![]() |
বইটির নাম `বরিশাল অ্যাণ্ড বিয়ণ্ড এসেজ্ অন্ বাংলা লিটারেচার'
আগে আমরা মানুষটিকে একটু চিনে নেবার চেষ্টা করি । সেই চেষ্টার পথ সহজ করে দিয়েছেন তিনি নিজেই । প্রবন্ধ-সংকলনটির বিধিবদ্ধ লিখনগুলি বিন্যস্ত করবার আগে সূচিভুক্ত করেছেন একটি প্রবেশক -রচনা, যার নাম `প্রোলোগ - আত্মপরিচয়' । ঠিক এভাবেই লিখনটি লিপিকৃত
'Atmaparicay' | বাংলা শব্দকে এভাবেই মাঝে মাঝে নিজের ইংরেজি-বাক্রীতিতে মিলিয়ে নিয়েছেন তিনি । একটি আলোচনার রূপাবয়ব যদি এমন হয় যে, তার মূল ভাষাটি ইংরেজি (অথবা অন্য কোনো ইউরোপীয় ভাষা), কিন্তু তার বিষয়বস্তু বাংলা সাহিত্য - তাহলে ভাষ্য-কথনে দুই ভাষার শব্দ-সম্ভার মিলে-মিশে যাবে - এই পরিস্থিতি নিতান্তই স্বাভাবিক । বস্তুত, ভাষা-বিশ্বের জলমাটির বৈশিষ্ট্যটাই এমন যে, সেখানে অবিমিশ্র ভাষা বলে কিছু নেই । কোনোদিনই ছিল না । তাই তিনি অনায়াসেই একটি প্রবন্ধের নামকরণ করতে পারেন `সিরিয়স সাহিত্য' (Serious Sahitya) । নিজের বিদ্যাচর্চার ব্যাপ্তি ও বিচিত্র পথ-পরিক্রমার সূত্রেই এই আত্মবিশ্বাস তিনি অর্জন করেছেন ।ক্লিনটন সীলি-র আত্মপরিচয় থেকে জানতে পারি, স্নাতক স্তরের অধ্যয়নকালে জীববিদ্যা বা বায়োলজি ছিল তাঁর একটি বিষয় । তিনি তখনই দেশের বাইরে অন্য কোথাও চলে যেতে চাইছিলেন বিদ্যাচর্চার সূত্রে । যা তিনি চাইছিলেন না তা-ও স্পষ্ট ছিল তাঁর কাছে -
"মচ্ং ফ্ঠংঞত্রছস্ ঘছশ গছয ঠত্র ংঈণ্ণত্ৎ যগঠত্রভ ছঞ ঞচ্ং ঞঠস্ং. ষ্ণধঠত্রভ ঞধ গছশ ঞধ যছটং ঞচ্ং ঘধশত্রু ংঈধশ রুংস্ধবশছবষ্ ছত্ররু ংঈশধস্ ণধ ঙচ্ঠ ংঔঠত্রচ্ গছয ঞচ্ং ধত্রং ংঋধযঞভশছরুণ্ণছঞং ধৃঞঠধত্র ঝ ংঊত্রংগ ঝ রুঠরু ত্রধঞ গঠযচ্ ঞধ ংন্ংশবঠযং." সীলি-র বাক্য-নির্মাণের ভঙ্গি থেকেই তাঁর মনের চরিত্রটি অনুভব করতে পারি আমরা । আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি যেখানে বহির্দেশের উপর কোনো চাপ সৃষ্টি করে সেখানে সহযোগী হতে মন সায় দেয় না তাঁর । সীলি রাজনীতির মানুষ নন, বিদ্যা-শৃঙ্খলাকে আপন করে নেওয়া এক জ্ঞানার্থী - কেবল এই সিদ্ধান্তই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে না । তাঁর মন ও মননের রাষ্ট্রসীমা-বহির্ভূত মানবিক মুখও আমরা যেন চকিতে দেখে নিলাম এই বাক্যের দর্পণে । এই মন না থাকলে গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য দিনের পর দিন ভারত ও পূর্ববাংলার (পরে বাংলাদেশ) পথে-ঘাটে, গ্রামে-মফস্সলে দিনের পর দিন কাটাতে পারতেন না তিনি । আমেরিকার জনসাধারণ জীবন-যাপনের যে স্বাচ্ছন্দ্যে আ-জন্ম অভ্যস্ত - তার থেকে অনেকটাই সরে এসে ভারতীয় উপমহাদেশের জীবন-যাত্রা ও সংস্কৃতিকে বুঝে নিয়েছিলেন ক্লিনটন বুথ সীলি নামের এই ব্যক্তি । আমেরিকার শান্তি সেনাদলের স্বেচ্ছাসেবক (ংংঐছবং ঙধশৃয ফ্ধত্ণ্ণত্রঞংংশ) রূপে ১৯৬৩-তে ঢাকা-য় এসে পৌঁছলেন সদ্য যুবক সীলি । ঘুরলেন সন্নিহিত অঞ্চলে । দিগন্ত-প্রসারী মেঘনা পার হয়ে, চাঁদপুর স্পর্শ করে গেলেন নারায়ণগঞ্জ । তার পর কীর্তনখোলা নদীর তীরে বরিশাল । এই বরিশাল - জীবনানন্দের রূপসী বাংলার নিবিড়তায় তাঁর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলা সাহিত্যের এক তন্ময় গবেষক - তা তখনও তাঁর জানা ছিল না । কিন্তু ঘটনা এটাই । বরিশাল যেমন জীবনানন্দের, তেমনই সীলিরও । তাই সাহিত্য-গবেষক ক্লিন্টন বি. সীলি-র প্রথম কাজ কবি জীবনানন্দকে নিয়ে । বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে এই প্রাণের সংযোগ তাঁর জীবনে আর বিচ্ছিন্ন হল না । ছাত্রজীবনে পাঠ্য বিষয় ছিল জীব-বিদ্যা; পূর্ব বাংলায় এসে প্রথমে ছিলেন বরিশাল জেলা স্কুলের বিজ্ঞান-শিক্ষক - সেখান থেকে শুরু করে কর্মজীবন শেষ করলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় পাঠ-শৃঙ্খল (South Asian Studies) বিভাগের অধ্যাপকের পদে । পঁয়ত্রিশ বছর সেখানে যুক্ত থেকে বর্তমানে তিনি অবসর-প্রাপ্ত । বাংলা সাহিত্যের অনেক বিভাগেই বিচরণ করেছেন তিনি । মধ্যযুগের রামায়ণ অনুসারী রচনা কৃত্তিবাসের রাম পাঁচালি আর মঙ্গলকাব্য ; শাক্ত পদাবলি আর মাইকেল মধুসূদন দত্তের `মেঘনাদ বধ কাব্য' ; রবীন্দ্রনাথ আর মীর মোশার্রফ হোসেন-এর লেখা ; জীবনানন্দের কবিতা থেকে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান-এর সাম্প্রতিক উপন্যাস । কিন্তু এই সব রচনার সংকলন যখন বিন্যস্ত হল একটি গ্রন্থের দুই মলাটের মধ্যে তখন লেখক সে-বইয়ের নামকরণ করলেন `বরিশাল অ্যাণ্ড বিয়ণ্ড' - বরিশাল ছাড়িয়ে ।আমরা ফিরে যাই সীলি-র সঙ্গে বরিশালের প্রথম পরিচয়ের দিনগুলিতে - সেই ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দে । বাখরগঞ্জ জেলার কেন্দ্র-শহর বরিশাল । বরিশাল জেলা স্কুলের ভিতরেই একটি দু-তলা বাড়ির অব্যবহৃত একটি শ্রেণিকক্ষে তিনি থাকতেন । সেই ঘরেরই এক কোণে কেরোসিন স্টোভ-এ দুবেলা তাঁর রান্না করে দিয়ে যেতেন খ্রিষ্ট-ধর্মাবলম্বী বৃদ্ধ জন ব্যাপারি । তখনও বরিশালের বাজারে ষোলো আনায় এক টাকা আর চার পয়সায় এক আনা হিসেবে বেচাকেনা চলত । সেই ঘরে বিদ্যুতের আলো ছিল না । সন্ধ্যার রান্না হত লন্ঠনের আলোয় ; সন্ধ্যায় সীলি লেখা-পড়া করতেন আর একটি লন্ঠনের আলোয় । বরিশালের সেই বিদ্যুথীন রাত্রিগুলিতে লন্ঠনের আলোয় বসে কাজ করবার সময়ে তাঁকে কি মশা কামড়াত না ? মশারা তো `অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে' ! কিন্তু মশার কথা লেখা নেই এই আত্মপরিচয়ে ।
আছে বাঙালির আড্ডার উল্লেখ । `আড্ডা'
(adda) শব্দটিই ব্যবহার করেছেন সীলি, যেহেতু ঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই আড্ডা-র । `ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিস'- এর স্থানীয় কার্যালয়ের অধিকর্তা ছিলেন গোলাম কিব্রিয়া । সেখানে আসতেন ব্রজমোহন কলেজের কয়েকজন উত্সাহী অধ্যাপক । কিবরিয়া সাহেবই ছিলেন মধ্যমণি ; শোনাতেন মজার মজার গল্প, আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা ।সীলি অনেক সময়েই ঘুরে বেড়াতেন বরিশালের পথে - বড়ো রাস্তায় এবং গলিতে । তখন তিনি জীবনানন্দের নামও শোনেননি । `আত্মপরিচয়'-এ আমরা পড়ি -
"... I came to realize only several years later - I was actually walking past Jibananda Das's old house, the house where he was born and lived most of his life, until leaving for good for Kolkata in 1946, the year prior to Independence and partition. Oddly, I knew nothing of Jibanananda during my year and nine months in Barisal."শিকাগো-তে ফিরে এসে যখন `দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সভ্যতা' বিভাগে পি. এইচ. ডি. করবার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন সীলি, তখনই তিনি জীবনানন্দকে জানলেন । অত:পর এই আত্মপরিচয় আর নিজের জীবনের তথ্য-পরিচয় প্রদানের দিকে অগ্রসর হয়নি । বিলীন হয়ে গেছে জীবনানন্দের কবিতার প্রগাঢ় বহমানতায় । সীলি `রূপসী বাংলা'-র উল্লেখ করেছেন ; জীবনানন্দের কবিতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন উক্তি করবার ফাঁকে ফাঁকে `ফিরে এসো' ও `অদ্ভুত আঁধার এক' কবিতা দুটির স্বকৃত অনুবাদ উদ্ধৃত ও ব্যাখ্যা করে শেষ করেছেন রচনাটি । জীবনানন্দ সম্পর্কে তাঁর অনুভব তাঁর ভাষাতেই শোনা যাক -------
"The world of war made no sense to him; his poetry to that period reflected senselessness. He did not live to see the Vietnam War, a war that, as I noted, made little sense to me." জীবনানন্দের প্রতি ; ভারত, পূর্ব পাকিস্তান, বাংলাদেশের প্রতি সীলি-র হৃদয়ের অভিমুখ এভাবেই আমরা বুঝে নিতে পারি ।পরবর্তী কালে ক্লিনটন সীলি তাঁর অধ্যয়নের ক্ষেত্র পরিবর্তন করলেন । জীববিদ্যা ছেড়ে চলে এলেন বাংলা সাহিত্যের পঠন-পাঠনে । তিনি কলকাতায় এসে পি. এইচ. ডি.-র গবেষণা-সন্দর্ভ প্রস্তুত করলেন জীবনানন্দের কবিতা নিয়ে । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. নরেশ গুহ-র তত্ত্বাবধানে নিষ্পন্ন তাঁর সন্দর্ভটির সম্পূর্ণ নাম -
"Doe in Heat : A Critical Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1899 - 1954) with Relevant Literary History from the Mid -1920s to the Mid 1950s". - এই কাজটি করবার সময়ে কলকাতা ও পূর্ববাংলাতেই ছিল তাঁর বসবাস । তাঁকে দেখা যেত কলকাতার বিভিন্ন গ্রন্থাগারে ; তাঁকে পাওয়া যেত বিশেষভাবে পঞ্চাশের কবিদের সান্নিধ্যে । শান্ত-কন্ঠ, মিতভাষী এই যুবকের সঙ্গে তখন প্রীতি-সখ্যে বাঁধা পড়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই । এখনও সেই সম্পর্ক কোনো কোনো ক্ষেত্রে অটুট আছে । মাঝে মাঝে ভারতে আসেন তিনি ।এই গবেষণা-সন্দর্ভ প্রকাশিত হয়েছে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৬-এ । সীলি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ-এশীয় ভাষা-সংস্কৃতি বিভাগে বাংলার অধ্যাপক পদে বৃত হলেন । এখানে তাঁর বরিষ্ঠ সহকর্মী ও শিক্ষক হয়ে উঠলেন এডওয়ার্ড সি. ডিমক । ডিমক-ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অকৃত্রিম অনুরাগী, রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিবিড় শ্রদ্ধাশীল অধ্যাপক, আমেরিকায় বাংলা ভাষা-চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম পথিকৃত্, বাংলা সাহিত্যের অনুবাদক । এই সংকলন গ্রন্থটি তাঁকেই উত্সর্গ করেছেন সীলি - উত্সর্গ-লিপিতে লিখেছেন -
"In memory of / Edword C. Dimock, Jr. / teacher, friend, and colleague, / pioneer American Scholar of Bangla, / and inspiration incarnate"
![]() |
ক্লিন্টন্ সীলি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত একটি বিভাগে অধ্যাপনার দায়িত্বে ছিলেন দীর্ঘদিন । বিদেশি ছাত্রদের বাংলাভাষার বিভিন্ন পর্যায়ের সাহিত্য সম্পর্কে পাঠ দেওয়া হত সেখানে । পড়াবার জন্যে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই ইংরেজি ভাষায় ছিল অপ্রতুল । ছাত্রদের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে তাই ইংরেজিতে বঙ্গীয় সাহিত্যকৃতির বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে দেবার দায়িত্ব নিতে হয়েছিল অধ্যাপকদেরই' সেই সূত্রে সীলিও লিখেছিলেন একাধিক প্রবন্ধ যার বিষয় বাংলা সাহিত্য । সেইসব প্রবন্ধ থেকেই একটি নির্বাচিত সংকলন বর্তমান গ্রন্থটি - `বরিশাল অ্যাণ্ড বিয়ণ্ড' ।
![]() |
|
আমরা এখন আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধ সংকলনটির বিষয়বস্তু এবং রচনা-দৃষ্টিকোণ লক্ষ্য করব । যেমন, প্রবন্ধতালিকার প্রথমে লেখক আত্মপরিচয়মূলক একটি পূর্বকথা বিন্যস্ত করেছেন, তেমনই তালিকা শেষে সংযুক্ত করেছেন মধুসূদন থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত দুই বাংলার সাহিত্য এবং বিশ্বসহিত্যের প্রেক্ষিতগত সংলগ্নতা নিয়ে একটি সমাপ্তি-প্রবন্ধ । নাম - `এপিলোগ কামিংস্ অ্যাণ্ড গোয়িংস : ফ্রম মধুসূদন টু দ্য ডায়াসপোরা অব্ টুডে' । মধ্যে আছে তেরোটি রচনা । সেগুলির বিষয়বস্তু যথাক্রমে - ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলকাব্য, রবীন্দ্ররচনা ও মঙ্গলকাব্যের মধ্যে একটি তুলনা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মহাকাব্যিক উপমা প্রসঙ্গে তাস্সো, মিল্টন এবং মধুসূদনের রচনার সমান্তরালতা, মধুসূদনের হাতে রাবণ এবং রামের নির্মাণ, মেঘনাদবধ কাব্যের প্রেরণা, মেঘনাদবধ কাব্যে যুগ-পরিবর্তনের সাক্ষ্য, বনলতা সেন কবিতার একটি নিবিড় পাঠ, জীবনানন্দের বিরোধাভাসমূলক অলংকার, বাংলা সাহিত্য পাঠের দৃষ্টিকোণ, মীর মোশারাফ হোসেন এর রচনা, রবীন্দ্ররচনা এবং সত্যজিৎ রায়ের পুনর্নির্মাণে মাধ্যমের ভিন্নতা, রাজা প্রতাপাদিত্যের চরিত্র এবং বাংলা দেশের লেখিকা রিজিয়া রহমান-এর উপন্যাস প্রসঙ্গে সিরিয়াস সাহিত্য সম্পর্কিত আলোচনা ।
প্রতিটি প্রবন্ধের সবগুলি দিক আলোচনা করা সম্ভব নয়, এবং তার প্রয়োজনও নেই । আমরা দেখবার চেষ্টা করব বাংলা সাহিত্যের অবলোকনে ক্লিন্টন সীলি-র দৃষ্টিভঙ্গির বৈশিষ্ট্য ।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যকে কেন্দ্র করে যে প্রবন্ধটি লিখিত হয়েছে সেখানে মঙ্গলকাব্যের গঠন এবং কার্যকারিতা বিষয়ে সু-দীর্ঘ আলোচনা আছে । উল্লিখিত হয়েছে মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল কাব্য এবং আরও কোনো কোনো অ-প্রধান মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু ও গঠন-রীতি । বিশেষভাবে সীলি দেখিয়েছেন ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি । এই কাব্যের অভিমুখিনতা দেবীর প্রতি নয়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রতি ; এই কাব্যে দেবতা প্রসঙ্গ ছাপিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছে মুসলিম শাসক অধিকৃত বাংলায় হিন্দুরাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অবস্থানসূচক বাস্তবতা ।
পরবর্তী প্রবন্ধে - `সে ইট উইথ স্ট্রাক্চার টেগোর অ্যাণ্ড মঙ্গলকাব্য' অত্যন্ত কৌতূহল উদ্দীপক একটি রচনা । রবীন্দ্রনাথের `তাসের দেশ' নাটকের সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের একটি সমান্তরাল তুলনা উপস্থিত করেছেন সীলি । আমরা প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে তাঁর সঙ্গে বিতর্কে প্রবৃত্ত হতে পারি । কিন্তু সীলি-র বিশ্লেষণ আমাদের `তাসের দেশ' সম্পর্কে নতুন একটি জানলা খুলে দেবে । আমরা তাঁর ভাষাতেই তাঁর মন্তব্য দেখে নিতে পারি -
"Land of the Cards is every bit as transparently didactic as the medieval narratives. Moreover, by using what is essentially a mangal kavya plot structure, Tagore has added emphasis to his message. That structural feature, because of its association with mangal kavya literature, carries its own meaning : Whatever is being illustrated is important to your welfare - audience take heed !" (p. 45)
![]() |
|
এরপর দুটি প্রবন্ধের অবলম্বন হয়েছে জীবনানন্দের কবিতা । "শিফ্টিং সী-জ্ অ্যাণ্ড বনলতা সেন" । এখানে তাঁর আলোচনার বিষয় হয়েছে মালয় সমুদ্র । এই `মালয়' কোন্ মালয় ? মালয়েশিয়া অথবা ভারতের মালাবার উপকূল, যেখানে থাকে মলয়ালি ভাষা-ভাষি মানুষ । সীলি মনে করেছেন জীবনানন্দের লিখিত মালয় শব্দটি মলয় শব্দ থেকে নিষ্পন্ন বিশেষণ । সাধারণত আমরা `বনলতা সেন' কবিতাটিতে ব্যবহৃত মালয় এবং সিংহল-কে শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়া ভাবতে অভ্যস্ত । কিন্তু সীলি বলতে চেয়েছেন - জীবনানন্দ ভারতীয় পরীণাহ (পেনিনসুলা-র বাংলা - কবিতায় শব্দটি ব্যবহার করেছেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত) ছাড়িয়ে যেতে চাননি এই কবিতায় । সিংহল আজ রাষ্ট্র হিসেবে স্বতন্ত্র কিন্তু লঙ্কাদ্বীপ এক সময়ে ভারতেরই অঙ্গ ছিল । অন্যদিকে মালয় সাগর - মালাবার উপকূলবর্তী সমুদ্র-অংশ । এই বলয়ের মধ্যেই তিনি সন্ধান করেছেন তাঁর বনলতা সেনকে । শ্যামবর্ণ, কৃষ্ণকুন্তলা আয়তনয়ন বনলতা সেনকে তিনি সন্ধান করেছিলেন এই ভারতের জল মাটিতে । এ জন্যেই সীলি বনলতা সেন কবিতায় যে নতুন অনুবাদ করেছেন তা উদ্ধৃত করেছেন প্রবন্ধটিতে এবং মন্তব্য করেছেন যে এই অনুবাদটিই হল `জিওগ্রাফিকালি কারেক্ট্' । -
"For thousands of years I've been roaming the paths of this earth, / From waters round Sri Lanka, in dead of night, to seas up the / Malabar Coast." (p. 130)
ক্লিন্টন সীলি প্রাক্তন পূর্ব-পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে গেছেন অনেকবার । তাঁর পঠন-বৃত্তে পূর্ববাংলার সাহিত্যিকেরাও আছেন । স্বতন্ত্রভাবে দুটি প্রবন্ধে তিনি উনিশ শতকের এবং উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিক্ষণের বিশিষ্ট লেখক মীর মোশাররফ হোসেন-এর সাহিত্য এবং বিশ শতকের শেষ পর্বের লেখক রিজিয়া রহমান এর উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন । অপর একটি প্রবন্ধে (ভিউয়িং বাংলা লিটারেচার) তিনি শামসুর রহমান, শহীদ কাদরী, জীবনানন্দ ও মহাশ্বেতা দেবীকে আলোচনার পরিসরে নিয়ে এসেছেন । এই প্রবন্ধটিতে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ্দের চোখে `প্রাচ্যতা' অর্থাৎ ওরিয়েন্টালিজম্-এর নির্মাণ প্রসঙ্গে এডোয়ার্ড সাইদ-এর বিখ্যাত গ্রন্থটির প্রসঙ্গ এসেছে ।
`বরিশাল অ্যাণ্ড বিয়ণ্ড' - এই প্রবন্ধ সংকলনটির যে বিবরণ আমরা পেশ করলাম, সেখান থেকে ক্লিন্টন সীলি-র বাংলা সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ, নিবিড় পঠন, স্বতন্ত্র নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া গেল । কিন্তু যে পরিচয়টি পাওয়া গেলনা, তা হল তাঁর অন্তরস্থিত ব্যক্তিত্বের হৃদয় ও মনন সম্মিলিত স্বরূপ । সীলি-র কাছে সাহিত্যপাঠ তাঁর মানবতাবোধেরই সম্প্রসারণ । প্রবন্ধগুলির বিভিন্ন অংশে এই মনের পরিচয় আমরা পাবো । আমেরিকার নাগরিক ক্লিন্টন সীলি বিশ্বসভ্যতার দুই প্রান্তকে দেখেছেন । বিলাস উপচে পড়া রাষ্ট্রগুলির বিপরীতে আছে বিদ্যুতের আলো আর পরিস্রুত জল পৌঁছয়না - এমন অনেক অনেক অঞ্চল । ছড়িয়ে আছে আফ্রিকায়, ভারতীয় উপমহাদেশে এশিয়ার পুব ও পশ্চিম প্রান্তে । সীলি এই নিরালোক পৃথিবীকে আপন করতে চেয়েছেন । বাংলা সাহিত্যের সাহায্যেই তিনি গড়ে নিয়েছেন সেই সেতু । এ জন্যেই জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রাণের কবি । জীবনানন্দের `অদ্ভুত আঁধার এক' কবিতাটির স্ব-কৃত অনুবাদ তিনি তাঁর প্রথম আত্মপরিচয় লিখনটিতেই দিয়েছেন । এই কবিতাটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, -
"... most prophetic, most intelligible, and, to my mind, most sensible" রচনা বলে । এই রচনাটির শেষ চারটি ছত্র উদ্ধৃত করে আমরা শেষ করব ক্লিন্টন বি সীলি-র এই প্রবন্ধ-সংকলন সম্পর্কিত আলোচনা - "Jibanananda's words would ??? tree, unfortunatley, for more than a decade to come : the world did indeed not dare make a move without the deluded guiding advice of those with no vision at all." (p. 6)(পরবাস-৪৬, সেপ্টেম্বর, ২০১০)