• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮১ | জানুয়ারি ২০২১ | উপন্যাস
    Share
  • অন্তর্জাল (৫) : অঞ্জলি দাশ


    ।।১৬।।

    কালবেলায় ঘুম ভেঙে তমা দেখলো বারান্দার রেলিং-এর নরম রোদ্দুরের মাঝে মায়ের শাড়ির প্রান্ত অলস পড়ে আছে। বুঝলো, মা ওখানে চুপচাপ বসে আছে। ওই রেলিংটার গায়ে মায়ের একাকীত্ব লেগে থাকে। তমা মাঝে মাঝে যখন রেলিংএ মুখ রাখে, মায়ের সেই একাকীত্বের গন্ধ পায়। মায়ের কিছু নিজস্ব সুগন্ধী আছে, নিজস্ব কিছু প্রসাধনীও। ভালো লাগলেও তমা কখনও ওগুলো ব্যবহার করে না। মা করতে বললেও করে না। ওগুলো এক্সক্লুসিভলি মায়ের গন্ধ হিসেবে রেখে দিয়েছে। সেই গন্ধটাই শরৎকালের গা শির শির করা হাওয়ার সঙ্গে মিশে ওকে ঘুম থেকে জাগিয়েছে আজ। তার মানে মা এখন ওই রেলিংএর পাশে। মায়ের একাকীত্ব মোচনের চেনা স্পেস। কিন্তু প্রায় পাঁচ মাস পর বাড়ি ফিরেছে তমা। ও কাছে আছে, তবু কেন মা ভোরবেলায় ওখানে? এমনিতে গতকাল থেকে একটা কুয়াশার ভেতর আছে তমা ফোনের ব্যাপারটা নিয়ে। রং নাম্বারই যদি হবে, তাহলে সেটা কেন অন্যমনস্ক করে রেখেছে মাকে? জিজ্ঞেস করলেও মা কিছু খুলে বলছে না।

    জেগে জেগে দেখা স্বপ্নটুকুর আস্বাদ পুরোপুরি নিতে পারলো না। মনে মনে বললো – তোমার কথা ভাবতে আমি ভালোবাসি উপল, ওটা আমার প্রিয় অবসর যাপন। কিন্তু তার চেয়ে আরো অনেকখানি বেশি ভালোবাসি মায়ের মধ্যে ডুবে যেতে। আমার পৃথিবী আমার মা। সেই পৃথিবী বিষাদে ডুবে থাকলে চারপাশটা শূন্য লাগে। তখন তুমিও কুয়াশার আড়ালে চলে যাও। যদি পারি, একদিন আমার সেই পৃথিবীর মাঝখানে তোমাকেও নিয়ে আসবো উপল, পথ হাতড়াচ্ছি। একটু সময় চাই।

    --মা...। তমা বিছানায় শুয়েই ডাকলো।

    --মা...। দুবার ডাকার পর রোদ্দুরমাখা আঁচল নড়ে উঠলো। মায়ের গন্ধটা আর একটু জড়িয়ে ধরলো ওকে।

    --ডাকছিস কেন?

    -মা...। মা...। আবার পরপর দুবার ডাকলো তমা।

    কান্তার এতক্ষনে সম্বিত ফিরলো। এ তো সেই নামের নেশায় ডাক। ছোটবেলায় ঘুম ভেঙে ‘মা মা মা মা...’ এভাবে অসংখ্য বার ডেকে যেতো তমা। কান্তা কাছে এসে আদর করে বলতো, কী বলবি?

    --মা বলবো। মা মা মা...।

    --এতবার মা মা বলার কী আছে?

    --আমার ভালো লাগছে বলতে।


    সেই সব দিনের কথা ভাবতে ভাবতেই কান্তা ভেতরে এলো। তমার বিছানার পাশে বসে ওর কপালের ওপর, মুখের একপাশ জুড়ে লুটিয়ে থাকা চুলের গোছা সরাতে সরাতে বললো – এত তাড়াতাড়ি তোর ঘুম ভাঙলো যে? শীত করছিল? ভোরের দিকে একটু একটু ঠান্ডা পড়ছে ক’দিন ধরে।

    পাশে গুটিয়ে থাকা চাদরটা টেনে ওর গায়ে দিয়ে দিল। তমা সরে এসে কান্তার কোলের ওপর মুখটা গুঁজে দিয়ে বললো – তুমিই বা এত সকালে বারান্দায় কী করছিলে?

    ঘুম ভেঙে গেল, উঠে পড়লাম। কী আর করি, বারান্দায় বসে সূর্য ওঠা দেখলাম। শিউলি ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। ভালো লাগছিল বসে থাকতে।

    তমা লাফ দিয়ে উঠে পড়লো, মা চলো না লিলি খালাদের বাসায় যাই শিউলি ফুল নিয়ে আসি। --রোদ উঠে গেছে এখন আর ফুল পড়ে আছে নাকি, করবীদির শাশুড়ি কখন কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন।

    --করবী কাকিমাদের রোজ ফুল লাগে, তাই না মা?

    --হ্যাঁতো। রোজ পুজো করে যে।

    --ব্যাপারটা খুব সুন্দর, তাই না মা? হিন্দুরা খুব ফুল ভালোবাসে।

    --ও আবার কী কথা! ফুল ভালোবাসার আবার হিন্দু মুসলমান কি? ফুল সবাই ভালোবাসে। আমরা স্কুলের বইএ একটা কবিতা পড়তাম--‘কোরানের বাণী’ নামে। কবিতাটা এইরকম... ‘জোটে যদি মোটে একটি পয়সা, খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি/ দুটি যদি জোটে, তবে অর্ধেকে ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী...’ সবটা মনে নেই।

    --বাহ ভাবনাটা খুব সুন্দর। কিন্তু মা ফুলটা হিন্দুদের জীবনযাপনের একটা অঙ্গ। বলো, কোরানে যতই লেখা থাক আমরা কি নিয়ম করে রোজ ফুল আনি ঘরে?

    হঠাৎ কী মনে হতে প্রসঙ্গ থেকে সরে এলো তমা--মা, আব্বু ফোন করলো না তো আমাকে। জানে নিশ্চয় আমি বাড়ি আসছি।

    --কাল ফোন করেছিল তো। তোকে চাইছিল, তুই তখন ল্যাপটপে কিছু করছিলি। শুনে বললো তোকে পরে আবার ফোন করবে।

    --হয়তো ভুলেই গেছে।

    তমা বিছানা থেকে নেমে আচমকা চীৎকার করে ডাকলো, মনিরা চায়ের পানি বসা।

    ওর গলার আওয়াজে কিছু উষ্মা মেশানো।কান্তা জানে ওর হঠাৎ করে এই মুড চেঞ্জের কারণ। সামান্য কারণেই ইকবালের ওপর অভিমান করে বসে।


    ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে অনেকদিন পর তানপুরাটাকে নামালো তমা। ধুলো জমে আছে। তানপুরার কভারটা খুলে মনিরাকে ডাকলো। মনিরা সারাক্ষণ ওর ডাকের অপেক্ষায় থাকে। সুযোগ পেলেই তমার কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। ডাক পেয়েই হাসিমুখে এসে দাঁড়ালো। তমা কভারটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, এটা আজ কেচে দিবি। তারপর এক টুকরো নরম কাপড় নিয়ে তানপুরাটা মুছতে মুছতে লক্ষ্য করলো মনিরা কভারটা হাতে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েই আছে।

    --কি রে কী দেখছিস?

    --তোমার ওই গানের তাম্বুরাটা দেহি।

    --ওরে গাধা, এটা তাম্বুরা না, তানপুরা।

    --ওই হইল গিয়া একই কথা। যন্তরটা তো গানের, না আপা?

    --হুঁ।

    --কী সোন্দর সুর বাইরায় ওইডার গা থিকা! তুমি যহন গান গাও, সুরগুলান তোমার সঙ্গে ধুয়া ধরে, না আপা?

    ওর কথা শুনে খুব মজা লাগলো তমার। কী অকপট সহজ সরল ব্যাখ্যা করলো তানপুরার। নিজেও কখনো এভাবে ভাবেনি।

    --আপা, তুমি আমার গলায় তোমার ওই গানগুলান দিবা?

    --মানে?

    --মানে তোমার ওই সব গান আমারে শিখাইবা?

    --শেখাবো। আগে তুই কভারটা রেখে আয়, ওটা ধুলোয় ভর্তি। এক্ষুনি আমার হাঁচি শুরু হয়ে যাবে। যা। তারপর আমাকে দু’কলি গান গেয়ে শোনা, দেখি তোর গলায় সুর আছে কি না।

    তমার কথা শেষ হতে না হতেই উজ্জ্বল মুখে দৌড়ে গিয়ে কভারটা রেখে এসে মেঝেতে বসে পড়লো মনিরা। একবার গলা ঝাড়লো।

    --গাই আপা? হাসবা না।

    --না হাসবো না, তুই শুরু কর।

    --‘হলুদিয়া পাখি সোনার বরণ,
    পাখিটি ছারিল কে, রে আমার পাখিটি ছারিল কে...
    কেউ না জানিল কেউ না দেখিল,
    কেমনে পাখি, দিয়া যে ফাঁকি, উইরা গেল রে চোখের পলকে।
    সোনার পিঞ্জিরা শূন্য করিয়া, কোন বনে পাখি গেল যে উরিয়া
    পিঞ্জিরার জোরা খুলিয়া খুলিয়া ভাইঙ্গা পরে সেই পাখির শোকে...
    আমার পাখিটি ছারিল কে...।
    সবই যদি ভুলে যাবিরে পাখি, কেন তবে হায় দিলি রে আশা
    উইরা যদি যাবি ওরে ও পাখি, কেন বাইন্ধা ছিলি বুকেতে বাসা
    কতনা মধুর গান গান শুনাইয়া, গেলিরে শেষে কেন কান্দাইয়া
    তোমারে স্মরিয়া দুখের দরিয়া উথলি ওঠে হায় স্বজনের চোখে...।’
    খোলা গলায়, মনপ্রাণ ঢেলে গেয়ে গেল মনিরা। তমা বিস্ময়ে হতবাক।ওর জিভে ‘ড়’-অক্ষরটা আসে না, আর চড়ার দিকে মাঝে মাঝে গলাটা চিরে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু মনিরার কাছে ও আশা করেনি এত চমৎকার গান। বাসনপত্র ধুতে ধুতে কখনো কখনো মিহিসুরে বড়জোর গুনগুন করতে শুনেছে ওকে। কিন্তু ওর গলায় যে এই জিনিস লুকিয়ে আছে ভাবতে পারেনি। ওকে বাধা না দিয়ে চোখ বন্ধ করে তমা পুরো গানটা শুনলো। এতটাই তন্ময় হয়ে ছিল যে, কখন গান শেষ হয়েছে খেয়াল নেই।

    --আপা? গান তো শ্যাষ, আর নাই।

    --কোত্থেকে শিখলি এ গান।

    --ট্যাঞ্জেস্টার হুইনা হুইনা শিখছি আপা।

    শুধু ট্রানজিস্টারে গান শুনে এত সুন্দর করে নিখুঁত সুরে তালে গাওয়া সহজ কথা নয়।

    --তোর বাড়িতে কেউ গানটান করতো?

    --হ, আপা। আমার নানাজি কেরামতি গান করতো। তয় হেইগুলান আমার ভালা লাগে না। গান যদি মনের কথা না কয়, তয় হেই গান কানে লাগলেও বুকে ত লাগে না।

    তমা চমকিত হয়ে তাকালো মনিরার মুখের দিকে। সহজ বিশ্বাসে কী সাংঘাতিক একটা কথা বললো মেয়েটা। কেরামতি গান বলতে ও হয়তো কালোয়াতি গানের কথা বলতে চেয়েছে। খুব মজার তো মেয়েটা। হঠাৎ তমার মনে হলো, সারা বাড়ি আলোড়িত করে গান গাইল মনিরা, অথচ কান্তা একবার উঁকি দিয়েও দেখলো না। স্বাভাবিক নয় ব্যাপারটা। মনিরাকে জিজ্ঞেস করলো, মা কোথায় রে মনিরা?

    --আম্মা তো গোসলে গেছে।

    ওর কথা শেষ হতে না হতে ভেজা চুলে তোয়ালে জড়িয়ে দরজায় দাঁড়ালো কান্তা।

    কে গাইছিল রে? মনিরা দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো, কেউ তো গায় নাই আম্মা, ট্যাঞ্জেস্টারে বাজতে আছিল।

    তমা উঠে গিয়ে মনিরার চুলের গোছা ধরে আলতো টেনে দিয়ে হেসে বললো, এই যে তোমার ভাঙা ‘ট্যাঞ্জেস্টার’। সামান্য মেরামত করতে হবে। মা, তুমি জানতে ও এত ভালো গান জানে?

    --কী করে জানবো, আমাকে কখনো শোনালে তবে তো। ও আমাকে পাত্তাই দেয় না। ও ভাবে এ বাড়ির আসল গার্জেন তুই। দেখ না তোকে সারাক্ষণ কেমন ‘জো হুজুর’ করে।

    তমার মনে হলো মা এখন কিছুটা হালকা মুডে আছে। তার মানে মেঘটা কাটছে। মেঘ না হয় কাটলো, কিন্তু তমা তো নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ওকে তো জানতে হবে মেঘটা জমেছিল কেন?

    পরশু থেকে উপলের সঙ্গে একবারও কথা হয়নি। নিজের পারিবারিক ব্যাপারস্যাপার ওকে এমন বিব্রত করে রেখেছে, এর বাইরে অন্যকিছু ভাবার অবকাশ বা মানসিকতা কোনোটাই পাচ্ছে না। কিন্তু উপলও তো একবারও কথা বলার চেষ্টা করেনি। না ফোনে, না নেটে। কাল উপলকে একবার চেষ্টা করেছিল ফোন করতে। দুবার কল করার পর একবার লাগলো, বেজে গেল ধরেনি। তার পরেও উপল কলব্যাক করেনি। ওকে এটা বলার জন্যে ছটফট করছে তমা যে, ওর আব্বু এবং মা উপলের মায়ের খুবই পরিচিত। কিন্তু অন্য একটা কৌতূহল মনের মধ্যে গেঁথে আছে। উপলের মা তো বলেছিলেন, ‘তোমার মায়ের সঙ্গে কাল ফোনে কথা বোলবো’। ফোন করেননি। কেন কে জানে! সেদিন রাতে ভদ্রমহিলা এতটা উৎসাহ দেখালেন, অথচ তারপর থেকে চুপচাপ। হতে পারে নিজের ব্যস্ততার কারণে। কিম্বা এমন নয়তো, মায়ের বলা ওই ‘রং নাম্বার’টাই ওঁর? মা বুঝতে পারেনি। তাই যদি হয়, মা এত গম্ভীর কেন? কী এমন কথা হয়েছে দুজনে? বুকের মধ্যে এত চাপ নেয়া যাচ্ছে না। মাকে মনমরা দেখলে পৃথিবী দুলে ওঠে তমার। সেজন্যেই বেশি অস্থির লাগছে। ওর কাছে সব অস্থিরতার একমাত্র মুক্তি ওর গান।

    কান্তা নিজের ঘরের দিকে চলে যাওয়ার পর তমা গীতবিতানটা নামিয়ে আনলো। ও কখনও বই দেখে গান করে না, আড়াইশ তিনশ গান ওর এমনিই মুখস্ত। তবু গীতবিতানটা পাশে না থাকলে ভালো লাগে না।

    মনিরা মুখের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

    --কি রে তোর কাজ শেষ?

    --ওই রে আম্মায় তো কইছিল ডাইল বাটতে, ভুইল্যা গেছি। আর সব কাজ গুছাইয়া দিছি।

    --যা, হাতের কাজ সেরে আয়।

    অনিচ্ছায় উঠে বেরিয়ে গেল মনিরা।

    নিজের ঘরে বসেই টিউটোরিয়ালের খাতা দেখতে দেখতে শুনছিল কান্তা, তমা একের পর এক গান গেয়ে চলেছে। এত ভাল গায় মেয়েটা। ওর গলায় এমন কিছু আছে যা সম্মোহিত করে রাখে। ইকবালের পরিবারের কেউ গান করে না। কান্তারও পিতৃ-মাতৃ-কুলের কারো কখনও সঙ্গীত প্রতিভা ছিল বলে শোনেনি কান্তা। ওর স্থির বিশ্বাস তমার ভেতর রুমা তার তীব্র ইচ্ছের বীজ বপন করে গিয়েছিল। রুমার স্বপ্ন ছিল, মেয়ে যেন ‘অরুণিমার মতো গান গাইতে পারে।’ রুমার ওই একটা ইচ্ছেই সযত্নে লালন করেছে কান্তা। খুব ছোট্টবেলা থেকে গান শিখিয়েছে মেয়েকে। অরুণিমা কত ভালো গায়, কতবার বলেছে কান্তাকে। একসময় কান্তারও খুব ইচ্ছে ছিল ওর গান শোনার।

    --অরুণিমাকে একবার নিয়ে আসিস। এত গল্প শুনি, খুব দেখার ইচ্ছে।

    --ছুটিতে তো ও নিজের বাড়ি চলে যায়। দেখি কোনো ছোট ছুটিতে নিয়ে আসবো। কিন্তু তখন তুই কি আসতে পারবি?

    --আগে থেকে বলিস, ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

    কান্তা তখন ঢাকা ইউনিভারসিটিতে থার্ড ইয়ার। একবার অরুণিমাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল রুমা। কান্তার সঙ্গে দেখা হয়নি।


    ।।১৭।।

    ইউ টিউবে মন দিয়ে একটা সিনেমা দেখছিল টিটো। হঠাৎ খেয়াল হলো ওর ফোনটা অনেকক্ষণ ধরে বাজছে। উঠে গিয়ে ধরতে না ধরতেই থেমে গেল। তিনটে মিস কল। দুটো টুপুরের, একটা তিতিরের। তড়িঘড়ি টুপুরকে কল ব্যাক করলো। টুপুরের গলায় ওর স্বভাবসিদ্ধ সুর।

    --কী ব্যাপার রোমিও? ফোন ধরছিলি না কেন? নিশ্চয় অন্তর্জালে আটকে পড়েছিলি?

    --মানে?

    --মানে ইন্টারনেট।

    --ঠিক ধরেছিস। বল।

    --কী বলছে?

    --কে কী বলছে?

    --কে আবার? বিদেশিনী।

    --দিভাই, আমাকে কী ভাবিস বল তো? হ্যাঁ নেটে ছিলাম ঠিকই। একটা সিনেমা দেখছিলাম, মাঝপথে বাগড়া দিলি তুই।

    --তোর সঙ্গে কথা আছে।

    --সংক্ষেপে বলবি।

    --সংক্ষেপে তো হবে না। তাড়া কিসের তোর? রাত একটা পর্যন্ত তো ফেসবুকে অনলাইন দেখি রোজ।

    --তার মানে তুইও একটা অব্দি ফেসবুক-এ থাকিস।

    --হ্যাঁ রে তুই নাকি বাংলাদেশ যাচ্ছিস?

    --হ্যাঁ। আসলে মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনে বাংলাদেশের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছে। মা বাবা যেখানে জন্মেছে, একটু একটু করে বড় হয়ে উঠেছে, সেই জায়গাগুলো আমারও খুব দেখতে ইচ্ছে করে।

    --খুব কথা বলতে শিখেছিস তো টাট্টু।

    টিটো বুঝতে পারলো টুপুর ওর কথা শুনে খুশি হয়েছে। ছেলেবেলায় খুব যখন আদর করতো, ওকে টাট্টু বলে ডাকতো টুপুর।

    --আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করে। দেশটা আফটার অল আমার পূর্বপুরুষের ভিটে। আমার বাবাও তো তার শৈশব কৈশোর রেখে এসেছে ওখানে।

    --সে কি রে! তুই তো সারাক্ষণ দিদাকে আর মামুকে বাঙাল বলে পেছনে লাগিস।

    --সে তো আদর করে। শুনলাম তুই গিয়ে নাকি তমাদের বাড়িতে উঠছিস?

    --হ্যাঁ। ও আমাকে ইনভাইট করেছে।

    --তমা ইনভাইট করলো, আর তুই অমনি নেচে উঠলি। ক’দিনের পরিচয় তমার সঙ্গে? এই জন্যেই তো বলি, তুই সেই হাবা গঙ্গারামই রয়ে গেলি।

    --তমার বাড়িতে থাকতে অসুবিধে কোথায়?

    --তমা ক্যাজুয়ালি ইনভাইট করেছে তুই ওর বন্ধু বলে, থাকতে হবে তো ওর মা বাবার বাড়িতে। তাদের কাছে তুই অ্যাকসেপ্টেড তো?

    --দিভাই, তোর প্রবলেমটা কী খুলে বলতো?

    --আমার কোনো প্রবলেম নেই। প্রবলেম হতে পারে তমার মা বাবার।

    --এ কথা কেন বলছিস?

    --আমার কমনসেন্স বলছে। একটা ছেলের বাড়িতে তার মেয়ে বন্ধুকে লোকে যত সহজে অ্যাকসেপ্ট করে, একটা মেয়ের বাড়িতে তার ছেলে বন্ধুকে ততটা ভালো মনে অ্যাকসেপ্ট করে না রে বুদ্ধু। তাদের কাছে তুই একেবারেই অচেনা। তার ওপর একটা মুসলিম পরিবার।

    --তুই হঠাৎ এমন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেলি কেন?

    --হোয়াট প্রতিক্রিয়াশীল?

    --এই যে সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছিস !

    --আমার কথাগুলো সাম্প্রদায়িক নয়, রিয়ালিটি। তমা ওর মা বাবার সঙ্গে তোকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিয়েছে?

    --ওর বাবা তো বাইরে থাকেন। বাড়িতে তমা আর ওর মা...

    --যাওয়ার আগে তমাকে বল, তোর সঙ্গেঅন্তত ওর মাকে ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিতে। ফোনে। যেমন তুই তোর মায়ের সঙ্গে করিয়ে দিয়েছিস তমাকে। তাঁর সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবি তুই তাঁদের বাড়িতে গিয়ে থাকবি এটাকে ভদ্রমহিলা কী ভাবে নিচ্ছেন।

    ফোনের অন্যপ্রান্তে টিটো চুপ করে আছে। টুপুরের মনে হলো, নিষেধ না করেও টিটোর মধ্যে একটা দ্বিধা তৈরি করে দিতে পেরেছে ও। এর চেয়ে বেশি কিছু করা ওর পক্ষে সম্ভব না। টিটো মোটেই ডেসপারেট টাইপের ছেলে নয়। সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাববে। আর টিটো যদি আরো নাছোড়বান্দা হয়, সব ব্যাপারটা ওকে বলতেই হবে। পাশাপাশি নিজেকে ভগ্নদূতের মতো মনে হচ্ছে। হয়তো প্রেম নয়, একটা ভালোলাগা সাহচর্য তো বটে। টিটো ভাবতেই পারবে না, টুপুর কৌশলে সম্পর্কটাকে ছিঁড়ে দিতে চাইছে। কিন্তু যে জটিলতার মাঝখানে পিসি জড়িয়ে গেছে, তাতে এছাড়া আর কীভাবেই বা তাকে সাহায্য করবে।

    টুপুরের সঙ্গে কথা বলার পর কনফিউজড লাগছে টিটোরও। মাঝে আর মাত্র এক সপ্তাহ। কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কথাটা খারাপ বলেনি দিভাই। তমা যেতে বললো, আর ও কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই ডিসিশান নিয়ে ফেললো, টিকিটও কাটা হয়ে গেলো। নিজেকে খুব বোকা বোকা মনে হলো। সত্যিই তো তমা তো ওর পরিবারের কারো সঙ্গে টিটোকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। কেউ হয়তো জানেই না ওর কথা। নিজের বাড়ির কথা ডিটেলসে কখনও তমা কিছু বলেনি ওকে। ও জানতেও চায়নি। দরকারটাই বা কী? এখন মনে হচ্ছে, তাহলে কি তমা বেড়াতে যাওয়ার কথাটা ক্যাজুয়ালি বলেছে? নাহ, আর একটু ভাবতে হবে।

    মায়ের সঙ্গে ফেসবুকে তমার কী কথা হলো জানার জন্যে কৌতূহলের পাশাপাশি ভেতরে ভেতরে চাপা উদ্বেগও অনুভব করছে টিটো। কদিন ধরে অফিসে ওর কাজের এতটাই চাপ যাচ্ছে, তমাকে ফোনও করা হয়নি। মাকেও না। গতকাল একবার তমার ফোন এসেছিল কোনো একটা সময়। তখন রিসিভ করার মতো অবস্থা ছিল না। একটা প্রেজেন্টেশান নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাছাড়া অনসাইট-এর ব্যাপারটা একটু পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও টেনশানে আছে। রাতে ফেসবুকে তমাকে পাওয়া যায়নি। অনেকদিন পর বাড়ি গেছে, হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিচ্ছে নিশ্চয়। কাল অফিসে টিফিন আওয়ারে একবার ফোন করতে হবে। তখনই কায়দা করে বলবে ওর মায়ের সঙ্গে অন্তত ইন্ট্রোডিউস করে দিতে। না কি ওর ফোনের অপেক্ষা করবে? ও কি ওর বাড়িতে আদৌ কিছু বলেছে টিটো সম্পর্কে? সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছে তো টিটোর যাওয়াটাকে? একটা অস্বস্তি জড়িয়ে গেল মনে। নাহ সিনেমা দেখতে ভালো লাগছে না আর। ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো।

    রোজ ঘুমোনোর আগে একবার যায়, সেই নিয়মে ঠাম্মার ঘরে এলো টুপুর। শর্মিলাও শুতে যাওয়ার আগে শাশুড়ির দরকারি জিনিস ঠিকঠাক হাতের কাছে আছে কি না দেখে নিচ্ছে। একমাত্র এই ঘরেই এখনও জলের গ্লাস এবং মশারি চালু আছে। কাজেই মশারি ঠিকমতো গোঁজা হলো কি না, জলের গ্লাস হাত বাড়ালেই ঠিকমতো পাওয়া যাবে কিনা দেখে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একবার টুপুরের মুখের দিকে তাকালো। টুপুর এক চিলতে হাসলো – ইন্সপেকশান শেষ? শর্মিলা গম্ভীর মুখেই বললো, সাড়ে এগারোটা বাজে, মা এখন ঘুমোবে, তুই আবার এখানে বসলি কেন?

    --ঠাম্মা দশ মিনিট পরে ঘুমোলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। তুমি শুতে যাও। আমি এখন কিছুক্ষণ থাকবো এখানে। একটু নিঃশ্বাস নেবো।

    শর্মিলা কিছুদিন থেকে সারাক্ষণ গম্ভীর হয়ে কথা বলে টুপুরের সঙ্গে। টুপুর বোঝে মায়ের যন্ত্রণার জায়গাটা। মায়ের মুখের দিকে তাকালে খারাপ লাগে টুপুরের, কিছুদিন থেকে এমন আহত মুখ নিয়ে ঘুরছে। কিন্তু ও নিজেও তো নিরুপায়। মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না যে ও এক্সট্রা অর্ডিনারি কোনো অপরাধ করছে না। প্রথম কথা, অন্য কারো ক্ষতি না করে সর্বৈবভাবে নিঃসঙ্গ একজন মানুষের পাশে দাঁড়ানো কোনো অপরাধ নয়। দ্বিতীয়ত সেই মানুষটার সাহচর্য ওকে আরাম দেয়, উজ্জীবিত করে। নাহ টুপুর কোনো ভুল করছে না। মা বড্ড অবোধ। পিসিকে বলেও খুব একটা লাভ হয়নি। সেও ভাবছে মেয়েটা শেষপর্যন্ত এই করলো? খুব হতাশ লাগছিল পিসিকে। ঠাম্মাকে এখনই এসব কথা বলা যাবে না ঠিকই, কিন্তু ঠাম্মার কাছে এলে, অন্য নানা কথায় মন খারাপ কেটে যায়।

    আজ দুপুরে অরুণিমার অমন অসহায় বিস্রস্ত চেহারা টুপুর কখনো দেখেনি। বরাবরের সুখী আহ্লাদী টাইপের মানুষ। সাংঘাতিকভাবে বিচলিত বোধ করেছে টুপুর। বিষয়টা অদ্ভুত জটিল। তবে টিটোর ব্যাপারটাকে খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। টিটো যে মেয়েটার সঙ্গে গভীর প্রেমে ডুবে আছে, ওর সঙ্গে কথা বলে একেবারেই মনে হয়নি সেকথা। আজকাল অমন গণ্ডা গণ্ডা নেটের প্রেম দেখেছে টুপুর। এটা ওর টাইমপাস ছাড়া আর কিছু না। আজকালকার মা বাবারাও একটা বাচ্চা নিয়ে সারাক্ষণ হারাই হারাই করে। আদিখ্যেতার চূড়ান্ত।


    ।।১৮।।

    অফিসে বেরোনোর সময় সুপ্রিয় বলে গেছে, বিকেলে রেডি হয়ে থেকো। আমি আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরুবো। অনেকদিন নাটক দেখিনি, আজ একটা নাটক দেখতে যাবো। ফেরার সময় টিকিট কেটে নিয়ে আসবো। আগে দুজনে খুব নাটক দেখতো। অরুণিমার একদম ইচ্ছে করছে না যেতে, কিন্তু সুপ্রিয়কে না বলতেও মন চাইছে না। ও প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে অরুণিমার মন ভালো করার।


    অগত্যা শুধু সুপ্রিয়কে সঙ্গ দেয়ার জন্যে যাওয়া। রেডি হচ্ছিল, তখনই ডোর বেল বাজলো। শোভা দরজা খুলেছে। কারো সঙ্গে কথা বলছে। অরুণিমা উঁকি দিয়ে দেখলো, তিতির। এ যেন মেঘ না চাইতে জল। তিতিরের কথা খুব মনে হচ্ছিল দুদিন ধরে। হঠাৎ কেন যেন বুকের ভেতর একটা ফুরফুরে হাওয়া বয়ে গেল। কাছে আসতেই বুকে জড়িয়ে ধরলো তিতিরকে, যা কদাচিৎ করে ও। কেন যেন মনে হলো এই মুহূর্তে তিতিরকে ওর বড্ড দরকার। তিতিরও একটু অবাক। কিন্তু বুঝতে দিল না।

    --কবে এসেছিস?

    --এইতো চার পাঁচদিন হলো।

    --তুইও পালটে গেছিস।

    --আমিও মানে? আরো কেউ পালটেছে নাকি? ব্যাপার কী বলো তো।

    --এতদিনে মনে পড়লো আমার কথা। কতদিন তোকে দেখি না বলতো।

    --আসার পর থেকে তো চরকির মতো ঘুরছি। আমরা এমন চাকরি করি, মা বাবাকেও ভুলিয়ে দেয় কোম্পানি। কালই তোমার কাছে আসবো ভেবেছিলাম, নানান ঝামেলায় আটকে গেলাম।

    তিতিরের কথা মন দিয়ে শুনছে না অরুণিমা। ওর মাথায় তখন ঘুরছে তিতিরের আসাটা, নাটক দেখতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ক্যানসেল করার একটা যুৎসই কারণ হতে পারে। চট করে নিজের মোবাইল ফোনটা তুলে নিলো।

    --দাঁড়া তিতির, তোর কাকুকে একটা ফোন করে নিই আগে। তারপর জমিয়ে গপ্প করবো।তোর গান শুনবো আজ।

    তিতির হঠাৎ কাচুমাচু মুখ করে বললো, কাকিমা আমি বেশিক্ষণ আজ থাকবো না কিন্তু। অনেক কাজ। এই তো কালই দিল্লি ছুটতে হবে। দিল্লি থেকে ফিরে একদিন একটু বেশি সময় নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।

    --এমন বুড়ি ছোঁয়া করে আসতে কে বলেছে তোকে?

    --আজ একটা দরকারে এসেছি। টিটো এখন যে অ্যাপার্টমেন্টে শিফট করেছে, তার অ্যাড্রেসটা চাই আমার। আমার কাছে ছিল, খুঁজে পাচ্ছি না।বদমাসটা ফোন করলে ধরে না। কাল দুবার ফোন করেছি, দুবারই ‘নো রিপ্লাই’। রাগ করে আর করিনি। ভাবছিলাম মাসির কাছেই উঠবো। আজ রাগটা কমে গেছে। ভাবলাম অ্যাড্রেসও নেয়া হবে, তোমার সঙ্গে দেখাও হবে।

    --কী করবি ঠিকানা দিয়ে?

    --বলছি না একটা দরকারে দিল্লি যেতে হবে আমাকে। কালই আমার দিল্লির ফ্লাইট। ওর ফ্ল্যাটে থাকবো দু’রাত। ওর সঙ্গে আড্ডাও মারা যাবে। ওর তো কাল অফিস, বললেও এয়ারপোর্টে আসতে পারবে না রিসিভ করতে। আমাকেই ওর ঠিকানায় পৌঁছুতে হবে। বাই দ্য বাই আমি এমাসের শেষের দিকে আমেরিকা যাচ্ছি।

    --তাই! কতদিনের জন্যে?

    --আপাতত ছ’মাসের জন্যে। দেখা যাক তারপর কী হয়। আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। ডিপেন্ড করে প্রজেক্টের উপর।

    --টিটোর সঙ্গে তোর নিয়মিত কথা হয়?

    --হ্যাঁ, হয় তো। ওরও তো অনসাইটের অফার আছে। বললো, এ বছর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। জানি না কী করবে।

    --আমাকে তো বলেনি এটা। ওর বাবাকেও না। কি যে হচ্ছে ছেলেটা দিন দিন।

    --সে হয়তো ও যাবে না ঠিক করেই নিয়েছে, তাই আর জানায়নি।

    --যাবে নাইবা কেন! কী এমন মহাকাজ আছে এখানে? বোঝা না, ওকে। ঘুরে আসুক এবার। সামনের বছর ওর বিয়ে দেবো আমি। চাকরি তো দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেলো। সাতাশ চলছে।

    --ছেলের বয়েস কমাচ্ছো না তো?

    --তোর কাছে বয়স কমিয়ে রেহাই পাবো? মাথায় কী যে বাংলাদেশের ভুত চেপেছে!

    --ভুত না, বলো পেত্নি।

    তার মানে তিতিরও জানে ব্যাপারটা। তবে পেত্নি শব্দটা শুনতে ভালো লাগলো না অরুণিমার। তমার জন্যে একটা সফট কর্নার আছে, ও রুমার মেয়ে। তিতিরের মধ্যে কি হিংসে আছে তমাকে নিয়ে? এই ভাবনায় কেন যেন আনন্দ হলো।

    --ওভাবে বলিস না। মেয়েটা দেখতে কিন্তু বেশ।

    --ও, তোমার তাহলে বেশ মনে ধরেছে বোঝা যাচ্ছে। তবে তো হয়েই গেল। এবার তাহলে মেনু ঠিক করো।

    --ধুর, তুইও যেমন। ও কি আর আমার পছন্দের পরোয়া করে। এমনিই বললাম। মেয়েটা চমৎকার।

    --অতসব জানি না, তবে বড্ড ন্যাকা। টিটোটাও আজকাল খুব ন্যাকা হয়ে গেছে। সঙ্গদোষ। শোভা একটা প্লেটে দুটো শোনপাপড়ি আর আর নলেন গুড়ের সন্দেশ এনে তিতিরের সামনে ধরলো।

    --খেয়ে নাও এটুকু, কতদিন পরে এলে। আগে বলে আসবে তো।

    --ওহ, শোভাদি তুমি সেই একই রকম আছো, গলা পর্যন্ত খাওয়াতে না পারলে তোমার শান্তি হয় না। একটু চা খাওয়াও।

    শোভা চলে যাওয়ার পর অরুণিমা বললো,

    --হ্যাঁ রে তিতির, টিটো তো তোকে সব কথা বলে আমি জানি। ঠিক করে বল তো, ও কি ওই বাংলাদেশের মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করছে?

    --আগে বলো প্রশ্নটা টেনশান না আনন্দের?

    --টেনশান। নেটে কি কাউকে চেনা যায় বল? ভুলভাল লোকজনের আখড়া। আমার ছেলেটা যা সরল...

    --মোটেই সরল না তোমার ছেলে। ভালোই ফ্লার্ট করতে জানে।

    --ও ফ্লার্ট করছে বলছিস?

    --তাছাড়া আবার কি? মেয়েটা রাম ন্যাকা, দেখোগে আরো কত জনের সঙ্গে ওই একই কথা কপি-পেস্ট করছে। তোমার ছেলে তার সঙ্গে সঙ্গত করছে।

    --টিটোর ওপর খুব রেগে আছিস মনে হচ্ছে। দিল্লি থেকে ফিরেই একবার আসিস কিন্তু।

    --নিশ্চয়। তৈরি থেকো, লেটেস্ট খবর দেবো।

    --পুজোতে কলকাতায় থাকছিস তো?

    --হ্যাঁ। তোমরা পুজোয় কোথাও বেড়াতে যাচ্ছো না তো?

    --না। পুজোয় বেড়াতে যাওয়া একেবারেই পছন্দ নয় তোর কাকুর। তখন টুরিস্টস্পট গুলোতে ভিড় থিকথিক করে।

    --গতবার তো গিয়েছিলে।

    --সে তো গতবার টিটো এলো না বলে।

    --এবারও তো টিটো আসবে না।

    --তুইও জানিস?

    --জানি তো। তোমরাও যাও না বাঙলাদেশ ঘুরে এসো ওর সঙ্গে। সবাই মিলে হোটেলে থাকবে। অরুণিমা নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস গিলে নিলো। বাংলাদেশের এই ব্যাপারটা যে কি সাঙ্ঘাতিক জটিল হয়ে উঠেছে, তিতির তো সেটা জানে না।

    নাটক দেখে বাইরে ডিনার করে ফিরলো ওরা। চেঞ্জ করে নিয়ে সুপ্রিয় ইন্টারনেট খুলে বসলো। কিছুক্ষণ পরে অরুণিমাও এসে পাশে বসলো। নিজের কাজ হয়ে গেলে সুপ্রিয় অরুণিমাকে বললো, নাও স্কাইপটা খোলো। শ্রীমানকে দেখি একটু।

    --তুমি খোলো না। আমার ইচ্ছে করছে না।

    স্কাইপ-এ লগ অন করে দেখলো অনলাইন আছে টিটো। বিছানার ওপর বসে একটা ম্যাগাজিন দেখছে। পাশে একটা খালি কফি মগ।

    --এখন কফি খাচ্ছিস কেন?

    --খাচ্ছি না, খেয়েছিলাম সকালে।

    টিটো একটু রাগ রাগ করে বললো,

    --তোমার ফোনের সুইচ অফ কেন? ফোন করে করে পাইনি। না তোমাকে, না বাবাকে।

    অরুণিমা উঠে গিয়ে নিজের মোবাইলটা নিয়ে এলো। অনেকগুলো মিস কল। একটা টুপুরের বাকিগুলো টিটোর।

    --আমি আর তোর বাবা একটা নাটক দেখতে গেছিলাম। সেই তখন বন্ধ করেছিলাম আর অন করতে মনে নেই। ডিনার করেছিস?

    --করেছি।

    --তোর নাকি আমেরিকায় যাওয়ার প্রোপোজাল আছে?

    --তোমাকে কে বললো?

    --তিতির।

    --তোমার বিশ্বস্ত ইনফরমার। এর পেটে কোনো কথা থাকে না।

    --গোপন করার কী আছে?

    --গোপন করবো কেন? এইজন্যে বলিনি যে, এবছর আমার যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তোমরা তো আমেরিকা শুনলেই নেচে ওঠো...

    --যাওয়ার ইচ্ছেই বা নেই কেন?

    --তুমি অত বুঝবে না।

    --তোর বাবা তো বুঝবে। তাকেও তো বলিসনি।

    --আরে বাবা গেলে তো বলবো। এখানে একটা খুব ইম্পর্টান্ট প্রজেক্ট আছে সামনে। কেরিয়ারের জন্যেই এখন আমি ওটা করতে চাই।

    --বাংলাদেশ যাওয়ার জন্যেই অনসাইট প্রোপোজাল ছাড়ছিস না তো?

    --বলছি তো যদি অনসাইটের ব্যাপারটাকে এড়াতে পারি, তবেই যাবো বাংলাদেশে। একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে নিয়ে এমন শুরু করেছ তুমি। বাংলাদেশে যাওয়াটা এমন কিছু ইম্পর্টান্ট নয় আমার কাছে।

    অরুণিমা পুরোপুরি বিশ্বাস করলো না, তবে শুনতে ভালো লাগলো।

    --যা এবার শুয়ে পড়।

    --গুডনাইট।

    টিটো অফ হওয়ার পর টুপুরকে কল ব্যাক করলো অরুণিমা।

    --ফোন করেছিলি কেন?

    --এমনি তোমার খবর নিতে। কেমন লাগলো নাটক?

    --ঠিক আছে। টিটোর সঙ্গে কথা হয়েছে তোর?

    --হ্যাঁ। ওর বাংলাদেশ যাওয়ার ব্যাপারে আমি খুব শিওর না পিসি।

    --মানে?

    --মানে ও নিজেই কনফার্ম না।

    --টিকিট তো কাটা হয়ে গেছে।

    --ক্যানসেল করতে আর কতক্ষণ।

    --টুপুর, তুই যেভাবে হোক ওর যাওয়াটা আটকা। ইকবালরা চায় না টিটো যাক ওখানে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কিছুতেই ওর যাওয়া হবে না। আচ্ছা আমি কি নিষেধ করবো?

    --তোমাকে কিছু করতে হবে না। কেন নিষেধ করছো, সেটা বলতে পারবে তো? পারবে সবকিছু ওকে খুলে বলতে? এত চিন্তা করছো কেন বলো তো? সব ঠিক হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত ও নিজেই যাওয়া ক্যানসেল করবে।


    ।।১৯।।

    স্বপ্ন দেখছিল তমা। মা তার এক বান্ধবীকে নিয়ে নিউমার্কেট থেকে বেরুচ্ছে, নীপা আর ও পাশ দিয়ে হেঁটে গেল, মা যেন দেখেও দেখলো না। শুধু হাত নাড়লো, মুখে কিছুই বললো না। খুব রাগ হলো তমার। নীপা বললো, আরে রাগ করছিস কেন? উপলের মা সঙ্গে আছে তো, তাই তোকে কিছু বললো না। নীপার কথা শুনে তমা পিছন ফিরে দেখলো, উপলের মা প্রায় ওদেরই বয়সী একটা মেয়ে, মায়ের মুখটা বোঝা যাচ্ছে না বলে ও কাছে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, তবু মায়ের মুখটা ঝাপসা। মকবুল ফিদা হুসেনের ছবির মতো। অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করছে.........তখনই দরজায় খুব মৃদু টুকটুক শব্দ, তমার ঘুম ভেঙে গেল। জড়ানো গলায় ‘যাচ্ছি’ বলে আবার পাশ ফিরে শুয়ে শুনতে পেলো মনিরার ফিসফিস কথা, যাইতে কই নাই আপা, ঘুম ভাঙছে নাকি ঠাহর করলাম।

    --কেন?

    --তোমার নাস্তা করব, আম্মায় কইয়া গেছে তোমারে গরম গরম পরটা আর আণ্ডা ভুনা কইরা দেতে।

    --মা কোথায় গেছে?

    --সেইডা কয় নাই।

    উঠে পড়লো তমা। ঘড়ির দিকে তাকালো, ন’টা। এত সকালে মা তো যায় না কলেজে। মায়ের ক্লাস সাধারণত থাকে সাড়ে এগারোটার পর। আজ দুতিনদিন ধরে সবকিছু যেন অন্যরকম লাগছে। প্রথম দুদিন বাড়িটায় উৎসবের মেজাজ ছিল। হঠাৎ করে গত তিনচারদিন একটা অস্বাভাবিকতা, একটা গুমোট মেঘ ছেয়ে গেছে। এটা নতুন তমার কাছে। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে নানা রকম গল্প হয়, আহ্লাদিপনা চলে। হঠাৎ কী হলো! ও কাছে আছে, অথচ মা বিষাদের মূর্তি হয়ে ঘুরছে। শুধু বিষাদ নয়, একটা অস্থিরতা যেন সারাক্ষণ জাপটে ধরে আছে মাকে। সেই অস্থিরতা ভেদ করে ঠিকঠাক মায়ের কাছে পৌঁছুতে পারছে না তমা। এটা খুব অস্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করলে, যে উত্তর পাওয়া যাচ্ছে সেটা যুক্তিসঙ্গত লাগছে না। কিছু তো একটা ব্যাপার আছে। মা যদি এই মুডে থাকে, আর উপল যদি সত্যি সত্যি আসবে বলে ঠিক করে থাকে, সেটা খুব খারাপ হবে। এইরকম একটা ধোঁয়াটে পরিস্থিতিতে ওর এখন না আসাই ভালো। কিন্তু কী করেই বা নিষেধ করবে, একটা যুৎসই অজুহাত তো চাই। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কী দরকার ছিল হুট করে বাড়িতে আসতে বলার। মাকে একবার জিজ্ঞেস না করে। ভালো লাগছে না। উঠে পড়লো।

    দোতলার বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে চেষ্টা করলো হঠাৎ কী এমন ঘটলো। এখানে উপলের আসার কথা শুনে কি? কিন্তু সেদিন রাতে যখন বললো, মা তো স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিল। তেমন হলে তো ও নিজেই কোনোভাবে প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দিতে পারে। মাকে অখুশি করে কোনোকিছু করার কথা ভাবতে পারে না তমা। নাকি আব্বুর সঙ্গে কিছু নিয়ে মনোমালিন্য? কখনও তো দেখেনি দুজনকে ঝগড়াঝাঁটি করে মাকে এমন বিষাদে ডুবে থাকতে। মৃদু কথা কাটাকাটি হয়েছে, সেটা কেউ কনটিনিউ করেনি। বেশিরভাগ সময় আব্বুই সারেন্ডার করেছে। তাহলে? সেদিন, মায়ের ভাষায় ‘রং নাম্বার’ থেকে ফোন আসার পর থেকে কি? সত্যি কি রং নাম্বার ছিল?

    দুপুরে নীপাদের বাড়ি যাওয়ার কথা। একসঙ্গে লাঞ্চ করার কথা। ইচ্ছে করছে না। অনেকদিন পর দুইবন্ধু মিলে তুমুল আড্ডা দেবে, অনেক কিছু শেয়ার করবে ভেবেছিল। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আবার না গেলেও নীপা অভিমান করবে।

    --আপা নাস্তা দেবো?

    --না আমি আগে গোসল করে আসি, তারপর।

    --তুমি নীপাআপার বাড়ি যাইবা? দুফুরে দাওয়াত তোমার?

    --মা কী খেয়ে গেছে?

    --চা বিস্কুট খাইছে জানি।

    মনিরার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে মাকে ফোন করলো তমা। ফোনটা কেটে দিয়ে দুমিনিট বাদে নিজেই ফোন করলো কান্তা।

    --কখন উঠলি?

    --তুমি কোথায়?

    --কলেজে, একটা মিটিং আছে, তুই ঘুমোচ্ছিলি বলে আর জাগাইনি। তুই কখন যাবি নীপাদের বাড়ি?

    --যাবো সাড়ে দশটা নাগাদ। তুমি খেয়ে যাওনি কেন?

    --সাড়ে আটটায় বেরিয়েছি। অত সকালে খাওয়া যায় নাকি?

    --কখন ফিরবে?

    --ক্লাস শেষ হলে যেমন ফিরি।

    --না খেয়ে থাকবে এতক্ষণ?

    --আরে বাবা ক্যান্টিনে কিছু খেয়ে নেবো। আমার অনেক কলিগ ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে। তুই ব্রেকফাস্ট করেছিস?

    --না, বেরোনোর আগে করবো।

    নীপাদের বাড়ি থেকে সাড়ে তিনটে নাগাদ বাড়ি ফিরে এলো তমা। নানারকম ভাবনায় ক্লান্ত লাগছে। ভেবেছিলো মা ফেরার আগে একটা ঘুম দিয়ে নেবে। কান্তার ফিরতে সেই সাড়ে চারটে পাঁচটা। বেল বাজাতেই মনিরা খেতে খেতে এসে দরজা খুলে দিয়ে চোখের ইশারায় দোতলার দিকে দেখালো। মনিরা এই অসময়ে খাচ্ছে দেখে অবাক হলো। তবু ওর ইশারাকে পাত্তা না দিয়ে ওপরে এসে ধীরে সুস্থে চেঞ্জ করে নিয়ে বাথরুমে গেল। ফিরে এসে কি মনে করে মায়ের ঘরের দিকে একবার উঁকি দিতে গিয়ে চমকে গেলো। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে কান্তা। বুঝলো মনিরার ইশারার কারণ। প্রায় দৌড়ে কাছে গেল। ঘুমোচ্ছে ভেবে উৎকণ্ঠা নিয়েই ফিরে আসছিল। পেছন থেকে কান্তার গলা পেয়ে আবার কাছে গেল।

    --কী হয়েছে মা?

    --তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি যে?

    --কি জানি কী মনে হলো, চলে এলাম। কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি ক্লাস না নিয়েই ফিরে এলে, কী হয়েছে?

    --শরীরটা খারাপ করছিল। এখন ঠিক আছি।

    --ঠিক নাই আপা, একজন ম্যাডাম সঙ্গে আইছিলো। আম্মারে গাড়ি থিকা হাত ধইরা ঘরে দিয়া গেল। তুমি ডাক্তার ডাকো আপা। মনিরা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।

    --তুই যা তো তোর কাজে। আমি এখন ঠিক আছি রে।

    তমা কোনো কথা না বলে সোজা ডাক্তারকে ফোন করলো। মাকে ঘুমের ওষুধ দিলো, তারপর কলেজে ফোন করে কান্তার কলিগদের কাছ থেকে জেনে নিলো ঠিক কী হয়েছিল কান্তার।

    বিকেল হতেই তমার নিষেধ সত্ত্বেও বারান্দায় এসে বসেছে কান্তা। ঘুমিয়ে অনেক ফ্রেশ লাগছে। কেন এমনটা হলো বুঝতে পারছে না। থার্ড ইয়ারের ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ সব ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল। টেবিলে মাথা রাখতেই ছাত্রীরা দৌড়ে গিয়ে প্রিন্সিপালকে খবর দিলো। পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি, নিজেকে শূন্যে ভাসমান মনে হচ্ছিল। ডাক্তার বললেন, কোনোরকম মানসিক চাপ না নিতে, বিশ্রাম আর সাউন্ড স্লিপ দরকার। কলেজে যাওয়া ছাড়া বাড়িতে সারাদিনই তো বিশ্রামে থাকে। মনিরা একটা কুটো কেটে দুটো করতে দেয় না। আর কী বিশ্রাম নেবে? কিন্তু এই ক’দিন কিছুতেই ঘুমোতে পারছে না। বুকের মধ্যে সারাক্ষণ একটা ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না, সবসময় বুকের ভেতর কিছু একটা দলা পাকিয়ে আছে। সেটা উদ্বেগ, কষ্ট, না কান্না বুঝতে পারে না। শুধু বমি পায়।

    বহুদিন পর পিছন ফিরে দেখলো। আজ থেকে প্রায় ছাব্বিশ বছর আগের একটা দিন... খুব ঘরোয়াভাবে রেজিস্ট্রেশান হয়ে যাওয়ার পর অবরুদ্ধ কান্না নিয়ে বাথরুমের আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কান্তা--আয়নার ভেতরের মেয়েটিকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এভাবে তার সারা জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো কিছু আত্মীয় স্বজন। মনে মনে নিজের প্রতিবিম্বকে বলছিল... বিতর্ক সভায় অবলীলায় প্রতিপক্ষকে নস্যাৎ করে দাও, যেকোনো সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাত মুঠো করে পথে নামো, কলেজের করিডোর ধরে হেঁটে গেলে অন্তত এক ডজন ছেলে তাদের হৃদয় বিছিয়ে দেয়... শুধু কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের কথায় সেই তোমার বিয়ে হয়ে গেল এমন একজনের সঙ্গে... যে তোমার খালাতো বোনের স্বামী... যার দীর্ঘদিনের প্রেমিকা বউ তার আটমাসের বাচ্চাকে কোলহীন শূন্য বিছানায় ফেলে রেখে আত্মহত্যা করে একটা জায়গা খালি করে গেছে... শুধু সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্যে তোমাকেই বেছে নেয়া হল... তোমার কোনো স্বপ্ন নেই, প্রেম নেই, ভবিষ্যৎ নেই...। একটা ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং মনে হলো পুরো ঘটনাকে। তারপর শরীরের ভেতর পাক দিয়ে ভেতরের প্রবল অনীহা আর ক্ষোভ বমি হয়ে বেরিয়ে এসেছিল সেদিন। আজ ক’দিন ধরে সেই রকম একটা বমনেচ্ছা পাক দিয়ে উঠছে ভেতরে। সেটা ছিল ক্ষোভ আর এটা হলো আতঙ্ক। তখন ছিল গ্রহণ করার অনীহা, আর আজ হারিয়ে ফেলার ভয়।

    একদিন অনিচ্ছায় যে গুরুভার হাতে তুলে নিয়েছিল, অজান্তেই তা যে কখন নিজের প্রাণভোমরা, সাত রাজার ধন হয়ে গেছে টের পায়নি। আজ আতঙ্কিত হচ্ছে এই ভেবে যে, সামান্য অসতর্কতায় প্রবল ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে ওর একান্তের মায়ার প্রাসাদ। নিজেকে এতটা অশক্ত কখনও ভাবেনি। কে বা কী যে ওকে এমন দুর্বল করে দিয়েছে নিজেও জানে না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পাশে এসে বসলো তমা। মায়ের বাহুতে নিজের মুখটা একবার ছুঁয়ে নিলো।

    --কি রে একা খাচ্ছিস, আমার চা কই?

    --মনিরা আনছে। হরলিকস।

    --বিকেলে ঘুম থেকে উঠে চা না খেয়ে হরলিকস খাবো, আমি কি রোগী নাকি?

    --না রোগী না। শুধু পড়াতে পড়াতে ক্লাসে সেন্সলেস হয়ে যাও এই যা। একদম নিজের মত মতো চলবে না।

    কান্তা অল্প হেসে তমাকে জড়িয়ে একটু আদর করলো। শুনলো ঘরে ফোনটা বেজে যাচ্ছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। তমা হাত চেপে ধরে আছে, উঠতে দেবে না বলে।

    --এখন ফোন ধরবে না, এ নিশ্চয় তোমার কোনো ছাত্রী কুশল জানার জন্যে ফোন করছে।

    মনিরা কোত্থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে গেল। না ছাত্রীরা কেউ না। ইকবাল ফোন করেছে। তমা মনে মনে সময়টা হিসেব করে নিয়ে ভুরু কুঁচকোলো, এখন তো আব্বুর ওখানে ভোর। এত সকালে ফোন করছে?

    --এই তো তমা আর আমি বসে আছি বারান্দায়। হ্যাঁ ভালো আছি... ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই তমা ছোঁ মেরে কান্তার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো। ভুলে গেল ভয়ঙ্কর রকম অভিমান করে আছে ইকবালের ওপর।

    --মিথ্যে কথা আব্বু, মা মোটেই ভালো নেই। আজ কলেজে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। প্রেশার প্রচণ্ড বেশি। ডাক্তারচাচা এসে দেখে গেছেন। অনেকগুলো টেস্ট করতে বলেছেন। কিন্তু তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তো আছি। ভাগ্যিস আমি এইসময় এসেছি।

    একনাগাড়ে কথাগুলো বলার পর খেয়াল হলো, আব্বু এই ফোনটা মাকে করেছে, ওকে নয়। সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কান্তাকে ধরিয়ে দিলো। কান্তা ফোন নিয়ে উঠে ঘরে গেলো।

    বিকেল গড়িয়ে গেছে। সন্ধে নামছে। মনিরা এসে বারান্দার আলো জ্বালতে গেলে নিষেধ করলো তমা। মা এখনও আব্বুর সঙ্গে কথা বলছে। মা ভালো নেই সেটা এত তীব্রভাবে টের পাচ্ছে তমা, এর আগে আর কখনও এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। অসহায় লাগছে। আব্বু থাকলে সবকিছু ঠিক হয়ে যেতো। আব্বুকে মিস করছে। গ্রিলে হাত রেখে নিচে বাগানের দিকে তাকালো। রঙ্গন গাছটায় বিকেলবেলায় ঝারি দিয়ে জল দিয়েছে মনিরা, রাস্তার আলো পড়ে ঝিলমিল করছে জলে ভেজা ফুলের গুচ্ছ। রান্নাঘর থেকে মনিরার গলা পাচ্ছে, আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো... ভাওয়াইয়া জাতীয় কিছু গাইছে। কথা বুঝতে পারছে না, কিন্তু শুনতে বেশ লাগছে সুরটা। গানের কথাগুলো শোনার জন্যে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল তমা, কান্তা বেরিয়ে এলো নিজের ঘর থেকে।

    --তোর আব্বু আসছে নেক্সট উইকে। কান্তার গলায় ডুবতে বসা মানুষের হাতে খড়কুটো পাওয়ার স্বস্তি।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ (শেষ)
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments