‘কি লাভ হবে ওখানে গিয়ে? প্লেনটা টেক অফের পর বেশ কয়েক ঘন্টা ঠিকই উড়ছিল, ঠিক কোথা থেকে কনট্যাক্ট হারিয়েছে সেটা তো কারুরই জানা নেই।’
‘মিডিয়াকে ওরা ধাপ্পা দিচ্ছে, আসল কারণটা বলছে না। আমি নিশ্চিত যে ওখানে গেলে আমরা কিছু একটা ক্লু পাবোই পাবো। একটা অতবড়ো প্লেন টোটালি গায়েব হয়ে যায় কি করে? আমার মনে হচ্ছে ওটা হাইজ্যাকড হয়েছে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে টেররিজম ইনভলভড। হয়ত ওরা লুকিয়ে লুকিয়ে র্যানসম নিগোশিয়েট করছে। আমরা এখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে কিছু হবে না।’
‘তুই আগে মায়ের সাথে কথা বল দাদা। আরেকটা চিন্তা বাড়াস না।’
‘বলছি, কিন্তু আমি যাবো সেটা ঠিক করে ফেলেছি। আমি যদি হারিয়ে যেতাম, বাবা আমার খোঁজে সারা দুনিয়া চষে ফেলত না? হাই দেয়ার রনি। বা: দুজনেই দেখছি একসঙ্গে ক্লাস কেটেছিস।’ বিতান দেখতে পেয়েছে পাশ থকে রনি উঁকি মারছে। ওরা দুজনে পূর্বপরিচিত, পরস্পরকে বেশ পছন্দই করে।
‘বিতান ঠিক কথা বলছে, সাউথ ইস্ট এশিয়াতে টেররিস্ট অ্যাকটিভিটি খুব বেড়েছে আজকাল। ওই প্লেনে অনেক চাইনিজ সিটিজেন ছিল, আজকাল চায়নাতে উইগার বলে একটা এথনিক গ্রুপ টেররিজমের দিকে ঝুঁকেছে। এমনিতেই মালয়েশিয়া সরকারের ওপরে ইন্টারন্যাশনাল চাপ বাড়ানো দরকার যাতে সার্চ এফর্ট আর জোরদার হয়। আমি পারলে আমিও যেতাম।’
এতক্ষণে একটু যেন উৎসাহ পেয়ে সোজা হয়ে বসলো মিমি। ওর প্রিয় পুরুষেরা অভিযাত্রী হতে চায়, ওই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? তাছাড়া একটা প্রতিপক্ষ খাড়া করতে পারলে বুকের মধ্যেকার জমা রাগটা ঝেড়ে ফেলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যায় বটে। অজানা আশংকা আর দিশাহীন রাগের মতো যন্ত্রণাকর আর কিছুই নেই।
‘তাই যদি হয় তো আমাদের সকলের যাওয়া উচিৎ। ঠিক আছে, আমি মা’র সঙ্গে আজ রাত্তিরেই কথা বলবো। নেক্সট উইকে এমনিতেই স্প্রিং ব্রেকে স্কুল ছুটি।’
আঠেরো থেকে বাইশ বছর বয়েসে কেউ সংশয় নিয়ে ঘর করে না। একটু বাদেই ওরা মহা উৎসাহের সঙ্গে ইন্টারনেটের তথ্যসমুদ্রে ভাসিয়ে দেবে ওদের লাইফবোট। এই সমুদ্রও অসীম কিন্তু ওরা এখানকার দক্ষ নাবিক। মাউস আর কীবোর্ডের নিপুণ ন্যাভিগেশনে ছুটে চলবে ওদের নৌকো, দুপাশ দিয়ে বয়ে যাবে অজস্র খবর, প্রচার আর ব্লগ, বিদঘুটে সব ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব, নানান মতামত আর তর্কবিতর্কের লাগামছাড়া স্রোত। এসবে ওরা অভ্যস্ত তাই স্বাধীন স্বচ্ছন্দ এবং বিশ্বাসী, আপন আপন নির্বিকার ছন্দে প্রবাহিত।
কিন্তু এই প্রবাহ থেকে দূরে আরেকটা সমুদ্র আছে। সে সমুদ্র আদিম ও ভয়ানক, সেখানে বিনা প্ররোচণায় দানবিক ঢেউরা এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জনপদ। টুকরো টুকরো হয়ে ডুবে যায় নৌবহর, ফুসফুস ভর্তি লোনাজল নিয়ে যন্ত্রণায় খাবি খেতে থাকে অগণ্য মানবাত্মা। সেই সমুদ্রের নাভি বিদীর্ণ করে যখন বাসুকি নাগ মাথা তোলে, তখন অসহায় ও নিষ্প্রদীপ, ছেঁড়া পাতার মতন কাঁপতে থাকে একদা গর্বিত ভুবনগ্রাম। সেই ঘাতক সমুদ্রের স্মৃতিকে ভুলিয়ে রেখে এখন ওদের চারপাশে জ্বলছে বিজ্ঞাপনের বোর্ড, লোভনীয় আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে আছে রাজপথ।
‘তোর একটা ছোটোখাট স্ট্রোক হয়েছিল, যাকে টি আই এ বলে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি রিকভার করে গেছে, কোনোরকম নিউরোডেফিসিট হয়নি। এখন কদিন চুপচাপ শুয়ে থাক। বড্ড চাপ নিচ্ছিস আজকাল।’
কিসের চুপ? চুপ করে ভাববার চেষ্টা করলেন বিভাস। মাথার মধ্যে হাজারটা হারানো কথার নকশা। সমু ওরফে ডাঃ শ্যামল মাইতি কিন্তু বেশ উত্তেজিত।
‘লিপিকে খবর পাঠাই? এরকম অসুস্থ হয়ে একা একা থাকবি কি করে।’
যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে আপত্তি জানালেন বিভাস। চোখের সামনে একটা বিরাট বই খোলা হয়ে গেছে, অতি দ্রুত তার পাতাগুলো উলটে চলেছেন উনি, এখন কথা বলারও সময় নেই।
‘তুই সেই ঘাড় বেঁকা বাঙালই থেকে গেলি টুকু। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, খিটিমিটি হয়েই থাকে, তা বলে তোদের মতো এইরকম অদ্ভুত কাণ্ড কেউ করে না। এমনকি ডিভোর্স হয়ে গেলেও লোকে এইরকম সময়ে খবর পাঠায়, আসেও।’
‘আমাদের তো ডিভোর্স হয়নি।’ বিভাস ক্লান্তভাবে বললেন।
‘তাহলে তো আরো ভালো। ডিভোর্স হয়নি তবু দুজনে দুই কন্টিনেন্টে বসে আছিস। আচ্ছা তোর কি ছেলেমেয়েগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করে না?’
‘করে। কিন্তু ওদের লেখাপড়া ওখানেই ভালো হবে।’
‘দেখ টুকু আমি তোদের দুজনকেই ছোটো থেকে চিনি। তোরা শুধু শুধু নিজেদের কষ্ট দিচ্ছিস, ভগবানের দোহাই আমাকে একটা ফোন করতে দে।’ ডা: মাইতির গলায় এবার উদ্বিগ্ন অনুনয়ের সুর। বিভাস কিন্তু এখনও চুপচাপ, ওঁর মুখে একটা ক্লিষ্ট অবসাদের চিহ্ন, যেন অনেকক্ষণ ধরে কি একটা হারানো জিনিস খুঁজে খুঁজে এবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।
‘যাকগে, তুই রেস্ট নে একটু। আমি সন্ধ্যাবেলা আবার আসবো। বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হবে কিছু?'
বিভাস অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়লেন এবারও। কি কি যেন দরকার ঠিক মনে পড়ছে না। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে শ্যামল মাইতি একবার বন্ধুর দিকে ঘুরে তাকালেন, ওঁর চোখে কেমন একটা অর্থপূর্ণ দৃষ্টি।
‘বাই দি ওয়ে সমাদৃতা এসেছিল। বললো তুই একটু ভালো বোধ করলে তোর সঙ্গে দেখা করবে। চিন্তা নেই ওর ছেলে একদম ঠিক আছে, তোর পাশের কেবিনেই রিকভার করছে এখন।’ বিভাস হাঁ করার আগেই ওর প্রশ্নটা ঠিক ধরে ফেলেছেন ডা: মাইতি।
‘ওকে পাঠিয়ে দে প্লীজ।’
‘তুই জানিস ওর নাকি ডিভোর্স হতে চলেছে?’
‘জানি।’
‘তুই ওর ছেলের অপারেশনটা না করলেই হয়ত পারতিস। চেনা লোকের ওপর সার্জারি করলে স্ট্রেস হয়। ওরা শহরে আসার পর থেকেই দেখছি তুই কেমন যেন অন্যমনস্ক।’
‘সমু, একটা কথা জিজ্ঞেস করি? মানে কথাটা হয়ত অদ্ভুত শোনাতে পারে।’
‘করেই ফেল। অদ্ভুত শোনালে, শোনাবে। তোর উলটোপালটা কথা কি আজ থেকে শুনছি? হতে চাইলি সাহিত্যিক হোলি সার্জন।’
‘ধরে নে বাইশ বছর আগে আমি আমেরিকা চলে গেছি, ওখানেই প্র্যাকটিস করছি। তোর কি মনে হয়, লিপি আমাদের মধ্যে কাকে বিয়ে করতো আর তিতলিই বা কোথায় থাকতো?’
ড: মাইতি এক মিনিটের জন্য থমকে গেলেন। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে এলেন বন্ধুর বিছানার পাশে। ওঁর চোখেমুখে ব্যথা আর বিস্ময় খেলা করছে।
‘টুকু তুই চিরদিন একরোখা কম্পিটিটিভ পুরুষমানুষ, তোর মনের জোর সাংঘাতিক, শরীর খারাপ হতেও আমি কোনদিন দেখিনি। অসুস্থ হলে মনটাও উদাস হয়ে যায়, সেখানে তখন তার মধ্যে অতীত জীবনের নানারকম রিফ্লেকশন খেলা করতে থাকে। এটা অস্বাভাবিক কিছু না। তোরা সার্জনরা বিশ্বাস করিস ধরো তক্তা, মারো পেরেক, কেটেছেঁটে জুড়ে দিয়েছি, হিসাব খতম। অসুস্থতার শিকড় কতদূর অবধি নামে, শরীর আর মনের মধ্যে কি সাংঘাতিক যোগাযোগ, আমরা ফিজিসিয়ানরা কিন্তু সেটা বিলক্ষণ বুঝি। লিপির সঙ্গে গণ্ডগোল, তোর এই গোঁয়ার্তুমি করে একা একা থাকা, সমাদৃতার সঙ্গে এতদিন বাদে দেখা হওয়া, ওর ছেলের অসুখ, সব মিলিয়ে তোর মাথাটা ঠিক নেই, তাই শরীরটাও বিকল হওয়া আশ্চর্য নয়। তুই বরং এখন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়, কাল সকালে কথা হবে। আমি আজকের জন্য কারুর সঙ্গে দেখা করাই রেকমেন্ড করবো না। তোর রাতের খাবার আমি নিয়ে আসছি।’
‘জানতাম প্রশ্নটা উদ্ভট শোনাবে। আমি ভালো আছি সমু তুই তিতলিকে ডেকে দে একবার।’
‘তুই যেদিন কারো কথা শুনবি সেদিন আমার হাতের তালু দিয়ে তালগাছ বেরোবে। ভীমরতি আর কাকে বলে?’ গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন ডা: মাইতি। নার্স এসে ওষুধগুলো দিয়ে গেছে। ট্যাবলেটগুলো সরিয়ে রাখলেন। নার্স ভদ্রমহিলা প্রায়ই এসে কথা বলে যাচ্ছেন, সমু নির্ঘাৎ ভালো করে নজর রাখতে বলে গেছে। এদিকে তিতলির ফোন নম্বরটাও মাথায় আসছে না।
‘আসতে পারি?’ মিষ্টি অথচ সামান্য ভাঙা ভাঙা গলার স্বর, খুব আস্তে কথা বলাটা যেন এক ধাক্কায় খুলে দিলে মনের ভিতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাগুলো।
কেবিনের দরজাটাও খুলে গেছে, বারান্দায় জোরালো আলো, ঘরের ভেতরে আধো অন্ধকার। বিভাস দেখতে পেলেন দরজায় যে এসে দাঁড়িয়েছে তার মুখের চারপাশে ছায়া ফেলেছে খোলা চুলের ফ্রেম। স্যিলুট হওয়া শরীরের রেখাটি স্লিম অথচ সুগঠিত। দেখলেই বোঝা যায় এই শরীরের সঙ্গে জিমন্যাশিয়ামের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। হালকা রঙের প্যান্ট আর বাটিকের টপ পরা মহিলাটি এইবার আস্তে আস্তে এসে বিভাসের বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন, এবারে মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, রুপোলি ফ্রেমের চশমার পিছনে পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে পুরনো চোখের কাজলরেখা। সে মুখে কি সত্যিই সময়ের দাগ পড়েনি, নাকি বিভাসের চোখে পড়ছে না, অথবা হয়ত বা মেক-আপের নিপুণ কেরামতি সময়কেই দিয়েছে বোকা বানিয়ে।
‘কেমন আছো টুকুদা? ঘুমিয়ে পড়েছিলে।’
‘একদম না। আগে বলো পাপু কেমন আছে?’
‘খুব ভালো। ঘুমিয়ে পড়েছে, খুব একটা ব্যথাও বলছে না। মাঝখান থেকে কি হলো তোমার বলো তো? আমার খুব গিলটি লাগছে কেন তোমাকে ইনভলভ করলাম।'
‘এইরকম অসুস্থতা যে কারুর যে কোনো সময়ে হতে পারে।’ কথাটা নিজের কানেই খুব একটা জোরদার শোনালো না বিভাসের।
‘শ্যামলদা বলছিলেন যে তোমার ওপর খুব চাপ যাচ্ছে ইদানীং। সব আমার জন্য, আমি এসেই আরো চাপ বাড়িয়ে দিলাম। প্রথমে আমার এনজিও প্রজেক্টের জন্য ফান্ডিং, তারপর আমার ছেলের অসুখ।’
বিভাস চুপ করে রইলেন। তিতলি চেয়ারটা টেনে একটু দূরেই বসেছে, বিভাস আশা করেছিলেন ও আরেকটু কাছাকাছি বসবে। বিভাসের বলতে ইচ্ছে হল চাপ তো তুমি সেই কবে থেকেই বাড়িয়ে দিয়েছ তিতলি। তোমাদের বাড়ি ছিল বাস স্টপ থেকে খানিকটা ভিতরে, সরু একটা গলি দিয়ে যেতে হতো, সেখানে সবসময় ঠেলাওয়ালা আর ঝাঁকামুটেদের ভিড়। রাস্তাটা তার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেছে, সেখানেই এককোণায়, আমেরিকায় যাকে বলে টাকড অ্যাওয়ে, সেইরকমভাবেই ছিল তোমাদের দরজা লাগানো কম্পাউন্ড, ওখানে কি একটা কারখানাও ছিল বোধহয়। আমাদের বাবা-মা-রা পরস্পরকে চিনতেন, সেদিন তোমাদের বাড়িতে আমাদের রাত্রে খাবার নেমন্তন্ন ছিল। তোমার পড়ার ঘরে ছোট্ট কটেজ পিয়ানোটার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি সমানে কথা বলে যাচ্ছিলে, আমি ভ্যাবলার মতো সামনের কাউচে বসে শুনছিলাম। ঠিক আজকের মতোই সেদিনও আলোটা তোমার মাথার পিছনে ছিল। সেই সময়ে তোমার চুলটা ছিল একটু বুনো, একটু রুক্ষ কিন্তু সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন পিঠ উপচানো, এখনকার এই কাটাছাঁটা মসৃণ শহুরে চুল নয়। তুমি অনেক কথা বলেছিলে কিন্তু তার মধ্যে একটাই কথা আমার মাথায় সারা জীবনের জন্যে গেঁথে গেছে—আমার সত্যিকারের কোনো বন্ধু নেই জানো। সেই মুহূর্ত থেকেই আমার চাপ নেওয়ার শুরু হয়েছে।
তিতলি ওই বয়েসে ওইরকম একটু দু:খবিলাস তো সকলেরই হয়, তুমি হয়ত কিছু না ভেবেই কথাটা বলে দিয়েছিলে। তুমি কলকাতার একটা নামকরা কো-এডুকেশন স্কুলে পড়তে, ছেলেদের সঙ্গে ঘন্টাদুয়েক আড্ডা মারা তোমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু ওই প্রথম বোধহয় আমি একটা মেয়ের সঙ্গে অতক্ষণ একলা বসে কথা বলেছিলাম, বাবা-মায়েরা তখন বৈঠকখানায় নিজেদের গল্পে ব্যস্ত।
ব্যাস ওই একটাই সন্ধ্যা। তারপর কয়েক বছর হয়ে গেল দুই পরিবারে আর বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ নেই, কিন্তু তোমার ওই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করার ছবিটা আমার সঙ্গেই থেকে গেছে। এর কয়েকমাস বাদেই মাধ্যমিকের ফল বেরিয়েছে, আমি ভালো নম্বর নিয়ে কলকাতার এক নামকরা কলেজে ভর্তি হয়েছি। সে একটা অদ্ভুত সময় জানো তিতলি। বাংলা স্কুল আর মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে রোগামতন সাধারণ চেহারার একটা ছেলে জীবনে এই প্রথম পাড়ার গণ্ডির বাইরে এক অন্যরকম, উজ্জ্বল ও অভিজাত পৃথিবীর আঙিনায় পা রাখলো। সেইখানে দাঁড়িয়ে একদিকে যেমন সে অকারণ হীনম্মন্যতায় ভুগেছে অন্যদিকে এটাও অনুভব করেছে যে তার বোধ আর স্মৃতিশক্তি তীক্ষ্ণ, কল্পনা করার ক্ষমতা পাঁচজনের তুলনায় প্রবল। সে শুধু ঘাড় গুঁজে পড়াশোনা করতেই চায়নি, এই উত্তেজক নতুন পৃথিবীর সামনে নিজেকে মেলে ধরার, সকলের নজর টানার, চারদিক থেকে যৌবনের উত্তাপ শুষে নেবার প্রবল বাসনা জেগেছে তার অন্তরে। জানো তিতলি, ছেলেটা সেই অল্পবয়েস থেকে একটা উদ্ভট দোটানার সাথে ঘর করে গেল সারা জীবন। একদিকে মগজের মধ্যে তালগোল পাকানো আদর্শবাদ, পারিবারিক মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য, গরম গরম সব প্রগতিশীল আইডিয়া, অন্যদিকে লাগামহীন লিবিডো, পিঠের ওপর উচ্চাশার চাবুক, প্রখর এক প্রতিযোগী মনোবৃত্তি। রক্তের ভিতরে তখন টেস্টোস্টেরন অণুরা দিনরাত ঝটিকাবাহিনীর মতো কুচকাওয়াজ করে চলেছে, চোখের সামনে পার্ক স্ট্রীট, মিডলটন রো আর রাসেল স্ট্রীট দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝকঝকে গাড়ি আর সুগন্ধি সুন্দরীদের একটানা স্রোত। অখিল ক্ষুধায় তখন ছেলেটা সামনে যা পেয়েছে, গোগ্রাসে গিলেছে, সাহিত্য, সভাসমিতি, পলিটিক্স, নাটক, ডিবেট, গানবাজনা, কিচ্ছু বাদ যায়নি। এই করতে করতে দুটো বছর বেমালুম উড়ে গেল, সামনে পরীক্ষা—উচ্চমাধ্যমিক, জয়েন্ট এন্ট্রান্স, আই আই টি, আরো কি কি সব যেন। তখন আবার আদা জল খেয়ে পড়তে বসা। সত্যি বলতে কি এসবের মধ্যে তোমার কথা প্রায় ভুলেই ছিলাম এই দুবছর।
‘টুকুদা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কি ভাবছো বলতো। তুমি তো এইরকম চুপ করে থাকার লোক নও। শরীরটা সত্যিই খারাপ হয়েছে তাহলে।’
‘মাঝে মাঝে বাচাল লোকেরাও চুপ করে যায় তিতলি। আচ্ছা তোমার গলাটা কি আরো একটু ভেঙেছে, নাকি শোনার ভু্ল?'
কি আশ্চর্য আমি কি এই বয়সে ব্রাশ করছি নাকি হরমোনের কারসাজিতে ঠিক এই সময়েই কান গরম হয়ে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে? অবাক হয়ে ভাবলেন সমাদৃতা। গত একঘণ্টার কথাবার্তায় বিভাস এইরকম দু একটা সংক্ষিপ্ত বাক্য ছাড়া বিশেষ কিছুই বলেননি, শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছেন সোজা সামনের মানুষটির মুখের দিকে। চশমার আড়ালে ওঁর ধারালো দুচোখের দৃষ্টি, গতকাল অবধি যেখান থেকে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ছিলো, আজকে তারা যেন ঝড়ের বিকেলবেলায় বাসাছাড়া পাখির মতো বিভ্রান্ত। বিভাস যেন চোখ দিয়ে কথা বলছেন কিন্তু মুখের ভাষায় গুছিয়ে কিছু বলতে পারছেন না। শ্যামলদা বলছিলেন বিভাসের হয়তো একটা হালকা স্ট্রোকের মতন হয়ে গেছে যদিও স্ক্যান-এ ধরা পড়েনি কিছুই। এসব কি তারই উপসর্গ? হয়ত সমাদৃতার এখানে বসে থাকাটা উচিৎ না, এতে রোগী আরো উতলা হয়ে উঠবে, ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাবে হয়ত। নার্স মহিলাটি একটু আগে ওষুধ দেবার সময় ব্যাজার মুখে ঘড়ি দেখে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন সমাদৃতা।
‘আমি আসি কেমন। ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করো। গুড নাইট, কাল নাহয়’ —। বলতে বলতেই থেমে গেলেন সমাদৃতা। একটু কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বিভাস দুহাত দিয়ে ওঁর হাতটা আঁকড়ে ধরেছেন, ছোট ছেলেরা ভয় পেলে যেভাবে মাকে ধরে ফেলে।
‘তিতলি তুমি আর একটু বসবে, তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবো। আগে থেকেই বলে রাখছি, তোমার অকওয়ার্ড মনে হতে পারে, মনে হতে পারে যে ডাক্তার হিসাবে আমার এই সব কথা বলা উচিৎ নয়। ভাবতে পারো অসুস্থ হয়ে লোকটা হঠাৎ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করেছে কেন? কিন্তু বিশ্বাস করো আমি একটুও অসুস্থ নই। শুধু কয়েকটা ব্যাপার ধাঁধার মতন লাগছে, ঠিক করে বুঝতে পারছি না। বড্ড কনফিউজড। একটু হেল্প করো প্লীজ। আমি যেদিন হঠাৎ করে তোমাদের বাড়ি চলে গেছিলাম মনে আছে?
‘এখন থাক না টুকুদা। তোমার শরীরটাও ভালো নেই। গত কয়েক সপ্তাহে যতবার আমি পুরনো কথা তুলেছি, তুমিই না প্রতিবার নানা কায়দায় এড়িয়ে গেছো। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম তুমি আর সবার মতই সময়ের সঙ্গে বদলেছো, আর সেটাই তো হওয়া স্বাভাবিক। এখন দেখছি আবার সেই অবুঝ স্কুলের ছেলেটির মতন বায়না শুরু করেছো।’
‘তিতলি তোমার মনে আছে সেই যেদিন আমি তোমাকে প্রপোজ করেছিলাম।’
‘মনে নেই আবার। কথা নেই বার্তা নেই তিন বছর পরে একটা ছেলে এসে হাজির হলো। কি ব্যাপার, না তার নাকি একটা ইন্টেলেকচুয়াল ক্রাইসিস চলছে। তা আমার কাছে কেন? কারণ সে নাকি আমাকে গত তিন বছর ধরে পাগলের মতো ভালোবাসে। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে তাহলে বাপু, আমি তো তোমায় ভুলেই গিয়েছিলাম।’
‘আমি একটা কবিতার লাইন বলেছিলাম না-ভুলে থাকা, নয় তো সে ভোলা। বলেছিলাম বাইরের জিনিস দিয়ে মনের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটা ভরিয়ে রেখেছিলাম। সেই ফাঁকিটা যখন অসহ্য হয়ে উঠেছে তখন একদিন ভাদ্রমাসের গুমোট বিকেলবেলায় হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি পড়েছিল। আমি ছাদে উঠে দেখলাম একদিকের আকাশ তখনো মেঘলা, অন্যদিকে একটা ক্ষীণ রামধনুর রেখা, নারকোল গাছের পাতায় একটুখানি রোদ্দুরের আভাষ। আমার মনের দরজাগুলো এক ধাক্কায় খুলে গেল, দেখলাম তোমার সেই ছোট্ট পড়ার ঘরে, কটেজ পিয়ানোটার পাশে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। বৃষ্টিশেষের হাওয়ায় তোমার চুল উড়ছে। তিন বছর তুমি ওইখানেই দাঁড়িয়ে ছিলে। তখন ছাদ থেকে নেমে আমি সোজা তোমাদের বাড়ি চলে এলাম। এই প্রথম আমার একা একা কোনো মেয়ের বাড়িতে যাওয়া।’
‘বাপরে কি কাব্য! মনে আছে তখন তুমি যেখানে সেখানে, বাড়িতে, পথঘাটে, মুদির দোকানে এমনকি বাসে ঝুলতে ঝুলতেও কবিতা আওড়াতে। তোমার সঙ্গে রাস্তায় হাঁটা এক ঝকমারি ছিল, লোকজন ফিরে তাকাত।’ সমাদৃতাও যেন অতীতে ফিরে গেছেন।
‘তুমি বেশ ভয় খেয়ে গেছিলে কিন্তু। কোত্থেকে একটা ছেলে এসে বলছে সে তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে ছুঁয়ে দেখতে চায়। বলে দিয়েছিলে ওসব হবে না, আমার বয়ফ্রেন্ড আছে।’
‘তুমি অবশ্য হাল ছাড়ার পাত্র ছিলে না। লম্বা লম্বা চিঠি লিখতে শুরু করলে। আচ্ছা তোমার মতো পড়াশুনায় ভালো ছেলে এমন বিদঘুটে সব বানান ভুল কি করে করতে বলো তো?’
‘আমার বানান খুব খারাপ। ইংরেজি লেখার কথা তো না বলাই ভালো।’
‘চিঠিগুলো যেমন প্যাশনেট তেমনই ছেলেমানুষিতে ভরা। পড়তে পড়তে আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠতো। তুমি তখন প্রায় রোজ আসতে শুরু করেছো, বাবা-মা’র সন্দেহ হচ্ছে, বাড়িতে একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। তোমাকে বলেছিলাম একটু আস্তে চলো।’
‘আস্তে চলা এ জীবনে আর হলো কোথায়। তোমার কাছে লেঙ্গি খেয়ে তারপর থেকে ছুটেই চলেছি। ওইটাই সাফল্যের চাবিকাঠি আবার ওইটাই অভিশাপ। তুমি সেদিন ওই গানটা শুনিয়েছিলে—না চাহিলে যারে পাওয়া যায়। সেদিন প্রথম তোমার হাত ধরেছিলাম।’
‘মাই গড টুকুদা, তোমার কি হয়েছে? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে এসব যেন কালকের ঘটনা।’
‘পরের দিন কেমন করে জানি না, বড়রা কথাটা জানতে পারলেন। সেদিন দরজা খোলার সময় তোমার মায়ের মুখ দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। উনি বললেন বসার ঘরে যেতে কথা আছে। তুমি ঢুকলে, তোমার থমথমে মুখ, না আঁচড়ানো ভেজা চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে, চোখ দুটো কান্নায় লালচে। বুঝতে পারলাম মাসি সব জানতে পেরেছেন।
‘তারপর তুমি যা বললে, শুধু তুমিই বলতে পারো,’ সমাদৃতা হাসছেন।
‘আমি গটগট করে হেঁটে রান্নাঘরে চলে গেলাম। মাসি রান্না বন্ধ করে ফিরে তাকালেন। আমি বললাম —মাসি আমি তিতলিকে ভালোবাসি, ভবিষ্যতে ওকে বিয়ে করতে চাই। আমার আঠারো বছর বয়েস, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছি, ডাক্তার হবো, খুব একটা অযোগ্য পাত্র নই।’
‘আজকের এই দারুণ কনফিডেন্ট, কিছুটা অ্যারোগ্যান্ট কার্ডিওথোরাসিক সার্জন বিভাস দাশগুপ্ত তখন একটা সদ্য গোঁফওঠা ডেঁপো ছোকরা। মা তোমার স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলেন।’ মাসির কথা শেষ হবার আগেই আমি এক দৌড়ে তোমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিলাম, চোখে যে জল আসছে সেটা যাতে কিছুতেই ধরা না পড়ে। এখন খুব আপশোষ হয়, যাবার আগে তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খেয়ে গেলাম না কেন। কি আর হতো, বড়জোর মাসি বাড়িতে নালিশ করতো তারপর আর একপ্রস্থ বকাবকি, কান্নাকাটি এই তো? ওসব আমি কেয়ার করতাম না।’ বিভাস বললেন।
‘ভাগ্যিস ওইটুকু দয়া করেছিলে। এমনিতেই টেনশনের চোটে পরদিন আমার তেড়ে জ্বর এসেছিল। তারপর তোমার সেই ইংরেজিতে লেখা হে বন্ধু বিদায় মার্কা চিঠি। কি বাজে ভুলভাল ইংরেজি, গুচ্ছের কোটেশন আর প্রাণপণে নিজের বিদ্যে জাহির করার চেষ্টা।’ সমাদৃতা ফিসফিস করে বললেন, ‘তুমি জানো না ওই চিঠিটা আমি আজ অবধি রেখে দিয়েছি, এখন স্ক্যান করে সেভ করা আছে, তাই মাঝে মাঝে পড়তেও পারি। ওরকম কাঁচা আবেগের বন্যা আর অকালপক্ক লিবিডোর বিস্ফোরণ আমি কোনো বইতে পড়িনি, সিনেমাতেও দেখিনি।'
‘বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ওইরকম ইংরেজি শেখায়। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল আমার বিচ্ছেদের বেদনাটা ছিল জেনুইন কিন্তু অস্থায়ী। আমার মতো লোকেরা বেশিদিন দেবদাস হয়ে থাকতে পারে না। মেডিক্যাল কলেজে ক্লাস শুরু হবার তিন মাসের মধ্যে আমি লিপিকার প্রেমে পড়ে গেলাম। রেসিডেনসি শেষ করতে না করতেই বিয়ে, তারপর ওকে নিয়ে সোজা আমেরিকায়। তারপর তোমার সঙ্গে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল। কোথায় বলো তো?’
‘নিউ আলিপুর পেট্রল পাম্পে থ্রি বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে।’ সমাদৃতা এক নি:শ্বাসে বলে দিলেন, ‘তখন তো লিপিকার সঙ্গে খুব প্রেম চলছে, বাড়ি আসতে বললাম, এলে না। বললে যা শেষ হয়ে গেছে তাকে যেতে দেওয়াই ভালো, যাকে ভালোবেসে পাওনি তার বন্ধু হওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। আরো কি কি সব জ্ঞান দিয়েছিলে। ব্যাস তারপরে আর কোনো যোগাযোগ নেই, আমারও কয়েক বছর পরে বিয়ে হয়ে গেল সন্দীপের সঙ্গে। তারপর তো এত বছর কলকাতার বাইরে’ — সমাদৃতা একটা শ্বাস চাপলেন, ‘পরে শুনেছিলাম তুমি দেশে ফিরে এসে এই নতুন প্রাইভেট হাসপাতাল খুলেছো, কলকাতায় একা তুমিই এইরকম সার্জারি করতে পারো, তোমার বিরাট নামডাক। আমি কিন্তু শিওর, মা পরে আপশোষ করেছিল।’
বিভাসের কান খাড়া হয়ে উঠল হঠাৎ। উনি আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছিলেন। কবে? কিন্তু সে কথাটা জিজ্ঞাসা করাও তো মুশকিল। তিতলি হয়ত ভাববে ওঁর মাথায় গণ্ডগোল হচ্ছে।
‘তোমার আপশোষ হয়নি?’
‘আমার আর কি করার ছিল?’ সমাদৃতা হাসছেন। কয়েক ঘন্টা হয়ে গেছে ওরা দুজনে এখনও কথা বলে চলেছেন, বিছানার ওপরে মনিটরে সবুজ রেখাটা এখনও বিভাসের হৃদস্পন্দন মেপে চলেছে। সমাদৃতার মনের মধ্যে বিস্ময় থেকে কৌতুক, তারপর সেখান থেকে অনভ্যস্ত ভালোলাগার শিরশিরানি খেলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল অল্পবয়েসের খামখেয়ালিপনা, ঝুঁকি নেওয়া আর পাগলামির সময়টা যদি ম্যাজিকের মতো ফিরে আসতো, কি করতে চাইতেন উনি এখন?
সমাদৃতা চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন তারপর সাবধানে একটু ঝুঁকে পড়ে বিভাসের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলেন। বিভাস একটুও অবাক হলেন না, যেন এটা খুবই প্রত্যাশিত একটা ব্যাপার। বহুদিনের জমিয়ে রাখা অনুভূতিগুলো এখন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে আর বিভাস ঠিক তপ্ত বেলাভূমির মতোই তাদের শুষে নিচ্ছেন। এরই মধ্যে নার্স ভদ্রমহিলা একবার ঘরে ঢুকতে গিয়েও পালিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা এক্ষুনি ড: মাইতিকে রিপোর্ট করতে হবে। অন্য কোনো রোগী হলে উনি ঘরে ঢুকে যা করবার করতেন কিন্তু ড: দাশগুপ্তকে কিছু বলার সাহস এই হাসপাতালে কারো নেই।
ব্যাংকক শহরটায় দিনরাত ভিড় আর হট্টগোল লেগে আছে, কিন্তু তার মধ্যে হস্টেলিং ইন্টারন্যাশনাল নামে শহরের ইউথ হোস্টেলটা ওলড টাউনের একটু নিরিবিলি জায়গায়। উলটোদিকে একটা বাজার আছে, সেখানে বেশ সস্তায় খাবারদাবার পাওয়া যায়। মান্যতা, রন আর বিতান আপাতত এইখানেই উঠেছে। ওরা প্রায় হপ্তাখানেক কুয়ালালামপুরে ছিল, সেখানে হারিয়ে যাওয়া প্লেনযাত্রীদের আত্মীয়স্বজন, এয়ারলাইন অফিসিয়াল, সরকারী আমলা, উকিল, মোক্তার, সলিসিটর আর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন এজেন্সির লোকজন নিয়ে বেশ একটা সোরগোল হয়েছে কদিন। কাজের কাজ প্রায় কিছুই হয়নি যদিও প্রতিশ্রুতি এসেছে যথেষ্ট আর কমিটি বসেছে বেশ কয়েকটা। প্লেনটা জলে পড়ে গেছে এ ব্যাপারে সবাই বেশ নিশ্চিন্ত যদিও সাউথ চায়না সী তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো হদিশ মেলেনি। এদিকে সবাই যে মারাই গেছে এটা নিশ্চিন্ত হবার আগে ক্ষতিপূরণ নিয়ে দর কষাকষি শুরু হয়ে গেছে, যা দেখে ওরা হতবাক। বড়দের পৃথিবীতে সবকিছুই যে শেষ অবধি টাকাপয়সার হিসাবে গিয়ে দাঁড়ায় সেটা বুঝতে বেশ কষ্ট হয়েছে ওদের। মালয়েশিয়ান অফিসিয়ালরা তাঁদের এয়ারলাইনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তাঁরা দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়েছেন কিন্তু ভেতরের খবরাখবর কিছুই সময়মতো জানাচ্ছেন না। নানা কনস্পিরেসি থিওরী বাজারে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার মধ্যে আতংকবাদীরা আছে, ভিন্ন গ্রহের জীবেরা আছে, রহস্যময় রোগ আছে যাতে কিনা একদল মানুষ একসাথে পাগল হয়ে যায়, এমনকি ভূত প্রেত, ভগবানও বাদ পড়েনি। বাইরের লোকজন বিশেষ করে চীনেরা ক্ষেপে টং হয়ে আছে, মালয়েশিয়ানরা নাকি এক ফোঁটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। একটা আস্ত এরোপ্লেন উবে গেল, সিভিলিয়ান বা মিলিটারি রাডারগুলো তার টিকির দেখাও পেলো না, এমন আবার হয় নাকি? সতেরোটা দেশের নেভি আর কোস্টগার্ড জোরসে টহল দিচ্ছে কিন্তু হাজার হাজার মাইল খোলা সমুদ্রের মধ্যে একটা ক্ষুদে এরোপ্লেন খোঁজা আর গোলাভর্তি খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজা একই। এখন কথা উঠেছে এরোপ্লেনটা নাকি ইউ টার্ন নিয়ে থাইল্যান্ডের দিকে আসছিল, মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি কোথাও জলে পড়ে গেছে। পাইলট কেন উলটো রুটে চালাল, কেনই বা একটাও বিপদ সংকেত পাওয়া গেল না, এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ওরা মোটামুটি হাল ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে যাবার কথা ভাবছে, বাড়ি থেকেও ফিরে আসার জন্য প্রবল চাপ। এইরকম একটা হতাশাভরা সন্ধ্যাবেলায় ক্লান্ত তিনজনে একটা সস্তা হোটেলে ডিনার সারতে সারতে কথাবার্তা বলছিল। বিতান ওদের মধ্যে সবচেয়ে উৎসাহী, সে ভাবছে একাই আন্দামান রওনা দেবে।
‘শোন আমি বলছি তুই আর রনি ফিরে যা, স্প্রিং ব্রেক তো শেষ হয়ে এল, স্কুল শুরু হয়ে গেলে তোর পড়াশোনার খুব ক্ষতি হবে। আমি তো রইলাম।’
‘আর তোর কলেজের ক্ষতি হবে না, ওরা কোর্স ক্রেডিটগুলো এমনিই দিয়ে দেবে। এমন ভান করছিস যেন চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিস।’ মিমির গলা শুনে বোঝা যায় হাইস্কুল আর কলেজে মধ্যে স্ট্যাটাসের তফাতটা ও একেবারেই মানতে পারছে না। বিতান ঝাঁঝিয়ে ওঠার আগেই রনি পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। এই ট্রিপে ভাইবোনের ঝগড়া সামলানো ওর একটা প্রধান কাজ, ও সেটা বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে। কাজটা সহজ না কারণ ও লক্ষ্য করেছে যে এরা ভাইবোনে যতই ঝগড়া করুক দরকার মতন ঠিক পালটি খেয়ে যায়, তখন সব রাগটা গিয়ে পড়ে রনির ওপরেই। রনিকে দেখে যতই ফুটবল খেলোয়াড় মনে হোক ও আসলে বেশ ভাবুক টাইপের মাথাঠাণ্ডা মানুষ, চুপচাপ কথা হজম করে যায় আর মিটিমিটি হাসে।
‘ঠিক আছে ওটা নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো। আপাতত আমাদের হাতে তিনটে দিন আছে। আমরা ব্যাংককে বসে থেকে কি করবো তার চেয়ে বরং কলকাতা চলে যাই। কলকাতা থেকে আমাদের আমেরিকায় ফেরার ফ্লাইট আছে, আন্দামান যাবারও ফ্লাইট আছে তাছাড়া মিমি বলছিল ওর গ্র্যান্ডমাদারের সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
প্রস্তাবটা শুনে বিতান আর মিমি দুজনেই একটু হকচকিয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে ওরা প্রায় প্রতি বছর কয়েক সপ্তাহের জন্য কলকাতা এসেছে কিন্তু তাই বলে এ যাত্রায় কলকাতা যাবার কথা কেউ ভাবেনি। মিমি বুঝতে পারলো প্রস্তাবটা গত রাতের এলোমেলো কথাবার্তার ফসল। মিমির প্রতিটা কথা, প্রতিটা ইচ্ছে এই ছেলেটার কাছে সম্রাজ্ঞীর আদেশের মতন। এরই কোনো পূর্বপুরুষ নির্ঘাৎ রানীর সামনে পথের জলকাদার ওপর নিজের জমকালো ওভারকোট ফেলে দিয়েছিল, যাতে তাঁর পায়ের জুতোটি নোংরা হয়ে না যায়। মিমির হঠাৎ চোখ ঝাপসা হয়ে গলা ব্যথা করে উঠলো, টেবিলের তলায় রনির পায়ের ওপর আলতো ঠোক্করে বুঝিয়ে দিলো যে ও বুঝেছে। এই যাত্রায় আসাই হতো না যদি না দাদা আর রনি মিলে মাকে রাজি করাতে পারতো।
‘অসম্ভব। তোমরা এখনও ছেলেমানুষ, হয়ত এটাকে একটা অ্যাডভেঞ্চার ভাবছো, আসলে সাধারণ পাবলিকের এখানে কিছুই করার নেই, সমুদ্রের মধ্যে একটা এরোপ্লেন খুঁজে বার করা শুধু সরকারি এজেন্সি আর নেভির পক্ষেই সম্ভব। তাছাড়া আমি তো ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই চলেছি। এর মধ্যে তোমরা তিন বালখিল্য, ওখানে হাজির হয়ে করবেই বা কি? শুধু শুধু আমার চিন্তা বাড়াবে।
‘মা, আমি ওদের সঙ্গে যাচ্ছি, আমাদের এখন স্প্রিং ব্রেক, এমনিতেই আমার বন্ধুরা এখানে ওখানে বেড়াতে যাবে। হয়ত কোনো লাভই হবে না কিন্তু আমাদের নিজেদের জন্য এটা জরুরী। আমরা অন্তত জানবো যে যথাসাধ্য করেছি। তাছাড়া তুমি অত নেগেটিভ হচ্ছো কেন, অনেক সময় মিরাকলও তো হয়, বিরাট দুর্ঘটনা থেকে অনেকে সারভাইভ করে। আমরা ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটি থেকে যত চাপ বাড়াবো ওরা তত ভালো করে খুঁজবে। আরো অনেকে যাচ্ছে জানো, বিশেষ করে চায়না আর অস্ট্রেলিয়া থেকে।’
‘তুমি ইচ্ছে হলে যেতে পারো কিন্তু মিমির স্কুলের ক্ষতি হবে, ও যাবে না।’ লিপিকা নরম হবার পাত্র নন।
‘আন্টি, আমি স্কুলের প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলেছি, আমরা ইন্টারনেটে হোমওয়ার্ক করবো, আমাদের বন্ধুদের একটা গ্রুপ বানানো হয়েছে যারা আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। কোনো অসুবিধা হবে না,' রনি বলেছিল। ও জানে ভারতীয় বাবা-মায়েরা নাম ধরে ডাকা পছন্দ করে না বরং আঙ্কল বা আন্টি বললে খুশি হয়। এদেশের কোন মহিলাকে বেমক্কা আন্টি বলে ডাকলে সে যারপরনাই বিরক্ত হবে।
‘মা আমি কারুর সঙ্গে ঘুরতে যাচ্ছি না, বাবাকে খুঁজতেই যাচ্ছি। তুমি কেন আপসেট হচ্ছো, দাদা তো সাথেই যাচ্ছে, আমি দাদার সঙ্গেই নাহয় থাকবো।’ চেষ্টা করে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলেছিল মিমি, যাতে রনির খারাপ না লাগে। মায়ের আপত্তির আসল কারণটা ও আন্দাজ করতে পেরেছিল ততক্ষণে। শেষ অবধি লিপিকা নিমরাজি হয়েছিলেন।
রাস্তায় এখন অনেক লোকের ভিড়। আরেকটু রাত্তির বাড়লে ব্যাংককের নৈশজীবন জমে উঠবে কিন্তু এরা তিনজন আপাতত সে রসে বঞ্চিত। বিতান বোনের ওপর নজর রাখে বটে কিন্তু প্রতিদিন নিয়ম করে ওদের দুজনকে খানিকটা একলা সময় দিতে ভোলে না। খাওয়া শেষ করে ও উঠে দাঁড়িয়েছে এবার।
‘তোরা একটু বস আমি আসছি। একটা জিনিস চেক করতে হবে, এখানে ইন্টারনেট কানেকশন পাওয়া যাচ্ছে না।’
রনি আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মিমি খুব মন দিয়ে আইসক্রীম খাচ্ছে।
‘মিমস।’
‘উঁ’
‘কি ভাবছো?’
‘ভাবছি তুমি শুধু শুধুই আমার জন্য অ্যাত্তো ঝামেলা নিলে। মা ঠিকই বলেছিল, দে আর অল ডেড। ওরা প্লেনের রেকেজ খুঁজছে ড্যামেজ কনট্রোলের জন্য। দেখলে না ইনসিওরেন্স আর লিগাল ফার্মগুলো কেমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নো ওয়ান কেয়ারস অ্যাবাউট দি ভিক্টিমস।’
‘আমার তো তাতে কখনই কোনো সন্দেহ ছিল না না মিমি। তবুও বলবো এই খোঁজাটা আমাদের জন্য জরুরী। হয়ত আমাদের নিজেদেরই খোঁজা।’
‘কি খোঁজা রনি?’
‘আমারটা বলতে পারি। আমি আমার নিজের নতুন পরিচিতি খুঁজছি। গ্লোবাল ভিলেজের এক গ্রামবাসী হিসাবে।’
‘কি হেঁয়ালী করে কথা বলছো রনি।’
‘মিমস তুমি জানো আমি দুটো পরিবারে বড়ো হয়েছি। আমার যখন দশ বছর বয়েস, আমার বাবা-মা’র ডিভোর্স হয়ে যায়। সকালবেলায় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ গাড়িচাপা পড়ার মতো একটা রক্তাক্ত ডিভোর্স। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আমরা সবাই শুনলাম যে বাবা অফিসের এক সহকর্মীর প্রেমে পড়েছে, যে কিনা পুরুষমানুষ।’
‘তুমি বলেছো। তোমার বাবা ছোটবেলা থেকেই সমকামী ছিলেন।’
রনি হাসলো, ‘হ্যাঁ, কিন্তু ওদিকে আমাদের পরিবার ছিল গোঁড়া ক্যাথলিক, ওরা ডিভোর্সে বিশ্বাস করে না, সমকামীদের মানসিক বিকারগ্রস্ত ক্রিমিন্যাল মনে করে। বাবা আসলে অনেকদিন ধরেই সেই অফিসের বন্ধুটির সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিল, মা দেখেও দেখতো না, আমাদেরও কিছু জানতে দেয়নি। আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না মায়ের আসল সমস্যাটা কোথায় ছিল—বাবার বিকল্প জীবন, প্রেমহীন সম্পর্ক, ডিভোর্স, নাকি হোমোসেক্সুয়ালিটির কথাটা জানাজানি হয়ে সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়া।’
‘কিন্তু তার সঙ্গে তোমার পরিচিতির কি সম্পর্ক? মিমি আস্তে করে ওর হাতটা ধরেছে। এই ছেলেটার জীবন ওর তুলনায় কতো জটিল।
‘এই পরিচিতি জিনিসটাই যত নষ্টের গোড়া মিমি। আমি আমেরিকান ক্যাথলিক, তুমি ভারতীয় হিন্দু, অমুকে ইহুদি বা মুসলমান, এই সব পরিচিতিগুলোই আসলে এক একটা গল্প। ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে গল্পগুলো আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে ঢুকে গেছে। তখন ওদের বাদ দিলে আমরা বিপন্ন হয়ে পড়ি। গল্পগুলোকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য আমরা নিজেরা সবকিছু সহ্য করতে প্রস্তুত থাকি, আবার অন্যের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করতেও পিছপা হইনা। একমাত্র একটাই জিনিস আছে যে কিনা আমাদের এই অলীক গল্পের অত্যাচার থেকে অল্পসময়ের জন্য মুক্ত করে। সেটা কি বলো তো?’
মিমি ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো, রনির বক্তব্যের এক ফোঁটাও ওর মাথায় ঢুকছে না।
‘ন্যাচারাল ডিজাস্টার। বড়ো এটা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা বা একটা অপ্রত্যাশিত ট্র্যাজেডি—বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, অগ্নিকাণ্ড বা এইরকম একটা আস্ত এরোপ্লেন হারিয়ে যাওয়া। তখন অল্প সময়ের জন্য আমরা যে যার রূপকথার নায়ক নায়িকাদের ভুলে গিয়ে পাশের মানুষটার দুঃখকষ্টের সাথী হয়ে উঠি। ওই এরোপ্লেনের সবাই এখন হারিয়ে যাওয়া মানুষ, তাদের কোনো জাতিধর্ম নেই, তাদের প্রত্যাশা আর পরিণাম একই, তাই এই মুহূর্তে তারা ভুবনগ্রামের আদর্শ বাসিন্দা। এবার যদি প্লেনটাকে খুঁজে পাওয়া যায়, যদি সবাই ঠিকঠাক ফিরে আসে তখন আবার সকলে যে যার সাবেক পরিচিতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। যে কোনো সময়ে পৃথিবীর আকাশে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কমার্শিয়াল এয়ারক্র্যাফট থাকে। যদি তারা সবাই একদিন একসাথে হারিয়ে যায় তারপরে ল্যান্ড করে একটা বিকল্প পৃথিবীতে যেখানে আর কেউ নেই; সেই মানুষগুলো মিলে তখন নতুন একটা সমাজ তৈরি করবে হয়ত, তার বুনিয়াদ হবে প্রতিযোগিতার বদলে সমবেদনা।’
‘থিয়োরিটা ইন্টারেস্টিং, কিন্তু জানতে হচ্ছে করে যে এই যাত্রায় তোমার প্রেরণা কি? মিমির প্রতি সমবেদনা নাকি এই হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারটাই তুমি খুঁজতে বেরিয়েছো? সে কথা পরে হবে, আপাতত একজনের সঙ্গে পরিচয় করানোর আছে। ইনি মিস রাবিয়া হুসেন, আমরা যে কারণে এখানে এসেছি উনিও সেই কারণেই এসেছেন। ওঁর স্বামী জাভেদ ওই ফ্লাইটে ছিলেন।’
ওরা লক্ষ্য করেনি বিতান কখন ফিরে এসেছে, চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে শুনছে ওদের কথাবার্তা। ওর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একটা অল্পবয়েসী মেয়ে, তার পরনে কালো জিনসের ওপর ফুলহাতা মেরুন রঙের টপ। ওই একই রঙের একটা হেডস্কার্ফ দিয়ে ওর চুলটা ঢাকা কিন্তু মুখের ভাব খুব সপ্রতিভ, সেখানে হালকা লিপস্টিক, সাবধানী মেকআপ আর আইলাইনারের ছোঁয়া আছে, যে কোনো অল্পবয়েসী শহুরে মেয়েদের যেমনটা দেখা যায়।
‘বন্ধুরা আমাকে বলে রবিন।’ চেয়ার টেনে বসতে বসতে মেয়েটি বললো, ‘আমরা নিউইয়র্কে থাকি।’
খেতে খেতে অনেক কথা হল ওদের। রবিনের পরিবার পাকিস্তানি, আদি বাসস্থান লাহোর, নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইট এলাকায় ওদের দোকান আছে, ও বড়ো হয়েছে ওই পাড়াতেই। পড়াশোনায় ভালো, স্কুল শেষ করে ভর্তি হয়েছিল কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইচ্ছা ডাক্তারি পড়ে। কলেজে জাভেদ ইউসুফ বলে এক পিএইচডি স্কলার ওদের ফিজিক্স পড়াতো। লাজুক ছেলেটির সঙ্গে ধীরে ধীরে আলাপ, ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেম। জাভেদ একে ভারতীয় তার ওপর শিয়া, অন্যদিকে মেয়েটির পরিবার গোঁড়া সুন্নি, কাজেই বাড়ি থেকে প্রচণ্ড আপত্তি। বিয়ে না করে একসাথে থাকতে ওরা চায়নি, যদিও সেটা সহজ ছিল। তড়িঘড়ি বিয়ে করার জন্য পিএইচডি শিকেয় তুলে জাভেদ ঢুকলো একটা চাকরিতে, সেই চাকরির সূত্রেই ওর কুয়ালালামপুর আর বেইজিং যাবার কথা। সবার আগে ওরা কোর্টে গিয়ে বিয়েটা সেরে ফেলে যদিও একসাথে থাকা মাত্র কয়েকদিনের জন্য। রবিনের কাছে নতুন খবর বিশেষ কিছু নেই কিন্তু ঘটনাটা ঘটার পর ওর অভিজ্ঞতা কিছু অন্যরকমও। এখানে আসার ঠিক আগেই একটা আমেরিকান সিকিউরিটি এজেন্সি ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়।
‘তোমাকে ইন্টারোগেট করেছিল কেন? তোমার সঙ্গে এই অ্যাক্সিডেন্টের কি সম্পর্ক?’ মিমি অবাক, ‘আমাদের তো করেনি।’
‘আমি পাকিস্তানি পরিবারের মেয়ে, আমাদের কোনোরকম টেররিস্ট কানেকশন থাকলেও থাকতে পারে তো।’ রবিন হাসলো, ‘ওইরকম একটু আধটু সন্দেহ আর প্রোফাইলিং আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। অনেকেই ভাবছে এটাই ইসলামিক টেররিস্টদের কাজ। আবার উলটোদিক থেকে একদল বলছে এটা আসলে আমেরিকান আর্মির একটা টপ সিক্রেট এক্সপেরিমেন্ট।’
‘জানি। কিছু কিছু আমরাও শুনেছি। রবিন তুমি এখানে কোথায় থাকবে, কতদিন থাকবে কিছু ভেবেছো।’ বিতানের গলায় সহানুভূতির সুর। সদ্য বিধবা হওয়া এই মেয়েটির মধ্যে কেমন যেন একটা আভিজাত্য আছে, কথাবার্তায় দৃঢ়তা আর বিষণ্ণতার একটা অদ্ভুত মিশ্রণ। ওর হিজাব ওকে ঠিক আড়াল করেনি বরং মুখের চারদিকে গাঢ় রঙের একটা ফ্রেম তৈরি করেছে, যাকে ধর্মীয় অনুশাসনের বদলে ফ্যাশন স্টেটমেন্টই মনে হয় যেন।
‘জানি না। তোমরা কি করবে ভাবছো? ফিরে যাবে?’ শান্ত অথচ চিন্তিত গলায় বললো।
‘আমরা ভাবছি ফেরার আগে ইন্ডিয়া যাবো একবার। আন্দামান সী-তে খোঁজাখুঁজি চলছে। খবর কিছু একটা মিলতেও পারে। তাছাড়া ওখানে আমাদের বাড়ির লোকেরা আছেন।’
‘আমিও যাবো ভাবছি। আমাদের হনিমুনে একসাথে ইন্ডিয়া ঘোরার প্ল্যান ছিল, বিশেষ করে ওর শহর মুম্বাইতে। ও ওখানেই সেটল করতে চেয়েছিল, খুব বলতো ওদের পুরনো মহল্লার কথা। ওদের গলিটার মুখে বড়ো রাস্তার ওপর দারুণ একটা মোগলাই রেস্টুরেন্ট আছে সেখানকার হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আর চিকেন চাপের জবাব নেই। সেরা বিরিয়ানির জায়গা লাহোর না হায়দ্রাবাদ এই নিয়ে আমাদের খুনসুটি হতো যদিও আমি শেষ কবে লাহোর গেছি আমার মনেও আসে না। আমি ভাবছিলাম মুম্বাই গিয়ে ওর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসবো কিন্তু ওদের কি বলবো বুঝতে পারছি না। এয়ারলাইন বেশ ভালো টাকা দিয়ে সেটল করতে চায়, সেই টাকায় তো ওদেরও অধিকার আছে। কিন্তু আমার ইন্ডিয়ান ভিসা নিয়ে আবার ঝামেলা হতে পারে।’ রবিনের মুখে আবার সেই ব্যথাবিদ্ধ হাসিটা খেলে গেল।
‘এয়ারলাইন আমাদের সঙ্গেও সেটল করতে চেয়েছে, কিন্তু আমরা এখনো রাজি নই।’ বিতান বললো। আমরাও চাই এতগুলো জীবন নষ্ট হবার দায়িত্ব যাদের ওপরে, পৃথিবী তাদের চিনতে পারুক।’
‘যদি ইন্ডিয়া আসো, আমাদের সঙ্গে আসতে পারো। আমরা খুব খুশি হবো, একসাথে থাকলে কাজগুলো করতেও সুবিধা হবে।’ মিমি বললো। ও প্রায় কেঁদে ফেলেছে, অজান্তেই শক্ত করে চেপে ধরেছে রনির হাতটা।
‘দেখি কি হয়। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে খুব ভালো লাগলো। আজ তাহলে গুডনাইট।’ ওদের সঙ্গে মোবাইল নম্বর আর ইমেইল বদলাবদলি করে উঠে পড়লো মেয়েটি। দরজার দিকে ওর হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিমাটি মার্জিত অথচ আধুনিক, ওরা তিনজনেই তাকিয়ে থাকলো সেদিকে। দরজা অবধি গিয়ে একবার ফিরে তাকাল রবিন, নতুন বন্ধুদের দিকে ছোট্ট একটা হাত নাড়া আর মৃদু এক ঝলক হাসি ছুঁড়ে দিয়ে নেমে পড়লো রাস্তায়। আবার দেখা যে হবেই সেবিষয়ে ওদের কারোরই খুব একটা সন্দেহ নেই তখন। প্রিয়জন হারানোর দু:খ আর অল্পবয়েসের রোম্যান্টিক আশাবাদ ওদের মনের চুম্বক। রনি অনেক কথা বলতে চাইছে কিছু ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তাও ও মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে দেখলো।
‘আমি তোমাদের সাথে এসেছি যতটা স্বাভাবিক সমবেদনা থেকে ততটাই হয়তো এই দুর্ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে আসলে আমার নিজের জন্য এক বিকল্প জীবনের সন্ধানে। আমি জানতে চাই যে মানুষের নিজের চারদিকে এইরকম একটা অলীক পরিচিতির দেয়াল বানায় কেন? সে কি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, বুঝতে পারে যে তার প্রিয় আমিত্ব আর গর্বিত অস্মিতার প্রায় পুরোটাই ভিত্তিহীন, সাধারণ বুদ্ধির বিচারে হাস্যকর। সেইজন্যই কি সে কোমর বেঁধে যে যার নিজের গল্পটাকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা চালায়, বাধা পেলে হিংস্র আর অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে? নাকি দিনের শেষে সে তার বানিয়ে তোলা অস্তিত্ত্বের কয়েদখানা থাকে পালাতেই চায়, শূন্য থেকে শুরু করতে চায় সবকিছু?’
মিমি অবাক হয়ে রনির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটার অনেক কথা বোঝা যায় না কিন্তু তার পিছনে যে গভীর ভাবনা আর দুঃখবোধ রয়েছে, তাদের অনায়াসে ছুঁয়ে যাওয়া যায়। এই সফরে মন খারাপ আর উত্তেজনা এমন একসাথে মিশে গেছে যে মাঝে মাঝে সত্যি মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে ওদের।