• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৭৭ | জানুয়ারি ২০২০ | উপন্যাস
    Share
  • কালসন্ধ্যা : মিহির সেনগুপ্ত


    ।। সাত ।।

    চ্ছা আমি কি পাণ্ডবদের সম্ভাব্য নিধনের নিমিত্ত কোনোপ্রকার আনন্দ বোধ করছি? দুঃখ? সেকথা নিশ্চয় করে প্রকাশের। শারীরিক বা মানসিক সামর্থ্যও আমার আর নেই। তবে একথা আমি নিশ্চয় বলতে পারি। যাঁরা আমার দোষগুণ বিচার করে নিরপেক্ষ ভাবে সুচিন্তিত মতামত দেবেন, তারা বলতে বাধ্য যে যুদ্ধ আমি চাইলেও পাণ্ডবদের কারো বিনাশ তোমার কাম্য ছিল না। সেখানে একমাত্র ভীম হয়তো কিছুটা ব্যতিক্রম। আমি তাদের পরাজয় অবশ্যই চেয়েছিলাম। গুরু দ্রোণ যখন সেনাপতি তাঁকে বিশেষ ভাবে বলে দিয়েছিলাম, তিনি যেন যুধিষ্ঠিরকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করার প্রযত্ন করেন। আমার বিশ্বাস ছিল গুরু দ্রোণ তা পারবেন। পিতামহ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি দৈনিক দশসহস্র সৈন্য সংহার করবেন। তিনি পাণ্ডবদের প্রতি অস্ত্র ব্যবহার করবেন না। তিনি তাই করেছেন। কিন্তু গুরু দ্রোণের তেমন কোনো শপথ ছিল না। অর্জুন তাঁর প্রিয় শিষ্য। তাঁকে তিনি নিহত করবেন না, সেকথা তিনি বলেই নিয়েছিলেন। কিন্তু অন্যদের বিষয়ে তাঁর সেরূপ কোনো কথা ছিল না। তিনি অনেকবার যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু করেননি। তিনি, আমার যতদূর বিশ্বাস, পাণ্ডবদের প্রতি পক্ষপাতী ছিলেন। এ নিয়ে অশ্বত্থামাকে যুদ্ধের মধ্যেই একদিন এরকম ইঙ্গিত দেওয়ায়, সে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ব্যবহার করেছিল। সেটা হয়তো তার পক্ষে তখন অন্যায় ছিল না। কিন্তু গুরু স্বয়ংও ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।

    আসলে অশ্বত্থামাকে আমি অত্যন্ত কুৎসিত কথা বলেছিলাম। অশ্বত্থামা মহাবীর, ইচ্ছে করলে সে একা পাণ্ডবদের পর্যুদস্ত করতে সক্ষম ছিল বলে আমার মনে হয়েছিল। দ্রোণের সৈনাপত্যে যুদ্ধ চলার সময় পাণ্ডবদের বিক্রম দেখে একদিন অশ্বত্থামাকে বললাম, “তোমার পিতা আচার্য পান্ডবগণকে পুত্রবৎ রক্ষা করিতেছেন, তুমিও আমার দুর্ভাগ্যবশত তাহাদের সহিত তেমন শক্তি প্রয়োগে যুদ্ধ করিতেছ না। তোমার এইপ্রকার উপেক্ষা প্রদর্শন ধর্মরাজের প্রীতির নিমিত্ত অথবা দ্রৌপদীর আনন্দবর্ধনের নিমিত্ত - তাহা বুঝিতে পারিনা।“ অশ্বত্থামা আমার এই অশোভন ইঙ্গিতে মর্মাহত হয়েছেন এবং আমাকেও কঠোর বাক্যে তিরস্কার করতে ছাড়েননি। সে বলেছে, - “রাজন, আমার পিতা ও আমি পাণ্ডবগণকে ভালোবাসি এবং তাঁহারাও আমাদিগকে ভালোবাসেন। ইহা সত্য হইলেও যুদ্ধের সময় সেই ভালোবাসার কোনো স্থান নাই। ... রাজন, তুমি অতি লোভী ও শঠতা পরায়ণ। তুমি অহংকারী এবং কাহাকেও বিশ্বাস করিতে পারনা। সেই জন্য আমাদিগকেও আশঙ্কা করিতেছ। তুমি কুৎসিৎ, পাপাত্মা ও পাপপুরুষ। হে ক্ষুদ্রাত্মন, পাপচিও তুমি অন্যান্যদের এবং আমাদিগকেও এই জন্যই শঙ্কা করিতেছ।“ অশ্বত্থামা ছাড়া কেউই এরূপ কথা আমার মুখের উপর বলার সাহস রাখত না। তবে, আমার অভিযোগ মিথ্যে ছিল না।

    পিতার শোচনীয় বধবার্তা শুনে, দুঃখে শোকে অশ্বত্থামা অতিক্রুদ্ধতাবশত ভয়ানক নারায়ণঅস্ত্র প্রয়োগ করেছিল। একমাত্র কৃষ্ণ এই ভয়ঙ্কর অস্ত্রের ব্যবহার এবং সংবরণ বা তা থেকে অব্যাহতির উপায় জানত, ফলে, পাণ্ডবেরা রক্ষা পায়, তবে তাদের অগণিত সৈন্যক্ষয় ঘটে। আমি লক্ষ্য করেছি, তার পতার শোচনীয় মৃত্যুতে প্রতিশোধ গ্রহণ করার নিমিত্ত তার চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। শোকে, ক্রোধে সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অন্যথায়, সে মহাবীর, অতিমানব এবং সর্বভূতের সুহৃদ বলে পরিগণিত। তথাপি, তার এখনকার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে আমি ভালো করিনি।

    আমি অন্যান্য সুহৃদদের সুপরামর্শের মতোই, তার সদুপদেশও গ্রাহ্য না করে নিজের এবং অন্যদেরও ধ্বংসের কারণ হয়েছি। অশ্বত্থামা অবশ্য বলেছিল -“রাজন, এবার পাণ্ডবগণের সহিত সন্ধি কর। তোমার পক্ষের সকল বীরপুরুষই স্বর্গত হইয়াছেন, আমার মাতুল ও আমি অবধ্য (এইরূপ কথিত আছে)। আমিই শান্তির প্রস্তাব করিব। অর্জুন আমার কথা অমান্য করিবেন না। কৃষ্ণও যুদ্ধ চাহেন না(?)। যুধিষ্ঠির ধার্মিক ও দয়ালু, ভ্রাতৃগণ তাঁহার একান্ত অনুগত। রাজন্‌, আমি তোমার হিতাকাঙ্খী বলিয়াই সকাতরে অনুরোধ করিতেছি - প্রসন্ন হও, আমার পরামর্শ গ্রহণ কর। আমিই কর্ণকে শান্ত করিব। আমার এই পরামর্শ না শুনিলে অধিকতর অনুতপ্ত হইবে।‘ আমি গুরুপুত্রের এই পরামর্শও অগ্রাহ্য করেছি। কর্ণ তখনও জীবিত। তার উপর আমার অগাধ ভরসা ছিল।

    পরে কর্ণও অর্জুনের হাতে নিহত হয়েছে। আমি গুরুপুত্রের কাছে গিয়ে বললাম, “আজ তুমিই আমাদের পরম আশ্রয়। তোমার নির্দেশ অনুসারেই আজ সেনাপতি বরণ করিতে চাই।“ অশ্বত্থামা শল্যকে সেনাপতিপদে বরণ করতে বলায়, তাই করা হল।

    আমার উরুভঙ্গের পর, সাশ্রুনেত্রে, শোকাকুল আচার্যপুত্র প্রলয়কালীন বহ্নির মতো ক্রোধে জ্বলে উঠল। বলল - ‘মহারাজ, এই পাঞ্চাল-পাণ্ডবেরা আমার পিতাকে হত্যা করায় আমার যতটুকু দুঃখ হয়েছিল, তোমার এই অবস্থা দেখে আমার ততোধিক দুঃখ হচ্ছে। আমি সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, আজ আমি বাসুদেব উপস্থিত থাকলেও যেকোনো উপায়ে পাঞ্চাল বংশকে সমূলে নিধন করব। অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের নাম উল্লেখ না করায়, বুঝলাম না, তাদের বিষয়ে তার প্রতিজ্ঞা কি? মনে হয় অশ্বত্থামা পাঞ্চাল-দ্রুপদ দৌহিত্রদের পাঞ্চাল রূপেই উল্লেখ করল। সে পাণ্ডবদের প্রধান বংশধারা দ্রৌপদী পুত্রদের সংহার কামনা করেছিল। এই বলে, অশ্বত্থামা আমার অনুজ্ঞা প্রার্থনা করল। বলা বাহুল্য তার এই শপথে মুমূর্ষু আমার মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। প্রতিহিংসাপরায়ণতা মৃত্যুকেও গণ্য করে না।

    আমি এই মুহূর্তেও বুঝে উঠতে পারছি না, মানুষের নিকট বাঁচার স্পৃহা প্রবল না চিরপোষিত ক্রোধের নিমিত্ত প্রতিশোধস্পৃহা। ভীম আমার শতভ্রাতাকে হত্যা করেছে নির্মমভাবে। তারা সকলেই ভীমের প্রতি কোনো গুরুতর অন্যায় করেনি। অন্যদের কথা বাদ দিলেও আমার সর্বতোভদ্র ভ্রাতা বিকর্ণ তো সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং সকলের নিকটই অতি আদরণীয় ব্যক্তিত্ব রূপে গণ্য ছিল। দ্যূতসভায় পাণ্ডবদের পক্ষে দ্রৌপদীর বক্তব্যের সমর্থনে সে বিতর্ক তুলেছিল পিতামহ ভীষ্ম, দ্রোণ এবং অন্যান্য কুরু প্রবীণদের সঙ্গে। তাকে প্রাণে হত্যা করা কি আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল?

    প্রশ্ন উঠতে পারে, যুদ্ধে হতাহত হয়েই থাকে। কিন্তু বিধু অনুসারে যুদ্ধ অর্থে, বিশেষত অসম দ্বৈরথে হত্যা অকর্তব্য। অসম যুদ্ধ অন্যায়। যুদ্ধ শুরু হবার প্রাক্কালে এ ব্যাপারে যে নীতি নিয়মের নির্ধারণ করা হয়েছিল, পাণ্ডব ভ্রাতারা কেউই তা মানেনি। শঠতার জন্য আমাকে সাধারণত দায়ী করা হয়। কিন্তু অপক্ষপাত বিচারে পাণ্ডবদের আনুপূর্ব কর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শঠতার আশ্রয় নিয়েছিল।

    জতুগৃহ দাহ ব্যাপারটি, আগেই বলেছি, একটি প্রবল মিথ্যেচার। নিতান্তই সন্দেহ প্রবণতার জন্য বিদুরের পরামর্শে তারা এই কার্যটি করে। নচেৎ পঞ্চপুত্রসহ নিষাদরমণী এবং স্বয়ং পুরোচন, যার ওপর তথাকথিত এই ধ্বংসাত্মক কার্যের ভার ছিল, তারা সকলেই দগ্ধ হত না। বিষয়টি একান্তই পাণ্ডব-প্রেমী বিদুরের অতি সতর্কতাজনিত ভাবনাপ্রসূত। একমাত্র ভীম ব্যতিত যুদ্ধে (ন্যায় যুদ্ধে) আমি কোনো পাণ্ডবদের নিধন চাইনি। হ্যাঁ জয় আমি চেয়েছিলাম, কিন্তু তা অন্যায় যুদ্ধে নয়। যুদ্ধে সৈন্যরা হতাহত অবশ্য হয়, যদিও তাও গূঢ় বিচারে অন্যায়। মানুষের, বিশেষত শাসক বা ক্ষত্রিয়রাজাদের এই রীতি অতি কদর্য রীতি। যুদ্ধ অর্থই ধ্বংস, বিনাশ। কিন্তু অনাদিকাল থেকে এই প্রথা চলে আসছে। তথাপি নিজেদের স্বার্থেই শাসকেরা কতগুলি রীতির সৃষ্টি করেছে এবং বলা হয়, তা না মানা অধর্ম।

    আমি পাণ্ডবদের বিষয়েই এসব কথা বলছি বটে, তবে দীর্ঘকাল, রাজ্যশাসন করে আমি বুঝেছি ক্ষত্রিয়-অক্ষত্রিয় সব শাসক সমাজেই এরূপ অধর্ম অবধার্য। সুতরাং পাণ্ডবদের এককভাবেই দায়ী করছি না। আমরাও সমান দোষে দোষী। তবে বিশেষ করে পাণ্ডবদের কথা বলছি কেন? বলছি একারণে, যে তারা বড় গলায় ধর্মযুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ বলে বেশি কোলাহল করে বলে। আমি আবারও বলছি, ধর্মযুদ্ধ বলে কোনো যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধ ব্যাপারটাই অধর্ম। আমাদের উভয় পক্ষের মধ্যে একমাত্র যুধিষ্ঠিরই যুদ্ধবিরোধী। তাও নিতান্ত দলে পড়ে, কৃষ্ণ, সাত্যকি এবং পাঞ্চালদের প্রভাবে পড়ে সেও যুদ্ধে শেষপর্যন্ত মত দিয়েছে। এব্যাপারে আমার সর্বদা একটাই একরোখা মনভাব ছিল। যদি যুদ্ধ চাও, অবশ্যই যুদ্ধ হবে, নচেৎ শর্তলঙ্ঘন জনিত কারণে পুনরায় বনবাস-অজ্ঞাতবাস অবলম্বন কর। এমনিতে আমি রাজ্য প্রত্যার্পণ করব না।

    ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ যদিও আমার পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন, কিন্তু একমাত্র কর্ণ ছাড়া আর কেউই সর্বান্তকরণে আমার পক্ষাবলম্বী ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য ছিল, যেহেতু তাঁরা কুরুকুলের অন্নঋণে আবদ্ধ, কুলের আপৎকালে তাঁরা তার বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। কিন্তু পিতামহের এই বিচার খুব একটা যুক্তিযুক্ত বলে আমার মনে হয়নি। বিভাজিত হলেও পাণ্ডব কুলও কুরুবংশীয়। এই প্রবীণেরা সততই কামনা করেছেন যুদ্ধটা না হোক্‌। ফলে, সর্বান্তকরণে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলেই আমার বিশ্বাস। বিষয়টা আমি বুঝেও বুঝিনি, কারণ, ক্ষমতার দম্ভে আমি অন্ধ ছিলাম। তাঁদের পক্ষে পাণ্ডবদের মঙ্গল কামনা অসংগত ছিল না। বস্তুত, পাণ্ডবেরা দৃশ্যত তাঁদের নিকট কোনো অপরাধ করেনি। আমি প্রথম থেকেই মোহান্ধ ছিলাম। তারা তা ছিল না।

    ভীষ্ম কিভাবে পাণ্ডবদের সহায়তা করেন, তার উদাহরণ আমি বিরাটের উত্তর গোগৃহ লুন্ঠন প্রচেষ্টার সময়ই বুঝেছিলাম। বিরাট রাজের ষাটসহস্র গাভী আমরা হরণ করেছিলাম। আপাত বিচারে কার্যটি নিন্দনীয় হলেও ক্ষত্রিয় রাজাদের মধ্যে এরূপ রীতি বিরল বা অনৈতিক নয়। বিরাট ক্ষীণবল রাজা। আমাদের কৌরব বাহিনীর মুখোমুখি হবার কোনো সামর্থ্যই তাঁর হবে, এমন ভাবনাই আমি করিনি। তাই অতিরিক্ত আত্মশ্লাঘাবশত আমরা সহজেই লুন্ঠন কার্য সমাপ্ত করে প্রত্যাবর্তণ কালে বৃহন্নলারূপী অর্জুন, বিরাট পুত্র উত্তর সহ আমাদের প্রবলভাবে আক্রমণ করে। উত্তর তার সারথিরূপে রথ চালাচ্ছিল। তার শঙ্খধ্বনি এবং গাণ্ডীব টংকারে বৃহন্নলার ছদ্মবেশ সত্ত্বেও পিতামহ, গুরু দ্রোণ এবং আমি অর্জুনকে চিনতে পেরেছিলাম। যুদ্ধে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, আমি সকলেই পরাজিত হয়েছিলাম। গোধন উদ্ধার করে অর্জুন নগরীতে ফিরে গিয়েছিল। আমরা সকলেই, একমাত্র পিতামহ ব্যতিত অর্জুনের ঐন্দ্রাস্ত্রে মূর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। ভীষ্মও পরাস্ত হয়েছিলেন। ঐন্দ্রাস্ত্রের প্রভাব কাটাবার কৌশল একমাত্র ভীষ্ম ছাড়া আর কারোই আয়ত্ত্বে ছিলনা। তাঁর পরামর্শে অস্ত্রের প্রকোপ কাটাবার জন্য আমরা সকলেই ভূমিশয্যা আশ্রয় করেছিলাম এবং অচিরে জ্ঞান হারিয়েছিলাম। ভীষ্ম সক্ষম হয়েও ঐ অস্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ করেননি। পরে তিনি বলেছেন যে অস্ত্রের সম্মান রক্ষার জন্য তিনি ওরূপ করেছিলেন। পরে এই ব্যাপারটিকেও আমার পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতই মনে হয়েছে।

    অজ্ঞাতবাসের সময়কাল পূর্ণ হবার আগেই অর্জুন প্রকাশ্যে এসেছে এই জন্য দ্যূতসভার শর্তানুসারে তাদের পুনরায় বারো বছর বনবাস এবং এক বছর অজ্ঞাতবাস করতে হবে, আমি এরূপ বক্তব্য উপস্থিত করলে, গুরু দ্রোণ পিতামহ ভীষ্মকে নতুন করে গণনা করতে বললেন। ভীষ্ম চান্দ্রমাস অনুসারে গণনা করে জানালেন, বারো বৎসর এবং এক বৎসর, এই তেরো বৎসরের মধ্যে পাঁচটি মলমাস গিয়েছে এবং তদুপরি আরও বারোদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। দুর্যোধন সৌর মাস ধরে গণনা করে আগামী বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিজ্ঞাত অজ্ঞাতবাসের সময় বলে মনে করছিলেন, কিন্তু তা ঠিক নয়। পিতামহের এই গণনা বিষয়ে আমার বিতর্ক ছিল, কিন্তু তখনকার পরিস্থিতি বিতর্কের সপক্ষে ছিলনা। তবে পরবর্তীকালে এ প্রসঙ্গে আমি প্রবীণদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছি। আমার স্পষ্টতই স্মরণ ছিল, গণনা সৌরমাস অনুযায়ীই হয়েছিল। কারণ পিতামহ তাঁর গণনাদি সৌরবিধি অনুযায়ীই করতেন। পিতামহ কৌশল করেই বিষয়টা পাণ্ডবপক্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের দিন, মাস, বৎসরের গণনা চান্দ্রমাস অনুসারে কখনো হয়েছে এখন স্মৃতি আমার নেই। আমরা অবশ্য চন্দ্রবংশীয়, কিন্তু তার সঙ্গে দিন, মাস, বছর গণনার কোনো সম্পর্ক নেই। যাই হোক্‌, পিতামহের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমি তাঁর বিচার মেনে নিয়েছিলাম। আমি অন্য সকলের প্রতি ধৃষ্টতা প্রকাশ করলেও, পিতামহ ভীষ্মের উপর কখনো ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিনি। কিন্তু তিনি যুদ্ধ বিষয়ে আমাকে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেননি। এ বিষয়েও আমার মনে কিছু ধন্দ আছে। কারণ আচার্য দ্রোণ, কৃপ, এমনকী মাতুল শকুনিও যুদ্ধের বিপক্ষেই কখনো না কখনো মত প্রদান করেছিলেন। পিতা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তো কোনোদিনই দৃঢ়মতের মানুষ ছিলেন না। তাঁকে যে যখন যা বুঝিয়ে দেয়, তাই বোঝেন। সে কারণে, আম সর্বদাই তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে চলি, যুদ্ধে তিনি যেন আপত্তি না করেন। পিতা, যাইই ঘটুক, শেষপর্যন্ত আমার কথাই শুনতেন।

    কিন্তু মাতাকে যখন বললাম যে মাতার চিন্তার কোনো কারণ নেই, কারণ স্বয়ং গাঙ্গেয় আমার পক্ষে আছেন, যিনি একাকী কাশীরাজের তিন কন্যাকে সব নৃপতিদের নির্জিত করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি মহারাজ শান্তনুর চাইতেও অধিক শক্তিধর। তিনি ব্রহ্মর্ষি-সদৃশ এবং দেবগণেরও ভীতিজনক, এরূপ প্রসিদ্ধি তাঁর আছে। তাঁকে কে নিধন করতে পারে? এরূপ বীরপুঙ্গব সহায় থাকলে ভীতির কোনো কারণ নেই। মাতা আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে বলেছেন - ‘হে মূঢ়, তুমি ভাবছ, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি বীরেরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে তোমার পক্ষে যুদ্ধ করবেন, তা কখনোই সম্ভবপর হবে না। তাঁদের কাছে তোমরা এবং পাণ্ডবেরা সব বিষয়েই সমান। যদি অন্নঋণের মর্যাদার জন্য তাঁরা যুদ্ধে যোগ দেন। তবে বরং প্রাণ ত্যাগ করবেন, তথাপি যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে লজ্জায় তাকাতে পারবেন না’। মাতার বচন সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তাঁরা যুদ্ধ করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা আধা ইচ্ছেয় এবং আধা অনিচ্ছায়। পিতামহ স্বয়ং তাঁর পতনের গূহ্য কথা পাণ্ডবদের অনুরোধে বলে দিয়েছিলেন। শিখণ্ডীকে তিনি পুরুষ মনে করতেন না। বস্তুত শিখণ্ডী ছিলেন নপুংসক। অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে ভীষ্মের উপর শরবর্ষণ করেছে। ভীষ্ম যুদ্ধ বিমুখ হয়ে নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষায় প্রতিযুদ্ধে নিস্পৃহতা অবলম্বন করেছেন। আসলে অতি বার্ধ্যক্যের কারণে জীবনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিলই না।

    আমার মনোভাব আমি কারুর কাছ থেকেই গোপন করিনি। বিদুর কুরুবংশের সুদীর্ঘকালীন মহামন্ত্রী। সুতরাং তিনি আমার সমুদয় মনোভাব খুবই উত্তমরূপে অবগত ছিলেন। তাঁর পাণ্ডবপ্রীতির কারণে আমার সঙ্গে তাঁর নিয়ত মতদ্বন্দ্ব ছিল। মতবিরোধ সত্ত্বেও বিদুর আমার অকল্যাণকামী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মাত্রাধিক উপদেশের কারণে তাঁর উপর আমার বিরক্তি উৎপাদিত হত। তিনি প্রায়শই পিতাকে বলতেন আমাকে পরিত্যাগ করতে। তাঁর মধ্যে ক্ষোভ এবং দুঃখে একদিন তাঁর পিতৃস্থানীয় ভীষ্মকে ভর্ৎসনাও করেছিলেন। বলেছিলেন, -‘নষ্টপ্রায় কৌরব বংশকে একদিন তুমিই পুনরুদ্ধার করেছিলে, আমি পুনঃপুনঃ বিলাপ করিতেছি কিন্তু তুমি তাহা উপেক্ষা করিতেছ। আমি এবং ধৃতরাষ্ট্র তোমার চিত্রিত আলেখ্যমাত্র, তুমিই সব কিছু করিতেছ। তোমার রক্ষিত এই কুল যেন তোমারই উপেক্ষায় বিনষ্ট না হয়। তুমি জীবিত থাকিতে সেই কুলাঙ্গার দুর্যোধন কে? এই অনার্য কৃতজ্ঞ লোভীর দোষেই কুরুকুল বিনষ্ট হইবে। আজ এই দুর্দিনে যদি তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়া থাকে, তবে ধৃতরাষ্ট্র এবং আমাকে লইয়া বনে যাত্রা কর। অথবা এই দুর্মতি দুর্যোধনকে বন্দী করিয়া তুমিই পাণ্ডবগণের সাহায্যে এই রাজ্য শাসন কর। হে রাজশার্দ্দুল, প্রসন্ন হও, অগণিত নৃপক্ষয় ও কুলক্ষয় নিবারণ কর”।

    আমি জানি, ভীষ্ম ইচ্ছে করলে, আমাকে নিগৃহীত করেও পাণ্ডবদেরকে তাদের প্রাপ্য অংশ দিতে পারতেন। এতখানি না করলেও, “অন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করিতে আমার ইচ্ছা নাই” - বলে, তিনি অনায়াসে আমাকে ভয় দেখাতে পারতেন। তিনি খুব ভালই জানতেন যে আমি তাঁর বাহুবলকেই প্রধান সম্বল বলে মনে করেছি। তাঁর মতো মহামতি পুরুষের পক্ষে এটা অনুমান না করার কথা নয়।

    এই ঘটনায় আমি বিদুরের প্রতি যারপরনাই ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হয়েছিলাম এবং অত্যন্ত রূঢ়তার সহিত তিরস্কার ও অপমান করে রাজসভা থেকে বহিস্কার করে দিয়েছিলাম। অতঃপর বিদুর হস্তিনাপুর পরিত্যাগ করে তীর্থযাত্রায় গমন করেন এবং যুদ্ধকালে রাজধানীতে তিনি থাকবেন না, এরূপ শপথ সহকারেই চলে গিয়েছিলেন। বিদুরকে রাজসভা থেকে বিতাড়ন আমার পক্ষে অত্যন্ত অনিষ্টকর হয়েছিল। বিদুর উত্তম মন্ত্রণাদাতা এবং পিতার অত্যন্ত প্রিয় ও সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু তাঁর নিয়ত পাণ্ডব-প্রশংসা এবং আমার নিন্দাবাদ আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। যুদ্ধকালে আমার পক্ষে এরূপ একাধিক ছোটোবড় আত্মকলহ আমাদের ক্ষতিই বৃদ্ধি করেছে। ভীষ্ম ও কর্ণের কলহ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে দুজনেই শপথ করলেন যে দুজন একসঙ্গে যুদ্ধ করবে না। কর্ণকে আমি অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে মান্যতা দিয়েছিলাম, তার কি এমন একটা শপথ করা সঙ্গত হয়েছে? ফলে দশ-দশটা দিন সে যুদ্ধই করল না।


    ।। আট ।।


    কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবেরা শিবিরে চলে গেলে, অশ্বত্থামা, তার মাতুল কৃপাচার্য এবং যাদববীর কৃতবর্মা ভূলুন্ঠিত আমার নিকট উপস্থিত হলেন। অশ্বত্থামা আমার গুরুপুত্র এবং সখা। তাঁর পিতার নিধন অত্যন্ত নৃশংসভাবে ধৃষ্টদ্যুম্নের হাতে ঘটেছে। অপক্ষপাতভাবে বিচার করলে ধৃষ্টদ্যুম্নেরও আচার্য হত্যায় কারণ ছিল। আচার্য তাঁর বন্ধু দ্রুপদকে শিক্ষা দেবার জন্য কুরুপাণ্ডব শিষ্যদের গুরুদক্ষিণা প্রদান উপলক্ষ্যে বন্দী করে নিয়ে আসার আদেশ দিয়েছিলেন। তদনুসারে তারা দ্রুপদকে বন্ধন করে এনেছিল। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে তখন বাধ্য হয়ে পাঞ্চালের অর্ধাংশ আচার্যকে দিতে হল। তখনকার মতো বিবাদ মিটলেও পুরোপুরিভাবে কোনোদিনই তাঁদের হৃদ্যতা ফিরে আসেনি।

    মহাযুদ্ধে যুধিষ্ঠির দ্রুপদকে এক অক্ষৌহিণী সেনার অধ্যক্ষ রূপে বরণ করেছেন। ভীষ্ম আমার নিকট দ্রুপদকে মহারথ বলে উল্লেখ করেছেন। বৃদ্ধ হলেও তিনি মহাশক্তিধর ছিলেন বলে ভীষ্ম উল্লেখ করেছেন। চৌদ্দদিন যুদ্ধ করে, পঞ্চদশ দিবসে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই আচার্যের শাণিত ভল্লের আঘাতে নিহত হন দ্রুপদ। আসলে কুরুপাঞ্চাল সম্পর্ক কোনোকালেই মিত্রতামূলক ছিল না। তারা পরস্পরের শত্রুই ছিল। আচার্য দ্রোণ তা জানতেন এবং এজন্য দ্রুপদের সহিত মনোমালিন্যে তিনি তার কুরুপাণ্ডব শিষ্যবর্গকে নিযুক্ত করেন। সুতরাং আচার্য দ্রোণকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিশোধমূলক আচরণের কারণ ধৃষ্টদ্যুম্নের একেবারে ছিল না একথা বলা যায় না। দ্রুপদ তাঁর বাল্যসখা দ্রোণকে অপমান করেছিলেন। আচার্য দ্রোণও তাঁকে পরাস্ত করে প্রতি-অপমান করেছেন। কিন্তু অন্তর থেকে দ্বেষ কোনো পক্ষেরই যায়নি। তার উপর এই মহাযুদ্ধ। মূল যুদ্ধ ধার্তরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবদের হলেও, এই সুযোগে বিবদমান সব ছোটো বড় পক্ষই পরস্পরের প্রতি প্রতিশোধ চরিতার্থে যত্নশীল হয়েছিল।

    আমার ভূলুন্ঠিত হবার পর, যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে সমাপ্তই ধরে নেওয়া হয়েছে। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের মধ্যে বেশিরভাগ সৈন্য উভয়পক্ষেরই নিহত হয়েছিল। কিছু নিশ্চয় পলায়ন করেছিল। আমার পক্ষে প্রধান যোদ্ধার মধ্যে আমাকে যদি এখনও জীবিত বিবেচনা করা হয়, তবে চারজন জীবিত। তার মধ্যে তিনজন মাত্র যুদ্ধক্ষম। অশ্বত্থামার প্রতিজ্ঞার কথায় পূর্বাপর চিন্তা না করে আমি অতি দ্রুত তাকে এই সামান্য শক্তির সৈনাপত্যে বরণ করে নিয়েছিলাম। আমার উচিত ছিল, আচার্য কৃপ এবং যাদববীর কৃতবর্মার সহিত এ বিষয়ে পরামর্শ করা। শুধু অশ্বত্থামার মত নিলেই তো চলবে না।

    আচার্য কৃপের মতামত তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাঁকে যা বলা হবে, তিনি প্রায় বাধ্যতামূলক ভাবে তা করবেন। আবাল্য তাঁরা দুই ভাই-বোন, কৃপ এবং কৃপী মহারাজ শান্তনুর আদেশ ও ইচ্ছাক্রমে হস্তিনাপুরেই মানুষ। তাঁর ভগিনী কৃপীর আচার্য দ্রোণের সহিত বিবাহ হয়। অশ্বত্থামা তাঁদের পুত্র। কৃপ এবং কৃপী, এই দুজনেরই জন্ম রহস্যাবৃত তথা কিংবদন্তি নির্ভর। এ বিষয়ে স্পষ্ট যদি কেউ কিছু জানতেন, তিনি মহারাজ শান্তনু। তিনিই সম্ভবত প্রচার করেছিলেন যে যেহেতু তিনি কৃপাপূর্বক এই দুইজনকে প্রতিপালন করেছেন, তাই তাঁদের নামায়ণ করা হয়েছে কৃপ ও কৃপী বলে।

    কথিত আছে শরদ্বান নামে মহর্ষি গৌতমের এক পুত্র ছিলেন। শরদ্বানের কঠিন তপস্যায় ভীত হয়ে তাঁর তপোভঙ্গের জন্য ইন্দ্র জানপদী নামের এক সুরবালাকে তাঁর নিকট পাঠান। তাকে দর্শনমাত্রেই শরদ্বানের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং হাত থেকে ধনুর্বাণ খসে পড়ে। তিনি দ্রুত আসন ত্যাগ করে স্থানান্তরে যাবার ফলে এক শরগুচ্ছে তাঁর স্খলিত বীর্য পতিত হয়। তার থেকেই একটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হয়। তারাই মহারাজ শান্তনু প্রতিপালিত এবং নামায়িত কৃপ ও কৃপী। আচার্য দ্রোণের জন্মও প্রায় অনুরূপ রহস্যাবৃত। তাঁর জন্ম দ্রোণ বা কলসীর মধ্যে হয়েছে বলে তাঁর নাম দ্রোণ।

    আমাদের অতিবৃদ্ধপ্রপিতামহী দুষ্মন্ত পত্নী শকুন্তলার জন্মও বিশ্বামিত্রের বীর্যে স্বর্বেশ্যা মেনকার গর্ভে হয়েছিল। আমার অনুমান, কৃপ, কৃপী এবং দ্রোণের জন্মও স্বর্বেশ্যাদের গর্ভেই হয়েছিল। কলসী বা শরস্তম্ভে সন্তানের জন্মকথা অনৈসর্গিক।

    যাইহোক, কৃপাচার্য ধনুর্বেদে পারদর্শী হয়ে কুরু-পাণ্ডব কুমারদের প্রাথমিক অস্ত্রগুরু হন। তিনি নিজেও অসামান্য শস্ত্রকুশলী এবং মহাবীর এক যোদ্ধারূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ভীষ্ম আমাকে বলেছিলেন, ‘মহাত্মা কৃপাযার্চকে অতিরথ বলে জানবে’। কৃপাচার্য হস্তিনার কুমারদের ছাড়াও কৃষ্ণবংশ এবং অন্যান্য দেশের রাজকুমারদের অস্ত্রগুরু ছিলেন। যুধিষ্ঠিরও আচার্য কৃপকে যথেষ্টই শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর রাজসূয় যজ্ঞকালে সুবর্ণ ও মণিমুক্তাদির রক্ষার দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত করেছিলেন। আচার্য অত্যন্ত নিপুণতার সহিত সেই দায়িত্ব পালন করেন।

    আচার্য কৃপ খুবই স্বল্পভাষী ছিলেন। আমার মনে হয় আমার পক্ষে যোগদান করলেও, পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর অনেকটাই দুর্বলতা ছিল। যদিও এ বিষয়ে মুখে কখনোই কিছু তিনি বলেননি। তিনি যত বড় যোদ্ধাই হোন না কেন, অর্জুনের সহিত যুদ্ধে কখনোই জয়লাভ করতে পারেননি। বিরাটের গোগৃহে আমার সঙ্গে তিনিও গিয়েছিলেন। বৃহন্নলাবেশী অর্জুন রণক্ষেত্রে উপস্থিত হলে কর্ণ একটু অতিরিক্ত আস্ফালন করায়, অর্জুনের শৌর্যবীর্যের উল্লেখ করে তাকে তিনি ভর্ৎসনা করেছিলেন। পরে অবশ্য অর্জুনের আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেন। সেদিন আমরা সকলেই অর্জুনের হাতে নির্জিত হয়ে পলায়নই করেছিলাম, এমনকী ভীষ্মও।

    আচার্য কৃপ, আমাদের চারজন জীবিত কুরুপক্ষীয়দের মধ্যে সবার চাইতে মিতভাষী, স্থিরবুদ্ধি এবং বিচক্ষণ। অশ্বত্থামা তাঁর স্নেহাস্পদ ভাগিনেয়, কিন্তু পদাধিকারে সেনাপতি। সে যা বলবে সেটা সেনাপতির আদেশ, বিনাপ্রশ্নে তা পালন করতে হবে। কিন্তু একথাও সত্য যে একমাত্র অন্যায়ভাবে দ্রোণহত্যা ব্যতিরেকে তাঁর পক্ষে ব্যক্তিগত কোনো প্রতিহিংসার ব্যাপার নেই, যে কারণে এই নৈশ আকস্মিক যুদ্ধে গমন সঙ্গত হয়। বিশেষত, প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ যখন কার্যত শেষ হয়েই গেছে। এই যুদ্ধ এখন একান্তই যুদ্ধের নামে ব্যক্তিহত্যা। গুপ্ত হত্যা সর্বথাই নিন্দার্হ। তা যুদ্ধ নয়। কোনো বিধিতেই একে সমর্থন করা যায় না। কিন্তু এখন আর সেই ভাবনার কোনো অর্থ নেই। আচার্য কৃপ এক্ষেত্রে শুধু সেনাপতি অশ্বত্থামার আদেশই পালন করতে গেছেন। নিঃসন্দেহে নিজের দিক থেকে এটাকে তিনি যুদ্ধ বলেই মনে করেন না। যুদ্ধের ব্যাপারে আমি শুধু বালক অভিমন্যুকে সপ্তরথীর বেষ্টনে নিরস্ত্র অবস্থায় মারা ব্যতিত অন্য কোনো অন্যায় যুদ্ধের আশ্রয় গ্রহণ করিনি।

    আজকে এই নৈশযুদ্ধে গুপ্ত ঘাতকদের মতো ঘুমন্ত পাণ্ডব-পাঞ্চাল পক্ষীয়দের নিধন করা, আমাদের জন্য অপরিসীম অপযশ আনয়ন করবে। আমার এখন যা শারীরিক এবং মানসিক অবস্থা তাতে কতক্ষণ আর জীবিত থাকব জানিনা। এই যুদ্ধে যদি পাণ্ডব পাঞ্চাল সবার নিধন হয় এবং অশ্বত্থামারা আমার জন্য বিজয় নিয়ে আসে, আমি জীবিত থাকলেও সেই বিজয় নিয়ে আমার কী লাভ হবে? আমার পুত্র, পৌত্র, পূজনীয়জনেরা, বন্ধুবান্ধব কেউই তো আর বেঁচে নেই। কাদের নিয়ে আমি রাজ্যসুখ ভোগ করব?

    কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা নিশ্চয়ই খুব হৃষ্টমনে এই কার্যে যাননি। কৃতবর্মার কথায় পরে আসছি। কৃপাচার্য যে স্বেচ্ছায় এই কার্যে যাননি, তা তার মুখ দেখেই আমি অনুমান করেছি।

    অশ্বত্থামা অত্যন্ত উগ্র প্রতিশোধকামী। সে অসামান্য বলশালী কিন্তু তার প্রাণভয়ও মাত্রাধিক। প্রাণভয়ে ভীত যোদ্ধারা শত্রুর শেষ রাখতে চায় না। এখন ভাবছি, অশ্বত্থামার কথায় স্বীকৃত না হলেই বোধহয় সঙ্গত হত। বোধ হচ্ছে, আমাদের এই যুদ্ধ এবং বিবাদ শুরু থেকেই ভুল পথগামী ছিল। সর্বশেষ এই ভুলটি একান্তই অকারণে অনুষ্ঠিত হল এবং আমারই নির্বুদ্ধিতায়।

    কৃতবর্মার পক্ষে আমার জন্য এরূপ নিতান্তই অসম্ভব বলেই আমার মনে হয়। বস্তুত এ বিষয়ে একমাত্র অশ্বত্থামা ব্যতিত অপর দুজনের সহিত আমার আদৌ কোনো বাক্যালাপ হয়নি। আচার্য কৃপের অবশ্য আমার প্রতি অন্নঋণের কৃতজ্ঞতা আছে। কৃতবর্মার সেরূপ কোনো হেতু নেই। অধিকন্তু সে সাত্যকির সমতুল্যই অতিমাত্রায় কৃষ্ণের প্রিয়। যুদ্ধের উদ্যোগকালে, সেনা সংগ্রহের জন্য অর্জুন এবং আমি পৃথকভাবে দ্বারকায় গিয়েছিলাম। কৃষ্ণ আমাকে নারায়ণী সেনা দিয়ে সাহায্য করলে, আমি কৃতবর্মার সহিত সাক্ষাৎ করি। অর্জুন সপক্ষে শুধু কৃষ্ণকে চেয়েছিল এবং কৃষ্ণও এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ এবং নিরস্ত্র থাকার অঙ্গীকারে অর্জুনের ইচ্ছা পূরণ করতে আগ্রহী হয়েছিল। অর্জুন আর কৃতবর্মার নিকট যায়নি। সম্ভবত সে কারণেই অভিমানবশত কৃতবর্মা আমার আবেদনে তার এক অক্ষৌহিণী সেনাসহ আমার সঙ্গে যোগ দেয়। এতটা আমি আশা করিনি। তবে যেখানে কৃষ্ণ স্বয়ং পাণ্ডব পক্ষে যোগদানকারী, সেখানে কৃতবর্মা সামান্য অভিমানবশত অর্জুনের সঙ্গে না গিয়ে আমার সঙ্গে এল, এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয় বলে আমার মনে হয়েছিল। অর্জুনের সহিত তার সখ্য গভীর ছিল, তাছাড়া মাঝখানে কৃষ্ণের উপস্থিতিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এমনকী অভিমন্যুর বিবাহোৎসবেও কৃষ্ণের সহিত সেও যোগদান করেছিল।

    কুরুপাণ্ডবের সন্ধিস্থাপন উদ্দেশ্যে যুধিষ্ঠিরের দূতরূপে কৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুরের রাজসভায় আসে তখন সাত্যকি ও কৃতবর্মাও তার সঙ্গে এসেছিল। আমি শুনেছি, আমি কৃষ্ণকে বন্দী করার ষড়যন্ত্র করেছি এরকম ধারণায় সাত্যকি কৃতবর্মাকে বলেছে, ‘শীঘ্র সেনাদল প্রস্তুত করে সভাদ্বারে প্রস্তুত থাক’। অবশ্যই এই প্রচার সম্পূর্ণই অসত্য। এটা একান্তই কৃষ্ণের চক্রান্ত। কিন্তু সেসব কূটনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা। যে কৃতবর্মা আমার জন্য সৈন্য সাহায্য ছাড়াও নিজে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে যোগদান করেছে তার সঙ্গে এতবড় একটা বিষয়ে আমি মতামত বিনিময় করলাম না। অশ্বত্থামার ক্রুদ্ধ শপথের সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকে সম্মতি দিয়ে ফেললাম যে, যাও, তোমরা নৈশ আক্রমণে পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের গুপ্ত হত্যা কর। আচার্য কৃপ এবং কৃতবর্মার সঙ্গে একটাও কথা বিনিময় করলাম না। আমিতো সর্বতোভাবে পরাভূত হয়েইছি। তাহলে এর কি প্রয়োজন ছিল? গুপ্ত আক্রমণে আরও কতগুলি প্রাণ নষ্ট হলে কীভাবে তা আমার উপকারে আসবে? আমি নিজেই তো এখন মৃত্যুর হা-মুখের সামনে রয়েছি। আমি কি কোনোভাবেই এই কার্যে নিজের মঙ্গল লাভ করতে পারি? মঙ্গল দূরস্থান যে অহংকার আর আত্মম্ভরিতা - তাইই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

    অহংকার, আত্মম্ভরিতা সব মানুষের মধ্যেই কমবেশি থাকে। আমার মধ্যে এসব মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেশি। ওটাই যেন আমার জীবনীশক্তি। এখন যতই সময় বয়ে যাচ্ছে, ততই তার নিলয় ঘটছে। এই দোষের জন্য যে কত অনিষ্ট ঘটে, নিজেদের মধ্যে সামান্য কারণে অপ্রীতিকর ঘটনার উদ্ভব হয়, তার সম্যক পরিচয় আমি নিজের আচরণে অনুধাবন না করলেও একদা কর্ণ-অশ্বত্থামার কলহে আমার নিকটে প্রতিভাত হয়েছিল।

    জয়দ্রথ নিধনের পর কর্ণ আমাকে ভরসা দেওয়ার জন্য বলেছিল যে সে একাই সসৈন্য পাণ্ডবদের নিধন করে আমাকে নিষ্কন্টক করবে। কোনো ভয় নেই। শুধু কর্ণ বলে কথা নয়, এরকম আস্ফালন, যোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই অহরহ করে থাকে। এ ব্যাপারে তারা সম্ভব-অসম্ভব বিচার করে না। কর্ণের এইরূপ মূঢ় আস্ফালন চুপচাপ সহ্য করতে না পেরে আচার্য কৃপ তাকে কঠোর উপহাস ও ভর্ৎসনা করে বলেছিলেন যে অর্জুনের তুলনায় কর্ণ নিতান্তই ক্ষুদ্র। দম্ভাতিশয্যে কর্ণ সে কথা না মেনে প্রতিজ্ঞা করল যে সে কৃষ্ণার্জুনকে অবশ্যই বধ করবে। একথায় কৃপাচার্যের উপহাস বৃদ্ধি পেলে, তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কর্ণ তাকে বলে - “তুমি ব্রাহ্মণ, বৃদ্ধ এবং রণে অসমর্থ, বিশেষত পাণ্ডবগণের প্রতি স্নেহপরায়ণ। এই জন্যই আমার বীরত্ব উপলব্ধি করিবার মতো সামর্থ্য তোমার নাই। পুনরায় এরূপ অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করলে অসি দ্বারা তোমার জিহ্বাচ্ছেদ করিব”।

    অশ্বত্থামা তার মাতুলের এই অপমান সহ্য করতে পারল না। অসি কোষমুক্ত করে সে কর্ণের দিকে ধাবিত হল। আচার্য ও আমি অতি কষ্টে তাকে ধরে রেখেছিলাম। অনেক অনুনয়-বিনয় এবং স্তবস্তুতি করে অশ্বত্থামাকে সংযত করতে হয়েছিল। সেক্ষেত্রে কর্ণের দাম্ভিকতার আতিশয্যেই এই আত্মকলহের উদ্ভব ঘটেছিল। আচার্য কৃপও কর্ণকে বলেছিলেন যে তিনি তার এরূপ ব্যবহার ক্ষমা করলেন বটে কিন্তু তার এই অত্যধিক দর্প অর্জুন নাশ করবেন। ন্যায় বা অন্যায় যেভাবেই হোক কর্ণ অর্জুনের হাতেই নিহত হয়েছিলেন।

    প্রসঙ্গত, এখানে একটা ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করছি। পূর্বে বহুবার যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গে বলেছি যে আমাদের উভয় পক্ষের মধ্যে একমাত্র যুধিষ্ঠিরই যুদ্ধের প্রকৃত প্রতিকূলে ছিলেন। কিন্তু আমি একটা বিষয় বুঝি না, এত প্রতিপক্ষীয় বীরের মধ্যে তিনি কর্ণ সম্পর্কে অতটা বিরূপ ছিলেন কেন? তা কি দ্রৌপদির উপর দ্যূতসভায় কর্ণের অশালীন আচরণের জন্য? না এর পশ্চাতে অন্য কোনো কারণ আছে? জনশ্রুতি ছিল এই যে কর্ণ কুন্তির কানীন পুত্র। যুধিষ্ঠির কি এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানতেন? সে কারণেই কি কর্নের নিধন বিষয়ে বার বার অর্জুনকে তিনি নির্দেশ দিতেন? বিষয়টি নিয়ে শুনেছি, অর্জুনের সঙ্গে তাঁর কুৎসিৎ কলহ পর্যন্ত হয়েছিল এবং তিনি অর্জুনকে গাণ্ডিব পরিত্যাগ করতে বলায়, সে তাঁকে হত্যা পর্যন্ত করতে উদ্যত হয়েছিল। কৃষ্ণ তার চাতুর্যে তা বন্ধ করে।



    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments