তবে আমি যুধিষ্ঠিরকে যতটা বুঝেছি তিনি যদি কর্ণ বিষয়ে জানতে পারতেন, তবে অবশ্যই নিজে উদ্যোগী হয়ে কর্ণকে কুলে গ্রহণ করে রাজত্ব প্রদান করার জন্য প্রবীণ কৌরবদের বাধ্য করতেন। এ বিষয়ে যুদ্ধের প্রাক্কালে মাতা কুন্তি এবং কর্ণের গোপন সাক্ষাৎকার গূহ্য পুরুষের নিকট আমি শুনেছি। কিন্তু তাদের আলোচনার বিষয় আমি জানতে পারিনি। বলার মতো প্রয়োজনীয় সংবাদ থাকলে কর্ণ নিশ্চয়ই স্বয়ং আমাকে বলতেন। আমার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়াটা অশোভন হতো। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল অতি গভীর। আবার একথাও সত্য যে এরকম বিষয় সম্পর্কে আমাদের দুই পিতামহ মহর্ষি ব্যাস এবং দেবব্রত ভীষ্ম কিছুই জানবেন না! এটা একেবারেই অসম্ভব।
কর্ণ যদি কুন্তির কানীন পুত্র হয়, তার তো বিধিসম্মতভাবে পাণ্ডুরই পুত্র হবার কথা। কানীন পুত্র, ক্ষেত্রজ পুত্র ইত্যাদির প্রচলন, সমাজে ক্রমশ লয় প্রাপ্ত হচ্ছে এবং লোক নিন্দার কারণ হচ্ছে। কিন্তু কুন্তি তো শুনেছি, পাণ্ডুর আদেশে তিনজন পুত্রকে ক্ষেত্রজ প্রথায় ধারণ করেছিলেন এবং মাদ্রির যমজ পুত্রদ্বয়ের আয়োজন তিনিই করে দিয়েছিলেন। কর্ণ যদি তাঁর কানীন পুত্র হয়, সেকথা তিনি সেই সব আলোচনার প্রাক্কালেই পাণ্ডুকে বলেননি কেন? কিন্তু তাতে কি? কর্ণ আমার সখা, কারণ গুরু দ্রোণের শিষ্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ পরীক্ষাকালে হস্তিনাপুরের রঙ্গস্থলীতে প্রথম কর্ণের আবির্ভাব। লোকবার্তায় এই প্রতিযোগিতা বৃত্তান্ত অবগত হয়ে কর্ণ সেখানে উপস্থিত হলে আচার্য কৃপ তার কুলশীল বিষয়ে প্রশ্ন করেন। কারণ, একমাত্র ক্ষত্রিয় রাজকুমার ব্যতীত অন্য কেউ এই প্রতিযোগিতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার অধিকারী ছিল না।
এইসব প্রশ্নোত্তরের সময় অধিরথ সারথি সেখানে উপস্থিত হয়ে কর্ণকে তাঁর পুত্র বলে পরিচয় দেন। এ নিয়ে ভীম কুৎসিৎ কুটকাটব্য করলে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম এবং যেহেতু রাজা বা রাজপুত্র ছাড়া অন্য কোনো জাতির কেউ এই প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারবে না এরূপ নিয়মের কথা তখন কৃপাচার্য জানান, আমি সঙ্গেসঙ্গেই কর্ণকে অঙ্গ রাজ্যের অধীশ্বর রূপে বরণ করে নিই। তথাপি ভীম কুলশীল, জাতি বর্ণ, পিতৃ পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে অকারণ বিতণ্ডা চালিয়ে যেতে থাকলে আমি বলেছিলাম — ‘নদী, ঋষি এবং বীরপুরুষ ইত্যাদিদের উৎপত্তি জানা শক্ত। জল থেকে অগ্নির উৎপত্তি, দধীচির অস্থি দ্বারা ব্রজ নির্মিত হয়েছিল। জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত বলে, ভগবান (...?) আগ্নেয়, কার্তিকেয়, রৌদ্র, গাঙ্গেয় ইত্যাদি বলা হয়। বিশ্বামিত্র প্রমুখ ক্ষত্রিয়রা যে তপস্যা দ্বারা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছিলেন, তাও তোমার না জানবার কথা নয়। আচার্য দ্রোণ কলস থেকে উৎপন্ন। শরস্তম্ভ থেকে গৌতমের (কৃপ?) জন্ম। তাছাড়া তোমাদের জন্মবৃত্তান্তও আমার জানা আছে। এই ঘটনার পর থেকেই পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষবশত কর্নের সহিত আমার গভীর সখ্য হয়।
শরীরের সঙ্গে মন ওতপ্রোত। সর্বাঙ্গে অপরিসীম যন্ত্রণা। দেহে এমন কোনো স্থান নেই যা বেদনাবিহীন। দীর্ঘ অষ্টাদশ দিবস কঠিন যুদ্ধ করেছি একজন সাধারণ সৈনিকের নিষ্ঠায়। তার মধ্যে আজকে প্রভাত থেকে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত ভীমের সহিত আমার যে দ্বৈরথ যুদ্ধ(??) হয়েছে, সেটা অতি কষ্টসাধ্য এবং শ্রমসাপেক্ষ। গদাযুদ্ধে যদি আমি ভীমের মতো রীতি-বিরুদ্ধ যুদ্ধ করতাম, আমার নিপুণতায় তাকে ধরাশয়ী করতে আদৌ বিলম্ব হতো না। কিন্তু অন্যায় যুদ্ধ আমি যে করিনি, সর্বজনমান্য বলদেব তার উল্লেখ ক’রে ভীমকে তিরস্কার করেছেন। শুধু তিরস্কারই নয়, আমার প্রতি ভীমের অশ্রদ্ধা ও অবমাননামূলক আচরণে তিনি তাকে আক্রমণ করতে পর্যন্ত উদ্যোগী হয়েছিল। কৃষ্ণ তাকে সত্য মিথ্যা বুঝিয়ে নিরস্ত করলে, বলদেব বিরক্ত হয়ে দ্বারকায় প্রস্থান করেন।
এরকম শারীরিক এবং মানসিক অবস্থায় আমার ভাবনার সামঞ্জস্য আর বজায় থাকছে না। ক্রমশ আমার ভাবনার গতি এবং ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ভাবনা ক্রমশই বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গিয়ে বক্তব্য বিশৃঙ্খল হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি, সময় ফুরিয়ে আসছে। আঃ একটু জল! বড় পিপাসা! কিন্তু কে দেবে? আমি তো এখন চারদিকে মৃতদেহের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে আছি। কে আমার আর্তনাদে সাড়া দেবে? জলই বা কে দেবে? হায়! আমি প্রবল প্রতাপান্বিত মহারাজা দুর্যোধন। লক্ষ মানুষ যার সামান্যতম একটা অঙ্গুলিহেলনে যে কোনো প্রয়োজন মেটাতে পারত, সে এক গণ্ডুষ জলের জন্য কাতর!
যুদ্ধের নিয়মবন্ধে ছিল, অসুস্থ, আহত, বিশ্রামপ্রার্থীকে উপযুক্ত বিশ্রাম এবং শুশ্রুষার সযোগ দিতে হবে। শত্রু হলেও আহতাবস্থায় তাকে আঘাত করা অনৈতিক। এই প্রসঙ্গে যাদববীর সাত্যকির সহিত আমার দ্বৈরথ সমরের একটি বৃত্তান্ত আমার মনে পড়ছে। বহক্ষণ ধরে অসিযুদ্ধ করতে করতে আমার রণক্ষেত্রের এক নিরালা প্রান্তরে গিয়ে উপনীত হয়েছিলাম। স্থানটি ছিল ছায়া সুনিবিড় এবং অতি মনোরম। বহুক্ষণ অসিচালনায় আমরা উভয়েই ক্লান্ত এবং বিশ্রাম প্রত্যাশী হয়ে কোমল তৃণআস্তরণের উপর পাশাপাশি শয়ন করে, কখন যেন বিশ্রস্ত্র আলাপে মগ্ন হয়ে পড়লাম। সাত্যকি ছিল আমার কিশোরকালের অতি প্রিয় এবং ঘনিষ্ঠ সখা। কথা বলতে বলতে, কখন যেন আমরা অতীতের শত্রুতাবিহীন মধুর স্মৃতিতে নিমগ্ন হয়ে বর্তমানের তিক্ততা বিস্মৃত হয়ে পড়লাম।
সাত্যকি আমার একটা হাত তার হাতের মধ্যে গ্রহণ করে বলল, ‘সখে, এ আমরা কি করছি? আমাদের মধুর কৈশোরিক সুন্দর অনুভূতিগুলো কোথায় হারিয়ে গেল?’ আমি বলেছিলাম — ‘আমাদের ক্ষত্র ধর্মকে ধিক্। ধিক্ রাজশক্তির প্রলোভন, ধিক্, ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার দাম্ভিক প্রচেষ্টা। আজ দেখ, সাত্যকি আর দুর্যোধন - এই দুই প্রাণসখা পরস্পরের প্রাণ নিতে প্রত্যাশী।’ এই কথা শেষ হলে, সাত্যকি বিশ্রাম পরিত্যাগ করে অকস্মাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বলল, — ‘কিন্তু সখে, যুদ্ধ আরম্ভ না করা যদি বা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল, যুদ্ধ বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই। এসো, অসি গ্রহণ কর। যুদ্ধ চলুক।’ মুখে একথা বললেও সে শায়িত আমাকে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করল না। আমি ধীর ভাবে শয়ন ছেড়ে উঠে, তাকে আলিঙ্গন করতে সেও প্রতি আলিঙ্গন করে বলল, — ‘আজ আর যুদ্ধ হবে না।’ বলে বিপরীত দিকে চলতে শুরু করল। আমিও। অষ্টাদশ দিবসের যুদ্ধকালে আমরা দুজনেই বোধহয় এই একবারই অক্ষত্রোচিত তথা মানবোচিত আচরণ করেছিলাম।
এখন এই নির্জন প্রান্তরে যখন ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে, চারদিকে শৃগাল, কুক্কুর, নিশাচর গৃধ্রজাতীয় পক্ষী এবং নেকড়ে জাতীয় হিংস্র প্রাণী আমাকে বেষ্টন করে আছে, আমি প্রাণপণে আকাঙ্ক্ষা করছি শত্রু-মিত্র, যে কোনো একজন মানুষ আমার নিকট এসে দুদণ্ড বসুক। সে যদি আমার সারাজীবনের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যও আমাকে তিরস্কার বা সমালোচনাও করে, তাইই করুক। তবু কথা বলুক। আমি এই নৈসঙ্গ আর সহ্য করতে পারছি না। জ্ঞানত, আমি তথাকথিত ধর্মাচরণ, ঈশ্বরভজনা ইত্যাদির প্রতি আকর্ষিত বোধ করিনি কখনো। ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস বা অবিশ্বাস স্পষ্টভাবে কোনোটাই নেই। দার্শনিক প্রস্থানে আমি সাধারণজনের কল্যাণকামী এবং ইহজাগতিকতাবাদী। সে কারণেই বোধহয়, এত শারীরিক, মানসিক ক্লেশের মধ্যেও ঈশ্বরকে আহ্বান ক’রে বলছি না, আমাকে যন্ত্রণামুক্ত কর। কিন্তু তথাপি, নিজের প্রচেষ্টা ব্যতিরেকেই অন্তরের মধ্য থেকেই স্বতোৎসারিত হচ্ছে এক প্রার্থনা, — ‘হে হৃদিস্থিত দেবতা কেউ একজন আসুক, যে আমার সহিত কথা বলবে, অন্তত তিরস্কার, ভর্ৎসনা করবে বা যা কিছু। অথবা তার যেভাবে খুশি যন্ত্রণাই প্রদান করবে।
আশ্চর্য, সবার কাছে পরিচিত যে অভিমানী, ক্রোধন স্বভাব দাম্ভিক দুর্যোধন, তার এখন কোনো অভিমান, ক্রোধ বা দাম্ভিকতাই নেই। আমার এই বোধ, এই বিবেচনা যদি স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত, আজ এই অনর্থের সৃষ্টি হতনা। আজ আমি পরম ক্ষমতাশীল, পরম বৈরভাবমুক্ত মানুষ। কিন্তু আমি যে এরূপ ভাবনায় ভাবিত তার হেতু কি? এতো কোনোভাবেই আমার স্বভাব ধর্ম নয়। বোধহয়, মৃত্যু অতি সন্নিকট। হে হৃদিস্থিত দেব, একজন কেউ আসুক, যে আমার এই নিঃসীম নিঃসঙ্গতা দূর ক’রে আমাকে অন্তত মুহূর্তের স্বাভাবিকত্বে স্থিত করবে। সে যে কেউ হোক। এমন কি যদি আমাকে ভীমের নিকট ধরিয়ে দিয়েছে যে ব্যাধ সেও আসে, আমি তাকে বন্ধু ভাবেই গ্রহণ করব।
আমি তাকে বিশ্বাস ক’রেছিলাম। এইসব অনার্যজাতীয় জনেদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়তই ঘনিষ্ঠ ছিল। কৃষ্ণার্জুন, নিষ্ঠুর ভাবে খাণ্ডব দহনের প্রাক্কালে নির্মমভাবে ছিন্নমূল করেছিল, আমি তাদের পুনর্বাসনের আয়োজন করে দিয়েছিলাম। এই ব্যাধও তাদের একজন। কিন্তু সে লোভপরবশ ভীমের নিকট আমার সলিলাবাসের সন্ধান দেয়। সে ভীমের দৈনন্দিন আহারের জন্য মাংস সরবরাহকারী। অবশ্য ভীমই তাকে এই গুপ্তচর বৃত্তির জন্য নিযুক্ত করেছিল। কিন্তু আরণ্যক জাতীয়রা এরূপ লোভপরবশ হয়না। হয়তো, এজন্য সে তার গোষ্ঠীপতি তথা গোষ্ঠীর জনেদের নিকট চরম শাস্তিই ভোগ করবে। কিন্তু আমার বর্তমান মানসিকতায় আমি কারুরই অনিষ্ট, বিশেষ করে প্রাণহানি চাইনা। ‘সর্ব্বেসত্তা সুখীনো ভবন্তু’।
তাছাড়া, ব্যাধের লোভের জন্য নিন্দা করা আদৌ কি আমার শোভা পায়? আমার লোভের জন্যই তো এই মহাধ্বংসী যুদ্ধটা হল এবং দুই পক্ষে অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী প্রাণ বিনষ্ট হল। এই বিশ্বে লোভী কে নয়? সুতরাং ব্যাধকে দোষারোপ করে লাভ নেই। এই মুহূর্তে যদি সেই ব্যাধও এসে উপস্থিত হয়, আমি ভাগ্য বলে মানবো। ওঃ, এই নিঃসঙ্গতা কি মর্মান্তিক! ইতিপূর্বে আমি যে আত্মপক্ষ সমর্থনে অন্যদের সমালোচনা করছিলাম, তা সবটাই অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সর্ব অঘটনের জন্য আমিই দায়ী। আমার পরম শত্রু যে ভীম, সেও আমার সব অনাচার ভুলে গিয়ে যুদ্ধ পরিহার করতে বলেছিল। অহংকারমত্ত আমি ভেবেছি, আমার বিপুল সৈন্য সংগ্রহ দেখে ভীত হয়েই এরা সেসব কথা বলছে। একমাত্র কর্ণ ব্যতিত অন্য কেউই আমার যুদ্ধ কামনাকে সার্বিকভাবে সমর্থন করেনি। কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর করে দিয়ে আমি তাকে চির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছিলাম। অবশ্য তাছাড়াও, তার যুদ্ধের জন্য উদগ্র স্পৃহার অন্য কারণও ছিল। ধনুর্যোদ্ধারূপে অর্জুনের প্রতি তার স্পর্ধা ছিল অপরিসীম। আমিও অর্জুনের প্রতিযোদ্ধাকল্পে কর্ণকে সর্বাধিক ভরসা করেছিলাম।
একথা ঠিক কর্ণকে কৃষ্ণের কুপরামর্শে, তার রথচক্র মাটিতে প্রোথিত হবার এবং সেই রথ উদ্ধার করার প্রচেষ্টার অবসরে অর্জুন নিহত করে। নচেৎ ন্যায় যুদ্ধে কর্ণকে অর্জুন সহজে নিপাতিত করতে পারত না। এছাড়াও কর্ণের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র ছিল। শল্যকে আমি আবেদন করেছিলাম কর্ণের সারথ্য করতে। শল্য পাণ্ডবদের মাতুল। পাণ্ডবেরা সেই সুযোগ গ্রহণ করে শল্যকে দিয়ে কর্ণের অপ্রীতিকর বাক্য দ্বারা, তার তেজোহানি ঘটায়। কর্ণের রথচক্র মৃত্তিকায় প্রোথিত হওয়ার বিষয়টার জন্যও সম্ভবত শল্য দায়ী। আমি যত অপরাধেই অপরাধী হই না কেন, আমার পক্ষের ভিতর এবং অপরপক্ষের দিক থেকে প্রভূত ষড়যন্ত্র যে করা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেনাপতি কল্পে ভীষ্ম শুধু দৈনিক দশ হাজার সৈন্য বিনাশ ব্যতিত আর কিছুই করেননি। কোনো মহারথীকে তিনি নিপাত করেননি। অবশেষে প্রতিজ্ঞার নামে তিনি তো বানবর্ষণই বন্ধ করে শরীর পেতে অর্জুনের শরসমূহ গ্রহণ করলেন, যতক্ষণ না তিনি রথ থেকে ভূতলে পতিত হলেন। তিনি বলেই দিয়েছিলেন পাণ্ডবদের উপর তিনি অস্ত্রাঘাত করবেন না। গুরু দ্রোণের কথাতো পূর্বেই বলেছি। আসলে ভীষ্ম এবং দ্রোণ উভয়েই অতি বাধক্যের জন্য জীবনের প্রতি বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছিলেন। সে কারণে উপযুক্ত যুদ্ধ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি বলেই মনে হয়।
মাতা গান্ধারি আমাকে যুদ্ধারম্ভের পূর্বে যা বলেছিলেন, তা যথার্থ ভাবেই অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। তথাপি আমার প্রকৃত চেতনার উদয় হয়নি। পূর্বে আমি আমার নিজস্ব দোষত্রুটি সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না এমন নয়। তবে প্রথম থেকেই আমি পাণ্ডবদের যে পরিমাণ নির্যাতন করেছি। পরে আমি নিরস্ত হলেও এবং পাণ্ডবদের অর্ধরাজ্য প্রদান করলেও তারা যে তাতে সন্তুষ্ট হয়ে সব কিছু ভুলে গিয়ে আমার প্রতি প্রসন্ন থাকত, এমত বিশ্বাস আমার ছিল না। উপরন্তু কৃষ্ণের অকল্পনীয় কূট পরামর্শে আমার রাজ্যাংশও তারা গ্রাস করত। কৌরব সভায় তার দৌত্যকালে যদি আমি কৃষ্ণের শর্ত অনুসারে পাঁচখানি গ্রাম পাণ্ডবদের দিতাম, তার সাহায্যেই তারা, কৃষ্ণের সহায়তায় সমগ্র কৌরব রাজত্ব গ্রাস করে নিত। যাদব এবং পাঞ্চালরা পাণ্ডবদের একান্ত সহায় ছিল।
শুধুমাত্র খাণ্ডব প্রস্থের মতো একটি ভগ্ন-অট্টালিকা এবং সংলগ্ন খাণ্ডব অরণ্যকে সম্বল করে তারা যে সম্পদ আহরণ করে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরীর পত্তন করেছে, তাতে গোটা কুরুরাজ্য হাতে পেলে তো তারা সম্পূর্ণ আর্যাবর্ত অধিকার করত। কৃষ্ণ তথা যাদব ও পাঞ্চাল গণতো তাইই চেয়েছিল। আর্যাবর্তকে একটা একক ধর্মরাজ্যে পরিণত করে নিজের বাসুদেবত্ব প্রতিষ্ঠাই কৃষ্ণের কাম্য ছিল। কূট রণনৈতিক কৌশলে সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতা একচ্ছত্ররূপে অধিকার করার জন্য পাণ্ডবদের সহায়তা কৃষ্ণের প্রয়োজন ছিল। কৃষ্ণ, তার ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতার কারণে যাদব অভিজাততন্ত্রের রাজা অথবা সামন্তপ্রধান হওয়ার কথা ভাবেনি। এমন কি সম্রাটপদও তার আকাঙ্খার বস্তু ছিল না। সে নিজের চারদিকে এমন একটা মুগ্ধ লোকবলয় সৃষ্টি করেছিল যে তারা তাকে ঈশ্বর রূপে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। সে স্বমুখে অবশ্য কখনোই এমন দাবি করেনি। মহর্ষি বেদব্যাস, পিতামহ ভীষ্ম, বিদুর, পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতা, এঁরা সকলেই তাকে ঈশ্বর বলে, জগৎ কারণ বলে প্রচার করেছেন। কিন্তু আমার একটাই প্রশ্ন, ঈশ্বরই যদি কেউ হয়, সে এত পক্ষপাতদুষ্ট অথবা কূটবুদ্ধি সম্পন্ন হয় কি করে? তার ইচ্ছা মাত্রেই সব অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে সব কিছুই মঙ্গলময় হত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতো এমন ঘোর অমঙ্গলময় ঘটনা তো সে তার ঐশী ক্ষমতায় বা ইচ্ছামাত্রেই বন্ধ করে দিতে পারত। তা না করে, এই বিপুল লোকক্ষয়ের দায় সে একমাত্র আমার উপরই চাপিয়ে দিল কেন? কিংবা যদি আমিই এসবের জন্য দায়ি হই, আমার মনে এই অধর্মের বীজ সঞ্চার করার দায় কি সেই ঈশ্বরের উপরই বর্তায় না? যে রিপু সমূহের জন্য আমা হেন ব্যক্তিরা মূর্তিমান অমঙ্গলরূপে ঘোষিত, সেইসব রিপু সমূহের স্রষ্টা কে? এমন কোনো তত্ত্ব আছে কি, সব মঙ্গল ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন, আর সব অমঙ্গল অন্য কেউ?
অথবা, মঙ্গল এবং অমঙ্গলের এই ধারণা কে সৃষ্টি করেছে, যখন একমাত্র ঈশ্বরই সর্বসৃষ্টির মূলাধার বলে কথিত? বরং এসব বাদ দিয়ে আমরা কালতত্ত্বের বিবর্তনকে গ্রাহ্য বলে গ্রহণ করতে পারি। কালই সকল সৃষ্টির এবং ধ্বংসের পরম কারণ, এই সত্যই চরম সত্য বলে মনে হয়। কালই আমাকে নির্মাণ করেছিল, এখন কালই তার বিলয় ঘটাচ্ছে। এখানে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা আছে বলে আমি মনে করি না। অথবা ঈশ্বরের প্রয়োজনই বা কি? সখা চার্বাক বলে, ‘ঈশ্বরেআসদ্ধে প্রামাণাভাবাৎ’। অবশ্য ঈশ্বরবাদিরা এর প্রতিযুক্তিও উপস্থিত করে থাকেন। তবে এক্ষনে এরূপ যুক্তি তর্কের প্রয়োজনই বা কি?
চার্বাক বলেছিলেন, — ‘রাজন, তথাপি মানুষ ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে, কারণ, মহাশক্তিধর কালের হাতের সে ক্রীড়নক, দুর্বল, রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু, ব্যাধির প্রকোপে সে সদা কাতর। চতুর ব্রাহ্মণেরা মানুষের এই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তাকে শোষণ করে। মিথ্যে প্রলোভনে বিভিন্ন আচার অভিচারে-ভুলিয়ে রাখতে চায়। এছাড়াও, এইসব আনুষ্ঠানিকতায় মানুষ সাময়িক ভাবে হলেও মিথ্যে সান্ত্বনা পায়।’
চার্বাকের কথায় আমার মনের অনেক দুর্বলতা দূর হয়েছিল। কিন্তু আজ এখন এই নিঃসীম নৈসঙ্গে মনে হচ্ছে ঈশ্বর বলে সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বকল্যাণকর কেউ একজন থাকলে বেশ হত। এই অন্তিম মুহূর্তে একজন নির্ভরতার সঙ্গী পেতাম। হায়! আজ তো কেউই আমার কাছে নেই। আমি একেবারেই ভীষণ একা। আমি অজস্র মনুষ্যঘাতি কুল পাংশুল। আমার নরক যন্ত্রণা আমি ইহলোকেই ভোগ করছি। হে ব্যাধ, তুমি সঠিক কার্যই করেছ। এছাড়া আমার আর অন্য শাস্তি কিছুই হতে পারত না।
আমার দ্বারা অনুষ্ঠিত সবচেয়ে অন্যায্য এবং অপরাধমূলক কার্য হচ্ছে, দ্যূত সভায় দ্রৌপদির লাঞ্ছনা। এই কাজটি একান্তই কাপুরুষোচিত এবং বর্বরতাপ্রযুক্ত ছিল। বহু প্রাচীনকাল থেকে এই দ্যূত ক্রিড়া অত্যন্ত নিন্দিত এক বিনোদন। মদ্যাদির প্রভাবে মানুষ যতটা বোধশূন্য হয় সে সবের মধ্যে শতগুণ বেশি দূষণীয় এক বিনোদন। রাজাদের দুইটি ব্যসন তাঁদের জন্য অহিত আনয়ন করে — তার মধ্যে একটি এই দ্যূতক্রীড়া, অপরটি মৃগয়া। এসব এমনভাবে মানুষদের মধ্যে উত্তেজনা তথা নেশার্ততার সৃষ্টি করে যে, তারা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনে।
অগ্রজ যুধিষ্ঠিরের এই ক্রীড়ার প্রতি দুর্বলতার কথা আমার এবং বিশেষ করে মাতুল শকুনি ও কর্ণের জানা ছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠির আদৌ এই পাশ-ক্রিয়ায় দক্ষ ছিলেন না। একথা সত্য, রাজ্য এবং ধনবৈভবাদি জিতে নেওয়ার অভীপ্সায় আমরা চক্রান্ত করে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বাধ্য করেছিলাম যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণমূলক এক প্রতিযোগিতায় যোগদান করতে। যুধিষ্ঠির সহজেই রাজি হয়েছিলেন। পিতা প্রবীণ কৌরবদের কথায় প্রথমে আপত্তি করলেও আমাদের আগ্রহে শেষপর্যন্ত যথেষ্টই উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন।
কিন্তু যুধিষ্ঠির এই প্রমোদে এতই আত্মহারা তথা উন্মত্ত হলেন যে আমাদের অকল্পনীয় ফললাভ হল। এবং তা শুধু একবারের প্রতিযোগিতায় নয়। প্রথমবারের পরাজয়ে সব সম্পদ হারিয়ে সভাস্পদের/সভাসদ্দের (??) অনুরোধে মহারাজ তাদের সব সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার বর দেন। তারপর কি হয়েছিল, কিভাবে যুধিষ্ঠির দ্বিতীয় বারের প্রতিযোগিতায় আবার সর্বস্ব হারালেন এবং বারো বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাত বাসের শর্তে মেনে নেন। এসবই আমার স্বার্থের অনুকূলেই ছিল। কিন্তু কর্ণ এবং দুঃশাসনের প্রমত্ততার জন্য দ্রৌপদির লাঞ্ছনার আয়োজন অবধার্য হলে আমার পক্ষীয় যারা, তারা সবাই অশ্লীলতায় মেতে উঠল এবং সঙ্গে অতিমাত্রায় দুঃশাসন, কর্ণ এবং আমিও। হ্যাঁ, আমি, মহারাজ দুর্যোধন। আসলে আমরা, যেহেতু দ্রৌপদি পঞ্চ-ভর্তৃকা, সে কারণে তাঁকে গণিকার অধিক জ্ঞান করিনি। দুঃশাসন তাঁকে নির্বস্ত্রা করার কুরঙ্গে মেতেছে কর্ণ এবং আমারই সম্মতিতে। উন্মুক্ত সভাস্থলে বাম উরু প্রদর্শন করে আমি কুৎসিৎভাবে তাঁকে সেখানে উপবেশন করার আহ্বান জানিয়েছি। আমি জানি, দ্রৌপদির উপর কর্ণের লোভ এবং রুদ্ধ অভিমান ছিল। সুতরাং সুযোগ পেয়ে সে তাঁকে লোভের দৃষ্টিতে দেখতে পারে, যদিও তা অভব্য এবং অশালীন। কিন্তু আমি? আমি তো একমাত্র কলিঙ্গ রাজপুত্রীকে তাঁর স্বয়ম্বর সভা থেকে বলপূর্বক এনে বিবাহ করে একমাত্র তাঁকেই কামনা করেছি। এ বিষয়ে আমি তো এখানে একমাত্র ব্যতিক্রমী পুরুষ। তাহলে, আমি কেন ইদৃশ আচরণ করলাম! আমার মহিষী কলিঙ্গ রাজকুমারী, পরে আমাকে বলেছিলেন, — ‘মহারাজ, আপনি আমার চিরকালীন অহংকারের অবমাননা করেছেন। আমি আপনার একমাত্র ভার্যা ছিলাম এবং আপনাকে একপত্নী অনুরক্ত বলেই জানতাম। কিন্তু হায়!
দীর্ঘসময় কর্তিত পুচ্ছ ভুজঙ্গের মতো অবস্থান করে আমার দেহ আর এই ক্লেশ বহন করতে পারছিল না। সামান্য দূরত্বে একটি খণ্ডিত বৃক্ষ কাণ্ড পড়েছিল। বড়ই আকাঙ্ক্ষা বোধ করছিলাম যদি সেটির সহিত পৃষ্ঠ রক্ষা করে খানিক অবস্থান করতে পারতাম! দুই হাতের সাহায্যে অতি ক্লেশে এবং বহু সময় ব্যয়িত করে সেই অবস্থান লাভ করে কিছু আরাম অনুভব হল। এখন হয়তো আরও খানিক্ষণ, আরও অনেক খানিক্ষণ বেঁচে থাকা সম্ভব হবে। অবশ্য তা এই সামান্য আয়াসটুকুর জন্যই শুধু মনে হচ্ছে। কতক্ষণ এই অবস্থা স্থায়ী হবে, জানিনা। এখন আমার চাই একজন অন্তত কথা বলার সঙ্গী। কি অসহ্য যে এই নৈঃশব্দ্য এবং নিঃসঙ্গতা! মনে হচ্ছিল যেন সহস্র বৎসর ধরে এমত অবস্থানে আছি।
নীতি এবং বিধি অনুসারে, আমি যতই দোষে দুষ্ট হই, আমার এই অবস্থায় প্রাপ্য ছিল উপযুক্ত শুশ্রূষা এবং চিকিৎসা। কিন্তু না কৃষ্ণ, না পাণ্ডবগণ, কেউ তা বিচার করেনি। যুধিষ্ঠির এখন সর্বার্থে রাজা। সুতরাং যুদ্ধবন্দীরূপে আমার সেবা, সংরক্ষণ এবং চিকিৎসার দায়িত্ব ছিল তাঁরই। আমি যদি যুদ্ধে নিহত হতাম, তাহলে তাদের একমাত্র কর্তব্য ছিল আমার দেহের অগ্নিসৎকার ইত্যাদি করা। কিন্তু আমি যে আহত, মুমূর্ষু। আমাকে এরকম অবস্থায় ফেলে তাঁদের চলে যাওয়া তো রাজধর্ম নয়। বিশেষত, যুদ্ধারম্ভে তো এই নীতি নিয়ম ধার্য হয়েছিল।
যুদ্ধারম্ভের আগেই, আমরা উভয় পক্ষই পারস্পরিক সিদ্ধান্তে পক্ষাপক্ষ নির্বিশেষে সেবা-শুশ্রূষা পাওয়ার জন্য বৈদ্যক এবং চিকিৎসকদের ব্যাপক একটি বস্ত্রাবাস স্থাপন করেছিলাম। পিতামহ মহর্ষি ব্যাস এবং পিতামহ ভীষ্ম উভয়েই বলেছিলেন, — ‘বৎসগণ, আহতদের কোনো পক্ষ হয় না। আহত মাত্রেই চিকিৎসা এবং শুশ্রূষা পাওয়ার অধিকারী।’ সেই অনুসারে সব আহতরাই ওই আরোগ্যশালায় চিকিৎসিত হয়েছে। আমি স্বয়ং যুদ্ধের ব্যস্ততার মধ্যেও গূঢ় পুরুষদের নিকট থেকে এ বিষয়ে সংবাদাদি গ্রহণ করেছি। আমি জানিনা, এখনও সেখানে সেই কর্মতৎপরতা আছে কিনা। এরকম তো হতে পারে না যে উভয় পক্ষের সমুদয় সৈন্য শুধু মৃত্যুই বরণ করেছে, আহত অবস্থায় চিকিৎসিত হয়নি। আমি না হয় পরাজিত হয়েছি, কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবেরা কি কর্তব্য পালন করছে? তারা কি এ বিষয়ে আদৌ সচেতন আছে? সম্ভবত নেই। আমি প্রতিপক্ষীয় প্রধান যখন মুমূর্ষু অবস্থায় অবহেলিত পড়ে আছি, সাধারণ আহত সৈনিকদের তখন কি অবস্থা তাতো সহজেই অনুমেয়। ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের অনেক কিছুই, হয়তো বা বেশিটাই নিন্দনীয়। কিন্তু কিছুতো নিয়মও বিধিবন্ধের ব্যাপার আছে, সেসব পালন করা তো ক্ষাত্রধর্মই। কৃষ্ণ এই যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ আখ্যা দিয়ে আসছে, যুধিষ্ঠির অসামান্য ধর্মবৎসল বলে প্রশংসিত। এই কি তার পরিচয়? দূরে একটি মশাল বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মনে হয় আমার দিকেই আসছে। অশ্বত্থামাদের প্রত্যাগমনের এখনও বিলম্ব আছে। তবে কি পাণ্ডব পক্ষের কেউ আমাকে হত্যার বাকি কার্যটুকু সম্পন্ন করতে আসছে? তা হোক, তবুতো জীবিত কেউ আসছে।
এই সঙ্গে মনে একটু প্রফুল্লতারও যেন উদ্ভব হচ্ছে? যদি সেই ব্যাধ, যে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিল, সে হয়? তার গ্রাম তো এখান থেকে খুব দূরবর্তী নয়। হয়তো, আমার বর্তমান অবস্থার কথা জেনে তার অনুতাপ হচ্ছে এবং দুঃখ প্রকাশ করার ইচ্ছায় আমার সন্ধান করছে। হতে তো পারে। তবে যাই হোক্, যেই আসুক কিছু কথা তো বলা যাবে? যদি কোনো ঘাতকও হয়, তাতেই বা কি, আমার এমনিতেই তো সময় ফুরিয়ে আসছে অনুভব করছি। শুধু সেক্ষেত্রে তাকে বলব, — ‘হে ঘাতক, আমি প্রস্তুত। শুধু দুদণ্ড তুমি আমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ বার্তালাপ কর। আমি নিঃসঙ্গতাটা থেকে খানিক মুক্ত হই। তারপর চির-নৈশব্দ্যে অবগাহন করতে আমার ক্লেশ হবে না।
আলোক বিন্দু ক্রমশ নিকটবর্তী হয়ে পূর্ণ মশালে পরিণত হল। সেই আলোকে দেখলাম, আমাদের পরম প্রিয় সঞ্জয় সম্মুখে দণ্ডায়মান। সে সর্বাঙ্গে ক্ষতবিক্ষত। রুধিরাক্ত। মনে হচ্ছে, কেউ তাকে যথেচ্ছ প্রহারে লাঞ্ছিত করেছে। সম্মুখে উপবেশন করে, সঞ্জয় বলল, — ‘হায়, মহারাজ, এও আমাকে দেখতে হল? এগারো অক্ষৌহিনী চতুর্বল শক্তির অধিকারী কুরুরাজ দুর্যোধনের এই পরিণতি দেখে আমার অশ্রু বাঁধ মানছে না।’ আমি সঞ্জয়কে এই সময়ে, এই অবস্থায় পেয়ে যুগপৎ হর্ষিত এবং বিষাদিত বোধ করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, — ‘তুমি কি কোনো যুদ্ধস্থল থেকে এসেছ? তুমি কি কোনো ব্যক্তির আক্রমণ থেকে প্রহৃত হয়ে পালিয়ে এলে? কিন্তু তুমি তো যুদ্ধে যোগদানকারী ছিলে না। তোমার এ অবস্থা কে করল? তুমি এখানে উপবেশন কর। তোমার সহিত আমি একটু কথাবার্তা বলে খানিক স্বস্তি লাভ করি। আমি এই অবস্থায় সুদীর্ঘ সময় কর্তিত-পুচ্ছ ভুজঙ্গের মতো অবস্থান নিয়ে ছিলাম। পরে অতি ক্লেশে আমি এই দারুখণ্ডে পৃষ্ঠ রক্ষা করে খানিক স্বস্তির স্বাদ পাচ্ছি, যদিও বুঝতে পারছি, আমার আর অধিকক্ষণ আয়ু বাকি নেই। আচার্য কৃপ, অশ্বত্থামা, কৃতবর্মা এবং আমি এই চারজন, যুদ্ধশেষে জীবিত আছি। তার মধ্যে আমার উরুদ্বয় এবং কটি-সন্ধি চূর্ন। ওই তিন বীর পাণ্ডব এবং পাঞ্চাল শিবিরে এক নৈশ আক্রমণে তাদের নিধন করার শপথ নিয়ে গিয়েছে। অশ্বত্থামাকে আমি এই যুদ্ধের সেনাপতি পদে বরণ করেছি।’
সঞ্জয় বলল, — ‘মহারাজ, আবার বোধহয় আমারা নতুন একটা প্রাপ্তির(??) ভ্রান্তির শিকার হলাম। যদিও আমাদের দিক থেকে আর হারাবার কিছু নেই, তথাপি আমার মনে হচ্ছে, এক মহা বিপর্যয় আসন্ন। এই যুদ্ধ অত্যন্ত অন্যায় যুদ্ধ, এতে কারোরই কল্যাণ নেই। যখন যুদ্ধের অবসান হয়েছে তখন আর লোকক্ষয়ের প্রয়োজন কি? তা যে পক্ষেরই হোক। মহারাজ, দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়, যখন উভয় পক্ষেরই কিছু লাভের প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু এই যুদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষেরই সব প্রত্যাশার অন্ত হয়েছে। যারা তথাকথিত বিজয়ী তারাও রিক্ত এবং শূন্য, বিজিতদের তো কথাই নেই। তাহলে অশ্বত্থামা কেমন সেনাপতি যে সেনাহীন, অস্ত্র-বর্মহীন, রথ, অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি বিহিণ অবস্থায়, মাত্র দুইজন সহযোগী নিয়ে চৌরবৎ ব্যক্তি বিনাশে তৎপর হল? এতো যুদ্ধ নয়, ব্যক্তিহত্যা। একজন আততায়ীকে তো যোদ্ধা বা বীর আখ্যা দেওয়া যায় না। কৃতবর্মা যাদব ক্ষত্রিয় এবং ন্যায়, অন্যায় সব রকম যুদ্ধই তার জাতি-কর্ম। কিন্তু আচার্য কৃপ তো বয়সে অতি প্রাচীন এবং শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি কেন আপনাকে উপযুক্ত পরামর্শ দিলেন না? অশ্বত্থামা না হয় পিতৃশোকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়েছেন এবং দুর্দমনীয় প্রতিহিংসা বোধের শিকার হয়েছেন। কিন্তু হায়! এখন তো আর কিছুই করার নেই।’
একসঙ্গে অনেক কথা বলার জন্য ক্লান্ত সঞ্জয়, দুই হস্তে মুখমণ্ডল আবৃত ক’রে পরম হতাশায় রোদন করতে লাগলেন। তাকে বললাম, — ‘সঞ্জয় রোদন সম্বরণ কর। এসো, যতক্ষণ ওরা ফিরে না আসে, অথবা যতক্ষণ পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণ চেতনা-রহিত না হচ্ছি, ততক্ষণ আমরা তোমার বৃত্তান্ত এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলি। বল, তুমি কিভাবে এতটা আহত হলে?’ সঞ্জয় বলল, — ‘মহারাজ, এই মহাযুদ্ধে মহর্ষি বেদব্যাসের আজ্ঞায়, আমি যুদ্ধ বিষয়ে তাবৎ সংবাদ সংগ্রহ কার্যে লিপ্ত ছিলাম। কখনো কখনো আপনার পিতা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে সংবাদ সরবরাহ করার জন্যও আমাকে ঋষি আদেশ করেছিলেন। এই কার্যে অসংখ্য সংবাদ কমিককেও ঋষি নিযুক্ত করেছিলেন। এই স্যমন্তপঞ্চকেরই যুদ্ধস্থল ব্যতিরেকি একটি প্রান্তে আমাদের বস্ত্রাবাসের কর্মস্থল উভয় পক্ষেরই রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় করা হয়েছে। মহারাজ, ঋষি আমাকে এই সব সংবাদ লিপিবদ্ধ করে যে কোনো পরিস্থিতিতে সংরক্ষণের আদেশ করেছেন। তাঁর অভীপ্সা, যুদ্ধ শেষ হলে, এই সমুদয় কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি একখানি ইতিহাস-কাব্য রচনা করবেন ভবিষ্যৎ মানব সমাজের হিতার্থে। এ যেন এক ভিন্ন মহাযুদ্ধ। ঋষি বলেছেন, আমি যেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতশূন্য এবং নির্মোহচিত্তে এই কার্য নির্বাহ করি।
সেভাবেই কাজ হচ্ছিল। ইতোমধ্যে সংবাদ পেলাম আপনি মধ্যম পাণ্ডব ভীমের সঙ্গে গদাযুদ্ধের সময় তাঁর অন্যায় আঘাতে ভগ্নোরু হয়ে রণশয্যা লাভ করেছেন। এই সংবাদে ধৈর্য চ্যূত এবং হতাশ হয়ে, আমি অসিচর্মে সজ্জিত হয়ে পাণ্ডব পক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়েছিলাম। সাত্যকি এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন তখন আমাকে বন্দী ক’রে প্রচণ্ড প্রহার করে হত্যার উদ্যোগ করলে, সংবাদবহদের মুখে বার্তা শুনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে মহর্ষি আমাকে রক্ষা করেন। সাত্যকি এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে মহারাজ যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন মহর্ষি ব্যাস না আসা পর্যন্ত তাদের নিবৃত্ত রেখেছিলেন। যাই হোক্, আমি প্রহৃত এবং রক্তাক্ত বটে, কিন্তু গভীরভাবে আহত নই। কিন্তু মহারাজ, শত্রুপক্ষ নাহয় আপনাকে বৈদ্যক এবং শল্যবিদ্গণের আরোগ্যশালার বস্ত্রাবাসে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেনি, এই তিন বীর কি সেই কর্মটি করতে পারত না? তারা সকলে কি ধরেই নিয়েছিল যে আপনার আরোগ্যের কোনো আশাই নেই। কিন্তু এতো সম্পূর্ণ অমনুষ্যোচিত কাজ। জন্মমৃত্যু কালের নিদান, কিন্তু রুগ্ন, আহত মানুষের চিকিৎসা তথা শুশ্রূষার ব্যবস্থা করা তো শত্রুমিত্র সকলেরই ধর্ম।’
বললাম, — ‘সঞ্জয়, বহুভাগ্যে এই অন্তিম অবস্থায় তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে আমি পরম সন্তোষ লাভ করেছি। ধন্য মনে করছি। সুদীর্ঘ সময় ধরে আমি শুধুই অতীত কর্ম বিষয়ে অক্ষম(??) ভাবনায় নিমজ্জিত ছিলাম। শৈশব, কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত আমার জীবনে যত ঘটনা ঘটেছে, সব যেন নীলাকাশে উড্ডীয়মান কখনো শুভ্র কখনো কৃষ্ণ বর্ণের মেঘের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। কারোর সহিত বাক্যালাপের উপায় ছিল না। সবাই এই প্রান্তরে আমাকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় রেখে চলে গেছে। শুধু আচার্য কৃপ একটি জনপূর্ণ কলসি এবং একটি পান পাত্র পাশে স্থাপন করে রেখেছিলেন। নচেৎ জলও পেতাম না। গুরুপুত্র মহাবীর, কিন্তু সে সদাই প্রাণভয়ে ভীত। প্রতি মুহূর্তেই সে ভাবছিল, — এই বুঝি ভীম বা অর্জুন এসে তাকে হত্যা করে।
আমি অশ্বত্থামার উত্তেজক বাগ্মীতায় নির্বাণপূর্বের প্রদীপ শিখার মতো জ্বলে উঠেছিলাম। বস্তুত, তখন পূর্বাপর কিছুই চিন্তা করার মতো বিবেচনাশক্তি আমার ছিল না। আমি উত্তেজনা বশে তাকে সৈনাপত্যে অভিষেক ক’রে নৈশ সমরে যাবার অনুমতি দিলাম। তাঁরা চলে গেলে পরে আমার পশ্চাতাপ আমাকে দগ্ধ করতে থাকল এবং সেই সঙ্গে এই প্রায় অনন্ত নিঃসঙ্গতা তথা বাক্বিহীনতা। সঞ্জয়, এর চাইতে কঠিনতর নারকীয়তা আর কি হতে পারে? কিন্তু এই বৃথা প্রসঙ্গ থাক। তুমি আমাকে একটা বিষয় আনুপূর্ব বল। অবশ্য, এখন আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। তথাপি কিছুটা হলেও যেটুকু প্রাণশক্তি এবং চিন্তন ক্ষমতা এখনও রয়েছে, আমার কৌতূহল হচ্ছে একটা বিষয়ে বিশদ জানার। তা হচ্ছে, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক উপপ্লব্য নগরে দ্যূতরূপে তোমার যাওয়া এবং পাঞ্চাল, পাণ্ডব এবং যাদব, এই ত্রিশক্তির সহিত তোমার বাক্-বিনিময়। আমি জানতে চাই, কে বা কারা পাণ্ডবদের যুদ্ধে প্রলুব্ধ করেছিল। সঞ্জয়, আমার অবিমৃষ্যতা আমি জানি, সুতরাং সেকথার উপস্থাপনা চর্বিত চর্বণ হবে। তুমি বরং সে দিনের তোমার ভূমিকা এবং পাণ্ডব পক্ষীয়দের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য বিবৃত কর। আমি তো এই বিষয়টায় আদৌ জড়িত ছিলাম না। তাই তোমার মুখে শুনতে চাই।’
সঞ্জয় বলতে লাগল, — ‘রাজন, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট শান্তি প্রস্তাব নিয়ে উপপ্লব্য নগরে গিয়েছিলাম। যুধিষ্ঠির যথোচিত শিষ্টাচার সহকারে আমাকে গ্রহণ করে প্রথমে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন, —; “সঞ্জয়, দীর্ঘকাল পরে কুরু বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কুশল শুনে এবং তোমাকে সাক্ষাৎ দেখে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ জেষ্ঠতাতকেই প্রত্যক্ষ করছি।” এর পর তিনি সবারই কুশল সংবাদ নিলেন। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, — মহারাজ যুধিষ্ঠির, মহারাজ দুর্যোধনের কাছে সাধু-স্বভাব বৃদ্ধগণ আছেন, আবার পাপাত্মারাও আছে। আপনারা তাঁর কোনো অনিষ্ট করেননি, তথাপি তিনি আপনাদের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত আছেন। অন্ধরাজা যুদ্ধ অনুমোদন করেন না, তাই তিনিই আমাকে শান্তির বার্তা দিয়ে আপনার স্বকাশে পাঠিয়েছেন। মহারাজ, তিনি অত্যন্ত মনস্তাপে আছেন। সব পাপ অপেক্ষা মিত্রদ্রোহ গুরুতর একথা তিনি ব্রাহ্মণদের নিকট শুনেছেন। অজাতশত্রু, আমি ধৃতরাষ্ট্রের মুখপাত্ররূপে আপনাকে বলশি, আপনি আপনার অসাধারণ বুদ্ধিবলে শান্তির উপায় স্থির করুন। আপনারা পঞ্চভ্রাতা দেবতুল্য শক্তিধর। ভোগের নিমিত্ত আপনারা নিশ্চয়ই ধর্মত্যাগ করবেন না। মহারাজ, ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ আপনাদের জ্ঞাতি, জ্ঞাতি যুদ্ধ অধর্ম। সেই অধর্ম থেকে আপনি নিবৃত হোন।
যুধিষ্ঠির বললেন, — “এই সভায় আমাদের সবাই উপস্থিত আছেন, ধৃতরাষ্ট্র যা বলেছেন, তুমি তাই বল।” সভায় পঞ্চপাণ্ডব, বাসুদেব কৃষ্ণ, সাত্যকি চেকিতান, বিরাট, পাঞ্চালরাজ ও ধৃষ্টদ্যুম্ন — সকলকেই উদ্দেশ্য ক’রে আমি বললাম, ‘রাজা ধৃতরাষ্ট্র শান্তির প্রশংসা করে আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন। মহাবলশালী পাণ্ডবগণ, কোনো হীন কর্ম করা আপনাদের উচিত নয়, শ্বেত বস্ত্রে কজ্জল বিন্দুর ন্যায় সেই পাপ যেন আপনাদের স্পর্শ না করে। কৌরবদের যদি যুদ্ধে বিনষ্ট করেন, তবে জ্ঞাতিবধের পাপ আপনাদের আশ্রয় করবে। উপস্থিত মহাবীরগণ যাঁদের সহায়, তাদের কে জয় করতে পারে? আবার দ্রোণ, ভীষ্ম, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ প্রভৃতি যাঁর সহায়, সেই কৌরবগণকেই বা কে জয় করতে পারে? এই যুদ্ধে জয়ে বা পরাজয়ে কোনো মঙ্গলই নেই। আমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দ্যূত সঞ্জয় বিনীত হয়ে কৃষ্ণ ও বৃদ্ধ পাঞ্চাল রাজের নিকট প্রণত হচ্ছি, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি সন্ধির প্রার্থনা করছি। ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র চান যে, আপনারা শান্তি স্থাপন করুন।
যুধিষ্ঠির আমার কথার উত্তরে বললেন, — “সঞ্জয়, আমি কখনোই কাউকে বলিনি যে আমি যুদ্ধ করতে আগ্রহী। তাহলে তোমরা ভীত হচ্ছ কেন? আমি জানি, যুদ্ধ অপেক্ষা অযুদ্ধ ভালো। যদি দারুণ বা বীভৎস কর্ম না করেও অভীষ্ট বিষয় পাওয়া যায়, তবে কোন্ মূর্খ যুদ্ধ করতে চায়।”
সঞ্জয় এত পর্যন্ত বলে খানিক তুষ্ণী-ভাব অবলম্বন করলে, আমি বললাম, — ‘সঞ্জয়, আমি যুধিষ্ঠিরের তুল্য সদাচারী, সদালাপী ব্যক্তি কোনোকালেই নই, তা আমি নিজেকে উপলব্ধি করিনি বা এক্ষনেও করছি না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে যুধিষ্ঠিরের উক্ত ওই কথাটি আমার অভিমান এবং ক্রোধের উদ্ভব ঘটায় যে, আমরা ভীত। যুদ্ধ আবাহণ আমার পক্ষে অবশ্যই হঠকারিতা হয়েছে। কিন্তু আমার স্বভাব ধর্ম অনুযায়ী যুদ্ধ পরিহার করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তবে এরকম পয়াজয়ের কথা আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। পাণ্ডবেরা অবশ্যই জয়লাভ করেছে এবং রাজ্য সিংহাসনও পেয়েছে। কিন্তু তুমি আমাকে বলতো, এরকম জয়লাভে কতটা সৌভাগ্যের অধিকারী তারা হয়েছে? কাকে নিয়ে তারা এই ঐশ্বর্য ভোগ করবে? মানুষ ঐশ্বর্য ভোগ করে স্বজন-বন্ধুদের সহ। সেই স্বজন-বান্ধব কেইবা আছে, যাদের নিয়ে তারা সুখ ভোগ করবে?
আমি সুদীর্ঘকাল শুধু স্বজন-বান্ধব নয়। এই রাজ্যের বিপুল সংখ্যক প্রজাদের হিতার্থে অকাতরে আমার ভাণ্ডার মুক্ত করে দিয়েছি। কিন্তু পাণ্ডবেরা তো জানেই না লোকহিতৈষণা কি কি কার্যের দ্বারা সাধিত হয়। তারা সম্পদ ব্যয় করবে তাদের পক্ষে যোগদানকারী যাদবদের জন্য, যে ব্যয়ের পরিমাণ কৃষ্ণ বিপুল অঙ্কে করে রেখেছেন। বাকি যাবে ব্রাহ্মণদের তুষ্ট রাখার জন্য যাগ, যজ্ঞ এবং তাদের দান দক্ষিণা দিতে। পাণ্ডবেরা কি জানে, এই যুদ্ধের ফলে কৃষকেরা প্রকৃতিপুঞ্জ কিভাবে ক্ষতির সম্মুখে পড়তে চলেছে এবং অচিরেই দুর্ভিক্ষ, মারী এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপত্তি নেমে আসতে চলেছে। রাজ্যার্ধ পাওয়ার পর তারা প্রজা সাধারণের জন্য কী করেছে? তারা কি আদৌ জানে, প্রজাহিতৈষণা কাকে বলে বা তা কিভাবে সম্পন্ন হয়?
সঞ্জয়, আমি স্বীকার করছি যে আমি অত্যন্ত রাজ্যলোভী। কিন্তু এই কুরুরাজ্য এবং তার অধিবাসীদের বর্গ-বর্ণ-নির্বিশেষে আমি ভালোবাসি এবং সকলের মঙ্গলের জন্য তাদের সুশাসন দিই। কিন্তু পাণ্ডবেরা যে সর্বশ্রেণীর প্রজার মঙ্গল চায় না, তা তাদের ইন্দ্রপ্রস্থে অবস্থান এবং শাসন পরিচালনাকালেই সম্যক বোঝা গেছে। তারা অতি দ্রুত নিজেদের ধনবৃদ্ধি এবং শৌর্য প্রচারকল্পে শুধু প্রজা নিপীড়ন এবং প্রতিবেশি নিকট দূরের নৃপতিদের নির্জিত করে সম্পদ সংগ্রহ করেছে এবং তা শুধু ব্রাহ্মণদের পোষণ এবং যজ্ঞাদি নির্বাহের জন্য। বনবাসী অনার্যরা যজ্ঞ-বিরোধী এবং বেদ-বিরোধী বলে, ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় তাদের নির্বিচারে হত্যা করেছে। যারাই ভিন্ন রীতিনীতি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ, তারাই যেন হত্যার যোগ্য। পৌগন্ত(??) কাল থেকে আমরা পরস্পরকে দেখেছি। তখন থেকেই আমি তাদের পছন্দ করতে পারিনি। রাজ্যাংশের অংশভাগ অবশ্যই তার প্রধান কারণ; কিন্তু ভীমকে দিয়ে সব সমস্যা বা ভিন্নতার গায়ের জোরে নিষ্পত্তিও তাদের সঙ্গে আমার বিরোধের একটা অন্যতর কারণ, এই সত্যটা কেউই বুঝতে চাইল না।’
(ক্রমশ)