• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৪৬ | সেপ্টেম্বর ২০১০ | প্রবন্ধ
    Share
  • হেমন্ত : মীজান রহমান



    আকাশভরা এত নীল অনেকদিন দেখিনি । ইচ্ছে হচ্ছিল আকাশকে বলি, একমুঠো নীল ধার দেবে তুমি ? মন চাইছে গায়ে মাখি । গাড়ি চালাচ্ছিলাম, নইলে হয়ত সত্যি সত্যি সব কাজ ফেলে বসে বসে দু'ছত্র পদ্য লিখে ছেড়ে দিতাম ডাকে, ঠিকানা ছাড়াই । এমন পাগলামিতেও আমাকে ধরে বটে মাঝে মাঝে ।

    অক্টোবর আমার প্রিয় মাস ক্যানাডাতে । সেই প্রথম থেকেই । পাকা আটচল্লিশ বছর আগে, ফ্রেডারিকটন নাম পাখির শাবকের মতো এক ছোট্ট ঘুমঘুম শহরে, যখন অক্টোবরের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার । তখন আমার গাড়ি ছিল না । একদিন সকালবেলা বইপত্র হাতে ক্লাসে যাব বলে রাস্তায় বেরুচ্ছি এমন সময় একঝাঁক ঝরা পাতা আমার পিছু নিল । কিছুতেই আমার সঙ্গে ছাড়বে না । তাদের সঙ্গে একপ্রকার হিমহিম মিষ্টি বাতাস ঘুরে ঘুরে, উড়ে উড়ে, ছুটল আমার সাথে । ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ । হাঁটছি বলে মনে হয়নি, মনে হচ্ছিল ভাসছি । বিপুল এক বায়ুতাড়িত তরঙ্গ আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল । তখন থেকেই অক্টোবরের প্রেমে পড়া আমার ।

    কে জানে কি আছে ক্যানাডার হেমন্তে, কি সেই মায়ার ছোঁয়া, যা প্রাণমন একেবারে অবশ করে দেয় । সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই শিশিরের শব্দ শুনতে পাই জানালায় । ঊষার আকাশে অন্তহীন রহস্য । দু'চারটে উড়ো মেঘ তাকে যেন আরো গাঢ় করে তোলে । ছায়াছবিতে দেখা যেন সেই কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যার নির্জনতায় `ফ্রেঞ্চ লেফটেনান্টের স্ত্রী'র সেই ঘোমটাপরা মুখটির মতো । অক্টোবরকে ঠিক তাই মনে হয় আমার--যেন কোনও পরকীয়া প্রেমের দু:সাহসী অভিসার ।

    ছোটবেলায় দেখতাম অঘ্রানের মাঝামাঝিতে ফসলতোলার আনন্দমদিরাতে ভুরভুর করছে গ্রামবাংলার হৈমন্তী বাতাস । গোলাভরা ধান, উঠোনভরা সোনালি পাট স্তূপ স্তূপ করে সাজানো, কৃষকের ঘরে আনন্দের জোয়ার । মেয়েরা লজ্জার বাঁধ ভেঙে খল খল করে হাসত, গাইত, সাজত । হিন্দুপাড়ার মেয়েরা যাত্রা করত, গানের আসর বসাত । সেখানে মেয়েরা আলতাপরা পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে নাচত, গা দুলিয়ে, গ্রীবা বাঁকিয়ে, চোখ নাচিয়ে, আনন্দে আনন্দে উত্তাল হয়ে । ক্যানাডায় তা হয় না । অন্তত আমার চোখে পড়েনি । এরা থ্যাংকসগিভিং করে, জানি । টার্কি খায়, আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে হৈহুল্লোড় করে, কৃতজ্ঞতাভরে প্রণতি জ্ঞাপন করে তাদের শস্যদায়ী মহাপ্রভুর কাছে । কিন্তু তারা বাংলাদেশের গরিব কৃষকদের মতো নাচের ছন্দে আর গানের মাতনে মেতে ওঠে না, আনন্দবারিধারাতে করে না অবগাহন ।

    সেই অভাবটি যেন পূরণ করে দেয় প্রকৃতি । ক্যানাডার হেমন্তে প্রকৃতি নিজেই সাজগোজ করে, রূপের বাহার তুলে পাগল করে দেয় মানুষকে, বিগত প্রেমের বেদনাতে আকুল করে তোলে মানুষের দেহমন । মেঘমুক্ত দিন পেলে একাই বেরিয়ে যাই আমি গাড়ি নিয়ে । কোথায় যাব জানিনা, গাড়ি নিজেই নিয়ে যায় ঠিক জায়গাটিতে । পুরনো গাড়ি আমার মনের খবর জানে । কখনো ডাউ লেকের ধারে, যেখানে হ্রদের জলে পাতারা ভেসে ভেসে কোথায় যায় জানিনা । যেখানে কাঠবেড়ালিরা আসর জমায় গাছে ছায়ায়, কীটপতঙ্গেরা ছুটোছুটি করে কিসের আনন্দে কে বলবে । সেখানে গাছে গাছে রঙের আগুন জ্বলে অক্টোবরের রোদেলা দিনে । সেখানে ছেলেদের নিয়ে মাছ ধরতে যেতাম একসময়, আর তাদের মা পাশের বেঞ্চিতে বসে টমাস হার্ডির বই পড়ত-- কেন যে সে এত পছন্দ করত এই লেখকটিকে ।

    কখনো যাই বড়লোকের পাড়া রক্লিফে । প্রকাণ্ড সব প্রাচীন বাড়ি গাছে গাছে ঢাকা । হঠাৎ হঠাৎ সাঁকোর মতো কি যেন কি চমকে দেয় পথচারীকে । একটা মাঝারি আকারের খাল আছে সেখানে, যেখানে বাংলাদেশের শাপলার মতো ফুল ফোটে মরশুম এলে । খালের ধারে কাঁচা রাস্তা, কিম্বা একেবারেই রাস্তা নেই--লতায় পাতায় ছেয়ে গেছে সব । সেখানে পাখিরা অনর্গল কিচির মিচির করে যাছে, খরগোশেরা ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে তাদের প্রেমিকাদের, ঘুঘুরা ডালে বসে কাঁদছে গুমরে গুমরে । তারপর বিকেল হলে লম্বা ছায়া পড়ে সেই খালের ওপর । গাছের ছায়া, আকাশের ছায়া, প্রাচীন প্রেমের ছায়া, সব ছায়াতে মিলে একাকার হয়ে যায় । সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য । গাছ তখন ঝুঁকে পড়ে জলের ওপর নিজের ছায়া দেখার জন্যে । নিজের রূপে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় । সেখানে আমিও আমার মুখ দেখি, ছায়া দেখি । দেখি আমার স্মৃতিকে, আমার সমস্ত হৃদয় অর্পিত হয় তার পাদমূলে । তার অশেষ কাজলতা বর্ষিত হয় আমার কল্পনাতে, আমার আত্মায় ।

    কোনও স্বচ্ছ জলাশয়ে নিজের প্রতিকৃতি দেখামাত্র আমার মনে পড়ে যায় বহুদিন আগে পড়া এক অসাধারণ ছোটগল্পের কথা । দু:খের বিষয় গল্পটির নাম, এমনকি লেখকের নামও এখন মনে করতে পারছি না । ওতে এক মাতাল চরিত্রের অদ্ভূত কাণ্ডের কথা লেখা ছিল । মাতালটি তার এক বন্ধুর সাথে জোছনারাতে নৌকাবিহারে বেরিয়েছিল এক হ্রদের ওপর । সেখানে সে দেখতে পেল পূর্ণিমার চাঁদ থৈ থৈ জলে থরথর করে কাঁপছে । আহা, এবারে পেয়েছি তোমাকে হাতের কাছে । এই বলে সে হাত বাড়িয়ে চাঁদটাকে নৌকায় তুলে নিতে চাইল । পারলনা বলে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে । সাঁতার জানতনা বলে সে আর উঠতে পারেনি গভীর পানি থেকে । চাঁদ কিন্তু রয়ে গেল সেই একই জায়গায় । কি অসাধারণ আইডিয়া, তাই না ? কোনটা সত্য, আকাশের চাঁদ, না পানিতে ভেসেবেড়ানো ছবিটা ? জ্ঞান আর ইন্দ্রিয়ের পর্দাটি যখন থাকে না তখন বিষয় আর প্রতিবিম্বের তফাতটাই বা বুঝবার উপায় কি ? তাই প্রশ্ন জাগে, এই দীঘির জলে আমার মুখটি শিল্পীর আঁকা ছবির মতো ভগ্নরেখার রূপ নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে সে কি আমার চেয়ে বড়ো সত্য ? বা দীঘিপারের প্রকাণ্ড মেপল গাছটি তার বিপুল ছায়া ফেলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে সে কি তার নিজের রূপেতেই মুগ্ধ, না আমারই মতো বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিহিন আবরণ নিয়ে বিভ্রান্ত ?


    ***********************************


    এই যে বাস্তবের মাঝে পরাবাস্তবের প্রকাশ, অথবা অবায়বের তূরীয় শরীরে স্থূল বাস্তবের প্রতিভাস, এই দ্বন্দ্বটি সবচেয়ে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে হয়ত আধুনিক শিল্পকলার জগতে । মজার ব্যাপার হল যে শিল্পের এই আধুনিকায়নের পেছনে যে মৌল আইডিয়া সেটি কিন্তু এসেছে এক ক্ষণজন্মা পদার্থবিজ্ঞানীর কাছ থেকে--স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন । তাঁর প্রস্তাবিত চতুর্থ মাত্রা, যাকে তিনি প্রকৃতির এক অদৃশ্য এবং দুর্জ্ঞেয় বাস্তবতা বলেই দাবি করে বসলেন ১৯০৫ সালের এক কালজয়ী গবেষণাতে, সেই চতুর্থ মাত্রাই দু'তিন বছরের মধ্যে শিল্পীদের পটে আঁকা ছবিকে বস্তুর স্থূলত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নৈর্বস্তুকতার এক সূক্ষ্ম মাত্রাতে পরিণত করবার প্রেরণা দিয়েছিল, এবং তার প্রধান উদ্দীপনা যুগিয়েছিলেন সেযুগের দুই উদীয়মান তারকা--পাবলো পিকাসো আর জর্জি ব্রাক । তাঁদের হাত দিয়েই জন্ম নেয় পরবর্তীকালের বিমূর্ত শিল্পধারা--কিউবিজম, যেখানে
    মূর্তিমান প্রতিকৃতি পরিণত হয় ঘনজ্যামিতির রেখাবিচিত্রায় । অর্থাৎ গণিতের সাথে, সখ্যবন্ধন সৃষ্টি হয় শিল্পকলার । বস্তু লাভ করে এক নৈর্বস্তুক মাত্রা--বিজ্ঞানের সেই রহস্যময় চতুর্থ মাত্রা । অবিশ্বাস্য মনে হবে শুনতে যে সেসময়কার একজন বিশিষ্ট শিল্পী, মার্সেল ডুশাম্প, তাঁর অন্যতম বিখ্যাত ছবিতে আইনস্টাইনের ভাবানুসারে `সময়' নামক চতুর্থ মাত্রাটিকে দৃশ্যমান স্থিরচিত্রের ক্যানভাসে ধরে রাখবার চেষ্টা করেছিলেন । ১৯১১ সালে আঁকা তাঁর এই ছবিটির ফরাসী নাম : Portrait de joueurs d'echecs.

    জ্যামিতিক বা গাণিতিক মাত্রা জিনিসটা আসলে কি ? সাধারণ ভাষায়, একপ্রকার স্বাধীনতা । নড়াচড়ার স্বাধীনতা । একমাত্রা মানে ডানবাম ছাড়া অন্যদিকে নড়বার উপায় নেই--একটি সরলরেখা যেমন । আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক চলাফেরা তিনমাত্রিক--উত্তরদক্ষিণ, পূর্বপশ্চিম, উপরনিচ, এই তিনদিকেই আমাদের নড়াচড়া করবার স্বাধীনতা আছে । চতুর্থ মাত্রাটির ধারণা আইনস্টাইনের আগে কারো মাথায় ঢোকেনি, কারণ বিজ্ঞান তখনও অতটা অগ্রসর হয়নি । তবে গাণিতিকদের জগত আলাদা । তাঁরা হরহামেশাই নতুন নতুন মাত্রা তৈরি করে যাচ্ছেন তাঁদের অঙ্কের গবেষণাতে । সেই মাত্রার সাহায্যে তাঁরা অনেক দুরূহ সমস্যা সমাধান করছেন । এগুলো বাস্তবে কাজে লাগবে কি লাগবে না সে নিয়ে তাঁদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই । তাঁদের কাজ কল্পনার সৌধ রচনা করা--বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের সৌধ । অনেকটা আধুনিক বিমুর্ত আর্টেরই মতো । আধুনিক শিল্প আর আধুনিক গাণিতিকের চারণক্ষেত্র সম্পূর্ণ আলাদা । তাঁদের লক্ষ্য মূর্তি বানানো, ভাবের মূর্তি, আইনস্টাইনের সেই অতীন্দ্রিয় মাত্রাসম্বলিত মূর্তি, যার প্রধান উদ্দেশ্য অপার্থিব রূপের প্রতীক সৃষ্টি করা । হ্যাঁ, গণিতেরও একটা অপার্থিব রূপ আছে বৈকি । এবং সেটা যতই এবস্ট্রাক্ট হোক আপাতদৃষ্টিতে এবং আবিষ্কারকালে সুদূরপরাহত মনে হোক তার প্রয়োগশীলতা, দেখা গেছে যে তার ভেতরে যদি সেই দুর্লভ বস্তুটি থাকে যার স্পর্শে সবকিছুই এক স্বর্গীয় আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তাহলে প্রকৃতিদেবী নিজেই সেই এবস্ট্রাক্ট আবরণ ভেদ করে পরম বাস্তবের রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন । এবস্ট্রাক্টের যে সৌন্দর্য তা প্রকৃতিরই এক বিকল্প রূপ ।

    আমি অত্যন্ত স্থূলভাবে, রক্লিফের হেমন্তবেলায়, দীঘির জলে গাছের ছবি দেখে সেই অতীন্দ্রিয় বাস্তবতাকে খুঁজি । খুঁজি সুন্দরের পরমসত্তাকে । মানুষের অনন্ত তৃষ্ণাই তো তাই । যা স্নায়ুতে ধরা দেয়, যা ইন্দ্রিয়ের পরিধিতে বন্দী তার বাইরে, অনেক অনেক বাইরে আরো একটা মাত্রা আছে, আরো অনেক মাত্রা আছে, যাকে কেউ জেনেশুনেই স্পর্শ করতে চায়, কেউবা করে অজান্তে । এখানেই আমাদের অন্তহীন অতৃপ্তির উত্স--সকল সৃষ্টির উত্স ।

    অটোয়া,
    ৯ই অক্টোবর, '১০
    মুক্তসন ৩৯

    (অক্টোবর, ২০১০; পরবাস-৪৬)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)