সজ্জার একেবারে অগ্রবিন্দুতে হেলেনার যানটি হঠাৎ সামান্য কেঁপে উঠল। মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষের আসনটিতে হেলেনার সামনের পর্দায় একটি বিচলিত মুখ ভেসে উঠেছে। সে কিছু বলবার আগেই হেলেনা শান্ত গলায় বললেন, “কোন দুর্ঘটনা ঘটে নি ন্যাভিগেটর তোরাগানা। এই যানটির কাউন্টডাউন আমি নিজে বন্ধ করেছি। এর কেন্দ্রীয় গণকটি এখন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
“কিন্তু, কেন—”
বাইরের নীরন্ধ্র অন্ধকারের বুকে তখন, যানগুলির মতন একই সজ্জায় ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে একরাশ মহাকাশ গহ্বর। সেইদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হেলেনা বললেন, “আমি যে স্থানাংকগুলি বলছি সেই অনুযায়ী নতুন করে আমার যানটির ঝাঁপের হিসাব করুন—”
নিজের পর্দায় ভেসে ওঠা স্থাংকগুলিকে মহাকাশ মানচিত্রে প্রতিস্থাপিত করে হঠাৎ শিউরে উঠলেন অভিজ্ঞ ন্যাভিগেটরটি, “কিন্তু, মহামান্য, কোন ভারী বস্তুর কাছাকাছি মহাকাশ সুড়ঙ্গ খোলা নিয়মবিরুদ্ধ। হিসাবে লক্ষভাগের একভাগ বিচ্যুতি হলেও তাতে গ্রহটির মাটির তলাতেও সুরঙ্গের অন্যপ্রান্তটি খুলে যেতে পারে। সুদূর অতীতে তেমন দুর্ঘটনার উদাহরণ তো কম নেই—”
“তোরাগানা, আমি আপনার দক্ষতার ওপর নির্ভর করছি। মূল বাহিনীর কিছু আগে আমাকে সরাসরি নোভোস দুইয়ের কক্ষপথে পৌঁছাতে হবে।”
অভিজ্ঞ ন্যাভিগেটরটির মুখ শক্ত হয়ে উঠল, “আমি দুঃখিত মহামান্য। সঠিক কারণ না জেনে আমি এই আত্মঘাতী ঝাঁপ দিতে সম্মত নই।” “বেশ। তবে শুনুন। সীমালের যানটি ধ্বংস হবার বিষয়ে আমি কিছু চিন্তাভাবনা করেছি। এ সম্বন্ধে তার বিশ্বাসঘাতকতার তত্ত্বটি সত্য হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু তা সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়।”
“আপনার কাছে অন্য কোন বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা আছে কি?”
“আছে তোরাগানা। প্রথমে সীমালের এই স্নায়বিক ও মনস্তাত্বিক প্রোফাইলটি দেখুন। তার অভিযান শুরুর আগের নিয়মমাফিক পরীক্ষার ফলাফল। মেয়েটি সৎ এবং নির্লোভ। চিন্তাশীল ও ভারসাম্যযুক্ত মন। এবং এ ছাড়াও, আমি তাকে ছাত্রজীবন থেকে চিনি। মহাকাশ আকাদেমিতে আমার হাতেই তার শিক্ষার শুরু হয়েছিল। ফলে তার সে সময়কার চরিত্রও আমার জানা। পনেরো বছর কর্মজীবনেও চরিত্রের এই মূল বৈশিষ্ট্যগুলোয় কোন বদল আসে নি। এই যোদ্ধাটি একেবারে হঠাৎ করে এতবড়ো একটি বিশ্বাসঘাতকতা করে বসবে সেটি আপনার বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় কি?”
“কিন্তু তার বিশ্বাসঘাতকতার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে মহামান্য।”
“কিছু ঘটনা ঘটেছে যার থেকে প্রমাণিত হচ্ছে গ্রহপুঞ্জের কাছে আকোনা ধ্বংস হবার যে বিবরণ পৌঁছেছে তার উৎস তার যান।” “সে যানে সীমালই একক যাত্রী ছিল।”
“অতএব তার থেকে একটি যুক্তিগ্রাহ্য অনুমিতিতে পৌঁছানো যাচ্ছে যে একমাত্র তার পক্ষেই এই খবরটি পাচার করা সম্ভব। অথচ তার মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইলটি বলছে যে তার বিশ্বাসঘাতকতা করবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। অনুমিতি ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এইদুটি এক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী দুটি অবস্থানে রয়েছে।
“তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এখানে তোরাগানা- প্রথমটি হল, সীমালের যান থেকে তথ্যগুলি সরবরাহ হওয়া। গোয়েন্দা প্রধান অ্যাডলিন্ডার বিশ্লেষণ থেকে আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে এটির সম্ভাবনা প্রায় নিশ্চিত। দ্বিতীয়টি হল সীমালের মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল। এটিও একটি সুনশ্চিত বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্ত। তৃতীয়টি হল দ্বিতীয়টির প্রত্যক্ষ বিরোধী একটি সিদ্ধান্ত, যা দাবি করছে সীমাল বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এখন, যদি আমরা একটি বিকল্প অনুমিতির সাহায্য নিই যা প্রথমদুটির বিরোধীতা না করেও ঘটনাটির একটা সুষ্ঠু ব্যাখ্যা দিতে পারে তাহলে সেই অনুমিতিটি এই বিশ্বাসঘাতকতার তত্ত্বের চেয়ে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য হবে নিশ্চয়?”
তোরাগাণা কৌতুহলী মুখে তাকিয়েছিলেন হেলেনার দিকে।
“আমি যদি অনুমান করি সীমালকে বাধ্য করা হয়েছিল তথ্যগুলি দিতে? অথবা যদি অনুমান করি তার অজ্ঞাতে তথ্যগুলি চুরি করা হয়েছিল তার কাছ থেকে? সেক্ষেত্রে তা কিন্তু প্রথম দুটি অনুমিতির বিরোধিতা করছে না। অর্থাৎ তুলনায় অনুমানটি অধিকতর গ্রহনযোগ্য হওয়া উচিত।”
“ঠিক। শুধু আপনার যুক্তিতে একটিই গুরুতর গলদ রয়ে গেছে মহামান্য। একমাত্র নোভোসের হাতেই ওই তারকাপুঞ্জে পৌঁছোবার মত প্রযুক্তি ছিল। আকাশগঙ্গার দ্বিতীয় কেউ সেখানে পৌঁছে তাকে বাধ্য করতে বা তার যান থেকে সে তথ্য চুরি করতে কিংবা তার যানটি ধ্বংস করতে—”
“সঠিক বিশ্লেষণ তোরাগানা। কিন্তু মনে রাখুন, সীমাল আকাশগঙ্গার শেষপ্রান্ত থেকে পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের একটি তারকাপুঞ্জে পৌঁছেছিল। এত দূর থেকে সে তারকাপুঞ্জে কোন বুদ্ধিধর প্রাণের অস্তিত্ত্ব আছে কি না তা বোঝার মত প্রযুক্তি আমাদের কাছে এখনও নেই। যদি এমন হয়—”
“আপনি বলতে চাইছেন—”
আমি শুধু আরও একটি অনুমিতি দিতে চাইছি যা হয়ত বিশ্বাসঘাতকতা তত্ত্বের সমস্যাগুলিকে অতিক্রম করবে। ভেবে দেখুন তোরাগানা, এর পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকলেও এর একটি বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। আর যদি এর সত্য হবার সামান্যতম সম্ভাবনাও থেকে থাকে তাহলে মেনে নিতে হবে সেখানকার অজ্ঞাত বাসিন্দারা শুধু বুদ্ধিধর তাই নয়, আকাশগঙ্গার বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিকেও তারা ক্রমাগত অনুসরণ করে চলেছে এবং সঠিক সময়ে একটি ছোট্ট চালে আমাদের সমস্ত স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে সাফল্যের সঙ্গে।”
তোরোগানা মাথা নাড়ছিলেন, “আপনার অনুমিতিটিকে সম্ভাব্য ধরে নিলে সেক্ষেত্রে এ-ও ধরে নিতে হয় যে আমাদের এই অভিযানের খবরও সেই অজ্ঞাত শত্রুর কাছে রয়েছে।”
“এবং তার সামান্য সম্ভাবনাটুকুও থাকলেও আমি নোভোস গ্রহের সভ্যতার শেষ সদস্যদের সরাসরি সেই বিপদের মুখে নিয়ে ফেলতে সম্মত নই। যখন তারা ওই গ্রহমণ্ডলকে ঘিরে থাকা মেঘপুঞ্জে গিয়ে পৌঁছোবে সেই সময় আমি আগে একবার গ্রহটিতে পৌঁছে দেখতে চাই। এ পরিকল্পনাটি আমি এখন অবধি কাউকে জানাই নি। বিপরীত গণনা চালু হবার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে গণকযন্ত্রটিকে নিষ্ক্রিয় করে নিজেদের হাতে যানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি। শত্রুপক্ষ যদি আমাদের ওপরে কোন অজানা পথে গুপ্তচরবৃত্তি করতে থাকে তাহলেও আমার এই অভিযান তাদের কাছে অজানা থেকে যাবে। সেই চমকটুকুই আমাদের সাফল্যের একমাত্র সম্ভাবনা তোরোগানা।”
“আদেশ পালিত হবে মহামান্য।”
“একটা লম্বা শ্বাস ফেলে সামনে ঘুরে বসে একটি বোতাম স্পর্শ করলেন হেলেনা। গোটা যানটির প্রতিটি কক্ষে গমগম করে বাজছিল তাঁর গলা, “বন্ধুরা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল একটি অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয় দেখেছেন যে বহরের অন্যান্য যানগুলি আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গেছে ক্যানি মেজরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমাদের যাত্রাপথ তাদের থেকে বহুগুণে বিপজ্জনক হতে চলেছে। নোভোসের ভবিষ্যত নির্ভর করবে আমাদের এই একক যাত্রার সাফল্যের ওপর। এখন আমার প্রতিটি নির্দেশ মন দিয়ে শুনুন-—”
উপস্থিত জিমুয়েলা তাং-এর অবশ্য দূরবীক্ষণ প্রক্ষেপিত কমলাবর্ণের নক্ষত্রটির দিকে নজর ছিল না। অভিযান নির্দেশক হেলেনা জাইলভস্কির যানটি কোন কারণে উল্লম্ফনে ব্যর্থ হয়েছে। ডেইকি তরঙ্গেও তার কোন সাড়া না পেয়ে জিমুয়েলা এই মুহূর্তে অভিযানের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু কোন সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে তাঁর প্রথম বাধাটি উপস্থিত হয়েছে কমলা বর্ণের সূর্যটির ঠিক পাশে জ্বলতে থাকা একটি উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণের আলোকবিন্দুর রূপ নিয়ে। বস্তুটির আয়তন নক্ষত্রটির তুলনায় বহুগুণে ছোট। তবে তুলনায় অনেক কাছে থাকবার ফলে আয়তনে তা নক্ষত্রের চিত্রটির প্রায় সমান সমান। মেঘপুঞ্জটি যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক জীবের মতই দুই বর্ণের দুটি ভাস্বর চোখ নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় রয়েছে।
“স্ক্যানিং এর ফলাফল?”
জবাবে গণকের যান্ত্রিক কন্ঠটি সরব হয়ে উঠল, “ফলাফল শূন্য। বস্তুটি তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গের সম্পূর্ণ বর্ণালিটির পক্ষেই অভেদ্য। প্রতিফলনের হার শতকরা একশো শতাংশ।”
“বস্তুটি কৃত্রিম বা প্রাকৃতিক সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া গেছে কি?”
“না।”
“পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করো—”
এইবার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল জিমুয়েলার যন্ত্রগণকটি। এই বিশেষ কাজটি করবার জন্য এই শ্রেণীর গণক যোগাযোগ সীমার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত গণকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। তারপর তাদের মিলিত গণনাশক্তির প্রয়োগে যাবতীয় তথ্যের বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য একটি অনুমিতিতে উপস্থিত হয়ে। প্রায় এক মিনিট বিরতির পর গণক ফের কথা বলল, “প্রাকৃতিক। সম্ভাবনা শতকরা আশি শতাংশ।”
“অনুমানের কারণ?”
“কারণ শতকরা একশো ভাগ প্রতিফলনের বিজ্ঞান এখনও মানুষের করায়ত্ত নয়।”
তাঁকে ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একবার জিমুয়েলা। তারপর ফের প্রশ্ন করলেন, “সেক্ষেত্রে বস্তুটি কী হতে পারে?”
“কোন ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্যাসদানব গ্রহের হীরকনির্মিত কেন্দ্রীয় অঞ্চল। গ্রহটি ধ্বংস হবার ফলে যা ছিটকে এসে এই মেঘমন্ডলে আশ্রয় নিয়েছে এবং এখানকার ঘন ধুলিকণার ঘর্ষণে অতীব মসৃণ চেহারা নিয়েছে।”
“দ্বিতীয় ব্যাখ্যা?”
“শতকরা কুড়ি ভাগ সম্ভাবনা হল এটি শক্তিক্ষেত্র দ্বারা সংরক্ষিত কোন অন্য সভ্যতার যান।”
হঠাৎ যন্ত্রগণকের স্বরটিকে বন্ধ করে উত্তেজিত হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে বসলেন জিমুয়েলা, “প্রথম তত্ত্বটির প্রমাণ অতি সহজেই করা যাবে। কয়েক হাজার ডিগ্রি উত্তাপের একটি রশ্মিঝলক সে প্রশ্নের জবাব দেবে।” বলতেবলতেই সামনের নিয়ন্ত্রণ প্যনেলে কয়েকটি নির্দেশ দিলেন তিনি। সঙ্গেসঙ্গেই পাঁচটি রণপোতের সামনের দিক থেকে একটি করে অতিকায় স্ফটিক বের হয়ে এল উন্মুক্ত মহাকাশে। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষার পর তাদের থেকে চোখ ধাঁধানো পাঁচটি আলোকশিখা ধেয়ে গেল বস্তুটির দেহের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুকে লক্ষ করে। এবং তার কয়েক মুহূর্ত পরেই তাঁর গলা থেকে একটি হর্ষধ্বনি উঠে এল। বস্তুটি সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে।
কিন্তু হর্ষধ্বনিটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। পাশের নিয়ন্ত্রণপর্দাগুলি থেকে একজন সহকারীর উত্তেজিত গলা ভেসে আসছিল, “ভরসন্ধানী যন্ত্রের রিডিংটি দেখুন মহামান্য। বস্তুটি অনাহত আছে। শুধু, একবিন্দু তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গও আর নির্গত হচ্ছে না তার দেহ থেকে—আমাদের সম্পূর্ণ শক্তির ঝলকটিকে তা শুষে নিয়েছে-—”
ততক্ষণে ফের বস্তুটি ফিরে এসেছে দৃষ্টিক্ষেত্রে। আবার সেই চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্যটি দেখা যায় এখান থেকে। আর তারপর হঠাৎ একটি তীব্র জ্যোতিপুঞ্জ তার দেহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে নৌবহরটির কিছু দূর দিয়ে মিলিয়ে গেল মহাশূন্যে।
নির্বাক হয়ে নিজের আসনে বসে ছিলেন জিমুয়েলা তাং। এক মুহূর্তে সম্পূর্ণ প্রতিফলক ও সম্পূর্ণ শোষক এই দুটি রূপের মধ্যে যাওয়াআসা করতে পারে এমন কোন প্রযুক্তির সম্ভাবনা এখনো মানুষের বিজ্ঞানে আসে নি। তাঁদের রশ্মিকামান থেকে প্রক্ষেপিত শক্তিপুঞ্জকে শুষে নিয়ে তাকে ফের একটি ঘনবদ্ধ অগ্নিবাণে পরিণত করে ছুঁড়ে দিয়েছে এই যান। একইসঙ্গে একটি সর্বোচ্চ শক্তির সুরক্ষাবর্ম ও অস্ত্র দুই হিসেবেই এর ব্যবহার হতে পারে। বস্তুটি প্রাকৃতিক নয় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই আর। কারা এরা? আকাশগঙ্গার এত কাছে মানুষের সম্পূর্ণ অজান্তে—
কিন্তু চিন্তাটি সম্পূর্ণ হল না তাঁর। নিয়ন্ত্রণকক্ষে থাকা সবক’টি গলা থেকেই একটি ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ের ধ্বনি বের হয়ে এসেছে।
আলোকবিন্দুটি হঠাৎ দ্রুত আকারে বাড়তে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে তা বের হয়ে আসছিল মেঘপুঞ্জের আলো আঁধারীর থেকে। তীরের ফলার চেহারার আক্রমণাত্মক সজ্জাটি দ্রুত বদলে ফেলছিল গোটা নৌবহর। গোলকটিকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে একটি অর্ধবৃত্তাকার রক্ষণব্যূহে নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছিল যান্ত্রিক মসৃণতায়। অভিজ্ঞতা জিমুয়েলাকে বলছিল, প্রতিটি যানের প্রধান প্রতিবস্তু কামানগুলি এই মুহূর্তে সেই কেন্দ্রবিন্দুটির দিকে নিশানা করে আছে।
“ভরসন্ধানী যন্ত্রটির দিকে দেখুন মহামান্য, বস্তুটির ভর—”
ডাকটি শুনে হঠাৎ সেইদিকে চোখ ফেলেই চমকে উঠলেন জিমুয়েলা। বস্তুটির ভর প্রায় হঠাৎ করেই এক লক্ষ গুণ বেড়ে উঠেছে।
“অজ্ঞাত শত্রুর আচরণকে আক্রমণ হিসাবে ধরে নেয়া হল। প্রতিটি রণতরীকে আদেশ দেয়া হচ্ছে আপনাদের প্রতিবস্তু কামান—”
হঠাৎ জিমুয়েলার সম্প্রচারটি মাঝপথে থেমে গেল। অগ্রসরমাণ গোলকটি প্রায় পঞ্চাশহাজার কিলোমিটার দূরে এসে গতি স্তব্ধ করেছে। প্রতিটি যানের সম্প্রচারক্ষেত্রে একটি প্রাচীন কন্ঠস্বর ভেসে উঠেছে তখন, “আকাশগঙ্গার আগন্তুকেরা, হবিষ্টর আশীর্বাদ গ্রহণ করুন। আপনাদের মধ্যে একজন প্রতিনিধির সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।”
“জিমুয়েলা উঠে দাঁড়িয়ে প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ভাসমান অতিকায় গোলকটির প্রতিচ্ছবির দিকে এগিয়ে গেলেন, “আমি নোভোস গ্রহের অগ্রগামী উপনিবেশ বাহিনীর প্রধান জিমুয়েলা তাং। নোভোস গ্রহের সংসদের নামে আমি এই গ্রহমণ্ডলটির দ্বিতীয় গ্রহটিকে নোভোস দুই নামে অভিহিত করলাম এখন থেকে তা নোভোসের শাসণাধীন একটি—”
“এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন জিমুয়েলা তাং। এ প্রসঙ্গে আলোচনা এগোবার আগে আপনাদের জন্য একটি ছোটো প্রদর্শনীর আয়োজন করেছি আমি। আশা করি এতক্ষণে আপনাদের ভরসন্ধানী যন্ত্রটি দেখিয়েছে যে এই যানটির ভর প্রায় এক লক্ষগুণ বিবর্ধিত হয়েছে। কিন্তু তা ভুল। আমার যানটি ক্ষুদ্র। মাত্রই পঞ্চাশ যোজন পরিমিত। অতিরিক্ত ভরটি সৃজন হয়েছে আমার যানটির আকর্ষক রশ্মিতে আবদ্ধ এই বামন গ্রহটির জন্য—”
বলতে বলতেই গোলকটি থেকে একটি সুতীব্র আলোকরশ্মি গিয়ে ছড়িয়ে গেল তার পেছনের আকাশে। সেখানে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে হঠাৎ করেই আবির্ভূত হয়েছে একটি অতিকায় বস্তুপিণ্ড।
“বলা বাহুল্য, এই বামন গ্রহটির আয়তন ও ভর আপনাদের নৌবহরের মিলিত ভরের চেয়ে বহুগুণে বেশি। কিন্তু একে কক্ষপথ থেকে বিচ্যূত করে এইখানে নিয়ে আসতে আমার যানটির মোট শক্তির সামান্যই ব্যায়িত হয়েছে। এইবার, একে আমি ফের এর কক্ষপথে ফেরত পাঠাবো—” বলতে বলতেই হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠল অতিকায় বস্তুপিণ্ডটি। তারপর, একটি দীর্ঘ বক্ররেখাপথে গোলকটির পেছন থেকে ছিটকে গিয়ে মিলিয়ে গেল মহাজাগতিক মেঘপুঞ্জের অন্তরালে।
“এটি একটি নিরীহ প্রদর্শনীমাত্র হে আগন্তুক নৌবহর। আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয় এ-ও অনুধাবন করেছেন যে এই যানটি আপনাদের অস্ত্রভান্ডারের সমস্ত শক্তিঝলককে নিজের বর্মে শুষে নিয়ে ফের তাকে প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারে আপনাদের ওপরে। প্রথমবার আপনাদের নির্বোধ আক্রমণকে ক্ষমা করেছি। কিন্তু দ্বিতীয়বার তা ঘটলে প্রতিটি আক্রমণে নির্গত শক্তিরশ্মিটি প্রতিফলিত হবে আপনাদের এক একটি যানের কেন্দ্রস্থলে।”
জিমুয়েলা নিজের ভিতর গড়ে ওঠা কাঁপুনিটিকে কোনক্রমে বশে রেখে শান্ত গলায় বললেন, “হবিষ্ট, আমরা যুদ্ধের সন্ধানে এখানে আসি নি। এই তারকাপুঞ্জে পঁচিশ লক্ষ গ্রহ রয়েছে। তাদের মধ্যে কেবল একটিকে আমাদের বাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করতে চাইছি।”
একটু নীরবতার পর হঠাৎ হবিষ্টর কন্ঠস্বরটি ফের ফিরে এল, “নোভোস গ্রহের ধ্বংসের জন্য আমরা আন্তরিক সহানুভূতি জানাই আপনাদের। কিন্তু—”
“আপনারা কতদিন ধরে আমাদের ওপরে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন হবিষ্ট?”
“গুপ্তচরবৃত্তি নয় দানব,” হঠাৎ হবিষ্টর গলায় একটু উত্তেজনার সঞ্চার হল, “তোমাদের সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই আমাদের সতর্ক নজর রয়েছে তোমাদের ওপরে। সহস্রাব্দির পর সহস্রাব্দি ধরে দেখেছি তোমাদের রক্তাক্ত উন্নতির ধারাকে। তোমাদের বর্বরতার সমস্ত ইতিহাস আমার পরিচিত। আশ্রয়প্রার্থী তোমরা নও। এই তারকাপুঞ্জকে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তোমরা এখানে এসেছ।”
জিমুয়েলা কথা বলতেবলতেই সামনের নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন একবার। প্রতিটি প্রতিবস্তু কামান গোলকটির দিকে লক্ষ্যস্থাপন করেছে। যোগাযোগ প্যানেলের গায়ে একটি বিন্দুতে আঙ্গুলটি স্পর্শ করলেন তিনি।
হঠাৎ একযোগে গর্জন করে উঠল কামানগুলি। সুতীব্র গ্রহধ্বংসী শক্তির স্রোত চারপাশ থেকে ছুটে এসে গ্রাস করেছে কেন্দ্রস্থ গোলকটিকে। প্রত্যুত্তরে সহসা ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে অন্ধকার আকাশের বুকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল অতিকায় গোলক। আর পরমুহূর্তেই তার মাথার ওপরের একটি বিন্দু থেকে অতিকায় একটি আলোকধারা বের হয়ে গ্রহমণ্ডলটির আবর্তনতলের সঙ্গে উল্লম্বভাবে ছুটে গেল মহাকাশের নক্ষত্রবিহীণ একটি এলাকার দিকে।
আস্তে আস্তে ফের উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল অন্ধকার ক্ষেত্রটি। উজ্জ্বল গোলকটির দেহ সামান্য স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে এবার। জিমুয়েলা সেইদিকে তাকিয়ে অক্ষম ক্রোধে ছটফট করছিলেন। সুরক্ষাবেষ্টনীর শক্তি কমিয়ে দিয়েছে আগন্তুক যান। তারা জানে নৌবহরের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রটির শক্তি একবার ব্যয়িত হলে ফের তাকে কার্যকরী করে তুলতে বেশ কিছুক্ষণ সময় প্রয়োজন হয়। তাই পূর্ণশক্তির বর্ম আর তাদের কাছে এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় নয়। ঠিক কতটা জানে এরা আকাশগঙ্গার প্রযুক্তির সম্বন্ধে?
অন্ধকারের বুকে থেকে একটি অতিকায়, প্রাচীন জলপোতের আকার ফুটে উঠছিল ধীরে ধীরে। তার একপাশের শীর্ষবিন্দুতে দাঁড়ানো বৃদ্ধ মানুষটির ওপরে একটি আলোকরেখা এসে পড়েছে। তাঁর কন্ঠস্বর ধ্বনিত হচ্ছিল প্রতিটি যানের ভিতর, “এই নিয়ে দ্বিতীয়বার তোমাদের ক্ষমা করলাম আগন্তুক নৌবহর। কিন্তু আর নয়। এইবার তোমাদের ফিরে যেতে হবে তোমাদের মাতৃতারকাপুঞ্জে।”
জিমুয়েলা তিক্ত হাসলেন একবার, “আবার ফিরে আসব আমরা হবিষ্ট। আরো উন্নততর অস্ত্র নিয়ে, তখন দেখব—”
মৃদু হাসলেন বৃদ্ধ, “ফিরে আসবে, তবে এখন নয় জিমুয়েলা। এখনও তোমাদের আকাশগঙ্গার সীমানা থেকে বের হবার অনুমতি নেই। তোমার বহুদূর কোন উত্তরসূরী হয়ত একদিন ফের এইখানে ফিরে আসবেন যুদ্ধের আহ্বান নিয়ে। কিন্তু ততদিনে আমাদের উত্তরসূরী ঈশ্বরজীব তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকবে। সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফল আমি জানি। প্রতি কল্পেই তাতে একবার করে তোমাদের পরাজয় ঘটেছে। অথবা, হয়ত কোনদিন-—”
বলতেবলতে সহসা অতিকায় নৌকাটি থেকে কতগুলি ক্ষীণ আলোকসূত্র ধেয়ে এল আক্রমণকারী যানগুলির উদ্দেশ্যে। মাত্রই এক মুহূর্তের জন্য প্রতিটি যানের শরীরের একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থায়ী হল তা, তারপর যেমন হঠাৎ করে এসেছিল তেমনই অকস্মাৎ নিভে গেল তারা। “তোমাদের অবশিষ্ট শূন্যজ শক্তিসংগ্রাহকগুলি বিনষ্ট করা হয়েছে। তবে তোমাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি পঁচিশ সহস্র আলোকবর্ষব্যাপী পথ সৃষ্টি হবে এখন। সেই পথে ফিরে যেতে হবে তোমাদের। হবিষ্টের আশীর্বাদ তোমাদের সঙ্গে রইল—”
“সোমক?”
সীমালের নীল চোখদুটি খুলে গেছে। শুয়ে থাকা অবস্থাতেই চোখদুটিকে সোমকের দিকে তুলে ধরেছিল।
“বলো।”
“আমার সমস্ত কথাই তো আমি তোমাকে খুলে বলেছি। এইবারে তুমি তোমার কথা আমায় বলবে না?”
“আমার কোন বিশেষ কথা নেই যে সীমাল। আমি এই গ্রহেরই—”
“না সোমক। এই গ্রহের মূল ভুখন্ডের যে আদিম জনজাতির কথা তুমি আমায় বলেছ তারা সদ্যই উদ্বর্তিত। তুমি তাদের একজন নও। তুমি—”
“আমি তো তোমাকে বলেছি সীমাল, আমার প্রকৃত পরিচয়টি এখনও তোমার বুদ্ধির অতীত। এর বেশি জানতে চেও না তুমি। হয়ত কোনদিন আমি তোমাকে আমার সঠিক পরিচয়টি দিতে পারব। তবে তা আজ নয়।”
“বেশ। আমি তার জন্য অপেক্ষা করব সোমক। আমি কি ঠিক করেছি জানো?”
“বলো।”
“আমাদের মূল উপনিবেশ স্থাপনকারী দলটি এসে পৌঁছোতে আর তো বেশি দেরি নেই। আমার পাঠানো বিপদসংকেত হয়ত তাদের যাত্রাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। তারা এসে পৌঁছোলে আমিও এই গ্রহেই থেকে যাবার অনুমতি চেয়ে নেব। নির্জন এই দ্বীপটিতে শুধু আমরা দুজন—”
“একটা তীব্র দুঃখের স্রোত উঠে এল সোমকের বুকের ভিতর। নোভোসের ধ্বংস হবার সংবাদটি তার অজানা নেই। কোনমতে অনুভূতটিকে সংবরণ করে সে বলল, “কিন্তু কেন সীমাল? নিজের মাতৃগ্রহে ফিরে যেতে চাও না তুমি?
যুবতীটি উঠে বসে ঘন হয়ে আসে তার সঙ্গীর শরীরের কাছে। তার চোখে স্বপ্নের স্পর্শ লেগেছিল, “আমার নিজের সমাজে নারীপুরুষের সম অধিকার নেই সোমক। সে সমাজে তোমার স্থান হবে না কখনো। তাছাড়া—”
“তাছাড়া—কী সীমাল?”
“আ-আমি আর আমাদের শক্তিশোষকের আবরণে মোড়া কৃত্রিম আলোর জগতে ফিরে যেতে চাই না।”
বলতেবলতেই উত্তেজনার স্পর্শ লাগছিল তার গলার স্বরে, “এখানে আমাদের অনেক কাজ থাকবে সোমক। আমি কখনো বুঝিনি উন্মুক্ত আকাশ এত সুন্দর হতে পারে। আমি জানতাম না একজন পুরুষকে একজন নারী কখনো ভালোবাসতে পারে। আমি জানতাম না সোমক—”
তার গালে আঙুলের একটি আদুরে স্পর্শ দিয়ে সোমক বলল, “আজ সন্ধ্যাবেলা—”
“অভিনন্দন সোমক,” কথাটির মাঝপথে বাধা দিয়ে মাথার মধ্যে দ্বিতীয় একটি কন্ঠস্বর বেজে উঠল তার মাথায়, “যোদ্ধাটির পরিবর্তনশীল অনুভূতির চলন আমি গত দুদিন ধরে ক্রমাগত নথিভূক্ত করে চলেছি। যদি তুমি তা দেখতে পেতে! মাত্রই দুটি দিনের মধ্যে তুমি তাকে যে কী আমূল বদলে দিতে সক্ষম হয়েছ তা তুমি নিজেও জানো না। পদ্ধতিটিকে একসঙ্গে বহু দানবমস্তিষ্কে সঞ্চালিত করবার জন্য একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা যদি সম্ভব হত—”
“পারবে নেরা?”
“জানি না সোমক—” হঠাৎ কন্ঠস্বরটিতে একটি তিক্ততার স্পর্শ এল, “আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, এই যোদ্ধানারীটির মস্তিষ্কচেতনায় ওই অনুভূতিটির বিবর্তনকে শুরু থেকে অধ্যয়ন করলে হয়ত আমি একে অনুভব করবার কোন সূত্র পাব। সেই থেকেই বের হয়ে আসবে উপযুক্ত পদ্ধতির গাণিতিক যুক্তিশৃংখল। সে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছি আমি। কিন্তু যত দেখছি তত আরো বেশি করে উপলব্ধি করছি এর জটিলতাকে। একবার—যদি একবার, সামান্য কিছুক্ষণের জন্যও এর চেতনার সঙ্গে নিজের চেতনাটিকে মিশিয়ে দেবার সুযোগ পেতাম—”
“একবার চেষ্টা করে দেখবে নেরা? সূত্রটি আবিষ্কার করা গেলে আমার আরব্ধ কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে। আমি তো কেবলমাত্র দেবর্ষীদের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে এই পার্থিব দানবজাতির মধ্যে এখনও ভালোবাসা নামের বিচিত্র ও মঙ্গলদায়ক একটি শক্তির অস্তিত্ত্ব রয়েছে। উপ্সথিত তা বহু সহস্রাব্দির অব্যবহারে ঘুমন্ত, কিন্তু উপযুক্ত পদ্ধতিতে তাকে জাগিয়ে তোলাও সম্ভব। হয়ত তার ফলে ঈশ্বরজাতি কোন একটি পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ জাতিটিকেই একেবারে পরিবর্তিত করে দেবার কোন প্রযুক্তি নিয়ে চিন্তা করতেন। হয়ত অতিদূর কোন ভবিষৎ সময়ে, আরো বহু রক্তপাতের অধ্যায় পেরোবার পর তা সফলও হত। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, তুমি সফল হলে দানবজাতির ভবিষ্যতকে আমূল বদলে দিতে পারা যাবে মাত্রই কয়েকটি প্রজন্মের মধ্যে। দুটি শক্তিশালী জাতি ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসে এই প্রথম একই লক্ষ্যে পথ চলা শুরু করবে। ব্রহ্মান্ডের ভবিষ্যতের ইতিহাস বদলে যাবে নেরা—”
“সম্ভব নয় সোমক। আমার গণনা বলছে, জৈবমস্তিষ্কটি আমার এত দীর্ঘকালের সঞ্চিত স্মৃতিভাণ্ডারকে এক মুহূর্তের জন্যও ধারণ করতে পারবে না। চেতনামিশ্রণের সঙ্গেসঙ্গে সুতীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে সম্পূর্ণ অকর্মণ্য হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবার আগে যদি সামান্য কয়েকটি মুহূর্তও তা আমার চেতনাকে ধারণ করতে পারত তাহলেও আমি তার সঙ্গে একীভূত হয়ে অনুভূতিটিকে আত্মস্থ করে নিতে সক্ষম হতাম। তার পর এই একটি চেতনা ধ্বংস হয়ে গেলেও কোন সমস্যা হত না আর-—”
“না! সীমাল—” হঠাৎ একটু শিউরে উঠে সীমালকে নিজের কাছে টেনে নিল সোমক।
সীমাল একটু অবাক হয়ে দেখছিল তার দিকে, “কী হল তোমার? এত অন্যমনষ্ক হয়ে কী ভাবছিলে তুমি এতক্ষণ? আমি তো তোমার কাছেই রয়েছি!”
চেতনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। মাথার ওপর তামাটে হয়ে আসা অপরাহ্নের আকাশের ওপারে নিকট কক্ষপথে একটি ধুলিপুঞ্জ ফের ফিরে গেছে তার গবেষণার কাজে। আকাশের দিকে একঝলক তাকিয়ে ফের সীমালের দিকে ঘুরে তাকাল সোমক।
“তুমি বলছিলে, আজ সন্ধ্যাবেলা—”
“হ্যাঁ সীমাল। আজ সন্ধ্যাবেলা সেই উন্মুক্ত আকাশ আর ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায় তুমি দেখতে পাবে। এই গ্রহের সদ্য উদ্বর্তিত বুদ্ধিধর জাতিটি তাতে অমৃতের স্পর্শ দিয়েছে। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো শুধু।”
“আমি দেখতে চাই সোমক। জানতে চাই। কেবল তোমার জন্য নয় সোমক। এই গ্রহটিকে আমি রক্ষা করতে চাই। এইখানে থেকে আমি—আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করব, কেউ যাতে এর সূর্যকে ঢেকে দিতে না পারে, কেউ যেন এই বাস্তুতন্ত্রটিকে ধ্বংস করে আরো একটি আকাশগঙ্গা সভ্যতার বীজ রোপণ না করে। আমরা তাদের বোঝাবো সোমক—”
বেদনার্ত চোখ নিয়ে সীমালের দিকে তাকিয়ে দেখল পুরুষটি। সে জানে না, কেউ তার জন্য এইখানে আর কোনদিন ফিরে আসবে না—”
“ও কীসের শব্দ সোমক?”
“তারা আসছে সীমাল। তারা জানে না এই দ্বীপে এখন অন্য কেউ আছে। এসো , আমাদের আড়ালে যেতে হবে—”
হাত ধরাধরি করে নারী ও পুরুষটি কিছুদূরে একটি বালুকাস্তূপের অন্তরালে গিয়ে বসল। এইখান থেকে সমুদ্রতটটি সুস্পষ্টভাবে দেখা যায়। কিছুক্ষণ বাদে ঢেউয়ের মাথায় মাথায় অন্ধকার বিন্দুর মত নৌকাগুলি দেখা দিল। সবল হাতের দাঁড়ের টানে ধীরে ধীরে কূলের দিকে এগিয়ে আসছিল তারা। প্রতিটি নৌকার আরোহীদুজনের শরীরে দেবী ইরো ও ভালিয়ার আলোকরশ্মি আশীর্বাদের মতন ছড়িয়ে পড়ছিল। “ওরা কারা সোমক?”
উদ্বর্তনের এ এক বিচিত্র কাহিনী সীমাল। এই গ্রহের সমাজে নারীপুরুষের সম্পর্কে সন্তান উৎপাদন ও বন্ধনহীন আনন্দের সম্পর্কস্থাপনে কোণ বাধা নেই। কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় একে অন্যকে ভালোবেসে একসঙ্গে বাঁচতে চায় তাদের জন্য একটি আশ্চর্য প্রথার উদ্ভাবন করেছে এরা। স্থানীয় ভাষায় তাকে বিবাহ বলে। তার অনুষ্ঠানের পর জুটিগুলি এই নির্জন স্বর্গদ্বীপে এসে তিনটি মধুযামিনী কাটিয়ে যায় একত্রে। এই দ্বীপে স্থানাভাব নেই। প্রত্যেকে বেছে নেবে অন্যের দৃষ্টির আড়ালে তাদের নিজের নিজের মিলনকুঞ্জটিকে। মুক্ত আকাশ ও অকৃপণ প্রকৃতির কোলে দীর্ঘ সময় ধরে চিনে নেবে একে অন্যকে। তারপর ফিরে যাবে নিজেদের গ্রামে সংসার স্থাপনের জন্য।”
“বিবাহ—বিচিত্র নাম। আচ্ছা সোমক, আমরাও সেই প্রথাটির উদযাপন করতে পারি না? আমিও তো চাই—”
তার মুখটিকে দু হাতে ধরে নিজের কাছে নিয়ে এল সোমক, “মাত্রই তিনটি মধুযামিনী পালন করতে পারে এরা এই দ্বীপে। তুমি চাইলে আমরা এইখানে অনিঃশেষ মধুযামিনী পালন করে যেতে পারি সীমাল। তুমি কি তাই চাও?”
“চাই সোমক—আমি চাই—” ফের একবার তার কাছে ঘন হয়ে আসে যুবতীটি। তার চোখদুটি বন্ধ হয়ে আছে—“আমাকে স্পর্শ করে থাকো সোমক। তোমার পাশে এইভাবে বসে আমি অনেকগুলি দিন ও রাত্রি কাটিয়ে যৌবন থেকে বার্ধক্যে পৌঁছে যেতে চাই-আমি তোমাকে ভালোবাসি হে পুরুষ—”
সেই অবসরে আরো একবার, তার দীর্ঘ স্বর্ণবর্ণ কেশে আদরের আঙুলগুলি বোলাতে বোলাতে সামান্য কিছু অণুগণককে তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করিয়ে দিল সোমক। প্রথম অনুভূতি তরঙ্গগুলি মৈথুনকালে সংগৃহীত হয়েছিল। দেবর্ষীদের নিঃসন্দেহ করবার জন্য, এখনকার এই শারীরিক আমোদবিহীন মুহূর্তটিতে উত্থিত অনুভূতির এই দ্বিতীয় তরঙ্গটিকেও সঞ্চয় করে নেওয়া প্রয়োজন।
হঠাৎ নীচুতারে বাঁধা তীক্ষ্ণ একটি শব্দ সীমালের মনোযোগটিকে ফিরিয়ে নিয়ে এল পাশে পড়ে থাকা তার বর্মটির দিকে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে তার একটি অংশে হাত ঢুকিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠা ছোট একটি যন্ত্র বের করে এনে একনজর দেখে সে বলে উঠল, “তারা আসছে সোমক। আমার অবস্থান তারা খুঁজে পেয়েছে—”
সোমক তার কথার কোন উত্তর দিল না। হঠাৎ করেই ধ্যানস্থ হয়েছে যেন সে। শরীরটি কঠিন করে সামনের দিকে শূন্য দৃষ্টি মেলে সে তাকিয়েছিল। তার মাথার মধ্যে তখন একটি সাবধানবাণী বেজে চলেছে, “আগন্তুক যান-অভেদ্য শক্তিবর্মে আচ্ছাদিত—এই গ্রহের উচ্চ আবহমণ্ডলে অতিমহাকাশ সুড়ঙ্গ থেকে আবির্ভূত হয়েছে- ইকসা দ্বীপের দিকে এগিয়ে চলেছে যানটি--সাবধান সোমক--—”
“দেবর্ষীদের সংবাদ পাঠাও নেরা। তারপর এইখানে এসে পৌঁছাও—”
“আমি তা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি সোমক। তাঁরা আসছেন। শুধু সামান্য কিছুটা সময় এদের কোনভাবে নিষ্ক্রিয় রাখতে হবে আমাদের—”
“কিন্তু এর মধ্যে এদের সম্পূর্ণ নৌবহর এসে পৌঁছোলে সেই সামান্য সময়ের মধ্যেই এই গ্রহটিকে প্রাণশূন্য করে দিতে সক্ষম হবে তারা নেরা। সব শেষ হয়ে যাবে—”
“তা ঘটবে না। বাকি যানগুলিকে তাঁরা বিতাড়িত করেছেন। শুধু এই একটি যানই সম্ভবত কোনভাবে তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে—”
উঠে দাঁড়িয়ে সীমালের দিকে হাতটি বাড়িয়ে ধরল সোমক। দেবর্ষীদের যানকে অতিক্রম করে—কী করে তা সম্ভব হল? আকাশের গভীর থেকে হঠাৎ একটি ধুলিরেখা তীব্রবেগে এগিয়ে এসে ততক্ষণে তাদের চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছে। সোমক সেটিকে ঘুরে দেখল একবার। সীমাল তাকে খেয়াল করে নি। তার চোখদুটি তখন, মধ্য আকাশে দেবী ইরোকে আচ্ছাদিত করে একটি অতিকায় রাক্ষস পতঙ্গের মত অবতরণ করতে থাকা যানটির দিকে নিবদ্ধ।
বেলাভূমির উৎসব থেমে গেছে। বালির ওপর এসে স্থির হওয়া কদাকার যানটি একটি হিংস্র প্রাণীর মত নিঃশব্দে অপেক্ষা করছিল। মানুষগুলি সভয়ে বেশ কিছুটা দূরে সরে গিয়ে তাকিয়ে দেখছে সেটির দিকে। পালিয়ে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করবার কথা তাদের মাথায় আসে নি। অকারণে প্রাণনাশ হয় না এই গ্রহে। সেই ভয় পেতে তারা শেখেনি কখনো।
ধীরে ধীরে যানটির দিকে এগিয়ে গেল সোমক ও সীমাল। এইবার মৃদু সারা জাগল সেটির দেহে। তার মুখের কাছ থেকে একটি স্ফটিক বের হয়ে এসেছে। তার লক্ষ্য বেলাভূমিতে সশংকে অপেক্ষমান মানুষগুলি। স্ফটিকটির ওপরে একটি আলোকিত গবাক্ষ খুলে গেল হঠাৎ। একজন যোদ্ধা সেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর দৃঢ়বদ্ধ মুখটিতে একটি আলোকরশ্মি এসে পড়েছিল।
“সহ নির্দেশক সীমাল—”
সোমককে উপেক্ষা করে সরাসরি সীমালকে সম্বোধন করছিলেন প্রৌঢ়াটি, “আমি অভিযান নির্দেশক হেলেনা জাইলভস্কি। তুমি জীবিত আছ দেখে ভালো লাগল।”
সীমালের মুখটি হাসিহাসি হয়ে উঠল এইবার, “শুভ সন্ধ্যা নির্দেশক জাইলভস্কি। নোভোস দুই গ্রহে আপনাকে স্বাগত জানাই। বাকি উপনিবেশ স্থাপক নৌবহরটি—”
“আমি তাদের পেছনে রেখে এগিয়ে এসেছি সীমাল। তারা আসছে।” বলতেবলতেই সোমকের দিকে ঘুরে দেখলেন প্রৌঢ়াটি। তারপর মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বললেন, “তোমার যৌনদাসটি চমৎকার, একে কি ওই আদিম মনুষ্যেতরের দল থেকেই সংগ্রহ করেছ তুমি?”
“মহামান্য, আমার সঙ্গী এ গ্রহের স্থানীয় বাসিন্দাদের দলভূক্ত নয়। এবং সে আমার যৌনদাসও নয়। সে আমার বন্ধু। আমরা পরস্পরকে নির্বাচন করেছি—”
“বন্ধু? একজন পুরুষ? পরস্পরকে নির্বাচন— কথাগুলির অর্থ আমার বোধগম্য হল না সীমাল। দখলের প্রাথমিক পর্ব সম্পন্ন হবার পর তুমি সেগুলি আমায় বুঝিয়ে বলবে।”
“বলব মহামান্য। এই গ্রহে এসে আমি এমন কিছু জেনেছি যা আমি নোভোস থেকে আগত সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই।”
“নিশ্চয় সীমাল। তবে এখন নয়। আগে কাজগুলি সম্পন্ন হোক। তবে একটি অপ্রিয় কর্তব্য রয়েছে আমার। সেটি প্রথমে করে নেয়া যাক—”
বলতে বলতে তাঁর হাতের একটি সামান্য নির্দেশে যানটির পার্শ্বভাগ থেকে একটি স্বচ্ছ গোলক নির্গত হয়ে সীমালের সামনে এসে থামল। “তোমার অস্ত্রশস্ত্রগুলি নিচে রেখে তোমার যৌন—উঁহু, কী যেন বললে—বন্ধু--, তাকে নিয়ে তুমি ঐ জীবাণুনাশক গোলকটিতে করে যানে উঠে আসবে এই মুহূর্তে। উপস্থিত কিছুক্ষণ বন্দি থাকতে হবে তোমাকে।”
সীমালের ভ্রুদুটি কুঞ্চিত হয়ে উঠল, বর্মের দুপাশে রাখা অস্ত্রগুলিকে একবার স্পর্শ করে সে বলল, “কিন্তু-কেন?”
“স্বাভাবিকভাবেই, তোমার তা জানবার কথা নয়। তোমার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার গুরুতর অভিযোগ আছে। যদিও আমি নিজে বিশ্বাস করি তা মিথ্যা, কিন্তু তবু, সামরিক আদালতের সামনে তোমাকে নির্দোষীতার প্রমাণ পেশ করতে হবে। কথা দিচ্ছি মাত্রই একটি দিন সময় নেব আমরা। ততক্ষণ তোমার ওই পুরুষটিকে আমরা একটু উপভোগ করে নিতে চাই। যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের অনেকেরই জৈবিক ক্ষুধা দীর্ঘকাল অপরিতৃপ্ত রয়েছে।”
হঠাৎ সোমকের সামনে এসে তাকে দুহাতে আবৃত করে দাঁড়াল সীমাল।
হেলেনা ভ্রু দুটি কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। তারপর বললেন, “তোমার আচরণ থেকে মনে হচ্ছে তুমি তা করতে রাজি নও সীমাল। কিন্তু কেন? পুরুষ তো উপভোগেরই বস্তু। তাকে তুমি ভাগ করে নিতে চাও না?”
“না মহামান্য।”
“আমি কিন্তু তোমায় কোন অনুরোধ করিনি সহনির্দেশক। এটি একটি আদেশ।”
সীমাল নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল সোমককে আড়াল করে।
নিঃশব্দে সেইদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলেন হেলেনা। তারপর কেটে কেটে বললেন, “তোমার এই আচরণ ব্যখ্যাহীন, শিষ্টাচারবিরোধী এবং শৃংখলাভঙ্গের সামিল। আমি তোমায় সাবধান করে দিতে চাই যে, এর ফলে তোমার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগটি জুরিদের মনে দৃঢ়তরই হবে।”
“আমি সে বিচারের সম্মুখীন হবার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত মহামান্য। কিন্তু এই পুরুষটিকে আমি কোনমতেই আমাদের সেনাদলের জৈবিক ক্ষুধাপূর্তির যন্ত্র হতে দিতে রাজি নই।”
হেলেনা মাথা নাড়লেন একবার। তারপর হাত উঁচিয়ে মাথার ওপর এগিয়ে থাকা স্ফটিকটিকে দেখিয়ে বললেন, “তর্ক করবার অবসর আমার নেই সীমাল। দ্বীপটির সম্পূর্ণ নির্বীজকরণের আগে এখানকার অচেনা জীবকণার সংস্পর্শে আমি আমার কোন সেনাকে আসতে দিতে রাজি নই। পুরুষটিকে আমাদের উপভোগের জন্য ভাগ করে নিতে অস্বীকৃত হলে তুমি একাই উঠে এস। এই স্ফটিকটিতে এই মুহূর্তে সিগমা রশ্মির সঞ্চার করা হচ্ছে। কয়েকটি ঝলকে প্রথমে এই দ্বীপটির নির্বীজকরণ করা হবে এখন। তারপর এর ওপর একটি ক্ষণস্থায়ী সৌরশোষক আবরণ স্থাপন করে আমরা সোন্যদলের জন্য প্রথম ঘাঁটিটি নির্মাণ করব। আমাদের হাতে সময় নেই সীমাল।”
ধুলিকণার আবরণটি মাথার ওপরে স্থির হয়ে ভাসছিল। সোমক একবার সেটির দিকে তাকাল। সম্পূর্ণ নির্বাক হয়ে রয়েছে নেরা। চেতনার সামান্যতম তরঙ্গও বের হচ্ছে না তার দিক থেকে।
স্ফটিকটি থেকে গুণগুণ শব্দ নির্গত হতে শুরু করল হঠাৎ। দ্রুত বর্ণ পরিবর্তন করে লোহিততপ্ত একটি পুষ্পের আকৃতি নিচ্ছিল তা।
হঠাৎ সোমকের হাত ছেড়ে কিছুদূরে অপেক্ষায় থাকা পুষ্পসজ্জিত দম্পতিদের দিকে ছুটে গেল সীমাল, “মূর্খের দল, দাঁড়িয়ে থেকো না। অরণ্যের আশ্রয় নাও। কয়েক মুহূর্ত বাকি আছে আর—” তার ভাষাটি না বুঝলেও তার মধ্যে থাকা শক্তিশালী আবেদনটির অনুভূতিটি ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল মানুষগুলির মধ্যে। হঠাৎ ভয়ার্ত গলায় আর্তনাদ করে উঠে নিকটবর্তী অরণ্যের অন্ধকারের দিকে ছুটে গেল তারা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছুটন্ত মানুষগুলির দিকে একবার দেখে নিয়ে যানটির দিকে ঘুরে তাকাল সীমাল। ভাসমান ধুলিপুঞ্জটি তখন সোমকের সঙ্গ ছেড়ে সীমালের দেহের চারপাশে একটি সুক্ষ্ম অর্ধস্বচ্ছ মেঘের মত দুলছে।
সেইদিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গিয়ে স্ফটিকটির নিশানার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। তারপর নীচু গলায় স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, “আমি ফিরে যেতে চাইনা হেলেনা। যে স্বর্গের সন্ধান আমি আপনাদের দেব বলে স্থির করেছিলাম, আপনারা তার যোগ্য নন। এই প্রাণীগুলিকে হত্যা করতে হলে প্রথমে আপনাকে স্বজাতির হত্যা দিয়ে শুরু করতে হবে। সিগমা রশ্মির প্রথম ধারাটি আপনি আমার ওপরে ওপরে বর্ষণ করুন।”
প্রৌঢ়ার মুখটি কুঞ্চিত হল একটু। এক মুহূর্ত থেমে থেকে তিনি বললেন, “আমারই ভুল ছিল তাহলে। বিশ্বাসঘাতকতা তুমি সত্যই করেছ সীমাল। মাতৃগ্রহের প্রতি আনুগত্য হারিয়ে একটি অজানা গ্রহের কিছু মনুষ্যেতর জীবের সঙ্গে যোগ দিয়েছ। ক্ষমতার বড়ো লোভ তোমার সীমাল, তাই না? ভেবেছিলে আকাশগঙ্গা থেকে এই গ্রহে এসে এই আদিম জীবদের ঈশ্বরী হয়ে একটি স্বাস্থ্যবান যৌনদাসকে সঙ্গে নিয়ে জীবনটিকে উপভোগ করবে। সেইজন্য নিজের মাতৃগ্রহকে ধ্বংস করতেও তোমার হাত কাঁপেনি—”
“নোভোস—ধ্বংস হয়েছে? কিন্তু আমি—”
“থামো। নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করবার আর কোনো সুযোগ তুমি পাবে না বিশ্বাসঘাতক যোদ্ধা। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হবে।”
বলতে বলতেই তাঁর হাতের ইশারায় মৃদু ঝলসে উঠল স্ফটিকটি। সেই খণ্ডমুহূর্তটিতেই হঠাৎ সোমক অনুভব করল সীমালকে ঘিরে থাকা ধুলিকণাগুলি চঞ্চল হয়ে উঠেছে। রশ্মির আঘাতটি সীমালকে স্পর্শ করা ও তার বালুকাশয্যায় লুটিয়ে পড়বার মুহূর্তটির মধ্যে দ্রুতবেগে তা সীমালের দেহের মধ্যে অদৃশ্য হয়েই ফের বাইরে বের হয়ে এসে ভেসে উঠল বাতাসে। সীমালের প্রাণহীন শরীরটি তখন লুটিয়ে পড়েছে বালুকাশয্যায়।
“জেনারেটর পূর্ণশক্তিতে নিয়ে যান। গোটা দ্বীপটিকে আবৃত করে পরবর্তী আঘাত—”
বাক্যটি সম্পূর্ণ করা হল না হেলেনার। হঠাৎ করেই কোন অধিকতর শক্তির আঘাতে স্ফটিকটি সম্পূর্ণ শক্তিহীন হয়ে নির্বাপিত হয়েছে। দেবী ইরো ও ভালিয়ার আলোকে আচ্ছাদিত করে তখন যানটির মাথার ওপরে নেমে আসছিল পঞ্চাশ যোজন পরিমিত অতিকায় নৌকাটি। পরমুহূর্তেই তার অদৃশ্য আকর্ষণে একটি পালকের মতই ভাসতে ভাসতে যানটি গিয়ে নৌকার নীচের দিকে খুলে যাওয়া একটি সুড়ঙ্গে অদৃশ্য হল। আর তার পর হঠাৎ গতি বাড়িয়ে ফের আকাশ থেকে উধাও হল সেই অতিকায় নৌকা।
“কোথায় যাবো?”
“আকাশগঙ্গায়। দেবর্ষীদের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। তাঁরা এবার ফিরে যাবেন নিজের বিশ্বে। কিন্তু আকাশগঙ্গায় আমাদের আরব্ধ কাজ এইবারে শুরু হবে যে। তাঁরা আমাদের সেইখানে পৌঁছে দিয়ে যাবেন সোমক।”
একটি নরম হাত এসে তার মাথাটিকে স্পর্শ করেছে। সোমক মুখ তুলে চাইল। নেরা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। কতক্ষণ কেটে গেছে তার এইভাবে একাকি পর্বতচূড়ায় সেই গুহাটিতে বসে তা সোমকের মনে নেই। সমুদ্রতটটি শান্ত হয়ে আছে। দম্পতিরা হয়ত বা সন্ধ্যার সেই আতংকের মুহূর্তগুলিকে কাটিয়ে উঠে এতক্ষণে আপন আপন কুঞ্জবনে তাদের মধুযামিনী পালনে মগ্ন হয়েছে ফের। উপগ্রহদুটির আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত হয়ে রয়েছিল তখন। তটভূমি থেকে কিছুটা দূরে মৃদু সঞ্চরমান জলরাশির ওপরের বাতাসে অতিকায় নৌকাটি স্থির হয়ে অপেক্ষা করছিল।
“নেরা—”
“আমি পেরেছি সোমক। আমি সফল হয়েছি। ভালোবাসার গোপন সংকেতটিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি আমি,” নেরার কন্ঠের উচ্ছাস বাধা মানছিল না, “তোমার স্বপ্ন এবার সফল হবে সোমক। এখন আমি জানি, কেমন করে ওই আকাশগঙ্গার দানবজাতির মধ্যে দ্রুত জাগিয়ে তোলা যাবে বিস্মৃত সেই ভালোবাসার অনুভূতিটিকে—আমি জানি—”
“আমাকে একটুক্ষণ একা থাকতে দাও নেরা। এইখানে- সীমালের এই গুহাটিতে-একটি রাত শুধু—”
তার দিকে একটুখানি তাকিয়ে দেখল নেরা একবার। তারপর হঠাৎ একটি লতার মতন তার শরীরকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, “কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব হল তা তো জানতে চাইলে না সোমক—”
কন্ঠস্বরটি কানে যেতে হঠাৎ সোমকের শরীরটি রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। চোখ খুলে মৃদু গলায় সে বলল, “সীমাল—”
নেরার চোখদুটির মধ্যে দিয়ে সীমালের গভীর নীল চোখদুটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল যেন।
“অবাক হচ্ছ সোমক? তোমার সীমাল হারিয়ে যায় নি।”
“কিন্তু—”
“তোমাকে বলেছিলাম না, সীমালের চেতনার সঙ্গে একটুক্ষণের জন্য মিশ্রিত হতে পারলে আমি সেই অজ্ঞেয় গণিতের সূত্রটিকে আবিষ্কার করে নিতে পারব জৈবিক ও যান্ত্রিক দুটি চেতনার মিশ্রশক্তির বলে? আমরা তা পেরেছি সোমক। সীমালের দেহটির মৃত্যুর মুহূর্তে তার মস্তিষ্কের গভীরে পৌঁছে তার চেতনাটিকে আমি নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিয়েছি—আমি—আমরা এখন এক—ভালোবাসার অর্থ আমরা জানি সোমক—জানি, কেমন করে তার ঘুমন্ত বীজটিকে ফের একবার জগিয়ে তুলতে হবে আকাশগঙ্গার ওই দানবজাতির মধ্যে-তোমার সীমাল বেঁচে আছে প্রিয়তম, তোমার নেরা আর যন্ত্রমস্তিষ্ক নই—আমি তোমার মত—আ-আমরা তোমার—”
মৃদু হাসি ফুটে উঠল সোমকের মুখে। প্রিয় নারীটিকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে তার ওষ্ঠে ওষ্ঠ রেখে সে বলল, “কোন নামে ডাকব আমি তোমাকে আমার ঈশ্বরী?”
ভাসমান যান তিনটি নৌশৃঙ্গের নিচে এসে কিছুক্ষণ স্থির থাকল। স্থানটি সাধারণ একটি গিরিচূড়ামাত্র। তবে প্রবাদে বলে একদা এইখানে দেবতার আবাস ছিল। অতিকায় একটি নৌকা এইখানে আকাশকে স্পর্শ করে জেগে থাকত। তারপর একসময় তাদেরই হাতে বিশ্বের ভার সমর্পণ করে সেই দেবতারা তাদের বোধের সীমার বাইরে চিরবিশ্রামে গিয়েছেন।তবে সে কেবলই কবির কল্পনা। এই গ্রহের তিন সহস্র বর্ষের ইতিহাসে কখনো সেই দেবতাদের কোন ভৌত অস্তিত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবুও এই বিশ্বাসটিকে এই গ্রহের প্রতিই মানুষ এখনও শ্রদ্ধা করে চলে। বলা হয়, এই গ্রহের জীবকূলের ‘ঈশ্বরজাতি’ এই নামকরণটিও তাঁদেরই করা।
এই যান তিনটিও শ্রদ্ধা নিবেদন করতেই আজ এসেছে এইখানে। একটি ঐতিহাসিক মূহূর্তের সূচনার প্রাক্কালে।
প্রথম যানটি থেকে একজন ঈশ্বরজাতীয় পুরুষ ও মহিলা নেমে এসে যুক্তপাণি হয়ে দাঁড়ালেন শৃঙ্গটির সামনে। গম্ভীর, নীচু গলায় বললেন, “আজ প্রথম ইরাস্মান গ্রহের বাসিন্দারা এই বৃহশির তারকাপুঞ্জের বাইরে অভিযানে চলেছে। আকাশগঙ্গা তারকাপুঞ্জের দানবসভ্যতার যে বন্ধুগ্রহগুলি দীর্ঘকাল ধরেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে, তাঁদেরই সহায়তায় তারকাভ্রমণের প্রযুক্তিটি আমাদের এত দ্রুত করায়ত্ত করা সম্ভব হয়েছে। আপনারা তাঁদের মঙ্গল করুন হে দেবর্ষীদ্বয় হবিষ্ট ও ক্ষিতিজ। আজ বন্ধুত্বের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হোক এই ঈশ্বরজাতি ও ওই দানবসভ্যতার মধ্যে। প্রার্থনা করি দূর ভবিষ্যতে আপনাদের আশীর্বাদে তা প্রসারিত হয়ে যাক সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে—”
************
প্রার্থনার সেই দৃশ্যটি তখন তাদের অজান্তে অন্য একটি স্থানেও প্রতিফলিত হচ্ছিল। আকাশগঙ্গার কেন্দ্রস্থলে মানুষের অগম্য একটি গ্যাসদানবের অভ্যন্তরে ঘন, বিষাক্ত গ্যাসের মেঘমালার দেহে প্রতিফলিত সেই চিত্রটি দেখতে দেখতে বড়ো আনন্দে একে অন্যের আলিঙ্গনে মিশে যাচ্ছিল একজন পুরুষ ও তার কৃষ্ণকেশী, শ্যামাঙ্গী অথচ তীব্র নীলানয়না সঙ্গিনী। গত তিনটি সহস্রাব্দি ধরে এই আকাশগঙ্গা নক্ষত্রপুঞ্জের গ্রহে গ্রহান্তরে তারা একটু একটু করে বড়ো যত্নে বপন করে চলেছে তাদের আবিষ্কৃত সেই ঈশ্বরীয় অনুভূতির বীজ। ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে তাদের সঙ্গে বৃহশির নক্ষত্রপুঞ্জের ঈশ্বরজীবদের নিবিড় সখ্য।তাদের স্বপ্ন পূরণের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল আজ এই দুই তারকাপুঞ্জের দানব ও ঈশ্বর বাসিন্দারা। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পুরুষটির কন্ঠ আলিঙ্গন করে সে তার কানে কানে বলল, “আমরা তোমায় ভালোবাসি সোমক। ভালোবাসার অর্থ আমরা জানি—”
(শেষ)