আধুনিক বাংলা গানঃ স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্ত (১৯৩০-১৯৮০), প্রথম খণ্ড—নির্মল নাথ; প্রকাশকঃ এম সি সরকার এন্ড সন্স; কলকাতা-৭২; প্রথম প্রকাশঃ পয়লা বৈশাখ ১৪২৬; ISBN 978-81-940240-1-9
কলেজ স্কোয়ারের পহেলা-বৈশাখী কচি-বইমেলার শতেক বইয়ের ভিড়ে আলোচ্য বইটিতে চোখ চলে গিয়েছিল পুরোপুরি তার শীর্ষনামে ততটা নয়, যতটা ঐ ‘প্রথম খণ্ড’ উল্লেখে। আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ ঊনিশশো ত্রিশ থেকে আশি বটে। এই পুরো দৈর্ঘ্যই যখন লেখক এ’কেতাবে ধরে নিয়েছেন, তবে আর ‘দ্বিতীয় খণ্ডে’ গিয়ে কী লিখবেন? না কি সময়ের দৈর্ঘ্যের নিরিখে নয়, অন্য কোনো থিম্যাটিক বিভাগে ‘দ্বিতীয়’ বা ‘তৃতীয়’ খণ্ড আসবে হয়ত ভবিষ্যতে? জানিনা। জানতে পারলামও না, কারণ ঠিক এই বিষয়টি কভার করে যে মুখবন্ধটি থাকার দরকার ছিল তা নেই এই বইতে।
*
তবে কি ইহা এক অকাজের বই?
না না না না, এক্কেবারেই নয়।
অসাধারণ আর্কাইভাল ভ্যালু এই বইয়ের, এবং এ’কেতাব লিখতে বর্ষীয়ান সাংবাদিক নির্মল নাথ মশাই যে ছ’-সাত বছর সময় নিয়েছেন, মোটেই বিফলে যায় নি তা। এর চাইতে কম সময় নিলেই বোধহয় এলাকাড়ির কাজ হয়ে যেত। বড় পরিশ্রমের কাজ করেছেন লেখক। পাঁচ শত পৃষ্ঠার এই পৃথুলা হার্ডবাউন্ড গ্রন্থের শুরুতে ‘সূচিপত্র’ ও শেষে অক্ষরভিত্তিক ‘নির্দেশিকা’ (পরিশিষ্ট)--দুইটিই বড় কাজের কাজ হয়েছে।
সূচিপত্রে ‘গায়ক’ অংশটিই প্রায় বারো আনা জুড়ে। এবং এখানে দশক-ভিত্তিক উপবিভাগ করে দেওয়া হয়েছেঃ ত্রিশের দশকে কুন্দনলাল সায়গলে শুরু হয়ে প্রাক্-আশির দশকে পিন্টু ভট্টাচার্য পর্যন্ত একুশ জন প্রধান প্রধান গায়কের উপর এক একখানি নিবন্ধ। এবং, চারজন বিশিষ্ট মার্গীয়-সঙ্গীতাচার্যের উপর একখানি সংবদ্ধ নিবন্ধঃ--জ্ঞান গোঁসাই-ভীষ্মদেব-তারাপদ-জ্ঞানপ্রকাশ (চিন্ময় লাহিড়ী নেই কিন্তু)।
গ্রন্থের পরবর্তী বিভাগে ষোলজন ‘গীতিকার’—অজয় ভট্টাচার্য, গৌরী, পুলক, প্রণব, শৈলেন... কে নেই? প্রেমেন্দ্র মিত্র মশাইও ঢুকে এসেছেন ভিতরে।
শেষে ‘স্বর্ণযুগের জীবনমুখী গান’ নিয়ে একটি তথ্যবহ অধ্যায়।
*
এ’তো গেল বইটির বহিরঙ্গের ধাঁচা।
অন্দরে প্রবেশ করবার আগে সূচিপত্র দেখেই যে প্রশ্নটি মনে জাগে তা হলোঃ সন্ধ্যা-প্রতিমা-আরতির মতো বাঙলার কিংবদন্তী মহিলাশিল্পীগণের নামে একটিও অধ্যায় নেই কেন? গীতিকারগণ তো রয়েছেন, ‘সুরকার’-দের নিয়ে আলোচনা কবে পড়তে পাবো? এ’সব কি বইখানির (হয়ত) আগামীতে প্রকাশিতব্য ‘দ্বিতীয় খণ্ডে’ আসবে? এ’সব কথা তো এখানেই প্রাঞ্জল করে দেওয়ার দরকার ছিল গো, নৈলে নগদ চার চারশোটি টঙ্কা ফেলে যে পাঠক কিনলেন এ’বই তার মনের খট্কা কাটে কী করে?
*
এবারে অন্য গল্পে আসিঃ
১৯৭৫-এর পূজার হিটতম গান মান্না দে-র কণ্ঠে ‘ও কেন এতো সুন্দরী হলো?’ তখন সকল পূজামণ্ডপে-মণ্ডপে বাজছে। বাঙলা গানের জগতের সর্বজনশ্রদ্ধেয়া ‘বড়দি’ সুপ্রভা সরকার সেদিন তাঁর বাড়িতে মেয়েদের টিউশন দিচ্ছেন, আর বারে বারে মাইকে আসা ঐ গানে তাঁর তাল কেটে যাচ্ছে। শেষ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘ওঃ, মান্না যে কী সব গায়! ও সুন্দরী হলো তো তোর বাবার কী?’
বা,
পঞ্চাশের দশকে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য তখন এচ-এম ভি-র ‘বেস্ট সেলার’ গায়ক।
সেবার কর্তৃপক্ষ হঠাৎ তুঘলকি সিদ্ধান্ত নিলো যে শ্যামল-আলপনা-সতীনাথ-উৎপলা-কে দিয়ে পুজোর গান করানো হবে না। প্রতিবাদে ধনঞ্জয় নিজেও সেবার গান রেকর্ড করবেন না বলে জানিয়ে দিলেন। কর্তৃপক্ষ অতঃপর সিদ্ধান্ত বদলে বাধ্য হন। এ’হেন নীতিগত প্রশ্নে আকাশবাণীর সর্বেসর্বা রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গেও টক্কর নিতে পিছোননি ধনঞ্জয়, গড়েছিলেন ‘আর্টিস্টস’ এসোশিয়েশন’। আর হ্যাঁ, এই ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য কিন্তু আদতে এক ঈশ্বরভক্ত আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ ছিলেন, কোনো হার্ডকোর কম্যুনিস্ট নন।
বা,
১৯৫৮-এ’ তারাশঙ্করের লেখা ‘ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি’ গেয়ে মান্নাবাবু গানটিকে এক কিংবদন্তীর পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন (আজও সমান জনপ্রিয়)। তাই তার কিছু পরে পরেই এর কাছাকাছি কোনো ভাবের একটি গানকে জনপ্রিয় করে তোলা সহজ কাজ ছিল না, বিশেষতঃ গীতিকার যার তারাশঙ্কর নন। পুলক বন্দ্যো. তাই তাঁর ‘ও দয়াল বিচার করো দাও না তারে ফাঁসি’ গাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং শচীনকর্তার কাছে, বোম্বাইতে। কিন্তু কর্তার অন্য পূর্ব-সিদ্ধান্তের কারণে তিনি গাইতে না পারলে পুলক এক পোস্টকার্ডে লিখে গানটি কলকাতায় পাঠিয়ে দেন অখিলবন্ধু ঘোষের ঠিকানায়। বাকিটা ইতিহাস। দুঃখের কথা, সাধক-গায়ক অখিলবন্ধু কিন্তু সেকালে হেমন্ত-মান্না-ধনঞ্জয়-জগন্ময়ের ছায়ায় কোনোদিনই এক নম্বর আসনটির ধারেকাছেও যেতে পারেননি।
*
এ’হেন ছুট্কাহানি (anecdote) ছড়ানো এ’বইয়ের পাতায় পাতায়, যা আদারওয়াইজ অ-সুখপাঠ কে-ও উপভোগ্য করে তুলেছে।
‘আদারওয়াইজ অ-সুখপাঠ’ বললাম কেন? কারণ সারা বই জুড়ে লেখকের কলম যেন ছাড়া-ছাড়া ‘ডিজিট্যালি’ এগিয়েছে শূন্য-এক শূন্য-এক করে করে, নদীর স্রোতের মত ‘এনালগি’ নয়। বিচার, অবশ্য, আমার সম্পূর্ণই ব্যক্তিগত; আমি তো ভুল হতেই পারি। এ’ বই তাই পুলক বাঁড়ুয্যের ‘কথায় কথায়...’ নয় [গ্র.স.ঃ পরবাস, সংখ্যা-৫০], বা অভিজিৎ বন্দ্যো.র ‘গানের গল্প....’ নয় [গ্র.স.ঃ পরবাস, সংখ্যা-৬৩]. যদিও, আর্কাইভাল ভ্যালুতে নির্মল নাথ মশায় এঁদের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকেন। দুই মলাটের মধ্যে প্রাপ্ত শত শত সুখপাঠ্য ও প্রয়োজনীয় তথ্যের খাতিরে এই বইকে মাথায় করে রাখতে হবে।
*
শেষে কয়েকটি অপছন্দের কথা বলবো? বলিঃ
এক. একই কেতাবে এতো এতো মুদ্রণপ্রমাদ দেখতে পাওয়া বড়ই দুর্ভাগ্যের ফল। এমনকি, টাইটেল পেজে ‘মূদ্রক’ লেখা হয়েছে, জহর সরকার-লিখিত ‘মুখবন্ধ’-টির প্রথম পাতায় দুইটি মুদ্রণপ্রমাদ। শতবর্ষ প্রাচীন ‘এম সি সরকার এন্ড কোং’ যদি এমন কাজ করে... !
দুই. কালানুক্রমিক বিভাজনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে লেখক কী কারণে ত্রিশের দশকের দলে ঠাঁই দিলেন বুঝলাম না।
তিন. চমৎকার বইটির প্রচ্ছদ এক্কেবারেই শিল্পোত্তীর্ণ হয়নি। স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্তের বইয়ের ঘোর কালিমালিপ্ত বর্ণটি বিশেষ অপছন্দের কারণ হয়েছে। পরিকল্পনাহীন যেমন-তেমন প্রচ্ছদ।
চার. এমন এক কোষধর্মী গ্রন্থের পৃষ্ঠমলাটে এক সুলিখিত ব্লার্ব থাকা বিশেষ জরুরি ছিল। নেই।
পাঁচ. বইয়ের জ্যাকেটে (‘তৃতীয়’ প্রচ্ছদে) লেখক-পরিচিতি অতি অনুপাদেয় লিখন হয়েছে, যেখানে লেখকের চাইতে তাঁর বাপ-দাদা-কাকার পরিচয়ই দীর্ঘ হয়ে পড়েছে।
না বাবা, আর লিখবো না, কারণ তাতে বইটির নেগেটিভ দিকটাই বড় হয়ে উঠছে, যেটা এই গ্রন্থ-সমালোচনা লেখবার উদ্দেশ্য মোটেই নয়।
আলোচ্য গ্রন্থটি এক অতি প্রয়োজনীয় সঙ্গীত-ইতিহাসকোষ--এই তথ্যটিই ধরা থাক শেষে। এবং এ’ বই স্থায়ী স্থান করে নিক আপনার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে।
অচলন্তিকাঃ লুপ্ত ও অচলিত শব্দের অভিধান--বিশ্বনাথ জোয়ারদার; ‘গাঙচিল’ প্রকাশনা; কলকাতা ৭০০১১১; ISBN: 978-93-84002-13-8
ফেব্রুয়ারি ২০১৪তে, অর্থাৎ পাঁচ বছর আগেই কলকাতা থেকে এমন একখানি অসাধারণ কোষগ্রন্থ বেরিয়ে গেছে, আর এই অধম গ্রন্থ-সমালোচক তার খবরটুকুও রাখে না--ভেবে নিজগণ্ডেই ঠাস্ ঠাস্... কারণ বাংলা শব্দ-বানান-ব্যবহারের উপর লিখিত কোষগ্রন্থের বিশেষ কদরদান ভাবি নিজেকে, এবং ‘পরবাস’-এর এই কলমেই এমন এমন বেশ কিছু গ্রন্থের সমালোচনা বেরিয়েছে [উদা. ঃ ‘পরবাস’-সংখ্যাঃ ৪৩, ৫২ , ৫৪, ৬২, ৬৫, ৬৮ ]
বলা বাহুল্য, ইঙ্গভাষায় এমন ‘অপ্রচলিত শব্দকোষ’ অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে, যেমন, ‘The American Heritage Dictionary of the English Language’ (প্র. প্র. ১৯৬৯), যদিও তার সম্পাদক উইলিয়ম মরিস সাহেবকে মদত দিতে শতাধিক পণ্ডিতের এক দল ছিল, আর এখানে আমাদের জোয়ারদার সাহেব নিছক্কা একেলা। আরও উল্লেখ্য, লেখক বিশ্বনাথ জোয়ারদার (১৯৪৪-২০১২ খৃ.) মহাশয় কিন্তু পেশাদার অভিধানকার/ভাষাবিদ্ ছিলেন না, ছিলেন এক নৃতত্ত্ববিদ্ ও সমাজতাত্ত্বিক। ভারতে প্রস্টিটিউশন-সমস্যার উপরে ওঁর বিশ্বমানের বইও রয়েছে (পড়িনি), রয়েছে কলকাতার ইতিহাসের উপর চমৎকার একটি বই (পড়েছি)। তা, প্রেসিডেন্সি কলেজের উপর লেখা পরিসংখ্যানবিদ্ অধ্যা. বিশ্বনাথ দত্তের ইতিহাসগ্রন্থের কথাও তো আমরা পড়েছিলাম (পরবাস, সংখ্যা-৫০ )। অর্থাৎ, কাজটাই আসল, লেখকের পরিচিতিটি তত নয়। যেমন এই বইটি। মস্তকোপরি ভিন্ন স্থান হয় না এ’ গ্রন্থের।
*
চালু, অর্থাৎ প্রচলিত শব্দের সহজ-ব্যবহার্য অভিধান লিখে গিয়েছিলেন প্রণম্য রাজশেখর বসু মহাশয়, তাই তার নাম ‘চলন্তিকা’, যে অভিধান আজ আশি বছর বাঙালীর ঘরে ঘরে নিত্যব্যবহার্য। আর বিশ্বনাথবাবুর এই অপ্রচলিত শব্দের অভিধান ‘অচলন্তিকা’ সাড়ে পাঁচশত পৃষ্ঠার এক মহাকোষগ্রন্থ যাতে প্রায় তিন সহস্র সংখ্যক প্রবিষ্টি (entry) আছে ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যাই যে বাংলাভাষায় এতো অপ্রচলিত বা লুপ্ত/লুপ্তপ্রায় শব্দ ছিল/আছে?? ওরেঃ বাপ্ রে!
শ্রীদিব্যজ্যোতি মজুমদার-লিখিত ‘মুখবন্ধ’-টি নিজেই এক স্বর্ণখনি, যাতে তিনি হরিচরণ-জ্ঞানেন্দ্রমোহন-সুবলচন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করে করে দেখিয়ে দিয়েছেন বিশ্বনাথবাবু ঠিক কোনখানটায় অনন্য। এমন ‘মুখবন্ধ’ পড়তে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়!
*
শিবের গীত পেরিয়ে এবার শব্দ-রাজ্যে ঢুকি।
ভাষাতত্ত্ব, আরও বিশেষ করে বললে শব্দ-তত্ত্ব, যে ইতিহাস খোঁড়ার এক গাঁইতি, সেটা এমন লুপ্ত(প্রায়)শব্দের এক অভিধান ঢুঁড়লে আরও বিশেষ করে বোঝা যায়।
উদা. কলকাতার বৃহত্তম ‘নাখোদা মসজিদ’ তৈরি করেছিলেন গুজরাটাগত কচ্ছি-মুসলমান দরিয়াগামী বণিকগণ--‘নাখোদা’ শব্দের অর্থ ‘নাবিক’। লুপ্ত না হলেও লুপ্তপ্রায় শব্দ। পেলাম এই গ্রন্থে। আরেকটিঃ যেমন, হুতোম লিকে গেচেন, ‘বৈঠকখানার মেকাবি ক্লাকে টাং টাং করে পাঁচটা বাজ্লো...’ (James) McCabe & Co ছিলেন সেকালের এক প্রখ্যাত ওয়াচমেকার--নাম শুনে স্কটিশ মনে হলেও ইনি কিন্তু আসলে আইরিশ ছিলেন। চারটি প্রবিষ্টি রয়েছে এই গ্রন্থে। রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ উপন্যাসে মৃন্ময়ীর তোরঙ্গের মধ্যে ‘রুবিনির ক্যাম্ফর’ থাকার কথা রয়েছে। একটি প্রবিষ্টি রয়েছে এখানে। বঙ্কিম যে ‘রাজসিংহে’ মহিষীদিগের পৃথক ‘রেউলা’ থাকার কথা বলেছেন, মারাঠি-আগত [‘রাউল’ (অন্তঃপুর)] সেই শব্দেরও উল্লেখ পেলাম। ‘তাফতা’ [অর্থঃ রেশম-পশমের শীতবস্ত্র] ---রয়েছে এখানে।
প্রায় প্রতিটি প্রবিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাসাহিত্য থেকে সেঁচে আনা এক এক বাক্যের উদাহরণ গ্রন্থখানির এক অসামান্য আভরণ।
২. কিছু কিছু শব্দ প্রাচীন বা লুপ্তপ্রায়। যেমন, এখানে পাচ্ছি, ‘রুপি’। অর্থ, লালমুখো বাঁদর। ‘রুপি বাঁদর সাজা’ বা ‘রুপি বাঁদরকে নাচানো’--চলতি কথায় এমন ব্যবহার আমরাও বাল্যকালে শুনেছি। এদান্তে উটে গেচে।
৩. আর বহু বহু শব্দ তো রয়েছে এখানে যেগুলো আঞ্চলিক ও অপ্রচলিত--কোন্ অর্থে? স্থান-কালের নিরিখে। এতো বৃহৎ বঙ্গদেশে, এ’তো স্বাভাবিক, যে শব্দ শ্রীহট্টে চালু, তা বাঁকড়োয় অ-চালু। ঐ যে উপরে ‘নিছক্কা’ [অর্থঃ নিছক। এক্কেবারে] বা ‘এদান্তে’ [অর্থঃ ইদানিং] লিখলুম, সেগুলো আমাদের হুগলী-বর্ধমান জেলায় সুপ্রচলিত, অন্যত্র নয় (এই অভিধানেও উল্লেখ পাইনি)।
৪. ‘রিয়াদ’, ‘তাপঝাল’, ‘খষ্টি খর্ষণা’ [টেকচাঁদ-ব্যবহৃত শব্দ]… প্রভৃতি অনেক অনেক শব্দ রয়েছে যেগুলি প্রকৃতই অপ্রচলিত/লুপ্ত। দুই মলাটের মধ্যে এমন এমন শব্দের ভাণ্ডার পেয়ে যাওয়াটা সৌভাগ্যের, কারণ অন্য কোনো অভিধানে এদের খুঁজে পাওয়া যাবে না কো।
৫. ভিন্নার্থ শব্দঃ ‘রুধির’ [অর্থঃ রক্ত, টাকা]; ‘মূর্ছনা’ [অর্থঃ খলে আয়ুর্বেদিক ঔষধের শোধন]; ‘জোকার’ [অর্থঃ উলুধ্বনি]; ‘জুয়া’ [অর্থঃ জোগানো... ভারতচন্দ্র-ব্যবহৃত]; ‘খাই’ [গহ্বর । ‘খাঁই’ নিন্দার্থে ক্ষুধা--এখানে নেই ] … ইত্যাদি ইত্যাদি এমন অনেক শব্দ পাচ্ছি যেগুলি সাধারণতঃ চালু অর্থটিতেই বেশি ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অন্য অর্থও তো রয়েছে। ভাগ্যিস বিশ্বনাথবাবু মনে করিয়ে দিলেন, ভুলেই ছিলাম যে নৈলে।
৬. এক্কেবারেই ঘরোয়া চালু শব্দ—আছে/নেইঃ
‘ল্যাদাড়ে’ [অর্থঃ অতি অলস], ‘দাঁদুড়ে’ [অর্থঃ সদম্ভ উপস্থিতি]; ‘নেই আঁকড়া’ [অর্থঃ নাছোড়বান্দা];--এমন শব্দও অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে দেখে ভালো লাগল,
আর…
‘আঁৎলা’ [অর্থঃ অপটু হাতে কোনো কাজের প্রচেষ্টা করা, বা কিছু খোঁজা], ‘অলবড্ডে’ [অর্থঃ যে লোক বা বুড়ো মানুষ গুছিয়ে কোনো কাজ করতে পারে না], ‘ফাঁট’ [অর্থঃ লোক-দেখানো ], ‘আঁতিপাঁতি’ [অর্থঃ প্রবল প্রচেষ্টায় কিছু খোঁজা. ক্রি বিণ. ], ‘হুপোশাস্তর’ [অর্থঃ আগাম সূচনা বিনা চলে আসা, বা কিছু কাজ করে ফেলা], ‘থুসি/আলতুসি’ [অর্থঃ অল্পেতেই কাতর আদুরে মেয়ে। বিণ. ]...--এমন এমন শব্দগুলি এই অভিধানেও নেই? দুখী হলাম। তাহলে কি এই সব শব্দগুলি ক্রমে এক্কেবারেই হারিয়ে যাবে গো?
6. কিছুকিছু শব্দ অবশ্য লুপ্তপ্রায় বা অচলিত একেবারেই নয়। তাই এই অভিধানে এদের স্থান পাওয়া প্রশ্নাতীত কি? উদা. ‘সেবা’, ‘পয়জার’, ‘রিরংসা’, ‘তাড়াতাড়ি’, ‘খলু’ (সংস্কৃত শব্দ)।
*
শেষে লিখি, ‘অচলন্ত’ বলে কোনো শব্দেরই আস্তাকুঁড়ে ঠাঁই হয় না, হতে পারে না। গবেষকের অনুসন্ধান ছাড়াও এমন এমন শব্দ ইতিহাসের জ্যান্ত দলিল। হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না এদের। বড় আদরের ধন যে এই সব লুপ্তপ্রায় শব্দ---কত কত শৈশবের স্মৃতি, কত কত মা-ঠাকুমার গলার স্বর, গায়ের সুবাস মিশে আছে গো এই এই শব্দগুলির মধ্যে।
দুঃখ হয়, বড্ড দুঃখ হয় যে এমন একটি অসাধারণ অভিধান তেমন প্রচার কেন পায় না?
এ’তো বঙ্গসাহিত্যের আভরণ!
প্রকাশক গাঙচিলের প্রোডাকশন চমৎকার, অতি চমৎকার।
বাংলা বানানঃ রস ও রহস্য--প্রদীপ রায়গুপ্ত। ‘ঋতাক্ষর’ প্রকাশন, কলকাতা- ৪; ISBN 978-93-84186-25-8
একই, বা কাছাকাছি বিষয়ের উপরে পরপর দুইখানি গ্রন্থ-সমালোচনা পড়তে পাঠকের ভালো লাগবে কি?
ঠিক এমত দ্বিবিধায় পড়েছিলুম ঊনষাট সংখ্যায় [https://www.parabaas.com/PB59/LEKHA/brBhababhuti59.shtml ] কবীরদাসজী ও জ্ঞানদিল দাসজী-র দুইটি বইয়ের কথা পর পর লিখতে গিয়ে।
এখন এখানে শ্রদ্ধেয় প্রদীপ রায়গুপ্ত মহাশয়ের রস ও রহস্য ঘাঁটতে ঘাঁটতে মনে হলো, বিশ্বনাথবাবুর ‘অপ্রচলিত’ অভিধানখানির স্থান মস্তকোপরি হলে, এটির স্থান বুকে, হৃদয়ের বড় কাছাকাছি। কারণ, বানানের মতো এক নীরস বিষয়ের গল্প এমন রসালো ঢঙে কে কবে শুনিয়েছে? [আমাদের কৈশোরে ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকায়, সম্ভবতঃ, জ্যোতিভূষণ চাকী মশাই এমন শোনাতেন]। তাই, এই কেতাবের কথা ‘পরবাস’-এর পাঠকের কাছে এক্ষুণি বলবো না? পেট ফুলে ঢোল হবে যে!
আরও উল্লেখ, রায়গুপ্ত মশাই-ও কিন্তু পেশাদার অভিধানকার বা অধ্যাপক নন, ছিলেন ‘ইন্ডিয়ান রেভেন্যু সার্ভিসের’ উচ্চপদে, এখন অবসরে। ব্লার্বে ওঁকে ‘ভাষাভাবুক’ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটাই ওঁর যথার্থ পরিচয়। আর হ্যাঁ, ইনি উচ্চমানের সাহিত্য-পত্রিকা ‘জলার্ক’-এর সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই।
*
‘বাংলা বানান নিয়ে কোনও সর্বমান্য নীতি নেই’--এক্কেবারে প্রথম বাক্যে এই খেদ দিয়ে শুরু করে লেখক কিন্তু আনন্দবাজারী ‘কী লিখবেন কেন লিখবেন’-এর ঢঙে ফরমান দিতে বসেননি, বরং যুক্তি দিয়ে গল্প করে বলছেন, কেন এই বানানটি ঐটির চাইতে সংগততর ও অনুসৃতব্য? এই ভঙ্গিমাটি বড় ভালো লাগল। যদিও ওঁর সুপারিশগুলি সব যে মানি বা মানতে পারি বা সকলে মানে তা তো নয় (তাহলে বইটি লিখবারই প্রয়োজন হতো না)। তবু বড় সুখপাঠ্য। আরে এটাই সবচেয়ে বড় গুণ, কারণ বাংলা বানান নিয়ে পুবে-পশ্চিমে অজস্র বই হয়েছে, হয়ে চলেছে। তার মধ্যে এটিই পড়তে এতো ভালো লেগে গেল কেন? এটিকেই বুকে ধরে রাখবো কেন?
*
বাংলা বানানের একরূপতা আনবার প্রচেষ্টায় বড় বাধা ‘অধিক সন্ন্যাসী’। কলি. বিশ্বের ১৯৩৬-৩৭-এর বিধি মানব না ঢাকা ‘বাংলা একাডেমী’, না ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’, না আনন্দবাজারী না সংসদ? প্রত্যেকেই মোড়ল। এখানেই লক্ষ (না, ‘লক্ষ্য’?) করুন, সারস্বত-সংস্থার গ্রীক অভিধাটির বঙ্গীকরণও এপার-ওপার দুই বানানে করেছে। কে ঠিক? সেই বিতর্কে না গিয়ে প্রদীপবাবু যে যে বিষয় নিয়ে গপ্প করেছেন তার দু’একটি শিরোনাম দেখলে বইটির সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা হয়ে যায়ঃ
‘ধাতু থেকে শব্দে’, ‘অনুস্বার বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু’, ‘হাইফেনায়িত হাইফেন’, ‘ঋষি ও কাঠবেড়া৯’, ‘সাক্ষী শুধু বিশালাক্ষ্মী’--এমন বিশখানি নিবন্ধ রয়েছে এখানে। হ্যাঁ, বইখানি প্রবিষ্টি (entry) ধরে ধরে অভিধানের ঢঙে নয়, গল্পচ্ছলে নিবন্ধাকারে লেখা। পড়ে পড়ে চলে যেতে বড় ভালো লাগে তাই। সর্বশেষ নিবন্ধখানি ২০০৪ সনে ‘দেশ’-পত্রিকায় প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আমাদের হ্রস্সি দীর্ঘি জ্ঞান’-এর পাঠ-প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঐখানে প্রকাশিত একখানি দীর্ঘ পত্র। অসাধারণ সেই চিঠির মান। এমন চিঠি পড়তে পাওয়া ভাগ্যের কথা। #
*
প্রতিটি নিবন্ধ ধরে ধরে এখানে আলোচনার উপায় নেই, দরকারও। তবু পড়তে পড়তে যেমন যেমন মনে হয়েছে, দু’কথা বলি।
বানানের একরূপতা আনবার প্রয়োজন কী, আর না আনলে কী অনর্থই বা হয়ে যাচ্ছে? জানি, মোর এই অর্বাচীন প্রশ্নে গুণিজন ভ্রূকুঞ্চন করতে পারেন, কিন্তু নেহাৎ শিশুপাঠক ও বিদেশিপাঠক ছাড়া ‘মত’ আর ‘মতো’, ‘তা’ছাড়া’ আর ‘তাছাড়া’ , বা ‘কি’ না ‘কী’--এমন এমন বিভ্রান্তিতে কেউ ভুগবেন বলে মনে হয় না। লেখক নিজেই উল্লেখ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-বিভূতি-তারাশঙ্করও আজীবন তাঁদের লেখায় একই বানান বিধি মেনে চলেন নি (পৃ. ৪৩)। ‘ইংরেজিতে আমরা অক্লেশে easy এবং easily; knife এবং knives; repeat অথচ repetition এবং climax কিন্তু climatic লিখি। কৈ, তখন তো বানান-বৈষম্যের অভিযোগ তুলি না?’
বড্ড হক কথা।
*
তা বলে কি বাংলা বানান নিয়ে ‘অরাজকতা’ চলতেই থাকবে? তা বলে কি বর্তমান বইটির মতো বই-এর কোনোই প্রয়োজন নেই?
কে বললে? আলবাৎ (না, ‘আলবাত’) আছে। কর্ষণ না হলে উর্বরতা আসবে কী করে গো? শুধু, প্রদীপবাবুর মতোই ‘সংগততর’ বানানের দিকেই আমরা ঝুঁকে থাকবো, বাজারী ফরমানকে এড়িয়ে চলবো, কারণ তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। নৈলে, বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবার প্রচেষ্টাতেই কাল যাবে, ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি আটকে যাবে (যেটাই কিনা বানান সংশোধনের কারণ)।
*
# সর্বশেষ নিবন্ধখানি একটি স্বর্ণখনি। এখানে চারপাঁচ পৃষ্ঠার মধ্যে এতো এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছুঁয়ে গেছেন প্রদীপ—অচিন্ত্যনীয়। বাংলাকে সরলীকরণের প্রচেষ্টায় বস্তুত তার মূলোৎপাটন সেই পূর্ব পাকিস্তানের কাল থেকে আবুল মনসুর আহমদ, পেটোয়া-কবি গোলাম মোস্তাফা-ফররুখ আহমদ-রা ভয়াবহভাবে করে গিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে বিদ্যাসাগরীয়-বঙ্কিমী বাংলার তৎসম স্পর্শ মাত্রই ছিল বুৎপুরুস্ত হিঁদুয়ানীর পরাকাষ্ঠা। কিন্তু ২০০৪ সনে কলকাতায় বসেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বিত্ব বর্জনের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে ‘সন্ন্যাসী’ বানানের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন প্রদীপ, ‘এখন, তিনতলা অক্ষর ভেঙে দোতলা করতে গিয়ে যদি সন্নাস লিখি, তাহলে তো উপন্যাস না লিখে উপনাস এবং বিন্যাস না লিখে বিনাস লিখতে হয়। ...সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মগুলি এতই যুক্তিপূর্ণভাবে তৈরি ও পরস্পরের সঙ্গে এতটাই সম্পর্কযুক্ত যে খাপছাড়াভাবে এখানে-ওখানে হাত দিলে ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাবে।’
আর তা আমরা করবোই বা কেন? বাংলাভাষার মূল সংস্কৃত থেকে--এই সত্যটিকে উপেক্ষা করা যায়? কেনই বা তা করতে হবে? ভাষা পড়বো কিন্তু ব্যাকরণ জানবো না, আর সেটা না জেনেই স্বেচ্ছাচারিতার বশে সরলীকরণ চাইবো আর তার জন্যে মূলে দেবো টান--এগুলি নিছক অসভ্যতা। পৃথিবীর কোন্ সভ্যভাষাভাষী মানুষ নিজভাষার উপর এহেন উৎপাত সহ্য করে নেয়, জানিনা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এমনকি, সরল ‘মাছ’ শব্দ বাংলায় রয়েছে বলে তৎসম ‘মৎস্য’ ও ‘মীন’ শব্দ রাখায় আপত্তি করেছিলেন, ও ‘মাছমন্ত্রী’ লেখার সুপারিশ করেন। ‘একাধিক প্রতিশব্দ থাকাটা একটি ভাষার বৈভব সূচিত করে’ জানিয়ে চমৎকার লিখেছিলেন প্রদীপ যে সেক্ষেত্রে ‘মীনাক্ষী’ নামের মেয়েটিকে ‘মাছাক্ষী’ বলে ডাকা যাবে কিনা। হেঁ হেঁ হেঁ !
*
নতুন প্রকাশনালয়ের কাজ চমৎকার। একটিও মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়েনি।
দশে দশ পাওয়ার মত বই একটি!
The Mediterranean in History--Edited by David Abulafia, M/s Thames & Hudson Ltd, London; First published 2003; ISBN 978-0-500-29217-4 ইউরোপের ইতিহাসের উপরে, বিশেষ করে আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস নিয়ে কম ভালো ভালো বই তো আর লেখা হয় নি; নর্মান ডেভিস সাহেবের বইটির কথা এক্ষুণি মনে পড়ছে; ডেভিড মেসনের বইটিও বিশেষ কাজের। ডেভিড টমসনের ‘ইউরোপ সিন্স নেপোলিয়ন’ তো কলেজে আমাদের টেক্সটবই-ই ছিল, যে বই এখনও সময়ে সময়ে পাতা উল্টে-পাল্টে দেখি।
কিন্তু, ইউরোপের ইতিহাস তো আর কেবল তার স্থলভূমির ইতিহাসই নয়---ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়া--, কারণ সমুদ্র-জলযাত্রা-জলযুদ্ধ এতো অঙ্গাঙ্গীভাবে ইউরোপীয় ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে যে জল-কে না চিনলে ইউরোপকে চেনা যায় না (ঠিক এ’কথাটা, যেমন, ভারত ইতিহাসের ক্ষেত্রে সেভাবে বলা চলে না)। অতলান্তিক মহাসাগর না-হয় পঞ্চদশ শতকের শেষের দিক থেকে ইউরোপীয় রাজনীতি ও জনজীবনকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে, কিন্তু ভূমধ্যসাগর? ভূমধ্যসাগরের ইতিহাস ইউরোপের ইতিহাসের মতোই পুরনো, হয়ত বা তার চাইতেও বেশি (আনাতোলিয়ার হত্তী-দের ইতিহাস ইউরোপেরও আগের)। কিন্তু কেবলমাত্র ভূমধ্যসাগরের ইতিহাসের উপরে কোনো বই আগে আমি পড়িনি, আর এক বন্ধুর পরামর্শে আলোচ্য বইটি কিনে, পড়ে মনে হলো এ বই হাতে না নিলে, না পড়লে নিশ্চয়ই অপূর্ণতা থেকে যেত। গত এক পক্ষকাল বুঁদ হয়ে আছি এই বইখানা নিয়ে, এমনই এর মাদকতা!
*
ম্যগাজিন সাইজের (২৮ সেমি বাই ২২ সেমি) ৩২০ পৃষ্ঠার একটা বই, যাতে ৩০৮ টি চিত্র রয়েছে (তারমধ্যে ১৬১ টি রঙীন), বহু বহু চিত্র পূর্ণপৃষ্ঠাব্যাপী, এবং প্রতিটিই ভূমধ্যসাগরকে বেড় করে থাকা স্পেন-ইতালি-তুর্কি-মিশর-মরক্কো প্রভৃতি দেশগুলির প্রাচীন মন্দির-মসজিদ-গির্জার গা থেকে নেওয়া ফ্রেস্কো/মোজেইক/পেইন্টিং/ফটোগ্রাফ; বহু বহু প্রাচীন মানচিত্র, অনেকগুলি আবার জিয়াকোমেটি বা জাঁ পুই এর মতো নামী দামী ভাস্কর-চিত্রশিল্পীর কাজের রেপ্লিকা। সত্যিই, ‘অপূর্ব’ ছাড়া এ’বইএর পাঠ-প্রতিক্রিয়া আর কিছু হতে পারে না। পাশে পড়ে থাক্ ফেসবুক-ইউটিউবের জগৎ, এমন একখানি বই হাতে পেলে তাতে বুঁদ হয়ে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়--যেন এক ডকুমেন্টারি ফিল্ম স্টিল হয়ে আছে দুই মলাটের মধ্যে।
*
কিন্তু না, এ কোনো পিকটোরিয়াল বুক নয়। পিকটোরিয়াল বুকে ছবিই হয় প্রধান, ভাষ্য গৌণ। বর্তমান বইটিতে টেক্সট হয়ত ছাপিয়ে যায় ছবিকে, বা বলা ভালো গায়ে গায়ে চলে দুইই--কখনও বুঁদ হয়ে ছবির ডিটেইলস দেখতে দেখতে পাঠে ফিরে এলে মনে হয় না যে হারিয়ে গিয়েছিলাম কোথাও। চিত্র ও ভাষ্যের এহেন মধুর যুগলবন্দী কমই দেখতে-পড়তে পাওয়া যায় কোনো বই-এ। কেবল চিত্রগুলির তলায় তলায় লেখা ‘পরিচিতি’ পড়ে পড়েই দিন তিনেক কাটিয়ে দেওয়া যায়।
*
গ্রন্থ-সমালোচক সেজে কলম ধরেছি যদিও, কেতাবটির সম্পাদক ডেভিড এবুলাফিয়া (জ. ১৯৪৯) সম্বন্ধে কিসুই জানতাম না। পরে নেটে ঠুকরে-ঠাকরে জানতে পারলাম যে ইনি একজন খ্যাতনামা কেম্ব্রিজ-ইতিহাসবিদ্, বৃটিশ ইহুদি, যাঁদের পূর্বপুরুষ স্পেনদেশ থেকে এসেছিলেন। এবং এঁর উৎসাহের বিষয়ই হলো সমুদ্রের ইতিহাস, বিশেষতঃ, মধ্য-ও-রেনেশাঁস যুগের দক্ষিণ ইউরোপের ইতিহাস। ঠিক এই বিষয়টির উপরেই ওঁর আরেকটি এমন পিকটোরিয়াল-কাম-টেক্সটবুক বেরিয়েছিল, সেটি ওইউপি থেকে। পেঙ্গুইন থেকে এই অক্টো. ২০১৯ এ’ ওঁর ‘দ্য বাউন্ডলেস সীঃ-- আ হিউম্যান হিস্ট্রি অব দ্য ওশান্স’ বলে আরেকটি বড় বই বেরোতে চলেছে, যার সীমাটি বৃহত্তর। আমাদের নিজস্ব সঞ্জীব সান্যাল মশাই ধ্যান দিন না [https://en.wikipedia.org/wiki/Sanjeev_Sanyal] (ভারত মহাসাগরের উপরে যাঁর অসামান্য একখানি বই পড়েছি গতবছরই)।
*
এইবার বইখানির কন্টেন্টে আসিঃ
মুখবন্ধ সহ এগারোটি অধ্যায় রয়েছে, তার মধ্যে সম্পাদক-লিখিত উপক্রমণিকাটি পড়েই ফ্ল্যাট! ব্যক্তি নহে, পরিবেশ; ব্যষ্টির সিদ্ধান্ত নয়, দীর্ঘকালীন সাংস্কৃতিক বিকাশই ইতিহাসের পরিচালিকাশক্তি, আর সেটাই হৌক্ ইতিহাস-রচনার ইঞ্জিন--- Annales school of historiography-র প্রাণপুরুষ ফরাসী ইতিহাসবিদ্ ফার্নান্দ ব্রাউদেলের (১৯০২-৮৫) এই শিক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে ভাবশিষ্য এবুলাফিয়ার এই গ্রন্থে, এবং তা নিয়েই লেখা ওঁর উপক্রমণিকাটি। তাই, বললাম না, পিকটোরিয়াল বুক বলে উপেক্ষা করবার অবকাশ নেই এই বইটিকে। এর পরের পরের অধ্যায়ে--‘দ্য ফার্স্ট ট্রেডিং এম্পায়ার’ থেকে ক্রিশ্চান ভূ. সাগর, ইসলাম ভূ. সাগর হয়ে বিশ্বযুদ্ধের কাল হয়ে আজকের বিশ্বায়নের যুগের ভূ. সাগরের ইতিহাস লিখতে চার মহাদেশ সেঁচে সম্পাদক মশাই ডেকে এনেছেন স্যর অলিভার রকহ্যাম, মিশেল বালার্দ, মলি গ্রীনের মতো নামী ইতিহাসবিদদের!
*
এটি অবশ্য ঠিক গ্রন্থ-সমালোচনা লেখা হচ্ছে না, হয়ে যাচ্ছে অত্যুচ্ছ্বাস!
বাকিটা পাঠক পড়ে নেবেন।
পুনঃ—পরিশিষ্টে এই রকম হাতের কাছে তৈরি এক Further Reading List পাবার জন্যেই বইখানি কিনে ঘরে রাখতে হবে।