|| বারো ||
আরব সাগর তথা ভারতের পশ্চিম উপকূলেই যে শুধু সমুদ্রযাত্রা জারি ছিল, তা আদৌ নয়। বঙ্গোপসাগর তথা পূর্ব উপকূলেও অতি প্রাচীন কাল থেকেই সমুদ্রপথে পাড়ি দিয়েছে ভারতীয় নাবিকরা। বঙ্গ, কলিঙ্গ, সাতবাহন ও আরও দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে। বাণিজ্যের প্রয়োজনে তারা চলে যেত পশ্চিমে সুদূর মিশর থেকে পূর্বে ভিয়েতনাম অবধি।
বাংলার ছেলে বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করেছিল ষষ্ঠ খিস্টপূর্বাব্দে, সিংহলের ইতিহাস মোটামুটি সেই সময় থেকেই শুরু। বাংলা ও উড়িষ্যার বাণিজ্যতরী চলে যেত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলোতেও। প্রথম প্রথম তারা উপকূল ছেড়ে খুব বেশি দূর দিয়ে যেত না। সুন্দরবনের গা ঘেঁষে পুবদিকে চলতে শুরু করে চাটগাঁ পেরোলে দক্ষিণ-পুবে নামত ব্রহ্মদেশের গা বেয়ে। তার সর্বদক্ষিণ প্রান্তে এসে আবার পুবদিকে চলতে হত। এখান থেকে দক্ষিণে আন্দামান সমুদ্র শুরু। সেই বরাবর দক্ষিণে চলতে থাকলে একসময় পৌঁছে যাওয়া যায় মালাক্কা প্রণালী। তার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়লে বাঁহাতে পড়বে ভবিষ্যতের মহানগরী কুয়ালালামপুর, আরও এগিয়ে গেলে সিঙ্গাপুর। কম্বোজ বা ভিয়েতনাম যেতে গেলে সেখান থেকে আবার উঠতে হত উত্তরে, স্থলভূমির দেখা পেলে উপকূল বেয়ে যেতে হত আরও পুবমুখো।
অত ঝামেলায় যাবে কেন তারা? আন্দামান সাগরে পড়তেই তো বাঁদিকে সেই মুরগির গলার মত জায়গাটা যেটা মালয় দ্বীপপুঞ্জকে জুড়ে রেখেছে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে। সেখানেই অর্থাৎ ক্রা-এর খাঁড়িতে মালপত্র নামিয়ে নিয়ে স্থলপথে পুবদিকে চলত তারা। অল্প একটু গেলেই পূর্ব উপকূল, থাইল্যান্ড উপসাগরে পৌঁছে গেলে ওখান থেকে জলপথে কম্বোজ বা ভিয়েতনাম আর কতদূর! এইভাবে গেলে মুরগির মুণ্ডুর মত জায়গাটা জলপথে ঘুরে আসার দরকার পড়ত না। ভিয়েতনামের মেকং নদীর বদ্বীপ তখন খুব রমরমা বন্দর। সেখান থেকে মালবাহী পণ্য উত্তরে চলতে চলতে পৌঁছে যেত সুদূর চিনদেশের বন্দরগুলোতেও।
এই মেকং নদীর অববাহিকাতেই স্থাপিত হয়েছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারতবর্ষের প্রথম উপনিবেশ, খুব সম্ভবত প্রথম খ্রিস্টপূর্বাব্দে। চিনারা এই জায়গাকে বলত ফুনান রাজ্য। কীভাবে এই রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল, তা নিয়ে এক গল্প মুখে মুখে ফেরে। এক ভারতীয় বাণিজ্যতরী তাদের পণ্য নিয়ে যাচ্ছিল, সমুদ্রের মধ্যে তা লুঠ করতে যায় চম্পার স্থানীয় জলদস্যু নাগা উপজাতির লোকেরা। তাদের নেত্রী ঐ চাম উপজাতির রাজকন্যা, তার নাম সোমা। ভারতীয়রা ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়, বীরের মত যুদ্ধ করে জলদস্যুদের প্রতিহত করে তারা, নেতৃত্ব দেন একজন দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ, কৌনদিন্য। জলদস্যুরা পালিয়ে গেলেও জাহাজটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাকে সারানোর জন্যে জাহাজ কূলে ভেড়াতেই হয়। সমস্যা হচ্ছে, এই শত্রুসঙ্কুল পরিবেশে যদি জলদস্যুরা আবার ফিরে আসে!
এই চিন্তা যে অমূলক নয়, সেটা প্রমাণ করতেই সেদিন সন্ধ্যায় জাহাজে এসে উপস্থিত হয় স্থানীয় নাগাদের এক চর, তার হাতে পান-সুপুরি এবং একটা চিঠি। ভয়ে ভয়ে সেই চিঠি খুলে তারা তো অবাক। যুদ্ধের নয়, রাজকন্যা সোমার প্রস্তাবটি একেবারেই অভিনব। তিনি বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। ভারতীয় ব্রাহ্মণসন্তানটির বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে সোমা তাকে মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছেন। চম্পার সংস্কৃতিতে কোনো শুভকাজে নিমন্ত্রণ জানাতে হলে পান-সুপুরি দিয়েই তা করতে হয়।
গেছিলেন ব্যবসা করতে, করে ফেললেন বিদেশিনীর পাণিগ্রহণ, তার আর ফেরা হল না। প্রিয় থং নাম নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন কম্বোজ রাজ্য। তাদের সন্তানাদি বেশ অনেক প্রজন্ম ধরে শাসন করতে লাগল ফুনান ও পারিপার্শ্বিক রাজ্যসমূহ। ভিয়েতনামের চম্পা ও কম্বোজের খ্মেরের বহু স্থানের দেয়ালে এই গল্পের বিভিন্ন রূপ উৎকীর্ণ হয়ে রইল। চম্পা ও খ্মের দুই জায়গার রাজারাও দাবি করলেন তারা ফুনানের সোমা ও তার ভারতীয় স্বামীর উত্তরপুরুষ। মাতৃতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা চালু ছিল প্রায় দেড় হাজার বছর। তাদের প্রতীক নাগ অর্থাৎ সাপ ব্যবহৃত হয়েছে খ্মেরের রাজকীয় চিহ্নসমূহে, পরবর্তীতে অ্যাঙ্করেও। এই ভারতীয় ব্রাহ্মণ কৌনদিন্য আসলে নাম নয়, গোত্র, করমণ্ডল উপকূলে এই গোত্রের ব্রাহ্মণদের দেখা মেলে এখনও।
কয়েক দশকের মধ্যেই ভারতীয় নাবিকরা বঙ্গোপসাগরের হাবভাব বুঝে যায় হাতের তালুর মত। তখন উপকূল বরাবর জাহাজ চালানোর বদলে তারা সুবিধা নিতে থাকে হাওয়া ও স্রোতের। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে ইন্দোনেশিয়ার বহু জায়গায় ভারতীয় প্রভাব। এবং এই কাজে প্রথমদিকে সাফল্য অর্জন করেছিল তামিল বা বাংলার নাবিকরা নয়, সম্ভবত কলিঙ্গরাজ্যের নাবিকরা। তাদের প্রধান বন্দর ছিল চিল্কা হ্রদ। বঙ্গোপসাগরের গায়ে লাগা এই নোনা জলের হ্রদ এক সুরক্ষিত বন্দর। সেখান থেকে তারা পাড়ি দিতে লাগল সুদূর সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বোর্ণিওতে।
তবে যাত্রাপথ আদৌ সরলরৈখিক ছিল না। উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু যখন বইতে শুরু করত অঘ্রান মাস শুরু হতেই, সেই হাওয়ার সুবিধা পালে লাগিয়ে তারা চলে যেত সিংহল দ্বীপে। সিংহল বহুযুগ ধরে ভারতীয় নাবিকদের চেনা জায়গা। সেখানে গিয়ে জাহাজে জল ও খাদ্য-টাদ্য তুলে নিয়ে বিষুবরেখা বরাবর সামুদ্রিক স্রোত ব্যবহার করে ভারত মহাসাগরের পথে পুবদিক বরাবর চলে তারা পৌঁছে যেত সুমাত্রা। তারপর মালাক্কা প্রণালী ধরলে ইউ-পথ ধরে বোর্ণিও-ভিয়েতনাম, অথবা সুমাত্রার পশ্চিম ও পরে দক্ষিণ উপকূল বরাবর জাহাজ ভাসিয়ে দিলে যবদ্বীপ-বালি।
ফেরার পথও ওটাই, ফিরতি স্রোত ধরে ফের সিংহল হয়ে ফেরা। অঘ্রানে চিল্কা থেকে যাত্রা শুরু করলে যবদ্বীপ-বালি পৌঁছাতে পৌষ ফুরিয়ে মাঘ পড়ে যেত। এবার সেখানে মাঘ-ফাল্গুন দু-মাস ধরে চলত ব্যবসা-বাণিজ্য। চৈত্রের শুরুতে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি। ওখান থেকে সিংহল পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুরু হয়ে যেত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর হিন্দোল। সেই খোলা হাওয়া পালে লাগিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসত তারা, বর্ষা শুরুর আগেই।
অল্পদিনের মধ্যে বাংলা, অন্ধ্র, তামিল বণিকরাও শুরু করল এইপথে বাণিজ্য, উত্তর-পশ্চিম ভারতের ঘোড়া-ব্যবসায়ীরাও তাদের ঘোড়া নিয়ে এসে জুটত তাম্রলিপ্ত বন্দরে যবদ্বীপ-সুমাত্রায় ঘোড়া বেচার জন্যে, তবু তাদের মধ্যে কলিঙ্গ বণিকদের দাপটই সম্ভবত ছিল বেশি। এখনও উড়িষ্যার লোকগাথায় এর প্রভাব অনেক। প্রতি বছর কার্ত্তিক পূর্ণিমায় তারা জলে প্রদীপ ভাসায়। নারী ও শিশুরা কোনো জলাশয়ের তীরে এসে কাগজের তৈরি নৌকায় তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দেয়। কোনারকের কাছে সমুদ্র উপকূলে ভাসানো প্রদীপ উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর টানে লাইন দিয়ে পূর্ণিমার জোৎস্না মেখে ভেসে চলে দূর থেকে দূরে। হাজার দেড়-হাজার বছর আগে এভাবেই তারা তাদের ঘরের পুরুষদের বিদায় জানাত বাণিজ্যে যাওয়ার আগে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দরে।
সেই রীতি স্মরণ করে এখনও কার্ত্তিক পূর্ণিমায় বালি-যাত্রা মেলা বসে কটকে।
কীসের বাণিজ্য করত এই ভারতীয় বণিকরা? প্রধানত সুতির কাপড়। ভারতে উৎপন্ন সুতিবস্ত্রের তখন বিশ্বজোড়া নাম। এর সঙ্গে গহনার উপযোগী কাচের পুঁতি, ধাতব বস্তু, ভারতীয় মশলাও থাকত। থাকত ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী পশ্চিমী দেশগুলো থেকে আসা আরব বণিকদের কাছ থেকে কেনা সামগ্রীও। এইসব বিক্রি করে তারা কিনে নিয়ে আসত চিনদেশের রেশম, সুমাত্রার কর্পূর, ইন্দোনেশিয়ার লবঙ্গ, জায়ফল। ইওরোপের বিভিন্ন দেশে অতীতে যেসব মশলাকে ভারতীয় বলে গণ্য করা হত, তাদের বেশ কিছু আসত ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলো থেকে। সারা পৃথিবীর লবঙ্গ উৎপন্ন হত সেখানকার কয়েকটা ক্ষুদ্র দ্বীপে। ভারতে উৎপন্ন প্রধান মশলা ছিল আদা-গোলমরিচ।
দুটো দেশের মধ্যে দীর্ঘকালীন বাণিজ্য শুধুমাত্র তো পণ্য সরবরাহে সীমাবদ্ধ থাকে না। শুরু হয় সংস্কৃতির আদান-প্রদানও। ভারতবর্ষ থেকে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে পড়ল হিন্দু সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতি। পৌঁছে গেল রামায়ণ মহাভারতের গল্প, সংস্কৃত ভাষা, তার সাহিত্য। শুরু হল মন্দির নির্মাণ ও তৎসংক্রান্ত প্রযুক্তি ও শৈলীবিনিময়। পরবর্তীতে দীর্ঘকাল মুসলমান অধীনে থেকে দেশের জনগণ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেছে, ইওরোপিয় উপনিবেশের ফলে তার মধ্যে প্রবেশ করেছে তার প্রভাবও, কিন্তু অতীতের হিন্দু প্রভাব তাদের সংস্কৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়নি। জায়গার নাম, মানুষের নাম, শব্দসম্ভারের প্রচলিত বহু শব্দ, শিল্প ইত্যাদির মধ্যে বেঁচে আছে হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রভাব – ভিয়েতনাম থেকে ব্রহ্মদেশ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। সেখানকার উৎসবাদিতে ব্যবহৃত মুখোশ বা ছায়া-পুতুলনাচ যে অন্ধ্র-উড়িষ্যা থেকেই সেখানে গেছিল, তা বোঝা যায়। আসলে এগুলো সমুদ্রে ভাসমান জাহাজীদের আমোদ-প্রমোদের জন্যেই উদ্ভাবিত হয়েছিল। নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্যে তারা জাহাজের দাঁড় দিয়ে তৈরি করত ‘শ্যাডো পাপেট্রি’।
এর মানে এই নয় যে সমস্ত কিছু শুধু ভারত থেকেই ওখানে যেত। ওখান থেকে ভারতে আসা সংস্কৃতির উদাহরণও কম নেই। সামান্য চুন লাগিয়ে কুচো সুপুরি খয়ের লাগিয়ে পান খাওয়ার রীতি ভারতীয়রা শিখল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকেই। বালি, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স এমনকি তাইওয়ানের গ্রামেও এই রীতি প্রচলিত ছিল, এখনও আছে। বিয়ে-শাদির মত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণে পান-সুপুরি অত্যাবশ্যকীয়।
* * *
ইসলামের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত মহাসাগরের পশ্চিম ভাগে আরব সাগরপাড়ের দেশগুলোতে ধর্মীয় প্রভাব পড়তে শুরু হলেও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে তার প্রভাব পড়তে সময় লেগেছে অনেক। বাংলায় বৌদ্ধ পালরাজারা রাজত্ব চালিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চীপুরমকে রাজধানী বানিয়ে রাজত্ব করেছে পল্লবরা।
অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইন্দোনেশিয়ার যবদ্বীপ ও তার সন্নিহিত রাজ্যগুলো নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়িতে মেতে উঠল। তাদের আগ্রাসন গিয়ে পৌঁছাল কম্বোজ এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের চম্পায়। রাজা সঞ্জয় নামে একজন কিছুদিন খ্মের শাসন করে গেলেন। মালাক্কা প্রণালীর মুখেই সুমাত্রা-মালয়ের শ্রীবিজয় রাজ্য, দক্ষিণ ভারতের চোল বংশের রাজা রাজেন্দ্র চোলের আমলে সেখানে ভারতীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সে দেশই বা পিছিয়ে থাকবে কেন, সেখানকার রাজা ঝটিতি আক্রমণে খ্মেরের ছোট ছোট জনপদের কয়েকজন শাসককে হত্যা করে নিজের শাসন কায়েম করলেন। এ রকম গোলমালের মধ্যেই উঠে এলেন একজন নতুন শাসক, তার নাম দ্বিতীয় জয়বর্মণ। তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন অ্যাঙ্কর সাম্রাজ্য।
দ্বিতীয় জয়বর্মণ ছিলেন শৈব। তিনি দেশের মধ্যে শিবের মন্দির স্থাপন করলেন। কীভাবে তিনি রাজা হলেন, তা ঠিক জানা না গেলেও এমন হতে পারে যে তিনি সেখানকার কোন এক রাজকন্যাকে বিয়ে করে তার গদি দখল করেছিলেন। গদি দখল করেই তিনি স্থানীয় শাসক এবং যবদ্বীপ ও শ্রীবিজয় থেকে আসা যোদ্ধাদের পরাজিত করে স্থাপন করলেন নিজস্ব কর্তৃত্ব। মহাকাব্যগুলোতে যেমন রাজসূয় বা অশ্বমেধ ধরনের বেশ বড়সড় যজ্ঞ-টজ্ঞ করে আশেপাশের রাজাদের জানিয়ে দেওয়া হত, আমিই পৃথিবীর অধিপতি, ইনিও সে রকম কিছু এক অনুষ্ঠান করে নিজেকে চক্রবর্তী-সম্রাট ঘোষণা করেছিলেন। এর ফলে সেখানে বাইরের উৎপাত কমে গেল। ইন্দ্রপুর নামে তিনি এক নতুন রাজধানী ও অনেক নতুন নতুন শহর স্থাপন করে তিনি রাজত্ব বাড়িয়ে চললেন। কম্বোজের মাঝামাঝি আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে যে বিশাল হ্রদ – যার নাম টোনলে স্যাপ – সেই হ্রদ তার রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হল, অনেক নতুন নতুন জনপদ গঠিত হল। সেচ ব্যবস্থায় নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে আশেপাশে শুরু হয়ে গেল প্রচুর ধানের চাষ।
আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় জয়বর্মনের মৃত্যু হয়। তার ছেলে রাজ্য শাসন করেছিলেন ৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ অবধি। পরবর্তী রাজা প্রথম ইন্দ্রবর্মণ ছিলেন দ্বিতীয় জয়বর্মনের রানির ভাইপো। প্রথম ইন্দ্রবর্মনের স্ত্রী ছিলেন প্রাচীন ফুনানের প্রতিষ্ঠাতা সেই কৌনদিন্য-সোমার বংশের মেয়ে। এই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা অ্যাঙ্কর রাজ্যের শাসক হওয়ার পক্ষে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ইন্দ্রবর্মণ যখন শিবের মন্দির স্থাপন করলেন, তিনি তার মূর্তি উৎসর্গ করলেন তার বাবা-মা দ্বিতীয় জয়বর্মণ ও তার রানির উদ্দেশেই নয়, মায়ের বাবা-মা অর্থাৎ নিজের দাদু-দিদাকেও। প্রথম ইন্দ্রবর্মনের সময়কালে অ্যাঙ্করে গঠিত হল রাজ্যব্যাপী নালা ও খালের নেটওয়ার্ক, যার ফলে টোনলে স্যাপ হ্রদের জল সেই সব নালার মাধ্যমে আশেপাশের এলাকায় বয়ে আনা যায় ও তার সেচ দিয়ে সেই অঞ্চলে শুরু করা যায় ব্যাপক ধানচাষ।
তার উত্তরাধিকারী যশোবর্মণ যখন গদিতে বসলেন, ততদিনে অ্যাঙ্কর বেশ বড়সড় রাজ্য, তার মধ্যে ঢুকে গেছে এখনকার কাম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং লাওস। সুতরাং তার প্রয়োজন পড়েছিল একটা বড়সড় রাজধানীর। তিনি অ্যাঙ্করে এই রাজধানী পত্তন করে তার নাম দিলেন যশোধরপুর। আরও অনেকগুলো মন্দির স্থাপিত হল তার সময়ে, যার মধ্যে ছিল প্রিয় বিহারের মন্দিরও। সারা পৃথিবীতেই অ্যাঙ্কর হয়ে উঠল দশম শতকের এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ শহর। কিন্তু সাধারণভাবে যা হয়, আবার নিজেদের মধ্যে মারামারি করে দশম শতকের শেষদিকে তার অবস্থা পুনরায় খারাপ হয়ে গেল। একইভাবে সেই ধ্বংসস্তূপে উঠে এলেন প্রথম সূর্যবর্মণ। তিনিও ছিলেন দ্বিতীয় জয়বর্মনের রানি তথা প্রথম ইন্দ্রবর্মনের মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী, অর্থাৎ সেই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসনের উপযুক্ত দাবিদার। প্রথম সূর্যবর্মণ একাদশ শতকের প্রথমার্ধ প্রায় অর্ধ শতক ধরে রাজত্ব চালিয়েছিলেন। রাজা হয়েই আভ্যন্তরীণ গোলমালে হারানো রাজ্যাংশ তিনি পুনরায় নিজের অধিকারে নিয়ে আসেন, তাদের ওপর নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপন করেন। তার সময়ে রাজ্য বেড়ে পূর্ব দিকে চলে যায় চম্পার সীমান্ত অবধি। তিনি নির্মাণ করেন অ্যাঙ্করের বিখ্যাত স্কাই প্যালেস, যার মাথাটা নাকি পুরোটাই মোড়া ছিল সোনা দিয়ে।
নাগাবংশীয় এই শাসকদের রাজকীয় প্রতীক ছিল সাত-মাথাওয়ালা এক ভয়ঙ্করদর্শন নাগ। তাদের শিল্প-সংস্কৃতিতে এর প্রচুর ব্যবহার। গল্প শোনা যেত, রাজা প্রতিদিন রাত্রি প্রথম প্রহরে প্রাসাদের এক উচ্চকক্ষে শয়ন করতেন এক সাপিনীর সঙ্গে, রাজা কাছে এলেই যে সাপিনীর খোলস ছেড়ে ধারণ করত এক পরমাসুন্দরী নারীর রূপ। এই সাপিনী যে নাগাবংশী রাজকন্যার প্রতীক, তা নিশ্চয় বলার দরকার নেই।
প্রথম সূর্যবর্মনের মৃত্যুর পর আবার শুরু হয়ে যায় অরাজক অবস্থা। চম্পার চামরাজারাও আক্রমণ করে খ্মের। এবং আগের মতই নতুন এক রাজা শাসক হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন ১১১৩ সালে। তিনি দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ। তাঁর আমলেই তৈরি হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মন্দির এবং উপাসনাস্থল – অ্যাঙ্করবাট।
ভাট বা ওয়াট না লিখে যে বাট লিখলাম, তার কারণ ‘যখন পড়বে না মোর চরণচিহ্ন এই বাটে’-র বাট তথা চত্বর হচ্ছে এই বাট, সংস্কৃত তৎসম শব্দ। অ্যাঙ্কর শব্দটাকে বলা যেতে পারে নগর-এর অপভ্রংশ। নগরের চত্বর, যা বিভিন্ন শহরে সাধারণভাবে স্কয়ার – যেমন টাইম স্কয়ার, ট্রাফালগার স্কয়ার, রেড স্কয়ার, তিয়েন-আন-মেন স্কয়ার – তেমনি এই অ্যাঙ্করবাট। চত্বরটি আদর্শ আয়তক্ষেত্র, তার দেয়াল দৈর্ঘ্যে ১০২৫ মিটার, প্রস্থে ৮০২ মিটার এবং উচ্চতায় সাড়ে চার মিটার। এলাকা চারশো একরেরও বেশি, সওয়া ষোল লক্ষ বর্গমিটার অর্থাৎ প্রায় চারখানা তিয়েন-আন-মেন স্কয়ারের সমান। এর চার দিকে ৩০ মিটার দূরত্বে ১৯০ মিটার চওড়া একটি পরিখা।
হিন্দু পুরাণে বর্ণিত দেবতাদের আবাস মেরু পর্বতের আদলে গড়া হয়েছে এর মন্দিরটি। তার কেন্দ্রে পাঁচটা সুউচ্চ শিখর যেন মেরু পর্বতের পাঁচটি পর্বতশৃঙ্গের প্রতিনিধি। তার দেয়াল ও পরিখা যেন পর্বতমালা ও মহাসাগরের প্রতীক। অন্যান্য খ্মের মন্দির যেখানে পূর্ব দিকে মুখ করে নির্মিত হয়েছে, সেখানে আঙ্করবাটের মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে নিবেদিত মন্দির, বিষ্ণুদেব পশ্চিম দিকের সাথে জড়িত, হয়ত সে কারণেই।
রাজা সূর্যবর্মণের মৃত্যুর পর এর নির্মাণ কার্য বন্ধ হয়ে যায়, ফলে এর দেয়ালের কিছু কারুকার্য অসমাপ্ত থেকে যায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনে কম্বোজে পরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন ঘটে। ফলে পরের শতাব্দীতে আঙ্করবাট বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়। মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে বিষ্ণুর মূর্তিটা বের করে স্থাপন করা হয় প্রধান প্রবেশদ্বারের মুখে। তাতে অবশ্য বিশেষ সমস্যা হয়নি হিন্দু-বৌদ্ধ কারোরই। হিন্দু ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির মধ্যে অনেক মিল ছিল। বৌদ্ধদের কোনো অসুবিধা ছিল না বিষ্ণুপুজোয়। হিন্দুরাও বুদ্ধদেবকে বিষ্ণুর অবতার হিসাবেই গণ্য করে।
দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ অ্যাঙ্করে সুষ্ঠু শাসন নিয়ে এলেও তার মৃত্যুর পর আবার বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। ১১৭৭ সালে অ্যাঙ্কর শহরটি খ্মেরদের চিরাচরিত শত্রু চম্পার চামদের হাতে পরাজিত ও লুণ্ঠিত হয়। পরিচিত স্থলপথের বদলে তারা আক্রমণ শানায় নদীপথে, তাতে খ্মেররা সম্পূর্ণ হতচকিত হয়ে যায়। যশোধরপুর শহরের বাইরের পরিখা কোনো কাজেই আসে না প্রতিরক্ষায়। চামরা লুঠপাট চালায়, রাজাকে হত্যা করে, মন্দিরের কিছুও ধ্বংস করে।
আবার পুরনো রীতি অনুসরণ করে নতুন রাজা হন সপ্তম জয়বর্মণ, তার মা ছিলেন প্রথম সূর্যবর্মণের নাতনি! জলপথের যুদ্ধেই চামদের চামড়া গুটিয়ে দিয়ে রাজ্যটিকে পুনর্গঠিত করেন তিনি। যশোধরপুরে যথেষ্ট প্রতিরক্ষাব্যবস্থা না থাকায় তার বদলে এর কয়েক কিলোমিটার উত্তরে অ্যাঙ্কর থোম-এ নতুন রাজধানী ও বায়ুন নগরে প্রধান মন্দির স্থাপন করেন। রাজধানীতে তোলা হয় ল্যাটেরাইট পাথরের মোটা দেওয়াল। তার চারিদিকে চওড়া পরিখা। বিশাল মাপের প্রবেশদ্বারে বৃহদাকৃতি মানুষের মুখের প্রতিকৃতি স্থাপিত হয়।
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে অ্যাঙ্করের রমরমা সময়ে এটা ছিল সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির নগর। প্রায় লাখ দশেক লোক বাস করত এই জনপদে।
অ্যাঙ্করের রাজকীয় পদযাত্রা ছিল দেখার মত। সেই বিশাল মিছিলের শুরুতে চলত বড়সড় এক অশ্বারোহীর দল, বাজতে থাকত কাড়া-নাকাড়া ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। তার পিছনেই চলত রাজসভার সুন্দরী মহিলাদের এক বিশাল দল। তাদের হাতে থাকত সোনা ও রুপোর পাত্র, গায়ে বিভিন্ন অলংকারাদি। এদের মধ্যে কিছু কিছু মহিলা সশস্ত্রও থাকতেন, তাদের হাতে থাকত সুবর্ণখচিত ঢাল তলোয়ার। এদের পেছনে আসতেন মন্ত্রী এবং রাজপুত্ররা। তারা বসতেন হাতির পিঠে। তাদের পোশাকে থাকত সোনা রুপোর পদক। এদের পেছন পেছন আসতেন রানি এবং রাজপরিবারের অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলারা। তারা চড়তেন পালকি এবং রথে। সবশেষে আসতেন রাজামশাই স্বয়ং। তাকে ঘিরে থাকত ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল। তারাও আসতেন হাতির পিঠে চেপে। রাজার হাতে শোভা পেত বিশাল দৈব তলোয়ার।
অ্যাঙ্করের নগরবাসীরা যে সবাই বড়লোক ছিল এমন নয়। বড়লোকরা বাস করতেন টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িতে, গরিবদের বাড়ি ছিল পাতায় ছাওয়া। প্রত্যেকের বাড়িতেই মেঝেতে মাদুর পাতা থাকত, টেবিল চেয়ার বা খাট-পালংকের ব্যাপার ছিল না। লোকের মাদুরে বসত, তার ওপরেই ঘুমাত রাত্রে। জলবায়ু এত বেশি গরম এবং আর্দ্র ছিল যে সময়ে সময়ে লোকজনকে মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করতে হত। বিষুবরেখার তীরবর্তী হওয়ায় এই ঘটনা তেমন অস্বাভাবিক কিছু নয়।
অ্যাঙ্করের বাজারে পণ্য কেনাবেচায় দেখা যেত মূলত মহিলাদের। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এটাও একটা স্বকীয়তা। বহুশত বছর পরে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর মধ্যে মেঘালয় এবং মণিপুরে একই দৃশ্য দেখা যাবে। শিলং এবং ইম্ফলের খাসি প্রজাতির মানুষরা খ্মেরদের তাদের পূর্বসূরী হিসাবে গণ্য করবে। খ্মের সংস্কৃতি বহু শতবর্ষ ধরে বয়ে চলবে তাদের জীবনযাপনেও।
* * *
সুমাত্রা-মালয়ে যেমন শ্রীবিজয় রাজাদের কর্তৃত্ব, যবদ্বীপে ত্রয়োদশ শতকে তেমনি গড়ে উঠল সিংহসারি রাজত্ব। এদের ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাব লক্ষণীয়। সিংহসারি মানে ঘুমন্ত সিংহ। যদিও যবদ্বীপে সিংহ দেখার সম্ভাবনা কম, হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে সিংহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতীক হিসাবে সারা ইন্দোনেশিয়াতেই সিংহ বিরাজমান। তারই সাক্ষ্য দিতে ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নাম হবে সিঙ্গাপুর।
চেঙ্গিজ খান ও তার উত্তরসূরীদের হাতে মঙ্গোলরা শক্তিশালী হতে তার প্রভাব এসে পড়ল দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়াতেও। দক্ষিণ ভিয়েতনামের চম্পায় মঙ্গোল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। সুমাত্রায় শ্রীবিজয় রাজাদের শক্তি ধীরে ধীরে কমে আসতে যবদ্বীপ এই অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করে। বালি, মাদুরা, কেদিরি প্রভৃতি তাদের শাসনাধীন হয়।
সিংহসারিদের পাঁচ রাজা রাজত্ব করেছিলেন ১২২২ থেকে ১২৯২ সাল পর্যন্ত। এর প্রথম রাজা কেন-আরক ছিলেন স্থানীয় শাসকের ভৃত্য, মনিবকে বধ করে তিনি রাজা হয়েছিলেন। শাসকের পুত্র অনুসাপতি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তাকে হত্যা করে রাজ্য দখল করেন। কেন-আরকের উপপত্নী-গর্ভজাত ছেলে পঞ্জি-তোজয় অনুসাপতিকে হত্যা করে ফের রাজা হন, কিন্তু বেশিদিন টানতে পারেননি। তার ভাইপোরা বিদ্রোহ করে। ভাইপোদের নাম বিষ্ণুবর্ধন আর নরসিংহমূর্তি। এই সাম্রাজ্যের শেষ রাজা বিষ্ণুবর্ধনের পুত্র কীর্তিনগর। তিনি একাধারে শৈব ও বৌদ্ধ। হিন্দু-বৌদ্ধ মিশ্রসংস্কৃতিতে উদ্ভূত তন্ত্রসাধনা প্রসার লাভ করছিল। রাজা কীর্তিনগর তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাসী হয়ে পড়লেন।
প্রবল পরাক্রমী কুবলাই খান কীর্তিনগরের কাছে দূত পাঠালেন ১২৮০ সালে, উদ্দেশ্য বশ্যতা স্বীকার করে কর প্রদান। কীর্তিনগর পাত্তা দিলেন না। পরের বছর আবার এল দূত, আবার ফিরে গেল তারা খালি হাতে। আট বছর পরে ১২৮৯ সালে আবার এল কুবলাই খানের নির্দেশ – হয় বশ্যতা স্বীকার করো, নতুবা মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও। মেং-চি নামে এক দূত কীর্তিনগরের কাছে কুবলাই খানের বার্তা পড়ে শোনালে রাজার নির্দেশে মেং-চির কান কেটে নিয়ে দূতকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হল চিনে। ক্রুদ্ধ কুবলাই খান ১২৯২ সালে এক হাজার রণতরী প্রেরণ করলেন কীর্তিনগরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। ১২৯৩ সালের শুরুতে যবদ্বীপের তীরে এসে উপস্থিত হল বিশাল মঙ্গোল বাহিনী। কীর্তিনগরের সেনারা তখন দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, প্রধান দল গেছে পশ্চিমে শ্রীবিজয় অভিমুখে। তাদের কাছে খবর গেল আক্রমণ প্রতিহত করার। কিন্তু কীর্তিনগর জানতে পারলেন না, তাঁর অগোচরে নিজের সাম্রাজ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে অন্য এক বিদ্রোহী শক্তি।
সিংহসারির অধীন কেদিরির শাসক জয়কাত্বং ষড়যন্ত্র করে একযোগে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করল কীর্তিনগরের রাজধানী। রাজা চর মারফত উত্তরের আক্রমণের খবর পেলেন, সেদিকের শত্রুদের দমন করতে পাঠালেন তার জামাইকে, তার নাম নরার্য সংগ্রামবিজয়। সংগ্রামবিজয়কে বিশেষ বেগ পেতে হল না উত্তরের আক্রমণ প্রতিহত করতে, কিন্তু ততদিনে দক্ষিণ দিক থেকে জয়কাত্বং পৌঁছে গেছে রাজধানীতে। তন্ত্রসাধনায় বসেছেন রাজা কীর্তিনগর, সেই অবস্থাতেই তিনি ঘরশত্রুর হাতে নিহত হলেন।
খবর পৌঁছেছিল সংগ্রামবিজয়ের কাছেও। সে দ্রুত সেনাবাহিনী ঘুরিয়ে রাজধানী দখল করার চেষ্টা করার আগেই জানা গেল, শ্বশুরমশাই নিহত হয়েছেন। তার জীবনসংশয় হতে পারে জেনে সে তিনজন বন্ধু নিয়ে গা ঢাকা দিল মাদুরায়। একজন বন্ধুর বাবা আর্য বীররাজ তখন মাদুরার শাসক এবং সিংহসারির শত্রুপক্ষ। ছেলের পরামর্শে তিনি অবশ্য শত্রুতা ভুলে জয়কাত্বং-এর সঙ্গে এদের মধ্যস্থতা করতে রাজি হলেন। অর্জুন পাহাড়ের উত্তরে তারিক অরণ্যের শাসনের অধিকার পেল সংগ্রামবিজয়। সেই বনে প্রচুর বেলগাছ, আর সেই বেল প্রচণ্ড তেতো। স্থানীয় ভাষায় বেলের নাম মজা। তেতো বেল অর্থে মজাপহিত নাম হল সংগ্রামবিজয়ের রাজধানীর, সে পরিচিত হল বিজয় নামে।
এদিকে বিশ-তিরিশ হাজার সৈন্য আর হাজারখানেক রণতরী নিয়ে মঙ্গোল সৈন্য এসে গেছে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে। তাদের সেনাপতির নাম শি-বি, তার দুই সহযোগী উত্তরকুরু তথা উইগুর প্রদেশের লোক লকে মেসে আর চিনা গাওজিং। তির-ধনুক, ঢাল-তলোয়ার ছাড়াও তাদের সঙ্গে ছিল গোলাবারুদ বর্ষণের কামানও। পদাতিক দলের সঙ্গে ভারী হাতুড়ি ও কুঠার। অশ্বারোহী দলে তেজী অশ্ব। একশো ফুট লম্বা, ছত্রিশ ফুট চওড়া এক একটা জাহাজে ২০-৩০ জন করে সৈন্য। তবে দক্ষিণ চীন থেকে রওনা হয়ে আসার পথে তাদের এক বিকট তুফানের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে, তাতে জাহাজগুলো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, নষ্ট হয়েছে খাবারদাবারও। চম্পায় ভেবেছিল তারা জাহাজগুলো সারিয়ে উপযুক্ত রসদ তুলে নেবে, কিন্তু চম্পার শাসক তাদের উপকূলে জাহাজ ভেড়ানোর অনুমতি দেয়নি, ফলে তাদের মধ্যে উদ্দীপনার অভাব। তাদের বিরুদ্ধে লড়বে যে স্থানীয় যবদ্বীপী সৈন্যরা, তাদের সংখ্যাও ঐ বিশ তিরিশ হাজারই। তবে তারা দ্বীপের অধিবাসী হওয়ায় তাদের জাহাজগুলো দ্রুতগতি ও বড় বড়, লম্বায় দেড়শো ফুটেরও বেশি, এক একটায় পাঁচশো থেকে হাজার সৈন্য বইতে পারে। সেই জাহাজ তৈরি হয়েছে বহু মোটা মোটা কাঠের পাটাতন জোড়া দিয়ে, তা দূর থেকে ছোঁড়া গোলার আঘাত সইতে পারে। তাদের সেনারা জলপথে মঙ্গোলদের চেয়ে অধিকতর যুদ্ধপটু।
মঙ্গোল যোদ্ধাদের আগমনের খবর জেনে বিজয় মজাপহিত থেকে তাদের কাছে বার্তা পাঠাল। জানাল তাদের শত্রু যে কুবলাই খানকে অসম্মান করেছে, সে আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রে নিহত হয়েছে। বর্তমান রাজা জয়কাত্বং অন্যায়ভাবে রাজ্য দখল করেছে। সে তাকে রাজা হিসাবে মানে না এবং সেজন্যে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। মঙ্গোলরা চাইলে তারা একযোগে আক্রমণ করতে পারে, করলে সে সহজেই পরাভূত হবে। রাজ্যের ম্যাপ পাঠিয়ে দিল সে।
শি-বি তাকে জানাল, একযোগে আক্রমণে তার আপত্তি নেই, তবে সে এসেছে তাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের স্বীকৃতি নিয়ে যেতে। বিজয়কে সে রাজ্যপ্রাপ্তিতে সাহায্য করবে যদি সে কুবলাই খানের বশ্যতা স্বীকার করে, তাকে কর দিতে রাজি থাকে। বিজয় তার শর্ত মেনে নিয়ে জানিয়ে দিল, তা তো সে দেবেই, সঙ্গে তার দুই রাজকন্যাকেও সে উপহার দেবে মঙ্গোল রাজাকে।
তিন সপ্তাহের মধ্যেই কাদিরির পতন হল। জয়কাত্বং মঙ্গোলদের একদিক দিয়ে ঠেকাতে গেলে অন্যদিক দিয়ে বিজয়ের মজাপহিত সেনারা এসে তার রাজপ্রাসাদ লুঠ করে জ্বালিয়ে দিল। জয়কাত্বং পশ্চাদপসারণ করে রাজধানীতে ফিরে দেখল তার রাজপ্রাসাদ বিধ্বস্ত। সপরিবার ও সপারিষদ আত্মসমর্পণ ছাড়া তার আর উপায় থাকল না। পাঁচ কোটি ইউয়ান মূল্যের সম্পত্তি তুলে নিল মঙ্গোলরা তাদের জাহাজে।
বিজয় তাদের জানাল, সে মজাপহিত ফিরে গিয়ে করের ব্যবস্থা করবে। মঙ্গোলরা যেন কয়েকদিন পরে তাদের প্রতিনিধি পাঠায় তার রাজ্যে, তাদের হাতে সে তুলে দেবে তার কর এবং রাজকন্যা দুজনকেও। রাজকন্যারা রক্তপাত একেবারে সহ্য করতে পারে না, তাদের কোমল হৃদয়, তাই প্রতিনিধিরা যেন অস্ত্রহীন অবস্থায় তাদের রাজ্যে যায়।
শি-বি দুশোজনের এক প্রতিনিধি পাঠাল মজাপহিতে কর আর রাজকন্যা তুলে আনতে। বিজয় তাদের কচুকাটা করে ফেলল। ফেলে বসে থাকল না, সে জানে এই খবর পেলে শি-বি সমস্ত সেনা নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। সে অগ্রবর্তী হয়ে আচমকা আক্রমণ করে বসল শি-বির শিবির। অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে গেল মঙ্গোল সেনারা। প্রাণ নিয়ে তারা পালাতে লাগলে পেছন থেকে তাড়া করে তাদের এক এক করে জাহাজ দখল করতে লাগল সংগ্রামবিজয়ের সেনারা। আর্য আদিকর নামে যবদ্বীপের আর এক শাসকও মঙ্গোলদের আক্রমণ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। গেরিলা আক্রমণে হঠাৎ চমকে দিয়ে যেসব জাহাজে ধনরত্ন বোঝাই করেছিল মঙ্গোলরা, সেগুলো সব দখল করে নিল বিজয়।
অর্ধেকের বেশি সেনা এবং বহু জাহাজ ধ্বংস হতে শি-বির পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর গত্যন্তর রইল না। বহুদিন হয়ে গেছে তারা যুদ্ধে বেরিয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী হাওয়া বইছে এখন, কিছুদিন পরেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে আর জাহাজ ভাসানো যাবে না। এই হাওয়া কাজে লাগিয়ে দেশে ফিরতে না পারলে আবার বসে থাকতে হবে অন্তত ছ-মাস। তার মধ্যে এই শত্রুরা তাদের কী অবস্থা করবে, কে জানে।
দু-মাসের ওপর লাগল তাদের দেশে পৌঁছাতে। এতগুলো সেনার জীবনের ও যুদ্ধজাহাজের বিনিময়ে তারা জিতে এনেছে জয়কাত্বঙের বাচ্চাদের আর শ’খানেক সভাসদ, রাজ্যের ম্যাপ আর রাজার চিঠি। পুরস্কারস্বরূপ কুবলাই খানের কাছ থেকে তার জুটল সত্তর ঘা চাবুক। তার সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ বাজেয়াপ্ত করা হল।
বিজয় দখল করে নিল তার শ্বশুরের রাজধানী। ১২৯৩ সালের নভেম্বরে কীর্তিরাজস জয়বর্ধন নাম নিয়ে শুরু করল মজাপহিত রাজবংশ।
* * *
১২৯২ সালে মার্কো পোলো ঘুরে গেল সুমাত্রা যবদ্বীপ। তার প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে এল ইবন বতুতা।
এর মধ্যে মজাপহিতদের সমৃদ্ধি দেখার মত। বিজয়ের পর তার ছেলে কিছুদিন রাজা হয়েছিল কিন্তু তার ছেলেমেয়ে না থাকায় রাজত্ব সম্প্রদান করা হল বিজয়ের বড় মেয়ের হাতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে রাজার ছেলে না থাকলে ভাইপো বা এই রকম কোনো পুরুষ উত্তরাধিকারীর হাতে দায়িত্ব এসে যেত। কিন্তু এখানকার ব্যবস্থা অন্য রকম, অনেকটা দক্ষিণ ভারতের কাকতীয় রাজবংশের মত – ছেলের অভাবে মেয়ে বা বোন রাজা হবে।
বিজয়ের বড় মেয়ের ছেলে রাজসনগর রাজা হল ১৩৫০ সাল নাগাদ। সে হচ্ছে যাকে বলে মজাপহিত রাজ্যের স্বর্ণযুগ। তবে সেটা ঠিক তার জন্যে, এ কথা বলা যাবে না। তার প্রধানমন্ত্রী গজমদ এই স্বর্ণযুগের প্রধান স্থপতি। গজমদের কূটনীতির প্রভাবেই মজাপহিতরা সমগ্র ইন্দোনেশিয়া জুড়ে স্থাপন করল তাদের প্রভাব।
ওদিকে মঙ্গোলদের দাপটে চিন গুটিয়ে গিয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হলেও তাদের বণিকরা বাণিজ্যতরী নিয়ে ব্যবসাপত্তর বজায় রেখেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, সিংহলে, ভারতে। সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বালির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজত্বের সঙ্গে সেই ব্যবসা চালু ছিল। চিনা সং রাজবংশের সঙ্গে শ্রীবিজয়ের সম্পর্ক অতি পুরনো। ১৩৭৭ সালে মিং রাজ্যের চিনা দূত এই দ্বীপপুঞ্জের মালয়ু রাজ্যের এক রাজ্যাভিষেকে হাজির হলে মজাপহিত রাজা সেটা সুনজরে দেখলেন না। মালয়ু রাজ্য তার অধীন, সেখানে চিন নাক গলানোর কে? তারা ওখানে কে রাজা হবে, তাতে অংশগ্রহণ করবে কেন? মিং রাজদূতকে তলব করে হত্যা করা হল যবদ্বীপে। ফলে দীর্ঘকাল চিনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক শীতল হয়ে রইল। চিনারা এ ব্যাপারে থাইল্যান্ডের রাজাকে নালিশ করলে তারা কড়াভাবে বুঝিয়ে দিল চিনাদের ঔদ্ধত্য কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।
অথচ সারা পৃথিবী চায় চিনাদের রেশমবস্ত্র, তাদের চিনেমাটির বস্তু। বাণিজ্য ছাড়া রাষ্ট্র অচল। কর সংগ্রহ না হলে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিই বা কোথায়? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা মালাক্কা প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে পুব-পশ্চিমের নৌ-বাণিজ্যের দফারফা। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে পণ্য রপ্তানির জন্যে আগেই খুলে গেছিল স্থলপথ – সিল্ক রুট। কিন্তু সেই পথে বিভীষিকার মত ছড়িয়ে পড়ল ব্ল্যাক ডেথের করাল বিভীষিকাও।
জলপথ কোনোভাবেই বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। রাজা দরকার হলে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেবেন নামিদামি উপঢৌকন সহযোগে। যুদ্ধ নয়, মিত্রতার প্রাথমিক দাবি নিয়ে পাঠাবেন রাজদূত।
সেই দৌত্যের উদ্দেশ্যেই একের পর এক সাত সাতখানা চিনা মহা-বাণিজ্যতরী ভাসল সাগরে। তাদের সর্বাধিনায়ক এক নপুংসক অ্যাডমিরাল। তার নাম ঝেং হে।
পঞ্চদশ শতকের শুরুতে এক নতুন মিং সম্রাট ইয়োঙ্গল উপাধি ধারণ করে স্থির করলেন বিশ্বকে চীনের শক্তি দেখাবেন। ইয়োঙ্গল মানে অনন্ত আনন্দ। আনন্দদায়ক সেই উদ্দেশ্যে তিনি পরিকল্পনা করলেন বড় বড় সমুদ্রযাত্রা স্পনসর করবেন। বহু শতবর্ষ ধরে চীনের জাহাজ বিদেশের উপকূলে বাণিজ্য করেছে, কিন্তু তাদের তো আর সমুদ্রযাত্রা বলা যায় না। এই যাত্রাগুলো হবে তাদের চেয়ে অনেক আলাদা, অনেক আড়ম্বরপূর্ণ, অনেক রাজকীয়। ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল পর্যন্ত চিনের বিশাল বিশাল বাহিনী সুমাত্রা, ভারত, সিংহল, ওমান এবং আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে সমুদ্রযাত্রায় বেরোল। এই যাত্রার যারা সাক্ষী, তারা অভূতপূর্ব এই জাহাজগুলোকে দেখে বিস্মিত না হয়ে পারেনি। বিশাল লম্বা ছিল এর প্রধান জাহাজগুলো। এক একটা চারশো ফুট লম্বা। সেই তুলনায় পরবর্তীতে কলম্বাসের মাত্র পঁচাশি ফুট লম্বা বিখ্যাত সান্তা মারিয়াকে দুগ্ধপোষ্য শিশুই বলা যায়। চিনের এই জাহাজগুলোতে ভর্তি হয়েছিল পোর্সেলিন, রেশম, লাক্ষা এবং অন্যান্য বাণিজ্য-উপযোগী এবং উপহার-উপযোগী বস্তুসমূহ। তাদের সঙ্গে পেছন পেছন যেত শতশত ছোট ছোট নৌকা। সেগুলো প্রধানত ছিল বড় জাহাজের যাত্রীদের রসদ যোগান দেওয়া ও প্রয়োজনে তার সুরক্ষায় যুদ্ধ করা। সব মিলিয়ে এক একটা যাত্রায় প্রায় সাতাশ হাজার নাবিক এবং যোদ্ধা মোতায়েন ছিল।
এই যাত্রার সর্বাধিনায়ক ঝেং হে ছিল একজন মুসলিম হিজড়ে। তার জন্ম হয়েছিল ইউনান প্রদেশের এক মুসলমান পরিবারে, তারা ছয় ভাইবোন। তার বাপ-ঠাকুর্দা নামের সঙ্গে হাজি ব্যবহার করত, অর্থাৎ তারা মক্কায় হজ করতে গেছিল। বাল্যকালে ঝেং-এর নাম ছিল মা হে। ইউনান চারিদিক থেকে স্থলভূমি দিয়ে বেষ্টিত, তার কোন উপকূল নেই। যখন সে বালক তখন মিং রাজবংশের রাজার সেনারা ইউনান প্রদেশ থেকে মঙ্গোলদের উৎখাত করতে এসেছিল। মা হে-র পূর্বপুরুষরা মঙ্গোলদের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছে। মা হাজি মিং সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। সেনারা বালক মা হে-কে স্থানীয় মঙ্গোল সেনাপ্রধানের খোঁজ দিতে বললে সে বানিয়ে বলে যে মঙ্গোল সেনাপ্রধান লেকের জলে আত্মগোপন করে আছে। রেগেমেগে সেনারা তাকে ও অন্যান্য বহু লোকজনকে তুলে নিয়ে যায় এবং অণ্ডকোষ ছেদন করে তার পুরুষত্ব হরণ করে তাকে রাজপুত্রের ভৃত্য বানিয়ে রাজবাড়িতে রেখে দেয়। রাজপুত্র ঝু দি তখন বেইজিঙের শাসক। তার সঙ্গে মা হে মাঝে মাঝে মঙ্গোলদের সঙ্গে যুদ্ধেও গেছে। এভাবেই তার সঙ্গে একটা সৌহার্দ্য গড়ে ওঠে, যার জন্য রাজপুত্র রাজা হওয়ার পর এই বন্ধুর নতুন নাম দেয় ঝেং এবং তাকেই দায়িত্ব দেয় সমুদ্রযাত্রাগুলোর সর্বাধিনায়ক হওয়ার।
১৪০৫ সালে প্রথম যাত্রায় নতুন রং-করা তিনশো সতেরোটা চারশো-ফুটি জাহাজ চিনের নানজিং থেকে যাত্রা শুরু করল। আমরা যেমন দিক বোঝাতে বলি উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম, চিনারা বলে ডং-শি-নান-বেই, তবে এর ক্রম আলাদা। ডং-শি-নান-বেই হচ্ছে ক্রমান্বয়ে পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ-উত্তর। জিং মানে রাজধানী, অর্থাৎ নানজিং মানে দক্ষিণের রাজধানী, বেইজিং হচ্ছে উত্তরের। সাতাশ হাজারের বাহিনী এগিয়ে চলল ইয়াংসি নদীপথে, গিয়ে পড়ল পূর্ব চিন সাগরে, সেখান থেকে দক্ষিণ চিন সাগর। যবদ্বীপে নোঙর করলেও ঝেং হে মজাপহিতদের সঙ্গে কোনো সংঘর্ষে গেল না। তার এটা প্রথম সফর, এর মুখ্য উদ্দেশ্য এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্বন্ধে ঘোড়ার মুখের খবর জোগাড় করা।
এক একটা ঐ রকম বিশাল সাইজের জাহাজ আর ঐ রকম অতগুলো জাহাজ এদের সবাইকে ভড়কে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। শোনা গেল শ্রীবিজয়ে এক কুখ্যাত চিনা জলদস্যুদল সেখানকার মজাপহিত শাসককে উৎখাত করে রাজধানী প্যালমবং দখল করে নিয়েছে। ঝেং হে তাকেও উপেক্ষা করে সোজা চলে এল সিংহলে। কয়েকদিন সেখানে থেকে বুঝে নিল সিংহলের রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার। সেখান থেকে তার পরবর্তী গন্তব্যস্থল হল ভারতের পশ্চিম উপকূলের কালিকট বন্দর। ১৩৪১ সালে এক ভয়ঙ্কর বন্যায় সে অঞ্চলের প্রধান বন্দর মুজিরিস ধ্বংস হয়ে গেলে তার উত্তরে কালিকট হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিপণন-কেন্দ্র। কালিকটে নোঙর করে কয়েক মাস ধরে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করল। বিক্রি করল সঙ্গে নিয়ে-আসা রেশম ও চিনেমাটির দ্রব্যাদি, কিনে নিল পর্যাপ্ত গোলমরিচ, মুক্তো। জেনে নিল সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিও।
ফেরার পথে শ্রীবিজয়ের প্যালমবঙে চিনা জলদস্যুর জাহাজ গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানকার যোদ্ধাদের তুলে নিয়ে গেল নিজেদের জাহাজে। ফেরার পথে এক এক করে তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করে সমুদ্রে ফেলে দিল।
এই একখানা সামান্য মারামারি ছাড়া বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হল ঝেং হে-র প্রথম সফর। এবার থেকে তারা এই সমুদ্রযাত্রাকে কাজে লাগাবে অন্য উদ্দেশ্যে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এবং যে বন্দরেই তাদের জাহাজ নোঙর করুক, সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য হতে হবে তাদের নিয়মমাফিক। চিন এই ব্যাপারে কারও কথা শুনতে নারাজ। প্রয়োজন হলে সেখানকার শাসককে বদলে দেওয়া হবে। এই যেমন কালিকটে ট্যাঁ-ফো করছিল সেখানকার শাসক জামোরিন। এসব চিন বরদাস্ত করবে না। পরের সফরে এই জামোরিন যাতে বদলে যায়, সেটা নিশ্চিত করবে ঝেং হে-র সেনাবাহিনী।
কেরালার মাতৃতান্ত্রিক নায়ার-যোদ্ধারা নিজেদের বলে সমুদ্রের প্রভু – সামুদ্রিন। সেটাই চিনা ও অন্যান্য বিদেশিদের উচ্চারণে হয়ে গেছে জামোরিন। মুজিরিসে এরাই বন্দরের ক্রিয়াকলাপ দেখাশুনা করত, কালিকট বন্দরের সূচনাপর্ব থেকেই এর শাসক বিদেশী বণিকদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করে।
চিনারা কালিকটে বিশেষ সুবিধা করতে পারল না। বরং কালিকটের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দক্ষিণে এক শহরে তাদের প্রভাব বিস্তার করে চলল। চিনের প্রভাবে সেই শহরের নামই হয়ে উঠল – কোচিন।