• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬৪ | সেপ্টেম্বর ২০১৬ | উপন্যাস
    Share
  • অন্য কোনখানে : দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য

    চতুর্থ অধ্যায়


    || ২ ||

    এক অমোঘ উত্থান


    সীমাল একটি আশ্চর্য স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্নে সেই রহস্যময় পুরুষটি তার সঙ্গে খেলা করে। নির্জন অরণ্যে, পাহাড়ে, স্বর্ণাভ বালুকাভূমিতে তাকে নিয়ে হেঁটে যায় সেই পুরুষ। এইখানে কোন যুদ্ধ নেই। অস্ত্রের ঝনঝনা নেই। পরিচিত দুনিয়ার কোন উপসর্গই নেই এই স্বর্গভূমিতে। আছে শুধু প্রিয়তম একটি দ্বিতীয় সত্তা। তবুও নিজেকে বিচ্ছিন্ন লাগে না তার। কেমন করে যেন একটি অজানা, নতুন জীবনবোধ তাকে পরিপূর্ণ রাখে। দূর নক্ষত্রমণ্ডলে কিছু ভাসমান রণপোত মাঝেমাঝে চোখে পড়ে তার। নিঃশব্দে একে অন্যকে আক্রমণ করে ছিন্নভিন্ন করে চলে তারা। সীমাল দেহহীন এক অস্তিত্ত্ব হয়ে সেইগুলিকে দেখে চলে শুধু। কী যেন মনে পড়তে গিয়েও মনে পড়ে না তার—আর সেই মুহূর্তেই পুরুষটি এক বজ্র আকর্ষণে তাকে কাছে টেনে নিয়ে সবকিছু ভুলিয়ে কী এক মোহমন্ত্র পড়ে দেয় তার শরীরে—তার দেহের প্রতিটি তন্ত্রী এক অপরিচিত সুরে বেজে ওঠে যেন। শারীরিক আনন্দের যে অভিজ্ঞতাটিকে সে এতদিন জেনে এসেছে এ অনুভূতি তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা—

    কিন্তু তবু, সেই সব সুখানুভূতির ভিতরেও একটি বেদনার অনুভূতি কাজ করছিল তার মধ্যে। ক্রমশই তীব্র হয়ে উঠছিল তা। তারপর একসময় রূঢ়ভাবে সে অনুভূতিটি তার ঘুম ভাঙিয়ে দিল। মাথার ওপরে অরণ্যের পত্রমুকুটটির ফাঁক দিয়ে অজস্র রৌদ্রশলা এসে বিদ্ধ করেছে তাকে। চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখল সে। জনমানবের চিহ্ন নেই সেই অরণ্যে। শুধু সমুদ্রের দূরাগত গর্জন শোনা যায় বনান্তরাল থেকে।

    শরীরের ভিতরে কষ্টদায়ক অনুভূতিটি ক্রমশই বেড়ে উঠছিল তার। অনুভূতিটি তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। অস্থিরভাবে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই যুবতীটির চোখে পড়ল পাশে পাতার পাত্রে রাখা স্বচ্ছ পানীয় জলটির দিকে। উঠে বসে সেটিকে হাতে তুলে নিয়ে আকন্ঠ পান করল সে। এইবারে কিছুটা সুস্থ লাগছে। জলপাত্রটির পাশে গুটিকয় ফল রাখা রয়েছে। তবে কি কালকের সেই পুরুষটি তার জন্য—

    হঠাৎ একটি বিচিত্র সুখানুভূতি ছেয়ে গেল তার মনের ভিতর। ফলগুলি অপরিচিত। তবে তাদের সুগন্ধ লোভনীয়। হাত বাড়িয়ে একটি ফল তুলে নিয়ে তাতে কামড় বসাল সে। হালকা অম্লমধুর একটি স্বাদ ছড়িয়ে পড়ছে জিভে—”

    কিছুক্ষণ বাদে সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল যোদ্ধা সীমাল। অযথা কোন দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয়া নোভোস গ্রহের একজন যোদ্ধার শোভা পায় না। পুরুষটি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। এবং বিপজ্জনক। এই গ্রহটিতে এখনও অবধি এই একটির বেশি কোন মানুষও তার চোখে পড়েনি। কেন? তার যানটিকে ধ্বংস করতে বাধ্য হয়েছে সে এর জন্য। অথচ এই মানুষটি তাকে এত যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে। কেন? তবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এই মুহূর্তে তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব হবে না। চারপাশের গভীর অরণ্যটিকে সে ঘুরেফিরে তাকিয়ে দেখল একবার। এই তার একমাত্র উপায়। যতদিন না নোভোসের সেনাবাহিনী এসে পৌঁছোচ্ছে, এই অরণ্যভূমিতে তাকে লুকিয়ে থাকতে হবে। তারপর, যেদিন নোভোসের সেনাদল এসে পৌঁছোবে এই গ্রহের কক্ষপথে, সেদিন সীমাল ফের একবার মুখোমুখি হবে ওই অহংকারী পুরুষের।

    তবু, মানুষটির কথা মনে পড়তেই কেন যেন সমস্ত অসন্তোষ, সমস্ত ভয়ের কথা দূরে সরে গিয়ে তার উষ্ণ স্পর্শের স্মৃতিটি ভেসে আসে তার অনুভূতিতে। গভীর দুটি চোখ, পেশিবহুল শরীরে তার এলোমেলো চুলগুলি সর্পশিশুর মত খেলা করে যায়-—

    হঠাৎ সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে দিল সীমাল। এ কী ভাবছে সে? তার গণকটির যন্ত্রমস্তিষ্ককেও বশীভূত করা হয়েছিল কিছু সময় আগে। তবে কি—

    সামান্য শিউরে উঠল সে একবার। পায়ের কাছে খানিক দূরে তার গতরাত্রের পোশাকগুলি পড়েছিল। এক এক করে সেগুলি পরে নিয়ে অস্ত্রসমেত বর্মটিকে গায়ে জড়িয়ে নিল ফের। কোমরের কাছে ভারী রশ্মি-অস্ত্রটির শীতল ও বন্ধুত্বপূর্ণ স্পর্শ তাকে খানিকটা আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিচ্ছিল। উদ্ধত সেই পুরুষ তাকে চেনে নি এখনও।

    মানুষটির কথা মনে ঘুরে আসতেই ফের একটা তীব্র রাগ ছড়িয়ে গেল তার শরীরে। সমুদ্রের জলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই চেতনা হারিয়েছিল সে কাল রাত্রে। নিঃসন্দেহে পুরুষটি কোন এক সময়ে তাকে এই পর্ণশয্যায় তুলে এনেছে। তাকে কিছু খাদ্য ভিক্ষাও দিয়েছে। তার দেহ থেকে সিক্ত পোশাক খুলে সযত্নে সরিয়ে রেখেছে পাশে। অথচ রতিক্রিয়ার কোন চিহ্ন নেই তার শরীরে। বন্ধু হোক বা শত্রু হোক, সীমালের ঘুমন্ত, নগ্ন শরীরের আকর্ষণকে উপেক্ষা করতে পেরেছে একজন পুরুষ—এই প্রথম। একটা তীব্র অপমানবোধ কাজ করছিল তার ভিতরে। কী ভাবে নিজেকে সোমক নামের ওই পুরুষজীবটি? প্রথমে সে তাকে পরাস্ত করেছে, তারপর দয়া ও উপেক্ষা দেখিয়ে—

    এই আত্মম্ভরিতা তাকে ভাংতে হবে। ওই পুরুষটিকে বশ্যতা স্বীকার করাবে সীমাল। কোন ঋণ সে রাখবে না তার কাছে। শুধু—একবার সেনাবাহিনীর আসবার খবরটা এসে পৌঁছাক তার সংযোগযন্ত্রে! নিষ্ফল আশায় সে বারবার তার বর্মের একপাশে সংযুক্ত যন্ত্রটিকে চালু করে তার সাহায্যপ্রার্থনার বোতামটিকে টিপে ধরে-—

    খানিক বাদে উঠে দাঁড়াল সীমাল। আশেপাশে জীবজন্তুদের চলবার ক্ষীণ পথরেখা চোখে পড়ে। তাদেরই একটি ধরে একটি পাহাড়ি চড়াই-এর দিকে এগিয়ে চলল সে। কোন উঁচু স্থান থেকে জায়গাটি একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার প্রথমে—


    ************


    মহানির্দেশক রমুলা জাইমিন খানিকটা হতবাক হয়েই হাতে ধরা যন্ত্রটির পর্দার দিকে তাকিয়েছিলেন। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কিন্তু—কী করে তা সম্ভব অ্যাডলিন্ডা? গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হিসাবে আপনি নিজে—”

    “আমি নিশ্চিত মহানির্দেশক। এ খবরটি আমার দফতর থেকে কোনমতেই বের হতে পারে না। অথচ—”

    “অথচ—” রমুলা জাইমিনের ভ্রু দুটি কুঁচকে উঠেছিল। অ্যাডলিন্ডার দক্ষতা ও সততা প্রশ্নাতীত। অথচ এই মুহূর্তে আকাশগঙ্গায় মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির সবগুলি গণরাজ্যই একযোগে আকোনা গ্রহের যুদ্ধে অজানা প্রযুক্তির ব্যবহারকারী হিসেবে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করেছে নোভোস গ্রহকে। কী করে—

    “আমি কিছু অনুসন্ধান করেছি এ বিষয়ে। তার প্রাথমিক ফলাফল ও অনুসিদ্ধান্তগুলো আপনার গোচরে আনতে চাই মহানির্দেশক।”

    পর্দার দিকে মুখ ফিরিয়ে মাথা নাড়লেন রমুলা জাইমিন, “এই মুহূর্তে সেসব জেনে কোন লাভ আছে কি অ্যাডলিন্ডা? ষোলটি গণরাজ্যের মিলিত বাহিনী এই মুহূর্তে কারিয়ান নীহারিকায় একত্রিত হচ্ছে। মিত্র ও অক্ষশক্তি হাত মিলিয়েছে আমাদের থেকে এই শূন্যজ শক্তির প্রযুক্তির দখল নেবার জন্য। আর দু একদিনের মধ্যে নোভোস গ্রহকে ঘিরে তারা দুর্ভেদ্য একটি প্রতিরক্ষাবলয় গড়ে তুলতে চলেছে। তার আগেই আমাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলি নিয়ে নিতে হবে। এখন অপরাধীর অনুসন্ধান করে অপচয় করবার মত সময় আমার নেই।”

    “মার্জনা করবেন মহানির্দেশক। পরবর্তী পদক্ষেপ বলতে যদি ক্যানি মেজরির সেই গ্রহটিতে একটি বড়ো বাহিনীর সমরঘাঁটি তৈরি করবার অভিযানের কথা ভেবে থাকেন সেক্ষেত্রে আমার অনুসিদ্ধান্তগুলি এই মুহূর্তে আপনার আরও বেশি করে শোনা প্রয়োজন। তার পর সেই অনুযায়ী উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন না করলে আমাদের এই শেষ আশাটিও ধংস হয়ে যেতে পারে।”

    “কী বলতে চাইছেন আপনি?” জাইমিনের কন্ঠস্বরে কৌতুহলের স্পর্শ ছিল।

    “সহ নির্দেশক সীমাল বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।”

    “কোন প্রমাণ?” চাপা গলায় প্রায় ফিসফিস করে শব্দগুলি ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন রমুলা।

    সেইটিই আপনার গোচরে আনতে চাইছি। আমাদের আকোনা অভিযানের যে খবরটি গোটা নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতিটি গ্রহে সম্প্রচারিত হয়েছে সেটি নিছক একটি সংবাদ নয়। সেটি আকোনা ধ্বংসের অব্যবহিত পরে ঘটা জিমুয়েলা তাং ও সীমালের মধ্যে একটি কথোপকথনের পুর্ণাঙ্গ রেকর্ডিং।”

    স্থির দৃষ্টিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মহানির্দেশক। অ্যাডলিন্ডা বলে চলেছেন তখন, “জিমুয়েলা এবং সীমালের যানের গণকের স্মৃতিতে এই তথ্যগুলি রয়েছে। এবং তথ্যসংরক্ষণের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী দুটি যান থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটও কেন্দ্রীয় মহাফেজখানার গণকেও সঞ্চিত হয়েছে।

    “আমি জিমুয়েলার যান এবং মহাফেজখানার গণকটিকে নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। সেখান থেকে এ তথ্যগুলি সম্প্রচারের কোন চিহ্ন নেই। অতএব অবশিষ্ট রইল সীমালের যানটি। তার পাঠানো শেষতম সম্প্রচারটি জানাচ্ছে, তার যানটি কোন ব্যাখ্যাহীন শক্তির কবলে পড়েছে এবং সে তাকে ধ্বংস করতে চলেছে। তার পর থেকে তার যান থেকে কোন সম্প্রচারই আর এসে পৌঁছায় নি আমাদের কাছে।”

    হঠাৎ আঙুলের একটি ছোঁয়ায় যোগাযোগটি বিচ্ছিন্ন করে দিলেন রমুলা। প্রমাণটি অকাট্য এবং যুক্তিসঙ্গত। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সংযোগযন্ত্রের গায়ে তাঁর আঙুলগুলি দ্রুত চলাচল করছিল।


    ************


    প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ভাসমান উদ্বিগ্ন ষোলজন সেনাধ্যক্ষের মুখগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন রমুলা জাইমেল। তারপর ধীরকন্ঠে বললেন, “আজ আপনাদের হাতেই নোভোস গ্রহের ভবিষ্যৎ গৌরব নির্ভর করছে।”

    “আদেশ করুন মহানির্দেশক,” সবচয়ে সামনে ভাসমান বয়োজীর্ণ মানুষটি তাঁর কঠিন নীল চোখদুটি তাঁর দিকে তুলে বললেন।

    “সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের একটি বিশাল নৌবহর যে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সে কথা আপনারা সকলেই জানেন।”

    “আপনি আদেশ করলে আমরা জীবনপণ করে তার—”

    “থামুন কমান্ডার হেলেনা। মূর্খের মত সামান্য শক্তি নিয়ে গ্রহপুঞ্জের দানবিক শক্তির মুখোমুখি হবার কোন অর্থ নেই। প্রতিরক্ষার কৌশল ও তা কার্যকরী করবার ভার বাহিনীর বাকি অধিনায়কেরা নির্ধারণ করবেন। ইতিমধ্যে আপনাদের কাজ প্রতিরক্ষা নয়, পশ্চাদপসরণ।”

    কথাক’টি বলে চারপাশের বিমর্ষ মুখগুলির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন রমুলা। তারপর বললেন, “আপনাদের এই আদেশ দেবার কারণ, আপনারা, এবং আপনাদের যানে যে সমাজের অন্যান্য মানুষদের আপনারা বহন করে নিয়ে যাবেন, তাঁরা এই গ্রহের শ্রেষ্ঠতম মানুষ। তাঁরা ক্যানি মেজরির উদ্দিষ্ট গ্রহটিতে পৌঁছে সেখানে নোভোস দুই এর গোড়াপত্তন করবেন। গুরুতর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে আপনাদের। কেউ তা পালন করতে অনিচ্ছুক হলে জানান। আমি তাঁর পরিবর্তে—”

    সম্পূর্ণ সভাটিকে নিশ্চুপ দেখে একটু পরে রমুলা ফের মুখ খুললেন, “আমি নিশ্চিত ছিলাম, মাতৃগ্রহের স্বার্থে আপনারা সকলেই আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। ক্যানি মেজরির ওই গ্রহটিতে কিছু রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। একটি বিশ্বাসঘাতকতা ঘটানো হয়েছে নোভোসের সঙ্গে। মিত্র ও অক্ষশক্তির নৌবহরের এই নোভোস অভিমুখী অভিযান তারই প্রত্যক্ষ ফল।”

    “কিন্তু কার বিশ্বাসঘাতকতায়, তা যদি আমাদের—”

    “জানবেন। আপনাদের যানের গণকে এই বিষয়ে একটি করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ইতিমধ্যেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন শুনুন। এই বিশ্বাসঘাতকতার প্রেক্ষিতে আপনাদের যাত্রাপথ নিয়ে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে। আমাদের শূন্যজ শক্তিসংগ্রাহকযুক্ত রণতরীগুলিকে কয়েকটি সম আকৃতির বহরে বিভক্ত করা হয়েছে আপনাদের নেতৃত্বে। এর প্রতিটি দল বারো ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে ক্যানি মেজরির উদ্দেশে যাত্রা করবে। প্রতিটি বহরের অর্ধেক যাত্রী হবেন বাছাই করা সৈনিকেরা, আর বাকি অর্ধেক যাত্রী হবেন এ গ্রহের শ্রেষ্ঠতম মস্তিষ্কেরা। অগ্রগামী বহর গন্তব্যে পৌঁছে পরিস্থিতি দেখে পেছনে থাকা বহরগুলিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবে।”

    “প্রস্তুতির জন্য কতটা সময় পাব আমরা? যাত্রীদের সংগ্রহ করে আনা, যানগুলিতে রসদ ও অন্যান্য উপকরণ একত্র করা ইত্যাদি বেশ কিছু—”

    সেনানায়কটিকে হাতের একটি অসহিষ্ণু ইশারায় থামিয়ে দিলেন রমুল, “প্রথম ঝাঁপটি শুরু হবে এখন থেকে ঠিক বারো ঘন্টা পরে। যাবতীয় কর্মতালিকা ও নির্দেশমালা ইতিমধ্যেই আপনাদের নিজ নিজ যানের গণকযন্ত্রে পাঠানো হয়ে গেছে। বিনাপ্রশ্নে তার প্রতিটি আদেশ পালন করাই আপনাদের মাতৃগ্রহের প্রতি আনুগত্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে। এখন কাজ শুরু করুন।

    শুভযাত্রা।”


    ************


    কথোপকথনটির ঠিক বারো ঘন্টা পর একশোটি যানের প্রথম বাহিনীটি কমান্ডার হেলেনার নেতৃত্বে নোভোসের কক্ষপথ ছেড়ে গ্রহমণ্ডলের বাইরের মহাজাগতিক মেঘপুঞ্জের মধ্যে উপস্থিত হল। তারপর একসঙ্গে তীব্র শক্তিবিচ্ছুরণ করে তারা উধাও হল একশোটি অতিমহাকাশ গহ্বরের মধ্যে।

    কিন্তু তারপর আর বেশি সময় পান নি রমুলা জাইমিন। এর ঠিক বারো ঘন্টা পরে দ্বিতীয় বাহিনীটি যখন মেঘমণ্ডলে গিয়ে উপস্থিত হল তখন সেখানে আগে থেকে উপস্থিত সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের অতিকায় নৌবহর তাদের প্রতিরোধের কোন দ্বিতীয় সুযোগ দিল না।

    যানগুলি ধ্বংস হবার মাত্রই এক ঘন্টার মধ্যে সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের নৌবহর নোভোস গ্রহের কক্ষপথে এসে পৌঁছাল যখন, ততক্ষণে গ্রহটিকে ঘিরে একটি সুদৃঢ় নিরাপত্তাবলয় তৈরি করেছে নোভোস গ্রহের সমস্ত যুদ্ধযান। তবে তার প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ছিল না। কিন্তু তবু, মাত্রই কয়েকঘন্টার মধ্যে তাদের মরণপণ প্রতিরোধকে পরাস্ত করে যখন কক্ষপথের নিয়ন্ত্রণ নিল সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের নৌবহর, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে থাকা ক্যানি মেজরিগামী বিশেষ রণতরীগুলি ততক্ষণে নোভোসের কক্ষপথ ছেড়ে অবতরণ করেছে তার ভূপৃষ্ঠে। সমুদ্রতলবর্তী একটি গুপ্ত আশ্রয়ে সেগুলিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার সমস্ত সেনা ও যাত্রীসমেত। এক আশ্চর্য শূন্যতা ঘিরে ছিল গ্রহটির কক্ষপথকে। সেখানে তখন এদিক ওদিক ভেসে বেড়াচ্ছে সেই অন্তিম যুদ্ধে আত্মদান করা অসংখ্য রণতরীর ধ্বংসাবশেষ। মাত্র কয়েক ঘন্টার যুদ্ধে অগণিত প্রাণ শেষ হয়ে গেছে।

    তাঁর ভূপৃষ্ঠের নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে সম্পূর্ণ দৃশ্যটাই স্থির হয়ে দেখেছেন রমুলা জাইমিন। বাইরের আকাশে সুতীব্র গর্জনের ধ্বনি উঠছে। আকাশ অন্ধকার করে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের মিলিত বাহিনী। হাতে ধরা যন্ত্রটিতে এইবার তাঁর শেষ আদেশটি দিলেন রমুলা, “উপনিবেশ বহরের প্রতিটি যানের গণকযন্ত্রকে আমার গণকযন্ত্রের সঙ্গে সংযুক্ত করুন।”

    কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর গণকযন্ত্রটি একটি তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল। গভীর সমুদ্রের তলদেশে গোপন আশ্রয়ে অপেক্ষমান যানগুলির নিয়ন্ত্রণ তাঁর যন্ত্রে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। বাইরে জুতোর উদ্ধত শব্দ উঠছিল। নিয়ন্ত্রণপ্যানেলে দ্রুত আঙুল চলছিল রমুলার। তাঁরা না পেলে ওই যন্ত্রের অধিকার নক্ষত্রপুঞ্জের আর কেউ পাবে না। মাতৃগ্রহ নোভোসের মৃত্যু নেই। অন্য এক নক্ষত্রপুঞ্জে তার কিছু বীজ অন্তত ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। হয়ত প্রাচীন উপকথার ফিনিক্স পক্ষীর মতই একদিন সেখান থেকেই নতুন করে উত্থান হবে তাঁর মাতৃভূমির।

    যানগুলির শূন্যজ শক্তিশোষকগুলিকে পূর্ণশক্তিতে চালু করে দিলেন তিনি। সমুদ্রের গভীরে সুতীব্র, বিস্ফোরক একটি শক্তিস্তর জমে উঠবে এবারে। পাশাপাশি, আত্মধ্বংসী বর্তনীগুলিও চালু হয়েছে তাদের। এইবার, প্রয়োজনে শুধু একটিমাত্র সংক্ষিপ্ত নির্দেশ-—


    ************


    আকাশগঙ্গা থেকে প্রায় ছ'শো আলোকবর্ষ দূরে স্বাভাবিক মহাকাশে ভাসছিল নক্ষত্রযানের বহরটি। এইখানে তারা সম্পূর্ণ নিরাপদ। শূন্যজ শক্তিসংগ্রাহক যন্ত্রের সহায়তা ছাড়া কেউ এখানে তাঁদের অনুসরণ করবে না।

    পরবর্তী বহরের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ শুরুর সংকেত পাঠানো হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হেলেনা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন প্রক্ষেপণক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে।

    পর্দাটির এক কোণে হঠাৎ সংকেতজ্ঞাপক লাল আলোটি দপদপ করে উঠতে সতর্ক হলেন হেলেনা। তাঁদের যানের শক্তিকোষগুলি ইতিমধ্যেই ভরে উঠেছে ফের।

    একটু পরেই প্রক্ষেপণক্ষেত্রে প্রথম ছবিটি ভেসে উঠতে খানিক বিমূঢ় হয়ে পড়লেন তিনি। সামরিক উর্দিতে সজ্জিত অপরিচিত মানুষটি প্রৌঢ়া। কালো মুখ থেকে উজ্জ্বল সাদা চোখদুটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল তাঁর দিকে। তবে মানুষটি অপরিচিত হলেও যে ঘরটিতে বসে আছেন তিনি সেটি হেলেনার সুপরিচিত। মহানির্দেশক রমুলার এই কর্মকেন্দ্রটিতে প্রায়শই যেতে হয় তাঁকে।

    “আপনি—”

    হাত ঘুরিয়ে বাহুতে লাগানো “সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জ” লেখা ব্যাজটি একবার তাকে দেখালেন তিনি। তারপর নিচু গলায় বললেন, “আমি সহ-সভাপতি ইউটুনা জেমস। আপনার গ্রহটিকে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই গ্রহের প্রশাসক হিসাবে আমি আপনাকে আদেশ দিচ্ছি আপনি আপনার নৌবহর নিয়ে অবিলম্বে ফিরে আসবেন। নচেৎ—”

    হাতের একটি ইশারায় সম্প্রচার বন্ধ করে দিলেন হেলেনা। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, আর কোন বাহিনী তাঁর সঙ্গী হবে না এর পর। মহানির্দেশক রমুলার শেষ আদেশটি এবার তাঁকে একাই পালন করতে হবে।


    ************


    চারপাশে প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ভেসে থাকা উদ্বিগ্ন মুখগুলির দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত নিজের কথাগুলি সাজিয়ে নিলেন হেলেনা। তারপর যখন মুখ খুললেন তখন তাঁর গলায় উত্তেজনার কোন চিহ্ন ছিল না।

    “বন্ধুরা। একটি দুঃখজনক সংবাদ দিতে আপনাদের আহ্বান করেছি। নোভোসের পতন হয়েছে। এখন আমাদের এই একশোটি রণতরীর হাতেই রয়েছে নোভোসের ভবিষ্যৎ।”

    পোড়খাওয়া অধিনায়কদের মুখের একটি পেশিও বিচলত হল না। নোভোসের দিকে সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের বাহিনীর এগিয়ে আসবার খবর তাঁদের অজ্ঞাত ছিল না। শান্তভাবে তাঁরা পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন।

    মুখগুলির দিকে একবার দেখে নিয়ে ফের কথা বললেন হেলেনা, “উদ্দিষ্ট গ্রহে পৌঁছে আমাদের কর্মপদ্ধতি কী হবে তার বিষয়ে মহানির্দেশক রমুলার সুস্পষ্ট নির্দেশ আমার কাছে রয়েছে। গ্রহটির কক্ষপথে পৌঁছে আমাদের প্রথম কর্তব্য হবে সেটিকে বলয়াকারে ঘিরে ফেলে সবক’টি যান থেকে সিগমা তরঙ্গের একটি সুসংহত বিচ্ছুরণে গ্রহটিকে সম্পূর্ণ প্রাণশূন্য করা। এরপর একে একে আমাদের যাত্রী ও অর্ধেক সেনাবাহিনীকে গ্রহে অবতরণ করানো হবে। যানগুলি গ্রহটিকে ঘিরে একটি নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে তার কক্ষপথে অপেক্ষা করবে। যে-কোন সন্দেহজনক বস্তু দেখলে সেটিকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হবে ও বিনাপ্রশ্নে সেটিকে ধ্বংস করতে হবে।

    “আরো একটি কথা। আমার যানটির থেকে সমস্ত অসামরিক যাত্রীকে অন্যান্য যানে বিভক্ত করে নিতে হবে প্রথমে। তাঁদের স্থান নেবেন সমসংখ্যক সৈনিক।”

    “কেন তা জানতে পারি কি মহামান্যা?”

    প্রশ্নকর্ত্রী সেনানায়কটির দিকে একবার ঘুরে দেখলেন হেলেনা। এই পরিকল্পনাটি তাঁর একান্তই নিজস্ব। কারণটিও ব্যক্তিগত। নির্দেশক সীতা আব্রাহামের বিশ্বস্ততা প্রশ্নাতীত। তাঁর নিজের হাতে তৈরি সৈনিক। তবু এই মুহূর্তে তাকেও তাঁর নিজের পরিকল্পনাটির কথা বলা যাবে না। বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লেন তিনি, “না সীতা। দুঃখিত। এটি একান্তই গোপনীয়।”


    ************


    “অনুসন্ধান সমাপ্ত হয়েছে প্রশাসক জেমস। শূন্যজ শক্তিসংগ্রাহকযুক্ত যানগুলির অবস্থান নির্ণীত হয়েছে।”

    “ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন ব্রাইকিয়ান,” বলতে বলতেই যোগাযোগ যন্ত্রটি বন্ধ করে সামনে বসা রমুলা জাইমিনের দিকে একবার ঘুরে দেখলেন ইউটুনা জেমস। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “এভাবে অপরাধ গোপন করা যায়না মহানির্দেশক। বৃথাই আপনি এতগুলি ঘন্টা আমাদের যাবতীয় অনুরোধ উপরোধকে প্রত্যাখ্যান করলেন। আপনাকে আমি বিনীত অনুরোধ করব যানগুলির সৈনিকদের কোন প্রতিরোধ করতে নিষেধ করুন।”

    “কেমন করে তা করব প্রশাসক? এ গ্রহের স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণ হরণ করেছেন আপনারা। ক্ষমতাহীন একজন মহানির্দেশকের আদেশ দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা মানবেই বা কেন?”

    ইউটুনার কন্ঠস্বর হঠাৎ নরম হয়ে এল, “মহানির্দেশক রমুলা, আপনার কোন ক্ষমতাই এখনও হরণ করা হয়নি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিচারের জন্য সাময়িকভাবে তা স্থগিতই করা হয়েছে শুধু। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ঘৃণ্য স্কার্তি ক্যাম্পানদের গ্রহটিকে ধ্বংস করে আপনি মানবজাতির মঙ্গলই করেছেন। তবে আইন আইনই। সে তার নিজের পথেই চলবে। কিন্তু, আমরা বিনা কারণে আরও কিছু মানুষের প্রাণহানির কারণ হতে চাই না।”

    “অর্থাৎ আমার বিচার হবে। একটি ঘৃণ্য প্রজাতির মানুষকে শাস্তি দেবার অপরাধে আইন আমাকে গণহত্যাকারীর শাস্তি দেবে। বলতে পারেন জেমস, সেক্ষেত্রে আমি কেন সহযোগিতা করব আপনাদের সাথে?”

    টেবিলের ওপর পড়ে থাকা একটি চিত্রঘনক নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন ইউটুনা। রমুলার ছটি সন্তানের হলোগ্রাম রয়েছে তার ছটি দিকে। সেটি হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে তিনি বললেন, “আপনাকে সত্যি কথাটাই বলি মহানির্দেশক। সম্মিলিত গ্রহপুঞ্জের শুধু শূন্যজ শক্তিশোষক ঘনকগুলি প্রয়োজন। আমাদের সৈনিকেরা আপনাদের যান বা তার যাত্রীদের কোন ক্ষতি করবে না। আপনাদের বিচারটিকেও আমরা কেবলই একটি নিয়মরক্ষার অনুষ্ঠানে পরিণত করতে রাজি আছি। শুধু, তার বিনিময়ে আপনার এই সহযোগিতাটুকু প্রয়োজন আমাদের।

    স্থির হয়ে প্রক্ষেপণক্ষেত্রটির দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন রমুলা জাইমিন। শক্তিশোষকগুলি এতক্ষণে তাদের পূর্ণশক্তিস্তরে পৌঁছে গেছে। প্রক্ষেপণক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছিল, সমুদ্রতলের গোপন উৎক্ষেপণকেন্দ্রটির দিকে তখন নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে ঝাঁকে ঝাঁকে উভচর রণতরীর দল। হঠাৎ হাতের মণিবন্ধে বাঁধা ছোট যন্ত্রটিকে একবার তুলে ধরলেন তিনি ইউটুনার সামনে। তারপর প্রক্ষেপণক্ষেত্রে ভেসে ওঠা সার সার অপেক্ষমাণ রণতরীগুলির দিকে দেখিয়ে শান্তকন্ঠে বললেন, “এক-একটি শক্তিশোষক যন্ত্র এক হাজার আলোকবর্ষ দীর্ঘ অতিমহাকাশ সুড়ঙ্গের জন্ম দেবার মত শক্তি ধরে। সমুদ্রের নীচে অপেক্ষমান আমাদের ওই রণতরীগুলোর প্রতিটায় একটি করে এই যন্ত্র রয়েছে। সেগুলি যদি একসঙ্গে পূর্ণশক্তিতে বিস্ফোরিত হয় তাহলে তার মোট শক্তির পরিমাণ কতো হতে পারে তার কোন ধারণা আছে আপনার মহামান্য ইউটুনা জেমস?”

    তাঁর চোখে মৃত্যুর শান্ত অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছায়াটি হঠাৎ ইউটুনা জেমসের অভিজ্ঞ বুকেও কাঁপন ধরালো। তাড়াতাড়ি আসন ছেড়ে উঠে রমুলার দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, “না রমুলা—কোটি কোটি প্রাণ—এইভাবে—”

    যন্ত্রটির গায়ে আঙুল স্পর্শ করে শান্ত গলায় রমুলা জবাব দিলেন, “বিদায় ইউটুনা জেমস। নরকে তোমার শেষ আশ্রয় হোক—”

    পরক্ষণে সহস্র সূর্যের জ্যোতি নিয়ে জ্বলে উঠল নোভোস গ্রহের মহাসমুদ্রের বুকের বিস্তীর্ণ একটি এলাকা। কক্ষপথে অপেক্ষায় থাকা গ্রহপুঞ্জের রণতরীগুলি কিছু বোঝবার আগেই সুতীব্র একটি শক্তিতরঙ্গের আঘাত তাদের মুছে দিল আকাশের বুক থেকে। এর কয়েক মুহূর্ত পরে, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মহাকাশের বুকে যখন মিলিয়ে যাচ্ছিল দুর্ভাগা গ্রহটি, তখন কোন জীবিত প্রাণীই তার সাক্ষী হবার জন্য সেখানে বেঁচে ছিল না।

    শুধু সাক্ষী ছিল তারকাপুঞ্জটিকে ঘিরে সদাজাগ্রত কিছু পর্যবেক্ষণকেন্দ্র। ধ্বংসের মর্মান্তিক সেই চিত্রটিকে সংগ্রহ করে নিয়ে তারা তাকে সম্প্রচার করল ক্যানি মেজরি নক্ষত্রপুঞ্জের তারকাবলয়ের মধ্যে অবস্থিত সেই গ্রহটির বুকে—


    ************


    “সময় হয়েছে দেবর্ষী ক্ষিতিজ। অন্তিম ঝাঁপটির জন্য তৈরি হচ্ছে নোভোসের বাহিনী।”

    প্রক্ষেপণক্ষেত্রে নোভোসের ধ্বংসাবশেষের ছবিটি তখনও দেখা যাচ্ছিল। সেইদিকে তাকিয়ে বিমর্ষভাবে মাথা নাড়লেন ক্ষিতিজ, “দানবজাতি হলেও, এতগুলি প্রাণ এইভাবে শেষ হবে জানলে আমি হয়ত সংবাদটি ওই তারকাপুঞ্জে সম্প্রচার করবার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতাম হবিষ্ট।”

    হবিষ্ট উত্তেজিতভাবে মাথা নাড়লেন, “প্রাণের সমাপ্তি সর্বদাই দুঃখের হয় ক্ষিতিজ। কিন্তু এই ধ্বংসের জন্য আমরা দায়ী নই। দায়ী এদের লোভ। ধরে নিন, বৃহত্তর ব্রহ্মাণ্ডের স্বার্থে প্রকৃতিই এই প্রতিশোধ নিয়েছেন এদের ওপরে। কিন্তু আর দেরি নয়। এখনই যাত্রা না করলে—” “কিন্তু গ্রহটিকে এইভাবে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে—”

    কথাটি হবিষ্টকে সামান্য ভাবিয়ে তুলেছ দেখা গেল। একটু থেমে থেকে তিনি বললেন, “আপনি ইকসা দ্বীপে বার্তা পাঠান দেবর্ষী। সেখানে নোভোসের যোদ্ধাটি ইতিমধ্যে অরণ্যে একাকি আশ্রয় নিয়েছে শুনেছি। যতক্ষণ না আমরা ফিরে আসি, সোমক ও নেরার মধ্যে একজন যেন পালা করে দ্বীপে থেকে ওই যোদ্ধাটির ওপরে নজর রাখবে। অন্যজন যেন কক্ষপথে থেকে চারপাশে সতর্ক নজর রাখে।”

    ক্ষণিকের দুর্বলতা ততক্ষণে ঝেড়ে ফেলেছেন ক্ষিতিজ। প্রয়োজনীয় নির্দেশগুলি নেরার কাছে সম্প্রচারিত করে দেবার পর তাঁর অঙ্গুলিনির্দেশে হঠাৎ করেই যেন জীবন্ত হয়ে উঠল সেই নৌকাসদৃশ গিরিচূড়া। এক তীব্র ভূকম্পনে তার গায়ের পাথরের আবরণটি ভেঙে চূরমার হয়ে যাচ্ছিল। দূরস্থ গ্রামগুলির বাসিন্দারা সভয়ে দেখল, তাদের প্রজন্মান্তরের পরিচিত সেই ঈশ্বরের আবাস গিরিচূড়াটি এক ভয়াল অগ্নিভ রূপ ধারণ করেছে। তারপর হঠাৎ সেই প্রস্তরশয্যা ছেড়ে আকাশে ভেসে উঠল একটি অতিকায় নৌকা। বাতাসে একমুহূর্ত স্থির হয়ে থেকে সহসা একটি ত্বরিত উল্লম্ফনে তা ওপরের দিকে ধেয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল মেঘের আড়ালে—


    ************


    ক্ষুদ্র গুহাটি একেবারে গিরিশৃঙ্গটির চূড়ার কাছে। গভীর অরণ্য তার পায়ের কাছে একটি পরিত্যক্ত বস্ত্রখণ্ডের মত অবহেলায় ছড়িয়ে আছে। গুহাটির দরজায় নিঃশব্দে বসেছিল সীমাল। আজ ছ'দিন হল এই জায়গাটিতে সে আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। গুহার কিছুদূর দিয়ে একটি স্বছতোয়া ঝরনা বহে যায়। তার জল বড়ো সুস্বাদু। প্রথমে একটু অস্বস্তি হয়েছিল তার। খোলা আকাশের নীচে বহমান ধারার জল সে আগে কখনো দেখে নি। কিন্তু জলধারাটির কাছে গিয়ে বসতে একটি আশ্চর্য স্নিগ্ধতা ছেয়ে গিয়েছিল তার মনে। কয়েকটি পাথরের বেষ্টনীতে তার একটি ক্ষুদ্র অংশ স্থির হয়ে আছে। সেইখানে, নীল আকাশের পটভূমিতে তার নিজের মুখের ছবিটি পড়েছিল। সেইটি দেখতে দেখতেই অন্যমনস্কভাবে আঙুল দিয়ে তার পাশ দিয়ে বহমান জলটিকে প্রথম স্পর্শ করেছিল সীমাল। জলধারা তার হাতের আঙুলগুলিকে নিয়ে খেলা করেছিল। তার খানিক নিচে উজ্জ্বল সাদা বালির স্তর। তার ওপরে চলমান জলের উচ্চাবচের সঞ্চরমাণ ছায়া পড়ছিল। ধীরে ধীরে কখন এ সেই জলধারার মধ্যে নিজের দেহটি ছড়িয়ে দিয়েছিল সীমাল তা তার নিজেরই খেয়াল ছিল না। তার দেহের অন্ধিসন্ধিতে ছুটন্ত জলের অঙ্গুলিস্পর্শকে মেখে নিতে নিতেই কখন যেন তার তৃষ্ণার্ত ঠোঁটদুটি এক দীর্ঘ চুম্বনে বেশ কিছুটা জলকে শুষে নিয়েছিল মুখের ভিতর। বড়ো সুস্বাদ ছিল সেই খনিজমিশ্রিত শীতল জল।

    এই গ্রহের অরণ্যে লাল, পিঙ্গল, পীত, হরিত বিভিন্ন বর্ণের সুস্বাদু ফল সহজেই মেলে। গুহা ছাড়িয়ে নদীর ধারাটি ধরে কিছুটা নেমে এলে যে গভীর অরণ্য, সেইখানে সামান্য অনুসন্ধানেই অজস্র ফলবান গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। মাটিতে সামান্য খননেই মিলে যায় নানাজাতীয় সুস্বাদু কন্দ।

    খাদ্যসংগ্রহে, প্রিয় নদীটির সঙ্গে জলক্রীড়াতে এবং বাসগুহাটিকে পরিচ্ছন্ন রাখতেই সারাদিনের অনেকটা সময় কেটে যায় তার। তার সংগ্রহ করে আনা ফল ও কন্দের লোভে মাঝেমাঝে কিছু নিরীহ প্রাণী এসে উঁকিঝুঁকি দিতেও শুরু করেছে এখন। প্রাণীগুলি বুদ্ধিমান ও বন্ধুত্বপূর্ণ। সীমালের হাত থেকে আহার গ্রহণ করে যায় বড়োই স্বছন্দে। যেন কতকালের পরিচিত।

    সব কাজের শেষে, সন্ধ্যার মুখমুখ সূর্য অস্ত গেলে আকাশে যখন উপগ্রহদুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে তখন সে নীরবে এই গুহামুখটিতে বসে নীচে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের দিকে তাকিয়ে থাকে। দূরের সমুদ্রের থেকে উঠে আসা লবণাক্ত বাতাস অরণ্যটির সুবাস গায়ে জড়িয়ে এসে তার অবিন্যস্ত স্বর্ণবর্ণের কেশরাজি নিয়ে খেলা করে। তারপর একসময় উপগ্রহদুটি অস্ত গেলে মাথার ওপর অপরিচিত নক্ষত্ররাজি একরাশ লোহিতপুষ্পের মত ফুটে ওঠে যখন, সীমাল তখন তার প্রিয় আসনটি ছেড়ে উঠে গুহার ভিতরে যায়। সেখানে মধুর, কবোষ্ণ অন্ধকারে তৃণশয্যাটি অপেক্ষায় থাকে তার জন্য। এই আশ্চর্য শান্ত ও নিস্তরঙ্গ জীবন তাকে যে কী মোহজালে বদ্ধ করেছে-—

    তারপর রাত্রে, নিদ্রার অচেতনায়, যুক্তি যখন চিন্তাকে বশে রাখতে পারে না আর, সেই অসহায় মুহূর্তে অপরিচিত শত্রুপুরুষটি ফের একবার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। উজ্জ্বল চোখদুটি তার দিকে তুলে ধরে তাকে নির্বস্ত্র করে পেশিবহুল দুটি হাতে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নেয় সে। সীমাল বাধা দেয় না। মানুষটির বুকে মুখ গুঁজে একটি শিশুর মতই পরম নির্ভরে, নির্ভয়ে অপেক্ষা করে থাকে কখন তার পুরুষ তাকে সেই সুখের তুঙ্গমুহূর্তে পৌঁছে দেবে।

    কখনো কখনো সেই মুহূর্তগুলিতে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসে সে। হাত বাড়িয়ে শয্যায় খোঁজে নিদ্রার জগতে সুপরিচিত শরীরটির স্পর্শকে। আর তারপর চেতনা সম্পূর্ণ ফিরে এলে অন্ধকারে তার চোখদুটি ক্ষুধিত বাঘিনীর মত ধ্বকধ্বক করে জ্বলে, এক বিচিত্র দ্বন্দ্বের বিষামৃতময় অনুভূতি তাকে উন্মাদ করে তোলে নির্জন রাত্রের সেই একাকি মুহূর্তগুলোতে। একদিকে তার নবজাগ্রত অনুভূতিগুলি তাকে এই গ্রহটির এই সুখময় দিনগুলির দিকে, তার শত্রু অথবা প্রিয়তম পুরুষটির দিকে প্রবল শক্তিতে ঠেলে দিতে চায়, অন্যদিকে তার জন্মগত শিক্ষা তার কাছে সেই কৃষ্ণ আবরণে আবৃত যন্ত্রময় জন্মগ্রহটির প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যের দাবি জানিয়ে যেতে থাকে। অন্ধকারের মধ্যেই তার হাতদুটি অব্যবহৃত অস্ত্রগুলিকে স্পর্শ করে বারংবার। আর তারপর ফের সশঙ্কে সেগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দেয় দূরে—

    তবু, তার অগোচরে সেই স্বর্গভূমিতেও একটি বিপদ ক্রমশ ঘিরে আসছিল তাকে। পর্বতশৃঙ্গে একটি সুস্বাদ শিকারের অস্তিত্ব নজর এড়ায়নি এই অরণ্যের এক শ্বাপদ প্রজাতির। এরা ভীরু জীব। দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে। দিনের আলোকে কোন শিকারের মুখোমুখি হবার সাহস তাদের নেই। রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে তারা তাই নির্নিমেষে লক্ষ করে চলেছিল তাদের বাঞ্ছিত শিকারটিকে। সীমিত প্রবৃত্তি দিয়েই বুঝতে চেষ্টা করছিল তার সবচেয়ে অসহায় মুহূর্তগুলিতে। এবং এইভাবেই ধীরে ধীরে সাহস বেড়ে উঠছিল তাদের-—


    ************


    *** “দেবর্ষীরা যাত্রা শুরু করলেন কি সোমক?”

    “হ্যাঁ নেরা। মাত্রই কিছুক্ষণ আগে তাঁরা কক্ষপথ ছেড়ে অগ্রসর হয়েছেন।”

    “তুমি কি কিছুক্ষণের জন্য এইখানে ফিরে আসবে তবে?”

    “কোন প্রয়োজন আছে কি?”

    “এই কারণেই আমি যোগাযোগ করেছি তোমার সঙ্গে সোমক। সীমালের তোমাকে প্রয়োজন হবে আজ।”

    “তুমি তো তাকে এই কদিন চোখেচোখেই রেখেছ? যতটুকু বলেছ তাতে দেখা যাচ্ছে, দ্রুত মানিয়ে নিয়েছে সে তার নতুন পরিবেশের সঙ্গে। হঠাৎ কী প্রয়োজন হল?”

    “কয়েকদিন ধরেই কয়েকটি মাংসলোভি পার্বত্য জিকা সীমালকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছে, তা তো তোমায় আমি বলেছি।”

    “হ্যাঁ। বলেছ। কিন্তু এরা ভীরু জীব। বড়ো দল না হলে সহজে কোন মানুষকে আক্রমণ করতে ভয় পাবে। তাছাড়া, সীমাল প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। এদের তরফ থেকে তার কোন ভয়ের কারণ তো নেই?”

    “ভয়ের কারণ একটি ঘটেছে সোমক। তাই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমি। প্রায় পঞ্চাশটি জিকার একটি বিরাট দল ওই পাহাড়টির আশেপাশে এসে জড়ো হয়েছে আজ বিকালে। সতর্কভাবে পাহাড়টিকে ঘিরে পাক খাচ্ছে তারা। এতগুলি প্রাণীর হাতে অতর্কিতে আক্রান্ত হলে সীমালের মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব নয়। নিজের অস্তিত্ব জানান না দিয়ে আমি তাকে কোন সাহায্য করতে পারব না সোমক।”

    “বেশ। তাহলে তুমি কি আজ রাতটির জন্য আমার জায়গাটা নেবে?”

    “সানন্দে,” বলতে বলতেই নেরার ঠোঁটে একটু হাসি খেলা করে গেল, “তাছাড়া, তোমার জন্য একটি বিস্ময়ও অপেক্ষা করে আছে হয়ত আজ।”

    “একটু খুলে বলবে?”

    “না। তাতে বিস্ময়টি আর থাকবে না তোমার,” বলতে বলতেই একটু সতর্ক হয়ে গেল নেরা। সোমকের একটি সূক্ষ্ম চিন্তাতরঙ্গ তার মনটিকে পড়বার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে নেরা তা কিছুতেই হতে দিতে রাজি নয়। গত কয়েকদিন ধরে নোভোস গ্রহের ওই যোদ্ধাটির ওপর ছায়ার মত নজর রেখে চলেছে সে। আর তার সঙ্গেসঙ্গে তার মনের ভিতরে অর্ধজাগ্রত ভালোবাসা নামের অনুভূতিটিকে নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করবার চেষ্টাটিও চলেছে নেরার। অনুভূতিটির সঠিক চরিত্র অনুধাবন করতে না পারলেও এটুকু সে অনুমান করতে পেরেছে যে অত্যন্ত শক্তিশালী এই অনুভূতি এই দানবজীবের অস্তিত্বের একটি প্রধান উপাদান। অথচ বহু সহস্র বছরের মৃত্যুসাধনায় তারা সেই মূল প্রবৃত্তিটিকেই কী সাফল্যের সঙ্গে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে! কেন এমন হয়? জৈবমস্তিষ্কও তো একটি গণকযন্ত্র বই আর কিছু নয়। তবে কেন তা এমন যুক্তিহীন পথের সাধনায় নিজেকে বিসর্জন দেয়? আজ কয়েকদিন ধরেই ওই সজীব, অপরিচিত অনুভূতিটিকে বারংবার স্পর্শ করে তা বুঝতে চেয়েছে নেরা। কিন্তু সফল হয় নি। হয়ত সোমক সে চেষ্টায় সফল হবে। তার চেতনাও তো আসলে জৈব চেতনাই। সেই কারণেই দেবর্ষী হবিষ্ট প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য সোমকের ওপরেই ভরসা রেখেছেন--

    নিবিড় অরণ্যে পরিভ্রমণরত নারীটির মনে প্রতিদিনই সেই বিচিত্র অনুভূতিটি, সম্ভাব্যতা গণিতের সব তত্ত্বকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এই গ্রহের আকাশ বাতাস প্রকৃতির প্রতিটি দৃশ্য বর্ণ গন্ধ যেন জলসিঞ্চন করে চলেছে অনুভূতির সেই সদ্যোজাত অংকুরটির দেহে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল নেরার বুক থেকে। সীমাল জানে না, কত বড়ো একটি পরীক্ষার সামনে সে আজ তার তারকাপুঞ্জের সমগ্র প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করছে। সোমকের উদ্দেশ্যটি নেরা জানে। শুধু একটি তারকাপুঞ্জ নয়, হয়ত সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেরই একটা নতুন ভবিষ্যতের দরজা খুলে যেতে পারে এ পরীক্ষায় সীমাল সফল হলে।

    হঠাৎ একটি অস্বস্তিকর অনুভূতি ছড়িয়ে গেল তার চেতনায়। সীমালের চেতনা কত সহজেই না এই অনুভূতিটিকে আত্মস্থ করে চলেছে তার যাবতীয় কৌম আচরণবিধি ও শিক্ষাকে অতিক্রম করে। অথচ সে কেন তা পারে না? তার দেহের অণুগণকগুলির মধ্যে একটি যন্ত্রণাদায়ক বিচলন সৃষ্টি হচ্ছিল এই চিন্তাটির সঙ্গেসঙ্গে। এই বিচলনটিকেই কি ঈর্ষা বলে? হবে হয়ত।


    ************


    * সন্ধ্যায় সামান্য বেশ ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল আজ। ঝড় ও বজ্রপাত কিছুটা অস্বস্তিদায়ক হলেও, তার পর যখন আকাশ থেকে কবোষ্ণ জলধারা নেমে আসতে শুরু করল তার গুহাটির চারপাশে সীমাল তখন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেনি। কখনো বৃষ্টি দেখেনি সে নোভোস গ্রহে। সেখানে প্রকৃতিকে অনেক আগেই সম্পূর্ণ পরাস্ত করেছে মানুষ। গুহা ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল সে খোলা আকাশের তলায়। ক্রমাগত নেমে আসা তীক্ষ্ণ বারিরশ্মিগুলির সুখদ স্পর্শ চামড়ায় যে তিরতিরে অনুভূতিটি জাগিয়ে তোলে তার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা তার ছিল না। অনুভূতিটি তাকে মুগ্ধ করেছিল। ফলে সে রাত্রে ঘুমটি গভীর হয়েছিল সীমালের।

    গভীর রাত্রে হঠাৎ গায়ে কারো আঙুলের স্পর্শ লেগে ঘুম ভেঙে গেল সীমালের। তাড়াতাড়ি উঠে বসে অস্ত্রসহ বর্মটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়েছিল সে তখন একটা সবল হাত তার গলা জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে আঙুলগুলো দিয়ে চাপা দিয়ে ধরল। অন্য হাতটা তার হাতে তার স্নায়ুপীড়ক যন্ত্রটি ধরিয়ে দিয়ে কানে কানে বলল, “আমি সোমক। তুমি আক্রান্ত। আমি এখন একটি আলো জ্বালব এখানে। তৈরি হও।”

    মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল সীমাল। এবং একই সঙ্গে সকৌতুকে খেয়াল করল কত সহজে নোভোসের একজন দক্ষ সেনানায়ক এই দ্বিতীয় মানুষটির নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিল। অনুভূতিটি তার মধ্যে একবিন্দু উষ্মারও সৃজন করছিল না সেই মুহূর্তে। পরম নির্ভরতায় এই মানুষটির হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছে সে।

    হঠাৎ পাথরের মৃদু ঘর্ষণের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দপ করে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠল। দুটি দীর্ঘ জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ড দুই হাতে ধরে আছে সোমক। তার লালাভ দপদপে আলোয় প্রাচীন গাথায় বর্ণিত কোন পৌরাণিক বীরের মতই দেখায় তাকে। গুহার সামনে জড়ো হয়ে আসা জন্তুর দলটির থেকে তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল সে।

    রক্তের মধ্যে এক আদিম, সুপরিচিত উন্মাদনা জেগে উঠছিল সীমালের। সোমকের পা দুটির নিচে উবু হয়ে বসে অন্ধের মত নিজের অস্ত্রটি বাড়িয়ে ধরল সে। বোতামটিতে মৃদু একটু চাপ দিতেই হঠাৎ সামনে এগিয়ে আসা একটি জীব থমকে গেল। তার চোখের ঔজ্জ্বল্য ম্লান হয়ে এসেছে। আর তারপর তীক্ষ্ণ একটি আর্তনাদ করে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল সে। কাচের মত স্বচ্ছ হয়ে আসা দৃষ্টিটি স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শেষ মুহূর্ত অবধি সে বুঝতে পারেনি, খাদ্যের সন্ধানে এসে এত তীব্র যন্ত্রণা তাকে কেন পেতে হল। হঠাৎ সীমালের মাথার মধ্যে একটা প্রবল ওলটপালট হয়ে গেল। একটা ভাঙচূর চলছে সেখানে। হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চোখদুটি বন্ধ করে সে বসে পড়ল সেই পাথরের মেঝের ওপর।

    জ্বলন্ত কাষ্ঠখণ্ডদুটি নাড়িয়ে এগিয়ে আসতে থাকা পশুগুলিকে ভয় দেখাতেদেখাতেই সোমক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ঘুরে দেখল সীমালের দিকে। তার ঠোঁটের কোণায় একটি বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছিল। পরমুহূর্তেই কাষ্ঠখণ্ডদুটি নিয়ে নতুন উৎসাহে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল ক্ষুধার্ত পশুগুলির দিকে। বারংবার দুটি দীর্ঘ অগ্নিসর্পের মত তার জ্বলন্ত অস্ত্র ধেয়ে যাচ্ছিল লাফ দিয়ে ঢুকে আসা জীবগুলির দেহ লক্ষ করে। হত্যা নয়। কোন সরাসরি আঘাতও নয়। আগুনের হলকার সামান্য স্পর্শই এদের ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করবার পক্ষে যথেষ্ট হবে।


    ************


    “সীমাল —ওরা চলে গেছে—সীমাল—”

    বহুদূর থেকে সোমকের গলাটি ভেসে আসছিল যেন। দুটি হাত তাকে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরেছে একটি পেশল বক্ষে। সীমালের শরীরটি এইবার প্রত্যুত্তর দিল সেই আহ্বানে।

    “চেয়ে দেখো সীমাল--চোখ খোলো। একটি পশুরও প্রাণহানি হয়নি আজকে আমাদের হাতে। দেখো দেখো, তোমার হাতে আহত পশুটিও ধীরে ধীরে উঠে চলে যাচ্ছে গুহা ছেড়ে—”

    আস্তে আস্তে চোখদুটি খুলে ধরল সীমাল। কিছুক্ষণ আগের সেই তাণ্ডবের কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট নেই আর এখানে। গুহার দরজা দিয়ে আকাশের মাঝখানে ভাসমান ইরোর স্নিগ্ধ মুখটি দেখা যাছিল। সেই অনুজ্জ্বল আলোয় পুরুষটি তাকে ঘিরে রেখেছে নিজের সমস্ত শরীর দিয়ে। হঠাৎ কী যে হয়ে গেল সীমালের। প্রাণপণে মানুষটিকে আঁকড়ে ধরে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁটদুটিকে রাখল সে। মানুষটি আপত্তি করল না। তার দেহের উগ্র পুরুষগন্ধ সীমালের সমস্ত চেতনাকে আবৃত করে ফেলছিল যেন—

    সুতীব্র কামনার অভিঘাতে কেঁপে কেঁপে ওঠে নারীদেহটি। অভ্যস্ত পথে সুপরিচিত শরীরটিকে ধীরে ধীরে সুখের তুঙ্গ চূড়ায় নিয়ে চলেছিল পুরুষটি। অস্ফুট স্বরে নারীটি কত কী বলে যায়—তার মনের আগলটি আজ খুলে গেছে প্রিয়তম পুরুষের উষ্ণ সান্নিধ্যে।

    সেই সুখসমুদ্রে তাকে মগ্ন রেখে পুরুষটির দেহ থেকে নির্গত কিছু প্রায় অদৃশ্য ধুলিকণাসদৃশ অণুগণক নারীটির মস্তিষ্কে প্রবেশ করে।

    অনুসন্ধানী গণকগুলি সন্ধান করে চলে সেই নির্দিষ্ট স্নায়বিক রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াগুলির, যার উপস্থিতি তাকে ঈশ্বরজীবের প্রতিবিম্ব হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। সেই অণুগণকেরা যান্ত্রিক পারিপাট্যে তাদের স্মৃতিকোষে সঞ্চিত করে নেয় নারীটির মস্তিষ্কে সদ্যজাগ্রত সেই অনুভূতিগুলির প্লাবনের সুনিশ্চিত প্রমাণ—

    হঠাৎ এক তীব্র আনন্দের স্রোতে সোমকের সব সাবধানতার অবসান ঘটল। নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই দানবজাতি এখনও ভালোবাসতে পারে—ভালোবাসা, চার অক্ষরের এক অমোঘ উত্থান—

    এক গভীর স্নেহমিশ্রিত আদরে নারীটিকে আরো একবার আঁকড়ে ধরল সোমক। কোন এক আদিম প্রেরণায় নারীটিও বুঝি অনুভব করতে পেরেছে তার সঙ্গীর মনের আনন্দের এই নতুন উৎসারণটিকে। নীল চোখদুটি খুলে তার চোখের দিকে এক নজর তাকিয়ে দেখল সে। তারপর আরো একবার সুতীব্র উল্লাসে নিজেকে সমর্পণ করল তার উল্লসিত রভসের স্রোতে।


    (চলবে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ 'শ্রী শাম্ব'
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)