতো থাকতে দাও। সারাক্ষণ ছেলের ওপর নজরদারি করাটা মোটেই ভালো কথা না।
--কেমন আছেন আপা?
--ভালো। তুমি এখানে কী করছো?
--আমি তো এই বাগানখানা ইজারা নিয়েছি।
--কেন, এখন আর ইন্ডিয়ান জিনিস বিক্রি করো না?
--নাহ, বর্ডারে খুব কড়াকড়ি। একটা সূঁচ আনতে গেলেও পয়সা দিতে হয়।
--কী কর এখন?
--সাহেববাজারে একটা ফলের দোকান দিয়েছি। আপনি তো আর আসেন না এদিকে।
--বর্ডার পেরিয়ে সবসময় আসা যায় নাকি। এই তো কত ঝামেলা করে এলাম।
--আপনার ছেলেকে তো দেখি মাঝে মাঝে এখানে এই চর বরাবর ঘুরে বেড়ায় একটা মেয়ের সঙ্গে।
--চেনো আমার ছেলেকে?
--কেন চিনবো না? আপনারই মুখের আদল।
সুপ্রিয় একটু এগিয়ে গেছে জলের কাছে। নিচু হয়ে হাত দিয়ে জল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। আচমকা একটা ঢেউ এসে ওর পায়ের কাছে প্যান্টটা ভিজিয়ে দিতেই ও লাফ দিয়ে সরে এলো। ঠিক তখনই অরুণিমার চোখে পড়লো, ওদের থেকে পনের ষোলো হাত দূরে একটা মেয়ে একা আপনমনে হেঁটে যাচ্ছে। নীল তাঁতের শাড়ি পরা। এতক্ষন লক্ষ্য করেনি। অরুণিমা ‘এই শোনো’ বলে ওকে ডাকতে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে কিছুতেই স্বর বেরুচ্ছে না। মেয়েটা একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই মেয়েটি ফিরে তাকালো। অরুণিমা প্রাণপণ শক্তিতে ‘রুমা’ বলে চিৎকার করে উঠলো, তখনই টের পেলো সুপ্রিয় ওকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিচ্ছে। ঘুমটা ভেঙে গেল। সুপ্রিয় জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করলো, কী স্বপ্ন দেখছিলে? কাকে ডাকছিলে?
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সুপ্রিয় আবার পাশ ফিরে শুলো। ঘোর ভেঙে আত্মস্থ হতে সময় লাগলো অরুণিমার। স্বপ্নটাকে মনে করতে চেষ্টা করলো। রাজশাহী ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাস — কাজলা গেট — পদ্মার পাড় — আমবাগান — রুমা — নীল শাড়িতে --ওটা রুমা ছিল কি? না কি অন্য কেউ?
সন্ধে থেকে নীল রঙটা মাথার মধ্যে এমনভাবে ছেয়ে ছিল যে স্বপ্নেও সে পিছু ছাড়েনি। শুয়ে শুয়ে আপনমনে ভাবতে ভাবতে আচমকা কী মনে হতেই উত্তেজনায় উঠে বসলো অরুণিমা।ওর সন্ধেবেলার সেই অবয়বহীন ভাবনাটা ভিত পেল যেন। বুকের ভেতর অস্থির লাগছে। কিন্তু এই এখন ও কী করে মেলাবে দুজনকে? প্রায় তিরিশ বছর, একটা বিরাট সময়। রুমা এখনও স্মৃতির অনেকখানি জুড়ে থাকলেও চেহারাটা আজ আর তত স্পষ্ট নয়।
একগ্লাস জল খেয়ে নিয়ে আবার ঘুমোনোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আর ঘুমোনো গেল না। পুরোনো ছবিগুলো মনের দখল নিয়ে নিলো। সব কিছু খুব স্পষ্ট নয়, তবু ঝাপসাও নয়। মনে হলো, একটা পুরোনো চিঠি হাওয়ায় উড়তে উড়তে কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল। রোদ বৃষ্টি লেগে যার অক্ষরগুলো ঝাপসা হতে হতে সন্ধেবেলার আকাশের মতো হয়ে গেছে। আজ উলটো হাওয়ায় সে আবার কাছে চলে এসেছে। আর সহসা এক টুকরো জ্যোৎস্না এসে তার ওপর আলো ফেলেছে। নরম আলো। মন কেমন করা আলো।
এখন এই শেষ রাত্তিরে একা, সেই তিরিশ বছর আগেকার স্মৃতির মুখোমুখি। নিজেই যেন নিজের কাছে তুলে ধরলো সেই পুরোনো ছবি। স্মৃতির গায়ে জড়িয়ে থাকা গল্প। আর ওর সামনে বসে সেই গল্প শুনছে অন্য কেউ। যেন বা টিটো গল্প শুনবে বলে ছোটবেলার মতো গালে হাত দিয়ে অরুণিমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে উদগ্রীব হয়ে। আর ও বলছে -- শোন টিটো, এ গল্প তোর জেনে নেয়া দরকার। জানা দরকার। এ গল্প আমার, খানিকটা তোরও বা। খুব মন দিয়ে শোন।
পুরোনো সেই দিনের কথা............
রাজশাহী থেকে চলে আসার ঠিক দু’দিন আগে — কাজলা গেটে বাস থামতেই প্রায় লাফিয়ে উঠে এলো রুমা। নামবো বলে আমি আর অশ্রু প্যাকেটগুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে দরজার দিকে এগোতেই রুমা টেনে ধরলো আমাকে।
--এখানে নামিস না। শিরিন আপার বাড়ি যাবো।
শিরিন আপা আমাদের দু’বছরের সিনিয়ার। কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়তো। হস্টেলে জীবনে ওর স্নেহ আর আদর আমাকে বাড়ির অভাব বুঝতে দেয়নি। ওর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতার সূত্র অতনুদা। আমার দাদার বন্ধু। শিরিন আপা আর অতনুদার প্রেম একসময় ইউনিভারসিটি চত্বরের চর্চিত বিষয় ছিল।
রুমার হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললাম — এই এখন শিরিন আপার বাড়ি! অসম্ভব। সেই সাড়ে দশটায় বেরিয়েছি।
ও মুখ ঝামটা দিল — আমাকে না জানিয়ে বেরোলি কেন? অত সকালে, কী এমন জরুরি কাজ ছিল যে আজই না করলে চলছিল না?
--কিছু কেনাকাটা ছিল। আজ অশ্রু সেরিকালচারে যাচ্ছিলো, ভাবলাম আর তো সময় পাবো না। এখন ভীষণ টায়ার্ড লাগছে রে। হস্টেলে ফিরে স্নান না করা অব্দি শান্তি নেই। লক্ষ্মী সোনা তুই যা। শিরিনআপাকে বলিস আমি কাল গিয়ে দেখা করে আসবো।
--আমি না গেলেও চলবে। শিরিন আপা তোকেই বিশেষ করে যেতে বলেছে আজ। যাওয়া না যাওয়া তোর ইচ্ছে।
গম্ভীর মুখে জানালার পাশে সিট নিয়ে বসে বাইরে চোখ রাখলো রুমা। জানি এখন আর কিছু বলবে না। আমার সঙ্গে অশ্রুকে দেখে এমনিতে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে। অশ্রুর সঙ্গে ওর পুরোনো ঝগড়া। জিজ্ঞেস করলে কখনও কারণটা স্পষ্ট করে বলে না। আমিও জোর করি না। অন্য মেয়েরা নেমে গেছে। অশ্রু নামার জন্যে বাসের দরজায়। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম — প্যাকেটগুলো নিয়ে যাবি? আমি হস্টেলে ফিরে তোর ঘর থেকে নিয়ে আসবো। ও হাত বাড়ালো। অগত্যা সবগুলো প্যাকেট ওর হাতে গছিয়ে দিলাম। নিঃশব্দে নেমে গেল অশ্রু। আবুভাই বাসের ঘন্টি বাজানোর আগে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো — কি গো আপারা নামবেন না?
ক্যাম্পাসে অনেকগুলো স্টপেজ। আমাদের হস্টেলে যেতে হলে কাজলা গেটে নামলেই সুবিধা হয়।এরপর বাসটা মতিহার গেট হয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংএর পাশ দিয়ে আমবাগান ছাড়িয়ে টার্মিনাসে দাঁড়াবে। আমি আবুভাইকে কিছু বলার আগেই রুমা উঠে বাসের ঘন্টি বাঁধা দড়িটা নাড়িয়ে দিলো। ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাস থেকে রাজশাহী শহরটা অনেকটা দূরে। কিছু কেনাকাটা করতে গেলে শহরের প্রাণকেন্দ্র সেই সাহেববাজারে যেতে হয়। আবুভাই ইউনিভারসিটির অনেকজন বাস কনডাক্টরের মধ্যে একজন। বড্ড সদালাপী। আমাদের সবার নাড়ি-নক্ষত্র ও জানে। ও এতক্ষণ আমার আর রুমার কথাবার্তা শুনছিল। বললো — শিরিন ম্যাডাম কাল এই চারটের বাসে শহরে গেছিলেন।
‘রয়টার’-- বলে আবুর দিকে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে আমার দিকে ফিরলো রুমা।
--এই চারপাঁচ ঘন্টা ওই রামগরুড়ের ছানার সঙ্গে কী করে কাটালি বল তো?
অশ্রু একটু সিরিয়াস টাইপের মেয়ে, হাসে কম। কিন্তু রুমা ওকে সহ্য করতে পারে না বলে ওই বিশেষণ দিলো।
--আরে বাবা ও সেরিকালচারে যাচ্ছিল, তাই ওর সঙ্গে জুটে গেলাম। ওখান থেকে মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে মালার সঙ্গে একবার দেখা করে এলাম। ওর সঙ্গে আর তো দেখা হবে না।
মালা, মালেকা বানু আমার ছোটবেলার বন্ধু। মেডিক্যালে পড়ে। আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ওকেই সহ্য করে রুমা।
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংএর পাস দিয়ে বাসটা বাঁক নেওয়ার সময় চোখে পড়লো নীলুফার আর সেলিম শহিদ মিনারের চাতালে বসে আছে। ওদের দিকে হাত নাড়তেই সেলিম চেঁচিয়ে উঠলো, কবে যাচ্ছো? বাসটা এগিয়ে গেল। উত্তর দেওয়া হলো না। উত্তর আশাও করেনি ও। কারণ সবাই জানে কাল, পরশু কিংবা তার পরদিন ফাইনাল ইয়ারের সবাই একে একে চলে যাবে। এখন গোটা ক্যাম্পাস জুড়ে একটা যাই যাই সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতি বছর এই সময়টাতে বাতাস হু হু করে, পায়ের পাতা ভারি হয়ে আসে স্মৃতির ভারে।
বাস থেকে নামতেই রাবেয়া আপার মুখোমুখি। আমাদের চর্যাপদ পড়াতেন। সাজতে বড় ভালোবাসেন। সাজটাও একটু বিচিত্র বলে আড়ালে ছাত্রছাত্রীরা হাসাহাসি করে ওঁকে নিয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে যতটা সম্ভব মধুর করে হাসলেন রাবেয়া আপা,
--কবে যাচ্ছো?
--পরশু। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
কিছু একটা বলতে হয় তাই বলা। উত্তরের অপেক্ষা না করেই পাশ কাটালাম রুমার কথা ভেবে। ও সমানে আমার হাতে চিমটি কেটে যাচ্ছে। রাবেয়া আপা আবার সবকিছু বলেন একটু বেশি ডিটেলসে। রুমা সঙ্গে থাকলে কারো সঙ্গে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলা যায় না। ও খুব বিরক্ত করে। রেগে যায়। বলে তুই এত জনসংযোগ করে বেড়াস কেন রে? ইলেকশানে দাঁড়াবি?
--আশ্চর্য কথা। মানুষের সঙ্গে মানুষ সম্পর্ক রাখবে না? বনে গিয়ে বাস করলেই হয়।
--তুই তো সম্পর্কের ব্যাপারে বাছবিচার রাখিস না। ক্যাম্পাসে চারপাশে তোর এত আত্মীয়তার গিঁট, যাওয়ার সময় খুলবি কী করে?
--সবাই যেভাবে খোলে সেইভাবে খুলবো।
ইউনিভারসিটির দিন শেষ। রুমাও যাবে। সবাই যাবে। কিন্তু আমার যাওয়ার সঙ্গে ওদের যাওয়ার একটু পার্থক্য আছে। আমার তো শুধু গিঁট খোলা নয়, আমি তো যাবো শিকড় উপড়ে নিয়ে। রুমা সেটা জানে। তীব্রভাবে জানে। আর জানে বলেই ব্যাপারটাকে এড়িয়ে থাকে। এটা নিয়ে সাধারণত কিছু বলে না। কষ্টগুলো নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করে না ও।
রুমা, রুমানা আহমেদ। আমার রুমমেট, বন্ধু, পরমাত্মীয়। ভীষণ জেদি, একরোখা, সোজাসাপটা। হাতে গোনা দু’চারজন ওর পছন্দের লোক ছাড়া পরোয়া করে না কাউকে। আমাকে নিয়ে ওর দখলদারি পরিচিত সকলের জানা। অনেকেই আড়ালে নানারকম আঁকাবাঁকা মন্তব্য করে, আমার কানে আসে। গায়ে মাখি না। রুমার চেয়ে আপনজন এই পাঁচ বছরের হস্টেল জীবনে আর তো পাইনি। আমাকে ও কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না। সেই জন্যেই কারো সঙ্গে আমার বেশি ঘনিষ্ঠতা ওর একেবারেই পছন্দ নয়।
বাসস্ট্যান্ডের পুবদিকের বাঁধানো রাস্তা সোজা কেমিস্ট্রি বিল্ডিংএর দিকে চলে গেছে। একটু গিয়ে বাঁদিকে ফিজিকস বিল্ডিং, ডানদিকে অডিটোরিয়াম। দুপাশে সারি সারি হিজল আর আকাশমনির গাছ। মাঝে মাঝে দু’চারটে অর্জুন আর রাধাচূড়া। হলদে আর বেগুনি রঙের পাপড়িতে ছেয়ে আছে গোটা পথ। পা ফেলতে পায়ের পাতা শিরশির করে। এত ঝরা ফুল, এমন গন্ধে পাগল হাওয়া, পাতার বিচিত্র ফিসফাস, এসব ছেড়ে কী করে যে যাবো। আজ এদের সবার কথা, সবার ব্যথা আমার ভেতরে বাজছে। প্রত্যেকটা ঝরা পাতায়, ধুলোয় লুটোনো পাপড়িতে, প্রতিটি ঘাসের ডগায় যেন টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে আমার হৃদয়।
অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রুমা হঠাৎ থেমে গেল।
--শুনতে পাচ্ছিস ঝুম?
--কী?
--‘আমার যেতে সরে না মন, তোমার দুয়ার পারায়ে...’ অরুণিমা মজুমদার গাইছে। একটু হাসলাম।
--চোখ বন্ধ কর, শুনতে পাবি।
রুমা ঘোর লাগার মতো বললো। আমার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখ ঝরলো না বটে, বুকের ভেতর হু হু নিশ্বাসে আরো কিছু ফুল ঝরলো, পাতা উড়লো। আমার পাঁচ বছরের ক্যাম্পাস জীবনে এই অডিটোরিয়াম মঞ্চে কত যে গান গেয়েছি। এর সঙ্গে আমার আত্মার যোগ।
অডিটোরিয়ামের দরজা খোলা। ভেতরে রঙ হচ্ছে। পনের দিন পরে ফিলজফি কনফারেন্স। তার প্রস্তুতি চলছে। দুজনে পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। দেয়ালে বাঁশের ভারা বাঁধা। চেয়ার এলোমেলো করা, স্টেজের ওপর রঙের কৌটো, ব্রাশ, হাজারো সরঞ্জাম ছড়ানো। রুমা আমার হাত ধারে স্টেজের ঠিক সামনে নিয়ে গিয়ে বললো, ওই দেখ সামনের সারিতে ম্যাথসএর সুকুমার স্যার। তার পাশে আমাদের ডিপার্টমেন্টের জাকারিয়া স্যার, সুবীরদা এস্রাজ বাজাচ্ছেন।
ওর পাগলামিতে আমিও যেন আক্রান্ত হলাম। ও ধারাবিবরণীর মতো বলে যাচ্ছে, আর আশ্চর্য আমার চোখের সামনের বাস্তব ছবিটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আমিও যেন ও যা বলে যাচ্ছে, সব দেখতে পাচ্ছি। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, ইংরেজির নাজমা অ্যানাউন্স করছে — অরুণিমা মজুমদার এবার গাইছে... ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো...’। আর ওই তো অডিটোরিয়ামের ডান দিকের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ইকবাল একমনে গান শুনছে। ওর ওই এক অভ্যেস, কোনোদিন চেয়ারে স্থির হয়ে বসে কোনো অনুষ্ঠান দেখে না। যেন অন্য কোথাও যাওয়ার আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু শুনেই চলে যাবে।
হঠাৎই কানে এলো ইকবালের গলা। রুমার নাম ধরে ডাকছে। ঘোর কেটে গেল। পিছন ফিরে দেখি সত্যিই দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ইকবাল।
--কি রে তোরা এখানে কী করছিস?
--অরুণিমার গান শুনতে এসেছিলাম। রুমা স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দে বললো।
--মানে?
--সব কিছুর মানে জানাতে হবে? মানে ওই তো স্টেজে অরুণিমা গাইছে। চোখ নেই?দেখতে পাচ্ছিস না?
ইকবাল হাসলো না। বিচলিত হলো না। সহজ গলায় বললো, তোর মতো অতটা দূরদর্শী নই, তাই দেখতে পাচ্ছি না। তবে শুনতে পাচ্ছি, কানে বাজছে।
--বাজছে তো? সেই কথাই তো বলছি। তুই এখানে কী করতে?
--ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে দূর থেকে তোদের দেখতে পেলাম। তুই আর অরুণিমা বাস থেকে নেমে সোজা এখানে ঢুকলি। কৌতূহল হলো। তাছাড়া জানি তো — যাবার সময় হলো বিহঙ্গের। ইচ্ছে হলো একটু কথা বলতে। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
বললাম, রুমাও তো পরশু যাচ্ছে আমার সঙ্গে।
--তোর সঙ্গে মানে তোদের বাড়ি?
--না না ও পাকশিতে নেমে যাবে।
রুমা কুষ্টিয়ার মেয়ে। পাকশিতে ওর মামার বাড়ি। আমাকেও দু’বার বেড়াতে নিয়ে গেছে পাকশিতে। ইকবালও কুষ্টিয়ার ছেলে। ছোটবেলা থেকে ওরা দুজন সহপাঠী। রুমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা প্রেমের হলেও বন্ধুত্বটাই আসল। ইকবালের সাবজেক্ট ফিজিকস। খুব ভালো কবিতা লেখে। বন্ধু হিসেবেও খুব নির্ভরশীল। মনে আছে একবার প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ডাক ধর্মঘট চলছিল। সুপ্রিয়র সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমার মন খারাপ দেখে ইকবাল রাজশাহী শহরে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল আমাকে সুপ্রিয়র সঙ্গে ফোনে কথা বলার জন্যে। রুমার প্রেমিক ছাড়াও ওর প্রতি একটা শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভালোলাগা আছে। আজ সেই ভালোলাগাটুকু ব্যথার মতো স্পর্শ করলো। হয়তো ছেড়ে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে বলে বুকের ভেতর আবেগ জমছে।
আমাদের পাশে হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল আবার বললো, পাখি তাহলে উড়ছে কবে? ও আমার কোন উড়ানের কথা বলছে আমি জানি। এড়িয়ে গেলাম।
‘ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে, যা পাখি যা উড়ে যা রে একাকী...’ অজান্তে গলা দিয়ে গানের এই লাইনটা বেরিয়ে এলো সুরে। থামতেই ইকবাল বললো, থামলি কেন অনেকদিন তোর গান শুনিনি, চল না কোথাও বসি।
রুমা ঝাঁঝিয়ে উঠলো, অনেকক্ষণ বকেছিস। এবার দয়া করে কেটে পড়। পাঁচ বছর ধরে ও অনেক গান শুনিয়েছে, সেইগুলো রি-ওয়াইন্ড কর। আমরা এখন শিরিনআপার বাড়ি যাচ্ছি। যাবি তুই? তোকে অবশ্য যেতে বলেনি, মাইন্ড ইট।
রুমার মাথায় আলতো চাঁটি মেরে নিজের হস্টেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলো ইকবাল। ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে হলো — এরা আমার কেউ নয়? এই যে রুমা আমার হাত মুঠোয় ধরে হাঁটছে, আর ক’দিন পরেই এরা আমার জীবনযাপন থেকে মুছে যাবে? আর কখনও দেখা হবে কি ওদের সঙ্গে? দাদা বারবার করে চিঠি লিখছে বাবাকে — ঝুমুরকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দাও। ভুলেও যেন ওখানে চাকরির চেষ্টা না করে। একদিন চলে যখন আসতেই হবে, এখানে এসে সেটল করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
একটু একটু করে টান লাগছে শিকড়ে। বুকের মধ্যে পাক দিয়ে উঠছে ছোট ছোট ঢেউ। কষ্টের, অভিমানের। ইকবাল, নীলুফার, সেলিম, রোজিনা ওরা সবাই জানে আমাকে চলে যেতে হবে এদেশ ছেড়ে। যেতেই হবে। জানে এবং গ্লানিহীন মেনেও নেয়। কেন যেতে হবে এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। শুধু একজন কিছুতেই মানতে পারে না, বুঝি। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে তার চোখ জলে ভরে ওঠে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে কাঁদে, আমি টের পাই। অদ্ভুত সব কথা বলে। পাগলামি করে। একদিন মাঝ রাত্তিরে উঠে আমাকে জাগিয়ে বললো,
--ঝুম, তোর দাদার সঙ্গে আমার বিয়ে দিবি?
--না, তোর মতো ছিটিয়ালকে সামলানো আমার দাদার কম্মো নয়। ও হান্ড্রেড পার্সেন্ট নর্মাল মানুষ।
--আমি নিজেকে চেঞ্জ করে নেব।
--ইকবালের কী হবে? ও তো তোর পাগলামিতেই অভ্যস্ত। ও নর্মাল মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে পারবে না।
--তুই কি ভাবিস আমাকে না পেলে ইকবাল মরে যাবে? মোটেই না। ওর হাড় জুড়োবে, চারটে ভাত বেশি খাবে। ও জানে তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।
--তাহলেও না। কারণ আমার দাদা একজনকে ভালোবাসে। তাকেই বিয়ে করবে।
--তাহলে কী হবে?
--সেটা কাল সকালে দুজনে মিলে ভাববো। প্লিজ এখন ঘুমোতে দে। আর পাগলামি করিস না।
--তোর কাছে ঘুমোবো আজ।
--উঠে আয়।
আমার পিঠের সঙ্গে মুখটা গুঁজে শুয়ে থাকে। টের পাই আমার পিঠ ভিজছে। অস্বস্তি হয়, তবু ভিজতে দিই। কারণ আমারও গলার কাছটা ব্যথা করতে থাকে।
পরদিন সকালে চা খেতে খেতে রুমা বলে,
--একটা উপায় ভেবেছি ঝুম। আমার ছেলের সঙ্গে তোর মেয়ের বিয়ে দিবি?
--তারা কোথায়?
--ইচ্ছে হয়ে আছে মনের মাঝারে।
--আমার যে মেয়েই হবে তোকে কে বললো?
--হতেই হবে।
--হতেই হবে কেন? আমার যদি ছেলে হয় তাতে তোর আপত্তি কোথায়?
--তাহলে তো আমার মেয়েকে নিয়ে তোর ছেলে চলে যাবে। সেটা হলে তো চলবে না।
--আশ্চর্য পাগল, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি বলে কি তোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?
--জানি না। তবে আমি অনেক ভেবে দেখেছি, শুধু হৃদয়ের সম্পর্ক দিয়ে আত্মীয়তা স্থায়ী হয় না। তার জন্যে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
থেকে থেকে এই রকম আরও কত পাগলামি ওর।পাশে পাশে হেঁটে যাওয়া রুমার হাত ছুঁয়ে আজ আবার গলার কাছটা ব্যথা করে উঠলো। চোখ ঝাপসা।
বুঝতে পারিনি কখন শিরিনআপার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পৌঁছে গেছি। ব্যালকনির গ্রিল ছাপিয়ে মানিপ্ল্যান্ট আর লতানে গোলাপ ঝুলে আছে। দোতলায় উঠে বেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে গেল — শিরিনআপা। সেই মন ভালো করে দেওয়া হাসি, চোখের পাতায় সেই প্রশ্রয়ের ছায়া।
--আয় খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে তোকে। নে, ফ্রেশ হয়ে নে। একটা তোয়ালে এনে হাতে ধরিয়ে দিল। হাত মুখ ধুয়ে ফিরে এসে দেখি ওরা দুজন ড্রয়িংরুমে চুপচাপ বসে আছে। রুমা দাঁত দিয়ে নখ কাটছে, শিরিনআপা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মনে হলো বাতাস কিছুটা ভারাক্রান্ত। হালকা করতে চাইলাম — কী ব্যাপার বলো তো, তুমি পেয়াদা পাঠিয়ে আমাকে ধরে আনলে। আমি তো কাল আসবোই ভেবে রেখেছিলাম।
--কাল এলে তো আজকের দিনটা ফুরিয়ে যেত। শিরিনআপা আমার দিকে ফিরলো, তার পর উঠে গিয়ে একটা বাটিতে খানিকটা পায়েস এনে এক চামচ আমার মুখে তুলে দিল। কাজুর পায়েস, আমার খুব প্রিয়। বুঝলাম কেন আজই আসার জন্যে রুমার এত পীড়াপীড়ি।
--তোমার মনে ছিল?
--তুই ছাড়া আর সবার মনে ছিল। যাদের তুই একদম পাত্তা দিস না এমন কি তাদেরও সকাল থেকে মনের মধ্যে এটাই ঘুরছিল।
রুমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বুঝলাম আমি সকালে ওকে না জানিয়ে শহরে যাওয়ার জের এখনও চলছে।
সেন্টার টেবিলের ওপর একটা গীতবিতান। শিরিনআপা বললো, ওটা তোর জন্যে।
--কোথায় পেলে? রাজশাহীতে পাওয়া যায় না আমি জানি।
--সে তো আমিও জানি। একজনকে দিয়ে আনিয়েছি।
--কাকে দিয়ে?
--শুনলে তোর হাসি পাবে। আলিকে দিয়ে।
বইটা খুলে দেখি প্রথম পাতায় লেখা-- ‘এ পরবাসে রবে কে’। বুকের মধ্যে কেমন করে উঠলো। শিরিন আপার লুকোনো ব্যথার জায়গাটা আর একবার দেখতে পেলাম। একটা ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ছায়া কি আজও লালন করছে ও নিজের মধ্যে? আমার মতো অতনুদাও এই মাটির দাগ গা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের শিকড়বাকড় উপড়ে নিয়ে চলে গেছে। আর সেই শূন্যতাটুকুকে কি স্থায়ী রক্তক্ষরণের মতো বয়ে বেড়ায় শিরিন আপা? ওর প্রতিদিনের জীবনযাপনে তার কোনো ছায়া পড়ে না। স্বামী, তিন বছরের ছেলে উজান, নিজের অধ্যাপনা সব কিছু নিয়ে ওর সংসারে আনন্দধারা বয়। সেখানে কোনো ফাঁকি নেই।
--তোমার নামটা লিখে দিলে না?
--লিখে না দিলে ভুলে যাবি আমার নাম?
ভুলেছি কি ভুলিনি সেটা কথা নয়। কিন্তু সেই নাম লেখা পৃষ্ঠাটা কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল এটা সত্যি। উড়ে উড়ে এসে বাঁধা পড়ে ছিল অন্তর্জালের কোনো এক গিঁটে। এতদিন পরে কে তাকে ফিরিয়ে আনলো এটা ভাবতে গিয়ে মনটা আবার অস্থির হলো অরুণিমার। তার প্রতি একটা দুর্নিবার টান অনুভব করলো। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত রসায়ন, অতীত বর্তমান মিলিয়ে কিছুটা উথালপাথালও। মনে মনে বললো, জানিস টিটো, সেদিন শিরিনআপার বাড়ি থেকে ফিরে দেখি টেবিলের ওপর এক ডাল কৃষ্ণচূড়া। তার আড়ালে একটা সুন্দর ফটোফ্রেম। রুমার অভিমানের হেতু বোঝা গেল। নিজের ওপর রাগ হলো আমার। একটু পরে পাশের রুমের আভাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলো রুমা। রুমার ক্যামেরায় আমাদের দুজনের অনেকগুলো ছবি তুলে দিলো আভা। কৃষ্ণচূড়ার সঙ্গে রুমা আর আমার একটা ছবি ওই ফটোফ্রেমে রাখা ছিল। তুইও দেখে থাকবি। মায়ের খুব পছন্দের ছিল সেটা। মায়ের ঘরের নিচু কাঠের আলমারিটার ওপর থাকতো। সাদাকালো ছবি। ছবিটার গায়ে হলুদ ছোপ পড়েছিল বলে একসময় আমিই ওটা সরিয়ে রেখেছিলাম ওখান থেকে। আছে হয়তো কোথাও।
চা খেতে খেতে সুপ্রিয় বললো, কাল রাতে কাকে স্বপ্ন দেখছিলে? কারো নাম ধরে চেঁচিয়ে ডাকছিলে।
--সে ভারি অদ্ভুত স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্নটার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে, সেটাই বেশি ইন্টারেস্টিং। পুরো ব্যাপারটা না বললে তুমি বুঝতে পারবে না। আর গুরুত্বও দেবে না।
--বেশ তো ব্যাকগ্রাউন্ডটাই শুনি আগে।
--না, সেটা এখন বলা যাবে না। আগে টিটোর সঙ্গে কথা বলি, তারপর।
--স্বপ্ন দেখলে তুমি,এতে টিটোর সঙ্গে কথা বলার কী আছে? ওর সঙ্গে কী সম্পর্ক?
--আছে। বলছি তো সবটা না শুনলে তুমি বুঝবে না।
--ছেড়ে দাও। কিন্তু চেঁচিয়ে ডাকছিলে কাকে, আমি ঘুমের ঘোরে ঠিক বুঝতে পারিনি।
--রুমাকে, তোমার মনে আছে রুমার কথা?
--রুমা, মানে রাজশাহী, মানে তোমার সেই রুমমেট? ইন্টারেস্টিং। এতদিন পরে হঠাৎ রুমাকে!
--সেটাই তো রহস্য। জানো আমার খুব এক্সাইটেড লাগছে। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না।
সুপ্রিয়র এ সময় খুব তাড়া থাকে। ব্যাপারটা নিয়ে আর আগ্রহ দেখালো না। খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। অন্যদিন সুপ্রিয় বেরিয়ে যাওয়ার পর সকালবেলাতেই স্নান করে নেয় অরুণিমা। পুরোনো অভ্যেস। আজ ব্যতিক্রম হলো, উঠতে ইচ্ছে করছে না। বাইশ বছর বয়সটা ছেয়ে আছে মনে। পুরোনো ছবিগুলো একবার দেখতে ইচ্ছে করছে, দেখা দরকার। সবই রয়েছে ও-বাড়িতে। মায়ের আলমারিতে হয়তো, গিয়ে খুঁজতে হবে।
বিয়ের আগে পর্যন্ত নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়ানেয়া হতো রুমার সঙ্গে। বিয়ের পর দু’বছর সিঙ্গাপুর। তারপর কলকাতায় ফেরার পর কিছুদিন কোন্নগরে। তখনও অরুণিমার বিয়ের আগের যাবতীয় জিনিসপত্র মায়ের বাড়িতেই ছিল। নিজেদের ফ্ল্যাটে শিফট করার পর প্রয়োজনীয় যেটুকু, শুধু সেই জিনিসগুলো একটু একটু করে নিয়ে এসেছিল। ওই ছবিগুলো আনার কথা মনে হয়নি। রুমার অনেক ছবি ছিল। ভাবতে চেষ্টা করলো যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হলো কেন? একটা নির্দিষ্ট গ্যাপে চিঠি লিখতো দুজনেই। তারপর একটা সময়, কে শেষ চিঠি লিখেছিল, কে তার আর উত্তর দেয়নি, তারপর কবে যে সুতোটা ছিঁড়ে গেল, মনে নেই।
--বৌদি রাতের জন্যে কী তরকারি হবে?
ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শোভা। অরুণিমা কোনো উত্তর দিল না। রাতের রান্না সকালেই গুছিয়ে রাখে শোভা। টেবিল থেকে জলখাবারের প্লেট তুলতে তুলতে আবার জিজ্ঞেস করলো। এইবার সচকিত হলো অরুণিমা।
--কী বলছিলে?
--তুমি কী ভাবছিলে বলতো, আমি একই কথা দুবার জিজ্ঞেস করলাম। বলছি রাতের জন্যে কী রান্না হবে? অরুণিমা একটুখানি ভেবে নিয়ে বললো, রাতের জন্যে কিছু করার দরকার নেই। একটু পরে আমি মায়ের কাছে যাবো।
--কখন যাবে?
--এই স্নানটান করে নিয়ে বেরুবো।
ও-বাড়িতে গেলে অরুণিমা রাতে একেবারে খেয়েদেয়ে সুপ্রিয়র সঙ্গে ফেরে এটাই নিয়ম, শোভা জানে। তার মানে বিকেলটা কোনো কাজ নেই। অনেকদিন ধরে ভাবছে বোনের নাতনিটাকে একবার দেখতে যাবে। খুশি খুশি মনে নিজের কাজে হাত দিলো শোভা।
গেট খুলে ভেতরে ঢুকেই অরুণিমার চোখে পড়লো বারান্দার সিঁড়ির ওপর তখনও শিউলি ফুল ঝরে পড়ে আছে। গাছটা বারান্দায় ওঠার সিঁড়ির ঠিক পাশে। গাছটাকে ঘিরে খানিকটা ঘাসের জমি। ঘাসের ওপর যে ফুলগুলো ঝরে, মা বরাবর শুধু সেই ফুলগুলো পুজোর জন্যে নেন।বারান্দায় ওঠার সময় অরুণিমা রোদে কিছুটা ম্লান হয়ে আসা তিন চারটে শিউলি নিয়ে গন্ধ শুঁকলো। তারপর শব্দ না করে গ্রিলের দরজা খুললো।
বারান্দায় প্রচুর টব। সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে একটা দিক, চারপাশে মন ভালো করে দেওয়া গন্ধ। মায়ের খুব গাছের শখ। বাড়ির পেছন দিকে ছোট্ট এক টুকরো উঠোন আছে। এখানে আসার পর সেই উঠোনের চারপাশ ঘিরে গোটা কয়েক আম, নারকেল, একটা কাঁঠাল আর একটা কাগজি লেবুর গাছ লাগিয়েছিলেন বাবা। সেগুলো এখনও প্রচুর ফল দেয়। আর আছে মায়ের ঘরের জানালার ঠিক পাশে তিন চারটে সুপুরি গাছ। বাংলাদেশের বাড়িতে অনেক সুপুরি গাছ ছিল, বাবার ঘরের পাশে। এখানে চলে আসার পর বাবা প্রায়ই নজরুলের ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ আবৃত্তি করতেন। আবৃত্তি করতে করতে বাবার চোখ জলে ভরে উঠতো। বাবা জোগাড় করতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা কোত্থেকে কাকে দিয়ে যেন এই সুপুরি গাছগুলো এনে লাগিয়েছিলেন। তাতেও মায়ের মন ভরেনি। বাড়ির সামনের নিচু পাঁচিলের গায়ে গায়ে কত যে গাছ লাগিয়েছেন। দাদা বলে মায়ের এক টুকরো বাংলাদেশ।
ডোরবেলে হাত ছোঁয়ানোর আগেই দরজা খুলে গেল। টুপুর বেরোচ্ছে। অরুণিমাকে দেখে উচ্ছসিত — পিসি তুমি এখন ! কোনো বিশেষ দরকার?
--কেন রে দরকারে ছাড়া আসা যায় না তোদের বাড়ি?
--ওহ পিসি, বাড়িটা আমারও যেটুকু, তোমারও ততটুকুই। কিন্তু তুমি তো এই সময় বিনা নোটিশে এমনি এমনি আসো না।
--আজ এমনি এমনি আসতে ইচ্ছে করলো।
--এটা দারুণ ব্যাপার হলো। আমি না ফেরা পর্যন্ত যাবে না কিন্তু।
--কখন ফিরবি?
--চারটের মধ্যে ফিরে আসবো। থেকো কিন্তু, তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। দু’তিনদিন ধরে ভাবছিলাম তোমার কাছে যাবো।
অরুণিমার বুকের মধ্যে একটা টুং করে শব্দ হলো যেন। কী কথা ওর সঙ্গে টুপুরের? টিটোকে নিয়ে কিছু বলবে কি? টিটোর সঙ্গে খুব ভাব ওর। টিটো টুপুরের চেয়ে মাত্র তিন বছরের ছোট হলেও ব্যক্তিত্বের জন্যে টুপুরকে টিটোর চেয়ে অনেক বেশি বড় লাগে। তবু দুজনের মধ্যে একটা খুব সুন্দর বাইন্ডিং আছে। টিটোর ধারণা, টুপুর ওর জানা সবচেয়ে সেনসিবল আর লজিকালি কারেক্ট মানুষ। টুপুর ওকে খুব প্রশ্রয়ও দেয়। অরুণিমার ধারণা টিটো সব কথা বলে টুপুরের কাছে। গভীরভাবে তাকালো টুপুরের মুখের দিকে।
--আজ শাড়ি পরেছিস যে বড়?
--ডিপার্টমেন্টে একটা অনুষ্ঠান আছে। স্পেন থেকে একজন মহিলা এসেছেন, ওখানকার খুব নাম করা কবি। তাঁর কিছু কবিতা ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে আমি অনুবাদ করিয়েছি। সেগুলো পড়া হবে। মূল স্প্যানিশটা আমি পড়বো, ওরা অনুবাদগুলো পড়বে। বাইরের কোনো গেস্ট এলে আমি সাধারণত শাড়িই পরি, সেটা কি তুমি জানো না খুকুমণি?
অরুণিমাকে জড়িয়ে ধরে একটু আদর করে বেরিয়ে গেল টুপুর।
শর্মিলাকে এ সময় বাড়িতে দেখে অবাক হলো অরুণিমা — বৌদি, তুমি স্কুলে যাওনি কেন?
--আমাদের স্কুলের গভর্নিং বডির একজন মেম্বার মারা গেছেন, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে আজ। ভালোই হলো তুই এসেছিস। তোর কথাই ভাবছিলাম ক’দিন ধরে।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর অরুণিমার পীড়াপীড়িতে সুরমা আলমারি খুঁজে একটা প্যাকেট আর দুটো পুরোনো অ্যালবাম বার করে আনলেন।বেছে বেছে যে ছবিগুলোতে রুমা আছে, সেইগুলো খুলে নিলো অরুণিমা।
--কি রে, ছবিগুলো খুলছিস কেন? কী হবে ওগুলো দিয়ে?
--নিয়ে যাবো। কাল রাতে স্বপ্ন দেখেছি রুমাকে। আমার ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসকে। তাই মনে হলো ছবিগুলো আমার কাছেই নিয়ে রাখি। এগুলোতে তো আর কারো ইনটারেস্ট নেই।
--যোগাযোগ আছে রুমার সঙ্গে?
--নাহ, সেই সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর থেকে তো আর...
--তুই যাওয়ার পরও দু’একবার লিখেছিল মনে হয়। তোকে পাঠানো হয়নি।
লাফিয়ে উঠলো অরুণিমা--
–-লিখেছিল! কই কখনও বলোনি তো। আশ্চর্য!
--কতদিন পরে ফিরেছিলি তোরা, মনেই ছিল না ছাই।
--ফোনেও তো জানাওনি যে আমার চিঠি এসেছে।
--ওরে বাবা তখন কত দরকারি কথা থাকতো, তার মধ্যে এসব মাথায় থাকে নাকি?
–-এটাও দরকারি কথা মা। যাই হোক ফেলে দাওনি নিশ্চয়?
--ওমা, ফেলবো কেন! কোথায় কোন পুরোনো কাগজপত্রের মধ্যে মিশে আছে হয়তো।
--খুঁজে দেখো না মা প্লিজ। আমার খুব দরকার।
--তোর কি মাথা খারাপ! তিরিশ বছর আগের চিঠি কোথায় খুঁজবো আমি?
--আশ্চর্য কথা ! আমার জিনিস আমার হাতে পৌঁছে দেওয়ার কথা মনে হবে না তোমাদের? সেটাকে যত্ন করে রাখবে না? এই জন্যেই লোকে বলে, বিয়ের পর মেয়েদের বাপের বাড়ির চৌকাঠ উঁচু হয়ে যায়।
--এই দেখ, এত রাগ করছিস কেন? আচ্ছা বাবা খুঁজে দেখবো আমি।
এই সময় শর্মিলা এসে দরজায় উঁকি দিলো — ঘুমোবি নাকি ঝুমুর?
--না, কেন?
--একবার আমার ঘরে আয়।
--পুজো শপিং?
--তুই আয়,বলছি।
--চলো।
নিজের ঘরে ঢুকে শর্মিলা দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসে বললো, বোস তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
--কী ব্যাপার বলো তো, টুপুর বলে গেল আমার সঙ্গে বিশেষ কথা আছে। তুমি বলছো... আমার তো বুক ঢিব ঢিব করছে।
--আর বলিস না। টুপুরটা যা শুরু করেছে। শর্মিলা প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়।
--কেন কী হলো? প্রেম করছে?
--তাতে কে আপত্তি করেছে। প্রেমটা ঠিকঠাক হলে তো হতো।
--মানে?
--ভদ্রলোক ওর ডিপার্টমেন্টের। ওর চেয়ে অন্তত পনের বছরের বড়ো।
--এটাই তোমার আপত্তির কারণ?
--না রে বাবা, ভদ্রলোক বিবাহিত।
--সে কি? ইলেকট্রিক শক লাগার মতো মুখ অরুণিমার।
--তবে আর বলছি কী।
--টুপুরের হঠাৎ এমন দুর্মতি হলো কেন?
--আমি জানি না। রাতে আমি ঘুমোতে পারছি না। তোর দাদা, মা কেউ জানে না এখনও।
--আমি তো ভাবতাম অনুষ্টুপ। সেই যে ইকনমিকস নিয়ে পাশ করলো, জেএনইউ-এ পিএইচডি করছিল তার সঙ্গে টুপুরের রিলেশান। একবার আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। খুব চমৎকার ছেলে।
--আমিও তো সেটাই ভাবতাম। আমারও খুব ভালো লাগতো ছেলেটাকে। নিশিন্ত ছিলাম। আমাদের ভাবনার সঙ্গে কিছুই মেলে না।
--এই ব্যাপারটা তুমি জানলে কেমন করে? টুপুর বলেছে?
--ও আমাকে বলে নাকি কিছু? আমার কলিগ নমিতাকে তো তুই চিনিস। ওর স্বামী অমিত ইংরেজি পড়ায় ওখানে। অমিতের সঙ্গে সেই ভদ্রলোকের খুব বন্ধুত্ব।
--সে-ই বা কী করে জানলো?
--তাকে হয়তো বলেছে। ডিপার্টমেন্টে সবাই নাকি কানাঘুষো করে ওদের নিয়ে। বল তো কী লজ্জার কথা।
--টুপুরকে সরাসরি জিজ্ঞেস করো তুমি।
--আমার সাহস হচ্ছে না, যা মেয়ে। তুই জেনে নে ব্যাপারটা কদ্দুর গড়িয়েছে।
--এখনকার ছেলেমেয়ে গুলো বড্ড ডেস্পারেট। শুধু নিজের ইমোশানটাই বোঝে।
অরুণিমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর একটা কাঁটা বিঁধে গেল মনে। টুপুর ফিরলো তিনটে নাগাদ। চেঞ্জ করে নিয়ে একচোট হৈহৈ করলো, অন্যসময় যেমন করে। ডিপার্টমেন্টের নানারকম গল্প করলো। ওদের অনুষ্ঠান কত ভালো হয়েছে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো অরুণিমার দিকে।
--পিসি তুমি অন্যমনস্ক। শুনছো না আমার কথা। এনিথিং রং?
--না রে, কিছু না।
--কিছু না বললেই হলো? আমি তোমাকে চিনি না? তোমার মুখ বলছে... মায়ের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে?
--বাহ, এতক্ষণ আছি, কথা হবে না কেন?
--বুঝতে পেরেছি। কী কথা হয়েছে, আমাকে বলতে চাও না। বেশ তাহলে আমিই বলছি, মন দিয়ে শোনো। আমি একজনকে ভালোবাসি। আমরা হয়তো বিয়েও করবো। কিছুটা সময় লাগবে।
--কেন সময় লাগবে কেন?
--ও ম্যারেড। সেপারেশানে আছে। ডিভোর্সটা হয়ে গেলেই...।
--টুপুর তাদের ডিভোর্সের উপলক্ষ্য কি তুই?
--একেবারেই না। আমাকে ভিলেন ভেবো না। আমি একটা শূন্য জায়গা ভরাট করেছি মাত্র।
--এই বিয়েটা করতেই হবে?
অরুণিমার মুখের দিকে চোখ রেখে কিছুক্ষনচুপকরে থাকলো টুপুর। তারপর গম্ভীর মুখে বললো,
--না। বিয়ে করতেই হবে এমন নয়। তোমাদের সবার জন্যে এই স্যাক্রিফাইসটুকু করতে পারি। কিন্তু সম্পর্কটা থাকবে। সেটা বিয়ে না করেও পসিবল। আর কিছু জানতে চাও?
--যেটুকু বললি সেটা আগে হজম করি।
--করো। আর আমার মাকেও হজম করাও।
--কেন বৌদি কি কিছু বলেছে তোকে?
--বললে তো মিটেই যেতো। কিছু বলছে না, অথচ আঁকাবাঁকাভাবে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করছে আমাকে। আমি জানি মা আমাদের সম্পর্কে কিছু জেনেছে, তবে সেটা প্রপার ওয়েতে নয়।
--বেশ তো, তুই প্রপার ওয়েতে বল তোর মাকে।
--তোমার সঙ্গে যেভাবে বলতে পারি, মায়ের সঙ্গে কি সেভাবে কিছু বলা যায়, তুমিই বলো।এমনিতে আমার সামনে এলে এমন শোকাহত মুখ করে থাকছে, যেন আমি আত্মহত্যা করতে চলেছি।
অরুণিমা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মনে মনে বললো, আত্মহত্যাই তো। টুপুর যে এমন বিশ্রী একটা জটিলতায় নিজের জীবন জড়িয়ে ফেলবে স্বপ্নেও ভাবেনি। টিটোর ব্যাপারে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার কথা মনেই এলো না। টিটোর ওই লুকোছাপাটুকু ও নিজেই খুঁজে নেবে। সুপ্রিয়কে ফোন করে বললো, অফিস ফেরত মায়ের এখানে চলে আসতে।
সন্ধেবেলায় সুপ্রিয়কে দরজা খুলে দিতে দিতে শর্মিলা কৃত্রিম গাম্ভীর্যে বললো, দেখো চৌকাঠে আবার হোঁচট খেওনা যেন।
--আচমকা চৌকাঠে হোঁচট খেতে যাবো কেন আমি?
--ওহো তুমি তো জানো না, ঝুমুর আজ উপলব্ধি করেছে বিয়ের পর বাপের বাড়ির চৌকাঠ উঁচু হয়ে যায়।
--এটা তো আমার বাপের বাড়ি নয়। কিন্তু ঝুমুরের হঠাৎ এই উপলব্ধির হেতু কী?
--ওর বন্ধু রুমার প্রায় তিরিশ বছর আগে লেখা চিঠি কেন ওর হাতে তুলে দেয়া হয়নি, সেটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
--দাঁড়ান দাঁড়ান, কী বললেন? রুমা? কাল থেকে রুমা ভর করে আছে ওর মাথায়। রাতে ঘুমের ঘোরে, সকালে ব্রেকফাস্টের টেবিলে...কালচার করতে হচ্ছে ব্যাপারটা। তার আগে টুপুরের হাতের এক কাপ কফি খেতে চাই। টুপুর আছে তো বাড়িতে?
এই সময় অনির্বাণ ঘরে ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে বললো, টুপুর আমিও লাইনে আছি রে। কফি খেতে খেতে বাপের বাড়ির চৌকাঠ নিয়ে আর এক প্রস্থ হাসি মজা হলো। টুপুর বললো --পিসি আমিও মেপে রাখছি, পরে দেখবো আমার বেলায় কতটা উঁচু হলো।