২০০৮ সালের অক্টোবরে অক্সফোর্ডে অন্দ্রেই ভোরেল নামে একজন চেক চিত্রশিল্পীর ছবির প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম, যাঁর সব কাজ জুড়েই ছিলো বিষাদের একটা আস্তরণ । আমাদের জানানো হয়েছিলো যে তিনি দু'বছরের সময়সীমার মধ্যে তাঁর পরিবারের ছয়জন সদস্যকে হারিয়েছিলেন । তাঁরা প্রত্যেকে ক্যান্সারে মারা গিয়েছিলেন । তথ্যটা জানামাত্র আমার মন ছুটে গেছিলো একটি জরুরী প্রশ্নের দিকে : এই একগুচ্ছ মৃত্যুর পিছনে কি জেনেটিক এবং পারিপার্শ্বিক কারণের একটা জট নেই ? আমার মন বলছিলো, নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সেখানে তথ্যদাতা এমন কাউকে পাই নি যাঁর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা চালানো যায় । প্রদর্শনীতে শিল্পী স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু তাঁর ইংরেজীতে সেরকম দখল ছিলো না যে সেই ভাষায় এ ধরণের আলোচনা চালাতে পারেন, আর আমি, বলা বাহুল্য, চেক ভাষা জানি না । কেবল এইটুকু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো, ছবিগুলিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রকল্পে আবেশিক ভঙ্গিতে পুনরাবৃত্ত হয়েছে অবরুদ্ধ হবার খুঁটিনাটি, বন্দী অবস্থার অসহায়তা, শারীরিক ক্লেশ এবং মানসিক যাতনার অনুভব ।
ঠিক এর পরেই অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের পাঠানো বইটি পড়ি । অরিন্দম আমার সঙ্গে ই-মেইলে কথা বলছেন বেশ কয়েক বছর ধ'রেই, যদিও তাঁর সঙ্গে আমার মুখোমুখি আলাপ হয়েছে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে । এটি তাঁর প্রথম কবিতার বই, এবং তাঁরই সনির্বন্ধ অনুরোধে বইটি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ সশঙ্কচিত্তে দু'-চার কথা লিখতে বসেছি । `সশঙ্কচিত্তে' বলছি এইজন্যে যে এই বইটির উপাদানগুলির মধ্যেও পেয়েছি এক বিকীর্ণ বিষণ্ণতা : আক্ষেপ, নস্টালজিয়া, পেয়ে হারানোর কষ্ট, অপূর্ণতাবোধ ।
তাঁকে তখুনি ই-মেইলে প্রশ্ন করেছিলাম, এই বিষাদ কি তাঁর জীবনাভিজ্ঞতাপ্রসূত, আমার দেখা চেক শিল্পীর ছবিতে যেরকম, না কি তিনি দু:খবোধটাকে ইচ্ছা ক'রেই গাঢ় ক'রে এঁকেছেন - শিল্পগত কারণে ? এর উত্তরে গত ৩ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে তিনি যে-দু'-চার কথা লিখেছিলেন তার সংক্ষিপ্তসার এখানে দিচ্ছি, এই কারণে যে আমার পরিপ্রেক্ষিতে তা প্রাসঙ্গিক ।
তিনি লিখেছিলেন, জীবনের ভিতর দিয়ে তাঁর যে-ব্যক্তিগত যাত্রা, তার দ্বারা সম্ভবপর পাঠকদের প্রভাবিত হওয়া উচিত নয় ব'লেই তিনি মনে করেন, তবু এও ঠিক যে কবিতার যে-রাজ্যটা খুঁজে পাওয়ার জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন, সেখান থেকে সেই আঁধার অভিজ্ঞতাগুলিকে সর্বদা বাদ দেওয়া সম্ভব নয় । তাঁর সেই আঁধার অভিজ্ঞতার পুঁজি উল্লিখিত চেক আঁকিয়ের সঞ্চয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়, এবং সেই অভিজ্ঞতাগুলির উপর তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে রঙ চড়াবার চেষ্টাও করেন নি, আবার এ কথাও ঠিক যে তাঁর কবিতায় অপূর্ণতাবোধের যে-প্রকাশ, সেটি আমি ঠিকই সনাক্ত করেছি ।
এর অল্প পরেই অরিন্দম পরবাস -এ যে গল্পটি প্রকাশ করেন, তার প্লটে আছে যে একজন পেশাদার পুরুষ একটি শিশুসন্তানকে নিয়ে বিপত্নীক হয়েছে, তার স্ত্রী স্তনের ক্যান্সারে মারা গেছে । ডিসেম্বর ২০০৮-এ প্রকাশিত সেই গল্পটি আমি এই আলোচনাটি লিখতে বসার আগে পড়লাম । সেই চেক চিত্রকরের জীবনের গল্পটা কি তাঁকে আদৌ প্রভাবিত করেছিলো ? না কি অরিন্দমের গল্পটা তার আগেই লেখা হয়ে গেছে ?
সে যা-ই হোক, অরিন্দমের বক্তব্যে ফিরে আসি । তিনি বিশ্বাস করেন যে জীবনের নঞর্থক অভিজ্ঞতাগুলির সঙ্গে আমাদের যে-ধাক্কাধাক্কি, সেখানে আমরা প্রত্যেকে আলাদা, স্বতন্ত্র । যেমন, তাঁর নিজের ক্ষেত্রে তিনি জানেন যে তাঁর ঐরকম কিছু অভিজ্ঞতার উত্স হচ্ছে কৈশোরের কিছু অনিশ্চয়তাবোধ । (কার না থাকে শৈশবকৈশোর থেকে আহৃত তেমন কিছু সঞ্চয় ?) কিন্তু একই অবস্থার শরিক অন্য ভাইবোনেরা যে-পর্যায় পেরিয়ে আসতে পেরেছেন, তিনি নিজে এখনও তার ক্ষতচিহ্ন বহন করছেন । তা ছাড়া তাঁর মানসিক গঠনে প্রভাব ফেলেছে মৃত্যুবিষয়ক চিন্তা । একেবারে ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুভয় তাঁকে আবিষ্ট করেছে । কলেজজীবনে বার্গম্যানের ছায়াছবি দ্য সেভেন্থ সীল তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলো । জীবনে দ'ংউবার কাছের মানুষকে হারিয়ে তিনি বিপন্ন বোধ করেছেন । একটির কথা তিনি একবার লিখেওছিলেন আমাকে । মধ্যযৌবনের সেই বন্ধুবিয়োগের অভিজ্ঞতা তাঁকে উদ্ভ্রান্ত করেছে, বিনিদ্র রেখেছে, এক অর্থে ত্রক্রুদ্ধ করেছে । জীবন যদি এতই ক্ষণিক, তা হলে এই অস্তিত্বের অর্থ কী ? তিনি এখনও এই নিষ্ফলতাবোধের সঙ্গে কোনো মীমাংসায় আসতে পারেন নি । তাঁর প্রকাশকও অনুভব করেছেন যে দু:খবোধ অথবা `আপাত-সুখ'-এর বোধই এই কবিতাগুলির মূল থীম । বইটির নামকরণও প্রকাশকই করেছেন, একটি কবিতার একটি বিশেষ বাক্যাংশ অবলম্বনে । বইয়ের প্রচ্ছদ কিরকম হবে তা নিয়ে প্রকাশকের সঙ্গে কবি কোনো আলোচনাও করেন নি, কিন্তু চমকে উঠেছেন বই হাতে পেয়ে : এইরকম গাঢ় বাদামী রঙের একটা কাভারই তিনি মনে মনে কল্পনা করেছিলেন । প্রসঙ্গত: বলি, প্রচ্ছদের ছবিটি ছাড়াও এই বইয়ের অন্তর্গত শ্যামলবরণ সাহার সাদা-কালো স্কেচগুলি কবিতাগুলির মেজাজের সঙ্গে সত্যিই চমত্কারভাবে খাপ খেয়ে যায় ।
বইটি অরিন্দম উত্সর্গ করেছেন তাঁর মাকে, `কবিতার সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেবার জন্য' । `নষ্টচন্দ্র' শিরোনামে একটি মুখবন্ধ যোগ করেছেন, যেটি পড়লে বোঝা যায় যে কবিতাই ছিলো তাঁর কৈশোরের প্রথম ভালোবাসা । কিন্তু অন্য চাপে প'ড়ে জীবনপ্রবাহকে অন্য খাতে বইয়ে দিতে হয়েছে, প্রাথমিক সেই ভালোবাসাকে যথাসময়ে বাস্তবায়িত করতে পারেন নি, কেননা `কবিতার নশ্বর বিমূর্ততার চেয়ে গরম রুটির কঠিন বাস্তবের জোর এতই বেশি' । তবে দেরিতে হলেও সিরিয়াসভাবে কবিতা লেখা শুরু করেছেন তিনি, এবং বর্তমান বই সে-উদ্যমেরই ফসল । কবিতার প্রতি তাঁর কৈশোরের ভালোবাসাকে রূপ দিতে এই-যে দেরিটুকু হয়ে গেলো, এই জিনিসটাই কি তাঁর দু:খবোধের আদি হোমকুণ্ড, যাতে পরে ইন্ধন যুগিয়েছে বন্ধুবিয়োগ এবং বোম্বাই-জীবনের অন্যান্য নি:সঙ্গতা ? তরুণ প্রজন্মের অনেকের সঙ্গে কথা ব'লে একটা কথা বারবারই জেনেছি - যাঁরা শিল্পীর সংবেদন নিয়ে জন্মেছিলেন এবং সেভাবে বেড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলেন, অথচ তার পর কৈশোরের শেষ প্রান্তে এসে যাঁদের সাহিত্য, চিত্রকলা, বা সংগীতকে পাশে সরিয়ে রেখে জীবিকার তাগিদে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে পড়াশোনা করতে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ভালোবাসার প্রাথমিক চর্চাটিতে যথাসময়ে আত্মনিয়োগ করতে না পারার জন্য ক্ষোভটা কতখানি ব্যাপক । যখন সেইসব ছেলেমেয়েদের সংস্পর্শে আসি তখন তাঁদের স্বনির্বাচিত কর্মে উত্সাহ দেবার যথাসাধ্য চেষ্টা ক'রে থাকি । সেজন্যই এই আলোচনাটি লিখতে বসা ।
সেই সূত্রেই বলি, একটা বইয়ের গায়ে তার লেখক সম্পর্কে ন্যূনতম কিছু তথ্য থাকা উচিত - তিনি কবে কোথায় জন্মেছিলেন, কোথায় বড় হয়ে উঠেছিলেন, কোথায় পড়াশোনা করেছিলেন, পেশাসূত্রে এখন কী করেন, কোথায় থাকেন ইত্যাদি খবর । একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তাঁর লেখার সম্পর্কটা অবশ্যই কোনো সহজ-সরল ছক মেনে গ'ড়ে ওঠে না : তথাকথিত `ক্রাইম রাইটার'রা নিজেরা `ক্রিমিন্যাল' জগতের মানুষ এমন তো নয় । তবু সকলকেই কোনো-না-কোনো উপায়ে উপাদান সংগ্রহ করতে হয়, আর শেষ বিচারে জীবনই তো লেখালেখির উত্স । লেখক সম্পর্কে দু'-চারটে দরকারী বায়োডেটা বইয়ের গায়ে দেওয়া থাকলে পাঠকের পক্ষে তাঁকে তাঁর কনটেক্সটে ফেলে দেখতে সুবিধা হয়, এবং পাশ্চাত্য প্রকাশকরা প্রায় সর্বদাই এই প্রয়োজনীয় লেখকপরিচিতিটুকু সরবরাহ ক'রে থাকেন । পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রকাশকই এই কাজটার বেলায় অবহেলা দেখান; কেন তা বুঝি না । এই বইয়ের প্রকাশকও এ কাজটুকু করেন নি । সৌভাগ্যবশত:, অরিন্দমের নানা লেখা পরবাস -এ প্রকাশিত হয়েছে ব'লে এই পত্রিকায় তাঁর একটা লেখকপরিচিতি দেওয়া আছে, যা থেকে সবাই জানতে পারবেন যে তাঁর জন্ম বর্ধমানে, শিক্ষা বর্ধমান, নরেন্দ্রপুর আর শিবপুর বি. ই. কলেজে, পেশাসূত্রে বর্তমান নিবাস বোম্বাইয়ে । কবিতা ছাড়াও তাঁর আরেকটি ভালোবাসার বিষয় হলো গান । রবীন্দ্রনাথের গান ছাড়াও হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটদেশীয় ক্ল্যাসিকাল সংগীতের চর্চা তিনি ক'রে থাকেন । বস্তুত:, অরিন্দম আমার সঙ্গে সর্বপ্রথম যখন যোগাযোগ করেছিলেন তখন তা ছিলো রবীন্দ্রপ্রসঙ্গে, এবং সেটা ছিলো সাহানা নামে বোম্বাইয়ের একটি সংগীতশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যোগের সূত্রে । ব্যক্তিগতভাবে আমি আরও জানি যে তিনি এয়ার ইণ্ডিয়ার জন্য কাজ করেন, তা ছাড়া তিনি বিবাহিত এবং দুই সন্তানের পিতা । তথ্যনিচয়ের এ-জাতীয় কাঠামো মাথায় রাখলে একজন কবির মেজাজের প্রধান সুরটি বা তাঁর ব্যবহৃত চিত্রকল্পের বৈশিষ্ট্য সহজে ছোঁয়া যায়, ধরা যায় । এই-যে তিনি বর্ধমানের মতো `মফস্বল' শহরে শৈশব কাটিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে বোম্বাইয়ের মতো মহানগরের বাসিন্দা হয়েছেন, কবিতাপ্রেমিক হয়েও সাহিত্য না প'ড়ে শিবপুর বি. ই. কলেজে পড়েছেন (বা বাড়ির চাপে পড়তে বাধ্য হয়েছেন), তার পর এখন জীবিকার প্রয়োজনে এয়ার ইণ্ডিয়ায় চাকরি করছেন, এই তথ্যগুলি তাঁর আস্তিত্বিক আর্তির রূপরেখা বুঝতে অবশ্যই কিছুটা সহায়তা করে ।
অরিন্দম যে জীবনের মধ্যগগনে পৌঁছে অবশেষে কৈশোরের কবিতাপ্রেমকে নিজের সৃষ্টিতে রূপ দিতে পারছেন, তাঁর নিজেরই স্বীকৃতি অনুসারে এর পিছনে আছে আন্তর্জালের সাহিত্যসেবীদের কাছ থেকে পাওয়া উত্সাহ ও মদত । আলোচ্য বইয়ের অনেক কবিতাই, জানান তিনি, পরবাস, কৌরব, সোনাঝুরি প্রভৃতি ওয়েবসাইট থেকে পুনর্মুদ্রিত । তাঁর মুখবন্ধে তিনি বলেন : `কিন্তু এই ক'বছরে পৃথিবীর ভোল পাল্টেছে অনেক । বাংলা কবিতারও ।' আসলে সব কিছুরই তো ভোল পাল্টায় । তারই মধ্যে আমরা বেঁচে থাকার আর্ট আয়ত্ত করি, একজন অভিনেতা যেমন মঞ্চে বারবার ভোল পাল্টালেও তার নীচে একজন ব্যক্তিমানুষ থাকেন, নিজস্ব একটা ব্যক্তিতা রক্ষা ক'রে চলেন । পরিবর্তন সব ক্ষেত্রে এক লয়ে ঘটে না - রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, সাংস্কৃতিক জীবন ইত্যাদি ক্ষেত্রভেদে বিভিন্ন লয়ে পরিবর্তন ঘটে । অনেক দ্রুত লয়ের পরিবর্তন রাশীকৃত ফেনার মতো, তার নীচে শক্তপোক্ত পুরোনো কাঠামোগুলো দীর্ঘকাল বহাল তবিয়তে টিঁকে থাকতে পারে । আমার তো মনে হয় নিকট অতীতের বছরগুলিতে কবিতার ভোল যত না পাল্টেছে তার চাইতে বেশী পাল্টেছে সমালোচকদের বুলি ! অরিন্দম তাঁর অল্প বয়সের চেনা জায়গাটা থেকে স্থানচ্যুত হয়ে বোম্বাইতে তথাকথিত `প্রবাসী বাঙালী' হয়ে আছেন ব'লে ইন্টারনেটের বন্ধুরা তাঁর বিশেষ আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছেন । পশ্চিমবঙ্গে থাকলে অনায়াসেই সেখানকার `লিটল ম্যাগ'গুলির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারতেন । আমাদের পরিপার্শ্ব অনবরতই নানা খুঁটিনাটিতে বদলে যায়, তবু তারই মধ্যে কোনো-না-কোনো অবলম্বন জুটে যায়, একটা না হলে আরেকটা, যা আঁকড়ে আমরা বেঁচে থাকি । লাগে প্রয়োজনমতো একগুঁয়েমি বা লক্ষ্যে অবিচল থাকার মতো দৃঢ়তা, আবার একইসঙ্গে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে একটা সমঝোতা, অভিযোজনের বা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা । কখন অবিচল থাকতে হবে, আর কখন নমনীয় বা স্থিতিস্থাপক হতে হবে, সেই ব্যাপারগুলো বুঝে নেওয়া দরকারী । প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকেও বাংলাভাষার লেখিকা হিসেবে আমি যে টিঁকে আছি তা তো ঐভাবেই । দেখে ভালো লাগে যে অরিন্দম তাঁর জন্মের শহর বর্ধমানে তাঁর কবিতার প্রকাশক পেয়ে গেছেন ।
তাঁর মুখবন্ধে অরিন্দম লিখেছেন, "আসলে আমাদের মত লোকেদের কবিতাচর্চার বাপের বাড়ি হল গিয়ে আন্তর্জাল `কেননা তুমি এক নেট-কবি / দিনেরাতে আকছার অজস্র জালিগিরি করে বেঁচে থাকা' ।" এখানে বাহবাযোগ্য শ্লেষ আছে, তবে একটা ব্যাপারে আমার খটকা লাগছে : তিনি কি নিজের কবিতা `পার্থসখা' থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন ? যদি তা-ই ক'রে থাকেন, তবে তাঁর উদ্ধৃতির সঙ্গে বইয়ের ৩৫ পৃষ্ঠায় যা আছে তা কিন্তু ঠিক মিলছে না । সেখানে আছে : `তবুও তুমি এক নেট-কবি, দিনে-রাতে অজস্র জালিগিরি করে মাটি কামড়ে থাকা, সিনাই পর্বতের সেইসব প্রফেসির মত সত্য ।'
কবি হিসেবে অরিন্দমের একটা উল্লেখ্য জোর হলো তাঁর ভাষার দৃশ্যগুণ, বৃহত্তর অর্থে ইন্দ্রিয়ধর্মিতা । এদিক ওদিক এমন অনেক চিত্রকল্প ছড়িয়ে আছে, যা মনে গেঁথে যায়, প্রায় সিনেমাটিক দৃশ্য রচনা করে । প্রথম কবিতার শিরোনামে `মেঘেদের সংসার'-এর ধারণাটাই একটা অণুচিত্র তৈরি করে, তার পর তিনটি স্তবকে সেটি সম্প্রসারিত হয় । প্রথম স্তবকে মেঘেরা তাদের `বৃষ্টিহীন ঘর-সংসার' `সমস্ত উদলা ফেলে' রেখে `রং মেখে' `ব্রিজের দুপাশ ধরে' `কত সাধাসাধি করে'; দ্বিতীয় স্তবকে `হ্যাংলা মেঘের দল' `পাঁচ কা দশ, পাঁচ কা দশ'-এর আবহসংগীতে ব্রিজের এপার আর ওপার থেকে `একে ওকে তাকে' ঘিরে ধরে, - আশা করি ঠিক বুঝেছি, - আর তৃতীয় স্তবকে একটা দ্ব্যর্থক বিশ্রামের ছবি ফুটে ওঠে :
মাংসের ঘুঘনির গন্ধে নাক টানটান,দৃশ্যটা খুবই বাস্তব, কেবলই দৃশ্যগতও নয়, তার মধ্যে ঘুগনির ঘ্রাণ, হাইওয়ের ট্র্যাফিকের গর্জন, মাটির বাসন ভাঙার অনুমিত শব্দ সবই ঢুকে যায়, কিন্তু ধাবায় পাওয়া বিশ্রামটা দ্ব্যর্থক, কেননা `সমস্তই ফাঁকা', রঙিন মেঘগুলো বৃষ্টি দেয় না, আর ভাঙা হাঁড়িগুলো নিষ্কর্মার মতো আমাদের চোখের সামনে প'ড়ে থাকে ।
হাইওয়ের ধারে,
ধাবায় খাটিয়া পেতে রাখা, কিছু মেঘ ওইখানেও যাবে,
দিবসের চতুর্থ প্রহরে, সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি সমস্তই ফাঁকা
মেঘেদের সংসার, ভাঙা হাঁড়িকুড়ি, বৃষ্টিহীন ।
দ্বিতীয় কবিতাটিতেও শিরোনাম (`ঝুনু মাসিমার ট্যাটিং') একটা অণুচিত্রের আভাস দেয়, তার পর ঘটে তার বিস্তার : `ঝুনু-মাসিমার ট্যাটিং-এর লেসের মত,/ সূক্ষ্ম ও গভীর কাজে/ রাত্রির আকাশ ছেয়ে থাকে আজকাল ।' দ্বিতীয় স্তবকে ঘরোয়া উলের বল খুলতে খুলতে এক মহাজাগতিক মাত্রা পায় :
... উল-কাঁটা পড়ে আছে -কবিতার শেষে মানুষে আর প্রকৃতিতে মিলিয়ে একটা পুরো ছবি জেগে ওঠে -
কমলারঙের গোলা ছাড়া পেয়ে দুদ্দাড় দৌড়
হাতা-গলি বড়-রাস্তা-বনোয়ারিতলা
পেরিয়ে সে ন-কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল, ততক্ষণে....
বিছানায় আধশোয়া মাসিমা দিব্যি দেখতে পান,জানালার দিকে তাকিয়ে-থাকা আধশোয়া মহিলার মধ্যে তৈলচিত্রের আভাস আছে, তবে এই ছবি একটু আলাদা, কেননা এই দৃশ্য স্থির নয়, এর মধ্যে সময়ের গতিও ধরানো আছে । কালাতিপাতের সেই ধীরগতি ছন্দকে ফিল্মও বুঝি তেমন নিপুণভাবে দেখাতে পারে না, যেমন পারে কবিতার কয়েকটি লাইন । কবিতার শেষ লাইনের পরে কোনো দাঁড়ি কিন্তু নেই । সেটা কি অভিপ্রেত ? আর `রাত্রির' ঠিক আগে হাইফেনটা কি ড্যাশ্ হবে না ?
সুতো শেষ, তবু তাঁর অবাক ট্যাটিং
থেকে কল্কাদার নকশার খোঁজে জানালায় রাতের আকাশ,
রাত দুটো, রাত তিনটে-রাত্রির [যদ্দৃষ্টম্] নিকষ কালো থান
দুই হাতে টেনে নিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে সব কারুকাজ
আলো-আঁধারির ছবির প্রতি অরিন্দমের একটা পক্ষপাত আছে, যা তাঁর বিষাদের মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে যায় । যেমন দেখতে পাই, `পেরিফেরির বার্চবন' কবিতাটিতে, যেখানে আছে উড়ানের অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত একটি বাঙ্ময় ছবি : `ল্যাণ্ডিং লাইটস্ চোখ মটকায়', বা `ছত্রিশ বছর' কবিতাটিতে, যেখানে `শীতের মেরুর মত ভূতুডে আলোয় টারম্যাক / থমকে আছে', `নিয়ন সাইন জ্বলে-নেভে' । অন্য একটি ছোট্ট কবিতায় পাই এই পক্ষপাতের সারাত্সার : `জ্যোত্স্নার জামদানি বুটিকে এসেছি, / দেখিও না অন্ধকার, এইভাবে ফিরতে পেরে আনন্দিত আমি ।'
তাঁর কবিতার ছবি-ঘেঁষা দিকটা সম্পর্কে অরিন্দম তাঁর ই-মেইলে লিখেছিলেন যে দৃশ্যতা তাঁর কাছে বরাবরই মূল্যান্বিত, কিছু লিখবার আগে তাঁকে দৃশ্যতার দিকটা কল্পনা ক'রে নিতে হয় । এমন কি তিনি অঙ্কের সংখ্যাদেরও মনশ্চক্ষে দেখে থাকেন রঙের সাহায্যে, বিশেষত: গাঢ় বাদামী আর মেটে লালের বিভিন্ন শেডের মাধ্যমে । এ ব্যাপারে তিনি আমার ঈর্ষাভাজন, কেননা আমি অঙ্কের বৃহৎ সংখ্যাগুলিকে কোনোভাবেই মনশ্চক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারি না । হয়তো তাঁর সংবেদনে সিনেস্থেসিয়ার একটা ছোঁয়া আছে ! রঙের রবীন্দ্রনাথ -এর জন্য গবেষণা করার সময়ে সিনেস্থেসিয়া সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করেছিলাম । সুরের সঙ্গে রঙের কোনো সম্পর্ক কি তিনি খুঁজে পান ? `মেঘেদের সংসার' কবিতাটিতে সেই ধারণাটা যেন উঁকি মেরে যায় ।
তাঁর সংগীতচর্চার ছাপও অনিবার্যভাবেই কবিতাগুলিতে ছড়িয়ে আছে । সংগীতপ্রসঙ্গ অবলীলাক্রমে চ'লে আসে, অন্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনায়াসে মিশে যায়, যেমন `ছত্রিশ বছর' কবিতাটিতে মিশে যায় উড়ানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আর কোনো-এক গভীর নিগূঢ় শোকবোধের সঙ্গে, যার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতির জন্য তিনি `আপাত-সুখের' দৃশ্যের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে পারেন না :
... তোমাকেই খুঁজে যাই এখনো টুনটুনি,`টোড়ি' কবিতাটির সমাপ্তি সিনেস্থেটিক জাতের চিত্রকল্প দিয়ে :
টার্মিনাল থেকে টার্মিনালে,
মারোয়া-সন্ধ্যায় কিংবা কানাড়া-গহন মধ্যরাতে ।
ভারতসাগর জুড়ে দুপুরের রোদের সোনাটা,
আঙুরগুচ্ছের মত একজোড়া ঠোঁট নড়ছে ক্রিওলভাষায়
আপাত-সুখের দৃশ্য, তবু
তোমাকে কোথায় খুঁজবো ভেবে বুক চিন্-চিন্ করে ।
ব্যক্তিগত বৃষ্টিপাতে হেঁটে যাচ্ছে একলা রশিদলাইনগুলিতে রঙ, ধ্বনি, আকৃতি আর গতিকে একটা ছোট্ট ফিল্মী শটের ভঙ্গিতে মেলানো হয়েছে ।
বৃষ্টিপাত বৃষ্টিপাত, শাদা নখ ও শুদ্ধ সরগম
ছেড় তোলে । হেঁটে যাচ্ছে মভরঙা ছাতা
একা একা, মিয়াঁকি টোড়ির মত ।
তাঁর আধুনিক-নাগরিক এবং কর্মসংক্রান্ত পরিবেশকে বাহাদুরির সঙ্গে কাজে লাগিয়ে টানটান ভাষায় নানা স্মরণীয় টুকরো তৈরি করেছেন অরিন্দম । কবিতার নামকরণ, প্রথম লাইন নির্মাণ, বা কবিতার সমাপ্তি নির্মাণে তিনি বেশ একটা স্বকীয়তা দেখাতে পারেন । `বেজে যায় হেমন্তের শেষ মোবাইল' একটি কবিতার নাম তথা প্রথম লাইন । `ফেরা' কবিতাটি শেষ হয় এভাবে :
ফিরছি,`ছত্রিশ বছর'-এর সমাপ্তি একইসঙ্গে চিত্রানুগ, স্পর্শনীয়, এবং অন্বেষণে ব্যাকুল :
তবুও রাতের শেষ আন্ধেরি লোকাল,
কবিতা, গরম রুটি,
বল আমি কার কাছে যাব ?
হিমকণা ঝরছে ট্রানজিটে,তাঁর নস্টালজিয়ার বোধকেও অনেকসময় ভালোভাবেই ছুঁতে পারি, যেমন `এ বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিনে', `তোতাপুরী', `খুকির মা', বা `হেঁটে যাওয়া, বাদামতলা ও কালনারোড' কবিতায় । কিন্তু `কালনারোড' ওভাবে জুড়ে দেওয়া কেন, `কালনা রোড' হবে না ? নামপত্রে তাঁর প্রকাশকের ঠিকানায় তো `কালনা রোড'ই আছে ।
তোমাকে খুঁজছি আমি, ডিউটি-ফ্রী ও কাফেটেরিয়া-তে ।
তবে অরিন্দমের সব কবিতাই যে বুঝতে পেরেছি এমন দাবি করছি না । জায়গায় জায়গায় তাঁর বক্তব্য অস্বচ্ছ ঠেকেছে । `কাননবালিকা' আর `পাণিনিয় বিভ্রম' [`পাণিনির বিভ্রম' ? `পাণিনীয় বিভ্রম' ?] কবিতা-দুটি বেশ কয়েকবার প'ড়েও বুঝলাম না ঠিক কী বলতে চাইছেন । বুঝতে হলে তাঁর সঙ্গেই ওয়ার্কশপে বসতে হবে ! `মৈমনসিংহ গীতিকা'র ছোট ছোট কবিতাগুলি আরও উপভোগ করতাম, যদি কাহিনীগুলির সূত্র একটু ধরিয়ে দেওয়া হতো । পাতাগুলোতে যথেষ্ট জায়গা ছিলো, অনায়াসে একটু টীকা দেওয়া যেতো । তাতে আমার মতো পাঠকদের উপকার হতো । `রাত থেকে রাত' সিরিজের প্রথম কবিতার শিরোনাম h5n1 যে বার্ড ফ্লুর সব থেকে খারাপ ভাইরাসের নাম, তা প্রথমে ধরতে পারি নি । এটি এখনও এইচ-আই-ভি-র মতো সকলের মনে প্রোথিত হয় নি, তাই কবিতার নীচে এক লাইনের একটা ছোট্ট নোট দিলে ভালো হতো । জায়গাও ছিলো তার জন্য । নানা কবিতায় যতিচিহ্নের আরেকটু সতর্ক ব্যবহারও বক্তব্যকে স্বচ্ছতর করতো ।
তাঁর ভাষাব্যবহারের কোনো কোনো দিক আমাকে একটু প্রতিহত করেছে । অরিন্দম মধ্যে মধ্যে আকস্মিকভাবে জীবনানন্দীয় সাধু রীতি ব্যবহার ক'রে থাকেন - `যাহা', `তাহার', `তাহাদের', `জোকারদিগের', `আমরাও রেডি রাখিয়াছি' ইত্যাদি । `ভিজিটিং আওয়ার্স'-এ একবার প্রশ্ন করেন : `মনোগামি কোয়ার্ক কণারা, সকলেই কি এক একবার আমাদের ভালবাসিয়াছে ।' লক্ষণীয়, প্রশ্ন করলেও দাঁড়ি ব্যবহার করেছেন । একরকমের বক্র কৌতুক আভাসিত হয়, কিন্তু খেই মেলে না । প্রশ্ন ক'রে জেনেছি যে বক্তব্য থেকে দূরত্ব রচনা করা আর কৃষ্ণ কৌতুকের আভাস দেওয়াই তাঁর লক্ষ্য । তবে জিনিসটা আমার কানে চেষ্টিত ভঙ্গিমার মতো ঠেকে । `মনোগামি' কি ইংরেজী monogamy- র লিপ্যন্তর ? কিন্তু এখানে তো বিশেষণপদের মতো, অর্থাৎ monogamous -এর মতো ব্যবহৃত হয়েছে । তবে কি তিনি `একগামী' বোঝাতে চেয়েছিলেন ? কোয়ার্ক সম্পর্কে অরিন্দমের বিশেষ ঔত্সুক্য আছে ব'লে মনে হয়, দুটি আলাদা কবিতায় উল্লেখ পেয়েছি । ব্যাপারটা বৈজ্ঞানিক, একটা নোট দিলে কবিতাপড়ুয়া অনেকের পক্ষেই ভালো হতো ।
মধ্যে মধ্যে অরিন্দম এমন সব জায়গায় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেন, যেখানে ইংরেজীর কোনো দরকার ছিলো না, অনায়াসে বাংলা শব্দ ব্যবহার করা যেতো, যেমন, `জোকারদিগের বিষাদ-ম্যাট্রিক্স' কবিতায় `কনডেমড বিষাদ-পুরাণ', `পার্থসখা' কবিতায় `মোনোলগ' বা `প্রফেসির মত সত্য', `তোতাপুরী'-তে `সেইসব রিসেসগুলিতে', `উত্পলকুমার'-এ `তিন হাজার বি সি' ইত্যাদি । ঠিক, প্রচুর শিক্ষিত বাঙালী ইংরেজীর দেদার মিশাল দিয়ে বাংলা বলেন, এবং এও ঠিক যে আধুনিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি বোঝাতে ইংরেজী লাগেই, অনেক কিছুর জন্য বাংলা প্রতিশব্দ যে পাওয়া যায় না তা আমরা সবাই জানি । তা ছাড়া অনেক অনেক ইংরেজী শব্দ এখন রীতিমতো বাংলা হয়ে গেছে, তাদের ছাড়া আমাদের চলবেই না । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আবার ইংরেজী শব্দের বহুল ব্যবহার স্রেফ শিথিলতাপ্রসূত । যেখানে দরকার নেই, সেখানে ইংরেজী শব্দ ঢুকিয়ে দিলে কৃত্রিম ঢঙের অভিনয়ের মতো লাগে, - ইংরেজীতে যাকে বলে mannerism তার মতো কানে বাজে । আকাঁড়া ব্যবহার থেকে আমাদের কোনো ভাবগত প্রাপ্তি হয় না । আর পরিণামে এটা হয় যে যখন বিদেশী বুলি থেকে সত্যিই নতুন কিছু পাওয়া যায় - যেমন, `পার্থসখা'য়, `আমাদের পোমো চাই, বলে ক্যাকোফোনি জুড়ে দেয়' বা `পোমো কিরে ব্যাটা, হোমো অবদি জানি, আজকাল ফিলিম হচ্ছে খুব' - তখন সেই কৌতুকরসবাহী প্রয়োগগুলির চমক আর ধার একটু ক'মে যায় । কবিতার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে আরেকটু সতর্ক হতে হয়, নিজের রচনার শিল্পোত্কর্ষের স্বার্থেই আত্মসম্পাদনার প্রয়োজন থাকে । বাংলাভাষা আর কবিতার প্রতি অরিন্দমের দায়বদ্ধতা সুস্পষ্ট ব'লেই প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেলাম । `উত্পলকুমার' কবিতাটিতে `ভগ্নমাস্তুল তরণীর কীল বীম" সম্পর্কে আমার জিজ্ঞাস্য, `কীল' কি ইংরেজী keel , না বাংলা `কীল/কীলক' ? `বীম' নিশ্চয় beam ? প্রয়োজনবোধে একজন কবি তাঁর ভাষায় নতুন শব্দ বানিয়ে নিতেও পারেন । সেটা তো কবিদের একটা ন্যায্য কাজ । তাতে ক'রে ভাষারও সমৃদ্ধিসাধন হয় ।
বিদেশী শব্দ ব্যবহার করলে তার প্রতিবর্ণীকরণও ঠিকঠাক হওয়া দরকার । বিষাদ-দমনকারী Prozac ওষুধটা `প্রোজেইক' হবে না (পৃ: ১৩), তা হলে তো কেউ কেউ তাকে prosaic ভাববেন । একই পৃষ্ঠায় `নন-চ্যালান্ট দিভা' বাংলা কবিতার কতজন পাঠক বুঝবেন জানি না, তবে যা-ই হোক, nonchalant শব্দটা ফরাসী থেকে এসেছে, তাই ch -এর উচ্চারণ চ-এর মতো নয়, শ-এর মতো হবে । অনুরূপ পন্থায় পৃষ্ঠা ১৬-র `শ্যাতু' যদি chateau হয়, তা হলে `শাতো' লিখতে হবে । পৃষ্ঠা ৪০-এ সংগীতস্রষ্টা Chopin -র নামটা শঁপা হবে না, শপাঁ হবে, অর্থাৎ চন্দ্রবিন্দুটা প-এর উপরে বসবে । পৃষ্ঠা ৪১-এ `ওরিয়ন' পাচ্ছি; ইংরেজীতে Orion -এর উচ্চারণ কিন্তু `ওরায়ন' । ওখানে পাশ্চাত্য নামটা ব্যবহার করার দরকার কী ? বাংলায় `কালপুরুষ' লিখলেই তো ঝামেলা চুকে যায়; একটা অতিরিক্ত অনুপ্রাসও পাওয়া যায় - `কারণ সে কালপুরুষ কম্র আকাশের/ নীলদ্যুতি শূন্যতায় সুখী থাকা জানে' ইত্যাদি । বাংলাভাষার কবিরা কবিতা লেখার ওয়ার্কশপ কতদূর করেন, বা আদৌ করেন কিনা তা জানি না, তবে কবি যদি শুধু নিজের অহংবোধকে প্রকাশ ক'রেই সন্তুষ্ট না হন, যদি তিনি কম্যুনিকেটও করতে চান, অর্থাৎ অন্যদের কাছে পৌঁছতে চান, তা হলে দক্ষতার একটা পর্যায়ে পৌঁছনোর পর ওয়ার্কশপের অভিজ্ঞতা কিন্তু সত্যিই কাজে লাগে, তার সাহায্যে ভাষার অনেক শিথিলতা এড়ানো যায়, নানান খুঁটিনাটি ঋজু বা চোস্ত ক'রে নেওয়া যায় । অরিন্দম নিশ্চয়ই এই কথাটা মানবেন যে কবিতার ভাষারও একটা এঞ্জিনীয়রিঙের দিক বা ঠিকঠাক নাট-বোল্টু ব্যবহারের দিক আছে । তিনি যদি কোনো কর্মশালায় `কাননবালিকা' কবিতাটি পড়তেন, তা হলে আমি তাঁকে অনেক প্রশ্ন করতাম ! আমার ধারণা কর্মশালার ফীডব্যাক পেলে তিনি কবিতাটিকে এমনভাবে সাজাতে পারতেন, যাতে সেটির দুর্বোধ্যতা কেটে যেতো । এখানে ঐ প্রসঙ্গে একটিমাত্র প্রশ্ন ছুঁড়ি : কবিতাটির শেষ লাইনে `অবসিতে গীতে' বাক্যাংশটির তাত্পর্য কী ? `অবসিতে' কি মাইকেলী নামধাতু, না কি শব্দ-দুটি সংস্কৃত ব্যাকরণের `ভাবে সপ্তমী'র নিদর্শন ?
ভাষার নাট-বোল্টু ব্যবহারের শেষ পর্ব হলো নির্ভুল মুদ্রণ । প্রকাশিত বইয়ের মুদ্রণপারিপাট্যের পেশাদারী দায়িত্ব অবশ্যই প্রকাশকের, কিন্তু ভুলচুকের ছায়াটা শেষমেশ তাড়না করে বেচারী লেখকের টেক্সটকে । আজকাল নতুন প্রযুক্তির সুযোগে কোনো কপি-এডিটিং বা প্রুফ সংশোধন ছাড়াই বই ছাপা হচ্ছে । এতে প্রকাশকদের এবং মুদ্রকদের হয়তো `আপাত-লাভ', কিন্তু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন লেখকদের যথেষ্ট ক্ষতি । অরিন্দমের বইটিতে ছাপার ভুল বেশ কিছু র'য়ে গেছে - হ্রস্ব উ-কার আর দীর্ঘ ঊ-কারের, বা `ন' আর `ণ'-এর গণ্ডগোল থেকে শুরু ক'রে সমাসবদ্ধ শব্দের ভগ্নদশা বা দুটো আলাদা শব্দের পরস্পরে আটকে যাওয়া পর্যন্ত । এই জিনিসগুলি আজকাল বাংলা মুদ্রণের ত্রক্রনিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে । বইয়ের নামপত্রে যদি `কালনা রোড' থাকে, তবে সেই একই রাস্তাটা বইয়ের ভিতরে কিভাবে `কালনারোড' হয়ে যায় ? একই পাতায় কী ক'রে হয় `কাননবালিকা' এবং `কানন বালিকা' ? কবিতার প্রথম লাইনে আছে `ঝুনু-মাসিমা', কিন্তু শিরোনামে হাইফেন খ'সে গেছে; এই কবিতাটির শেষ স্তবকে একটি হাইফেন আছে, যেটি সম্ভবত: ড্যাশ্ হবে - আগেই সে-কথা উল্লেখ করেছি । মুখবন্ধে `মৈমনসিংহ-গীতিকা'র কথা আছে, কিন্তু কবিতাটিতে এসে শিরোনামে হাইফেন উধাও হয়ে গেছে । কবিতার ভিতরে আছে `আপাত-সুখের দৃশ্য', কিন্তু বইয়ের প্রচ্ছদে এবং নামপত্রে সেই একই বাক্যাংশ হাইফেনটি আলগোছে ফেলে দিয়ে হয়ে গেছে `আপাত সুখের দৃশ্য' । মার্জিন থেকে মার্জিনে ঠাসা গদ্যের বইয়ে নয়, একটা ছিপছিপে কবিতার বইয়ে `জ্ঞাপণ' (মুখবন্ধ), `শোষন' (পৃ: ২০), `মরুদ্যান' এবং `মরুত্পল' (পৃ: ৪৪), `ঝলসায়'-এর বদলে `ঝালসায়' (পৃ: ২৬), বা `ফেরার'-র জায়গায় `ফরার' (পৃ: ৩৭) কী ক'রে কোনো প্রুফ-রীডারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় ? আমার সন্দেহ, কেউ প্রুফ দেখেনই নি ।
কিন্তু অধুনা আমরা আরেক ধাঁচের গণ্ডগোলের দেখা পাচ্ছি, যেগুলির উত্স সাম্প্রতিক বাংলা সংস্কৃতির হালভাঙা পালছেঁড়া পোস্টমডার্ন নৈরাজ্য । দন্ত্য ন-এর সঙ্গে ড-এর যুক্ত অবস্থা বোঝাতে ফন্টে `ন্ড' উদ্ভাবিত হয়েছে । ফলে এই বইয়ের পৃ: ৩৭-এ আমরা পাই `হিরণ্যগর্ভের আণ্ডা', `স্বর্ণ-অন্ড', এবং `হিরণ্যগর্ভের আন্ডা'র বিচিত্র সহাবস্থান ! `আণ্ডা' তদ্ভব শব্দ হলেও `অণ্ড' পুরোপুরি তত্সম, সুতরাং `স্বর্ণ-অন্ড' যে-কোনো বিচারেই অশুদ্ধ, ওখানে দন্ত্য ন হতে পারে না । পৃ: ১৯-এর `পাণিনিয়' অশুদ্ধ, পাণিনি + ঈয় হবে `পাণিনীয়' । সন্দেহ থাকলে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের অভিধানের দ্বিতীয় খণ্ড দেখে নিন । সমগ্র ইন্দো-ইয়োরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম প্রকৃত ব্যাকরণরচয়িতা, সেই স্বনামধন্য পাণিনির নামটা দেখার পরও কোনো প্রুফ-রীডারের চেতনা হয় নি ? আমি বিস্মিত । বিমানের উড়ানে কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী যদি এভাবে ঘুমিয়ে পড়েন, তা হলে সর্বনাশ ঘটে । আমাদের লেখালেখির জগতে আমরা শুধু হোঁচট খাই, এবড়োখেবড়ো জমিটাকে অভিশাপ দিই, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে চলি । কবে আমাদের জগতে আরেকটু পেশাদারী দৃষ্টিভঙ্গি আসবে ? পৃ: ৩৮ এবং পৃ: ৪০-এ রয়েছে যথাক্রমে `শুধু তোমারি তিরে বিদ্ধ এক হৃদয়ের জন্য' এবং `জ্যা-মুক্ত তিরের মত নেকড়েটি' । দেখে রীতিমতো শারীরিক অস্বস্তি হয়েছিলো । এ ব্যাপারে অরিন্দমকে প্রশ্ন করেছিলাম । তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর অভিধানে দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে `তীর'কে `তির'-এর `অসঙ্গত বানানভেদ' বলা হয়েছে । জেনে শারীরিক অস্বস্তির সঙ্গে মানসিক যন্ত্রণা যুক্ত হয়েছিলো । `ভোল' কি এতই পাল্টেছে ? আমার কাছে ছোট-বড়-মাঝারি গোটা-পাঁচেক বাংলা অভিধান আছে, - প্রত্যেকটাই নামজাদা নমস্য পণ্ডিতের করা সংকলন, - এবং কোনোটাতেই `তির'-এর কোনো অস্তিত্ব নেই । আশৈশব `তীর' আর `তীরন্দাজ' বানান দেখে আসছি এবং লিখে আসছি । যতদূর জানি, বাংলা বানান থিতু হবার পর থেকে এভাবেই লেখা হচ্ছে । বাণ অর্থে `তীর' শব্দটিকে মনিয়ের-উইলিয়ম্সের সংস্কৃত অভিধানেও স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, প্রয়োজনীয় উত্সনির্দেশ এবং তুলনীয় ফার্সী শব্দটির দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ-সহ । অর্থাৎ এটিকে আমরা তত্সম শব্দ হিসেবেই নিতে পারি । একে হঠাৎ `অসঙ্গত' ঘোষণা করবার অধিকার কোনো গিলোটিন-আসক্ত ভাষা-সংস্কার আন্দোলনের নেই । সাহিত্যজগতে এই মূল-উত্পাটনকারী ধ্বংসাত্মক `মৌলবাদ' অসহ্য । ফার্সী ইন্দো-ইয়োরোপীয় গোষ্ঠীরই ভাষা, এবং পারিবারিক বিচারে ফার্সীর অনেক শব্দই আমাদের তুলনীয় শব্দগুলির আত্মীয় । ভাষাদের স্বাভাবিক বিবর্তনের পথে অর্থের সঙ্গে লিপির চিত্রধর্মের একটা অন্তরঙ্গ কানাকানি গ'ড়ে ওঠে; সেটাই গ্রাফিক শিল্পের প্রাণ, এবং সেই নকশা ধ'রে ধ'রে শৈশবে আমরা বানান শিখি, সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন শব্দদের মধ্যে সম্পর্কগুলি বুঝে নিই । সেই স্বাভাবিক আত্মীয়তাকে বিনষ্ট করা, শব্দদের শরীর থেকে তাদের ব্যুত্পত্তির চিহ্ন উড়িয়ে দেওয়া - এগুলি সুবিবেচনার কাজ নয় । আমরা জানি যে `তির্তির্ ঝির্ঝির্' ক'রে ক্ষীণধারায় জল পড়তে পারে, কিন্তু তীর জিনিসটার ধর্ম হলো তীব্রতা, তার জানান দিতে স্বরের দীর্ঘতাই উপযুক্ততর । এই সহজবোধ্য গ্রাফিক সাংকেতিকতাকে ধ্বস্ত করা মূঢ়তা । আর যদি `তীর' লিখি, তা হলে অপ্রতিরোধ্য লিপিগত লজিকে `তীরন্দাজ'ই লিখবো, `তিরন্দাজ' লিখবো না । একটা শব্দ বিদেশী উত্সের হলেই তা থেকে দীর্ঘ ঈ বাদ দিতে হবে, এমন যুক্তিবর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্রয় দিলে বাংলা বানান থেকে স্বজ্ঞা-সংলগ্ন চিত্রশ্রী ত্রক্রমশ: লোপ পেয়ে যাবে । যুক্তি হিসেবে ওটা প্রায় বর্ণবাদীদের যুক্তির সগোত্র । বিদেশী শব্দ কি তেমন কোনো যবন, যার স্পর্শে দীর্ঘ ঈ-র ব্রাহ্মণোচিত আভিজাত্য কলুষিত হয়ে যাবে ? পৃ: ৪০-এ অরিন্দম `স্লিট' শব্দটি ব্যবহার করেছেন - `গত রাতের বৃষ্টি ও তুষারপাত, / জমা-জল ও স্লিট গ্রাহ্যই করেনা' । `করেনা' `করে না' হওয়া উচিত, আর কনটেক্সট থেকে মনে হয় তিনি ব্যবহার করতে চেয়েছেন ইংরেজী sleet শব্দটি । যা বাঙালীদের গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের প্রকৃতিতে নেই, তার জন্য শব্দও গ'ড়ে ওঠে নি, তাই বিদেশের প্রকৃতির বর্ণনায় মধ্যে মধ্যে নতুন শব্দ আমদানি করতেই হবে, কিন্তু তাদের বানানে কী দীর্ঘ স্বরকে নিয়ম ক'রে বাদ দিতে হবে ? যেখানে আমাদের ভাষায় স্রোতের মতো ইংরেজী শব্দ ঢুকছে, আমরা অনবরত ইংরেজী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, তা থেকে প্রতিবর্ণীকরণ করছি, উদ্ধৃতি দিচ্ছি, সেখানে আমরা কি slit আর sleet , shit আর sheet ংঋ, sip আর seep , ship আর sheep , dip আর deep , lip আর leap , hip আর heap -এর মধ্যে পার্থক্য রাখবো না ? তা হলে সে তো নিজেদের পায়েই কুড়ুল মারা হবে, আর আমাদের নানাকর্মপটীয়সী লিপির বিদগ্ধ সৌন্দর্যের দিকে জুতো নিক্ষেপ করা হবে । ইংরেজীতে এরকম বিস্তর শব্দের জোড় আছে, যেগুলো আমরা হরদম ব্যবহার ক'রে থাকি, যেখানে হ্রস্ব-দীর্ঘ স্বরভেদে অর্থে আকাশপাতাল পার্থক্য এসে যায়, উচ্চারণে সেই ভেদকে মান্যতা দিতেই হয় । বাংলা হরফে সেগুলো লেখার প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের ন্যায্য প্রতিবর্ণীকরণ কিভাবে করা হবে ? অবিবেচক অতিসরলীকরণকে প্রশ্রয় দিলে আখেরে কি আমাদের ভাষারই ক্ষতি হবে না ? আমি তো মনে করি লিপির প্রকাশক্ষমতাকে সংকুচিত ক'রে ফেলা কখনো ঠিক নয়, বরং তাকে বাড়ানো ভালো । প্রযুক্তির দৌলতে যেটুকু বা আমরা এগোচ্ছি, অপরিণামদর্শিতা এবং অবহেলাজনিত শৈথিল্যের ফলে আবার ততটুকু পিছিয়ে যাচ্ছি যেন ।
তবে ঐসব প্রসঙ্গে আমার ক্ষোভ যেমনই হোক, এই আলোচনা নঞর্থক সুরে শেষ করতে চাই না । অরিন্দমের বইটিতে বিষাদের একটা বাতাবরণ থাকলেও তিনি জানেন (পৃ: ৩০) -
(পরবাস-৪৩, জুলাই, ২০০৯)
রৌদ্র থাক, জীবন তুমিই এসো ।
তাঁর লেখায় যথেষ্ট ক্ষমতা, যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি বর্তমান । বিষাদ দ্বারা ধ্বস্ত বোধ না ক'রে তিনি যেন মনে রাখেন যে লেখা এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে ভাবনাবিনিময় এক চমত্কার থেরাপি । জীবনে তাঁর নিশ্চয়ই কিছু প্রকৃত প্রাপ্তি ঘটেছে । যা-কিছু তিনি পেয়েছেন, যা-কিছু তাঁর এখনকার সৌভাগ্যের অন্তর্গত, সেগুলির মূল্য নিশ্চয় কম নয় । পারিবারিক শান্তি, সন্তানবাত্সল্যের স্নিগ্ধতাও তাদের মধ্যে পড়ে, এবং বড় বড় শিল্পীরাও সেইসব অভিজ্ঞতাকে স্বীকৃতি ও মান্যতা দিয়েছেন । জীবনের সেই আশীর্বাদগুলির উপর ফোকস্ করলে, প্রসন্ন মনে তাদের গ্রহণ করলে, তাদের থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করা সম্ভব । তখন তাঁর ভিতর থেকে এমন কবিতাও উত্সারিত হতে পারে, যেখানে আনন্দের দৃশ্যও আছে ।
অন্ধরাও জানে হাতের একটি পাখি ভালো,
ঝোপের ঝাঁকের চেয়ে ।