আ: কি করিয়া ভোল্তা হিদোন্দা যাইবো ?
দুনিয়া বিচরণে অভ্যস্ত পাঠক ভোল্তা হিদোন্দার রাস্তা জানেন না শুনিয়া সবিশেষ দু:খিত হইলাম ! আমার বিমান কোন পথে যাইবে সেই প্রশ্ন অবান্তর - মানচিত্র লইয়া আইস । আমরা ভোল্তা হিদোন্দার সন্ধান করিব ।
এই দেখিতেছো দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ - তাহার অন্ত:পাতী এই যে সুবিশাল দেশ - হ্যাঁ ঠিকই ধরিয়াছো ইহার নাম ব্রাসিল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ইহারা `ফুচ্বল' খেলিয়া থাকে ! `ফুচ্বল' শুনিয়া হাসিতেছো কেন - সারা বিশ্ব ইংরাজী বলেনা, - এ দেশের ভাষা পর্তুগীজ । কি বলিলে, পেলে কি চূনী গোস্বামীর সমকক্ষ খেলোয়াড় ? সঠিক জানিনা ভাই, বাজে বকিয়া বিব্রত করিও না - দ্যাখো, ভ্রমক্রমে এই সুবিশাল উপসাগরের নাম দেওয়া হয় জানুয়ারী মাসের নদী - হিও দি জ্যানিরো - তোমার আমার মতো ইংরাজীনবীস ইহাকে `রিও' বলিয়া ডাকায় এদেশের অধিবাসীবৃন্দ বহু কষ্টে হাস্য সম্বরণ করে । (ইংরাজী হনূকরণে ব্রাসিল কে ব্রাজিল লেখাও বরদাস্ত করিতে পারি - তাই বলিয়া ভোল্তা হিদোন্দা কে ভোল্টা রেডোণ্ডা বলিওনা যেন - পর্তুগীজ অতীব সমৃদ্ধ ভাষা, তাহার মর্যাদায় বাধিবে !) হ্যাঁ, যাহা বলিতেছিলাম, ইহাদের প্রত্যেকের নাম তকাই ! এই উপসাগরের নাম হিও, ইহার উপকূলবর্তী নগরীর নাম হিও, এই নগরী যে প্রদেশের রাজধানী তাহারও নাম হিও । ভোল্তা হিদোন্দা এই হিও প্রদেশের শহর - হিও নগরী হইতে সামান্য দূরে - সাম্পাওলো যাইবার প্রধান সড়ক পথের উপর । ইহা ব্রাসিল তথা সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকার প্রধানতম ইস্পাত উত্পাদন কেন্দ্র । আমি এই ভোল্তা হিদোন্দা ভ্রমণের গল্প বলিতেছি । পুণ্যবান শ্রবণ করো ।
ই: পান্থ এখনও কেন অলসিত অঙ্গ অথবা এলেম নতুন দেশে
সর্বাঙ্গে একটানা বিমান সফরের ক্লান্তি - সানফ্রানসিস্কো-মায়ামী-হিও দি জ্যানিরো ইউনাইটেড এয়ারলাইনস্ এর সুবিশাল জাম্বো জেট অবশেষে আমাকে গালেঁও বিমানবন্দরে সমর্পণ করে নিষ্কৃতি পেলো । আলো ত্রক্রমশ ফুটছে হিও দি জ্যানিরোর আকাশে - আগমন ঝরোখায় পোলিশিয়া ফেদারেলের কর্মচারীটি প্রায় ভাবলেশহীন মুখে আমার পাসপোর্টে ছাপ দিলেন । ব্রাসিলে স্বাগতম ! কাস্টমসের সামনে সুদীর্ঘ লাইন - আমার সামনে মহিলা কাস্টমস্ অফিসারটির মুখে ভেনাসের প্রস্তর কাঠিন্য । অন্য যে কোনো বিমানবন্দরের মতো এখানেও লাল পথ আর সবুজ পথ । তফাৎ শুধু সবুজ পথের দোরগোড়ায় একটা ছোট্ট বোতাম - লুল্লুর আবিষ্কার করা একটা ভাগ্য পরীক্ষার যন্ত্র ! যে কোনো যাত্রীকে বাধ্যতামূলক ভাবে চাপ দিতে হয় ওই বোতামে - চাপ দিলে জ্বলে ওঠে হয় একটা সবুজ আলো, নতুবা লাল, ম্লেচ্ছ ভাষায় এর নাম `র্যানডাম সার্চ' - হয় হেড নয় টেল - হয় লাল নয় সবুজ । দুটোই ঘটতে পারে পথিকবর - তুমি যাও বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে - আমি বোতামে হাত রাখি । সবুজ আলো ! ভেনাসের মুখে মৃদু হাসি । আমি এগিয়ে চলি - হঠাৎ চোখে পড়ে পাশের লাইনে লাল আলো জ্বালিয়ে লুল্লু বিরস বদনে স্যুটকেশ খুলে দেখাচ্ছে ।
ঈ: ভোল্তা হিদোন্দা যাত্রা তথা হোটেল বেলা ভিস্তা
বহির্গমনের পথে আমার নাম লেখা কাগজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন যে ট্যাক্সি চালকটি - ব্রাসিলে তিনিই আমার প্রথম পরিচিত ব্যক্তি । ভোল্তা হিদোন্দায় বহুবার দেখেছি তাঁকে এর পরে - সহৃদয়, হাস্যময়, বন্ধুবত্সল পর্তুগীজ ভাষী - এক কথায় পূর্ণাবয়ব ব্রাসিলিয়ান । এঁর ট্যাক্সিটি অত্যন্ত আরামপ্রদ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আধুনিক ফোকস ওয়াগন - তাঁর চালন ক্ষমতা আয়ারটন সেন্নার সমতুল্য । ভোল্তা হিদোন্দার প্রাণকেন্দ্র ইস্পাত সংস্থা কোম্পাইয়াঁ সিদেরুগিকা ন্যাশিওনালের সৌজন্যে ওই দিন তিনি আমার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন । তাঁর ট্যাক্সির জানলা দিয়ে আমি প্রথম চোখ রাখি এই চিত্ররূপময় দেশে । হিও দি জ্যানিরো ছাড়িয়ে চলেছি, সেই রূপসীর গল্প বলবো পরবর্তী কোনো অনুচ্ছেদে, আপাতত আমার চোখের সামনে হিও-সাম্পাওলো সড়কে প্রতিটি পাহাড়ী বাঁক নতুন নতুন রূপকথা রচনা করে চলে । পাহাড়ের গায়ে ঘন সবুজ জঙ্গল - অত্যধিক মানবীয় আবাসনে ব্রাসিলের উপকূলবর্তী অরণ্য আজ তার প্রাক্তন গরিমার ভগ্নাংশ যদিও - তবু নয়ন ভুলানো এলে, আমি কি হেরিলাম নয়ন মেলে - ব্রাসিলে সেই প্রাথমিক মুগ্ধতার স্মৃতি আজও আমাকে আলোড়িত করে । পথ শেষ হয় না - যাত্রা শেষ হয়, আমরা ভোল্তা হিদোন্দা পৌঁছই । পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠে ট্যাক্সি - অবশেষে বেলা ভিস্তা হোটেল - এ শহরের অধিবাসীদের গর্ব - যা আগামী চার মাস আমার বাসস্থান । অ্যাপার্টমেন্টো সেন্তো এ কোয়ারেন্তা বোঁ মুইতো বোঁ ! অজস্র সৌজন্য প্রদর্শন করে ট্যাক্সি চালক বিদায় নেন । ওবরিগারদো, চাও ! পাঠকের অনুমতি নিয়ে বেলা ভিস্তা হোটেলের গল্পটাই বরং আমি আগেভাগে সেরে ফেলি ।
জায়েমী গোভিয়া একবার আমাকে বলেছিলো ভোল্তা হিদোন্দা মোট তিনটে জিনিসের জন্য বিখ্যাত (১) কোম্পাইয়াঁ সিদেরুগিকা ন্যাশিওনাল - এদেশের জাতীয় ইস্পাত সংস্থা (২) বেলা ভিস্তা হোটেল আর (৩) এই ঈশ্বর পরিত্যক্ত শহর থেকে যে কোনো অজুহাতে হিও দি জ্যানিরোতে পলায়ন সম্ভবপর বলে ! জায়েমী কট্টর ক্যারিওকা - হিও দি জ্যানিরো ছাড়া পৃথিবীর যে কোনো শহরই ওর মতে হয় ঈশ্বরের অপসৃষ্টি - নতুবা পাউলিস্তা চক্রান্তের ফলশ্রুতি । সেই জায়েমী যখন বেলা ভিস্তা হোটেলকে গুরুত্বপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে - তখন এর গল্প শোনানোর জন্য পাঠকের কাছে আমি দায়বদ্ধ । পাঠক, পর্তুগীজ ভাষায় (হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন !) বেলা ভিস্তা মানে সুন্দর দৃশ্য । পাহাড় চূড়ায় ছড়ানো, সাজানো সুবিশাল এক ঔপনিবেশিক ধাঁচের পান্থশালা । বেলা ভিস্তা মনোরম, আরামপ্রদ - বেলা ভিস্তা এ শহরের একমাত্র চার-তারা পর্যটক আবাসন । পাহাড়ের উপরে হোটেল - সামনে আরও কয়েকটা ছোট ছোট পাহাড় - পাহাড়ের গা বেয়ে ঝাঁপ দেয় শহর । পাহাড়ের নিচে সান্তা সেসালিয়া গীর্জা - পাহাড়ের অন্যপাশে অবিশ্রাম ইস্পাত উত্পাদন করে কোম্পাইঁয়া সিদেরুগিকা ন্যাশিওনাল - এর চুল্লীগুলো ভোল্তা হিদোন্দার আকাশে অবিরাম অগ্নিবর্ষণ করে । গম্ভীর আওয়াজে কেঁপে ওঠে শহর - তৃতীয় ঝটিকা চুল্লীটি সগর্বে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করে । বেলা ভিস্তা হোটেলের সমীপে আলিঙ্গনরত প্রেমিক যুগলের কাছে এই শব্দ অর্থহীন, অর্থহীন পাহাড়ের প্রত্যন্তে বর্ণাঢ্য সূর্যাস্ত । গভীর নীল সন্ধ্যায় বেলা ভিস্তা হোটেলের অলিন্দে শিকো বোয়ার্কে হলাণ্ডিয়ার সংগীত বেজে উঠলে আরও একটি দিন পাহাড় চূড়ায় ফুরিয়ে যাবে । সময় হয়েছে পাঠক, আসুন বেলা ভিস্তার অভ্যন্তরটা এইবেলা দেখে নিই ।
সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে বেলা ভিস্তার গাঢ় শোণিম কার্পেট আপনাকে অভ্যর্থনা করবে । সুদৃশ্য কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দ্বিতলে - সিঁড়ির বাঁকে বিগত শতাব্দীর মায়া মুকুরটি পাঠক, আপনার আত্মপ্রতিকৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে । ভোল্তা হিদোন্দার নববিবাহিতরা ছবি তুলতে আসে এই মায়া মুকুরের সামনে । শ্বেত শুভ্র বিবাহবসন, যুবতীটি বেলা ভিস্তার রক্তিম সিঁড়ির ধাপে এক পা এক পা করে নেমে আসে, টাক্সিডো সজ্জিত যুবকটি দ্বিধাগ্রস্ত - প্রতিটি পদক্ষেপে অস্বাচ্ছন্দ্য, কষ্টকৃত অনায়াস ! সিঁড়ির বাঁকে আয়নাটির সামনে থমকে দাঁড়ায় যুবতী, কাঠের রেলিং এ হাত রেখে থমকে দাঁড়ায় : গর্বিত ভঙ্গিমা, সমগ্র বেলা ভিস্তা দ্যাখো এ মুহূর্তে আমারই শাসনে ! ভিডিও ক্যামেরায় এই মুহূর্তগুলি ধরে রাখে কোনো কৌশলী চিত্রশিল্পী, যে তরণীখানি ভাসালে দুজনে আজি এ নবীন সংসারে । একদিন ম্লান হবে এই সন্ধ্যার স্মৃতি, জানিনা আরও বিশবছর বাদে মেয়েটি এই ভিডিও ক্যাসেটটিকে হারিয়ে ফেলবে কিনা । আপাতত বর্তমানই একমাত্র সত্য - সম্রাজ্ঞীর জন্য দুয়ারে অপেক্ষমান অত্যাধুনিক ফিয়াট কিংবা ফোকসোয়াগন ! মেয়েটির গাড়ি অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে আমি এদেশের পর্তুগীজ আনন্দবাজার ও গ্লোবোতে মন দেবো : হিও দি জ্যানিরোর ফাভেলায় ট্যাঙ্ক সমেত ঢুকে পড়েছে পোলিশিয়া মিলিটার, মাদক দ্রব্যের চোরাই চালান রোধে ব্রাসিল সরকার এবার বদ্ধপরিকর - গতকালের মৃতদেহগুলির ছবিতে গ্লোবোর প্রথম পাতাটি সুসজ্জিত । কোন পথে গেল মেয়েটি ? যেখানে গভীর জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের, পাতাদের উত্সরণে কোনো শব্দ নাই; তবু তারা টের পায় কামানের স্থবির গর্জনে বিনষ্ট হতেছে সাংহাই । - বেলা ভিস্তার সন্ধ্যাগুলিতে অজস্রবার এ দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ।
নৈশভোজের সময় উপস্থিত । সংবাদপত্র পাঠ সমাপনে চলো পাঠক খাদ্যের অন্বেষণ করি । বেলা ভিস্তার `হেস্তুরান্তে'টি সুদৃশ্য । দেওয়ালগুলি চিত্রশোভিত । বেলা ভিস্তার অন্যতম বাসিন্দা ল্যুভর দর্শনে অভ্যস্ত মঁসিয়ে ব্রুণ এই চিত্রগুলি সম্পর্কে অবশ্য অত্যন্ত বিরূপ মতামত পোষণ করেন । ব্রাসিলের সর্বহারারা রাস্তা সারাচ্ছে অথবা ঘাস কাটছে - কিছু কিছু ছবিতে এবংবিধ দৃশ্যের অপটু চিত্রায়ণ - যা স্বয়ং জ্যোতি বসুর কাছেও শিল্প পদবাচ্য হবার যোগ্য হবেনা সম্ভবত - কিন্তু বেলা ভিস্তার একটি চিত্র সম্পর্কে আমি ও মঁসিয়ে ব্রুণ ভিন্ন মত পোষণ করি । পাঠক, এই চিত্রটি জটিল ; শয্যায় একটি ভুলুন্ঠিত সুপ্ত রমণীমূর্তি । এই মহিলার নগ্ন অবয়বে কোন সৌন্দর্য নেই, শয়নের ভঙ্গিমায় নেই তিলমাত্র শিল্পের অবকাশ । শয্যার বাইরে অশালীন ভঙ্গিমায় ঝুলে আছে এঁর মস্তক - আর রমণী শরীরের কাছে জগতের সমস্ত প্রত্যাশা মুছে দিয়ে অনামী শিল্পী এঁর মুখমণ্ডল সজ্জিত করেছেন ব্যাঘ্রসদৃশ পিঙ্গল কৃষ্ণ ডোরা কেটে ! সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে । উন্মত্ত কার্নিভাল শেষে বিধ্বস্ত এই নারী পৃথিবীর কারও নয়, নিজেরও নয় সম্ভবত । এঁরই প্রতিবেশী সবুজ উদ্যানের সবুজ নারীটিকেও আমি শিল্প বলে গণ্য করি । আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে কত পাখী গায় । অবশ্য আমার চোখে তো সকলি সবুজ, সকলই শোভন সকলই শ্যামল : এই হরিৎ নারীর সজীব কাননে প্রতিবেশিনী পিঙ্গলার নষ্টশসা কিংবা পচা চাল কুমড়োর খবর পৌঁছবে না কোনও দিনও ।
চিত্রদর্শন সমাপ্ত করে টেবিলে এসে বসি । পাঠক, ব্রাসিল বিখ্যাত ভোল্তা হিদোন্দার জন্য (ইহা রচা কথা, উপন্যাস মাত্র, বঙ্কিমবাবু যেইরূপ জানিতেন !), ভোল্তা হিদোন্দা বিখ্যাত তার বেলা ভিস্তা হোটেলের জন্য, বেলা ভিস্তা হোটেল বিখ্যাত তার `হেস্তুরান্তের' পরিচারকদের জন্য, আর পরিচারকেরা বিখ্যাত (তথা গর্বিত) তাঁদের ইংরিজী জ্ঞানের জন্য । টেবিলে এসে বসতেই মেনুকার্ড হাতে প্রথম জনের আর্বিভাব । সজ্জিত স্যুটে-বুটে, বো টাই, হাবভাব খাঁটি সাহেবের, সহাস্য বদন, প্রশ্ন : ভেরি গুদ্ ? - অর্থাৎ জানতে চান আমি ভালো আছি কিনা । এঁর ইংরিজী বলার পালা আপাতত শেষ । খেতে শুরু করলে দ্বিতীয়জন প্রশ্ন করেন : মাচ্ মোর হাইস্ ? অর্থাৎ আরও ভাত চাই কিনা । খাবার শেষে তৃতীয় জন শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন : কফ্ ? আমি বিষম খাই - পরক্ষণেই বুঝি ইনি জানতে চান যে ভোজন সমাপনান্তে আমি কফিপানে আগ্রহী কিনা । কফি অর্থাৎ কাফেজিনো - গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ, সুমিষ্ট ব্রাসিলীয় কফি - রসিকের কাছে অমৃতবৎ ! আমি ঘাড় নাড়ি । সিনর, আ কন্তা ফর ফাভর । কফিপান সাঙ্গ করে আমি পর্তুগীজ বলার চেষ্টা করি । মৃদু হাস্যে চতুর্থজন আর্বিভূত হন । ইনিই এঁদের সর্দার - পরিধানে মহার্ঘ স্যুট - চাল চলন নায়কোচিত । এঁর জিহ্বায় স্বয়ং ওয়েবস্টার আরোহন করেন - মাত্র একটি ইংরিজী শব্দ ইনি জানেন - এর বেশি প্রয়োজন নেই - শব্দটি হোটেল চালানোর ওঙ্কারমন্ত্র ! মেঘবিনিন্দিত স্বরে প্রশ্ন শুনি : স্যাটিসফায়েড ?! আমি মুগ্ধ হই । ত্রক্রমশ: এঁরা আমার নামটি আয়ত্ত্ব করে ফেলেন - সরাসরি সম্ভাষণ করেন নিরুপং চক্রোবোর্ত বলে । বলবার অপেক্ষা রাখেনা, এঁরা জানেন আমি `কক্কা কলা' পছন্দ করি, `লিমোঁ ও `সিন জেল' কোকাকোলা বলবার আগেই এসে পড়ে আমার টেবিলে এঁদের সাহচর্যে ত্রক্রমশ: আমি আসক্ত হয়ে পড়ি ব্রাসিলীয় রন্ধনে । `মুক্কেকা' সমেত `বাদেজো এ বায়েনা', `হোস্ট বিফে কম লিগ্যুমিস' অথবা `লম্বোর' `সুহাশকো' আমাকে অধিক থেকে অধিকতর `স্যাটিসফায়েড' করতে থাকে । বেলা ভিস্তা হোটেলের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে আছে এই মানুষগুলির আন্তরিকতায় - এঁদের আতিথেয়তার স্মৃতি আমার কাছে পূর্ণমাত্রায় ব্রাসিলীয় । বঁনয়েচ্ । শুভরাত্রি জানিয়ে, পাঠক আপাতত আমরা গাত্রোথ্থান করবো - কাল সকাল সকাল নগর দর্শনে বেরোতে হবে ।
উ : হে শহর, ধূসর শহর !
ভোলফ্গ্যাং রাইক আমাকে একটা সাইকেল ধার দিয়েছিলো - সারা ভোল্তা হেদোন্দা টো টো করে ঘুরে বেড়িয়েছি তাতে চড়ে । এই শহরের সব কটি `হুয়া', পর্তুগীজ ভাষায় রাস্তার প্রতিশব্দ, হাতের তালুর মতো পরিচিত হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে । এই শহরের প্রধান সড়ক শ্রমজীবী সরণিতে প্রতিটি ফোর্ড, ফিয়াট, ফোকসওয়াগন কিংবা মার্সেডিস গাড়ির আয়ারটন সেন্নারা বহুবার ব্রেকে পা রেখেছে তাদের মাঝখানে আমাকে দেখে ! অজস্র গাড়ি অ্যালকোহলে চলে ব্রাসিলে - মাদকতাময় মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে যায় বাতাসে । চড়াই উত্রাই রেল লাইন, ফ্লাইওভার পেরিয়ে যাই - এই শহরের নদীর নাম পারাইবা - নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল ! ধূসর শহরে নদী তার রহস্য হারিয়েছে - এই আশ্চর্য সুন্দর নামটি মনে মনে আউড়ে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছেছি নদীর পাড়ে । সাইকেলের গিয়ার বদলাতে বদলাতে দূর থেকে বহুবার দেখেছি লুল্লুকে এখানে : রাস্তার মোড়ে আইসক্রীম বিক্রী করছে কখনও, কখনও ফুটপাতের আড্ডায় সারভেজার গেলাস হাতে রাজা উজীর মারছে !
ভোল্তা হিদোন্দার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে কোম্পাইয়া সিদেরুগিকা ন্যাশিওনালের সুবিশাল অফিস বাড়িটি - অদূরেই `ব্যাঙ্কো' পোর্তোহিয়াল - একটু গেলেই অত্যাধুনিক সিডার শপিং সেন্টার সারাক্ষণ জমজমাট : দশজন ক্রেতা পিছু একশো জন দর্শকের ভিড়ে । প্রতিটি জিনিষ মহার্ঘ এখানে, প্রতিটি দোকান সুসজ্জিত । সিডার শপিং এর নিম্নতলে এসপ্রেসো কফির দোকানটি এ শহরের অধিবাসীদের কাছে তাজমহলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ! পাঠক, ভোল্তা হিদোন্দাকে চিনতে হলে আপনাকে আসতেই হবে এখানে - আপাদমস্তক মিনেইরো পাওলো আসিস আমাকে প্রথম নিয়ে আসে এখানে, বলে : এটাই এশহরে একমাত্র দোকান যার কফি তার নিজের শহর বেলো হরজন্তের সমতুল্য ! কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে যে দৃশ্য আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে তা নি:সন্দেহে প্রথম বিশ্বের । জনপূর্ণ এসকালেটার অবিশ্রাম উঠছে নামছে - অতিকায় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর মেসবেলা পরিপূর্ণ পণ্যসম্ভারে - যুক্তরাষ্ট্রে জে. সি পেনী কিংবা সিয়ার্স যেমন । আশপাশের ছোট অথচ তেজী দোকানগুলোতে লিভাইসের দ্বিগুন দামে বিকিয়ে যাচ্ছে অলটারনেটিভা কিংবা টাকো জিন্স । লুল্লু খুলেছে এখানে একটা জুতোর দোকান ! হাল ফ্যাশানের নাইকি কিংবা রিবক জুতো পরমানন্দে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছে । আমি পাওলোকে প্রশ্ন করি ব্রাসিল কোন বিশ্বে ? পাওলো হাসে বলে : একই সঙ্গে প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বে ! সর্বনিম্ন মাসিক বেতন ভারতীয় মুদ্রায় তিন হাজার টাকার মতো - আর পাওলোর সবচেয়ে করিত্কর্মা বন্ধুটি প্রতিদিন (হ্যাঁ পাঠক প্রতিদিন !) দেড় লাখ টাকা উপার্জন করে । পাওলো নিজে দু'টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ইস্পাত সংস্থার পরামর্শদাতা । বেলো হরজন্তেতে পাওলোর বাড়িতে টেনিস কোর্ট, সনা, সুইমিং পুল কিংবা তার গাড়ি তিনটি মার্কিন অধ্যাপকদের ঈর্ষান্বিত করবে না অবশ্যই - কিন্তু তার ব্যক্তিগত হাল্কা অ্যারোপ্লেনটি.... ?! পাঠক, এর নাম ব্রাসিল, প্রথম বিশ্ব তাকে তৃতীয় বিশ্বে ঠেলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়, তৃতীয় বিশ্ব তাকে সহোদর বলে গণ্য করতে পারে না । প্রায় রূপকথার মতো, বাত্সরিক দুহাজার শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি দেখেছে এই দেশ, কি এসে গেছে : জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি যাবে ! ১৯৯৪ সালে আমার প্রথম ব্রাসিল ভ্রমণকালে সেই মুদ্রাস্ফীতি কমে এসে মাসিক দু শতাংশতে দাঁড়িয়েছে । নতুন ব্রাসিলীয় মুদ্রা হিয়ল অসম্ভব মহার্ঘ, মার্কিন ডলারের প্রায় ১৮ শতাংশ ঊর্ধ্বে ! ভোল্তা হিদোন্দায় আমার বসবাস কালে প্রায় প্রত্যহ মার্কিন ডলার গড়িয়ে গড়িয়ে নেমেছে । এই নতুন হিয়লের কল্যাণে সাম্পাওলোর মিলিট্যান্ট নেতা লুলাকে ভোটযুদ্ধে ধোবীয়া পটকানে ধরাশায়ী করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছে ফারনান্দো হিকি ! ব্রাসিলে কি আবার স্বর্ণযুগ ফিরে এলো ? কেউ জানে না, একমাত্র বর্তমানই এদেশে সবচেয়ে বড় সত্য ! যে কোনো মুহূর্তে পাল্টে যেতে পারে ক্যালাইডোস্কোপ - আগামী বছর যদি দু'হাজার শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি আবার ফিরে আসে এদেশে অন্তত: কেউই আশ্চর্য হবে না ।
কফি পানান্তে বাইরে আসি । রাস্তায় জনস্রোত : শ্বেতকায়, কৃষ্ণকায়, মিশ্রকায় । ইস্পাত সংস্থার প্রতিটি কর্মচারীর পরনে ছাইরঙা ইউনিফর্ম - `বিলকুল আনপড়' দারোয়নটি থেকে এদের গবেষণাকেন্দ্রের নিয়ন্তা এম আইটি শিক্ষিত হিকার্দো লিয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকেই একই পোষাকে । কিছু কি শেখার আছে এর থেকে - হয়তো অনেক কিছুই । এই লিয়ালের প্রবল উত্সাহে সম্প্রতি কোম্পাইঁয়া সিদেরুগিকা ন্যাশিওনাল মোট দশকোটি টাকার অনুদান দিয়েছে ভোল্তা হিদোন্দা শহরের ফ্লুমিনান্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাতুবিদ্যা বিভাগকে ! লিয়ালের ডক্টরেট থিসিসের পরামর্শদাতা বিশ্বখ্যাত মরিস কোহেন আশা করি তাঁর এই প্রাক্তন ছাত্রের মধ্যে গর্ব করার মতো অনেক কিছু খুঁজে পাবেন । লিয়ালের সঙ্গে দেখা হয় রাস্তায়, লিয়াল হাত নাড়ে, একটু এগিয়েই দেখি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে লুল্লু । খালি গা, পরনে হাফ প্যান্ট - নাম পাল্টে রেখেছে পেদেরো - রাস্তার মস্তান, এই মুহূর্তে এদিককার ফুটপাত পেদেরোর নিয়ন্ত্রণে ! একটা গাড়ি থামতে আসে রাস্তার ধারে, প্রবল উত্সাহে পেদেরোরূপী লুল্লু সিটি দেয়, হাত পা নাড়ে (বহুদিন পরে লুল্লুকে সত্যি সত্যি ভূতের মতো দেখতে লাগে আজকে) । তিড়িং করে লাফ দিয়ে গাড়িটির উইণ্ড শিল্ড ওয়াইপারটিকে খাড়া করে দেয় । এটা সংকেত একটা - ব্রাসিলে থাকতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে । এর অর্থ এ গাড়িটি আপাতত পেদেরোর প্রহরাধীনে । মালিক তোর মঙ্গলে ঊষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা । পেদেরোবেশী লুল্লু তোর গাড়ি পাহারা দেবে - অন্য কেউ ছুঁতে এলে ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে প্রয়োজন বোধে ! বিনিময়ে অবশ্য যত্কিঞ্চিৎ প্রণামী প্রত্যাশা করে পেদেরো - মালিক দিতে রাজী হও বাছা, নতুবা লুল্লু ভূতে তোমার জানলার সবকটা কাচ ভেঙে দিলে সেজন্য কি পেদেরোকে দায়ী করবে ? আমি পাশ দিয়ে হেঁটে যাই - লুল্লু পরিচয়ের চিহ্নমাত্র দেখায় না - শহরের রাস্তায় গ্রীংগো দেখলেই কথা বলতে হবে এ জাতীয় অর্বাচীনতায় আর যেই হোক পেদেরো বিশ্বাস করেনা ! একটু এগোতেই মনে হয় কিছু একটা বলছে লুল্লু । উচ্চারিত শব্দ নয় - যেভাবে ভূতেরা কথা বলে আর কি, টেলিপ্যাথি জাতীয় কিছু একটা : "যা ঘুরে আয় পারাচী থেকে আমি থাকতে কেউ তোকে মোকাম্বো মারবে না !" কি করে যেন জেনে ফেলেছে সপ্তাহের শেষে আমি পারাচী বেড়াতে যাবো । আমি হাঁটতে থাকি লুল্লুর কথায় কর্ণপাত না করে । ইস্পাত কারখানার চুল্লীগুলোর সাদা ধোঁয়া মেঘের মতো ভেসে যায় ধূসর শহরের আকাশ বেয়ে ।
শহরময় ঘনিয়ে নামছে গভীর বিকেল । পাশের মাঠটায় ব্রাসিলের শিশুরা তাদের বাড়ির কুকুর সমেত `ফুচ্বল' খেলছে ! ওদিকে লীগের খেলা চলছে হিও দি জ্যানিরোতে । সারভেজা কিংবা গুয়ারানা খেতে খেতে রাস্তার দোকানে বসে অজস্র লোক খেলা দেখছে দোকানের টেলিভিশনের পর্দায় । চমত্কার একটা গোল করলো ফ্লুমিন্যান্সে এইমাত্র । ব্রাসিলের ধারাভাষ্যকার প্রায় একটানা দেড় মিনিট আর্তনাদ করেন গো ও ও ও ও ও ও ও ও ল, বলে । উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা । কুকুরটা চমকে গিয়ে খেলা বন্ধ করে । সন্ধ্যা হয়ে আসে ।
ঊ : পারাচী : তুমি অনন্ত নব বসন্ত অন্তরে আমার
জুনিয়া ও ভোলফগ্যাং আমাকে পারাচী নিয়ে যায় । জুনিয়া ব্রাসিলের মেয়ে - ভোলফ্গ্যাং জার্মান । মাতৃভাষার মতো পর্তুগীজ শিখেছে ভোলফগ্যাং - ব্রাসিলকে ভালোবাসে পিতৃভূমির মতো । জার্মান সমাজের সুদৃঢ় নিয়মকানুন, প্রায় ক্লক-ওয়ার্ক সদৃশ জীবনযাত্রায় ভোলফ্গ্যাং হাঁফিয়ে ওঠে, কষ্ট পায় স্বাধীনতার অভাবে - ব্রাসিলে ওর নিজেকে মুক্ত মনে হয় । দু'বছর সাম্পাওলোতে কাটিয়ে দেশে ফিরে গিয়েছিলো ভোলফ্গ্যাং, ডয়েশল্যাণ্ডের পশ্চিম ভাগে বোকুম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর ডক্টরেট থিসিস শেষ করছিলো । জন্মভূমে পরবাসী ভোলফ্গ্যাং, জার্মানী ওর ভালো লাগেনি - ফলত: আবার সে এসেছে ফিরিয়া ! ভোলফ্গ্যাং আপাতত ভোল্তা হিদোন্দাবাসী । জুনিয়া ওর বান্ধবী - প্রায় জন্ম থেকে ভোল্তা হিদোন্দায়, এই ছোট্ট শহরের কূপমাণ্ডুক্য ওর দৃষ্টির প্রসারতার অন্তরায় হয়নি সৌভাগ্যক্রমে ; ওর সহজ, আন্তরিক ব্যবহারে ব্রাসিলীয় রৌদ্রের উষ্ণতা খেলা করে ।
ভোল্তা হিদোন্দা থেকে সাম্পাওলো যাওয়ার পথে কিছু দূর গিয়ে বাঁক নেয় পারাচী যাবার রাস্তা । মাইল মাইল পথ গিয়ে ব্রাসিলের শ্বেত হস্তী পারমাণবিক বিদ্যুত্কেন্দ্রটি পেরোই আমরা, তারপর টানেল একটা, তারপরে আরও মাইল মাইল পথ । তারপর সমুদ্র পাহাড় ও নিবিড় অরণ্য একসাথে এসে মেশে । পারাচী শহর । নতজানু হই সুন্দরের কাছে । সমুদ্র দেখেছি অনেক, দেশে ও বিদেশে - পারাচীর মতো সমুদ্র দেখিনি কখনও । "ঈশ্বর, পৃথিবীতে স্বর্গ যদি থেকে থাকে কোথাও, এখান থেকে কখনই তা খুব বেশী দূরে নয়" - ব্রাসিলের সৈকতভূমি সম্পর্কে আমেরিগো ভেসপুচির এই উক্তিটি পারাচী সম্পর্কে আমি অকাতরে প্রয়োগ করতে চাই । কেবলমাত্র অনিন্দ্যকান্তি সমুদ্র বন্দর নহে পারাচী এক অতীব প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নগরী; বস্তুত: ব্রাসিলীয় স্বর্ণযুগের ইতিবৃত্তে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হয় পারাচীকে ঘিরিয়া । সমীপবর্তী মিনাস জেরাইসে স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হইলে - পারাচী স্বর্ণনিয়ন্ত্রিত বন্দর নগরী হিসাবে গড়িয়া উঠে । একদা ফরাসী নৌনাবিকেরা - হিওদি জ্যানিরো অবরোধ করেন - মুক্তিপণ হিসাবে পর্তুগীজদিগের নিকট হইতে দাবী করেন প্রায় দুই পোত স্বর্ণ মুদ্রা - বিকল্পে সমগ্র হিও দি জ্যানিরোকে ভূমিশায়ী করিবার ভয়ঙ্কর অঙ্গীকার রাখেন ! পরাভূত পর্তুগীজ বাধ্য হয় ওই স্বর্ণমুদ্রা গণিয়া দিতে - হিও দি জ্যানিরোর মুক্তিপণ প্রেরিত হয় এই পারাচী বন্দর হইতে । পারাচী শহরের বিগত স্বর্ণযুগের প্রাচীন অট্টালিকাগুলিতে, ইহার মনোরম গীর্জাগুলির সুমধুর ঘন্টাধ্বনিতে আজও সেই আশ্চর্য উপাখ্যান অনুরণিত হয় । পারাচীতে আধুনিক সড়ক নাই - পারাচীর রাস্তাগুলি লৌহখচিত । সমুদ্রে জোয়ার আসিলে আজও প্রায় সমগ্র শহর প্লাবিত হয় - পারাচী নগরী আপনার বিগত গৌরবের প্রতিবিম্ব দেখে, পারাচীর বিপণীগুলি আজও সেই রূপকথার গল্প বলিয়া যায় । ঝরোখায় অপেক্ষারতা রাজকন্যা : চম্পাকলী ইসাবেলা, নাকি নেহাতই বনবাসিনী কপালকুণ্ডলা, প্রশ্ন করে : ট্যুরিস্ট, তুমি কি পথ হারাইয়াছো ?
পথ হারাইনা ; জুনিয়া, আমি ও ভোলফ্গ্যাং পৌঁছে যাই পৌসাদা-র দরজায় । দরজার ওপর পর্তুগীজ বাক্যটি বঙ্গানুবাদে দাঁড়ায় : বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যাবো দ্বীপ থেকে দ্বীপে ! কড়া নাড়ি । স্মিত হাস্যে ভিতরে আমন্ত্রণ জানায় এক জার্মান যুবক ও তার ব্রাসিলীয় স্ত্রী । তারা এই পৌসাদাটি পরিচালনা করে । বেশ কিছু বছর আগে একমাসের জন্য পারাচী বেড়াতে আসে ওই যুবক, ওই একমাসের ভ্রমণ ওর সমস্ত জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় । পারাচী সম্পর্কে ওর মুগ্ধতা, সম্ভবত ভেসপুচি কিংবা নিরুপম চক্রবর্তীকে অতিক্রম করে ! ভোলফ্গ্যাং রাইক একা নয় এই পৃথিবীতে - একবছর বাদে সে- ফিরে আসে আবার, সঙ্গে আনে বিগত বছরের শ্রমলব্ধ ডয়েশ মার্ক । - ফিরে আসে পারাচী নগরে বাতাসের সঙ্গে দ্বীপ থেকে দ্বীপে ভেসে জীবন কাটাবে বলে !
ভরদুপুরে স্কুনার ছাড়ে পারাচীর জাহাজঘাটায় । বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ভেসে যাবো দ্বীপ থেকে দ্বীপে ! রৌদ্রকরোজ্জ্বল সমুদ্রে গভীর নীলিমা । তটরেখা মুছে গিয়ে পারাচী উপসাগরের অচেনা দ্বীপগুলির স্বর্ণাভ বালুকাবেলা ত্রক্রমশ: স্পষ্ট হতে থাকে । কোনো অজানা কারণে পারাচীর ধারে কাছে একবারও লুল্লুকে খুঁজে পাইনি !
ঋ : করকোভাদোর যীশু
দু'হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছেন যীশু, কলকাতায় নয় করকোভাদো পর্বতশীর্ষে ! যীশুর পায়ের নীচে লুটিয়ে আছে যে মহানগরী তার কাছে সানফ্রান্সিস্কো কিংবা সিয়াটেলের সৌন্দর্য ম্লান । দ্বিতীয় পাসপোর্টের অতিরিক্ত পৃষ্ঠাগুলি ভিসার ছাপে ছাপে ভরে উঠবার পরেও, হিও দি জ্যানিরোকে আমি আমার দেখা সমস্ত নগরীর সম্রাজ্ঞী বলে মানি । হিও দি জ্যানিরো আশ্চর্য প্রাণবন্ত মেট্রোপলিস - সমুদ্র, পাহাড় ও কংক্রীটের এক আশ্চর্য মহাকাব্য । কোপাকাবানা, পানেমা বা লেবলন হিও দি জ্যানিরোর প্রায় অলৌকিক তটভূমিগুলির নাম । শহরের মধ্যভাগে সেই বিশ্বখ্যাত চিনির পাহাড় । উত্তর প্রান্তে সুবিশাল মারাকানা ফুটবল স্টেডিয়াম । শহরের উত্তর ও দক্ষিণের বিভাজন একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক । শহরের দক্ষিণ প্রান্তে (জোনাসুল) এ একই সঙ্গে প্রাকৃতিক প্রাচুর্য তথা বিত্তের বৈভব । উত্তরাঞ্চলে (জোনাপার্ট) নিম্নবিত্তেরা ভিড় করে আছে । শহরের এই দুই অঞ্চলের প্রাকৃতিক বিভাজন ঘটিয়েছে পর্বতশ্রেণী । পর্বতগাত্রে প্রায় আক্ষরিক অর্থে ঝুলে আছে ফাভেলাগুলি - ব্রাসিলের দরিদ্রতমদের শেষ আশ্রয়ভূমি । লুল্লুর পরিচালনায় মাদক ব্যবসায়ীরা আজ ফাভেলাগুলিকে প্রবল প্রতাপে নিয়ন্ত্রণ করে । সাধারণ পুলিশের প্রবেশের প্রশ্ন ওঠেনা, পুলিশিয়া মিলিটার মাঝেমধ্যে হেলিকপ্টার - এমন কি ট্যাঙ্ক সমেত ফাভেলাগুলি অধিকারের চেষ্টা করতে থাকে । দুর্ভাগ্যবশত: এই ফাভেলাগুলির শতকরা নব্বইভাগ বাসিন্দা অতিশয় নিরপরাধ দরিদ্র শ্রমজীবী - এই অহি-নকুলের সংগ্রামে প্রাণান্তকর ভাবে বিপর্যস্ত । জানিনা পর্বতচূড়ার যীশু এই আক্রান্ত সন্তানবৃন্দের কাছে কোন আশ্বাসবাণী বিতরণ করেন । বিষণ্ণ যীশু দাঁড়িয়ে থাকেন একা, দৈনিক সংবাদপত্র জার্নাল দো ব্রাসিলের কার্টুনে, কাঁধে এ কে-৪৭ রাইফেল নিয়ে !
হিও দি জ্যানিরো পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যায় । কোপাকাবানায় আমাকে ও গুন্টুর গটস্টাইনকে পৌঁছে দিয়ে গুস্তাভো ফেরান বিদায় নেয় । অন্ধকারে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে । সাগরপারের গগনচুম্বী অট্টালিকাগুলি আলোকোজ্জ্বল । অজস্র লোক তখনও সমুদ্রতীরে - আলো জ্বেলে প্রবল বিক্রমে ফুটবল, ভলিবল খেলা চলছে । প্রতিটি সন্ধ্যাই আনন্দসন্ধ্যা এখানে, প্রতিটি দিনই উত্সব মুখর । অথচ স্বয়ং ঈশ্বর বিচলিত হন কোপাকাবানায়, লাস্যময়ী গণিকার ভিড়ে, পিস্তলধারী দুর্বৃত্তের আচম্বিত আক্রমণে - যাদের একাংশ নিতান্তই শিশু, পিতৃমাতৃপরিত্যক্ত `অ্যাবানদনাদো' : ব্রাসিলের ভ্রমণসঙ্গীগুলি এই স্বর্গপ্রতিম বালুকাবেলাকে অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে ঘোষণা করেছে । বেলা হয়, গেল ভয় বনময় । সকাল হলে কোপাকাবানায় তাকিয়ে দেখি চর্তুদিকে নয়ন ভুলানো এলে, আমি কি হেরিলাম নয়ন মেলে । বিপজ্জনক বস্তুর প্রচলিত সংজ্ঞার সঙ্গে রূপসী কোপাকাবানাকে কোনোক্রমেই মেলাতে পারিনা । গাঢ় নীল সমুদ্রের ঢেউতে সাদা ফেনা - গ্রানাইট পাথরের ঘন কৃষ্ণ পাহাড় সমুদ্রের কোলে দাঁড়িয়ে আছে - সমুদ্রের তীরে আবালবৃদ্ধবনিতা । স্নানার্থী । রৌদ্র সেবনার্থী । ঢেউয়ের শীর্ষে ভেসে আসে সার্ফ বোর্ড, আরোহিনীর পরিধানে বুমবুম বিকিনী ঝলসে ওঠে ! বালির উপরে সাম্বা নাচছে একটি দল । একটি কিশোর সংগীত পরিবেশন করে । সমুদ্রের ধারের ছোট ছোট দোকানগুলোতে বিক্রি হয় কচি ডাব, পাথরের যীশু, সাঁতারের পোষাক কিংবা রংচঙে তোয়ালে । আরও একটা দিন কোপাকাবানায় হাওয়ায় উড়ে যায় ।
চিনির পাহাড়ের ঠিক নীচে সমুদ্র । সমুদ্রে ভাসে রঙবেরঙের কায়াক । বেলাভূমিতে স্নানার্থীর ভিড় - তখন শীতের শেষ, সমুদ্র হিমশীতল । আমি ও গটস্টাইন জলে নামি । পশ্চিম জার্মানীর আহেন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ডিরেক্টারটি এই মুহূর্তে শিশুর মতো উচ্ছ্বল ! অনতিবিলম্বে প্রায় দয়াহীন ল্যাটিন সমুদ্র আমাদের আর্যরক্ত হিম করে দিলে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসি । গুস্তাভো ফোরান প্রস্তাব দেয় : কি হবে স্কাই ট্র্যামে করে গিয়ে, চলো চিনির পাহাড়ে হেঁটে উঠি ! চিনির পাহাড়ের টিকিট রাখি সঙ্গে । দুভাগে চলে এই স্কাইট্র্যাম - আধখানা হেঁটে উঠেও দ্বিতীয়ভাগে প্রবেশ করা যায় । ইচ্ছা না থকলে উঠতে পারা যায় সমুদ্রতীর থেকেও । পাহাড়ের নীচে ঘন সবুজ জঙ্গল - ফোরান জানে এর মধ্যে কোনখানে লুকিয়ে রয়েছে হেঁটে ওঠার সুঁড়ি পথ । আমরা উঠতে থাকি । যথেষ্ট শ্রমসাধ্য আরোহণ - কেননা এ হাঁটাপথ প্রায় আক্ষরিক অর্থে উল্লম্ব । পথের শেষে হৃত্পিণ্ড দেওয়াল ঘড়ির মতো বাজতে থাকে - ক্লান্ত সর্বাঙ্গ তবু কি আশ্চর্য আনন্দে ভরা । আধখানা উঠে দেখি স্কাইট্রাম অনেক আগেভাগে এসে দাঁড়িয়ে আছে । আমরা টিকিট দেখাই - টিকিট পরীক্ষক তাঁর সংগীতে বোঝান : বোকাগুলো জানেনা যে সমুদ্রের ধার থেকেও ট্রামে ওঠা যায় ! হিও দি জ্যানিরোর এই অনবদ্য স্কাইট্রামটি বন্ধু ও সহকর্মী পাওলো হাঁজেলের প্রপিতামহের সৃষ্টি । তাঁর আবক্ষমূর্তি আজও দাঁড়িয়ে আছে চিনির পাহাড়ের শীর্ষে । আপাতত সারা বিশ্বের ট্যুরিস্টে ভরপুর স্কাইট্রাম ত্রক্রমশ: ওপরে ওঠে । চিনির পাহাড়ের চূড়ায় ঈশ্বরের বাস - এখানে তিনি কিবোঁ আইসক্রীমের দোকান খুলেছেন । আমরাও আইসক্রীম কিনি - পৃথিবী শান্ত । সূর্য অস্ত যায় পাহাড়ে পাহাড়ে । বলো এদেশ ছেড়ে যাওয়া যায় কখনও ? গুস্তাভো ফেরান পাশে এসে দাঁড়ায় । প্রশ্ন করে : কেমন দেখছো ? ফেরানের জন্মভূমি স্পেন, বহুকাল হলো ব্রাসিলের নাগরিক । আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে : ইট্স এ প্যারাদাইস্ ! দিবাশেষের রক্তাভ আকাশ । সমুদ্রের ঢেউয়ে অন্ধকার নেমে এলো সুন্দর, তোমার কাছে নতজানু হবো বলে ।
৯ : ওরোপ্রেতো : নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক
আমি ও পাওলো আসিস ওরোপ্রেতো পৌঁছই ১৭০৭ সালের ২২শে নভেম্বর । পুরোপুরি তিনদিন তিনরাত কাটিয়ে ওরোপ্রেতো ছাড়ি ১৭০৭ সালের ২২শে নভেম্বর ! সময় স্তব্ধ হয়ে আছে ওরোপ্রেতোতে - বস্তুত: অনন্তকাল ধরে আরও অনন্তকালের জন্য । ওরোপ্রেতো ব্রাসিলের স্বর্ণযুগের শহর । এলডোরাডো দেখবোনা কখনও; দু:খ নেই, আমি ওরোপ্রেতো দেখেছি । পেছনে তাকিয়ে, ওরোপ্রেতো শহরে আমার সেই সময়াতীত বাহাত্তর ঘন্টার অবস্থান বার্গম্যানের ছবির স্বপ্নদৃশ্যের মতো প্রায় অলৌকিক মনে হয় ।
ওরোপ্রেতো মানে কালোসোনা । প্রায় চারশো বছর আগে সোনা পাওয়া যায় ব্রাসিলের মিনাস জেরাইস প্রদেশের এই অংশে । ব্রাসিলের সোনা জাহাজ ভরিয়ে পূর্ণ করেছে পর্তুগালের রাজকোষ, ব্রাসিলের সোনা তৈরি করেছে ওরোপ্রেতো শহর - সোনায় ভরিয়েছে এর আশ্চর্য গীর্জাগুলি । সোনার খনির কৃষ্ণ ত্রক্রীতদাসেরা দলে দলে মরেছে এরই আশেপাশে । উন্মত্ত স্বর্ণযুগ এসেছে ও গেছে ব্রাসিলে, যুক্তরাষ্ট্রে, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে । তবুও এই তিন মহাদেশে অন্য কোনো ওরোপ্রেতো এই শহরের মতো এভাবে বেঁচে আছে বলে শুনিনি কখনও । অত্যন্ত সঙ্গত কারণে ইউনেস্কো এ শহরকে বিশ্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক বলে ঘোষণা করেছে ।
পাহাড়ের গা বেয়ে ঘন সবুজ ব্রাসিলিয় জঙ্গল ; পাহাড়ের গা বেয়ে ছবির মতো নয়, ছবির থেকে সুন্দর শহর ওরোপ্রেতো । মাঝেমধ্যে বৃষ্টি পড়ে, ঘন মেঘ ভেসে বেড়ায় শহরে পথেঘাটে । পথ, ঘাট ? ওরোপ্রেতোর রাস্তাগুলো কালো পাথরের - বিংশ শতাব্দীর ধাতব সড়কের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও । গীর্জাগুলি যদি ঈশ্বরের আবাসস্থল হয় তবে এখানে তিনি স্থলে এবং অন্তরীক্ষে ! ওরোপ্রেতো শহরে সমতল রাস্তার অস্তিত্ব নেই কোথাও । শহরের নীচের স্তর থেকে ওপরের গীর্জাগুলিকে আকাশের অংশ বলে মনে হয় - ওপরের স্তর থেকে নীচের গীর্জাগুলিকে মনে হয় অনধিগম্য । ঈশ্বর সম্ভবত: চলাচল করেন সরলরেখায় - এ শহরের রাস্তাগুলো তাই সটান নীচ থেকে ওপরে ওঠে । অথচ পায়ে হেঁটে না বেড়ালে ওরোপ্রেতোকে বোঝা যায়না - পায়ে হেঁটে বেড়ালে পর্বতারোহণের ক্লান্তি আসে ।
এই শহরের প্রতিটি আনাচে কানাচে আমি পায়ে হেঁটে বেড়িয়েছি । ওরোপ্রেতো মৃতনগরী নয়, অজস্র মানুষের বসবাস এখনও । এ শহরে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছে ছাত্রদের বাসস্থান শ'খানেক `হিপুব্লিকা' । এ শহরের স্থাপত্যে ঊনবিংশ কিংবা বিংশ শতাব্দীর প্রবেশ ঘটেনি - ওরোপ্রেতো তাই এত বেশি আশ্চর্য করে । ওরোপ্রেতো প্রাচীন হয়নি আজও, মলিন হয়নি একটুও । অসীম মমতায় একদা এর গীর্জাগুলিকে শিল্পসম্ভারে ভরিয়ে তুলেছিলো পঙ্গু অ্যালিজাদিন - ব্রাসিলের মিকেলেঞ্জেলো । দুরারোগ্য ব্যাধিতে দুটি হাতের কর্মক্ষমতা লুপ্ত, এক হাতে ছেনি ও অন্যহাতে হাতুড়ি বেঁধে পৃথিবীর সমৃদ্ধতম বারোক শিল্পের যে নিদর্শন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে অ্যালিজাদিন এ শহরের পথে প্রান্তে - এ শহরের স্বর্ণসম্পদের থেকে তা আমাকে আরও অনেক বেশি মুগ্ধ করে ।
ব্রাসিলের তৃতীয় বৃহত্তম শহর বেলো হরজন্তের থেকে মাত্র ঘন্টা দেড়েকের ভ্রমণ দূরত্বে ওরোপ্রেতোতে এসে দৃশ্যপট পাল্টে যায় তাই হঠাৎ করে । অজস্র ছাত্র, অজস্র ভ্রমণকারী, ঝুটো পাথরের ফেরিওয়ালা, খাঁটিপাথরের ব্যবসায়ী, অজস্র নাইকি জুতোর ব্যস্ত চলাফেরা, অজস্র নাইকন ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক । অজস্র জাদুঘর, অজস্র অ্যালিজাদিন - মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত ওরোপ্রেতো ছড়িয়ে থাকে অবাক বিস্ময় হয়ে । আমি জানি রাত আর একটু গভীর হলে মন্ত্রবলে মুছে যাবে এর সব কিছু । অ্যালকুলে চলা গাড়ির বদলে ঘোড়ার খুরের শব্দ পাবো । মস্ত বড় বিচার সভা বসবে ঠিক প্রাসা দি তিরাদেন্তের সামনে - বিচারকের আসনে বসে লুল্লু পলাতক ত্রক্রীতদাসের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবে । ১৭০৭ সালের ২২শে নভেম্বর রাত কাটবে, রবিবারের সকালে যখন গীর্জার ঘন্টার অনুরণন বাজবে সমস্ত শহর জুড়ে - লুল্লুর আদেশে আমাকে ও পাওলোকে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে যেতে হবে ।
এ : যাবার বেলায় বঁধূ আমায় কাঁদিয়ে কেঁদেছে
ফুরিয়ে যায় সোনার দিন - শেষ হয়ে আসে আমার ব্রাসিল বাসের পালা । কদিন আগে টম জোবিমের মৃত্যু হয়েছে - শেষযাত্রায় জনসমুদ্র, শোকমগ্ন শিকোবোয়ার্কে ও গিলবার্তো গিল অশ্রু বিসর্জন করে । ও টম দো হিও দো মুণ্ডো - টম তুমি, হিওর, তুমি বিশ্বের - ওগো পানেমার মেয়ে তোমার স্রষ্টার মৃত্যুতে এদেশ মুহ্যমান । - পানেমার প্রধান সড়কটির নাম বদলে রাখা হলো হুয়া টম জোবিম । বিগত কয়েকদিন সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনে অন্যকোনো খবর গৌণমাত্র । যে শ্রদ্ধার আসনে এক শিল্পীকে বসিয়েছে এই দেশ - এই বিদেশীর স্মৃতিতে তা উজ্জ্বল হয়ে রইলো ।
তাহার পর একদিন বেলা ভিস্তা হোটেলে আমার বসবাসের সমাপ্তি ঘটিল । `মুইতো বাগাজ' সমেত বিদায় লইলাম সুহৃদবৃন্দের নিকট । মাত্র কয়েক মাস আগেও ভোল্তা হিদোন্দার নাম শুনি নাই, এদেশে কদাপি আসিতে হইতে স্বপ্নেও ভাবি নাই । নিতান্তই পাকেচক্রে আসা - তথাপি বিদায়ক্ষণে অনুভব করি নিতান্তই অল্পসময়ে এদেশে আমায় বাঁধনে বেঁধেছে ! আবার আসিব কোনোদিন । যাহা দেখি নাই দেখিতে হইবে । যাহা দেখিয়াছি তাহা পুনশ্চ দেখিতে চাই । বিদায় মুহূর্তে হাত নাড়া, চিন্তাস্রোত এইরূপ আমার । ত্রক্রমশ: মিলাইয়া যায় ভোল্তা হিদোন্দা - হিও দি জ্যানিরোর নবনির্মিত হাইওয়েটি অত:পর আমাকে গালেঁও বিমানবন্দরে পৌঁছাইয়া দিবে ।
ঐ : উপসংহার : সাইকেল সাইকেল করে ছুটে আসে ক্ষেতফাটা হাওয়া
ব্রাসিল গিয়েছিলাম শুনে দমদম বিমানবন্দরের কাস্টমস কর্মীটি হঠাতি খুব অবাক হয়ে গেলেন - খুবই সন্দিগ্ধ ভাবে তাকালেন আমার স্যুটকেশের দিকে - সম্ভবত: ওটা ওরোপ্রেতোর সোনায় ভরা ভেবে ! বেরিয়ে এলাম । বেরিয়েই দেখি লুল্লু । চেহারা অনেক বদলেছে, তবু ভোলবার উপায় নেই - আপাতত কলকাতায় ট্যাক্সি চালাচ্ছে ! আমাকে দেখেই দাঁত বার করে হেসে বললো : আমাদের ঘর নাই, আছে তাঁবু অন্তরে বাহিরে ! মুখে বলি : চুপ কর শালা ! অথচ মনে মনে আশ্বস্ত হই কলকাতার ভূত এখনও কবিতা ভোলেনি দেখে । লুল্লু গাড়িতে স্টার্ট দিলো । শহর জুড়ে মন কেমন করা দুপুর । সেই পুরোনো ভি আই পি রোডে লুল্লুর ঝরঝরে ট্যাক্সি । চারপাশে শহর ঝলকে যায় দিবা দ্বিপ্রহরে ।
ও : কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অসীম মমতায় যাঁহারা আমার ভোল্তা হিদোন্দার বাসকাল আনন্দে পরিপূর্ণ রাখিয়াছিলেন তাঁহাদের কাহারও কাহারও কথা এই নিবন্ধে বলিয়াছি । যাঁহাদের কথা বলিয়াছি ও যাঁহাদের কথা বলি নাই তাঁহাদের সকলের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা । সিনর আলেকজান্দ্রে দা সিলভা ও সিনর পাওলো আসিসের নিকট আমি নানাভাবে ঋণী । এই রচনা কোলাজধর্মী । ইহার মর্মে মর্মে অজস্র বাংলা কবিতার পঙ্ক্তি উদ্ধৃত হইয়া আছে । এইসব কালজয়ী প্রতিভার উত্তরাধিকার বিনম্র চিত্তে আমি বহন করিতে চাহি, যদিও সর্বত্র তাঁহাদের নামোল্লেখ সম্ভবপর হইলো না । বাবু শ্রী নলিনীকান্ত চক্রবর্তী চাহিয়াছিলেন এই কাহিনী লিখিত হউক । কৃতজ্ঞ চিত্তে তাহা স্মরণ করিতেছি । পরিশেষে কৃতজ্ঞতা শঙ্খমালা ও ছন্দার প্রতি - এই আখ্যানের মর্ম তাহারা বুঝিবে ।
রচনাকাল ১৯৯৬
(পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)