যার যা ধর্ম—মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। ‘প্রথমা’ প্রকাশন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। প্রথম প্রকাশঃ ২০১৪ ISBN 978 984 8765 80 7
আধুনিক বাংলা/বাঙালী তথা বাংলাদেশের সারস্বত মুখখানি যে-কয়জন বিদ্বজনের জীবন ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভাস্বর হয়ে ওঠে, উঠেছে, তার মধ্যে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সাহেব (১৯২৮-২০১৪ খৃ.) একজন প্রধান। অক্সফোর্ডের হিস্ট্রি-গ্রাজুয়েট, ব্যারিস্টার, পেশায় অধ্যাপক ও ব্যবহারজীবি, উনি ১৯৯৫-এ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। ওঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা শতখানেক হবে বোধহয়, তার মধ্যে কয়েকটির শীর্ষনাম দেখলে ওঁর জ্ঞানের পরিধির সামান্য অনুমান করা যেতে পারেঃ ‘ভাষার আপন পর’ ও ‘যথাশব্দ’ [বিষয়ঃ বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ], ‘কোরানসূত্র’, ‘গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ’, ‘রবীন্দ্রবাক্যে আর্ট, সঙ্গীত ও সাহিত্য’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আবুল মনসুর আহমদ ... থেকে... সরকারী-কবি গোলাম মোস্তাফা, ফররুখ আহমদের নেতৃত্বে ১৯৬০এর দশক থেকে যখন অনৈস্লামিকতার দায়ে রবীন্দ্রনাথ তথা বঙ্গভাষারই de-sanskritization চলেছে পূর্ববঙ্গে, তখন যে-ক’জন মানুষ এই কুরুচিকর সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন হাবিবুর রহমান-সাহেব তাঁদের মধ্যে প্রধান একজন। তাঁরই ভাষায়, “...হঠাৎ করে আকস্মিক দুর্ঘটনায় বাংলা ভাষায় সব লেখা যদি মুছে যায়, কেবল রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী বেঁচে থাকে, তবু আমরা তাই নিয়ে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।”
*
না, এ’ “ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া” হলো না। বাংলাভাষায় লিখিত একটি সর্বধর্মীয় বিশ্বকোষের এই আলোচনায় অভিধানকারের পরিচিতি ততটাই জরুরি যতটা ‘ডিভাইন কমেডি’ পড়তে গিয়ে দান্তের। তাই, আলোচ্য এই অভিধান লেখার জন্য হাবিবুর রহমান সাহেবের চাইতে যোগ্যতর ব্যক্তি হয়ত আর কেহ ছিলেনইনা বাঙলাভাষায় (হ্যাঁ, আমি প্রয়াত সুধীরচন্দ্র সরকারের কথা মাথায় রেখেই বলছি)। এই অভিধানের স্থান তাই মস্তকোপরি, স্থায়ী আবাস নিজস্ব গ্রন্থাগারে।
*
‘ধর্ম কাহাকে বলে?’
প্রশ্নটি একবার বড়দা-কে শুধিয়ে দেখুন না [এখানে ‘বড়দা’ বলতে ‘গুগুল’-দাদা বুঝতে হবে], কত হাজার হাজার জবাব আসে। ছোড়দা ‘উইকি’ প্রথম বাক্যেই অবশ্য বলিয়া দেন, ‘Scholars have failed to agree on a definition of religion’. বোঝো! যে বিষয়ের কোন সর্বমান্য সংজ্ঞাই হয় না, তার উপরে লিখতে হবে এক অভিধান?! অত্যন্ত কঠিন নয় কি টাস্কটা? রবীন্দ্রনাথ, অবশ্য, ধর্মকে সর্বত্রগামী প্রভাত আলোকের সঙ্গে তুলনা করেছেন, বলেছেন, ‘...তাহা ঈশ্বরের আপনাকে দান। তাহা নিত্য, তাহা ভূমা। তাহা আমাদিগকে বেষ্টন করিয়া, আমাদের অন্তরবাহিরকে ওতপ্রোত করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছে। তাহাকে পাইবার জন্য কেবল চাহিলেই হইল, কেবল হৃদয়কে উন্মীলিত করিলেই হইল।’ এই হৃদয়কে উন্মীলিত করবার সোপানই তো (গুরুবাক্যের মতো) এক কেতাব... ‘কেতাবের কেতাব’ হলো যে অভিধান!
*
প্রায় পৌনে চারশ’ পৃষ্ঠার এই অভিধানখানি হাতে নিয়ে, একটু একটু পাতা উল্টিয়ে প্রথমেই জানতে ইচ্ছা হয়, কতদিন সময় লেগেছিল ব্যস্ত মানুষটির এতোবড় এক অভিধান সংকলন করতে? না, ভূমিকাতে লেখা নাই। বস্তুতঃ, প্রকাশকের পক্ষ থেকে কোন ভূমিকাই নাই এই বইয়ের, যেটার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। অন্ততঃ, কত-সংখ্যক ভুক্তি (entry) রয়েছে এখানে, সেটা জানানোও তো প্রকাশকের একটা দায়িত্ব। ক্রেডিট-পেজে কেবল লেখা রয়েছে, ‘পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত প্রথম প্রথমা সংস্করণ’ ফেব্রুয়ারি ২০১৪। [এখানে ‘প্রথমা’-ও লেখেনি] বেশ। এ’সব থাক না। আসল বইটার কথায় আসি। সেটি তো অমৃতসমান!
*
‘নেই কেন’?
যে কোনো কোষগ্রন্থ হাতে পেয়ে প্রথমেই চেনা-অচেনা কোনো একটি ভুক্তির খোঁজ করাটা বড্ড স্বাভাবিক। সেটি না পেলে শুরু হয়ে যায় ‘নেই কেন’-র জিজ্ঞাসা। মধ্যপ্রাচ্যের আব্রাহামীয়, ভারতীয় ও পূর্বএশীয় মিলে পৃথিবীতে ‘প্রতিষ্ঠিত’ ধর্মই তো রয়েছে মাত্র দশটি (ইহুদি, খৃশ্চান, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, কনফুসিয়, পারসীক, শিখ, বাহা’ই্)। ঈশাই, ইসলাম, হিন্দু-র মতো ধর্মের সম্বন্ধে অনেকানেক ভুক্তি তো থাকবেই এই অভিধানে, স্বাভাবিক, তাই একটু নবীন একটু সংখ্যালঘিষ্ঠের ধর্ম ‘শিখ’ সংক্রান্ত এন্ট্রি খুঁজছিলামঃ ‘শিখ’, ‘গুরু নানক’, ‘গুরু গোবিন্দ’, ‘স্বর্ণমন্দির’ ইত্যাদি ইত্যাদি। একটিও নেই দেখে প্রথমেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সারা পৃথিবীব্যাপী অন্ততঃ দশটি দেশে তিন কোটি শিখধর্মাবলম্বী মানুষ বাস করেন এবং ভারত, বৃটিশ যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো দেশে শিখগণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগ্রহণ করে আছেন। বাংলাভাষায় প্রকাশিত এক সর্বধর্মীয় অভিধানে তাই শিখধর্মের নামোল্লেখমাত্র থাকবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। যদিও, ‘গ্রন্থসাহেব’ বলে একটি প্রবিষ্টি (entry) এখানে রয়েছে এবং সেটি ছোট্টর উপর অতি সুলিখিত প্রবিষ্টি। শিখপন্থের চাইতেও নবীনতর ইরানীয় বাহা’ই ধর্ম (দিল্লিতে যাঁদের অপূর্ব এক স্থাপত্যকীর্তি রয়েছেঃ ‘কমল মন্দির’)। খুঁজছিলাম প্রতিষ্ঠাতা বাহাউল্লাহ্-র নাম। নেই। যদিও ‘বাহাই’ বলে এক সুলিখিত প্রবিষ্টি রয়েছে, কিন্তু সেখানে এঁর আদিনামে মুদ্রণপ্রমাদ (‘নুরি’ হবে, ‘লুরি’ হয়ে গেছে)। ‘আহম্মদিয়া’ বা ‘কাদিয়ান’ বা ‘মীর্জা গোলাম আহমদ’ বলে কোন ভুক্তি নেই দেখে ব্যথিত হয়েছি, কারণ পাকিস্তান কাদিয়ানীদের ব্যান করেছে, এক বঙ্গাভিধান তা করবে কেন?
*
‘আছে কেন’?
দ্বিতীয় প্রসঙ্গঃ ‘উপযুক্ততা’। মানে, এক ধর্মীয় অভিধানের পক্ষে কোন্ কোন্ ভুক্তি উপযুক্ত, কোনটাই বা অনুপযুক্ত। উদা. ‘ঠগী’, ‘বয়ঃসন্ধির উৎসব’, ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম শিক্ষা সমিতি’, ‘সিগমুন্ড ফ্রয়েড’ ইত্যাদি ইত্যাদি (পুরো অভিধানটিই তো আর একবারে বসে পেড়ে ফেলিনি, সেটা সম্ভবও নয়)। একটি ধর্মীয় অভিধানে এই এই সকল ভুক্তি দেখতে কি পাঠক আশা করেন, বা প্রয়োজনে গ্রন্থাগারের তাক থেকে এই বই পেড়ে নিয়ে খুঁজবেন কি এন্ট্রিটা? সূঁচ কিনতে তো আর কেউ ইমারতী দ্রব্যের দোকানে যায় না, না? যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এক অনন্য শিক্ষাব্রতী ছিলেন, বাঙলায় মুসলিম নবজাগরণের এক প্রাণপুরুষ! কিন্তু এক ধর্ম-অভিধানে তাঁর স্থান কী সূত্রে? সেদিক দিয়ে দেখলে প্রথম হিন্দুবাঙালী কোরান-অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্রের নাম এখানে না পেয়ে হতাশ হয়েছি। হাজী মহম্মদ মহসীন নেই, কিন্তু কাশ্মীররাজ জয়নুল আবেদিন আছেন! বিভ্রান্তিকর।
তৃতীয় প্রসঙ্গঃ প্রামাণিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা। এই একটি নিরিখে আলোচ্য অভিধানখানি দশে সাড়ে নয় পায়। দীর্ঘ একখানি গ্রন্থসূত্র রয়েছে পরিশিষ্টে, যার প্রতিটিই প্রামাণ্য গ্রন্থ। অভিধানটির প্রতিটি প্রবিষ্টিই এতো সযত্নলিখিত, অতিকথন নেই--অভিধানের এক এক ভুক্তি (entry) কী ভাষায় কতটা নির্মেদভাবে লিখতে হয়--এই অভিধান পড়ে তা শেখা উচিত। কিছু কিছু ভুক্তি তো বিশেষভাবে মন কেড়ে নিয়েছেঃ যেমন, ‘দুঃখ’, ‘সিজদা’, ‘শিব’, ‘শিরক’। তাহলে, ভাই, ঐ সাড়ে পাঁচ পার্সেন্ট কাটলে কেন? সেটা যতটা না তথ্যবিচ্যুতি বা তথ্যবিতর্ক, তার চাইতে বেশি ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর ফারাক। সে কথা এত কম পরিসরে বলা যাবে না।
সর্বশেষ বিষয়ঃ গুরুত্ব ও ব্যাপ্তি।
(স্বাভাবিকভাবেই?) ইসলামীয় ধর্মেতিহাস অধিক গুরুত্ব পেয়েছে এই কোষে। পবিত্র কোরানের ১১৪ টি সুরাহ্-র মধ্যে ১০৯টির জন্যেই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র প্রবিষ্টি রয়েছে (বাকি পাঁচখানি সুরাহ্ বাদ গেল কেন বুঝতে পারলাম না)। অন্য অন্য ধর্মের প্রসঙ্গে এত পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রবিষ্টি নেই।
*
আলোচনা শেষের বিতর্ক ‘প্রথম’ নিয়ে। প্রকাশক এটিকে ‘বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান’ বলে ঘোষণা করেছেন প্রচ্ছদেই। ‘প্রথমা’-র প্রকাশঃ ফেব্রু ২০১৪ ; প্রথম প্রকাশঃ ‘ঐতিহ্য’, ঢাকা, ২০০৯। কিন্তু এই মুহূর্তেই আমার হাতের পাশে কলকাতার এম. সি. সরকার-প্রকাশিত যে “পৌরাণিক অভিধান”-খানি রয়েছে (সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত) সেটির প্রকাশ ১৯৮৮তে, যদিও এটি আদতে আরও অনেক প্রাচীন অভিধান, কারণ ব্লার্বেই রাজশেখর বসুর (১৮৮০-১৯৬০ খৃ.) প্রশংসাবাণী দেওয়া রয়েছে। এবং এই বইখানি এই গোত্রের এক আকরগ্রন্থের দর্জা পেয়ে আসছে বহুকাল ধরে। তবু, সুধীরচন্দ্র সম্পূর্ণতই হিন্দু পুরাণের অভিধান লিখেছিলেন, সেখানে এই রহমান-সাহেবেরটির মতো ‘কর্তাভজার’-র পাশাপাশি ‘কলিযুগ’ বা ‘কাবা’ বা ‘কেরি, উইলিয়ম’ স্থান পায়নি। বাংলা কোষগ্রন্থের ইতিহাসে তাই বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘যার যা ধর্ম’ এক অনন্য শ্রদ্ধেয় ও প্রয়োজনীয় স্থান নিয়ে থাকবে। থাকবেই। কারণ, এটি ‘প্রথম’ তো বটেইঃ সর্বধর্মের মিলিত প্রথম অভিধান। বাংলাভাষায়।
দশ--ঋজু গাঙ্গুলী। অরণ্যমন প্রকাশনী। কলকাতা-১২ ISBN 978 9383 200
উচ্চপদস্থ সরকারী আমলারা বাঙলাভাষায় লেখেন তোফা, আর তা কেবল স্মৃতিকথাই নয় [দ্র. পরবাস, ৬৬ সংখ্যা; পরবাস, ৭২ সংখ্যা], গত সংখ্যাতেই আমরা এমন এক লেখকের ইতিহাস-গ্রন্থের কথা পড়েছিলাম [পরবাস, ৭৩ সংখ্যা]। তবে ফিকশন এঁরা শেষ লিখেছিলেন কবে, মনে পড়ে না--বঙ্কিম-রমেশ-অন্নদাশংকরের পরে? ঔপন্যাসিক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় অসাধারণ লিখতেন, আর ... আর... তবে এ’গোত্রের কেউ বাংলাতে সায়েন্স ফিকশন বা ফ্যান্টাসি বা হরর লিখেছেন বলে তো মনে করতে পারছি না। সেই দিক দিয়ে বর্তমান সংকলনটি বেশ ইউনিক। আর, অবশ্য, লেখকের পেশাবিচারের নিরিখেই নয়, সাহিত্যমানেও এই গল্পসংগ্রহ যথেষ্ট উঁচুতেই স্থান পায়, তা তার বিষয়ের পরিব্যাপ্ততায়, গভীরতায় আর তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি নিটোল গল্প বলার মুন্সিয়ানায়।
*
কী করে বলি?
ফিকশনের গ্রন্থ-সমালোচনা লিখতে বসে ফের সেই প্রাচীন দোলাচলে পড়লুম গো--গল্পের অঙ্গটা না ছুঁয়ে কী করে তার ভালোমন্দের বিচার হয়? আবার, অঙ্গ-উন্মুক্ত করে দিলে ভাবী পাঠকদের প্রতি অবিচার করা হয়ে যায় না কি?
তবু, ভালো লাগাটুকু তো বলতেই হয়ঃ
‘খাম’ এ’সংকলনের সবচেয়ে দুর্বল গল্প বলে নাকি চাউর হয়েছে কোনো ফেসবুক গ্রুপে। শুনলাম। লেখকও ‘উপক্রমণিকা’-য় এই গল্পটি নিয়ে উচ্ছ্বাসিত নন, যেমনটি কিন্তু অন্য অন্য অনেক গল্প নিয়ে হয়েছেন। এ’ অধম-সমালোচকের কিন্তু শ্রেষ্ঠ লেগেছে এই গল্পটি, কারণ এটি এক না-বিষয়ের উপর লেখা গল্প, যেমনটি লেখা বড় একটা সহজ নয়। এক তরুণী ‘মিস মার্পেল’ শুধু বুদ্ধিবলে আর ডিডাকশন করতে করতে খুঁজে বের করলেন এক হারিয়ে যাওয়া খাম! পাঠক দেখতে পারেন পড়ে। ‘বাড়ি’ এমন আরেকটি ভালো লাগা গল্প যেটা আসলে কিসের গল্প---ভৌতিক না থ্রিলার না কী....ভাবতে ভাবতেই গল্পটি শেষ হয়ে যায়, পাঠকের ভাবনার রেশটি কিন্তু শেষ হয় না--সেটুকু লেখকের কলমের মুন্সিয়ানা। অসম্ভব গতি এই লেখকের কলমে, কোথাও হোঁচট নেই। নৈলে, এই সোশাল মিডিয়া আর ইউটিউবের যুগে আর কোন দিকে না তাকিয়ে এই পৌনে দু’শ+ পৃষ্ঠার বই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা গেল--কম কথা নাকি এ’? হ্যাঁ, এর মধ্যে হার্ডকোর সাই-ফি-ও আছে। প্রথম গল্পটিই পাক্কা সাইফিঃ-- ‘নূর’, যেখানে মানুষ, কৃত্রিম-মানুষ আর পিয়ানোর সুর একত্রে মিশে গেছে। ‘মান’ ও ‘জীবন’ আর দুটি পাক্কা সায়েন্স ফিকশন গল্প, যেখানে বিজ্ঞানের সঙ্গে মিশেল ভূগোলের, নৃতত্ত্বের, ইতিহাসেরও। এই বহুবিষয়ের চরাচরতা ঋজুবাবুর এক প্রশংসার্হ লিখনশৈলী যা পাঠককে টানে। আর আর বেশি বলে দিলে ভবিষ্যত পাঠকদের প্রতি অন্যায্য করা হয়ে যাবে যে গো। এবার থামি।
*
কেন ঋজুকে পড়তে পড়তে ঘনাদাকে মনে পড়ে গেল? ওঁর ‘সরকার জেঠু’ চরিত্রের সঙ্গে তো ঘনাদার দানায় দানায় মিল নেই। তবু অনন্য ও প্রণম্য প্রেমেন্দ্রবাবুর ঘনাদা-গল্পে বিজ্ঞান ও এডভেঞ্চারের যে ঠাস-বুনুনি সে গুলো এ’সংকলনের ‘স্মৃতি’ ‘সময়’ ‘ফাঁদ’ এর সঙ্গে মেলে। বড় ভাল লাগে।
লেখক-মহাশয় বয়সে যুবক, জানা গেল। ওঁর মধ্যে ভাবী কুর্ট ভনেগাটের ছায়া দেখি। জয়তু!
পুনঃ - নবীন এক প্রকাশনীর প্রোডাকশন। নিখুঁত কাজ (কয়েকটি মুদ্রণপ্রমাদ যদিও চোখে পড়েছে)। ভালো লেগেছে। প্রচ্ছদ ও অলংকরণ চমৎকার (অর্ক পৈতুণ্ডীকৃত)
বঙ্গভঙ্গ ও তৎকাল--গোলাম মুস্তাফা, প্রকাশনাঃ ‘সন্দেশ’, শাহবাগ, ঢাকা ১০০০. প্রথম প্রকাশ ২০১৫. ISBN 984 8088 87 3
বঙ্গভাষা ও সাহিত্যের নামী অধ্যাপক যখন বঙ্গেতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য মোড় নিয়ে কলম ধরেন, অবলীলাক্রমে সেটি এক বিশেষ বাস পায়। কারণ, ইতিহাসের সুসংবদ্ধ ও রীতিমাফিক পাঠ অবশ্যই সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দাবি রাখে কিন্তু যেহেতু এই বিষয়টিতে সাধারণ পাঠকের অনুসন্ধিৎসা সদাজাগ্রত, ইতিহাসের বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর উপর অন্যপ্রকার আলোক এসে পড়ুক---এটিও কাম্য। [পরবাস-৫০ সংখ্যায় এক রাশিবিজ্ঞানীর লেখা অনন্য এক ইতিহাসগ্রন্থের কথা আমরা পড়েছিলাম, মনে আছে?] আর, এখানে বিষয়টি যখন ‘বঙ্গভঙ্গ’--এবং, আদি-বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫-এর, কার্জনকৃত! alternate history নিয়ে জনপ্রিয় গল্পগাছা-চলচ্চিত্র বেশ কিছু হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাসপাঠেও alternate history এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়ে থাকে, বিশেষতঃ academic interest-এর স্বার্থে। ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ পরে রদ না করে দিলে বঙ্গীয় মুসলিমগণের সামগ্রিক উন্নতি এতটাই হওয়া সম্ভবপর হতো যাতে ১৯৪৭এর ভারতবিভাগ (ও বঙ্গব্যবচ্ছেদ) অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ত--এ’হেন মতের ঐতিহাসকগণও সংখ্যায় কম নন, উপেক্ষণীয়ও নহেন। অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা সাহেবের বর্তমান গ্রন্থখানি এই আলোকে পড়তে ইচ্ছা করি।
*
বাংলা একাডেমী পত্রিকা, চট্টগ্রাম বিশ্ব. স্টাডিজ প্রভৃতিতে প্রকাশিত মুস্তাফা সাহেবের চারখানি প্রবন্ধের সংকলন হলো বর্তমান কেতাবখানি। একবার ঐ প্রবন্ধ-চারিটির শিরোনামে চোখ বুলিয়ে নেব কারণ তা থেকেই গ্রন্থটির পরিসর সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া যাবেঃ (১) ‘বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী যুগঃ বাঙালির ভাবনার কয়েকটি দিক’, (২) ‘বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়াঃ হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের কয়েকটি দিক’, (৩) ‘বঙ্গভঙ্গ ও বাঙালির শিক্ষা ভাবনা’, এবং (৪) ‘বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী যুগে নারী-অধিকার প্রসঙ্গ’। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ও সামাজিক দুটি দিকই এসেছে আলোচনায়। হ্যাঁ, অর্থনৈতিক দিকটির আলোচনাও আছে। আসছি সে প্রসঙ্গে।
*
বৃটিশভারতে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির আয়তন ছিল বিশাল---এক লক্ষ ঊননব্বই হাজার বর্গমাইল, জনসংখ্যা ছয় কোটি। অন্য দুই প্রেসিডেন্সি বোম্বাই এবং মাদ্রাজও কিন্তু পিছিয়ে ছিল না। বোম্বের আয়তন বাংলার প্রায় সমান, ১.৯০ লক্ষ বর্গমাইল, জনসংখ্যা আড়াই কোটি। মাদ্রাজ লক্ষ বর্গমাইল, পৌনে চার কোটি। উল্লেখ থাক্, বম্বে প্রেসিডেন্সির ব্যাপ্তি ছিল সম্পূর্ণ সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে দক্ষিণে আজকের গোয়া পর্যন্ত। আর তার তলা থেকেই মাদ্রাজ প্রেসির শুরু--ওদিকে উড়িষ্যা পর্যন্ত (মাঝে মহীশূর ও ত্রিবাঙ্কুর বাদ)। লক্ষ্যণীয়, বৃটিশ সরকার কিন্তু ‘প্রশাসনিক সুবিধার্থে’ কখনই বোম্বে ও মাদ্রাজ প্রেসি.কে বিভক্ত করবার কথা ভাবেনি। বাংলার ক্ষেত্রে ভেবেছিল, তার প্রধান কারণ যে বাংলার নবজাগ্রত রাজনৈতিক চেতনা বটেই এটা আর বলে দিতে হয় না। কংগ্রেস ছাড়াও সেই রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ‘মুসলিম লীগ’-এর প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হতে দেখা যায়, প্রকাশিত হয় লর্ড মিন্টোর কাছে শিক্ষাব্রতী নবাব সলিমুল্লাহ্র পৃথক মুসলিম নির্বাচনের দাবি পেশের মধ্যে দিয়ে। এই জাগ্রতচেতনাকে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলাটা মূর্খামি। “মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশের ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হয়, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই। তাহারা যাহাদিগকে ম্লেচ্ছ বলিয়া অবজ্ঞা করিতেছে সেই ম্লেচ্ছের অবজ্ঞা তাহাদিগকে সহ্য করিতে হইবেই।” [রবীন্দ্রনাথ] বুঝতে তাই অসুবিধা হবার কথা নয় যে কেন মাত্র মাস-তিনেক বঙ্গভঙ্গ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তারপরে পরেই কবি এ’থেকে নিজেকে বিযুক্ত করেছিলেন, প্রমথ চৌধুরী/ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর উপরোধ-সমালোচনাতেও হেলেন নি। আসলে, স্বদেশী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হিন্দুভারতের পুনরুজ্জীবনকে মেনে নিতে পারেননি কবি। গরীব চাষীর পক্ষে অধিক দামে দিশি ধুতি ক্রয় আরেক বালাই। আন্দোলনটা তো ওখানেই ছিল, না? সামগ্রিক বঙ্গদেশের উন্নতিকে লক্ষ্য না রেখে কেবলমাত্র কলিকাতা-কেন্দ্রিক ‘উন্নতি’-কে নিয়ে এগিয়ে চলবার প্রচেষ্টার পিছনে বিড়লা-গোয়েঙ্কাদের স্বার্থ থাকতে পারে (ইস্পাহানী-আদমজীদেরও), কিন্তু, মনে রাখতে হবে, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হতেও ১৯২১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল, ‘ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ’ আরও পরে, ১৯২৪এ তে --কার্জনী-বঙ্গভঙ্গের কালে এ’হেন বাঙালী শিক্ষাতীর্থ ছিল অনেক সুদূরে।
*
মুস্তাফা সাহেবের আর্থ-রাজনৈতিক আলোচনার সঙ্গে সযত্নে যুক্ত হয়েছে সেকালের বাঙালির শিক্ষাভাবনা এবং নারী-অধিকার। তৃতীয় নিবন্ধটিতে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের চাঁচাছোলা ভাষার নির্যাসী মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য---“...আর্যসমাজীরা বেদপাঠ করতে বলে, বিবেকানন্দ বেদান্ত, মৌলবীরা বলে কুরআন পড়ো, পাদ্রী বলে বাইবেল। মনু বলে শূদ্রের কর্ণে বেদগান প্রবেশ করলে তাতে সীসা ঢালো। ...আমরা হিন্দু-মুসলমান এক বলে নৃত্য করছি, কিন্তু মুসলমান আমাদের জল ছুঁলেই সর্বনাশ।”
ঠিক ধরেছেন পাঠক, এ’বিসম্বাদের অপনোদন না হলে কিসের শিক্ষা, কী শিক্ষা? শতাধিক বৎসর পূর্বে বঙ্গভঙ্গকালের এই শিক্ষা-সংকট আজও কি দূর হয়েছে?
*
সর্বশেষ প্রবন্ধটিতে অধ্যা. মোস্তাফা সাহেব বঙ্গভঙ্গের আলোকে নারী-অধিকারের উপস্থাপনা করেছেন (কেবল স্ত্রীশিক্ষা নয়), যেখানে নারীর ভোটাধিকারের প্রসঙ্গও এসেছে। বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গে এই দিকটি সাধারণতঃ উপেক্ষিত থেকে যায়। এই অধ্যায়ে সরলা দেবীচৌধুরানীর (১৮৭২-১৯৪৫ খৃ.) উপর একটি উপ-অধ্যায় আশা করেছিলাম, বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩২ খৃ.) উপর আরেকখানি। বস্তুতঃ, এঁদের দুইজনকেই নব্যবঙ্গীয় রেনেশাঁসের ফসল বলতে হবে। সরলা দেবী তো কলকাতা থেকে এলাহাবাদ থেকে লাহোর পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গবিরোধী উত্তুঙ্গ প্রচারই করেছিলেন, আর আরবি-ফার্সিতে নয়, খানদানী পরিবারের বিপরীত স্রোতে গিয়ে বাঙলাভাষাশিক্ষার জন্য বেগম রোকেয়ার অদম্য জেদ তাঁকে বঙ্গীয়শিক্ষাজননীর আসনে বসিয়েছে। কার্জনী বঙ্গভঙ্গ যে জাতীয়তাবোধের জন্ম দেয় এ’সব তারই ফলশ্রুতি।
*
বঙ্গভঙ্গের উপর নামী-অনামী কৃশ-পৃথুল কেতাব কম লেখা হয়নি, কম পড়িওনি, কিন্তু শতখানিক পৃষ্ঠার মধ্যে বর্তমানটির মতো ভাবনা উদ্রেককারী বই অধিক পড়িনি। যদিও বহু বহু মুদ্রণপ্রমাদ ও অগোছালো প্রোডাকশন মন দুখী করেছে। এক্ষুনি উচিত অসাধারণ এই প্রবন্ধ-সংগ্রহের একখানি সযত্ন পুনর্মুদ্রণ।
ভবিষ্যত পাঠকদের জন্যে।
অতঃপর অন্তঃপুরে--সামরান হুদা। ৯রিকাল বুকস, কলকাতা-২৫. প্রথম প্রকাশ জানু্য়ারি ২০১৮ ISBN 978-81-933223-9-0
ঐ যে প্রচ্ছদচিত্রে দেখছেন লাল-সবুজ-হলুদরঙা অক্ষরে গ্রন্থনামটি লেখা, ওটা কিন্তু ছাপা নয়, কাপড়ের গায়ে সুতোর কাঁথাস্টিচ তুলে তুলে হাতের কাজ করা--এমন যত্নের কাজ (ব্রেইলের মতো প্রচ্ছদে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখি)! সেকালের মা-জেঠিমা-দিদিমাদের দেখেছি চটের আসনের উপরে “দুঃখে যাদের জীবন গড়া...” বা, “নেতাজী সুভাষ” লেখা/আঁকাটিকে সযত্ন কাঁচ-ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে পরিপাটি প্রদর্শন করতে। গৃহশোভা বৃদ্ধি পেত এতে, সন্দেহ নেই; আত্মীয়স্বজন এসে দেখে মেয়ের তারিফ করে গেলে গৃহকর্ত্রীর বুক ফুলতো গরবে। শ্রীমতী সামরান হুদার এই মায়াময় গ্রন্থটি হাতে নিয়ে প্রথম অনুভূতিতেই তাই ভেসে গেলুম আধ-শতক আগের পুকুর-বাগান-বাঁশবনের ছায়াঘেরা শৈশবে। স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠলো মনটা।
তবে, ভালো লাগার এই তো শুরু। বইখানির সারা অঙ্গ জুড়ে গণ্ডায় গণ্ডায় কাঁথার ছবি আর ছবি আর ছবি (সেগুলি রঙীন দেখতে পেলে মনটা আরও ভরতো, মানি, কিন্তু গ্রন্থমূল্যও আকাশছোঁয়া হয়ে উঠত, জানি)। তবে, এটি তো আর কোনো নকশীকাঁথার বই নয়, সেগুলি এখানে এসেছে প্রসঙ্গক্রমে, শোভাবৃদ্ধির কারণে। তাই ঐ কাঁথাচিত্রের গা ঘেঁষে ঘেঁষে সমগ্র কেতাবজুড়ে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ থেকে ‘জসীম উদদিন’ থেকে রাজশাহীর খ্যামটা গীতের সুপ্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি! এই বইয়ে এমন এমন কত কত গীত ছড়িয়ে রয়েছে, শেষে তার একটা ‘পরিশিষ্ট’ থাকলে বড় ভালো হতো, যাতে পাঠক পুনঃপাঠে সটান সেই সেই পৃষ্ঠা ফিরে পড়তে পারতেন।
দু’একটা নমুনা শুনবেন?
“মরি হে মরি হে মরি হে শ্যাম/ শয়নে স্বপনে তোমার নাম/ বরার বাড়ি ছাঁচি রে পান/ পয়সা দিয়া শ্যাম কিনিয়া আন/ আনো রে গুয়া পান কাটো রে খাই/হাসি মনে শ্যাম চলিয়া যাই।।” [ভাওয়াইয়া গান/ প্রতিমা বড়ুয়া] {হ্যাঁ, বর্তমান লেখিকা জলও লেখেন,পানিও লেখেন; গোস্ত এবং মাংস/ ফুফা ও পিসি এঁর কলমে পাশাপাশি আসেন।}
বা,
“নাকফুল দিয়া কইলা বন্ধু/ রূপে যে অতুল/ বাত্তি জ্বালাই চাইলাম হায় রে/ বরই গাছের ফুল/ বন্ধে ভারাইল রে।।” [চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান]
বা,
{এটি আরও উপাদেয়। কইন্যা বিয়া হৈয়া পরের ঘরে যাইবে...}
“ডাইল দিল চাইল দিল রসুই কইরা খাইও। / নতুন বাড়ীত খাইয়া তোমার সুখে নিদ্রা যাইও” [দ্বিজ কানাই]
এমন নেশাভরা মাদকতা আছে এই গ্রাম্যগীতে, যে পরেরটুকু পড়বার জন্যে তাক বেয়ে উঠে বই পাড়লুম [এখানে বাহুল্যবোধে লিখছি না। উৎসাহী পাঠকের জন্যে শেষে দিলাম। #]
*
বেপথু না হয়ে বইটির কথায় ফিরে আসি। একটা অনুযোগ শুনতে পাইঃ এই যেমন এপার-বাঙলায় স্মৃতি মিত্র বা কল্যাণী দত্ত বা যশোধরা রায়চৌধুরীরা ছিলেন আছেন হিন্দু-অন্তঃপুরের গপ্প শোনাতে [দ্র. গ্র.স- ৫২, ৫৯, ৭২, যথাক্রমে] মুসলিম অন্তঃপুরের তেমন গপ্প কৈ? আমরা অবশ্য তেমন একখানি গ্রন্থ-সমালোচনা পড়েছিলুম ৫১-সংখ্যায়, তবে উহা কিছুটা হাই-ফাই সাহিত্যালোচনা আছিল, বর্তমানেরটির মতো সিলেট জিলার প্রত্যন্ত গ্রামের দাদি-নানি-ফুফা-খালার কিসসা-চর্চিত নহে। বর্তমান লেখিকা যে-মমতায় তাঁর শৈশব-কৈশোরের কাহানী শুনিয়েছেন, এ’পার বাঙলায় তেমন লেখা আর হয়েছে কৈ? ঐ ঐ গীতিকা ঐ ঐ কাঁথায় মুড়ি দিয়ে যে অপরূপ গল্প শোনা গেল এই ত্রিশতাধিক পৃষ্ঠার কেতাবে, সেটি, প্রকাশনার ভাষায়, ‘আনপুটডাউনেবল’--এমন গতি তাতে, তেমন বিষয়বৈচিত্র, আর তেমনই তথ্যসমৃদ্ধ।
কত কীই যে জানি না! যেমন, ‘ঈদ-উল-ফিতর্’ উৎসবের ঐ ‘ফিত্র’ (দান)-এর সঙ্গে যে রমজানের সরাসরি কোনও যোগ নেই, এটি সম্পূর্ণ আলাদা একটি ইবাদত বা দানরূপে প্রার্থনা—এটা কি আগে জানতাম? জানতাম না। জানতাম না বিবাহের কথা-পাকা-হওয়ার ‘পানচিনি’ প্রথার কথা; পানের বোঁটা দিয়ে দাদির জ্বর-ছাড়ানো ঝাড়ফুঁকের কথা (পরে সেই বোঁটা আগুনে ফেললে যত জোরে ফাটবে, তত জবরদস্ত জ্বীনে ধরেছিল রোগিকে! ভাবো!); শীতলপাটির কারুকাজ; দাদির বুকের কাছে হাত জড়ো করে ঈদের চাঁদ দেখার দোয়া! তবে দুটি চরিত্রকে আমাদের চেনা চেনা লেগেছে। এক. পাক্কা অরিজিনাল সাইবেরিয়ান হাঁস বেচতে আসা শরবত মিঞা; আর দুই. দু’পায়ের ফাঁকে দড়ি বেঁধে তরতর করে সুপুরিগাছে উঠে যাওয়া সেই ছেলেটি।
এ’কেতাবে সামরান যা যা পদের রেসিপি দিয়েছেন, তার জন্যেও এর এক আর্কাইভাল ভ্যালু হয়। সত্যি। শুরু তার ভুনা মোর্গায় হ’লে শেষ বার্মিজ ইলিশের পদে, যা কিনা কাঁটাছুরি দিয়ে খেতে হয়! ইরিব্বাস!! আরও আছে কত কত রকমে চাউলের নাম, তাদের গুণবর্ণনাঃ শাইলের চাল, বোরো চাল, খাসার চাল, কালোজিরে চাল, কাটারিভোগ চাল, জলির চাল... লিখে লিখে আর শেষ করতে পারি না, হ্যাঁ। পাটালি গুড়, মুগের ডালের হালুয়া, ফুলপিঠা, পাক্কন পিঠাগুলি তো উপরি। পান খাওয়ারই বা কত রকম চল! হ্যাঁ, শেষে এই রান্নার হেডিং-ওয়ারি আরেকখানি ‘পরিশিষ্ট’ থাকলে বেশ হতো। সত্যি বলছি। [এখানে তিনটি ইমোজিঃ হে হে হে!]
*
না, এ’বই একবারে পড়ে শেষ করে তোরঙ্গে ঢুকিয়ে রাখার নহে, বন্ধু। আবার পড়তে ইচ্ছে করছে --গৃহিণীকে দেখাই সেই পৃষ্ঠাটা যেখানে টেকনাফি চিকেন রাঁধার তারিকা বলে দেওয়া রয়েছে।
অনেকদিন পরে কোনো কেতাব পড়ে দশে দশ দিতে ইচ্ছে হল!
গ্রন্থঃ ‘অতঃপর অন্তঃপুরে’---সামরান হুদা। ৯রিকাল বুকস, কলকাতা-২৫. প্রথম প্রকাশ জানু্য়ারি ২০১৮ ISBN 978-81-933223-9-0
# পদ্যের শেষাংশঃ
নয়া বড়ী লইয়া রে বাইদ্যা লাগাইল বাইঙ্গন।
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন।।
কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর।
সেই বাইঙ্গন বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার হার।।
নয়া বাড়ী লইয়্যারে বাইদ্যা লাগাইলো কচু।
সেই কচু বেচ্যা দিয়াম তোমার হাতের বাজু।।
নয়া বাড়ী লইয়্যারে বাইদ্যা লাগাইলো কলা।
সেই কলা বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা।।
নয়া বড়ী লইয়ারে বাইদ্যা বানলো চৌকারী।
চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি।।
হাস মারলাম কইতর মারলাম বাচ্যা মারলাম টিয়া।
ভালা কইর্যা রাইন্দো বেনুন কাল্যাজিরা দিয়া।।